রায় পিথৌরার কলমে – ১৯

১৯.

পূর্ব-পশ্চিমের বহু গুণী-জ্ঞানী দার্শনিক-পণ্ডিতজন দেহলি-প্রান্তে সমবেত হইয়া সপ্তাহাধিককাল মানবের মূল্য ও শিক্ষা-দর্শন সম্বন্ধে বহুমুখী আলোচনাকরতঃ স্ব স্ব দেশে প্রত্যাগমন করিয়াছেন– কেহ কেহ ভারতভ্রমণে বহির্গত হইয়াছেন।

চরম সত্য ভঙ্গের প্রাক্কালে সমবেত দার্শনিকমণ্ডলী একবাক্যে স্বীকার করেন, পূর্ব ও পশ্চিমের চিন্তাধারা এবং জীবনদর্শনে কোনওপ্রকারের দ্বন্দ্ব কিংবা অন্তর্নিহিত পার্থক্য নাই।

তৎসত্ত্বেও আমার মনে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ দ্বিধা রহিয়া গিয়াছে। কিন্তু সে তত্ত্ব এস্থলে সবিশদ আলোচনা না করিয়া অন্য একটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

পূর্ব-পশ্চিমের স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য আছে সেকথা স্বীকার করিয়া লইলেও তো কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। আমরা ইউনিটি বা ঐক্যের সন্ধান করিতেছি– সমতা বা ইউনিফর্মিটি আমাদের কাম্য নহে। বঙ্গবাসী পাঞ্জাববাসীর ন্যায় রুটি এবং মাংস না খাইলে কি উভয়ের ঐক্য অসম্ভব? বরঞ্চ বলিব, পাঞ্জাবি এবং বাঙালি উভয়েই আপন আপন বৈশিষ্ট্য স্বীকার করিয়া আপন মনীষার নব নব বিকাশ নব নব উন্মেষণ করিয়া যদি বৃহত্তর ঐক্যে সম্মিলিত হয়, তবে সেই ঐক্যই হইবে সত্য ঐক্য।

প্রাচ্য-প্রতীচ্য সেইরূপ যদি আপন আপন বৈশিষ্ট্য রক্ষা করিয়া সহযোগিতা করে, তাহাতেই তো বৃহত্তর মঙ্গল; বরঞ্চ বলিব, একে অন্যের অণুকরণ করিয়া করিয়া ক্ষুদ্র সমতার সন্ধান করিলে উভয়ই আপন আপন ঐতিহ্যভ্রষ্ট হইয়া আড়ষ্ট এবং ক্লীব দর্শনের পীড়াদায়ক পুনরাবৃত্তি করিবে মাত্র।

***

জনৈক ফরাসিস দার্শনিক বলিলেন, প্রাচী বরঞ্চ প্রতীচী সম্বন্ধে বহু জ্ঞান ধারণ করে, কিন্তু প্রতীচী সেই অনুপাতে প্রাচীর অল্প পরিচয় লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছে।

আপাতদৃষ্টিতে তাহার মনে হয়। কারণ যেসব ভারতীয় পণ্ডিত এই দার্শনিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তাহাদের অনেকেই বহু বৎসর ইয়োরোপে বিদ্যাভ্যাস করিয়াছেন এবং সেই সূত্রে ওই মহাদেশ সম্বন্ধে নানাপ্রকারের তত্ত্ব এবং তথ্য সঞ্চয় করিয়া স্বদেশপ্রত্যাগমন করিয়াছেন। কিন্তু প্রশ্ন, মাক্স মুলার, যাকোবি, লেভি, উইন্টারসিস, গেল্ডনার এবং পূর্ববর্তী যুগে যেসব ইয়োরোপীয় পণ্ডিত ভারতবর্ষে বাস করিয়া বহু সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করিয়া উত্তম উত্তম সংস্করণে প্রকাশ করিলেন; কানিংহাম, ফাগুসন, স্টিফেন, হেভেল ভারতীয় কলা সম্বন্ধে যে প্রকারের গবেষণা করিলেন, সেই তুলনায় কয়জন প্রাচ্য দেশবাসী গ্রিক কিংবা লাতিন পুস্তকের চর্চা করিয়া ইয়োরোপীয়দিগকে জ্ঞান দান করিয়াছেন? কয়জন ভারতীয় কিংবা চৈনিক বিদগ্ধ ব্যক্তি ইয়োরোপীয় কলার ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে প্রামাণিক এবং সর্বাঙ্গসুন্দর পুস্তক লিখিতে সক্ষম হইয়াছেন? ব্যোটলিঙ্ক-রোই যে বিরাট সংস্কৃত অভিধান প্রণয়ন করিয়া গিয়াছেন, সেই জাতীয় গ্রিক অভিধান যখন ভারতে রচিত হইবে বুঝিব আমরা সত্যই প্রতীচ্য বৈদগ্ধ্যের কিঞ্চিৎ সন্ধান পাইয়াছি।

***

এই হেমন্ত শিশিরে দেহলি-প্রান্তে যেসব কলা প্রদর্শনী দেখিলাম, তাহার মধ্যে দুইজন চিত্রকরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য– শ্ৰীযুত বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও শ্ৰীযুত অবনী সেন।

শ্ৰীযুত অবনী সেন গত সপ্তাহে তাঁহার বিগত কয়েক বৎসরের চিত্রকলা দেহলি-প্রান্তে উপস্থিত করিয়াছেন এবং সেইগুলি দেখিয়া বহু গুণী মুগ্ধ হইয়াছেন।

অবনী সেন সরল এবং অনাড়ম্বর চিত্রকার। তিনি জীবজন্তু, প্রকৃতি, পুরুষ-নারী দেখিয়াছেন অতিশয় সযত্নে এবং সেইগুলির প্রকাশ দিয়াছেন নিজস্ব সরল পদ্ধতিতে। সুদ্ধমাত্র মনোরঞ্জন করিবার জন্য কিংবা আর্টিস্টিক হইবার জন্য তাঁহার চিত্রে কোনওপ্রকারের ছলনা নাই। দিল্পি নগরীতে এ বড় বিস্ময়কর বস্তু। সামান্য দুই-তিনটি প্রদর্শনী ব্যত্যয়রূপে বিচারাধীন না করিলে অধিকাংশ স্থলেই দেখিয়াছি কেহ করিতেছেন মাতিসের নকল, কেহবা সেজানের, কেহবা ভানগগের। তবুও ঈষৎ সান্ত্বনা পাইতাম যদি ইহারা সত্যই পূর্বোল্লিখিত কৃতী পূরুষগণের অনুকরণ করিতেন। আমার মনে হয় ইহারা তাঁহাদিগের সত্য বৈশিষ্ট্য সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হন নাই, ইহারা অনুকরণ করিয়াছেন এইসব গুণীদের অবান্তর অংশগুলিকে। শুনিয়াছি শিলার নাকি ডেস্কে গলিত আপেল না রাখিলে কবিতা রচনা করিতে পারিতেন না। দিল্লিতে প্রদর্শিত অধিকাংশ চিত্রকারের চিত্রে গলিত আপেলের দুর্গন্ধ পাইয়া সন্দেহ হইল উঁহারা শিলারের অনুকরণ করিয়াছে– শিলারের প্রতিভার সন্ধান ইঁহারা পান নাই, কিংবা বলিব, অশ্বত্থামার ন্যায় পিষ্টতণ্ডুল দর্শনে উদ্বাহু হইয়া নৃত্য করিয়াছেন।

সাহিত্যে এই কর্ম অহরহ হইতেছে– তাহার সন্ধান সকলেই রাখেন, কিন্তু চিত্রে এই দুষ্কর্ম মর্মান্তিকরূপে শশিকলার ন্যায় বৃদ্ধি পাইতেছে।

তাই নিবেদন করিতেছিলাম, অবনী সেন কোনও গলিত আপেলের সন্ধানে কালক্ষয় করেন নাই। বিচিত্র পৃথিবীকে তিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, সেই দর্শন তাঁহার হৃদয়ের যে অনুভূতি যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়াছে, তিনি তাহারই প্রকাশ দিয়াছেন কোনও প্রকারের ছলনা না করিয়া।

এই প্রশস্তিই যথেষ্ট।

***

কলিকাতা মহানগরী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন বৈদেশিকদের যেসব প্রতিমূর্তি আমাদিগের নগরে নগরে বিরাজ করিতেছে ইহাদিগকে লইয়া আমাদের কর্তব্য কী? এই প্রশ্ন দিল্লিতেও উপস্থিত হইয়াছে।

কেহ বলিতেছেন, এইগুলোকে কোনও যাদুঘরে রাখিয়া দেওয়াই প্রশস্ততম পন্থা।

কেহ বলিতেছেন, তাহা হইলে ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকগণের মূল্যবান তথ্য আহরণের সূত্র বিনষ্ট করা হইবে।

কেহ বলিতেছেন, এইগুলি স্থানান্তর করিতে যথেষ্ট অর্থব্যয় হইবে এবং যে বিরাট ভাণ্ডার ইহাদিগের জন্য নির্মাণ করিতে হইবে তাহার জন্য অর্থব্যয় এক গৌরী সেনেই সম্ভবে।

কেহ বলিতেছেন, এইগুলিকে ইংলন্ডে পাঠাইয়া দাও। ইহারা ইংলন্ডের কৃতী সন্তান; স্ব স্ব নগরে ইঁহারা প্রাতঃস্মরণীয় এবং প্রাতর্দর্শনীয় হইয়া বিরাজ করুন।

এই ইন্দোনেশিয়ান বান্ধব আমাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, আপনারা বৈদেশিকদের এই প্রতিমূর্তিগুলি সহ্য করিতেছেন কেন?

আমি প্রশ্ন করিলাম, আপনারা ওলন্দাজ প্রতিমূর্তিগুলির কী ব্যবস্থা করিয়াছেন?

 মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, দণ্ডাধিককাল মধ্যেই চূর্ণবিচূর্ণ করিয়াছি।

***

স্বীকার করি বৈদেশিকের প্রতি কিংবা তাহাদের প্রতিমূর্তির প্রতি আমার এইরূপ জাতক্রোধ সহজে উপজাত হয় না। ভিনাস কিম্বা মজেসের প্রতিমূর্তি দেখিয়া আনন্দ পাই, কোনওপ্রকারের ক্রোধ চিত্তকোণ স্পর্শ করে না।

কিন্তু এই প্রতিমূর্তিগুলি যে অত্যন্ত কুৎসিত। যত দিন পর্যন্ত এই প্রতিমূর্তিগুলি নগরে নগরে বিরাজমান থাকিবে ততদিন আমাদের ভবিষ্যৎ ভাস্করদের সুরুচি নির্মাণের পক্ষে ইহারা নিদারুণ অন্তরায়– ফিল্মি গানা যেরূপ ইয়োরোপীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গ্রহণের পক্ষে অন্তরায় হইয়া রহিয়াছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যেরূপ ভারতীয় স্থপতির রুচি-বিকার ঘটাইতেছে। কিন্তু হায়, ফিল্মি গানা বন্ধ করিবার উপায় নাই, মেমোরিয়াল ধূলিসাৎ করিই-বা কী প্রকারে।

ঐতিহাসিকেরা যে এই প্রতিমূর্তিগুলি হইতে বহুতর গবেষণার উপাদান পাইবেন সেকথা অস্বীকার করি না, কিন্তু এ তথ্য অনস্বীকার্য যে, ইহাদের জন্য ভাণ্ডার নির্মাণ করা অর্থের অতিশয় অন্যায় অপব্যয়।

***

ইঁহারা স্বদেশে প্রত্যাগমন করিতে পারেন কি না সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা, ইংলন্ডমাতা ইঁহাদিগকে আপন বক্ষে স্থান দিবেন কি?

কারণ একদা একখানা বিরাট ইংলভীয় কামান– সেই কামান এই দেশে নাকি বহু শৌর্যবীর্য দেখাইয়াছিল– কোনও এক ইংরেজ মহাপ্রভুর উৎসাহে স্বনগরে প্রেরিত হয় এবং নগরের মধ্যবর্তী উদ্যানে প্রতিষ্ঠিত হয়। নগরবাসীগণ সেই বিকটদর্শন কামান দেখিয়া তদ্দণ্ডেই সে চক্ষুশূলকে অপসারণ করিবার জন্য তারস্বরে চিৎকার করে। বহু প্রকারে তাহাদিগকে বলা হইল, এই ভুবনবিখ্যাত কামান ভারতের অমুক দুর্গের প্রাচীর ভগ্ন করিতে সহায় হইয়াছে, অমুক নগরে শত শত ইংরেজের প্রাণরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে; এই কামানের জন্মস্থল এই নগর, অতএব এই নগর ইহাকে সম্মান না করিলে ইহার উপযুক্ত সম্মান করিবে কে?

কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। নাগরিকগণ দুর্যোধনের ন্যায় সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি দানে অনিচ্ছুক এবং কতিপয় পাষণ্ড বলিল, এই কামানের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে তাহারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং এই কামান কোথায় কোন অপকর্ম করিয়াছে তাহার লুপ্ত ইতিহাস জানিবার জন্য তাহারা কিছুমাত্র ব্যগ্র নহে।

অতএব আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা যদি এই প্রতিমর্তিগুলিকে ইংলন্ডকে সহৃদয়তার সঙ্গে দান করি তবে তাহারা সেগুলি স্বব্যয়ে লইয়া তো যাইবেই না, পরন্তু করুণকণ্ঠে বারম্বার নিবেদন করিবে, আপনারা না মহাত্মাজির শিষ্য; আমাদিগের গত অপরাধের জন্য কি এই প্রকারের নৃশংস প্রতিহিংসা লইতে হয়?

অতএব সেই শর্করায়ও মৃত্তিকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *