১৩.
ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের বহু বহু পুস্তক এদেশে লোপ পেয়েছে, কিন্তু অনুবাদ তিব্বত, চীন, মধ্য এশিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং পূর্ব তুর্কিস্থানের নানা ভাষাতে এখনও পাওয়া যায়। শুধু বৌদ্ধ মঠেই যে এদের সন্ধান মেলে তা নয়, মধ্য এশিয়ার বালির নিচ থেকেও এসব অনুবাদের বই এখন বেরুচ্ছে।
ভারতবর্ষীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ এবং তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নির্মাণের জন্য এসব অনুবাদ গ্রন্থ অবর্জনীয়। কিন্তু প্রশ্ন এই বিরাট কর্মভার গ্রহণ করতে যাবে কে?
কিছুকাল পূর্বে নাগপুরে শ্রীযুক্ত রঘুবীর ভারতীয় সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক পরিষদ (ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অব্ ইন্ডিয়ান কালচার) প্রতিষ্ঠা করেন। এ পরিষদের কাজ যাতে করে দেশ-বিদেশের গুণী-জ্ঞানীদের সাহায্যে ভালো করে গড়ে ওঠে, তার জন্য পরিষদ জাপান, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, বৰ্মা, সিংহল, ভারতবর্ষ, ফ্রান্স, ইতালি, জর্মনি, ইংলন্ড, হল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের পণ্ডিতদের সহায়তা চেয়ে আহ্বান জানান এবং ইতোমধ্যেই সহৃদয় উত্তর পেয়েছেন।
দিল্লিতে এসে শ্রীযুক্ত রঘুবীর বললেন, পশ্চিম জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্ৰীযুত নোবেল মহাযান বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণ প্রভাসসূত্র পুস্তকখানা সর্বপ্রথম প্রকাশ করবেন। পরিষদ ক্রমশ কী কী পুস্তক বের করবেন তার একটি খসড়াও অধ্যাপক নোবেল তৈরি করেছেন।
এ অতি উত্তম প্রস্তাব কোনও সন্দেহ নেই। ভারতের বৈদগ্ধ্যগত ইতিহাসের প্রতি যাঁরই কণামাত্র মমতা আছে, তিনিই এ কর্মে সহায়তা করবেন এ বিশ্বাস আমাদের মনে আছে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, একমাত্র ভারতীয় পণ্ডিতেরাই যদি একাজে সহায়তা করেন, তা হলেই অল্পদিনের ভিতর বিস্তর উন্নতি দেখানো সম্ভবপর হবে।
এ কাজের জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে সে প্রশ্ন অবান্তর।
এ কাজ যখন সম্পূর্ণ করতেই হবে, তখন টাকা যোগাড় করতেই হবে।
কিন্তু প্রধান প্রশ্ন এসব বই পড়বে কে?
সংস্কৃত ভাষার (পালি ও প্রাকৃতের কথা থাক) চর্চা বাংলা দেশে এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেকথা যারা আনন্দবাজারে চিঠিপত্রে জনমত পড়ে থাকেন তারাই জানেন। কেউ কেউ স্কুল-কলেজে সংস্কৃত চর্চার জন্য যে ব্যবস্থা করতে চান, সেটা বাচ্চাকে ক্রমে ক্রমে মায়ের দুধ ছাড়ানোর মতনই। অন্যেরা বাচ্চাটাকে বাকি জীবন আধমরার মতো করে রাখতে চান। যারা ভালো করে সংস্কৃত পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে চান, তারা যেন কল্কে পাচ্ছেন না বলে মনে হচ্ছে। বাংলার বাইরেও অবস্থা প্রায় একই। টোল-পাঠশালা বাঁচিয়ে রাখবার জন্য পণ্ডিতদের দু মুঠো অন্ন দেবার প্রস্তাব কেউ করেছেন বলে জানিনে।
শেষটায় কী হবে বলা শক্ত। তবে আশা করি, পাঠক আমার ওপর চটে যাবেন না, যদি নিবেদন করি যে, এ দেশে সংস্কৃতচর্চা ব্যাপকভাবে হওয়ার আশা দুরাশা। অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ, যেখানে ক্লাসিস্ পড়ানোর জন্য গণ্ডা গণ্ডা জলপানি রয়েছে, সেখানেই যখন বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতির মোহে পড়ে ছাত্রেরা ক্লাসিক বর্জন করেছে, তখন এ গরিব দেশ সংস্কৃতের জন্য কাকে কী প্রলোভন দেখাতে পারে?
অথচ স্বরাজ পাওয়ার পরও ভারতীয় তরুণ যদি আপন সংস্কৃতিচর্চা না করে, তবে সে এদেশে গড়ে তুলবে কী বস্তু? জলের বাঁধ, বিজলির প্রসার, কারখানার ছয়লাপ করে করেই তো একটা জাত বেঁচে থাকতে পারে না। আত্মার ক্ষুধাও তো রয়েছে– আজ না হয় পেটের ক্ষুধায় সেটাকে অস্বীকার কিংবা অবহেলা করে যাচ্ছি।
অতএব আমি মনে করি, ভারতীয় সংস্কৃতি সহজবোধ্য করে তুলতে হবে।
অর্থাৎ তিব্বতি চীনা থেকে যেসব বই অনুবাদ করা হবে, সেগুলো যেন হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি ভাষাতে সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করার ব্যবস্থা করা হয়। ইংরেজিতে অনুবাদ না করলেও ক্ষতি নেই আজকের দিনের ছেলে-ছোকরারা যখন দাশগুপ্তের ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস ইংরেজিতে পড়ে না, কিংবা পড়তে পারে না, তখন আর চীনা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ করে কী লাভ।
আমার মতো পাঁচজন বুড়ো মাথা চাপড়ে হয়তো জিগ্যেস করবেন, আমাদের এ অবস্থা হল কেন? সংস্কৃত কি তবে এদেশ থেকে লোপ পেয়ে যাবে? উত্তরে বলি, কালধর্ম।