১৪.
এই খোলা মাঠের সিনেমা বানাতে আমাদের এতদিন লাগল কেন? ইয়োরোপে ঠাণ্ডা, কুয়াশা, গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যা হতে হতে দশটা বেজে যায়– তা-ও ভালো করে অন্ধকার হয় না। সেখানে আকাশের তলায় সিনেমা বানানোর কথাই ওঠে না। আবার কাইরো শহরে বছরে আড়াই ইঞ্চি বৃষ্টি হয় কি না হয়, কুয়াশা সেখানে অজানা, আবহাওয়া না-গরম-না-ঠাণ্ডা, সেখানে তাই ভোলা সিনেমার খোলতাই। দিল্লি এ দুটোর মধ্যিখানে, বরঞ্চ বলব কাইরোর গাঁ ঘেঁষে, তবু ভোলা সিনেমা খোলা হল মাত্র গত সপ্তাহে।
ব্যবস্থা কিন্তু উত্তমই হয়েছে। যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটিও পুরনো দিল্লি আর নয়াদিল্লির মাঝখানে ফিরোজ শাহ কোটলার পিঠে পিঠ লাগিয়ে। সিনেমার পর্দাখানা বানানো হয়েছে মামুলি পর্দার ডবল সাইজে বেশ শক্ত করে বাঁধা হয়েছে, যাতে করে হাওয়ায় না দোলে, তবে চতুর্দিকে কালো বর্ডার লাগানো হয়নি বলে চোখ অস্বস্তি অস্বস্তি বোধ করে।
বিরাট ব্যবস্থা, তাই টিকিটের জন্য মারামারি কাটাকাটি করতে হয় না। ভিতরে গিয়ে যে কোনও এক কোণে আপন আসন বেছে নিয়ে দিব্য বায়স্কোপ দেখা যায়, কেউ এসে ধাক্কা লাগায় না, মশাই আমার সিটে বসেছেন যে মাইরি, সিগারেটের ধুয়োর উৎপাত নেই। মোলায়েম ঠাণ্ডায় অনায়াসে দু দণ্ড ঘুমিয়ে নেওয়া যায়।
এখনও অবশ্য তাবৎ কাইরোর মতো সর্বাঙ্গসুন্দর হয়নি। সেখানে ভালো টিকিট কাটলে একখানি ছোট টেবিল পাওয়া যায়, পছন্দমতো কটলিস-সসেজ, কব-কোপ্তা খেতে খেতে ইয়ার-বক্সিদের সঙ্গে শুষ্টিসুখ অনুভব করতে করতে বায়স্কোপ দেখা যায়।
হবে, হবে, সে-ও হবে।
এক নরওয়েবাসী তার বন্ধুকে বলল, এই গরমিকালে আফ্রিকায় বেড়াতে যাচ্ছি।
বন্ধু তাজ্জব মেনে বলেন, গরমিকালটাই বাছলে। সেখানে যে ও সময়ে শেড-টেম্পারেচার ১১২ ডিগ্রি।
প্রথম বন্ধু ভুরু কুঁচকে বলল, তা আমাকে ছায়ায় বসতে বাধ্য করবে কে?
ওপন অ্যার সিনেমাতেও তাই। টিকিটের দাম যখন কুল্লে এক টাকা, তখন ছবি ভালো না লাগলে সেখানে আপনাকে বসতে বাধ্য করবে কে?
বিশ্বাস করবেন না এই কদিনে নখানা ছবি দেখেছি। বাঙ্গালায় যাকে বলে গোগ্রাসে গোস্ত গিলেছি। এখনও ঢেকুর উঠছে।
দু একখানার পরিচয় ইতোমধ্যেই আনন্দবাজার এবং হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড-এ নিবেদন করেছি। যেগুলো দেখেছি তার মধ্যে মিরা ই মিলান সবচেয়ে উত্তম, আর যেসব ছবি দেখার সুযোগ হয়নি, তার মধ্যে গুণীদের মতে, বাইসাইল থিফ ইউঁকিয়ারিসু নাকি একেবারে রঙের টেক্কা।
***
মিশরি ছবি ছিল ইবন উন-নীল (অর্থাৎ নীলনদসম্ভান)। এ ছবি দেখে সত্যি মনে হয়, একদম ভারতীয় ছবি, শুধু তারকারা কুর্তা-পাজামা, ধুতি-পাঞ্জাবি না পরে আলখাল্লা আর জাব্বাজোব্বা পরেছে। নায়িকা ভিমরি গিয়েছেন, তার মাথা রেললাইনের উপরে পড়ে আছে, দূর থেকে পাঞ্জাব মেল (থুড়ি, আলেকজেন্ড্রিয়া মেল) গুম গুম করে ছুটে আসছে, নায়ক তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন— এই গেল এই গেল অবস্থায় শেষ মুহূর্তে নায়িকার উদ্ধার।
ফারাক এইটুকু, বাঙলা ছবিতে তখন ডুয়েট গান আরম্ভ হয়ে যায়, কেন গো বাঁচালে মোরে নিঠুর বঁধুয়া, এখানে তা হয়নি। (চীনা ছবি হোয়াইট হেয়ার্ড গার্ল কিন্তু গান বাবদে বাঙলা ছবিকেই ছক্কা-পাঞ্জা-বোম্ দিতে পারে)।
নীলনদসন্তান নিরেস ছবি বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। এ ছবি উন্নাসিকের (অর্থাৎ আপনার-আমার) জন্য বানানো হয়নি। সদর এবং মহকুমা শহরে এ ছবি বিস্তর কদর পাবে। তাই আমি হন্টরওয়ালি, মিস্ ফ্রন্টিয়ার মেল, ডাকু কি দিলরুবা, জাম্বু কা বেটার নিন্দেও কস্মিনকালে করিনি।
বুদ্ধের জীবনী জাপানি ছবি। অতি নবীন কায়দায় কার্টুন দিয়ে সিলুয়েট দিয়ে ছবিখানা তৈরি। তা-ও আবার স্টিলিসাইজড—তাই ভারতীয় নারকোল অশথ গাছ ঠিক ওত্রালো কি না, তাই নিয়ে কোনও শিরঃপীড়া হয় না। সঙ্গীত অত্যুত্তম, সবকিছু নিয়ে ছবিখানা সত্যই উপাদেয়।
***
বুদ্ধের জীবনের সবচেয়ে যে জিনিস চীনা-জাপানিদের আকৃষ্ট করে, সে হচ্ছে মারের বিভীষিকা এবং প্রলোভন! চীন দেশের গুহাতে বুদ্ধ-জীবনীর এ অধ্যায়টি বিস্তর রঙ ফলিয়ে বহু প্রকারে আঁকা হয়েছে। জাপানি বুদ্ধের জীবনী ছবিতেও দর্শক মারপর্ব অনেকক্ষণ ধরে দেখতে পাবেন। সেখানে নাচগানও চমৎকার।
আমাদের বিশ্বাস কার্টুনে ছবি বানালে ডিসৃনিকে নকল না করে উপায় নেই। ফরাসি ছবি সাহসী জন দেখে সে বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়। যেখানেই চিত্রকার নতুন কিছু করতে গিয়েছেন, সেখানেই তিনি মার খেয়েছেন বেধড়ক, আর যেখানে ডিসৃনিকে নকল করেছেন, সেখানে তিনি পানসে– নকল করলে যা হয়।
বুদ্ধের জীবনী ডিসনিকে নকল না করে সার্থক সৃষ্টি।
মিসেস ডেরি সম্বন্ধে হিন্দুস্থানে আলোচনা করেছি। ভাষা এবং তার চতুর্দিকে গড়ে ওঠা বৈদগ্ধ্য যে জোর করে কোনও জাতের ঘাড়ে চাপানো যায় না, তার অত্যুত্তম প্রমাণ পাওয়া যায় মিস ডেরিতে। গান, অভিনয়, সবকিছুই এ ছবিতে ভালো হয়েছে।
***
আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে মিরাকল ইন মিলান। অলৌকিক ঘটনা নিয়ে যে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ এ ছবিতে করা হয়েছে, সেটি ধরা পড়ে শেষমুহূর্তে। এ ছবি দেখলে বিরিঞ্চি বাবাদের প্রতি ভক্তি একটুখানি কমতে পারে।
***
জনৈক লেখক এক খ্যাতনামা কাগজে রবীন্দ্রনাথ যে দ্বিতীয় শ্রেণির কবি, ঔপন্যাসিক এবং দার্শনিক সেকথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। লেখক স্বীকার করেছেন, তিনি বাঙলায় রবীন্দ্রনাথ পড়েননি।
বিভারলি নিকলসও এই ধরনের বই লিখেছিল। মিস মেয়ের কথা আর বললুম না, কারণ দু একজনকে বলতে শুনেছি, মেয়োর উদ্দেশ্য হয়তো খারাপ ছিল না কিন্তু রবীন্দ্র-সমালোচকটার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাদের মনে প্রচুর সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।
নিকলসের বই যখন হুশ হুশ করে বিক্রি হচ্ছে তখন খ্যাতনামা প্রকাশক আমাকে বইখানার উত্তর লিখতে অনুরোধ করেন। বেশ দু পয়সা যে পাব সে লোভটাও দেখালেন।
আমি উত্তরে সবিনয়ে বললুম, মনে করুন এক হটেনটট লন্ডনে তিন মাস থাকার পর যদি শেক্সপিয়র, রাফায়েল, এঞ্জেলো, বেটোফেন, পাভলোভাকে কটুকাটব্য করে বই লেখে তবে কি কোনও সুস্থ ইয়োরোপীয় তার উত্তর লিখবে?
প্রশ্ন হচ্ছে নিকলস্ এবং আমাদের রবীন্দ্র-সমালোচক এ ধরনের বই বা প্রবন্ধ লেখে কেন?
এরা চায় পয়সা, কিন্তু জানে ভারতবর্ষ তথা রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রামাণিক রচনা লেখবার মতো মুরোদ এদের নেই। এদের বই কেউ কিনবে না। কিন্তু যদি গালাগাল দিয়ে লেখে তবে বহু লোক সেসব বইয়ের তীব্র প্রতিবাদ করবে, ফলে হট্টগোলের সৃষ্টি হবে এবং সেই ডামাডোলে বিস্তর বই বিক্রি হবে। অশ্লীল বইও এই পদ্ধতিতে বাজারে কাটে।
অতএব আমাদের উচিত কী?
চুপ করে থাকা।
তবে আমি আলোচনাটা উত্থাপন করলুম কেন? তার কারণ বহু সরল পাঠক এই দুচোমিটা না ধরতে পেরে হট্টগোলের সৃষ্টি করে বই বিক্রির সহায়তা করেন। আমার বক্তব্য, সবাই যেন এ বাবদে একদম নিপ ডেড় সাইলিন্ট পন্থা অবলম্বন করেন। আলোচনা উত্থাপিত হলেই নাক সিঁটকে বলবেন, মাপ করবেন, স্যার, এ বিষয়ে আমার কণামাত্র উৎসাহ নেই। বলেই অন্য কথা পাড়বেন। বলবেন, দেখো দিকিনি, রায় পিথৌরা কী চমৎকার লেখে কিংবা উল্টোটা। যাই করুন না কেন, রায় পিথৌরার তাতে করে দু পয়সা আমদানি বাড়বে না।
***
ইংরেজ বড় হুঁশিয়ার জাত। তারা এই পদ্ধতিতে ভালো বইও খুন করতে জানে।
লায়োনেল ফিলডেন নামক এক ব্যক্তি এদেশে কয়েক বৎসর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর বড় কর্তা ছিলেন। এদেশে ইংরেজের কীর্তিকারখানা দেখে ভদ্রলোক বিলেত গিয়ে সে সম্বন্ধে একখানা চটি বই লেখেন– একদা ডিগবি যেরকম এসপারাস ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লিখেছিলেন।
ইংরেজ বইখানা সম্বন্ধে এমনি ঠোঁট সেলাই করল যে বইখানা অতি অল্প লোকই পড়েছেন।
ঋষিরা তাই বলেছেন, নীরবতা হিরণয়, সাইলিনস্ ইজ গোল্ডেন!
***
দিল্লির ওপর দিয়ে বড় গর্দিশ গেল। বিস্তর ফিল্ম দেখানো হল, তারকাদের মিছিল হল, হাইফেল্স বেয়ালা বাজালেন, পণ্ডিতজি নেশনাল ট্রেজার্স ফান্ড খুললেন, সবচেয়ে বড় পোলো ফাইনাল হল, এলেনর রুজভেল্ট এলেন, তার ওপর গোটা তিনেক চিত্রপ্রদর্শনী। মানুষ কদিক সামলায়? সব সামলাতে গেলে রায় পিথৌরার কুইনটুপ্লেটের প্রয়োজন।
বাসু ঠাকুর যে বাড়ির খুশ-নাম ষোল আনা রাখতে পেরেছেন তা নয়। অবশ্য তিনি অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, দু জনার কাছ থেকে যা শিখেছেন তার অনেকখানি কাজে লাগাতে পেরেছেন।
বাসু ঠাকুরের ছবিতে প্রচেষ্টা আছে। ভদ্রলোক অনেক কিছু দেখছেন এবং ভেবেছেন তার চেয়েও বেশি। তুলির জোর তো আছেই, তার চেয়েও বেশি মূর্তি গড়ার হাত। বাসু ঠাকুরের সৃষ্টি তাই যে শুধু আনন্দ দেয় তা নয়, ছবিগুলোর সামনে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কিছু ভাবা যায়। প্রদর্শনী বহুদিন ধরে খোলা থাকবে।
***
ক্রিকেট ম্যাচে যখন পাশের বে-রসিক নানারকম উদ্ভট প্রশ্ন শুধায় তখন উদ্ভট উত্তরও পায়।
ওগুলো কী?
বিরক্তির সঙ্গে, উইকেট।
ওগুলো দিয়ে কী হয়?
ততোধিক বিরক্তির সঙ্গে, ক্লান্ত হলে খেলোয়াড়দের বসবার জন্য।
পোলো খেলা দেখতে গিয়ে আমার সেই অবস্থা; চক্কর কী, হাফ গোল কারে কয়, ফাউল কখন হয় আর কখন হয় না তাই বুঝবার পূর্বে খেলা শেষ হয়ে গেল।
তবু, আহা, দেখবার জিনিস! এক গোল থেকে আরেক গোল অবধি (ফুটবল তিন সাইজ) ঘোড়াগুলো যা ছুট দেখাল তার জন্যই ও খেলা দেখার প্রয়োজন। রাজা-রাজড়াদের গদি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খেলাও ঝিমিয়ে আসছে। মরে গিয়ে ঠাণ্ডা হওয়ার পূর্বে এক দফা দেখে নেবেন।