রায় পিথৌরার কলমে – ৫

৫.

ইংরেজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেবা করাতে, ফরাসি উত্তম ছবি আঁকতে, জর্মন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত রচনা করাতে কৈবল্যানন্দ অনুভব করে আর বাঙালি বলেছিলুম, তখুনি বলেছিলুম বলতে পারলে অর্থাৎ ভবিষ্যদ্বাণী করাতে সে সুপটু একথা সপ্রমাণ করতে পারলে জীবনে তার আর কোনও বাসনা থাকে না।

তাই আমিও আজ সোল্লাসে বলছি, বলিনি, তখন বলিনি শ্ৰীযুত মুখুজ্যে মশাইকে লাটসাহেব বানিয়ে ভারত সরকার অতি উত্তম কর্ম করেছেন? ভদ্রলোক মাইনে নেন নামমাত্র, আর আজ শুনতে পেলুম, তিনি নাকি বলেছেন, এত বড় বিরাট লাট-ভবনের তার প্রয়োজন নেই, তিনি মাত্র দু একখানি ঘর নিয়ে বাদবাকি অন্য কাজের জন্য ছেড়ে দেবেন।

কিন্তু একটা জিনিসে মনে একটু খটকা লাগল। শুনলুম, লাটবাড়ির ফালতো ঘরগুলোতে নাকি আপিস বসবে।

***

আমার জনকয়েক গুণী বন্ধুবান্ধবের বিশ্বাস তার চেয়ে যদি ওই ঘরগুলো দিয়ে কোনওপ্রকারের বৈদগ্ধ্যগত প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যায়, তবে লাটবাড়ির সম্মান বজায় থাকবে, বাঙালিরও উপকার হবে।

এই ধরুন না, রবীন্দ্রভবন। কলকাতার কবি রবীন্দ্রনাথ। কলকাতা বাংলা দেশের রাজধানীও বটে। তবু এই কলকাতা শহরেই যদি আপনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কোনও প্রামাণিক গ্রন্থ লিখতে চান, তবে আপনাকে একাধিক জায়গায় ছুটোছুটি করতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত সব জিনিস পাবেন কি না, সে বিষয়েও আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

লাটবাড়িতে এ ব্যবস্থাটা করলে হয় না?

কিংবা মনে করুন, একখানা উত্তম চিত্রশালা খুললে হয় না?

আরও কত কিছু করা যেতে পারে। আমার পাঠকেরা গুণী লোক মাথা না চুলকিয়েও গুম গুম করে পঁচিশখানা ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা বাতলে দিতে পারবেন। আমার মনে হয়, গুণীদের এ বিষয়ে চুপ করে থাকা উচিত নয়। আমাকে যদি পত্রযোগে জানান, তবে আমি তাদের মোক্তার এবং মুহুরিরূপে পাঠক-ধর্মাবতারের এজলাসে পেশ করতে পারি।

কিন্তু আপিস, না স্যার, লাটবাড়িতে আপিস- ও কোনও কাজের কথা নয়। শালিগ্রাম দিয়ে মশারির পেরেক পোতা? (ক্ষিতিমোহনবাবুর কপিরাইট)।

***

দুই দোরে ডবল পর্দা, দরজায় হুড়কো, ভেন্টিলেটারে কালো কাগজ সঁটা তবু দুপুরবেলা ঘরে বসেই আমেজ করতে পারলুম বাইরে কিছু একটা হচ্ছে– ভূতের নৃত্য কিংবা পিশাচিনীর শ্রাদ্ধ।

অতি সন্তর্পণে দরজা ফাঁক করে দেখি– মারাত্মক কাণ্ড।

আসমানজমিন গাছপালা সবকিছুর যেন জন্ডিস হয়েছে। অতি সূক্ষ্ম ধুলোর ঝড় বইছে– এখানে যাকে বলে আঁধি– আর সেই ধুলো আকাশে-বাতাসে এমনি ছড়িয়ে পড়েছে যে মনে হয়, যেন জন্ডিসের কুয়াশায় সবকিছু আচ্ছন্ন।

মনে হল যেন, পরশুরামের সেই ছবি দেখছি। কুয়াশার ভিতর দিয়ে শোনা গেল সব আছে, হরিনাথ, সব আছে।

নিজাম প্রাসাদে, জানিনে, কোন কারসিক গুটিকয়েক ঝাউগাছ গজিয়েছেন। বিরাট বিরাট গাছ–এদের আসল জন্মভূমি পাহাড়ে। সমস্ত বৎসর এরা বিরস বিবর্ণ মুখে কাটায়, শুধু শীতকাল এলে দেশের হাওয়া পেয়ে যেন চঞ্চল নৃত্যে নেচে ওঠে।

গ্রীষ্মকালে গরমের তেজে এদের থোকা থোকা সবুজ নিডল (পাতা) ঝলসে গিয়ে একদম হলদে হয়ে যায়, আর যেন কোনও গতিকে গাছের গায়ে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকে।

দেখি ঝড়ের হাওয়া ঠাস ঠাস করে ঝাউয়ের গায়ে থাবড়া মারছে আর খাবলা খাবলা নিডলের গুচ্ছো তুলোর মতো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। মাটিতে পড়ে গিয়েও এদের নিষ্কৃতি নেই। আঁধির জল্লাদ খুন করে চলে গেল, এখন তারই মুফরাস এদের ঝেটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে– বাগানে এদিক থেকে ওদিক, আবার ওদিক থেকে এদিক।

তিনটে বাজল, চারটে বাজল ঝড়ের বেগ বেড়েই চলেছে। কী অলক্ষুণে কাণ্ড!

***

রাত তখন আটটা। শুনলুম, প্রধানমন্ত্রীর প্লেন অতি কষ্টে নাকি অ্যারোড্রোমে নামতে পেরেছে, আর তার আধঘন্টাটাক পরেই মাদ্রাজের প্লেন মাটিতে নামতে না পেরে দুর্ঘটনায় খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গিয়েছে একটি প্রাণীও বাঁচেনি।

আমি জানি, আপনারা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু সমস্ত দুপুর আমার মনে কেমন যেন একটা অজানা ভয় জেগে রয়েছিল, কিন্তু শেষটায় যে এতগুলো জীবন নষ্ট হবে, তার কল্পনাও মনে করতে পারিনি। আর কল্পনা করলেই-বা কী করতে পারতুম?

পরদিন সুহৃদ ডাক্তার মজুমদার এবং লেডি ডাক্তার স্বরূপের সঙ্গে দেখা। এরা দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অকুস্থানে যান। যে কজনের তখনও প্রাণ ছিল, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না।

আমার মনে শুধু এটুকু সান্ত্বনা যে, আমার বন্ধু মজুমদার এবং আমার শিষ্যা (ডাক্তারিতে ) শ্ৰীমতী স্বরূপ আর্তজনের সাহায্য করাতে কোনও ক্রটি তো করেনইনি– স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। এঁরা সফদরজঙ্গ হাসপাতালে কর্ম করেন অ্যারোপ্লেন দুর্ঘটনা সম্পর্কে এঁদের কোনও সরকারি দায়িত্ব নেই। ভগবান এদের মঙ্গল করুন।

***

দিল্লিস্থ শান্তিনিকেতন-আশ্রমিক সঙ্ এবং নিউদিল্লি বাঙালি ক্লাব যুগ্মভাবে সুসাহিত্যিক শ্ৰীযুক্ত প্রমথনাথ বিশীকে ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষে দিল্লিতে নিমন্ত্রণ করেছেন। শ্রীযুক্ত প্রমথনাথের লেখার কদর কে কতটা দেন, তার বিচার রায় পিথৌরা করবেন না। কিন্তু একথা ঠিক, বাংলা সাহিত্যের সেবা আজকের দিনে যারা করেন তাদের মধ্যে শ্ৰীযুত বিশীই রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথ তখন প্রৌঢ়। তার স্বাস্থ্য তখন অটুট, ওদিকে কবিত্বের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি তখন পরিপূর্ণতায় পৌঁছে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তখন অক্লান্ত অধ্যাপনা করছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কাব্যসৃষ্টিও চলছে। এবং সর্বশেষ কথা, প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথের স্নেহ পেয়েছিলেন অকৃপণভাবে।

রবীন্দ্রনাথ শ্ৰীযুত বিশীর কাব্য এবং সাহিত্যপ্রচেষ্টার প্রশংসা করতেন আবার প্রয়োজন হলে কঠিন সমালোচনাও করতেন। নিতান্ত আত্মজন না হলে রবীন্দ্রনাথ কারও কঠোর সমালোচনা করতে চাইতেন না। (আর সাহিত্যের বাইরে তেল কিংবা কালির জন্য তিনি যেসব সার্টিফিকেট দিয়েছেন, সেগুলোর মূল্য কতটুকু সে তো সবাই জানেন) তাই শ্ৰীযুত বিশী সেদিক দিয়েও ভাগ্যবান।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলা দেশ শ্রীযুত বিশীর সামর্থ্যের সম্পূর্ণ ফললাভ করতে পারেনি।

***

পূর্ব এবং মধ্য আফ্রিকায় বহু ভারতীয় বসবাস করেন। মহাত্মা গান্ধীর কর্মজীবন এঁদের নিয়েই আরম্ভ হয়।

এসব জায়গায় বর্ণের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হচ্ছেন, খাস ইয়োরোপীয়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন ভারতীয়। তার পর বোধ করি আরব এবং সর্বশেষে দেশের মাটির ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ নিগ্রোরা।

ইংরেজ যে ভারতীয়দের ভালো চোখে দেখে না, সে তো জানা কথা কিন্তু সেখানকার ভারতীয়রা যখন নিগ্রোকে তাচ্ছিল্য করে, তখন আমার মনে বড় লাগে। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান রবীন্দ্রনাথ যে কতবড় এই বেদবাক্য বলে গিয়েছেন, সেকথা তারা জানেন না (আমরাই জানি কি?)।

পূর্ব আফ্রিকার ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রীযুক্ত আরাসাহেব পর্যন্ত দিল্লি এসেছেন। তিনি বলেন, আফ্রিকা, ইংরেজ, ভারতীয়, আরব, নিগ্রো সবাই মিলিয়ে একটা অখণ্ড সমাজ যদি না গড়ে তোলা যায় তবে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। তাঁর বিশ্বাস এই অখণ্ড সমাজ গড়ে তুলতে পারে প্রধানত তথাকার ভারতীয়রাই। তাই তিনি মনে করেন, এখানকার ভারতীয়েরা যেন পূর্ব আফ্রিকার ভারতীয়দের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেই সন্তুষ্ট না হন, তারা যেন সেই অখণ্ড সমাজের দিকে দৃষ্টি রেখে আপন প্রচেষ্টা ধাবিত করেন।

মহাত্মাজির সহকর্মী শ্ৰীযুত কাকাসাহেব কালেলকর পূর্ব আফ্রিকায় গিয়ে বহু সকর্ম করেছেন। আপন অভিজ্ঞতা একখানা উত্তম হিন্দি পুস্তকে প্রকাশ করেছেন সে পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে।

আরেকটি গুণী লোক পণ্ডিত শ্রীঋষিরাম। ইনি উপস্থিত আফ্রিকাতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার করছেন। আমাকে প্রায়ই চিঠিপত্র লেখেন এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের যেসব ছবি পাঠান, সেগুলো দেখে ভগবানকে বলি, আসছে জন্মে যেন নিগ্রো হয়ে জন্মাই।

উঁহু; সেটি হবার জো নেই।

তন্দুরি, মুর্গি মাফিক দিল্লির গ্রীষ্ম জাহান্নম তন্দুরি-আদমি বনে যাওয়ার পর তো।

 পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *