রায় পিথৌরার কলমে – ২২

২২.

পিথৌরাকে ধমক দেওয়া হয়েছে, তিনি কেন মাঝে মাঝে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় একই মাল পরিবেশন করেন।

উত্তরে নিবেদন, আগাগোড়া একই বস্তু পিথৌরা দুই কাগজে কখনও লেখেন না। তবে মাঝে মাঝে দু একটি বিষয় এমনই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় যে, তখন সেগুলো উভয় কাগজে উল্লেখ না করে থাকা যায় না।

এই ধরুন, কাল যদি ওখলায় বেড়াতে গিয়ে দেখি, যমুনার জল উজান বইছেন– পদাবলিতে এরকম অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে, কিন্তু স্বচক্ষে কখনও দেখিনি আর আনন্দবাজার হিন্দুস্থান দুটোই পড়েন যে, এরকম একটা ঘটনা একদলকে বিলকুল জানাব না?

যারা বাঙলায় রায় পিথৌরা পড়তে পারেন, তারা যে কোন দুঃখে ইংরেজিতে পড়েন, তা ও তো বুঝতে পারিনে। রস আর আড্ডা জমাবার জন্য ইংরেজি কি একটা ভাষা!

***

এই ধরুন, গেল সপ্তায় এখানে যা হল সে অভূতপূর্ব।

রাষ্ট্রপতি ভবনে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চারজন একনিষ্ঠ সাধককে স্বহস্তে চারখানা শাল গলায় পরিয়ে দিলেন। দিল্লি শহরের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের ওস্তাদ ইহুদি মেনুহিনও আনন্দের আতিশয্যে ঘন ঘন করতালি দিচ্ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি ভবন বলাতে ঘটনার পরিবেশ ঠিক ঠিক ওত্রালো না। যদি বলতুম, ভাইসরিগেল লজে কাণ্ডটা ঘটল তা হলে পাঠক খানিকটা আমেজ করতে পারতেন। কারণ বড়লাট আদরকদর করতেন, তাঁরই জাতভাই সায়েব-সুবোদের কিংবা রাজা-রাজড়াদের।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খার পরনে ছিল কুর্তা আর পাজামা– মাথায়ও কাপড়ের টুপি। এ বেশ পরে ভাইসদের আমলে ওস্তাদজি নিশ্চয়ই সেখানে আমল পেতেন না, সম্মান পাওয়ার কথা দূরে থাকে– সে খেয়ালি পোলাও খেতে যাবেন না।

সাদাসিধে কাপড়-জামা-পরা ওস্তাদ আলাউদ্দিন সাহেব যখন শান্ত মুখচ্ছবি নিয়ে রাষ্ট্রপতির সামনে দাঁড়ালেন, আর তিনি সহাস্যবদনে ওস্তাদের কাঁধে শাল রাখলেন, তখন আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলি, সাধু, সাধু, সাধু!

সাধু, সাধু বলার রেওয়াজ এখনও এদেশে ফের চালু হয়নি, কিন্তু সে নিয়ে আমার মনে কোনও আক্ষেপ নেই। সভাস্থলে যা করতালি-ধ্বনি উঠল, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, দেশের লোক ভারি খুশি আমাদের অনাদৃত অবহেলিত গুণীরা যে রাজ-সম্মান পেলেন। রাষ্ট্রপতিকে আমি বহু জায়গায় বহু সার্টিফিকেট-সনদ দিতে দেখেছি, কিন্তু এই চারজন ওস্তাদকে সম্মান দেখাবার সময় তার মুখে যে আনন্দ ফুটে উঠেছিল, তার থেকে বোঝা গেল, তিনিও ওস্তাদদের সম্মান দেখাতে পেরে খুশি হয়েছেন। এবং সত্যই তো, শুধু যে ওস্তাদরা সম্মানিত হলেন তাই নয়, এদের সম্মান দেখিয়ে রাষ্ট্রও তো সম্মানিত হল।

***

আলাউদ্দিন সাহেব অতিশয় নিরভিমান ও ধর্মভীরু লোক। তিনি শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তার মনে কি কোনও তোলপাড় চলছিল না? প্রথম যৌবনে যেদিন তিনি মা সরস্বতাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন, সেদিন কি তিনি আশা করতে পেরেছিলেন যে, এমন দিনও আসবে, যখন তিনি রাষ্ট্রপতির স্বহস্তে সম্মানিত হবেন? আজীবন তো তিনি দেখলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের লাঞ্ছনা অবমাননা। বরঞ্চ তাঁর বাল্যকালে সে সঙ্গীতের অনেকখানি কদর ছিল, তার পর ষাট-সত্তর বৎসর ধরে তিনি তার চোখের সামনে দেখলেন, কত ওস্তাদ না খেয়ে মারা গেলেন, কত মেধাবী তরুণ উৎসাহের অভাবে আপন প্রতিভার বিকাশ করতে পারল না। ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে সর্বস্বান্ত হওয়ার নিদারুণ বেদনা অনেক সাংসারিক লোকই জানেন, কিন্তু এখানে তার চোখের সামনে যা গেল, সে তো তার আপন বিত্ত নয়– যুগ-যুগ সঞ্চিত তাবৎ দেশের সঞ্চিত সঙ্গীত-সম্পদ যে তার চোখের সামনে ভেসে গেল।

না, তা তো নয়। আলাউদ্দীন সাহেবের আজ বড় আনন্দ, ভারতীয় সঙ্গীত আর লোপ পাবে না। রাষ্ট্রের, দেশের, দশের সকলেরই সস্নেহ দৃষ্টি পড়েছে ওস্তাদের ওপর, অর্থাৎ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর।

***

ওস্তাদ মুশতাক হুসেন খানও অতিশয় বিনয়ী লোক কিন্তু তিনি অত্যন্ত প্রাণবন্তও বটেন। রাজ-সম্মান পেয়ে তার মুখে দম্ভ ফুটে ওঠেনি, তিনি হলেন উল্লসিত এবং অভিভূত।

তাই তিনি যখন গান গাইতে আরম্ভ করলেন, তখন তাঁর গলা দিয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। আর সে কী গলা– ওঠানো-নামানোর কায়দা! উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, আকাশ-পাতাল সবদিক থেকে তিনি যেন টেনে এনে নয়া নয়া ধ্বনি নয়া নয়া সুর আপন গলার ভিতর দিয়ে বের করতে লাগলেন। কখনও গম্ভীর উচ্চকণ্ঠে– সে কণ্ঠ নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো যেন স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পেলুম আর কখনও যেন নিঝরিণীর গতিবেগের মতো, কখনও আবার তার গলা থেকে মারবেলের গুলির মতো গোল গোল তানের সারি পিল পিল করে বেরুতে লাগল।

আর কী উৎসাহ, কী উদ্দীপনা! ঘন ঘন শাকরেদদের দিকে তাকান, ভাবখানা এই, পছন্দ হচ্ছে তো? সমের সময় তবলচির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি, ইশারা মারেন, আদর দেখিয়ে তাম্বুলাওলার কাঁধে কাঁধ রেখে স্বর যাচাই করে নেন, আর মাঝে মাঝে দু হাত দিয়ে কানের ডগা ছুঁয়ে আপন অশরীরী ওস্তাদের সামনে যেন নিজের অপূর্ণতার জন্য ভিক্ষা করছেন।

বহু বাঘা ওস্তাদের মজলিসে শাকরেদদের বিবর্ণমুখে বসে থাকতে দেখেছি। মেহেরবান মুশতাকের সামনে তারা আনন্দে ফেটে পড়ার উপক্রম। শুরুর দিকে তারা তাকাচ্ছিল যেন শ্রীরাধা গোপীজনবল্লভের দিকে তাকাচ্ছেন।

ওস্তাদ মুশতাকের চেয়েও ভালো ওস্তাদের গান আমি শুনেছি, কিন্তু ওরকম প্রাণবন্ত, সচল রঙ্গে রঙ্গে রঙ্গিমা সঙ্গীত আমি পূর্বে কখনও শুনিনি।

***

দাক্ষিণাত্যের আইয়ার ও আয়াঙ্গারকে দেখেই মনে হল, এরা দু জনই অতিশয় ধর্মভীরু সজ্জন। দক্ষিণের ব্রাহ্মণবাড়িতে থাকার সুযোগ আমার জীবনে বহুবার হয়েছে। সঙ্গীতের প্রতি তাদের অনুরাগ গৃহদেবতার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

বিশ্বাস করবেন না, দক্ষিণের এক আইয়ার ব্রাহ্মণের বাড়িতে সঙ্গীতোৎসবের শেষে পাঁচটি (একটি নয়, দুটি নয়, পাঁচটি) তামিল কন্যাকে আগাগোড়া জনগণমন অধিনায়ক গাইতে শুনলুম। হাতে তাদের গানের বই ছিল না; তবু রাত্রি প্রভাতিল শেষ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত তারা একবার মাত্র না থেমে গড় গড় করে গেয়ে গেল– অবশ্য দক্ষিণি কায়দায়।

শুধাই, এই বাংলা দেশেরই কটি ছেলেমেয়ে তাবৎ জনগণমন অধিনায়ক কণ্ঠস্থ বলতে পারে?

আসল কথায় ফিরে যাই।

দক্ষিণি গুরুরা দুই সম্মান পেলেন। রাজ-সম্মান এবং উত্তর ভারতের সম্মান। উত্তর ভারত দক্ষিণি গানের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, সেকথা আপনি-আমি বিলক্ষণ জানি, কিন্তু শুরুদের পয়লা সা আর পয়লা পিড়িঙের সঙ্গে সঙ্গেই সভাস্থ তামাম উত্তর ভারত বে-এক্তেয়ার। দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি সঙ্গীত-রসজ্ঞাকে আমি এখানে চিনি। দেখি, তাঁরা চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন। একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য।

কণ্ঠে এবং যন্ত্রে যে এত গোপনবাণী লুকানো আছে, কে জানত? রায় পিথৌরা মূর্খ এবং অরসিক সঙ্গীতের সে কিছুই বোঝে না, তাই সব জিনিসই তার ভালো লাগে। তাই যদি নিবেদন করি, দক্ষিণি সঙ্গীতের তত্ত্ব না বুঝেও যদি তার মর্মে সাড়া জেগে উঠে, তবে কি স্বীকার করবেন না গুরুদেবের সঙ্গীত পশুর প্রাণেও মানবতা জাগাতে পারে। কিন্তু রায় পিথৌরা চুলোয় যাক; দেখি, উত্তর ভারতীয় উন্নাসিকেরাও মুগ্ধ হয়ে দক্ষিণ ভারতের কৃতিত্বকে যেন উদ্বাহু হয়ে অভ্যর্থনা করছেন।

উত্তর-দক্ষিণের এরকম মিলন আমি এর আগে কখনও দেখিনি।

***

আলাউদ্দীন সাহেব আমার দ্যাশের লোক। ভেবেছিলুম তাঁকে কত কথা বলব। গলা ভেঙে গেল, কিছুই বলতে পারলুম না। রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিতাও সঙ্গে ছিল। ওস্তাদকে সেলাম করল। ওস্তাদ বললেন, মা, কত দিন পরে দেখা!

ওস্তাদ মুশতাক হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বেরুচ্ছিলেন তাঁর বন্ধু কাশ্মিরী পণ্ডিত হাকসার। আমি লখনওয়ি কায়দায় ঝুঁকে ঝুঁকে তাকে তিনবার কুর্নিশ করলুম। ওস্তাদ সদয় হাসি হেসে (এবং সবিনয়ে) আমার কুর্নিশ নিলেন দেখে আমার আর সেদিন মাটিতে পা পড়েনি।

***

ততক্ষণে দক্ষিণি গুরুরা চলে গিয়েছেন।

তাদের প্রণাম করতে পারলুম না বলে মনে আক্ষেপ নেই। ভক্তি থাকলে অদৃশ্য প্রণামও যথাস্থানে পৌঁছয়।

***

নিরপেক্ষ পাঠক, এইবার বল তো হিন্দুস্থানে এ-বয়ানে ইংরেজিতে লিখেছি বলে বাঙলায় যদি আনন্দবাজারে না লিখতুম তা হলে তোমার প্রতি অবিচার করা হত না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *