রায় পিথৌরার কলমে – ২১

২১.

স্বরাজ পাওয়ার পর একটা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সেটা কেউই লক্ষ করছেন না কারণ জিনিসটা চট করে চোখে পড়ে না।

স্বরাজ লাভের পূর্বে খুব কম বিদেশি ছেলেই ভারতে পড়াশোনা করতে আসত। পাঠক হয়তো আশ্চর্য হয়ে বলবেন, সেই তো স্বাভাবিক; আমাদের যে শিক্ষা-ব্যবস্থা তার থেকে তো সুস্থ মানুষ দূরে থাকতেই চাইবে। এদেশে আবার পড়াশোনা করতে আসবে কে? টাকা থাকলে আমরাই আমাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশোনা করতে পাঠাই।

কথাটা খুব ঠিক। বাঘা বাঘা যে সব ন্যাশনালিস্টরা ভারতীয় ঐতিহ্য ভারতীয় কৃষ্টির জিগির গেয়ে সভাস্থল গরম করে তোলেন তারা পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে বিদেশি ঐতিহ্যের স্কুল-কলেজে পড়াবার জন্য তাদের অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ পাঠান।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও বিদেশি ছেলেরা ভারতে পড়তে আসে। তার প্রধান কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পদ্ধতি যতই খারাপ হোক না কেন, আমাদেরই মতো কু-ব্যবস্থা মেলা প্রাচ্য দেশে এখনও মজুদ এবং আমাদের চেয়েও অধম ব্যবস্থা কোনও কোনও দেশে আছে।

***

 মিশরের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় এদেশেরই মতো। তাই মিশরের লোক যদি এদেশে কালেভদ্রে আসে, তবে খুব বেশি আশ্চর্য হওয়ার কথা নয়। অবশ্যই মিশরীয়রা এদেশে আরবি পড়তে আসবে না– আমরা যেরকম সংস্কৃত পড়ার জন্য মক্কা কিংবা মদিনায় যাইনে। তাই যে মিশরি ছেলেটি এসেছে সে শিখতে চায় মোগল-চিত্রকলার ইতিহাস।

উপযুক্ত গুরুর হাতে পড়েছে; কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারলুম, ইতোমধ্যেই বেশ খানিকটা উন্নতি করতে পেরেছে।

***

আমার বিশ্বাস আমাদের চেয়েও অনুন্নত কিংবা আমাদের মতো দুর্ভাগা দেশের ছেলেরা প্রধানত আসবে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি ইত্যাদি শিখতে কিছুদিন পূর্বে শুনতে পাই, ইরান থেকে নাকি কিছু ছেলে আসবে কৃষি-বিদ্যা শিখতে। এবং তার পর আসবে আমাদের চারুকলার নিদর্শন দেখতে এবং তার ইতিহাস শিখতে। সাহিত্য বা দর্শন শিখতে যে বেশি ছেলে আসবে না সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ কারণ সংস্কৃত শেখার ব্যবস্থা ভারতের বাইরে প্রাচ্য দেশে নেই বললেও চলে, তাই তারা সে বাবদে প্রাথমিক উৎসাহ পাবে না এবং দর্শনের চর্চা আজ পৃথিবীর সর্বত্রই কমে আসছে।

কিন্তু চারুকলা সম্বন্ধে সকলেরই কৌতূহল ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে কাইরো-আনকারায় যে ভারতীয় চিত্র প্রদর্শনী খোলা হয় সেগুলোতে বিস্তর লোক এসেছিল এবং প্রেস সেগুলোর প্রচুর সুখ্যাতি করেছে। (কাইরোতে গত বৎসর ভারতীয় নর্তক-নর্তকীরা রাজার মতো সম্মান এবং রাজ-সম্মানও পেয়েছিলেন)।

শুধু তাই নয়, ওরাও আমাদের দেখাতে চায়। কিছুদিন পূর্বে ইন্দোনেশি চারুকলা প্রদর্শনী দিল্লিতে হয়ে গেল সেকথা সকলেই জানেন। আর রুশকে যদি আধা-প্রাচ্য জাত বলা হয়, তবে রুশ কলা-প্রদর্শনীর কথাও স্মরণ করতে হয়।

এই যে মিশরি ছেলেটি এসেছে মোগল চিত্রকলার ক্রমবিকাশের ইতিহাস শিখতে, এরপর আসবে আরও ছাত্র আমাদের প্রাচীনতর চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য শিখতে।

কিন্তু এসব পড়াবার ব্যবস্থা আমাদের কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে? এই যেসব ছেলেরা আসছে এবং আসবে তারা যখন দেখবে আমাদের সাধারণ শিক্ষিত লোক আমাদের চারুকলার কোনও মর্মই বোঝে না, কোনও তত্ত্ব রাখে না তখন তারা ভাববেই-বা কী?

এদিকে নিমন্ত্রিতেরা এসে পড়েছেন ওদিকে রান্নার কোনওপ্রকার আয়োজন নেই। আরেক ছিলিম তামাক ইচ্ছে করুন–অর্থাৎ টালবাহানা দিয়ে আর কতক্ষণ এদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে?

***

এই সম্পর্কে পণ্ডিতবর আবু রয়হান মুহম্মদ বিন্ আহম্মদ আল বিরুনির নাম মনে পড়ল।

কয়েকদিন পূর্বে কলকাতায় তাঁর সহস্রতম জন্মোৎসব হয়ে গেল। ইরান-আফগানিস্তান আরও নানাদেশে এ উৎসব সমাধা হচ্ছে।

অল বিরুনি ছিলেন ফিরদৌসির মতো গজনীর মাহমুদের সভাপণ্ডিত। ফিরদৌসির নাম অনেক বাঙালি শুনেছেন- যখন বাঙলা দেশে ফারসি চর্চা ছিল তখন এক বাঙালি কবি ফিরদৌসি মাহমুদকে গালাগাল দিয়ে যে কবিতা লিখেছিলেন তার অনুবাদ পর্যন্ত করেন :

রাজা যদি হইতেন রানির কুমার
মণিময় তাজ শিরে দিতেন আমার।

 অল বিরুনি সম্বন্ধে এক বাঙালি লেখক লিখেছেন :

মাহমুদের ইতিহাস নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাঁর সভাপণ্ডিত অল বিরুনির কথা বাদ দেবার উপায় নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে ছয়জন পণ্ডিতের নাম করলে অল বিরুনির নাম করতে হয়। সংস্কৃতি-আরবি অভিধান-ব্যাকরণ সে যুগে ছিল না (এখনও নেই), অল বিরুনি ও ভারতীয় ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কোনও মাধ্যম ভাষা ছিল না। তৎসত্ত্বেও এই মহাপুরুষ কী করে সংস্কৃত শিখে, হিন্দুর জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতিষ, কাব্য, অলঙ্কার, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন সম্বন্ধে তহকিক-ই-হিন্দ নামক বিরাট গ্রন্থ লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন সে এক অবিশ্বাস্য প্রহেলিকা।

একাদশ শতাব্দীতে অল-বিরুনি ভারতের সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ লিখেছিলেন– প্রত্যুত্তরে আজ পর্যন্ত কোনও ভারতীয় আফগানিস্তান (ইরান) সম্বন্ধে পুস্তক লেখেননি। এক দারাশিকুহ ছাড়া আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ আরবি ও সংস্কৃতে এরকম অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখাতে পারেননি।

এতে কিছুই বলা হল না।

ভালো করে বলবার জন্য যে জায়গা প্রয়োজন তা-ও এখানে নেই। তাই শুধু অলবিরুনি যেসব সংস্কৃত বই পড়ে তার কেতাব লিখেছিলেন তার কয়েকটির নাম দেওয়া হল :

সাংখ্য, পাতঞ্জল, গীতা, বিষ্ণুপুরাণ, মৎস্য পুরাণ, বায়ু পুরাণ, আদিত্য পুরাণ,পুলিসসিদ্ধান্ত, ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, খণ্ডখাদ্যক, উত্তর খণ্ডখাদ্যক, বৃহৎ সংহিতা সিদ্ধান্তিকা, বৃহৎ জাতকং, লঘু জাতকং, করণসার, করণতিলক।

অনেকের মনে হতে পারে অল-বিরুনি হয়তো ক্রিশ্চান মিশনারিদের মতো হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দুধর্মকে নিন্দা করার জন্য তার বই লিখেছিলেন। তাই তাঁর ভাষাতেই বলি।

এ বই তর্কাতর্কির বই নয়। হিন্দুদের কাছ থেকে শুধু সেসব সিদ্ধান্তই আমি তুলিনি যেগুলো যুক্তি দিয়ে ভুল প্রমাণ করা যায়। বরঞ্চ বলি, আমার পুস্তকখানিতে সুদ্ধমাত্র তাদের তত্ত্ব ও তথ্যের ঐতিহাসিক বর্ণনা দেওয়া হল। হিন্দুদের বিশ্বাস ও চিন্তার আমি হুবহু বর্ণনা দেব এবং পরে গ্রিকদের বিশ্বাস ও চিন্তার উল্লেখ করে দেখাব এই দুই জাতের মধ্যে মিল রয়েছে।

আশ্চর্য! ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে লোকটি গ্রিক ও ভারতীয় দর্শনের মিল দেখতে পেয়েছিলেন।

***

রায় পিথৌরা ভয়ঙ্কর বেরসিক লোক আমি ঠিক বুঝে গিয়েছি। মিস কলকাতা অর্থাৎ শ্ৰীমতী ইন্দ্রাণী রহমানকে রায় পিথৌরা চেনে তার বিয়ের পর থেকেই অথচ তার মনে কখনও সন্দেহ জাগেনি যে এর সৌন্দর্য এমনই মারাত্মক রকমের যে ইনি একদিন সুন্দরীদের মধ্যে কুতুব মিনার হয়ে উঠবেন।

তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রাণীকে নিয়ে রাস্তায় বেরুলেই লক্ষ করতুম পথচারীরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। একদিন ইন্দ্রাণীকে বললুম, তোমাকে নিয়ে রাস্তায় বেরুনো মুশকিল। সবাই কীরকম প্যাট প্যাট করে তাকায়। অস্বস্তি বোধ হয়।

ইন্দ্রাণী বলল, ছোঃ! আমার দিকে তাকাবে কেন? তাকাচ্ছে তোমার দিকে।

!!! বলে কী! তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রাণীর সৌন্দর্যের পরই কলকাতায় সে যুগে দ্রষ্টব্য বস্তু ছিল রায় পিথৌরার গগনচুম্বী পাতালস্পর্শী টাক।

এর থেকে বোঝা গেল, ইন্দ্রাণীর বুদ্ধি আছে। ক্যাসা কায়দায় আপন বিনয় আর ভদ্রতা দেখিয়ে দিল।

কিন্তু আমার বিশ্বাস ইন্দ্রাণীর রূপের চেয়ে গুণ অনেক বেশি।

ইন্দ্রাণী বহু পরিশ্রম আর অনেক সাধনা করে উত্তম ভরত নাট্য শিখেছে। আসছে বার নাচ দেখালে মিস্ কলকাতাকে মিস করবেন না।

সেদিন এক অবাঙালি পিথৌরাকে ধাতিয়ে গেলেন। পিথৌরা নাকি বড্ড বেশি বাঙালি বাঙালি বলে চ্যাঁচাচ্ছে।

আরে বাপু, রায় পিথৌরা কে এমন কেষ্ট-বিধু যে তার চিৎকারে কারও কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে?

একটা গল্প মনে পড়ল।

পূর্ব বাঙলার গয়না নৌকো ঘাটে ভিড়তেই ভাড়াটেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সব জায়গা দখল করে নিল। একটা চাষা ধরনের লোক কিছুতেই ঢুকতে না পেরে ছইয়ের বাইরে সেই হিমে বসে রইল।

জায়গা দখলপর্ব শেষ হতে ভিতরে আলাপচারি আরম্ভ হয়েছে।

আপনার নাম?

আজ্ঞে, তারাপদ হালদার। আপনার?

আজ্ঞে কেষ্টবিহারী পাল।

তৃতীয় ব্যক্তিকে, আর আপনার?

আজ্ঞে শশধরচন্দ্র গুণ।

করে করে নৌকোর ভিতরকার সকলের চেনাশোনা শেষ হল। তখন এক মুরুব্বি বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নামটা তো জানা হল না, বাবাজীবন।

 লোকটি অতিশয় সবিনয় বলল, আজ্ঞে আমার নাম পাঁচকড়ি বৈঠা।

 বৈঠা! এ আবার কী বিদঘুঁটে পদবি রে বাবা! বাপের জন্মে শুনিনি।

লোকটি আবার বৈষ্ণবতর বিনয়ে বলল, আজ্ঞে, আপনারা, হালদার, পাল, গুণ সব নৌকোর ভিতরে বসে আছেন। নৌকো চালাবে কে? তাই আমি বৈঠা একা নৌকা চালাচ্ছি।

বাঙালি কেষ্ট্রবিষ্টরা নৌকোর ভিতরে বসে আপন ধান্দায় মশগুল। তাই রায় পিথৌরা বৈঠা হরবকৎ চেল্লাচেল্লি করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *