রায় পিথৌরার কলমে – ৪

৪.

ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কৌতূহল সবদেশেই আছে, কিন্তু যদি জিগ্যেস করা যায় আজ পর্যন্ত কোন দেশ সবচেয়ে বেশি কৌতূহল দেখিয়েছে এবং সেই কৌতূহল পরিতৃপ্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে কে, তা হলে সকলের পয়লা নাম নিতে হয় জর্মনির।

আর কিছু না; শুধু যদি এই মাপকাঠিই নিই, ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, কাব্য, অলঙ্কার সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বই লেখা হয়েছে কোন ভাষায় তা হলেই জর্মনি পয়লা প্রাইজ পেয়ে যাবে। এখানে অবশ্য এমন সব কেতাবের কথা উঠছে না যেগুলো সুদ্ধমাত্র ভারতবর্ষকে কবজা রাখার জন্য ইংরেজ লিখেছে বা লিখিয়েছে, কিংবা এমন সব কেতাবের কথাও উঠছে না যেগুলো পড়া থাকলে হাতি শিকারের সুবিধে হয় অথবা ক্রিকেট খেলার পিচ বানাবার সময় কাজে লাগে। সোজা বাংলায় যাকে বলে শাস্ত্র-চর্চা আমি সেই শীল সেই অধ্যবসায়ের কথা ভাবছি।

***

জর্মনিতেও ভারতের চর্চা আরম্ভ হয় পঞ্চতন্ত্র নিয়ে। পঞ্চতন্ত্রের পেহলভি তর্জমার আরবি তর্জমার লাতিন তর্জমার জর্মন অনুবাদ হয় টুবিঙ্গেন শহরে সেখানকার রাজার আদেশে। তার পর আঠারো আর উনিশ শতকে জর্মনি সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত আর অর্ধ-মাগধী শিখে ভারত সম্বন্ধে যে চর্চাটা করল তার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার মাথা নিচু করতে হয়। এ চর্চাতে যে শুধু ভাষাবিদ পণ্ডিতেরাই যোগ দিলেন তা নয়, জর্মন দার্শনিক, সাহিত্যিক, কবিরা পর্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ভারতীয় চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হলেন।

***

 প্লাতো, দেকার্ত আর তার পরেই কান্ট।

দার্শনিক কান্টও যে ভারত নিয়ে চর্চা করেছিলেন এ তত্ত্ব কজন লোক জানে?

কান্টের সময় ভারত সম্বন্ধে ইয়োরোপের জ্ঞান এত সামান্য ছিল যে কান্টের পক্ষে ভারতীয় দর্শন চর্চা করা সম্ভবপর হয়নি, কিন্তু গভীর অন্তদৃষ্টি ছিল বলে যে সামান্য দু একটি খবর তিনি জানতে পেরেছিলেন তারই জোরে বলে যান, ক্রিশ্চান মিশনারিরা ভারতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখেন, ভারতীয় পণ্ডিতরা অত্যন্ত উৎসাহ এবং সহিষ্ণুতার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের বাণী শোনেন; কিন্তু ভারতীয়রা আশ্চর্য হল এই দেখে যে ক্রিস্টান মিশনারিদের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল নেই।

এ তত্ত্ব আজ আমরা সবাই জানি, কিন্তু আশ্চর্য সে যুগে কান্ট ওটা জানলেন কী করে? খ্রিস্টধর্ম যে এদেশে প্রচার এবং প্রসার লাভ করল না সেই তো তার প্রধান কারণ। ভাবের জগতে তো ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক অচল!

***

গ্যোটে শকুন্তলার প্রশস্তি গেয়েছিলেন তারই খেই ধরে রবীন্দ্রনাথ একখানা উত্তম প্রবন্ধ লেখেন সেকথা আমরা সবাই জানি।

তার পর বিখ্যাত কবি হাইনরিশ হাইনে কল্পনার চোখে ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভারি চমৎকার কয়েকটি কবিতা লেখেন। জর্মন ছেলে-বুড়ো কোনও ভারতীয়কে পেলেই সেসব কবিতা আবৃত্তি করে নিয়ে আনন্দ পায়। ভারতীয় গর্ব অনুভব করে–অবশ্য বলে রাখা ভালো নিছক কল্পনার উপর খাড়া বলে হাইনের কবিতাতে দু একটি বর্ণনার ভুল থেকে গেছে। গঙ্গার জলে হাইনে পদ্ম ফুটিয়েছেন এবং সেই পদ্মার সামনে হাঁটু গেড়ে পুজো করছে ভারতীয় তরুণী।

তাতে কিছু যায়-আসে না। কারণ ওদিকে আবার বশিষ্ঠ-বিশ্বমিত্রের কলহে হাইনে গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের দ্বন্দ্ব দেখতে পেয়েছেন এবং জর্মনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

***

আসল কৃতিত্ব কিন্তু জর্মনরা দেখিয়েছে বেদ উপনিষদ রামায়ণ মহাভারত পুরাণ গীতা, শ্ৰেীত সূত্র, গৃহ্য সূত্র, ষড়দর্শন, ভক্তিবাদ, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র নিয়ে।

ঋগ্বেদের অনুবাদ উনিশ শতকে হয়; তার পর তুলনামূলক ভাষা চর্চার ফলে ঋগ্বেদ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অনেকখানি বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই পুরাতন অনুবাদই চালু থাকে। মামলারের পর ঋগ্বেদ অনুবাদ করবার মতো দুটো মাথা কটা লোকের ঘাড়ে আছে?

সেই সাহস দেখালেন আরেক জর্মন পণ্ডিত– মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেলডনার।

গেলডনারের ঋগ্বেদ-অনুবাদ আশ্চর্য বই। গ্রাসমান, লুডবিশ, ম্যাক্সম্যুলারের যুগ থেকে ১৯২০ (মোটামুটি) পর্যন্ত ঋগ্বেদ সম্বন্ধে যত প্রবন্ধ যত ভাষায় লেখা হয়েছে তার সামান্যতম মূল্যবান জিনিসও কোনও কোনও উপলক্ষে গেলনারের অনুবাদে স্থান পেয়েছে। ফলে এই হয়েছে যে আজ ঋগ্বেদ সম্বন্ধে প্রামাণিক কোনও তথ্য অনুসন্ধান করার সময় বিশ্বভুবন খুঁজে বেড়াতে হয় না– গের্ডনারের জর্মন অনুবাদখানাই যথেষ্ট।

***

কিন্তু এর শেষ কোথায়? ঋগ্বেদ সম্বন্ধে যা বলা হল তা-ও তো অতিশয় সংক্ষেপে ) এখন যদি আর তিনখানা বেদ নিয়ে আলাপ-আলোচনা আরম্ভ করি, তা হলে লিখতে হবে আরেকখানা মহাভারত এবং সে মহাভারত ব্যোটলিঙ্ক-রোটের সংস্কৃত-জর্মন অভিধানের আকার ধারণ করবে।

ব্যোটলিঙ্ক-রোটের অভিধানখানি সার্থক বই। এ অভিধানকে হার মানাতে পারে এরকম অভিধান পৃথিবীতে নেই।

এর পশ্চাতে একটুখানি ইতিহাস আছে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি জর্মনরা বলল, ভালো অভিধান ছাড়া আর তো সংস্কৃত চর্চা করা অসম্ভব হয়ে উঠল। এর একটা কিছু ব্যবস্থা করা উচিত।

ব্যোটলিঙ্ক-রোট দুই গুণী অভিধানখানা লিখতে রাজি হলেন। বিরাট সাত ভলুমে সে

অভিধান শেষ হল, কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এ অভিধান ছাপাতে যাবে কোন প্রকাশক এত রেস্ত আছে কোন গৌরী সেনের?

গৌরী সেন রাজা ছিলেন না– তাই তুলনাটা টায়-টায় মেলে না। কারণ শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এ অভিধান ছাপাবার মতো পয়সা আছে শুধু রাশিয়ার জারের।

তখন জর্মন পণ্ডিতরা পাকড়াও করলেন তাঁকে– জারটি ভালো মানুষ ছিলেন (রামচন্দ্র! কম্যুনিস্ট ভায়ারা না আবার চটে যান) এবং টাকাটা অকাতরে ঢেলে দিলেন।

শুধু এই অভিধানখানিকে ভালো করে কাজে লাগানোর জন্যই জর্মন ভাষা শেখা উচিত।

মনে পড়ছে, প্রথম যৌবনে ক্রন্দসী শব্দের সামনে কাঁদ কাঁদ হয়ে মেলা অভিধান ঘটার পর ব্যোটলিঙ্ক-রোটের অভিধান খুলে শব্দের হদিস পাই। (স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মহোদয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত নেই তিনি বাঙালির গৌরবস্থল ও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তাই তার সামান্য দোষ-ত্রুটির প্রতি ইঙ্গিত করলে তার আত্মা বিরক্ত হবেন না বলে আশা রাখি। তাই এই উপলক্ষে নিবেদন করি, জ্ঞানেন্দ্রমোহন তার অভিধানে ক্রন্দসী শব্দ উল্লেখ করে যে বলেছেন সংস্কৃত অভিধানে পাই নাই, কিন্তু রোদসী পাইয়াছি পুনরায়, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক উদ্ভাবিত এই দুটি বাক্যই খুব ঠিক নয়।)

***

বপ, ডয়সেন, অল্ডেনবুর্গ, য়াকোবি, হিলেব্রান্ট, ড্যুটওয়া এদের সবাইকে বাদ দিয়ে তাদের কথায়ই আসি না কেন যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগাযোগ হয়েছে।

এই ধরুন ল্যুডার্স। গেলডনারের পরেই চতুর্বেদে পণ্ডিত ছিলেন এই বার্লিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক।

মোন-জো-দড়ো নিয়ে যখন বিশ্বভুবন মাথা ফাটাফাটি করছে, এ কোন সভ্যতা, এর বয়স কত, একে গড়ে তুলল কে, তখন জর্মনি ডার্সকে অনুনয় করে বলল, চতুর্বেদে হেন বস্তু নেই যা আপনার অজানা। আপনি মোন-জো-দড় ঘুরে এসে বলুন, বেদে বর্ণিত কোনও কিছু কী মোন-জো-দভড়াতে আছে যার থেকে প্রমাণ করা যেতে পারে যে মোন-জো-দড়ো আর্য সভ্যতা।

ল্যুডার্স ঘুরে গিয়ে বললেন, না, বেদের সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগ নেই।

 ব্যস্। সব মাথা-ঘামানো বন্ধ।

সব শাস্ত্রেই ল্যুডার্সের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। শেষ বয়সে সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রটি অধ্যয়ন করে তার সঙ্গে গ্রিক অলঙ্কার শাস্ত্র মিলিয়ে যখন বক্তৃতা দিতেন তখন দেখেছি তার শ্রোতারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনে যেতেন। এরকম পণ্ডিত জর্মনিতে আবার জন্মাবেন কবে?

***

কিংবা ধরুন কির্ফেল।

জৈন শাস্ত্রের মহাপণ্ডিত যাকোবির (ইনি স্বাধীনভাবে হিসেব করে লোকমান্য টিলকের সিদ্ধান্তেই উপস্থিত হন) শিষ্য কির্ফেলকে একদিন জিগ্যেস করেছিলুম, উপস্থিত কোন বিষয় নিয়ে মগ্ন আছেন?

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, পুরাণ নিয়েই তো জীবনটা কাটল। অন্য জিনিস ভালো করে পড়বার ফুর্সৎ পেলুম কই।

জিজ্ঞাসা করি, পুরাণের দেশ ভারতবর্ষে কয়জন লোক পুরাণের জন্য প্রাণ দেয়? একজনকে জানি বাঙালি মাত্রই তাকে জানে।

কিন্তু আজ এ শিবের গীত কেন?

এ সপ্তাহে দিল্লিতে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন জর্মন পণ্ডিত অধ্যাপক ডক্টর হেলমুট ফন গ্লাজেনাপ। বিষয় ছিল, জর্মনির ওপর ভারতীয় প্রভাব। সে বক্তৃতায় উপস্থিত ছিলুম।

শ্লেগেল থেকে আরম্ভ করে উইন্টারনিৎস-লডার্স পর্যন্ত তিনি পণ্ডিতের ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাস দিলেন। বয়স হয়েছে, স্মরণশক্তির ওপর আর নির্ভর করতে পারিনে, তবু টুকতে পারিনি।

তাই যেটুকু মনে ছিল তার সঙ্গে পিথৌরার অভিজ্ঞতা জুড়ে দিয়ে আপনাদের সামনে নিবেদন করলুম।

প্ল্যাজেনাপ তার বক্তৃতা শেষ করেন একটি প্রশ্ন জিগ্যেস করে এবং তার উত্তর দিয়ে।

জর্মনি ভারতীয় শাস্ত্র নিয়ে এত চর্চা করে কেন?

 উত্তরে বলেন, উভয় জাতিই উচ্চ চিন্তাতে আনন্দ পায়।

 আমরাও স্বীকার করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *