রায় পিথৌরার কলমে – ১৭

১৭.

ভারতীয় পার্লামেন্টের বাঙালি সদস্যগণকে নয়াদিল্লির কালীবাড়ি গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিশেষ সভায় আমন্ত্রণ করে অভিনন্দিত করেন। উল্লেখ প্রয়োজন নিমন্ত্রিত বাঙালিগণ সকলেই বঙ্গবাসী নন, এদের কেউ কেউ বাঙলা দেশের বাইরে থেকে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসন পেয়েছেন। তাছাড়া বাঙলা ভাষাভাষী উড়িয়া বিহারি আসামি সভ্যদেরও আমন্ত্রণ করা হয়েছিল এবং তাদের কেউ কেউ সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন এবং নিমন্ত্রিত সদস্যগণকে মাল্যদান করত একে একে সভার সঙ্গে পরিচিত করান।

এই উপলক্ষে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা কালীবাড়ির নতুন পুস্তকালয় এবং পঠনগৃহের দ্বার উন্মোচন করেন।

শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ বলেন, বাঙালির আজ দুর্দিন বাঙলার সামনে আজ নানা কঠিন। সমস্যার উদ্ভব হয়েছে এবং সেগুলো সমাধান করতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত কিংবা দলগত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সুদ্ধমাত্র খাঁটি বাঙালিরূপে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। এবং এ কর্মে যে শুধু বাঙালিই যোগ দেবেন তাই নয়; বিহার, উত্তর প্রদেশের বাঙালিরাও তাদের সহযোগিতা দেবেন।

শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ আরও বলেন, ভারতের ইতিহাস এবং ভাগ্য নির্মাণে বাঙালির দান নগণ্য নয়; আজ যদি বাঙালি তার দুরূহ সমস্যাগুলোর সমাধান না করতে পারে তবে যে শুধু বাঙালিই লোপ পাবে তা নয়, তাতে করে সমস্ত ভারতবর্ষ দুর্বল হয়ে পড়বে। (বাঙলা শর্টহ্যান্ড জানিনে, কাজেই প্রতিবেদনে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে আশাকরি বক্তা অপরাধ নেবেন না।)

এ তো অতি খাঁটি কথা– একথা অস্বীকার করবে কে?

কিন্তু প্রশ্ন আমাদের সমস্যাগুলো কী, এবং তার সমাধানই-বা কী? ডা. শ্যামাপ্রসাদ যদি সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন তবে আমরা উপকৃত হতুম। তবে হয়তো প্রীতিসম্মেলন দীর্ঘ ভাষণের উপযুক্ত স্থান নয় বলেই তিনি এ নিয়ে সবিস্তর আলোচনা করেননি। কিন্তু তবু অধমের বক্তব্য, অন্যত্র শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ যেসব ভাষণ দেন সেগুলো তিনি তার দলের মতবাদের দৃষ্টিবিন্দু থেকেই দিয়ে থাকেন। তারই কথামতো তিনি যদি খাঁটি বাঙালি হিসেবে নিরপেক্ষ বক্তৃতা দিতেন তবে আমরা অর্থাৎ যারা কোনও দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নই– উপকৃত হতুম। শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে দিল্লিবাসী বাঙালিগণকে নিরাশ করবেন না।

রায় পিথৌরার কথায় কেউ বড় একটা কান দেয় না– আর দেবেই-বা কেন, সে তো আর কেষ্ট-বিটু কেউ-কেডা নয়– এবং তাই সে বড় খুশি। সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সে তাই তখন পরমানন্দে যাচ্ছেতাই (হায়, যদি ঠিক যা ইচ্ছা তাই ঠিক ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারতুম তবে তো এতদিনে দেশবিদেশে কবি, সাহিত্যিক হিসেবে নাম করে ফেলতে পারতুম– দু পয়সা ভি আসত) বলে যায় এবং তারই মতো আরও কয়েকজন দায়িত্বহীন পাঠক সেগুলো পড়ে বলে, ঠিক বলেছ। এদেরই জন্য আমি কলম ধরি; তাই আমার মনে হয় স্বাধীনতার পর বাঙলার আকার ছোট হয়ে যাওয়াতে আমাদের নতুন সমস্যার অন্ত নেই।

তাই দেখতে হবে বাঙলার আয়তন কী প্রকারে বাড়ানো যায়।

ভাষার ভিত্তিতে ভারতীয় প্রদেশগুলোকে যদি নতুন করে গড়ে তোলা হয় তবে বাঙলার আয়তন বাড়বে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

কিন্তু তার বিরুদ্ধেও যুক্তি আছে।

বাঙলার বাইরেও বাঙালি সংস্কৃতির স্থান আছে। একথা কে না জানে, উড়িষ্যা, আসাম ও পূর্ব বিহারের শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই উত্তম বাঙলা জানেন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সঙ্গে তাঁরা সুপরিচিত, তাঁদের বাড়ির মেয়েরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গান এবং এসব প্রদেশের অশিক্ষিত জনও বাঙলা ফিল্ম দেখে।

আজ যদি এইসব প্রদেশের বাঙলাভাষী অঞ্চলগুলো বাঙলাকে দিয়ে দেওয়া হয় তবে বহু বাঙলাপ্রেমী বিহারি, আসামি এবং উড়িষ্যাবাসী আমাদের ওপর বিলক্ষণ রেগে যাবেন এবং ক্রমে ক্রমে সেই রাগের বশে বাঙালি সংস্কৃতি বর্জন করতে আরম্ভ করবেন।

এই পরিস্থিতির কথা ভাবলেই আমি বড্ড ভয় এবং ক্লেশ পাই।

কারণ বাঙলা দেশের পরিমাণের চেয়েও আমি বহু বহু গুণে বেশি মূল্য দিই বাঙালি সংস্কৃতির পরিব্যাপ্তিকে। আমার ধ্যানের বাঙলা বাঙলা দেশে সীমাবদ্ধ নয়– পশ্চিমবাঙলার গুটিকয়েক জেলাই তার বিহার-ভূমি নয়— আমার ধ্যানের বাঙলা আসাম, বিহার, উড়িষ্যার সুদূরতম প্রান্ত অবধি– না, কম বলা হল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, দিল্লি, জয়পুর যেখানেই বাঙলা সংস্কৃতির ছাপ পড়েছে, ছায়া পড়েছে, সেখানেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাঙলা। পূর্ব-বাংলাও তাই এ ধ্যানের বাঙলার ভিতরে।

টমাস মান যখন যুদ্ধের পর বিভক্ত জৰ্মনির পশ্চিমাঞ্চলে নিমন্ত্রিত হন তখন তাঁকে জিগ্যেস করা হয়েছিল তিনি পূর্বাঞ্চলেও যাবেন কি না? উত্তরে মা বলেছিলেন, যেখানেই জর্মন সংস্কৃতি সম্মান পায় সেখানেই আমার মাতৃভূমি।

এই ধ্যানের বাঙলা যেন বিনষ্ট হয়।

জমিদারি বাড়ানো ভালো কিন্তু জমিদারি বাড়াতে গিয়ে যদি হাজার হাজার মিত্রকে শত্রু করতে হয়, তাঁদের সঙ্গে যদি আমার আহার-বিহার বন্ধ হয়ে যায়, তারা যদি আমার সভ্যতা সংস্কৃতির চর্চা বর্জন করেন তবে দেখতে হবে, ভাবতে হবে, আমার কর্তব্য কী?

ওদিকে মানভূমি, সিংভূমের বাঙালির প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ ধর্মবোধও আছে। কোনও কোনও অদূরদর্শী বিহারিরা নাকি ওইসব অঞ্চল থেকে বাঙলা চর্চা তুলে দিতে চান– আমি হলফ করে কিছু বলতে পারব না, কারণ ওসব অঞ্চলে গিয়ে উকট সব সমস্যার সম্মুখীন হবার দায় থেকে শ্রীগুরু আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন; তাই যদি হয় তবে সেই-বা চোখ কান বন্ধ করে সয়ে নেব কী প্রকারে?

এই পিনসার মুভমেন্টের সামনে আমি হিমশিম খেয়ে গিয়েছি।

 কিন্তু ঠিক এইখানেই তো পিথৌরাতে-শ্যামাপ্রসাদে তফাত। এ সমস্যার সমাধান পিথৌরা জানে না, দায়ও তার নয়; শ্যামাপ্রসাদ যদি শ্যামার প্রসাদ পান তবে সমস্যা-সমাধান করতে পারবেন বলে আশাকরি। না হলে নেতা হলেন কেন?

তবে শেষ কথা এই : তিনি নিজেই যা বলেছেন সেইটাই সত্যি। এ সমস্যার সমাধান তাঁকে করতে হবে তাঁর পার্টিগত দৃষ্টিবিন্দু বর্জন করে, একদম হানড্রেড অ্যান্ড টেন পার্সেন্ট নির্জলা, নির্ভেজাল খাঁটি বাঙালিরূপে।

এবং শ্যামাপ্রসাদের বাঙালিত্ব সন্দেহ করবে কে? যদি কেউ করে, তবে বিদ্যেসাগর মহাশয়ের ভাষাতে বলি (সাবধান, চ্যালেঞ্জ করবেন না, আমি গেল কয়েক মাস ধরে শুধু বিদ্যাসাগরই পড়েছি), তার বাপ নির্বংশ হোক!

বাঙালিকে একথা ভুললে চলবে না, সে বাঙালি। সে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, খ্রিশ্চান নয়– সে বাঙালি।

আমার পরম শুভানুধ্যায়ী, বিদ্রোহী বীর, পরলোকগত উপীনদা এ সম্বন্ধে নির্বাসিতের আত্মকথাতে যা লিখেছেন সেটা বাঙালি যেন বারবার পড়ে, উদয়াস্ত সেই মন্ত্র জপ করে।

একবার বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়লেই একথা সবাইকে মেনে নিতে হয়।

বাঙলা-সাহিত্যের আঁতুড়ঘর বৌদ্ধ-মন্দিরে–চর্যাপদ নিয়ে, বেদবেদান্ত নিয়ে নয়। তার পর তার বৈষ্ণব রূপ। আজ বৈষ্ণবধর্ম হিন্দু ধর্মের অঙ্গ, কিন্তু যে যুগে সে জন্মগ্রহণ করে সে যুগে সে ব্রাত্য–ব্রাহ্মণ চণ্ডীদাস ধোপানি রামীকে বলেছেন,

তুমি বেদ-বাদিনী হরের রমণী
তুমি হও মাতৃপিতৃ
ত্রিসন্ধ্যা যাজন তোমারে ভজন
তুমি বেদ মাতা গায়ত্রী।

 এ যদি বিদ্রোহ না হয়, এ যদি স্বাধীন চিন্তাপদ্ধতি না হয়, তবে স্বাধীনতা কী? তার পর বাঙলা গদ্যের সূত্রপাত রামমোহন। তিনিও বিদ্রোহী— প্রচলিত হিন্দুধর্মের কতই না জঞ্জাল তিনি লৌহ-সম্মার্জনী দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে গেলেন। তার পর বাঙলার শ্রেষ্ঠতম সন্তান বিদ্যাসাগর মহাশয়–তাকে বর্ণনা করার ভাষা আমার আয়ত্তের বাইরে–তিনিও সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন কর্মের বিজয়পতাকা তুলেছেন। তার পর মাইকেল–রাম রাম! তিনি তো কেরেস্তান; কিন্তু শুধাই, আজ এবং সে যুগেও কেউ তাঁকে তাই নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে? ওদিকে পূর্ব-বাঙলায় মুসলমানরা কেচ্ছা-সাহিত্য, মুর্শিদিয়া, জারি, দৰ্বেশি রচনা আরম্ভ করেছেন- হিন্দু দীনেশচন্দ্র তো সেগুলো অবহেলা করলেন না! আজ মৈমনসিংহী গীতকবিতা বাংলার অলঙ্কার। তার পর বঙ্কিম; তিনি তো বৃন্দাবনের রসরাজকে সর্বজনসমক্ষে খুন করলেন এবং আশ্চর্য, যে ব্রাহ্মসমাজ বৈষ্ণবধর্মকে তাচ্ছিল্য করে কদম্ববৃক্ষকে অশ্লীল বৃক্ষ বলেন আমার শোনা কথা– সেই সমাজের মহাপুরুষ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই থেকে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, রসরাজ চলে গেলে আমাদের থাকবে কী?)। এবং পশ্য, পশ্য, যে বাঙালি বঙ্কিমকে ঋষি উপাধি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সে-ও রসরাজকে বর্জন করেনি। ঠিক ওই সময়ে কি না বলতে পারব না, কাঙাল হরিনাথের (কাঙাল যদি ছেলের মতো ছেলে হত তবে তুমি জানতে। কাঙাল জোর করে কোল কেড়ে নিত, তুমি পারতে না মা ছাড়তে) সখা মীর মশাররফ হোসেন বিষাদসিন্ধুতে মুসলমানের কারবালার কাহিনী লিখলেন; এ বই হৃদয়তাপের ভাপে-ভরা ফানুস, তত্ত্ব এতে নেই, তবু বাঙালি আজও সে বই কেনে। তার পর রবীন্দ্রনাথ তিনি কতখানি স্বাধীন চিন্তার প্রতীক ছিলেন সেকথা আপনারা আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন; তিনি হিন্দু নন, ব্রাহ্ম নন তিনি বাঙালি। তার পর সুকবি নজরুল ইসলাম। মুসলমান। তাঁর তখলুস্ (পেননেম) বিদ্রোহী কবি। একে মুসলমান, তায় বিদ্রোহী। অথচ বাঙালি হিন্দু তাকে কী শ্রদ্ধাই না দেখিয়েছে–আজও তাঁর জন্মদিনে তার রোগশয্যার চতুর্দিকে বহু বাঙালি জড় হয়। ক্ষীণ আশা নিয়ে যদি তিনি ক্ষণেকের তরে চৈতন্য পেয়ে আরও কিছু দেন (টুকরো খবর দ্রষ্টব্য)। সর্বশেষ পরশুরাম। তিনি আমাদের প্রচলিত ধর্ম নিয়ে যে উল্কট মশকরা করেন সে তো অবিশ্বাস্য। অন্য কোনও দেশ হলে বহু পূর্বেই তিনি লিচ, বার্নট এট দি স্টেক, কাফিররূপে কতলিত হতেন।

বাঙালি বাঙালি। হিন্দুধর্মের প্রতি তার সোহাগ নেই, মুসলমানকে সে অবহেলা করেনি, কেরেস্তানও তার ভাই। এরকম উদারতা কটা জাত, কটা সাহিত্য দেখিয়েছে?

আমি তো বিশ্বসাহিত্য জানিনে। অগ্রজপ্রতিম সখা শ্ৰীযুত সুনীতিকুমার জানেন। তিনিই বলুন না? ভুল প্রমাণ হলে দেহলিপ্রান্ত থেকে কলকাতা অবধি নাকে খৎ দেব।

অথচ কী আশ্চর্য! হিন্দুধর্ম বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালিই। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ এঁরা বাঙালি। আপনারা যদি সাহস দেন, তবে সে প্রলাপও একদিন নিবেদন করব।

উদ্ধৃতিতে ভুল থাকলে অপরাধ নেবেন না। এই পাণ্ডববর্জিত ইন্দ্রপ্রন্থে চণ্ডীদাস পাই কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *