২৩.
খবর এসেছে নাগপুরে জাপানি ভাষা শেখাবার ব্যবস্থা হয়েছে। অতি উত্তম প্রস্তাব।
ভারতবর্ষ আজব দেশ। কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজের মতো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি ভাষা পড়াবার ব্যবস্থা নেই– ওদিকে এদের তুলনায় ক্ষুদ্র নাগপুরে জাপানি পড়াবার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
ঠিক তেমনি আজ যদি আপনি উত্তম চীনা ভাষা শিখতে চান তবে আপনাকে যেতে হয় শান্তিনিকেতন নয়, পুণায়। অন্য জায়গায় বিশেষ কোনও বন্দোবস্ত নেই।
(এই দিল্লি শহরে বহুভাষা শেখাবার কিঞ্চিৎ ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই।)
নাগপুরে পুণায় জাপানি চীনা শেখাবার বন্দোবস্ত, অথচ বড় বড় শহরে নেই। এ যেন সেই মাকড় সম্বন্ধে পূর্ববঙ্গের ধাঁধা, কোথায় জাল আর কোথায় জেলে–
আট পা আঠারো হাটু,
জাল ফালাইতা গেল ঘাটু।
শুকনায় ফালাইয়া জাল
মাছে উঠি দিলা ফাল!
— কোথায় ভাষা শেখার ব্যবস্থা, আর কোথায় ভাষা-শিখনেওলা!
***
ওদিকে আজ্জম পাশা বলছেন ভারত এবং আরব মুলুক এক হয়ে প্রাচ্যের প্রধান শক্তি তৈরি হবে, এদিকে আমরা ভারতবর্ষে বলছি, আলবৎ, আমরা জগৎকে জীবননীতির তৃতীয় পন্থা বাতলাব ইত্যাদি কতই না বাক্যাড়ম্বর।
যেসব ঐক্যের স্বপ্ন আমরা দেখছি সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাষা না শিখে কী করে বাস্তবে পরিণত হবে আমায় বুঝিয়ে বলতে পারেন?
লন্ডনে প্রাচ্য এবং আফ্রিকার নানা ভাষা শেখার জন্য বিরাট প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্যারিসেও তাই। জর্মনির ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়েও বহুতর ভাষা শেখা যায় (এক সংস্কৃতের জন্যই জর্মনির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন সংস্কৃত অধ্যাপক ছিলেন সংস্কৃত শিখত মাত্র একটি ছেলে ও তা-ও এডিশনাল হিসেবে), ইটালিতে প্রাচ্য ভাষা শেখাবার ব্যবস্থা বহু দিনের অথচ এই বিরাট ভূমি ভারতে যেটুকু ব্যবস্থা আর সেকথা নিজেদের ভিতর তুলতেও লজ্জা বোধ করে।
শুনেছি, আমাদের ফরেন আপিসের একদা তিন-চারশ লোকের প্রয়োজন হয়েছিল এবং ভাষা জাননেওলা উপযুক্ত ব্যক্তি পাওয়া গিয়েছিল মাত্র আট না দশজন!
তবুও ভাষা শেখাবার কোনও ব্যাপক ব্যবস্থা কোথাও হচ্ছে না।
মাদ্রাসাগুলো মরে যাচ্ছে– আরবি-ফারসির চর্চা কমে আসছে।
আর সংস্কৃত তো ডেড ল্যানগুইজ। তাই টোলগুলো মরুক– আপত্তি নেই!!
কী দেশ!
***
দিল্লির বিখ্যাত সাধু নিজামউদ্দিন আওলিয়ার প্রখ্যাত সখা এবং শিষ্য কবি আমির খুসরৌর জন্মোৎসব কয়েক দিন হল আরম্ভ হয়েছে। আমির খুসরৌর কবর নিজামউদ্দিনের দরগার ভিতরেই এবং সে দরগা হুমায়ুনের কবরের ঠিক সামনেই। (এ দর্গায় আরও বহু বিখ্যাত ব্যক্তির কবর আছে।)।
খুসরৌর পিতা ইরানের বল্খ (সংস্কৃত বহিকম– ভারতীয় কোনও কোনও নৃপতি বখ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে) থেকে ভারতবর্ষে আসেন। পুত্র খুসরৌ কবিরূপে দিল্লির বাদশাহদের কাছে প্রচুর সম্মান পান।
ফারসি তখন বহু দেশের রাষ্ট্রভাষা। উত্তর ভারতবর্ষ (ফারসি এদেশের ভাষা নয়) আফগানিস্তান (সে দেশেরও দেশজ ভাষা পুশতু) তুর্কিস্থান (তারও ভাষা চুগতাই) এবং খাস ইরানে তখন ফারসির জয়-জয়কার। এমনকি বাঙলা দেশের এক স্বাধীন নৃপতি কবি হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
খুসরৌ ফারসিতে অত্যুত্তম কাব্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন। ভারতের বাইরে বিশেষ করে কাবুল-কান্দাহার এবং সমরকন্দ-বোখারা খুসরৌকে এখনও মাথার মণি করে রেখেছে।
আলাউদ্দিন খিলজি, তার ছেলে খিজর খান, বাদশা গিয়াসউদ্দিন তুগলুক, তার ছেলে বাদশা মুহম্মদ তুগলুক (ইংরেজ ঐতিহাসিকদের পাগলা রাজা)। এঁরা সবাই খুসরৌকে খিলাত-ইনাম দিয়ে বিস্তর সম্মান দেখিয়েছেন।
গুজরাতের রাজা কর্ণের মেয়ে যখন দিল্লি এলেন তখন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমার খিজর খান তাঁকে বিয়ে করেন। ইংরেজের মুখে শুনেছি, বিয়ে নাকি প্রেমের গোরস্তান, অর্থাৎ বিয়ে হওয়ার পরই নাকি সর্বপ্রকারের রোমান হাওয়া হয়ে যায়। এখানে হল ঠিক তার উল্টো। এঁদের ভিতর যে প্রেম হল সে প্রেম পাঠান-মোগল হারেমের গতানুগতিক বস্তু নয়– তাই অনুপ্রাণিত হয়ে খুসরৌ তাঁদের প্রেমকাহিনী কাব্যে অজর অমর করে দিলেন। সেই কাব্যের নাম ইশকিয়া- বাঙলা ভ্রমণের সময় সম্রাট আকবর সেই কাব্য শুনে বারম্বার প্রশংসা করেছিলেন। কর্ণের মেয়ের নাম দেবলা দেবী। শুনেছি, বাঙলায় নাকি দেবলা দেবী নাটক বহুবার অভিনীত হয়েছে।
গিয়াসউদ্দিন তুগলুক নিজামউদ্দিনকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। সে কাহিনী দৃষ্টিপাতে সালঙ্কার বর্ণিত হয়েছে দিল্লি দূর অস্ত! কিন্তু গিয়াস নিজামের মিত্র খুসরৌকে রাজসম্মান দিয়েছিলেন। খুসরৌ বড় বিপদে পড়েছিলেন– একদিকে সখার ওপর বাদশাহি জুলুম, অন্যদিকে তিনি পাচ্ছেন রাজসম্মান।
মুহম্মদ তুগলুক রাজা হওয়ার পর তাবৎ মুশকিল আসান হয়ে গেল। ঠিক মনে নেই (পোড়ার শহর দিল্লি একখানা বই পাইনে যে অর্ধবিস্মৃত সামান্য জ্ঞানটুকু ঝালিয়ে নেব), বোধ হয় খুসরৌ বাদশা মুহম্মদের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন।
সে এক অপূর্ব যুগ গেছে। সাধক নিজামউদ্দিন, সুপণ্ডিত বাদশা মুহম্মদ তুগলুক, ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী এবং সভাকবি আমির খুসরৌ।
প্রথম দেহত্যাগ করলেন শেখ-উল-মশাইথ নিজামউদ্দিন আওলিয়া, তার পর তার প্রিয়সখা আমির খুসরৌ, তার পর বাদশা মুহম্মদ শাহ তুগলুক এবং সর্বশেষে জিয়া বরণী।
ইংরেজ আমাদের কত ভুল শিখিয়েছে। তার-ই একটা– এসব গুণীরা ফারসিতে লিখতেন বলে এরা এদেশকে ভালোবাসতেন না। বটে? সরোজিনী নাইড় ইংরেজিতে লিখতেন, তাই তিনি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন না!
খুসরৌ মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন এবং সে ভূমির অশেষ গুণকীর্তন করে গিয়েছেন।
এবং দূরদৃষ্টি ছিল বলে তিনি যেটুকু দেশজ হিন্দি জানতেন (হিন্দিরও তখন শৈশবাবস্থা) তাই দিয়ে হিন্দিতে কবিতা লিখে গিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, ফারসি এবং হিন্দি মিলিয়ে তিনি উর্দুর গোড়াপত্তন করে গিয়েছেন জানতেন একদিন সে ভাষা রূপ নেবেই নেবে।
আবার বিপদে পড়লুম; হাতের কাছে বই নেই তাই চেক-আপ করতে পারছিনে– পণ্ডিত পাঠক অপরাধ নেবেন না– যেটুকু মনে আছে নিবেদন করছি–
হিন্দু বাচ্চেরা ব নিগর আজব হসন্ ধরত হৈ
দর ওকতে সুখ জদন মুহ ফুল ঝরত হৈ
গুম কে বি আর আজ লবেৎ বোসে বিগরিম–
গুফৎ আরে রাম! ধরম নষ্ট করত হৈ!
*
হিন্দু বাচ্চা কী অপূর্ব সৌন্দর্যই না ধারণ করে,
কথা বলার সময় মুখ থেকে যেন ফুল ঝরে।
বললুম, আয়, তোর ঠোঁটে চুমো খাব–
বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করত হৈ!