৬.
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস পালন করাতে দিল্লি যা উৎসাহ দেখায়, কলকাতার তুলনায় সে কিছু কম না। অবশ্য দিল্লি শহরে গণ্ডায় গণ্ডায় সুসাহিত্যিক নেই; কাজেই রবীন্দ্রজীবনী এবং সাহিত্য সম্বন্ধে বহুমুখী এবং বিস্তর আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন ঠিক ততখানি হয়তো হয়ে ওঠে না।
এবারে কলকাতা থেকে এলেন শ্ৰীযুত প্রমথনাথ বিশী সেই অভাব খানিকটে পূরণ করতে। কালীবাড়ি ক্লাবে শ্ৰীযুত বিশী বিরাট জনতার সামনে বক্তৃতা দেন। শ্ৰীযুত বিশী সম্বন্ধে দিল্লির নগণ্য নাগরিকরূপে রায় পিথৌরা কী ধারণা পোষণ করেন, সে সম্বন্ধে গত সপ্তাহে নিবেদন করেছি এবং এ সপ্তাহে সপ্রমাণ হয়ে গেল যে, তার ধারণা ভুল নয়।
অন্যান্য স্থলে ভাষণ দেন শ্ৰীযুত হুমায়ুন কবীর এবং শ্ৰীযুত দেবেশ দাশ। একই দিনে প্রায় সবকটি পরব হয়েছিল বলে রায় পিথৌরা দু একটির বেশি সামলে উঠতে পারেননি। তবে এঁদের পাণ্ডিত্যের খবর রাখি বলে লোকমুখে যখন শুনলুম এঁদের বক্তৃতা সত্যই উপভোগ্য হয়েছিল তখন সেকথা অনায়াসেই বিশ্বাস করতে পারলুম।
শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক স চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যের প্রায় সবকটি গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। শ্ৰীযুত নীলমাধব সিংহ নিষ্ঠার সঙ্গে গানগুলোর পরিচালনা করেন এবং অনুষ্ঠানটি যে সফল হয়েছিল, তার প্রধান কারণ ছেলেমেয়েরা গানগুলো অতি সযত্নে বহু পরিশ্রম করে আয়ত্ত করেছিল। শ্রীমান কৌশিক ও শ্রীমতী নন্দিতা এবং আরও অনেকেই অনুষ্ঠানটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য সাহায্য করেন। রায় পিথৌরাও মাঝে মাঝে উপর চাল মারার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাকে কেউ বড় একটা আমল দেয়নি।
***
অনেকেই বলেন, একই দিনে অনেকগুলো পরব না করে কোনও এক কেন্দ্রীয় স্থলে মাত্র একটি বিরাট সভা করা উচিত। আমি এ মত পোষণ করিনে। দিল্লি বিরাট শহর এবং এক স্থল থেকে অন্য স্থল যাওয়ার যা কুব্যবস্থা তাতে করে সেই কেন্দ্রীয় সভায় দিল্লির অধিকাংশ রবি-ভক্তরাই উপস্থিত হতে পারবেন না। তাই একই দিনে কালীবাড়ি, লেডি আরউইন স্কুল, লোদি কলোনি এবং বিনয়নগরে যদি রবীন্দ্রজন্মোৎসব অনুষ্ঠিত হয় তবে সেই ব্যবস্থাই ভালো।
অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় একটি সভা হলে আরও ভালো। গেল বৎসর টেগোর সোসাইটি নিউদিল্লি এবং টাউন হলে তার আগের বৎসর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় সভার আয়োজন করেছিলেন। এ বছর কেন হল না বোঝা গেল না। তবে একটা কারণ এই যে, দিল্লিতে প্রফেশনাল সাহিত্যিক কিংবা সাহিত্যসেবী কেউ নেই–সকলকেই কোনও-না-কোনও দপ্তরে সুবো-শাম কলম পিষতে হয়, তাই সবাই প্রতি বৎসর সবকিছু করে উঠতে পারেন না।
রবীন্দ্রনাথ-জন্মোৎসব আরও কিছুদিন ধরে চলবে। এ জিনিস যত বেশি দিন ধরে চলে ততই ভালো।
***
খাদ্যমন্ত্রী শ্ৰীযুত কানহাইয়ালাল মুন্সী বিদায় নেবার সময় বলেন ভারতবর্ষের কোনও খাদ্যমন্ত্রীই কিছুটি করতে পারবেন না, যদি তিনি বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে চাপরাসিরূপে না পান।
তাতেও কিছু হবে না। মন্ত্রীদের চাপরাসি মহাশয়গণের প্রধান কর্ম চেয়ারে বসে বেঞ্চিতে পা তুলে দিয়ে মেঘগর্জনে ঘুমনো। পর্জন্য যদি চাপরাসি হন তবে তিনি ওই গর্জনই ছাড়বেন– ওই একই পদ্ধতিতে বৃষ্টি নামাবেন না।
দ্বিতীয়ত পর্জন্যকে চাপরাসি ইতঃপূর্বে একবার হতে হয়েছিল তবে কি না যার চাপরাসি তিনি হয়েছিলেন সে বেচারি খুন হয় এক মানুষেরই দ্বারা।
স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে, তবু আবছা মনে পড়ছে–
ইন্দ্র যম আদি করে বাঁধা আছে যার ঘরে
ছয় ঋতু খাটে বারো মাস
সমীরণ ভয়ে ভয়ে চলে মৃদু গতি হয়ে
দেব রক্ষ যক্ষ যার দাস।
সেই শ্রীমান রাবণ যখন বেঘোরে প্রাণ দিলেন, তখনই ইন্দ্রকে পুনরায় চাপরাসি করতে যাবে! কে?
আমার মনে হয়, মুন্সীজি উত্তমরূপে বিবেচনা না করে এ প্রস্তাবটি করেছেন। যদি ধরেই নিই, তিনি ইন্দ্রকে কবজাতে এনে ফেলেছেন– তা হলে? তা হলে তো তাকে রাবণ বলে ডাকতে হবে। রাম, রাম!
***
কিন্তু আসল কথা সেইটে নয়।
ইন্দ্র কে, বৃষ্টিই বা কী?
শাস্ত্র বলেন, জল কারারুদ্ধ করে রাখে বৃত্র এবং সেই বৃত্রকে বধ করে ইন্দ্র জলকে মুক্তি দিয়ে মানুষের জন্য নাবিয়ে নিয়ে আসেন। কোনও মুনি বলেন, হিমালয়ের গিরিকরে বৃত্র জলকে বরফে পরিণত করে দেয় বলে সে জল আর জনপদভূমিতে নেমে আসতে পারে না। ইন্দ্র হচ্ছেন বসন্তের সূর্য। শীতের শেষে তার রৌদ্রবাণ বরফকে খণ্ড খণ্ড করে দেয় আর গভীর গর্জনে জলধারা নেমে আসে গঙ্গা যমুনা ব্ৰহ্মপুত্ৰ দিয়ে। অন্য মুনি বলেন, বৃত্র জলকে কারারুদ্ধ করে রাখে কালো মেঘে। ইন্দ্র তার বস্র হানেন, বিদ্যুৎ চমকায়, দামিনী ধমকায়, আর সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসে বৃষ্টিধারা, নববরিষণ।
এই মুনিগণের মতবাদের প্রতি লক্ষ রেখে রবীন্দ্রনাথও গেয়েছেন
দহনশয়নে তপ্তধরণী
পড়েছিল পিপাসার্তা।
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের
অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ,
দিকে দিকে হল দীর্ণ
নব-অঙ্কুর জয়পতাকায়।
ধরাতল সমাকীর্ণ
ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর, হে গম্ভীর।
আমার মনে হয়, ইন্দ্রদেব তাঁর কর্ম এখনও করে যাচ্ছেন বৈদিক যুগে যেরকম করে গিয়েছিলেন। বেদের ঋষি সে যুগে তার প্রশস্তি যেরকম ধারা গেয়েছিলেন, এ যুগে রবীন্দ্রনাথও তার প্রশস্তি ঠিক সেই রকমই গেয়েছেন।
বৃষ্টি হয়, বরফ গলেও জল নামে, কিন্তু আমরা সেই জলের ব্যবহার করতে জানিনে।
মিশরে বষ্টি হয় না। বৃষ্টি হয় সুদানে। কিন্তু মিশরীয়রা নাইল দিয়ে যে জল নেমে আসে, সেই জল নালা কেটে কেটে চতুর্দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে আপন জমি ভেজায়– মাঠে মাঠে ক্ষেতে সোনার ফসল ফলে ওঠে।
আমরা সেই কর্মটি করিনে। আমাদের নদী-নালা দিয়ে কি কিছু কম জল সাগরে গিয়ে পড়ে? আমরা কি সে জলের সদ্ব্যবহার করছি।
***
মুন্সীজি যে ব্যাকরণে ভুলটি করলেন, তাতে কোনও ক্ষতি নেই।
তিনি সুসাহিত্যিক– গুজরাতিতে উত্তম উত্তম পুস্তক লিখেছেন, কিন্তু আমার বড় দুঃখ। সেগুলো বাংলাতে অনূদিত হয়নি।
ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গসুন্দর ইতিহাস লেখাবার জন্যও মুসীজি ব্যাপক বন্দোবস্ত করেছেন।
আমার মনে হয়, মুন্সীজির পক্ষে রাজনীতি বর্জন করাই ভালো।