রায় পিথৌরার কলমে – ১৫

১৫.

খ্রিস্টের ছ শ বছর আগে বৈশালীতে গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। বলা হয়, বুদ্ধদেব এই বৈশালী রাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হন এবং আপন সদ্য নির্মাণের সময় তার অনেকখানি অনুকরণ করেন। এই বৈশালীতেই মহাবীর জীনের জন্ম।

বৈশালীর স্মরণে এখনও সেখানে প্রতি বৎসর উৎসব হয়। এবারকার উৎসবে শ্ৰীযুত কানহাইয়ালাল মুন্সী সভাপতিত্ব করেন।

শ্ৰীযুত মুন্সী বলেন, আমরা যদি ভারতের ভিতর দিয়ে বিশ্ব-ঐক্য এবং বিশ্ব-ঐক্যের ভিতর দিয়ে ভারতকে অখণ্ড রূপে চেনার চৈতন্য না জাগিয়ে তুলতে পারি তবে আমাদের স্বাধীনতা লোপ পাবে, স্বাধীনতা গেলে আমাদের আত্মার মৃত্যু হবে, আত্মার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের মহতী বিনষ্টি।

এ উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে কারও মনে কোনওপ্রকারের সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন, ভারতীয় কিংবা বিশ্ব-ঐক্যের সাধনার সঙ্গে প্রাদেশিক বৈদগ্ধ্যের সংঘাত আছে কি নেই? আমরা যখন বাঙলা ভাষা এবং সাহিত্যের চর্চা করি, আমি যখন বৃদ্ধ বয়সে উত্তমরূপে হিন্দি শিখতে এবং লিখতে নারাজ তখন আমাকে বাঙালি কূপমণ্ডুক এবং ভারতীয় ঐক্যের পয়লা নম্বরের দুশমন বলা হবে কি না?

বাঙলার তরুণ সম্প্রদায় যদি আজ আদাজল খেয়ে (আর অন্য বস্তু আছেই বা কী যে খাবে?) হিন্দি চর্চায় বসে যায়, বাঙলা বর্জন করে হিন্দিতে উত্তম উত্তম কাব্য কথাসাহিত্য রচনা করে তামাম ভারতকে ভেল্কিবাজি দেখিয়ে দেয়, প্রবীণ হয়েও সুনীতি চট্টো নাকি দেখাতে পেরেছেন তা হলে আমার কণামাত্র– আপত্তি নেই (যদিও একথা বলব যে কেউ যদি হিন্দি শিখে কোনও ভালো বই বাঙলায় অনুবাদ করে তবে আমি খুশি হই বেশি। কিন্তু দয়া করে আমার মতো প্রবীণদের আর এ গর্দিশে ফেলবেন না।

একটা গল্প মনে পড়ে গেল।

গৃহিণী শুনে স্তম্ভিত যে বড়বাবুকে মাসের কুড়ি তারিখে হাওলাত দেয় তারই আপিসের এক বেনে কেরানি। বড়বাবুর মাইনে সাতশ, আর কেরানির ত্রিশ। গৃহিণী চেপে ধরলেন, তাঁকে গিয়ে দেখে আসতে হবে সে কী করে বাড়ি চালায়। কর্তা বহুবার গাইগুই করে শেষটায় না পেরে গেলেন একদিন সন্ধের পর তারাপদর বাড়িতে।

বাড়ি অন্ধকার। ডাকাডাকিতে আলো জ্বলল। তারাপদ নেবে এল হাতে পিদিম, পরনে এইটুকুন গামছা। বড়বাবুকেও ঘেঁড়া চ্যাটাইয়ে বসিয়ে শুধাল, কোনও লেখা-পড়ার কর্ম আছে কি?

না। কেন?

 তা হলে পিদিমটা নিবিয়ে ফেলতে পারি আর গামছাখানা খুলে রাখতে পারি। বড়বাবু যা দেখবার জন্য এসেছিলেন তা দেখা হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পাড়ার মুখে পৌঁছতে না পৌঁছতেই চিৎকার করে বলতে লাগলেন, গিন্নি, শিখে এসেছি, শিখে এসেছি কিন্তু আমার দ্বারা হবে না।

বড়বাবুর মতো আমারও জানা হয়ে গিয়েছে, হিন্দি শিখলে আমার বহুৎ ফায়দা হবে, কিন্তু ওই যে বড়বাবু বললেন, আমা দ্বারা হবে না সেই মোক্ষম কথা!

উর্দুতেও এই মর্মে একটি উত্তম কবিতা আছে। মোমিন নামক কবিকে বলা হয়েছিল, আর কেন? সমস্ত জীবন তো কাটালে পাপ কর্ম করে করে; এইবার একটু ধর্মে মন দাও!

মোমিন বললেন,

উম্র সারী তো কটী ইশকে বুতা মে
মুমিন!
আখরী ওজমে ক্যা থাক্ মুসলমাঁ
হোঙগে?
সমস্ত জীবন তো কাটল প্রেম-প্রতিমাদের
মহব্বতে, রে মুমিন,
এখন এই আখেরি সময়ে কী ছাই
মুসলমান হব।

 তাই হিন্দি-উর্দু মাথায় থাকুন। যেটুকু টুটিফুটি শেখা আছে সেই করেঙ্গা, খায়েঙ্গা, হাই, হুই করে জীবনের বাকি কটা দিন প্রেমসে চালিয়ে নেব।

কিন্তু যদি বলি, বাঙলার চর্চা যে আমি আমার কট্টর বাঙালিত্বের জন্য করছি তা নয়– বাঙলার সেবার ভিতর দিয়েই আমি ভারতীয় ঐক্যের সেবা করছি; তা হলে হিন্দিপ্রেমী বাঙালিরা হয়তো আমাকে তাড়া লাগাবেন। তবু সেইটেই হক কথা, এইখানেই আঁটি জাতীয়তাবাদ।

আমাকে বিশ্বনাগরিক হতে হলে তো আর বিশ্বসংসারের ভাষা শিখতে হয় না, কিংবা এসপেরান্টোও কপচাতে হয় না। আমি মালাবারের ভাষা জানিনে তবু মালাবারের লোককে আমার বড় ভালো লাগে। আমি কিঞ্চিৎ ইংরেজি জানি এবং তার অনুপাতে ইংরেজকে অপছন্দ করি অনেক বেশি।

অতএব ভারতকে ভালোবাসা যায় হিন্দি না শিখেও। রোমাঁ রোলা হিন্দি জানতেন না তবু তিনি ভারতবর্ষকে চিনতেন ও ভালোবাসতেন অনেক দুবেজি পাড়েজির চেয়ে ঢের ঢের বেশি।

সুইটজারল্যান্ডের নিজস্ব সুইস বলে কোনও ভাষা নেই। সুইসরা ফরাসি, জর্মন, ইতালীয় ও রোমানি ভাষায় কথা কয়। এবং শতকরা নব্বইজন একাধিক ভাষা বলতে পারে না। ফরাসি-সুইটজারল্যান্ডে অতি অল্প লোকই জর্মন জানে, ইতালীয়-সুইটজারল্যান্ডেও তাই। অথচ এই চার ভাষায় গড়ে ওঠা সুইটজারল্যান্ড একতায় জর্মনি-ইতালিকে অনায়াসে হার মানাতে পারে।

আরবদেশের ভাষা আরবি, ধর্ম ইসলাম, জাতে তারা সেমিটি। আরব মাত্রেরই এই তিন-তিনটে ঐক্যসূত্র আছে– পৃথিবীতে এরকম উদাহরণ বিরল। তবু দেখুন তারা কটা রাষ্ট্রে বিভক্ত তাদের ভিতর রেষারেষি কীরকম মারাত্মক! সউদি আরব, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, মিশর, কুওয়াইত, বাহরেন। আলজিরিয়া, তুনিসিয়া, মরক্কোর কথা আর তুললুম না– সেখানে মূররক্ত কী মেকদারে আছে জানিনে। তাই যখন করাচি বিশ্ব-মুসলিম সজ্জ গড়ার খেয়ালি-পোলাও খায় তখন হাসি পায়। আরবদের এতগুলো ঐক্যসূত্র থাকতেও তারা সম্মিলিত হতে পারছে না, তার ওপর তুর্ক, ইরানি, পাকিস্তানি, জাভার মুসলমানকে ডেকে এনে একতা স্থাপন করা!

আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, যে ভারতীয় বৈদগ্ধ্য ভবিষ্যতে গড়ে উঠবে তার বুনিয়াদ প্রদেশে প্রদেশে। প্রত্যেক প্রদেশ আপন নিজস্ব ভাষা এবং সাহিত্য, আপন জনপদসুলভ আচার-ব্যবহার চারুশিল্প, আপন প্রদেশপ্রসূত ধর্ম এবং সম্প্রদায় এসব তাবৎ বস্তুর চর্চা করে যে ফললাভ করবে তারই ওপর একদিন দাঁড়াবে বিরাট কলেবর, বৈচিত্র্যসুশোভিত, সর্বজনগ্রাহ্য ভারতীয় বৈদগ্ধ্য।

আমার এক কাণ্ঠরসিক বাঙালি বন্ধু এই দেহলি-প্রান্তেই বিন্দ্ৰিযামিনী যাপন করছেন হিন্দি চর্চায়– ইনি সেই ব্যক্তি যিনি কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে দোস্তি জমান।

তিনি বিস্তর হিন্দি পড়েছেন। ব্যাকরণ কণ্ঠস্থ করেছেন, হিন্দির, পুলিঙ-স্ত্রীলিঙ তাঁকে কণামাত্র বেকাবু করতে পারে না, হিন্দির ফাউলার শ্রীবর্মার অচ্ছি হিন্দি তাঁর নখাঘ-দর্পণে।

তিনি বলেন– আমি বলছিনে, কারণ আমার শাস্ত্রাধিকার নেই হিন্দি ভাষা বাঙলার তুলনায় এখনও এত কাঁচা এত লিউয়িড় যে, এ ভাষাতে যে কোনও উত্তর-ভারতীয় অনায়াসে উত্তম হিন্দি লিখতে পারবে। তিনি বিশ্বাস করেন, ভালো বাঙলা লিখতে হলে যে মেহনত যে খাটুনির প্রয়োজন তার অর্ধেক পরিশ্রমে অত্যুত্তম হিন্দি লেখা যায়।

তাই তিনি বলেন, বাঙালির তো সব আছে। এখন তার একমাত্র পন্থা, হিন্দি মার্কেট ক্যাপচার করা– সুহৃদ ব্যবসায়ী তাই হামেশাই কারবারি ইডিয়াম ব্যবহার করেন– অর্থাৎ অচ্ছি হিন্দি শিখে, রবীন্দ্রনাথ-শরচ্চন্দ্রের কাছ থেকে নেওয়া শৈলী এবং ভাষা হিন্দির ওপর চালিয়ে দিয়ে হিন্দি সাহিত্যে রাজত্ব করা।

হয়তো হক কথাই কয়েছেন কিন্তু আমার মন সাড়া দেয় না।

প্রথমত এই প্রস্তাবে কেমন যেন একটা উৎকট প্রাদেশিকতা রয়ে গিয়েছে, কেমন যেন একটা একদা যাহার বিজয়-সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয় গোছ ইম্পিরিয়ালিজম রয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যই-বা এমন কোন গৌরীশঙ্করের চূড়োয় পৌঁছে গিয়েছে যে তার সেবকদের হিন্দি জয় করবার জন্য ছুটি দিতে পারি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *