রায় পিথৌরার কলমে – ১৬

১৬.

এককালে এদেশে বিস্তর ফারসি চর্চা হত। সরকার, মুন্সি, বখশি, কানুনগো, এসব যাদের পদবি তাদের বাপ-পিতেমো উমদাসে উমদা ফারসি শিখে এককালে মোগল রাজত্ব চালিয়েছেন। সরকার তো চিফ সেক্রেটারি, বখশি মানে চিফ পে মাস্টার অর্থাৎ একাউন্টেন্ট জেনারেল! বাপ– এসব আপিসারদের সঙ্গে দেখা হওয়া মানে তো বাঘের সামনে দাঁড়ানো। কান দিয়ে ধুয়ে বেরুতে থাকে। আর ওনারা রেগে গেলে তো হাড্ডি বিলকুল পিলপিলিয়ে যায়।

যাক্ মোদ্দা কথায় ফিরে আসি। এইসব বখশি-মুন্সিরা কিন্তু আজকের দিনের সেক্রেটারি-একাউন্টেন্টের মতো ছিলেন না– অর্থাৎ ফারসি সাহিত্যেরও চর্চা করতেন, মুশায়েরায় (কবি-সম্মেলন) কবিতা পড়তেন, বয়াজিতে (কবির লড়াই) মাথায় গামছা বেঁধে নেমে যেতেন।

স্বৰ্গত কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এই ঐতিহ্যের ভিতর আপন কবিতৃপ্রতিভার বিকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার আসল দরদ ছিল বাঙলা সাহিত্যের প্রতি। তাই তিনি হাফিজ-সাদির উত্তম উত্তম কবিতা অতি সরল বাঙলায় অনুবাদ করেন। এ কবিতাগুলো পড়ে হিন্দুরাই যে শুধু গুলিস্তানের শুলের খুশবো আর বুলবুলের মিঠি বোলি শুনতে পেতেন তাই নয়, উনবিংশ শতকের শেষের দিকের বাঙালি মুসলমান যখন বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের জোর চর্চা আরম্ভ করলেন, তখন তারা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্ভাবশতক অতিশয় ভক্তি ও ভালোবাসার সঙ্গে মুখস্থ করলেন। আমার বাল্য বয়সে আমি বৃদ্ধদের (হিন্দু- মুসলমান উভয় শ্রেণিরই) গদগদ হয়ে আবৃত্তি করতে শুনেছি–

নেত্র নাই বাঞ্ছা হেরি বিধুর বদন
কর্ণ নাই চাই শুনি ভ্রমর গুঞ্জন।

 এবং সর্বশেষে

প্রেম নাই প্রিয়লাভ আশা করি মনে।
হাফেজের মতো ভ্রান্ত কে ভব-ভবনে?

কিন্তু এসব গাজন আজ কেন?

গেল সপ্তায় বারোটি ইরানি দিল্লি এসেছিলেন, তার মধ্যে আটজন ছাত্র, দু জন শিক্ষক। এরা এসেছেন পশুচিকিৎসার শিক্ষাদান এবং গবেষণা দেখতে। এদের ভেতর দেড়জন জানেন ইংরেজি আর একজন ফরাসি।

কাজেই ফরেন-আপিসের দাওয়াতে গিয়ে দেখি ছেলেরা নিজেদের ভিতর গুজুর গুজুর করছে। কী আর করি আমার মুরুব্বি ফারসির বাঘা মৌলবি স্বৰ্গত জয়রাম মুন্সির নাম স্মরণ করে চালালুম হাস্ত হুস্ত। ফারসি ভাষাটা কঠিন নয় আর ইরানিরা ভদ্রতোয় লক্ষৌ কিংবা চীনদেশীয়কে হার মানাতে পারে। সুতরাং তারা আমার ফারসি শুনে মার তো লাগালেনই না বরঞ্চ উৎসাহের সঙ্গে গাল-গল্প জুড়ে দিলেন।

মুরুব্বি জয়রাম মুন্সি সদ্ভাবশতক পড়ে পড়ে আমাকে তার মূল কী, কোন কবি সেটি রচনা করেছেন এসব হদিস দিতেন– গুলস্তান বোস্তান তার কণ্ঠস্থ ছিল। কিন্তু হায়, আমাকে শেষ-শিক্ষা দেবার পূর্বেই খুদাতালার আপন গুলস্তানে তার নিমন্ত্রণ এসে গেল, এখানকার পাট তুলে দিয়ে সেখানে গজলকসিদা গাইবার জন্য।

আমি সে রাতের খানাতে কৃষ্ণচন্দ্রের বাঙলা অনুবাদের টুটিফুটি ফারসি অনুবাদ করতে লাগলুম, আর ছেলেটা টক্ টক্ করে তার মূল ফারসি বলে যেতে লাগল। আমার ভারি আনন্দ হল যে, পশুচিকিৎসা যাদের পেশা তারা যে এতখানি সাহিত্যচর্চা করে!

আর তারা খুশি যে, ভারতের শেষ প্রান্ত বাঙলা দেশের লোক তার আপন ভাষায় হাফিজ-সাদি গেয়েছে দেখে।

***

বাঙালিদের কাছে আমার একটি নিবেদন আছে।

সুভাষচন্দ্র বসু বার্লিনে যে বাড়িতে বাস করতেন সে বাড়িটির প্রতি বাঙালি মাত্রের কিঞ্চিৎ দরদ থাকা দরকার। অনেক ভারতীয়েরও আছে, একথা আমি নিশ্চয় জানি। বিশেষত ৪৬-৪৭ সালে দাক্ষিণাত্যে তার যে কী প্রতিপত্তি ছিল তা-ও আমি দেখেছি।

কেন্দ্রীয় সরকার কি এ বাড়িটি কিনে নিতে পারেন না? বার্লিনে আমাদের যে রাজদূতাবাস বসবে তারা ভাড়াটে বাড়িতে থাকবেন এবং সস্তায় থাকতে হলে আখেরে ভারতীয় সরকারকে বার্লিনে বাড়ি কিনতে হবে। কাজেই এই বাড়িটি কিনলে ভারতীয় সরকার কিছু অপকর্ম করবেন না।

আর যদি ভারতীয় সরকার এ বাড়িটি কিনতে রাজি না হন, তবে বাঙালি কি এ বাড়িটি কিনতে পারে না? তুমি-আমি গরিব সে আমি জানি, কিন্তু সবাই মিলে যদি একটা চেষ্টা দেওয়া যায়, তবে কি কর্মটা একেবারেই অসম্ভব?

এ নিয়ে একটা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।

আমরা বাড়িটি সম্বন্ধে অন্যসব খবরের তত্ত্বতাবাস করছি। ইতোমধ্যে কিন্তু আন্দোলনটা আরম্ভ করে দেওয়া উচিত।

***

শ্রীমতী রজোভেল্ট আমেরিকা ফিরে গিয়ে বলেছেন, ভারতীয়রা আধ্যাত্মিক এবং তারা সেই আধ্যাত্মিকতা পেয়েছে তাদের ধর্ম থেকে।

এ তো বাঙলা কথা। আধ্যাত্মিকতা আসে তো ধর্ম থেকেই–এতে আর নতুন কী বলা হল?

 উঁহু। ইংরেজিতে কথাটা অন্যরকম শোনায়। শ্রীমতী বলেছেন, ভারতীয়রা স্পিরিচুয়াল এবং তাদের স্পিরিচুয়ালিটি এসেছে তাদের রিলিজিয়ান থেকে।

অর্থাৎ স্পিরিচুয়ালিটি এবং রিলিজিয়ান সচরাচর এক জিনিস নহে। ইয়োরোপ এবং আমেরিকায় বহু লোক স্পিরিট (আত্মার) সাধনা করে, কিন্তু অনেকে রিলিজিয়ান জানে না।

তাই সপ্রমাণ হল রিলিজিয়ান এবং ধর্ম এক জিনিস নহে। এবং সেই কারণেই হিন্দু ধর্ম বলে কোনও জিনিস থাকতে পারে না। ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি তার অর্থ সনাতন ধর্ম। এ ধর্মের আগে হিন্দু শব্দ লাগানো যায় না। ঠিক যে রকম হিন্দু ভগবান মুসলমান ভগবান কিংবা খ্রিস্টান ভগবান হতে পারে না ঠিক তেমনি হিন্দু ধর্ম আমার কানে অদ্ভুত শোনায়।

শুধু হিন্দুরাই নয়, বৌদ্ধরাও যখন ত্রিশরণ মন্ত্রে ধর্মাং শরণং গচ্ছামি বলেন তখন তো ধর্মের পূর্বে বৌদ্ধ শব্দ লাগান না। কুরানে ধর্ম শব্দের জন্য পাই দীন কিংবা দীনুল্লা অর্থাৎ যে দীন আল্লার দিকে নিয়ে যায়। অন্য শব্দ ইসলাম। ইসলাম শব্দের ধাতু, ভগবানের ইচ্ছার সম্মুখে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা।

তাই ধর্ম শব্দের আগে হিন্দু কিংবা মুসলমান শব্দের প্রয়োগ আমি বুঝে উঠতে পারিনে। ধর্ম সর্বমানবের জন্য তার আবার হিন্দু-মুসলমান কী?

গত বৎসর এই সময়ে রমণ মহর্ষি দেহত্যাগ করেন। ইসলাম শব্দের স্মরণে মহর্ষির কথা মনে পড়ল।

দাক্ষিণাত্যের তিরু-আন্নামলাই গ্রামের রমণাশ্রমে কয়েক মাস থাকার সৌভাগ্য আমার জীবনে একবার হয়েছিল। শ্রীঅরবিন্দ সচরাচর কাউকে দর্শন দিতেন না আর রমণ মহর্ষিকে উদয়াস্ত একই ঘরে পাওয়া যেত। নানা লোক নানা প্রশ্ন করত, মহর্ষি উত্তর দিতেন। অবশ্য রেসে কোন ঘোড়া জিতবে জিগ্যেস করলে চুপ করে থাকতেন, এমনকি ভগবান কেন সংসারটা তৈরি করলেন, তার উত্তরও দিতেন না। বড্ড বেশি খোঁচাখুঁচি করলে বলতেন, তোমার তা জেনে কী দরকার।

একদিন আরেকটুখানি বাড়িয়ে উত্তর দিলেন। বললেন, তুমি যে প্রশ্নটা করলে সেটার উত্তর আমি যদি দিই, তবে সে উত্তর তুমি বুঝবে কী দিয়ে? অবশ্য তোমার মন দিয়ে। এখন তবে প্রশ্ন, তুমি তোমার মনটাকে বুঝতে পেরেছ কি? যে ফিতেটা দিয়ে তুমি জমি মাপতে যাচ্ছ তারই যদি দৈর্ঘ্য না জানো, তবে মেপে লাভ কী? তাই সক্কলের পয়লা মনটাকে চিনতে হয়।

একদিন দেখি জনাচারেক বয়স্ক তামিল মুসলমান মহর্ষিকে প্রণাম করে সামনের মেঝেতে বসল। দেখে মনে হল চাষাভূষা শ্রেণির কিংবা কোচম্যান হ্যাঁন্ডিম্যানও হতে পারে।

অনেকক্ষণ মহর্ষির দিকে তাকিয়ে থেকে শেষটায় একজন অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে তামিল ভাষায় বলল, আমরা আপনাকে অনেক প্রশ্ন জিগ্যেস করে বিরক্ত করতে চাইনে বলে বাড়ি থেকে সবাই মিলে একটিমাত্র প্রশ্ন ঠিক করে নিয়ে এসেছি। আপনি যদি উত্তর না-ও দেন, তাতেও আমাদের আক্ষেপ নেই, কারণ আপনার দর্শন আমরা পেয়েছি সেই যথেষ্ট।

শিশুর মতো মহর্ষি সরল হাসি হাসলেন। বললেন, বলো।

 প্রবীণটি বলল, মানুষের জীবনে সবচেয়ে কাম্য ধন কী?

 তৎক্ষণাৎ মহর্ষি উত্তর দিলেন, ইসলাম।

 চারজনই অনেকক্ষণ ধরে মহর্ষির দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর প্রণাম করে সন্তুষ্টচিত্তে বেরিয়ে গেল।

আমি জানি, মহর্ষি কোন অর্থে ইসলাম বলেছিলেন। এ চারজন বাড়ি ঘরে গিয়ে নিশ্চয়ই ইসলাম শব্দের তত্ত্বানুসন্ধান করবে এবং আল্লার কৃপা থাকলে সত্য ধর্মে পৌঁছবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *