৮.
বিবেচনা করি এই শীতকালেও বহু শত বাঙালি দিল্লি আসিবেন। যাহারা নিছক পারমিটের জন্য এখানে আসিবেন ভগবান তাহাদিগকে মঙ্গল করুন। আমাদের সঙ্গে তাঁহাদিগের কোনওপ্রকারের যোগাযোগের আশঙ্কা নাই।
কিন্তু যাহারা নিতান্ত মহানগরী দিল্লি দেখিবার জন্যই আগমন করিবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কদলী বিক্রয় করিবার দুষ্টবুদ্ধি যাহাদের নাই তাহাদের উদ্দেশে দুই-একটি নিবেদন আছে।
প্রথমত পাড়ার পাঁচজনের কাছে বড়াই করিবার জন্য অনর্থক পঞ্চাশটা কবর মসজিদ দুর্গ মন্দির দেখিয়া কোনও লাভ নাই। সবকিছু আখেরে ঘুলাইয়া যাইবে– লোদিদের বাগানে কুতুবমিনার চাপাইয়া বসিবেন, লালকিল্লার মাঝখানে শের শাহের মসজিদ দেখিয়া কী আনন্দ লাভ করিয়াছিলেন তাহার স্বপ্ন দেখিবেন, বিড়লা মন্দিরের সঙ্গে কুতুবের যোগমায়া মন্দির মিশাইয়া লইয়া অতিশয় অদ্ভুত স্থাপত্য নির্মাণ করিয়া বসিবেন। অতএব নিবেদন, অল্প দেখিবেন কিন্তু অতি উত্তমরূপে দেখিবেন। একটি ক্যামেরা– তা সে বক্স কিংবা বেবিই হউক– সঙ্গে আনিবেন এবং যদিও ভালো ভালো দালান ইমারতের উত্তম উত্তম ফটো সর্বত্রই কিনিতে পাওয়া যায় তবুও আপন রুচি অনুযায়ী ছবি তোলাতে যে বিশেষ আনন্দ আছে, সেই তত্ত্ব সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইবেন।
দ্বিতীয়ত ভারতের একখানা ইতিহাস সঙ্গে আনিবেন।
ভালো বায়োস্কোপ দেখিবার পর হৃদয়ে স্বতই বাসনা জাগে পুস্তকখানি পড়িবার। ঐতিহাসিক স্থাপত্য দর্শনের পর ওই একই অভিলাষ জন্মে। যখন শুনিবেন, এই ত্রিপোলিয়া তোরণের উপরেই বাদশা ফররুখসিয়ার তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী জাহানদার শাহকে বন্দি করিয়া প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন এবং আট বৎসর যাইতে না যাইতেই সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় সেই ফররুখসিয়ারকে অন্ধ করিয়া ওই ত্রিপোলিয়া তোরণের উপরেই বন্দি করেন ও পরে তাহাদের আদেশেই তিন নরপিশাচ তাহাকে ঠগীদের পদ্ধতিতে ফাঁসি লাগাইয়া খুন করে, তখন আপনার মনে কৌতূহলের সঞ্চার হইবে তাবৎ ইতিহাস অদ্যোপান্ত পাঠ করিবার। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন গাইড মাত্রই বিশুদ্ধ গঞ্জিকা না হউক কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জনের পক্ষপাতী। গাইড হিসাবে আমারও ন্যূনাধিক সে দুর্বলতা আছে; কিন্তু ইতিহাসের অত্যাচারে সেই দুর্বলতা সম্যক প্রস্ফুটিত হইবার অবকাশ পায় না।
তৃতীয় স্থাপত্য দর্শনকর্ম আরম্ভ করার পূর্বেই স্মরণ রাখিবেন দিল্লিতে হিন্দু স্থাপত্যের বিশেষ কিছু নাই। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিস্তর পরিশ্রম করিয়াও দিল্লিতে প্রাক কুশান যুগের কোনও কিছু আবিষ্কার করিতে সক্ষম হন নাই। অতএব হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ জাতীয় কোনও বস্তু দেখিবার আশা পোষণ না করাই প্রশস্ততর।
একেবারে যে কিছুই নাই তাহাও নয়। কুতুবমিনারের কাছেই রাজা চন্দ্রের(এই চন্দ্রটি কে তাহা ঐতিহাসিকেরা এখনও বলিতে পারেন না।) একটি মনোহর লৌহস্তম্ভ আছে; ফিরোজ তুগলুক নির্মিত ফিরোজ শাহ কোটলাতে একটি অশোক স্তম্ভ এবং উত্তর দিল্লিতে আর একটি; গিয়াসউদ্দিন তুগলুক নির্মিত তুগলুকাবাদের প্রায় ক্রোশ পরিমাণ দূরে সূর্যকুণ্ড (এই কুণ্ডটি সত্যই হিন্দু না মুসলমান সে বিষয়ে মুনিদের ভিতর এখনও মতভেদ আছে), এবং কুতুবমিনারের কাছে যে কুওওৎ উল-ইসলাম মসজিদ আছে তাহার স্তম্ভগুলি– এই স্তম্ভগুলি হিন্দু এবং বৌদ্ধ মন্দির হইতে নেওয়া হইয়াছিল এই বিষয়ে সন্দেহ নাই।
***
সংবাদ শুনিলাম, যে স্থলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেই স্থলে রাষ্ট্রপতি বৌদ্ধ শাস্ত্র ও পালি ভাষার চর্চার নিমিত্ত এক প্রতিষ্ঠানের দ্বারোদঘাটন করিয়াছেন। ক্রমে ক্রমে সেখানে নাকি তিব্বত, চীন, বর্মা, শ্যাম এবং সিংহলের ভাষা শিখাইবার ব্যবস্থা করা হইবে।
সংস্কৃতের কোনও উল্লেখ নাই!
হায়, আমি মূর্খ, আমার ধারণা ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বৌদ্ধধর্ম ও শাস্ত্রচর্চা হইত তাহা মহাযান বৌদ্ধধর্মের এবং মহাযানের অধিকাংশ এবং হীনযানের বহুলাংশ শাস্ত্র পালিতে নয়, সংস্কৃতে লিখিত। আমি মূর্খ, আমি তো জানিতাম, হিউয়েং সাঙ এই মহাযান শাস্ত্রই সংস্কৃতের মাধ্যমে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। আমি নিতান্ত জড়ভরত, আমি তো জানিতাম নালন্দাতে শিক্ষাদান প্রদানের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। আমি অতিশয় নির্বোধ, আমার কুসংস্কার ছিল সংস্কৃতের সাহায্য ভিন্ন বৌদ্ধধর্মের উচ্চতম বিকাশ, অর্থাৎ বৌদ্ধদর্শন ও তর্ক কণামাত্র আয়ত্ত করা যায় না।
কিন্তু সার্থক জনম আমার জনেছি এই দেশে। নবনির্মিত সংস্কৃত বিবর্জিত নালন্দার নব-বিদ্যায়তনের মোহমুদার আমার মোহ চূর্ণ চূর্ণ করিল, সদগুরুর ন্যায় অজ্ঞান তিমির অন্ধকারে জ্ঞানাঞ্জন শলাকার ন্যায় চক্ষু উন্মীলন করিয়া দিল।
এখন শুনিব, গ্রিক ভাষা শিখা থাকিলেই ইয়োরোপীয়ন দর্শন করায়ত্ত হয়। ফরাসি জর্মন (কিংবা কেবল মাত্র ইংরেজির মাধ্যমে) শিখিয়া দেকার্ত, কান্ট, হেগেল পড়িবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। প্লাতো, এরিসততেল অধ্যয়ন করা থাকিলেই তাবৎ ইয়োরোপীয় দর্শন হস্ততলগত।
***
কোন রাজাকে নাকি এক বুদ্ধিমান বিশেষ একপ্রস্থ পোশাক নির্মাণ করিয়া দিয়াছিল। সে পোশাক নাকি অসাধু জনের চক্ষুগোচর হইত না। রাজা একদিন সেই পোশাক পরিধান করিয়া শোভাযাত্রায় বাহির হইলে পাত্র অমাত্য অসাধুরূপে সন্দিহান হইবার ভয়ে করতালি ধ্বনি করতঃ পোশাকের ভূয়সী প্রশংসা করিলেন।
হঠাৎ একটি ক্ষুদ্র বালক চিৎকার করিয়া বলিল, কিন্তু পোশাক কোথায়, মহারাজ তো কিছুই পরেন নাই।
চীন হইতে প্রত্যাগত ভারতীয় অমাত্য ও অন্যান্য গুণীজন বারম্বার চিৎকার করিয়া বলিতেছেন চীন দেশ কম্যুনিস্ট নয়। ইঁহাদের কোনও অসাধু অভিসন্ধি নাই সে সম্বন্ধে আমি স্থিরনিশ্চয়, কিন্তু আমি প্রত্যাশা করিতেছি সেই বালকের। কখন না চিৎকার করিয়া বলে চীন তো কম্যুনিস্ট এবং সঙ্গে সঙ্গে সকলের সুখস্বপ্ন ভঙ্গ হয়।
***
আমি এই তত্ত্বটি এখনও হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলাম না। ইংরেজ যখন বলে জানো, লোকটি ভারতীয়, কিন্তু একদম আমাদের মতো; ভারতীয়দের সঙ্গে তাহার কোনও সামঞ্জস্য নাই কিংবা যখন কোনও বাঙালি বলে জানো, লোকটা আসলে ছাতুশোর কিন্তু আচার ব্যবহারে ঠিক বাঙালির মতো, তখন আমি আশ্চর্য হই। ছাতুষোর থাকিয়াও কি বাঙালির প্রশংসা অর্জন করতে পারে না?
অর্থাৎ চীনকে কম্যুনিস্টরূপে স্বীকার করিয়াও কি তাহার প্রশংসা করা যায় না কিংবা তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় না? তারস্বরে চিৎকার করিয়া বলিতে হইবে চীন কম্যুনিস্ট নয়, সে আমাদের মতো তবেই বন্ধুত্ব সম্ভবে? এবং চীন কি আমাদের এই চিৎকার শুনিয়া উল্লসিত হইবে?।
ইংরেজ যখন বলে এই ভারতীয় মোটেই ভারতীয়ের মতো নয়, একদম আমাদের মতো তখন কি আমরা উল্লাস বোধ করি?
***
মনু-নিষিদ্ধ পক্ষী ভক্ষণকরতঃ হিন্দু-সন্তান ইহলোক-পরলোক নষ্ট করুক এ অভিসন্ধি আমি কিছুতেই করিতে পারি না; তৎপূর্বে যেন আমার মস্তকে বজ্রাঘাত হয়।
কিন্তু আমার বহু পারসিক, মুসলমান, খ্রিস্টানি বন্ধু আছেন, তাঁহাদের কল্যাণার্থে নিবেদন করি তাহারা যদি কখনও দিল্লি আসেন তবে যেন একবার আফগানি নান (তন্দুরপকু রুটিবিশেষ) এবং তন্দুরি মুর্গি ভক্ষণ করিয়া দেহলি বাস সার্থক করেন।
এই দুই বস্তু বস্তুত গান্ধার দেশীয় অর্থাৎ পেশাওয়ার হইতে কাবুল পর্যন্ত এই দুই বস্তু সানন্দে ভক্ষণ করা হয়। কিন্তু বিচলিত হইবেন না, ইহাদিগকে ভক্ষণ করিবার জন্য পাঠান। দন্ত কিংবা উদরের প্রয়োজন নাই। ঈষৎ অবান্তর, তবুও নিবেদন করি পাঠানের দন্ত বাঙালি অপেক্ষা বহু নিকৃষ্ট। বড়ই কোমল জিনিস এবং তন্দুরের অভ্যন্তরে সুপক্ক করা হয় বলিয়া সর্বাঙ্গসুন্দর মাধুর্য ধারণ করে। গান্ধার দেশে লঙ্কার প্রচলন সংকীর্ণ বলিয়া তন্দুরিতে কোনওপ্রকারের তীব্র আস্বাদ নাই।
একদা এই দুই বস্তু দেহলি প্রান্তে প্রচলিত ছিল না। দেশবিভক্তির ফলে এক পেশাওয়ারি শিখ মহোদয় এই দুই মহাশয়কে দিল্লিতে প্রচলন করিয়াছেন। ভগবান তাহার মঙ্গল করুন।
কিন্তু সাধু ভক্ষক, সাবধান। মস্তক কর্তন করিবার ভীতি প্রদর্শন করিলেও তন্দুরি ছুরি কাঁটা দিয়া খাইবে না। উভয় হস্ত সঞ্চালন দ্বারা তন্দুরিকে খণ্ড বিখণ্ড করতঃ সোল্লাসে সশব্দে হোটেল রেস্তোরাঁ সচকিত করিয়া নির্লজ্জভাবে কড়কড়ায়েত মড়মড়ায়েত করিবে। যদি সাহস না থাকে আমাকে নিমন্ত্রণ করিও।
***
স্বর্গীয় পরিমল রায়ের শোকসন্তপ্ত বন্ধুবর্গ এই সংবাদ শুনিয়া কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা পাইবেন।
ইউ.এন.ও. রায়ের বিধবাকে সারাজীবনের জন্য মাসিক চারি শত টাকার ভাতা এবং তদুপরি রায়ের পুত্র ও কন্যার শিক্ষাব্যয় আপন স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছেন!
ইউ.এন.ও.-র জয় হউক।