রায় পিথৌরার কলমে – ১২

১২.

ভূতনাথ এবং তস্য বন্ধু মদনগোপাল কী করিয়া যে গঞ্জিকাসক্ত হইল তাহার সঠিক সন্ধান মেলে না। পরোপকারার্থে তাহারা প্রায়ই নিমতলা, কেওড়াতলা গমনাগমন করে; হয়তোবা সেই উপলক্ষে বন্ধুদ্বয় এই ধূম্ৰাত্মক রসে নিমজ্জিত হইয়াছিল।

গুরুজনরা এই সংবাদ শুনিয়া বিচলিত হইলেন। তাহারা ভূতনাথ ও মদনগোপালকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, দ্রসন্তানের এ কী আচরণ! আমরা বড়ই মর্মাহত হইয়াছি।

ভূতনাথ মদনগোপাল অতিশয় নম্র স্বভাব ধারণ করে; নতমস্তকে গুরুজনদের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া রহিল।

কোনওপ্রকারের আপত্তি অনুযোগ কিংবা উচ্চবাচ্য করিল না বলিয়া গুরুজনদের হৃদয় ঈষৎ দ্রবীভূত হইল। একজন বলিলেন, পালা-পার্বণে, অবরে-সরে না হয় কিঞ্চিত সন্মার্গভ্রষ্ট হইলে; কিন্তু নিত্য নিত্য– এইমাত্র বলিয়া সহৃদয় গুরুজন তৃষ্ণীভাব অবলম্বন করিলেন।

ভূতনাথ এবং মদনগোপাল ওই পন্থাই অবলম্বন করিবে মৌনভাবে এইরকম একটা প্রতিশ্রুতি দিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিল।

গৃহের দেহলি প্রান্তে গোধূলি লগ্নে ভূতনাথ ও মদনগোপাল নির্জীবের মতো পড়িয়া আছে। গঞ্জিকালগ্ন গতপ্রায়– ধূম্ররস না পাইয়া উভয়ই অতিশয় বিরস বদন। কিন্তু উপায়ান্তরই-বা কী? গুরুজনকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হইয়াছে, পালা-পার্বণ ব্যতীত গঞ্জিকারসে নিমজ্জিত হইবে না।

হঠাৎ রোদনধ্বনি শোনা গেল। মদনগোপাল তৎক্ষণাৎ সংবাদ নিতে প্রস্থান করিল। মুহূর্তেক মধ্যেই দ্রুতগতিতে প্রত্যাগমন করিয়া চিৎকার করিল ওরে ভূতো, ঝপ করিয়া একটা চিলিম সাজো। চুনীর মাতা গত হইয়াছেন।

ভগবান দয়াময়। পালা-পার্বনের সন্ধানে থাকিলে চুনীর মাতার মৃত্যুও পালারূপেই গণ্য করা যাইতে পারে।

রায় পিথোরা ভূতনাথ গোত্রীয়।

হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান আমার সম্মুখে স্ব স্ব পালা-পার্বণে আনন্দে নিমজ্জিত হইবেন এবং আমি দাঁড়িয়ে বাহিরে দ্বারে মোরা নরনারীর একজন হইয়া সেই রসস্রোতে নিমজ্জিত হইতে পারিব না, এই কুব্যবস্থার কল্পনামাত্র করিতেই আমি শিহরিয়া উঠি। তাহা হইলে আমি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অধিবাসী হইলাম কোন দুঃখে? অম্মদেশীয় মহাপুরুষগণ হিন্দুর মন্দিরদ্বার উন্মোচন করেন, ঈদোৎসবে মুসলমান সখাগণ দ্বারা নিমন্ত্রিত হয়েন, এই তাবৎ অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ সম্মুখে বিদ্যমান থাকিতে আমিই-বা কোন সম্প্রদায়-বিশেষের পালা-পার্বণে নিজেকে কূপমকের ন্যায় সীমাবদ্ধ করিব।

বড়দিন আসিল কিন্তু হায় কোথায় সেই ইংরেজ সম্প্রদায় যাহাদের প্রসাদাৎ গুরুভোজন এবং গুরুতর পানের সুব্যবস্থা হইত। খ্রিস্ট জন্মদিনের পূর্ব সন্ধ্যায় দেহলি প্রান্তে তাই অতিশয় বিরস বদনে মনে মনে ইংরেজকে অভিসম্পাত দিয়েছিলাম, স্বরাজ প্রদান করিলে তো করিলে (সে তো অস্থিমজ্জায় বারম্বার অনুভব করিতেছি) কিন্তু এই দেশ ত্যাগ না করিলে কি তোমাদের বাইবেল অশুদ্ধ হইয়া যাইত? অন্ততপক্ষে খ্রিস্টদিগকে খ্রিস্টধর্মে বাপ্তিস্ম করিবার সর্ববাসনা কি তোমাদিগের চিরতরে লোপ পাইয়াছে।

দেহলি প্রান্তে বিশ্বেশ্বর বলুন, কাবা বলুন, এখানকার চক্রবর্তী কনট (পাঞ্জাবি উচ্চারণ ক্লাট সার্কল) সার্কল। সুসজ্জিত বিপণিমণ্ডলী চক্রাকারে এক সুরম্য উদ্যানকে পরিবেষ্টন করিয়া রহিয়াছে এবং অপূর্বদর্শন কামিনীগণ সুরম্য বেশভূষায় সুসজ্জিত হইয়া এই আপন চক্রে ঘূর্ণায়মান হইতেছেন। কোনও ললনা পাদুকা ক্রয় করিতে উপবেশন করিয়াছেন– রাতুল নোগ্র (চরণ বর্বর-যুগে প্রচলিত ছিল) সম্প্রসারিত করিয়া মধুর কণ্ঠে কাম্য পাদুকার নখ-শির বর্ণনা করিতেছেন। তাঁহার সম্মুখের পাদুকা-স্তূপ হিমাচলকে অনায়াসে লজ্জা দিতে পারে, সেই গগনচুম্বী স্কুপের পশ্চাতে আপণ-স্বামী কিংবা আপন স্বামী কাহাকেও আর দেখা যাইতেছে না। আহা কী মধুর দৃশ্য!

কোনও নাগরী কঞ্জুলিকার জন্য গলবস্ত্র হইয়াছেন– অর্থাৎ ময়ূরকণ্ঠী চীনাংশুক খণ্ড অমলধবল গলে জড়িত করিয়া পুনঃপুন নিরীক্ষণ করিতেছেন বর্ণসামঞ্জস্য শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে সুবিন্যস্ত হইতেছে কি না। সখীগণ নানাপ্রকারের সদুপদেশ দিতেছেন, পরমগুরু পতিদেব বস্ত্রমূল্য শ্রবণকরত পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিয়াছেন, ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদকল্পে ওষ্ঠাধর উন্মোচন করিবার পূর্বেই নাগরীর নাসিকা স্ফীত হইতে লাগিল।

রায় পিথৌরা দ্রুতগতিতে বিপণি ত্যাগ করিলেন।

হায় খ্রিস্ট জন্মোৎসব! বিপণি-আপণ প্রদর্শন করিয়াই আমার উৎসব সমাধান হইবে?

অকস্মাৎ স্কন্ধোপরি চপেটাঘাত। দেখি, পারসি মিত্র, রুস্তম ভাই মিনুচিহর নাদির শাহ! তুমি মোহময়ী (বোম্বাই) ত্যাগ করিয়া দেহলি প্রান্তে কেন?

কর্মোপলক্ষে।

উত্তম উত্তম।

খ্রিস্ট জন্মোৎসব পালন করিতেছ না?

 দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলাম, খ্রিস্টান বন্ধু কেহই নাই।

নাদির শাহ স্কন্ধোপরি পুনরায় চপেটাঘাত করিয়া বলিল, এইমাত্র অনটন, তুমি কি বিস্মৃত হইয়াছ যে আমার পিতামহ জরথুস্ত্র ধর্ম ত্যাগকরতঃ খ্রিস্টের স্মরণ লইয়াছিলেন। আইস বত্স, এই নির্বান্ধব পুরীতে কোনও ভোজন এবং পানশালাকে আমাদিগের পৃষ্ঠপোষকতা দান করিয়া তাহাদিগকে কৃতার্থম্মন্য করি।

নাদির শাহ অতিশয় গুণী ব্যক্তি। ভোজনগৃহে প্রবেশকরতঃ সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করিল, শিশির ঋতুতে ব্র্যান্ডিই প্রশস্ত। তৎপর অন্য বস্তু সম্বন্ধে আলোচনা হইবে।

আমি বলিলাম, আমার দুর্বলতা আহারাদির প্রতি।

নাদির শাহ বলিল, ভ্রাতঃ, আমার মাতামহী বিশুদ্ধ ইরানবাসিনী, বাল্যকাল হইতে আমি ইরানি খাদ্য ভূরি ভূরি আহার করিয়াছি। প্রথম যৌবন দিল্লিতে কর্তন করি– মোগলাই খাদ্য আমার অপরিচিত নহে। গৃহিণী ফরাসিনী; অতএব ভ্রাতঃ, বিবেচনা কর এই সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা কিছু বেশি।

প্রথম আসিল ফরাসিস পদ্ধতিতে অরদ (hors-d’oeuvre)। নানা অংশে বিভক্ত যে বিরাট খুঞ্জা আসিয়া উপস্থিত হইল তাহাতে অন্তত দশাধিক রকমের খাদ্য। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জর্মন (ফ্রাঙ্কফুটার) সসিজ, ভর্জিত এবং অভর্জিত বেকন এবং হ্যাম, জলপাই তৈলসিক্ত টোস্টাসিন রৌপ্যবর্ণের সার্দিন মৎস্য, অতিশয় নমনীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অমলেট খণ্ড, সিরকা-নিমজ্জিত পলা-ত্রপুষী-কোষা (প্যাঁজ-কাঁকুড়-জলপাই), রুশদেশ হইতে সদ্যাগত কাভিয়ার বা মৎস্য-ডিম্বের স্যান্ডউইচ, সেই রুশ পদ্ধতিতে মাইয়নেজ মধ্যে সুপ কুকুটু-ডিম্ব। অন্য খাদ্যবস্তুগুলির গোত্রবর্ণ অনুমান করিতে পারিলাম না।

নাদির শাহ বলিল, ক্ষুধাকে তীক্ষ্ণতর করিবার উপাদান। স্পর্শ করিবে মাত্র– অনাহারের জন্য ব্যাপকতর ব্যবস্থা।

ধন্য নাদির শাহ।

বলিল, সুপ খাইলে অনর্থক উদর পূর্ণ হইয়া যায়। অতএব সুপ সর্বথা বর্জনীয়। ডাচেস অব উইনজার নিমন্ত্রণে কদাচ সুপ পরিবেশন করেন না। অতএব এক্ষণে আসিবে তন্দুর-মৎস্য।

আমি বলিলাম, তন্দুর-মুরগি খাইয়াছি কিন্তু তন্দুর-মৎস্য?

অর্থাৎ তন্দুরে প্রস্তুত মৎস্য– ওভেন-বেকড ফিশ!

সে মৎস্য দেখিয়া মনে হইল অপকূ বস্তু। যেন মৃত মৎস্য খাইতে দিয়াছে। অথচ স্পর্শ করিবামাত্রই তিনি নমনীয় কমনীয় খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্ন হইলেন। তন্দুরের উষ্ণতা চতুর্দিক হইতে সমভাবে মৎস্যের সংলগ্ন হইয়াছে বলিয়া তিনি অপূর্ব রসনাভিরাম রবস্তু হইতে সক্ষম হইয়াছেন।

নাদির শাহ আদেশ দিল, ইহার সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভিয়েনিজ ক্রোয়ার্স ভক্ষণ কর।

তুর্করা যখন ভিয়েনার নগরদ্বারে পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হয় তখন সেই ঘটনার স্মরণার্থে ভিয়েনা-বাসীরা অর্ধচন্দ্রের (ক্রোয়ার্স-ক্রিসেন্ট) আকারে এক কোমল অথচ মর্মরিত রুটি নির্মাণ করে। অতিশয় উপাদেয় লঘু খাদ্য।

অতঃপর তন্দুরি-মুরগি এবং আফগানি নান-রুটি। তাহার বর্ণনা আমার সুরসিক পাঠকদিগকে পূর্বেই নিবেদন করিয়াছি।

নাদির শাহ একাধাধিক নিষিদ্ধ পক্ষী ভক্ষণকরতঃ বলিল, এইবারে সত্য আহার আরম্ভ হউক। ওয়েটারকে বলিল, মটর-কোপ্তা-বিরিয়ানি, আলু-মটরশুটি মুরগি কারি, কিঞ্চিৎ কোপ্তা নরগিস্ (কলিকাতার ডেভিল) এবং অত্যল্প শূল্যপক মিশরি কাবাব (কলিকাতার শিক কাবাব)। আর দেখ, মুরগি-কারিতে যদি যথেষ্ট ঝোল না থাকে তবে এক পাত্র রৌগন-জুশ এবং কিঞ্চিৎ ক্রিম-লেটিস সালাড। উপস্থিত (এবং এই শব্দটি নাদির যথেষ্ট দঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করিল) ইহাই যথেষ্ট।

আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, বলিতে পারো, মূর্খেরা সালাড় কেন জলপাই (অলিভ) তৈল দিয়া প্রস্তুত করে? সেই তৈলে না আছে গন্ধ না আছে কোনওপ্রকারের তীব্রতা। সালাডের পক্ষে বঙ্গদেশে প্রচলিত সরিষার তৈলই প্রশস্ততম। তুমি এক কাজ কর। কিঞ্চিৎ মাস্টার্ড জলে তরল করতঃ সালাডের সঙ্গে সংমিশ্রণ করিয়া দাও।

ধন্য ধন্য নাদির শাহ; তুমি বঙ্গভূমিতে পদার্পণ না করিয়াও কী প্রকারে অবগত হইলে আমরা স্ফীততণ্ডুল সরিষার তৈল সহযোগে ভক্ষণ করি।

আহারে ক্ষান্ত দিয়া নাদির বলিল, ইহারা ঘৃতসিক্ত উত্তম পরোটা নির্মাণ করিতে জানে না। নতুবা পোলাও-কারির অন্তরালে মধ্যে মধ্যে সেই বস্তু চর্বণ রসনাকে বহ্বান্ন ভক্ষণে উৎসাহিত করে।

অতঃপর নাদির শাহ বলিল, মিষ্টান্ত সম্বন্ধে অহেতুক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়ো না। আমি তাহার সুব্যবস্থা করিয়াছি।

রসগোল্লা লেডিকিনি এবং সন্দেশ!!

নাদির বলিল, শুনিয়াছি, কলিকাতার তুলনায় নিকৃষ্ট। তুমি অপরাধ নিয়ো না।

ধন্য নাদির। নাদির ভারত জয় করিয়াছিল; তুমি খাদ্যব্রহ্মাণ্ড জয় করিয়াছ।

আশা করি, এই খাদ্যনির্ঘণ্ট দেহলি প্রান্তাগত বঙ্গবাসী স্মরণ রাখিবেন। আমাকেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *