২০.
যারা ভালো করে পৃথিবীর ইতিহাস পড়েছেন তারা খাঁটি খবর দিতে পারবেন, আমি সামান্য যেটুকু পড়েছি, তার থেকে আমার দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে মহাত্মাজির মতো মহাপুরুষ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয় জন্মাননি।
বুদ্ধদেবকে কোনও ব্যাপক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়নি, খ্রিস্টের সামনে যে রাজনৈতিক সমস্যা এসে পড়েছিল (ইহুদিদের পরাধীনতা) তিনি তার সম্পূর্ণ সমাধান করেননি, শ্রীকৃষ্ণ এবং মুহম্মদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করার আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই চার মহাপুরুষকেই কোটি কোটি লোক শত শত বৎসর ধরে স্বীকার করে নিয়ে জীবনযাত্রার পথ খুঁজে পেয়েছে কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস মহাত্মাজি যে বুদ্ধ এবং খ্রিস্টের অহিংস পন্থা নিয়ে যে রাজনৈতিক সফলতা লাভ করেছিলেন এ জিনিস পৃথিবীতে পূর্বে কখনও হয়নি। প্রেম দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে হিংসার ওপর জয়ী হওয়া যায় একথা পৃথিবী বহু পূর্বেই মেনে নিয়েছিল কিন্তু অস্ত্রধারণ না করে রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে জয়ী হওয়া যায় সেই অবিশ্বাস্য সত্য প্রমাণ করে গিয়েছেন মহাত্মাজি। আমার ভয় হয়, একদিন হয়তো পৃথিবী বিশ্বাস করতে রাজি হবে না যে মহাত্মাজির প্রেম ইংরেজের বর্বর সৈন্যবলকে পরাজয় করতে সক্ষম হয়েছিল। অবিশ্বাসী মানুষ আজ স্বীকার করে না যিশু মৃতকে প্রাণ দিয়েছিলেন; পাঁচশ বছর পরের অবিশ্বাসী দুটোকেই হয়তো এক পর্যায়ে ফেলবে।
***
পাঠক হয়তো জিগ্যেস করবেন, মহাত্মাজি রাজনৈতিক ছিলেন; তিনি কোনও নবীন ধর্ম প্রচার করে যাননি। তবে কেন তাঁকে ধর্মগুরুদের সঙ্গে তুলনা করি।
নবীন ধর্ম কেন সৃষ্টি হয় তার সবকটা কারণ বের করা শক্ত কিন্তু একটি জিনিস আমি লক্ষ করেছি। কি বুদ্ধ কি খ্রিস্ট সকলকেই তাদের আপন আপন যুগের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করে নিতে হয়েছিল। এ বিষয়ে পিথৌরার চর্চা বড়ই অগভীর সেকথা পাঠককে আবার জানিয়ে রাখছি।
বুদ্ধদেবের সময় উত্তর ভারতবর্ষের বনবাদাড় প্রায় সাফ হয়ে গিয়েছে এবং ফলে আশ্রমবাসীগণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছিলেন। সজ্ঞ নির্মাণ করে তাঁদের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা বুদ্ধদেবকে করে দিতে হয়েছিল। আমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে–অর্থাৎ যৌথ পদ্ধতিতে বিরাট প্রতিষ্ঠান (স) নির্মাণ ভারতে এই প্রথম। দ্বিতীয়ত তখন প্রদেশে প্রদেশে এত মারামারি হানাহানি যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো করে প্রসার পাচ্ছিল না। শ্ৰমণগণ এসব উপেক্ষা করে শান্তির বাণী নিয়ে সর্বত্র গমনাগমন করার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক অন্তরায় দূর হয়। তাই শ্ৰেষ্ঠীরা সবসময়ই সঙ্রে সাহায্যের জন্য অকাতরে অর্থ দিয়েছেন।
খ্রিস্ট ইহুদিদের স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর পন্থা ছিল ইহুদিদের নৈতিকবলে এতখানি বলীয়ান করে দেওয়া, যাতে করে পরাধীনতার নাগপাশ নিজের থেকে ছিন্ন হয়ে যায়– অরবিন্দ ঘোষও পণ্ডিচেরিতে এই মার্গেরই অনুসন্ধান করেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ যে শুধু কুরুপাণ্ডবের যোগসূত্র স্থাপন করার জন্য কূটনৈতিক দূত তাই নন, শেষ পর্যন্ত তিনি পাণ্ডববাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদও গ্রহণ করেছিলেন।
মুহম্মদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আরবের যুযুধান, ছিন্নবিছিন্ন বেদুইন উপজাতিগুলোকে এক করে শক্তিশালী জাতি গঠন করা।
মহাত্মাজিকে সবাই রাজনৈতিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন কিন্তু পৃথিবীর মহাপুরুষদের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকার করে নিলেই ঠিক হবে।
***
প্রশ্ন উঠতে পারে তাই যদি হয়, তবে মহাত্মাজি কোনও নবীন ধর্ম প্রবর্তন করে গেলেন না কেন?
সে তো খ্রিস্টও করে যাননি। খ্রিস্ট তিরোধানের বহু বৎসর পর পর্যন্তও তাঁর অনুচরগণ বুঝতে পারেননি যে তারা এক নবীন ধর্মের প্রদীপ হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। রামমোহন, নানকও দেখা দিয়েছেন ধর্মসংস্কারক রূপে– তাঁরা বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন– শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হল নবীন ধর্ম পরবর্তী যুগে।
মহাত্মাজির নবীন– অথচ সনাতন ধর্ম প্রবর্তিত হতে সময় লাগবে।
সেই ধর্মং শরণং গচ্ছামি!
***
গল্প শুনেছি এক গুরু যখন বুঝতে পারলেন তাঁর এক নতুন শিষ্য একদম গবেট তখন তাকে উপদেশ দিলেন বিদ্যাচর্চা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করতে। শিষ্য প্রণাম করে বিদায় নিল।
বহু বৎসর পরে গুরু যাচ্ছিলেন ভিন গাঁর ভিতর দিয়ে। একটি আধাচেনা লোক এসে নিজের পরিচয় দিয়ে শুরুকে আপন বাড়িতে নিয়ে গেল। সেই গবেট শিষ্য। শুরু তার যত্ন-পরিচর্যায় খুশি হয়ে শুধালেন, তা বাবাজি আজকাল কী কর?
শিষ্য সবিনয়ে বলল, টোল খুলেছি।
গুরুর মস্তকে এটম বোমাঘাত! খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে শুধালেন, তা কী পড়াও?
শিষ্য বলল, আজ্ঞে সবকিছুই, তবে ব্যাকরণটা পড়াইনে।
গুরু আরও আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কী কথা? আমার যতদূর মনে পড়ছে তুমি তো ব্যাকরণটাই একটুখানি বুঝতে।
শিষ্য বলল, আজ্ঞে, তাই এটা পড়াতে একটুখানি বাধো বাধো ঠেকে।
***
রায় পিথৌরা যে সর্বাবদে এই শিষ্যটির মতো সেকথা আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী? এই দেখুন না, দিনের পর দিন সে সম্ভব অসম্ভব কত বিষয়ে কত তত্ত্ব কথাই না বেহায়া বেশরমের মতো লিখে যাচ্ছে। কারণ? কারণ আর কী? সর্ববিষয়ে যার চৌকস অজ্ঞতা তার আর ভাবনা কী?
কিন্তু প্রশ্ন গবেট শিষ্য কিঞ্চিৎ ব্যাকরণ জানত বলে ওই বিষয়ে পড়াতে তার বাধো বাধো ঠেকত। পিথৌরার কি সেরকম কোনও কিছু আছে?
সেই তো বেদনা, সুশীল পাঠক, সেই তো ব্যথা।
মা সরস্বতী সম্বন্ধে কোনও কিছু লিখতে বড় বাধো বাধো ঠেকে। চতুর্দিকে গণ্ডা গণ্ডা সরস্বতী পুজো হয়ে গেল। আমি গা-ঢাকা দিয়ে, কিংবা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।
আর কোনও দেবতার সেবা করার মতো সুবুদ্ধি আমার হয়নি প্রথম জীবনে মা সরস্বতীই আমার স্কন্ধে ভর করেছিলেন আর আমি হতভাগ্য তাঁর সেবাটা কায়মনোবাক্যে করিনি বলে আজ আমার সবকিছু ভণ্ডুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। এখন মা সরস্বতীর দিকে মুখ তুলে তাকাতেও ভয় করে। হায়, দেবীর দয়া পিথৌরার প্রতি হয়েছিল, কিন্তু মুখ তাঁকে অবহেলা করে আজ এই নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে।
হায়, আমি যদি আজ আমার এক বন্ধুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে পারতুম,
নিতান্ত বালক যবে পুরাণের দেব-সভাস্থলে
চুপে চুপে দেখিয়াছি ইন্দ্র যম বরুণের গলে
মন্দারের মালা আর হস্তে নানা রতন সম্পদ
বৈভব সৌন্দর্য কত। অপরূপ নর্ম লঘুপদ
উর্বশীর সম্মোহনী ইন্দ্রজাল নৃত্যচ্ছন্দময়
শুনেছি সুরের কণ্ঠে হর্ষধ্বনি আর জয় জয়।
লক্ষ্মীর বৈভব হেরি নিষ্কম্প তরুণ আঁখি মম,
মহেন্দ্র-অঞ্চলার পশ্চাতে ফিরিছে ছায়াসম।
হে পিথৌরা, আজি আমি লজ্জা নাহি মানি,
মুগ্ধ মোরে করেছিল সর্বাধিক শ্বেত বীণাপাণি।
কী মন্ত্রে সে ভানুমতী বালকের চিত্তাসনখানি
জয় করে নিয়েছিল; মর্ম তার আজও নাহি জানি।
ঊনবিংশ শতকের বাংলা দেশের প্রধান দার্শনিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পূজনীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কত যে এবং কী অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তার সন্ধান বাঙলা দেশ আজ আর রাখে না। অথচ সমসাময়িক যুগে বাঙলার জ্ঞান দর্শনশাস্ত্র চর্চার ওপর তিনি যে গভীর প্রভাব রেখে গিয়েছেন তা সে সময়ের যেকোনও লেখকের রচনা থেকে বোঝা যায়।
সেই দার্শনিককে এক ব্যক্তি বলেন, আপনার মতো পাণ্ডিত্য বাঙলা দেশের কারও নেই- একমাত্র আপনিই বাঙলায় মন্দাক্রান্তা ছন্দে কবিতা লিখতে সক্ষম।
দ্বিজেন্দ্রনাথ আপন পাণ্ডিত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে একখানি চতুষ্পদী মন্দাক্রান্তায় লেখেন।
ইচ্ছা সম্যক জগ দরশনে
কিন্তু পাথেয় নাস্তি
পায়ে শিকলি মন উড়ু উড়
এ কি দৈবের শাস্তি
টক্কা দেবী করে যদি কৃপা
না রহে কোনও জ্বালা
বিদ্যাবুদ্ধি কিছু না কিছু না।
শুধু ভস্মে ঘি চালা।
দ্বিজেন্দ্রনাথেরই যখন এই অবস্থা তখন আর আমাদের ভাবনা কী?
জয় মা বীণাপাণি!