রায় পিথৌরার কলমে – ৩

৩.

একই সময়ে দিল্লি শহরে দুইটি প্রদর্শনী খোলা হইয়াছে; প্রথমটিতে দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্য ইউরোপের চিত্রতারকাগণ যে কলা সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহার নিদর্শন; দ্বিতীয়টিতে ইন্দোনেশিয়ার কলা সৃষ্টির সর্বাঙ্গসুন্দর সঞ্চয়ন।

এই দুইটি প্রদর্শনী দেখিয়া মনে পুনরায় প্রশ্ন জাগে, প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য কি একই রসের অনুসন্ধান করিয়াছে এবং সেই রস যদি একই রস হয়, তবে তাহা উভয় ভূখণ্ডের ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবনে কতখানি প্রসার লাভ করিয়াছে?

কলের জিনিস সস্তায় তৈয়ারি বলিয়া ইউরোপের বাড়িঘর, তৈজসপত্র, বেশ-ভূষা, এমনই এক সর্বজনীন রূপ গ্রহণ করিয়াছে যে, তাহাতে আর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তির রসানুভূতি প্রকাশ পায় না। স্বীকার করি, ইউরোপীয় রমণী পর্দা কিনিবার সময় আপন রুচির উপর নির্ভর করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই পর্দা অন্য লক্ষ লক্ষ পর্দার সঙ্গেই মিলিয়া যায়। পর্দার ক্ষেত্রে কোনও কোনও রমণী হয়তো নিজের হাতে তাহার উপর কিছু কিছু কারুকার্য করিয়া তাহাতে কিঞ্চিৎ বৈশিষ্ট্য আনয়ন করেন, কিন্তু টেবিল-চেয়ার, বাসন-কোসনের বেলা তাহার কিছুমাত্র অবকাশ থাকে না।

কল সবকিছু তৈয়ার করিয়া দিতেছে, সেখানে মানুষ রসসৃষ্টি করিবার অবকাশ পাইতেছে না–অথচ সেরকম মানুষ সব দেশেই আছে বিস্তর– তাহাদের তখন উপায় কী? তখন মানুষ নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্রকে আর কারুকার্য বিভূষিত না করিয়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কলাসৃষ্টি আরম্ভ করে। ফলে চিত্র এবং ভাস্কর্য মানুষের রসসৃষ্টির মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হয়। তাই কলের জিনিস যেখানে সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত–দৃষ্টান্তস্থলে মধ্য ইউরোপ সেখানেই প্রচুর পরিমাণে চিত্র অঙ্কিত হয়, মূর্তি নির্মিত হয়। আমার বিশ্বাস প্যারিস-বার্লিন দুই শহরে যে পরিমাণ চিত্র অঙ্কিত হয়, সমস্ত প্রাচ্য দেশে এত ছবি আঁকা হয় না।

আর একটি তত্ত্ব এস্থলে লক্ষণীয়; নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের কোনও অভাব এইসব চিত্র পূরণ করে না বলিয়া তাহারা দশের মনোরঞ্জন করিবার চেষ্টা করে না এবং ক্রমে ক্রমে নিরতিশয় ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হইয়া দাঁড়ায় এবং খুব বেশি হইলে মাত্র সেই গোষ্ঠীরই চিত্তবিনোদন করিবার চেষ্টা করে যাহারা রসের সংসারে সমগোত্রীয় এবং তাহার শেষ ফল এই হয় যে, এ ধরনের চিত্র এবং ভাস্কর্য অতিশয় অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপ ধারণ করে।

***

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই মধ্য ইউরোপীয় চিত্রকলার এই পরিণতি ঘটিয়াছিল। প্যারিস যদিও বহু বৎসর যাবৎ এই আন্দোলন আলোড়নের কেন্দ্রভূমি ছিল, তথাপি বার্লিন যখন একবার এই আন্দোলন গ্রহণ করিল, তখন তাহার পরিণতি অদ্ভুত অদ্ভুত রূপ গ্রহণ করিতে লাগিল।

দিল্লির চিত্রপ্রদর্শনীতে আজ আমরা প্রধানত সেইসব চিত্রের কিয়দংশ দেখিতে পাইতেছি।

ইহাতে ভালো চিত্র নাই, এই কথা আমার বলিবার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু মানুষের অধীর চিত্তকে যে শান্তি দেয়, তাহার সন্ধান এই প্রদর্শনীতে বড়ই কম। যেখানে সমস্তক্ষণ চিত্রকার নূতন ভাষা, নূতন শৈলী, নূতন আঙ্গিকের অনুসন্ধানে ব্যস্ত, সেখানে দর্শক সমাহিত রসের সন্ধান করিলে নিরাশ হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী?

গুণের দিক দিয়া অতি অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে, এই চিত্রগুলিতে প্রাণ আছে। প্রচেষ্টার ফল ভালো হউক, মন্দ হউক, প্রচেষ্টা মাত্রই দর্শকের চিত্তে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং সে চাঞ্চল্য গতানুগতিক কিংবা মৃত কলা অপেক্ষা অতি অবশ্য সর্বথা কাম্য।

***

ইন্দোনেশিয়ার কলা সেই দেশের জনসাধারণের কলা। প্রদর্শনীতে যেসব বস্তু রাখা হইয়াছে তাহার অধিকাংশই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এমনকি তৈজস এবং মূর্তিগুলি পর্যন্ত হয় গৃহসজ্জায় নয় পুতুলরূপে আনন্দদানের জন্য ব্যবহৃত হয়।

 এবং সর্বাপেক্ষা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, কি বালির পুতুল, কি গরুড়ের মূর্তি, কি পরিধান বস্ত্রের নকশা, কি বেতের ঝাপি, বারকোশ, কি বালা ব্রোচ আংটি, কি বাতিকের কারুকার্য সর্বত্রই স্পষ্ট বোঝা যায় এখানে কোনও নূতন শৈলীর অনুসন্ধানে উন্মত্ত নৃত্য নাই। রস কী করিয়া প্রত্যেক বস্তুটির ভিতর দিয়া প্রকাশ করিতে হয় তাহার সন্ধান ইন্দোনেশিয়ার কলাকার বহু শতাব্দী পূর্বেই পাইয়াছিলেন এবং সেই সত্যপথ ধরিয়া তাঁহারা প্রতিদিন জীবনের নিত্য ব্যবহারে আর কোন বস্তুকে আরও সুন্দর করা যায় তাহার চেষ্টা করিয়াছেন। এককালে আমাদের দেশের শিল্পীরাও প্রত্যেকটি জিনিসকে রসরূপ দিবার চেষ্টা করিতেন; এখন তাহাদের পরাজয়ের পালা আরম্ভ হইয়াছে। প্রতিদিন মিলের কাপড়, এলুমিনিয়মের বাসন আপন সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। বিবেচনা করি, এমন দিনও আসিবে যখন দুর্গাপ্রতিমা কলে তৈয়ারি হইয়া এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হইবেন।

এই প্রদর্শনীর বহু বস্তুর সম্মুখে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিয়াছি, এ জিনিসটির কি কোনও দোষ, কোনও ক্রটি নাই? স্পষ্ট ভাষায় বলি, এমন বহু জিনিস দেখিলাম যাহাতে সত্যই কোনও প্রকারের ত্রুটিবিচ্যুতি নাই। সর্বাঙ্গসুন্দর কলাসৃজনের এইরূপ অভিনব সঞ্চয়ন আমি আমার জীবনে আর কোথাও দেখি নাই।

রসবস্তু বিচারে কোনওপ্রকারের ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা ভৌগোলিক ক্ষুদ্রতার স্থান নাই এই সত্য বারম্বার স্বীকার করিয়াও যদি নিবেদন করি, কোনও সুন্দরী রমণীর মুখে যদি আমি আমার মাতার সাদৃশ্য দেখিতে পাই তবে সেই সুন্দরী কি আমার কাছে প্রিয়তর মনে হয় না?

মাতা, ভগ্নী, সকলকেই বাল্যকাল হইতে দেখিয়াছি, ঢাকাই শাড়ি পরিতে। দাওয়ায় বসিয়া কত সহস্রবার দেখিয়াছি, বাঁশের বেড়ায় শাড়ি শুকাইতেছে এবং সেইসব পাড়ের নকশাই তো আমাকে রসশাস্ত্রের প্রথম অ আ ক খ শিখাইয়াছে। জ্বরের ঘোরে যখন বালক তাহার দৃষ্টিশক্তির কর্তৃত্ব হারাইয়া ফেলে তখন সে একদৃষ্টে তাকাইয়া থাকে মাসিমার শাড়ির পাড়ের দিকে। চেতন-অর্ধচেতন উভয় মনই বাল্যকাল হইতে আপন অজানাতে এইসব বস্তু দিয়াই তাহার শিল্পসূত্র (ক্যানস অব আর্ট) নির্মাণ করে।

অকস্মাৎ এই প্রদর্শনীতে দেখি, ঢাকাই পাড়ের নকশা! দেহলি প্রান্তের রসযজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে ঢাকাই নকশা অনাদৃতা। তাই অর্ধপরিচিত সমুদ্রপারে আদৃত (না হইলে এই নকশা প্রদর্শনীতে স্থান পাইবে কেন) এই নকশা দেখিয়া আমার চিত্ত অভিভূত হইয়া গেল।

প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা শ্ৰীযুত বিনোদ এবং মহারাজা উভয়ই ইন্দোনেশিয়ার কলাতে ভারতের প্রভাব সম্বন্ধে ইঙ্গিত দিয়াছিলেন। তদুপরি এই তথ্যও জানি ভারতের বঙ্গদেশ, উড়িষ্যা ও মাদ্রাজ অঞ্চলই ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে সর্বাধিক বাণিজ্য করিয়াছে। আরও জানি ঢাকাই শাড়ির নকশা উড়িষ্যা এবং মাদ্রাজ অঞ্চলে প্রচলিত নহে।

তাহা হইলে আমার সুপরিচিত ঢাকাই শাড়ির নকশাই তো এই নকশাকে অনুপ্রাণিত করিয়াছে।

তাহা হইলে আমারই অনাদৃত আমার দেশের তন্তুবায় একদা রসভুমিতে ইন্দোনেশিয়া জয় করিতে সক্ষম হইয়াছে। পাঠক আপনাকে শ্রদ্ধা করি, আপনি পারেন না। আমিও পারি নাই।

কবিগুরু কর্তৃক রচিত বালি দ্বীপ কবিতাটির কয়েকটি ছত্র এই উপলক্ষে উল্লেখ করি :

সন্ধ্যাতারা উঠল যবে গিরিশিখর পরে,
একেলা ছিলে ঘরে।
কটিতে ছিল নীল দুকূল, মালতীমালা সাথে,
কাঁকন দুটি ছিল দু খানি হাতে।
চলিতে পথে বাজায়ে দিনু বাঁশি–
‘অতিথি আমি’ কহিনু দ্বারে আসি।
তরাসভরে চকিত করে প্রদীপখানি জ্বেলে
চাহিলে মুখে; কহিলে ‘কেন এলে’।
 কহিনু আমি, রেখোনা ভয় মনে–
তনুদেহটি সাজাব তব আমার আভরণে।
 আধোচাঁদের কনকমালা দোলানু তব বুকে।
 মকরচূড় মুকুটখানি করবী তব ঘিরে
পরায়ে দিনু শিরে।
 জ্বালায়ে বাতি মাতিল সখীদল,
তোমার দেহে রতনসাজ করিল ঝলমল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *