১৮.
বিদেশ থেকে মহামেহন্নত করে বিরাট বিরাট ছবি এদেশে এনে কেউ যদি প্রদর্শনী খোলে, তবে সে সম্বন্ধে সামান্যতম অপ্রিয় বাক্য বলতেও দ্রজনের বাধো বাধো ঠেকে। অথচ মৌনতা দ্বারা সম্মতি অর্থাৎ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলে যে-ভদ্র-মহোদয়গণ সোভিয়েট চিত্রপ্রদর্শনী খুলেছেন তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। আমরা যদি চুপ করে থাকি, তবে তারা ভাববেন এ ছবিগুলো আমাদের পছন্দ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধরনের ছবিই পাঠাবেন। আর আমরা যদি বলি, না, আমাদের প্রাণে এ ছবিগুলো কোনও স্পন্দন জাগাতে পারেনি, তবে হয়তো ভবিষ্যতে তাঁরা তাঁদের বিশাল ভাণ্ডার থেকে অন্য ধরনের ছবি পাঠাবেন।
***
স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ছবিগুলো ঘোর বস্তৃতান্ত্রিক বা রিয়ালিস্টিক। মুলত এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। রুশ বস্তৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রসঙ্, তার ছবি যে একদম বস্তুরূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে সেই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু প্রশ্ন বস্তৃতান্ত্রিক ছবি হলেই তাকে কি রঙিন ফটোগ্রাফি হতে হবে? প্রদর্শনীর অধিকাংশ ছবি তাই; এক শ বৎসর আগে, ইম্প্রেশনিজম আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ইয়োরোপীয় চিত্রকলার অবনতির যুগে, এরকম ছবি আঁকা হয়েছিল। ভারতবর্ষে রবি বর্মা এ ধরনের ছবি এঁকেই এদেশে নাম করেছিলেন। এসব ছবিতে মুন্সিয়ানা বিস্তর, খাটুনি এন্তার, কিন্তু এরা ছবির পর্যায়ে ওঠে না।
***
তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, রুশরা ভালো আঁকবার চেষ্টায় যে কাঠ-খড় পোড়াচ্ছে তার তুলনায় আমাদের অধিকাংশ চিত্রকররা কোনও মেহনতই করছেন না। ভালো করে লাইন টানার কিংবা তুলি ধরার পূর্বেই এঁরা সব সেজান গর্গা মাতিসের অতিশয় দুর্বল অনুকরণ করে অরিজিনাল ছবি আঁকতে আরম্ভ করে দেন। প্রকৃতি বা জীবজন্তু পর্যবেক্ষণ না করে, আপন হৃদয়ের জারক রসে সেটা না জারিয়ে নিয়ে তারা আকাশকুসুমবৎ কাল্পনিক অদ্ভুত অদ্ভূত জ্যুজানোয়ার বানাতে আরম্ভ করে দেন। সব ফাঁকি, সব ফকিকারি– পিছনে কোনও মেহন্নত নেই, কোনও সাধনা নেই।
রাশাতে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। মেহন্নত এবং উৎপাদনের মাপকাঠি দিয়ে সেখানে অর্থ এবং সম্মানের ওজন করা হয়।
রাশানরা খেটেছে, তাই ভবিষ্যতে এরা ভালো ছবি আঁকতে পারলে বিস্মিত হব না।
সর্বশেষ বক্তব্য, প্রদর্শনীতে উত্তম ছবিও কয়েকখানা আছে– জারের পূর্বেরও, পরেরও। তবে সেগুলো খুঁজে বের করতে হয়।
***
ইতোমধ্যে দিল্লিতে আর্ট নিয়ে গুটিকয়েক সম্মেলন হয়ে গেল। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, আমাদের জীবনের সঙ্গে আর্টের সম্পর্ক ক্রমেই ছিন্ন হয়ে আসছে এবং আমাদের উচিত আমাদের শিক্ষায়তনগুলোতে আর্ট শেখাবার সুব্যবস্থা করা।
***
আর্ট শেখানো উচিত–এ কথা বলতে গিয়ে কিন্তু অনেকেই দুটো জিনিস মিশিয়ে ফেলেন।
দেশসুদ্ধ লোককে ছবি আঁকতে কিংবা গান গাইতে (স্থাপত্য অর্থাৎ বিরাট বিরাট এমারৎ তৈরি করা শেখানোর কথাই ওঠে না) শেখানোর চেষ্টা করা ভুল- কোনও দেশ করেও না। কিন্তু এসব কলারস আস্বাদন করার শক্তি ও রুচি জন্মানো প্রত্যেক শিক্ষায়তনেরই কর্তব্য। এবং তার ব্যবস্থা আমাদের স্কুল-কলেজের কোথাও নেই। আমাদের স্কুল-কলেজের দেয়ালে অজন্তা, রাজপুত, মুগল কলা, ত্রিমূর্তি, নটরাজ, কনারক খাজুরাহো, কুত্ত্ব তাজের ফটোগ্রাফ টাঙানো থাকে না; কাজেই সেগুলোতে কী কলারস রয়েছে সেকথা মাস্টার-অধ্যাপক কাউকেই বুঝিয়ে বলতে হয় না।
আমাদের তাবৎ ঝোঁক সাহিত্যের দিকে। গদ্য এবং পদ্যে কী রস কোথায় লুকোনো আছে, আমাদের শিক্ষকরা সেটা পই পই করে বোঝান, শুকনো চসার পর্যন্ত আমাদের বাধ্য হয়ে চিবোতে হয়, এসব বিষয়ে রচনা লিখতে হয় ও সাহিত্যের ইতিহাস কণ্ঠস্থ করতে হয় (কবিতা কী করে লিখতে হয় তার তালিম অবশ্য দেওয়া হয় না– লাতিন স্কুলে যেরকম লাতিন পদ্য এবং টোলে যেরকম সংস্কৃত পদ্য রচনা করতে শেখানো হয়)। বহু বৎসর ধরে এই কর্ম চলে এবং শেষটায় কেউ কেউ সাহিত্যানুরাগী হন। যারা স্কুল-কলেজে থাকাকালীন, কিংবা ছাড়ার পর, কবিতা লেখেন সেটা প্রধানত নিজের চেষ্টার ফলে– স্কুল-কলেজের তালিম দেওয়ার ফলে নয়।
কিন্তু প্রশ্ন, সাহিত্য ভিন্ন অন্য বস্তুতে শিক্ষা দেবে কে?
***
কালই একজন খ্যাতনামা ভারতীয় ঐতিহাসিকের লেখা একখানা ভারতের ইতিহাস পড়ছিলুম। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বে অসাধারণ পণ্ডিত; কাজেই ভারতের প্রতি যুগের এই তিন বস্তু তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোচনা করেছেন। কোন ভ্রাম্যমাণের রোজনামচা কতখানি বিশ্বাস করা যায়, কোন মুদ্রা থেকে কতখানি ইতিহাস নিংড়ে বের করা যায়, পূর্বাচার্য ঐতিহাসিকগণের মধ্যে কে কতখানি বিশ্বাস্য কতখানি অবিশ্বাস্য এসব তত্ত্ব তিনি সূক্ষ্ম চালনির ভিতর দিয়ে বারবার চালিয়ে নিয়ে খাঁটি মাল পরিবেশন করেছেন।
কিন্তু প্রতি অধ্যায়ের পর যখন ওই যুগের শিল্পকলা নিয়ে তিনি আলোচনা আরম্ভ করেন তিনি আর পূর্ববর্ণিত অতি সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে আলোচনা ফাঁদেন না। তখন শুধু অ্যাজ ফাসন সেজ কিংবা একর্ডিং টু কানিঙহাম অথবা কার স্টিফেন ইজ রাইট হুয়েন হি সেনটেনস। তার নিজের কিছু বক্তব্য নেই।
আমি একথা বলব না, আমাদের ঐতিহাসিকের কোনওপ্রকার আপন রসবোধ নেই। সাহিত্যরস তার দিব্য আছে, ভাস-কালিদাস সম্বন্ধে তিনি সূক্ষ্ম পদ্ধতিতেই আলোচনা করেছেন; অর্থাৎ তিনি যৌবনের যে শিক্ষা ও রুচির তালিম পেয়েছিলেন তার বিকাশ করে উত্তম ইতিহাস লিখেছেন। কিন্তু চারুশিল্প বাবদে তিনি কখনও কোনও তালিম পাননি বলে ভারত-ইতিহাসের সেই সুবৃহৎ–হয়তো সর্বোত্তম অধ্যায় তিনি লিখতে পারেননি।
তাই প্রশ্ন, চারুকলার ইতিহাস (হিস্ট্রি) পাব কবে?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্রাজুয়েট বিভাগে আর্ট হিস্ট্রি পড়াবার সুব্যবস্থা আছে। প্রতি বৎসর কয়েকটি ছেলেমেয়ে এ বিষয় অধ্যয়ন করে ডিগ্রি নেন একটি মিশরি ছেলে সরকারি বৃত্তি পেয়ে এ বিষয়ে পড়তে কলকাতা এসেছে এবং খুব সম্ভব পরে বেকার থাকে।
আমার মনে হয় আর্ট হিস্ট্রি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই পড়ানো উচিত। লজিক, সংস্কৃতের ন্যায় যে কোনও ছেলে যেন বিষয়টি বেছে নিতে পারে। যারা এতে অনার্স নেবে তারা যেন জেনারেল আর্ট হিস্ট্রির কোনও বিশেষ অংশ– সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি যে কোনও একটি বিষয় নিয়ে গভীরতার চর্চা করে।
এইসব গ্রাজুয়েট পরবর্তীকালে স্কুল-শিক্ষকের কর্ম নিলে সেখানে অনায়াসে কলাচর্চার গোড়াপত্তন করতে পারবেন।
***
দিল্লি সম্মেলনে স্কুলের ড্রইংমাস্টারদের নিন্দে করা হয়েছে। জানি, সম্মেলন যা বলেছেন সেসব অতি খাঁটি কথা কিন্তু তবু আমার বেদনা বোধ হল।
ছেলেবেলায় যে দুটি ড্রইংমাস্টার আমাদের ছবি আঁকা শেখাতেন তারা রাফায়েল-টিশিয়ান ছিলেন না; এমনকি আজ বুঝতে পারি, তারা উত্তম ছবির আদর্শ বলতে রঙিন ফটোগ্রাফই বুঝতেন– তখনও অজন্তা-মুগল আমাদের ক্ষুদ্র মহকুমা শহরে এসে পৌঁছয়নি।
সেজান চিত্রকর, জোলা সাহিত্যিক। এঁর ছবি ওঁর চিন্তাধারাকে, ওঁর চিন্তাধারা এঁর ছবির ওপর প্রভাব বিস্তার করে অপূর্ব সৃষ্টির সহায়তা করেছিল।
আমার ড্রইংমাস্টাররা সংস্কৃত এবং ফারসির শিক্ষকদের মতো অবহেলিত, অনাদৃত ছিলেন।
এঁরা যদি কোনও কলা-ঐতিহাসিক শিক্ষকের দিগদর্শন পেতেন, তবে ভ্রান্তপথ বর্জন করে আমাদের ঐতিহ্যগত কলা-সৃষ্টির নির্মাণে নিজেকে অতি সহজে নিয়োজিত করতে পারতেন এবং তাতে করে এঁদের জীবন সার্থক হত।
সবাই অবহেলা করে এদের বলত পটুয়া– এমনকি সহকর্মীগণও এদের সঙ্গে ব্যবহার করতেন এমনভাবে যেন এঁরা ব্রাত্য, অপাঙক্তেয়– যোগাযোগের ফলে জাতে উঠেছেন। ডাঙায় নগণ্য মাইনে, জলে অবহেলা– শেষটায় একজন ঢাকার থিয়েটারের সিন এঁকে আর সব মাস্টারদের পয়সার দিক দিয়ে কানা করে দিলেন। কিন্তু আমি জানি, তিনি সুখী হননি। আমাকে তিনি স্নেহ করতেন; নিজে সেকথা বলেছেন। আজ বুঝতে পারি, কেন তিনি সুখী হননি।
রঙিন ফটোগ্রাফ হোক কিংবা আর যাই হোক, যখন তিনি মাস্টার ছিলেন, তখন তার একটা আদর্শ ছিল, স্টেজের সিন আঁকতে সে আদর্শটি লোপ পেল পেলেন তিনি টাকা।
***
বহু বহু বৎসর পরে আমি বার্লিন শহরে কয়েক মাস বাস করেছিলাম। সেখানে কয়েকজন মেধাবী চিত্রকরের সঙ্গে হৃদ্যতা হয়। এদের একজন আমার ঘরে এ-বই ও-বই নাড়াচাড়া করছেন। তার ভিতর ছিল চয়নিকা– ওই একখানা বই আমি সবসময়ই বিদেশে সঙ্গে নিয়ে যেতুম, বিস্তর বই নিয়ে যাবার উপায় নেই বলে।
সে বইয়ের প্রথম সাদা পাতায় আঁকা ছিল আমার ড্রইংমাস্টারের আপন তুলিতে আঁকা সূর্যোদয়।
আমার জার্মান আর্টিস্ট বন্ধু হতবুদ্ধি হয়ে সে ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, হোয়াট এ রটন পেন্টিং– বাট হোয়াট মাস্টারি অভার টেকনিক!