রায় পিথৌরার কলমে – ৭

৭.

শেক্সপিয়র বলিয়াছেন, এই সত্য জানাইবার জন্য ভূতের কী প্রয়োজন ছিল, মহারাজ ড. শাখট যে অতিশয় গুণী লোককে সেকথা জানাইবার জন্য রায় পিথৌরারও প্রয়োজন নাই।

কিন্তু আশ্চর্য হইলাম লোকটির অসাধারণ অধ্যবসায়, সহিষ্ণুতা এবং সদাজাগ্রত তীক্ষ্ণতা লক্ষ করিয়া উদয়াস্ত নানাপ্রকারের লোকের সঙ্গে নানাবিধ আলোচনার পর সামান্য মানুষ অপরাকের দিকে তৈলহীন প্রদীপের ন্যায় নির্জীব হইয়া পড়ে। তখন সে জিজ্ঞাসুর প্রশ্ন শুনিতে পায় না, শুনিলেও বিষয়বস্তুটি সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিয়া সদুত্তর দিবার জন্য চেষ্টিত হয় না।

এবং আমরা যে কয়টি প্রাণী তাহার চতুর্দিকে সমবেত হইয়াছিলাম, তাহাদিগের প্রত্যেককে অর্থনীতি ক্ষেত্রে অপোগও শিশু বলিলে কিছুমাত্র সত্যের অপলাপ হয় না। অথচ কী অদ্ভুত ধৈর্য ও মনোনিবেশ সহকারে আমাদের প্রত্যেকটি প্রশ্ন সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া লইয়া সোসাহে উত্তর দিতে লাগিলেন। কণ্ঠে বর্ণনামাত্র ক্লান্তি নাই, বচনভঙ্গিতে বিন্দুমাত্র ক্লৈব্য নাই।

এই বিশাল সংসারে অরসিক জনের অভাব নেই। তাঁহাদের একজন ড. শাখটের স্বন্ধে জর্মনির পুনরায় সশস্ত্রীকরণের দায়িত্ব চাপাইবার চেষ্টা করিলেন। ড. শাখট তাহার কী উত্তর দিলেন, সেই কথার পুনরুল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। যে বিরাট আট ভলুমে নুরেনবের্গ মোকদ্দমার দলিল দস্তাবেজ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতেই জ্ঞানী পাঠক এই ব্যাপারে তাবৎ বর্ণনা পাইবেন।

আমার ইচ্ছা হইতেছিল হঠাৎ অট্টহাস্য করিবার। যে মার্কিন, ফরাসি, ইংরেজ রুশের প্রতিভূ শাণিতবুদ্ধি উকিলগণ শাখকে নুরেনবের্গে কণামাত্র বিচলিত করিতে পারেন নাই, অবশ্যম্ভাবী আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ যুক্তি এবং অকাট্য প্রমাণ দ্বারা পদে পদে বিপক্ষকে নিদারুণ বিড়ম্বিত করিলেন, তাঁহাকে তর্কে পরাস্ত করিবার আকাক্ষা পঙ্গুর গিরিলজ্ঞান, বামনের শশাঙ্ক-করতলকরণ ইত্যাদি যাবতীয় তুলনাকে হাস্যাস্পদ করিয়া ফেলে।

বুদ্ধিমানের সংখ্যা ইতরজনের তুলনায় কম হইলেও সেই সভাতে তাহাদের অনটন ছিল না। সহসা তাঁহারাই একজন উচ্চকণ্ঠে বলিলেন।

শবব্যবচ্ছেদ কর্মে কী মোক্ষলাভ? ভারতবর্ষ দরিদ্র দেশ; তাহার সম্মুখে লক্ষ লক্ষ সমস্যা। বরঞ্চ যদি শাখট মহাশয় সেইসব ব্যাপারে আমাদিগকে জ্ঞানদান করেন, তবেই আমাদের সার্থক উপকার হয়।

সোল্লাসে সকলেই সম্মতি জানাইলাম।

পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিল। শাখট বলিলেন, আমি পরিকল্পনাটি পড়িবার জন্য সময় করিয়া উঠিতে পারি নাই। আগামীকল্য কাশ্মিরের পথে পাঠ করিবার বাসনা রাখি। কিন্তু কী প্রয়োজন এইসব বিশাল কলেবর পরিকল্পনা করিবার? তাহা হইতে অনেক শ্রেয়ঃ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ আরম্ভ করিয়া দিবার এবং আমার বিশ্বাস সেইসব কর্মই সর্বপ্রথম আরম্ভ করিয়া দেওয়া উচিত, যাহাতে বিপুল বিত্তের প্রয়োজন হয় না এবং যে স্থলে এক, দুই কিংবা তিন বৎসরের ভিতরই ব্যয়িত অর্থ সুফল প্রদান করিয়া হস্তে পুনরাগমন করিতে থাকে। তাহাতে রাজকোষের অর্থ সঞ্চয় হইবে, সেই অর্থ তৎক্ষণাৎ অন্য কর্মে নিয়োজিত করিয়া দেশ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইবে। জনগণের মনে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা দৃঢ়তর হইবে এবং এই পন্থাতেই আশু সুফল লাভের সম্ভাবনা।

ভারতবর্ষে বহু বিত্ত সঞ্চিত আছে, সেকথা কাহারও অজ্ঞাত নয়। এই অর্থ প্রধানত যুদ্ধের সময় উপার্জিত হয় ও বণিকগণ সে বিত্তের রাজকর বা ইনকামট্যাক্স দেন নাই বলিয়া এক্ষণে সে অর্থ কোনওপ্রকারের পরিকল্পনায় নিয়োজিত করিতে পারিতেছেন না। রাষ্ট্র শ্যেন দৃষ্টিতে বিত্তশালীদের প্রতি কর্ম পর্যবেক্ষণ করিতেছেন এবং আপনার ন্যায্য রাজকর উদ্ধারের জন্য সর্বস্ব পণ করিয়া বসিয়াছেন এবং ধনিকগণও রাজদ্বারে দণ্ডিত হইবার ভয়ে সেই অর্থ গোপন রাখিতেছেন।

ড. শাখটের বিশ্বাস, দেশের উন্নতির জন্য যখন এই অর্থের একান্ত প্রয়োজন এবং অন্য কোনও সূত্র হইতে কোনওপ্রকারের অর্থ লাভের আশাও নাই, তখন অতীতে কে কোন উপায়ে বিত্তশালী হইয়াছে, তাহার আলোচনা না করিয়া এবং ধনিকগণকে লাভের প্রলোভন দেখাইয়া অর্থ বাহির করিয়া দেশ নির্মাণকর্মে নিয়োজিত করাই ভারতের পক্ষে প্রশস্ততম পন্থা।

ড. শাখৎ পুনঃপুন বলিলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, যখন একথা স্থিরনিশ্চিয় হইয়া গিয়াছে। যে দেশ-নির্মাণকর্ম আরম্ভ করিতেই হইবে, তখন আর এ প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর অর্থ কোথা হইতে আসিবে। যেকোনো কৌশলেই হউক অর্থ একত্র করিতে হইবে এং কর্ম আরম্ভ করিয়া দিতেই হইবে।

আমি ভাবিয়াছিলাম, ডা. শাখট অর্থনৈতিক পণ্ডিত; তাহার কণ্ঠে শুনিব শান্ত সমাহিত উপদেশ। বিস্মিত হইলাম যে, তিনি তাহার বক্তব্য অতিশয় উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে প্রকাশ করিলেন এবং দেশ-নির্মাণ সম্বন্ধে আপনার মতামত আমাদিগকে বুঝাইবার জন্য শুধু যুক্তিতর্ক নয়, স্থির বিশ্বাসের গভীর অনুভূতিও নিয়োগ করিলেন। স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম ভারতের প্রতি তাঁহার প্রেম অকৃত্রিম ও তিনি আমাদের মঙ্গল কামনা করেন।

***

প্রায়ই দেখিতে পাই, ইংরেজ এবং মার্কিন এতদ্দেশীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমাদের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার বিজ্ঞাপন কিংবা বরপক্ষের স্বগুণ কীর্তন লইয়া ব্যঙ্গবিদ্রূপ করিয়া থাকেন। তাহারা করুন, আমাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই।

কিন্তু প্রশ্ন, তাহারা ভারতীয় বিজ্ঞাপনের দিকেই কটাক্ষ হানেন কেন?

সুইজারল্যান্ড হইতে জর্মন ভাষায় প্রকাশিত একখানি বিশ্ববিখ্যাত সাপ্তাহিকে নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটি পড়িলাম। আমার সঙ্কীর্ণ জ্ঞান এবং বুদ্ধি অনুযায়ী তাহার অনুবাদ নিবেদন করিলাম।

আমি আমার এক ত্রিংশতি বর্ষীয়া সুন্দরী বান্ধবীর জন্য একজন জীবনসঙ্গী অনুসন্ধান করিতেছি। আমার আশা, সেই জীবনসঙ্গী যেন আমার বান্ধবীর পঞ্চবর্ষীয় পুত্রের স্নেহময় পিতার আসন গ্রহণ করেন। আমার বান্ধবী উত্তম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি তন্বঙ্গী, ১৭৫ সেন্টিমিটার দীর্ঘ (প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি অনুবাদক), ক্যাথলিক, গৃহকর্মে সুনিপুণা এবং বহু রমণীসুলভ মোহিনী গুণ ধরেন। উচ্চশিক্ষা ও দৃঢ় চরিত্রবল ছিল বলিয়া জীবনে বহু দুর্যোগ সত্ত্বেও তিনি তাঁহার রসবোধ হইতে বঞ্চিত হন নাই। পাঠক, তুমি যদি এই জাতীয় অমূল্য সম্পদের গুণগ্রাহী হও এবং প্রেমময়ী জীবনসঙ্গিনী আকাক্ষা কর, তবে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সহিত ফটোগ্রাফসহ নিম্নে উদ্ধৃত পোস্টবক্সে পত্র লেখ। বিষয়টি গোপনীয়ভাবে আলোচিত হইবে বলিয়া উভয় পক্ষ প্রতিজ্ঞা করিতেছেন।

বিস্তর মস্তক কণ্ডুয়ন করিয়াও হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলাম না, এই কাতররোদন এবং ভারতীয় অরক্ষণীয়ার মধ্যে মূলত পার্থক্য কোথায়? এস্থলে বর্ণিত হইয়াছে, রমণী ভদ্রবংশোদ্ভবা, আমরা বলি মুখোপাধ্যায়, কুলীন, খড়দা মেল। এস্থলে বলা হইয়াছে, তিনি ক্যাথলিক, আমরা বলি তিনি ব্রাহ্মণ, বৈদ্য কিংবা কায়স্থ। গৃহকর্মে সুনিপুণার প্রতি লোভ হটেনটট হইতে প্যারিসের বিদগ্ধজন সকলেরই আছে এবং আমরা সুন্দরী বলিয়াই ক্ষান্ত দিই, এস্থলে কিন্তু দৈর্ঘ্যের উল্লেখ পর্যন্ত রহিয়াছে। অবশ্য আমরা জীবনের ঝঞ্ঝাবার্তার বিষয় উল্লেখ করি না, কারণ আমাদের বিজ্ঞাপন সচরাচর বিধবা রমণীর জন্য নহে। সুতরাং পঞ্চবর্ষীয় পুত্রের উল্লেখও আমাদের পক্ষে অপ্রয়োজন।

শুধু তাই নয়, বরপণ বস্তুটিও ইয়োরোপে অবিদিত নয়। নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যায়।

শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান যুবা বিবাহ ও বাণিজ্য করিতে ইচ্ছুক। বিশ হাজার ফ্রাঙ্কের প্রয়োজন।

স্পষ্টই বুঝা গেল, এস্থলে অর্থ অনর্থ নয়। যে কুমারীকে যুবা বিবাহ করিতে ইচ্ছুক, তাহার কুল-গোত্র-রূপ-লাবণ্য সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। বিশ হাজার ফ্রাঙ্ক হইলেই হইল।

কিন্তু ইহাকেও পরাজিত করিতে পারে এমন বিজ্ঞাপনও দেখিয়াছি।

নিজস্ব বাড়ি আছে এমন রমণীকে স্বাস্থ্যবান সুশিক্ষিত যুবক বিবাহ করিতে ইচ্ছুক। বাড়ির ফটোগ্রাফ পাঠান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *