রায় পিথৌরার কলমে – ১১

১১.

একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে মিস মেয়ে কিংবা বেভারলি নিকলস যে উদ্দেশ্য আর যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এদেশে এসেছিলেন শ্রীমতী রজোভেল্ট আদপেই সে রূপ নিয়ে আসেননি। ভারতবর্ষের ভালো-মন্দ পাপ-পুণ্য নিয়ে তিনি যেমন কড়া কড়া কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেন না ঠিক তেমনি তিনি অকারণ অসময়ে আমাদের পিঠ চাপড়ে আমরা যে বড় সুবোধ ছেলে সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চান না।

তাঁর দৃষ্টি আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যার দিকে। আজকের দিনে আমেরিকারই অঢেল রেস্ত আছে; ভারতের উন্নতির জন্য এদেশীয় বহুলোক খাটবার জন্যও তৈরি আছেন। এ দুয়ে মিলে যে অনেক সকর্ম সমাধান হতে পারে সে বিষয়ে কারও মনে কোনও দ্বিধা নেই। শ্ৰীমতী রজোভেল্ট ঠিক এই জিনিসটিই মনে রেখে এ দেশে বহু পর্যবেক্ষণ করেছেন ও দিল্লির তাবৎ সভা এবং পার্টিতে এ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন– অতিশয় সহিষ্ণুতার সঙ্গে সর্ব প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিয়েছেন।

এদেশের অনেকেরই মনে ভয় শুধু কম্যুনিস্ট না, অন্য পাঁচজনেরও আমরা যদি একবার মার্কিন টোপ গিলি তা হলে আর মার্কিন রাজনৈতিক বঁড়শি থেকে কস্মিনকালেও ছাড়া পাব না। এর উত্তরে প্রথম বক্তব্য ইংরেজি প্রবাদ, নো রিস্ক, নো গেন সম্পূর্ণ মিথ্যে নয়। দেশীয় প্রবাদের ভাষায় বলি, সাপ মারতে গেলে লাঠি ভাঙবেই ভাঙবে একথা হলফ করে বলা যায় না, মাঝে মাঝে না-ও ভাঙতে পারে।

দ্বিতীয়ত আমার বিশ্বাস পৃথিবীর বুদ্ধিমান জাত এখন আর ডাণ্ডা বুলিয়ে অন্য দেশের ওপর রাজত্ব করতে চায় না। এখন সে চায় অর্থনৈতিক রাজত্ব– অর্থাৎ পৃথিবীর আর পাঁচটা জাতের কাছে নিজের সুবিধেয় মাল বেচতে। তবে যদি বলেন, আমেরিকার কাছ থেকে রেস্ত নিলে আমরা তাদের অর্থনৈতিক আওতায় এসে যাব তা হলে নিবেদন, রুশ ভিন্ন পৃথিবীতে আজ কোন জাত মার্কিনি আওতার বাইরে? এই যে মহামান্য ইংরেজ মহাপ্রভুরা দুনিয়ার সর্বত্র দাবড়ে বেড়ান তেনাদের অবস্থাটা কী? আজ যদি তারা মার্কিনের সঙ্গে বড্ড বেশি তেড়িমড়ি করে তবে কাল কাক-কোকিল ডাকবার আগেই মাংসটা আণ্ডাটার দাম চড়চড় করে আসমানে চড়ে ডালটার উপর বসে ঠ্যাং দুলাবে। বাজার করতে গিয়ে তার চরণের ধুলোটি স্পর্শ করা যাবে না।

তবে হ্যাঁ, আলবৎ, স্বেচ্ছায় আমরা এরকম অবস্থা বরণ করে নেব কেন?

আমার অন্ধ বিশ্বাস ভারত বিরাট দেশ তাই সে কারও ধামাধরা না হলেও বেঁচে থাকতে পারবে। তার পূর্বে অবশ্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কৃষির সুব্যবস্থা করা। তার জন্যে প্রয়োজন জলের বাঁধ, বিজলির আলো। আরও দরকার কৃষির জন্য উন্নত কলকবজা, সার। এসবের জন্য উপস্থিত রেস্তর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ, একবার তার কৃষি আপন পায়ে দাঁড়াতে পারলে তখন আর কোনও ভাবনা থাকবে না।

আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, রায় পিথৌরা অতিশয় অমায়িক লোক। তিনি কারও কাছে অঋণী হয়ে মরতে চান না, তাই যদি এসব বাবদে রুশরা সাহায্য করতে চান, তবে তিনি তাদেরও সাহায্য নিয়ে রুশ জাতটাকে কৃতার্থম্মন্য করতে প্রস্তুত আছেন।

রুশের আওতায় পড়ে যাব? তার ভয় আরও কম। পূর্বে বলেছি, বুদ্ধিমান জাত অন্য দেশের ওপর রাজত্ব করতে চায় না। তাই ইন্দোচীনে ফ্রান্সের কাণ্ডকারখানা দেখে কী বলব ভেবে পাইনে।

গোড়ায় আমেরিকা ইন্দোচীনের ঝামেলায় নামতে চায়নি। ওদিকে ফ্রান্সের গাঁটে এত কড়ি নেই যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে একখানা আস্ত লড়াই চালাবার মতো বিলাস উপভোগ করতে পারে। তাই ফরাসিরা মেলা কায়দাকেতা করে, মেলা নল চালিয়ে মার্কিনকে নামাল তার দয়ে।

ওদিকে মার্কিন নামা সত্ত্বেও রাধা-নাচের নমণ তেল জ্বালাতে গিয়ে ফ্রান্সের আপন দেশে লাল বাতি জ্বলে আর কি। ফ্রান্সে এখন বহু বিচক্ষণ লোক দটা থেকে কোনও গতিকে বেরুতে পারলে বাঁচেন কিন্তু হায় ইতোমধ্যে মার্কিন চটে গিয়ে বলছে, ইয়ার্কি পেয়েছ? আমাকে নামিয়ে দিয়ে এখন কেটে পড়তে চাও? সেটি হচ্ছে না যে জল ঘোলা করেছ সেটা তোমাকেও খেতে হবে। মার্কিনি ভাষায়, ইন ইয়োর ওন জুস–আপন রসে সিদ্ধ হও।

ফ্রান্সের লোক বেহুলার ভাসান শোনেনি– তা হলে ইন্দোচীনের ঘাটের দিকে যেত না–

ও ঘাটে যেয়ো না বেউলো
বেভলো আমার মা
চাঁদের ব্যাটা দুশমন নখা
দেখলে ছাড়বে না।

শ্ৰীযুত সুবিমল দত্ত আমাদের ভারতের রাজদূত হয়ে জর্মনি যাচ্ছেন। উপস্থিত জর্মনির রাজধানী বন শহরে তাই বলে কেউ যেন না ভাবেন মহাশয় বনবাসে চললেন।

বন জর্মনির সেরা সুন্দর শহর। সামনে রাইন নদী, পিছনে ভিনাস পাহাড়, রাইনের ওপারে সিবেন গেবির্গে বা সুপ্ত পর্বত। চতুর্দিকে বাগান, চতুর্দিকে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি। শহরের ভিতরেও বিস্তর কাঁচা সবুজ পার্ক।

আর লোকগুলো ভারি চমৎকার। বন শহরটা জর্মনের সীমান্তে, বেলজিয়ামের গা ঘেঁষে। ফ্রান্সের সঙ্গেও তার বিস্তর দহরম মহরম। বন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর বিদেশি ছাত্র পড়াশোনা করে, ততোধিক টুরিস্ট বনে প্রতিবছর বেড়াতে আসে তাই বন-বাসিন্দা চিরকালই একটুখানি আন্তর্জাতিক বিশ্বনাগরিক প্রকৃতির খাঁটি প্রাশানদের মতো কুনো আর দাম্ভিক নয়।

স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ইংরেজের তাড়া খেয়ে খেয়ে বহু ভারতীয় শেষ আশ্রয় নিত জর্মনিতে। জর্মনরা কোনও কালেই ভারতীয়দের আশ্রয় দিতে কার্পণ্য করেনি। তাই যখন যুদ্ধের পর অনেক জাত কে কত ক্ষতিপূরণ পাবে তার আলোচনা করছিল তখন ভারতীয় সরকার স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন যে, জর্মনদের ওপর আমাদের কোনও দাবি-দাওয়া নেই। যেসব ভারতীয়দের জর্মনির সঙ্গে কোনওপ্রকারের যোগাযোগ ছিল তারাই এ সংবাদ শুনে উল্লাস বোধ করেছিলেন।

যৌবনে বন শহরে রায় পিথৌরা জর্মন সতীর্থদের সঙ্গে বসে বসে স্বাধীন ভারতের সুখস্বপ্ন দেখতেন। সেসব সতীর্থেরা সংস্কৃত ও ভারতীয় ঐতিহ্যের আলোচনা করতেন বলে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতেন না ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতা হারাল কী করে। এবং তাই বোধহয় তারা জোর গলায় বারবার বলতেন, ভারতবর্ষ খুব শীঘ্রই পুনরায় তার স্বাধীনতা ফিরে পাবে। কিংবা হয়তো আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বলতেন, কে জানে?

স্বাধীনতা লাভের পরই আমি এঁদের কাছ থেকে বহু আনন্দ অভিনন্দন পাই। একজন লিখলেন, তুমি তোমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট দেখাতে সবসময়ই লজ্জা অনুভব করতে। এইবার ভারতীয় পাসপোর্ট বুকে দুলিয়ে সোজা জর্মনি চলে এস।

ভারতের স্বাধীনতা লাভে এঁরা কতখানি উল্লাস বোধ করেছেন সেকথা আমি জানি, কিন্তু প্রকাশ করার মতো ভাষার দখল আমার নেই।

দত্ত মহাশয়কে জর্মনরা সাদরে গ্রহণ করে নেবে সেকথা আমি নিশ্চয় জানি, তার প্রধান কারণ দত্ত মহাশয় অতিশয় অনাড়ম্বর লোক! জর্মনির প্রতি তাঁর প্রীতি আছে– কিছুদিন পূর্বে ডা. শাখট যখন ভারতে আগমন করেন তখন উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছিল।

যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তাঁরা বলতে পারবেন জর্মনির সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগসূত্রের ফলে আমাদের কী কী লাভ হবে। আমি বলতে চাই, তার চেয়েও আমাদের বেশি লাভ হবে যদি আমাদের মধ্যে বৈদগ্ধ্যগত আদান-প্রদান নিবিড়তর হয়। জর্মনিতে সর্বপ্রথম সংস্কৃত চর্চা আরম্ভ হয় বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখনও সে চর্চা জোর এগিয়ে চলছে। বনের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র উত্তমরূপে স্থাপিত হলে এদেশের সংস্কৃত-চর্চা অনেকখানি উৎসাহ পাবে।

রাজদূতের মেলা কর্ম, অনেক ঝামেলা। কিন্তু দত্ত উচ্চশিক্ষিত লোক; তিনি কৃষ্টিগত যোগসূত্র স্থাপনে উৎসাহিত হবেন এ বিশ্বাস আমার আছে।

রুশদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। তাদের পর্যবেক্ষণ শক্তি আছে।

একদা মিশনারিরা এদেশে অকাতরে বিনামূল্যে লক্ষ লক্ষ বাইবেল বিতরণ করেছিলেন। ফ্রি বলে সেগুলো লোকে পড়ত না। তখন মিশনারিরা বাইবেল বিতরণ একদম বন্ধ করে দিলেন। ফলে আজ যদি আপনি বাইবেল পড়তে চান, তবে গাঁট থেকে অন্তত টাকা দশেক না খসালে একখানা ভালো বাইবেল পাবেন না। কাজেই অবস্থা পূর্ববৎ বাইবেল এখনও কেউ পড়ে না।

রাশানরা দিল্লির বাজারে ছেড়েছে এন্তার মার্কস, লেনিন, স্টালিন, লের্মেন্টফ, চেখক, কিন্তু একদম ফ্রি নয়, আবার ন্যায্যমূল্য থেকে অনেক সস্তা। দেড় টাকায় লের্মেন্ট পেয়ে যাচ্ছেন– ভালো কাগজ উত্তম ছাপা। আপনাকে ঠেকায় কে? এবং যেহেতু কাঁচা পয়সা ফেলে তেল কিনছেন তখন সে তেল আজ না হোক কাল মাখবেনই।

এসব বইয়ের চাপে পড়ে মার্কিন মুলুকের সস্তা কেতাব ছাড়া ইংরেজি আর কোনও কেতাব আমার বাড়ির সামনের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে না। স্টলওলা বলল, রাশায় ছাপা ইংরেজি বই বিক্রি করলে কমিশনও নাকি বেশি পাওয়া যায়।

আমার শুধু দুঃখ রাশানরা যত না মার্কস-এঙ্গেলস্ লেনিন-স্টালিন ছাড়ছে তার শতাংশের এক অংশও টলস্টয়, পুসকিন, দস্তায়স্কি, তুর্গেনিয়ে দিচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *