রায় পিথৌরার কলমে – ২

২.

কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দপ্তরের প্রধান সেক্রেটারি ডক্টর তারাচান্দ ভারতীয় রাজদূতরূপে ইরান যাইতেছেন।

ডক্টর তারাচান্দ যুক্তপ্রদেশ তথা দিল্লি অঞ্চলে সুপরিচিত। সংস্কৃত, ফারসি আর উর্দু এই তিন ভাষাতে তাহার অসাধারণ পাণ্ডিত্য বহু বিদ্বজ্জনের প্রশংসা অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে। ভারতে মুসলিম সংস্কৃতির আবেদন সম্বন্ধে তিনি যে গবেষণা করিয়াছেন, তাহাতে যে শুধু তাহার পাণ্ডিত্যই প্রকাশ পাইয়াছে তাহা নহে– চিত্র, সঙ্গীত, নাট্যকলায় তাঁহার সূক্ষ্ম রসানুভূতি তাঁহার পুস্তকরাজিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করিতে সক্ষম হইয়াছে। দারাশিকুহর সম্বন্ধে তাহার প্রামাণিক প্রবন্ধ দেশে-বিদেশে অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করিয়াছে। পণ্ডিত তারাচান্দ শব্দ এবং ধ্বনিতত্ত্বে সুপণ্ডিত বলিয়া দারার যুগের সংস্কৃত উচ্চারণ কিরূপ ছিল তাহা তিনি দারাকৃত সংস্কৃত শব্দের ফারসি লিখন পদ্ধতি হইতে উদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছেন। তারাচান্দের সংস্কারবর্জিত মন হিন্দু-মুসলমান উভয় বৈদগ্ধ্যের সম্পূর্ণ সম্মান দিতে সক্ষম হইয়াছে।

ইরান এবং মিশরে এতদিন যাবৎ দুইজন মুসলমান ভারতীয় রাজদূত ছিলেন। কাজেই ওই দেশবাসীদের মনে এই ভুল ধারণা হওয়া অসঙ্গত নয় যে, ভারতবর্ষের হিন্দুরা বুঝি আরবি-ফারসির চর্চা করেন না এবং মুসলমানেরাও বুঝি সংস্কৃত, হিন্দি তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।

মৌলবি তারাচান্দ যখন উত্তম উচ্চারণ সহযোগে রুমি-সাদি, হাফিজ-আত্তারের বয়েত আওড়াইয়া ইরানের মজলিস-মুশায়েরা সরগরম করিয়া তুলিবেন তখন যে তিনি অকুষ্ঠ প্রশস্তিকীর্তন শুনিতে পাইবেন তাহার কল্পনা করিয়াও আমরা উল্লাস বোধ করিতেছি।

ডক্টর তারাচান্দের যাত্রা জয়যুক্ত হউক।

***

শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ছাত্র, নেপাল যাদুঘরের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ শ্ৰীযুত বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের চিত্রপ্রদর্শনী দিল্লিতে সুরসিকজনের প্রশংসা অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।

হিন্দুর যেমন শাক্ত-বৈষ্ণব, মুসলমানের যেমন শিয়া-সুন্নি, ইংরেজের যেমন লেবার কনসারভেটিভ, দিল্লির তেমনি অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস্ সোসাইটি এবং শিল্পীচক্র। প্রথমটি আভিজাত্যাড়ম্বরে আমন্ত্রিত। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং অত্যন্ত অনটনের সময় অর্থমন্ত্রী ইঁহারাই এই প্রতিষ্ঠানের শিল্পপ্রদর্শনী উপলক্ষে হোতা হইবার অধিকার ধারণ করেন। বিদেশাগত যাবতীয় রাজদূতমণ্ডলী, তাহাদের ভামিনীকামিনীগণ নগরশ্রেষ্ঠী, ধর্মাধিকারী এবং তাহাদের পুত্রকলত্র এইসব প্রদর্শনীতে যোগদান করিবার জন্য যেসব রথ আরোহণ করিয়া আগমন করেন একমাত্র সেইগুলিকেই পরিবেক্ষণ করিবার জন্য রবাহূত অনাহূতগণ যজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে দ্বিতীয় শিল্পপ্রদর্শনীর আয়োজন করিয়া ফেলে।

উত্তম উত্তম চিত্র প্রদর্শিত হয়। দৈনিক মাসিক সর্বত্র সাধুবাদ মুখরিত হইয়া উঠে। নিজেকে ধন্য মনে করি। সার্থক আমাদের দিল্লিবাস!

আর শিল্পীচক্র নিতান্তই অঘ্রাহ্মণ শ্রেণির জনপদ প্রচেষ্টা। ইহাতেও উত্তম উত্তম চিত্র প্রদর্শিত হয়। মন্ত্রিবর্গ সচরাচর এই স্থলে আগমন করিবার সময় করিয়া উঠিতে পারেন না, তবে বিদেশাগত রাজদূতমণ্ডলীর সুরসিক দর্শকেরা শিল্পীচক্রকে অপাঙক্তেয় করিয়া রাখেন নাই। অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া অতিশয় সৌজন্যের সঙ্গে জীর্ণবাস শিল্পীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেন। তাঁহাদের ললনাগণ উদার স্মিতহাস্যে শিল্পীকে আপ্যায়িত করেন।

দুইটি প্রতিষ্ঠানই দিল্লিনগরের জন্য প্রয়োজনীয়। উভয়েই আপন আপন আদর্শ পালন করিবার চেষ্টা করিতেছেন।

অর্থাভাবে শিল্পীচক্র অনেক সময় আপন প্রদর্শনীগুলিকে অনাড়ম্বর এমনকি জীর্ণ বেশে পরিবেশন করেন। রসিকজন তাহাতে দুঃখিত হন, কিন্তু বিচলিত হন না। কদলীপত্র অতিথি-সেবকের দৈন্যের পরিচয় দিতে পারে সত্য, কিন্তু তাই বলিয়া কদলীপত্রে আতপান্ন ভক্ষণ বিস্বাদ প্রতীয়মান হয় না, কিন্তু সে দৈন্য রুচিহীনতার পরিচয় দেয় না। বিনোদবিহারীর চিত্র চিত্র-বিচিত্ররূপে পরিবেশিত হয় নাই। রসিকজন তাহাতে বিন্দুমাত্র চিত্তচাঞ্চল্য প্রকাশ করেন নাই। তাহার কলাপ্রচেষ্টা অনায়াসে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।

কিন্তু এই সংসারে কাণ্ডজ্ঞানহীনেরও অভাব নাই। রসবোধ তাহাদের নাই জানি কিন্তু কিঞ্চিৎ বুদ্ধি থাকিলে অরসিকজন আপন রসহীনতা প্রকাশ করে না। এস্থলে যে ব্যক্তি বিনোদবিহারীর নিন্দা করিয়াছেন তিনি রস হইতে বঞ্চিত সে তত্ত্ব আমরা বিলক্ষণ জানি, কিন্তু তিনি যদি ভাষণ না করিতেন, তবে হয়তো পণ্ডিতরূপেই শোভাবর্ধন করিতেন। তাহাতে আমাদের কিছুমাত্র আপত্তি নাই; শুধু যে নগরে গুণীজনের অহেতুক নিন্দা হয় সে নগরের নাগরিকমাত্রই নিজেকে বিড়ম্বিত মনে করেন।

***

কলিকাতা মহানগরীতে ফুটবল খেলা দেখিবার মতো ধৈর্য এবং শক্তি আমার আর নাই এবং দিল্লি শহরে দেখিবার মতো প্রবৃত্তিও নাই।

এক বন্ধু বলিলেন, বিবেচনা করে এই রাজস্থান এবং পূর্ববঙ্গের মল্লযুদ্ধ যদি তুমি দেখিতে চাও তবে তোমাকে অন্ততপক্ষে তিনশটি রৌপ্যমুদ্রা ব্যয় করিয়া কলিকাতা গমনাগমন করিয়া তাহা দেখিতে হইবে। অপিচ, উভয়পক্ষের যুযুধান ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে সমবেত। দিল্লীশ্বর বা জগদীশ্বর বলিলে যেখানে সামান্যতম অতিশয়োক্তি হয় মাত্র সেই রাষ্ট্রপতি সশরীরে উপস্থিত থাকিয়া ক্রীড়াজনিত ক্ষাত্রধর্মের উৎসাহ উদ্দীপনা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিবেন, সে স্থলে তুমি ন্যূনাধিক তিনটি রৌপ্যমুদ্রা ব্যয় করিতে কুণ্ঠা বোধ করিতেছ? হা ধর্ম! ঘোর কলিকাল! ধিক্ তোমাকে!

সবিনয় প্রশ্ন করিলাম, মূল্য-পত্রিকা ক্রয় করিবার জন্য কত প্রহর পূর্বে কুরুক্ষেত্রের প্রধান তোরণে উপস্থিত হইতে হইবে?

সবিস্ময়ে উত্তর করিলেন, এ কী বাতুলের প্রশ্ন? অর্ধঘণ্টাই প্রশস্ত।

এই সুসংবাদ শুনিয়া চিত্তে পুলক সঞ্চারিত হইল না। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের পীঠস্থান কলিকাতা নগরে মল্লযুদ্ধ দেখিতে হইলে দ্বাদশপ্রহর পূর্বে মৃতলবণ তৈলতণ্ডুলবস্ত্রইন্ধন বন্ধুবান্ধবসখাসজ্জন লইয়া উপস্থিত হইতে হয়, আর এই মহানগরী ইন্দ্রপ্রস্থে মাত্র অর্ধঘণ্টা।

আমার দ্বিধা অমূলক নহে। ইন্দ্রপ্রস্থের সজ্জনগণ মক্রীড়া নিরীক্ষণ করিলেন, ঈষৎ উত্তেজিত হইয়া করতালি দিলেন, যত্রতত্র অবান্তর সমালোচনা করিলেন, ভদ্রজনোচিত পদ্ধতিতে উভয় পক্ষের মঙ্গল কামনা করিলেন এবং ক্রীড়াশেষে দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা সুখে বিগতস্পৃহ মুনিজনের ন্যায় শান্তসমাহিত চিত্তে স্ব স্ব ভবনে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

এইবার আমি বলিলাম, হা ধর্ম। বিকট চিৎকার, ছত্রহস্তে লম্ফঝম্প, শ্রাবণের বারিধারার মতো শোকাশ্রু আনন্দবারি বর্ষণ, মল্লবিশেষের নামোল্লেখ করিয়া তীব্রকণ্ঠে তাহার চতুর্দশ পুরুষকে অভিসম্পাত, পার্শ্বে দণ্ডায়মান, বিপক্ষানুরাগীকে নিদারুণ চপেটাঘাত, ফলস্বরূপ অনুরাগীদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ, তস্য ফলস্বরূপ ছত্র ও পাদুকা ক্ষয়, রক্তপাত অঙ্গাঘাত, গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর জয়ী হইলে সন্দেশ বিতরণ, পরাজিত হইলে গৃহিণীকে কটু বাক্যবৰ্ষণ

কিছুই না?

এবম্বিধ ক্রীড়া দর্শনে কালক্ষেপ করে কোন সুরসিক?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *