রায় পিথৌরার কলমে – ১০

১০.

 ইউফ্রেতিস তাইগ্রিসের পারে আসিরীয় বাবিলনীয় সভ্যতা বেরোল, নীল নদের পারে মিশরীয়, পীতনদের পারে চৈনিক। গঙ্গাপারের আর্যসভ্যতা এদের চেয়ে কয়েক হাজার বছরের ছোট। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বহুকাল ধরে মনে মনে আশা পোষণ করছিলেন যে গঙ্গা কিংবা সিন্ধুপারে হয়তো-বা একদিন কোনও এক প্রাক-আর্য এবং আসিরীয় বাবিলনীয় মিশরীয় সভ্যতার সমসাময়িক ওই জাতীয় প্রাচীন সভ্যতা বেরুবে।

তাঁদের সে আশা পূর্ণ করলেন স্বর্গীয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্ব-জগৎ একদিন বিস্ময় মেনে শুনল সিন্ধু নদের পারে মোন-জো-দড়া নামক স্থানে রাখালদাস এক প্রাক আর্যসভ্যতা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সভ্যতা সম্বন্ধে এস্থলে সবিস্তর বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। শিক্ষিত ভারতীয় মাত্রই এ সভ্যতার উৎপত্তি বিকাশ পতন সম্বন্ধে কিছু না কিছু খবর রাখেন।

গোড়ার দিকে পণ্ডিতেরা মনে করেছিলেন এ সভ্যতা কেবলমাত্র সিন্ধু পারে-পারেই বিকশিত হয়েছিল। তাই তারা এর নামকরণ করেছিলেন সিন্ধ উপত্যকা সভ্যতা। কিছুদিন পরে ক্রমে ক্রমে সে ভুল ভাঙল–দেখা গেল, এ সভ্যতা সিন্ধু পেরিয়ে এবং ছাড়িয়ে সুদূর অবধি বিস্তৃত ছিল।

তারই সন্ধানে অরেলস্টাইন ভাওয়ালপুর স্টেট (পাকিস্তান) ও তারই সীমান্তে বিকানির রাজ্যে ১৯৪১ সালে খোঁড়াখুঁড়ি করেন। তারই প্রতিবেদন অরেলস্টাইন অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকরূপে বর্ণনা করেছেন তার কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে, কিছুটা পরে প্রকাশিত হবে।

নানা কথার ভিতর অরেলস্টাইন একথাও বলেন যে, ভাওয়ালপুর স্টেটের ফোর্ট আব্বাসের পূর্ব দিকে আর কোনও জায়গায় মোন-জো-দড়ো সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়নি। অরেলস্টাইন এ মন্তব্যটি করেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। আজকের ভাষায় বলা হবে, পাকিস্তানেই মোন-জো-দড়ের শেষ নিদর্শন পাওয়া যায়– পূর্বদিকে অর্থাৎ ভারতে পাওয়া যায় না।

কেন্দ্রীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহ-অধ্যক্ষ শ্ৰীযুত অমলানন্দ ঘোষ এ বছরে শীতকালটা বিকানির স্টেটে খোঁড়াখুঁড়ি করে ফিরে এসেছেন।

তাঁর প্রধান কর্মস্থল ছিল সরস্বতী নদীর মধ্যভূমি–মনু এ ভূমিকে পুণ্যভূমি ব্ৰহ্মাবর্ত নামে উল্লেখ করেছেন। দৃষদ্বতীর উত্তরে এবং সরস্বতীর দক্ষিণে ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র– মহাভারতকার বলছেন, কুরুক্ষেত্রে বাস স্বর্গলোকে বাস করার ন্যায়।

শ্ৰীযুত অমলানন্দ ঠিক কোন কোন জায়গায় তার অনুসন্ধানকর্ম সমাধান করেছেন তার সবিস্তর বর্ণনা খবরের কাগজের মারফতে পেশ করা কঠিন– এখন অসুবিধা এই যে তার জন্য ম্যাপের প্রয়োজন; মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে তিনি সরস্বতী এবং দৃষদ্বতী দুই নদীর পারে পারে অনুসন্ধান করতে করতে তাদের সঙ্গমভূমি এবং তারও পশ্চিমে অনূপগঢ় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। অনুপগঢ় থেকে প্রায় ছ মাইল দূরে ভাওয়ালপুর রাজ্যের সীমানা। শ্ৰীযুত ঘোষ ভাওয়ালপুর যাননি। ভাওয়ালপুর যাওয়ার উপায় নেই– সে জায়গা পাকিস্তানে সবাই জানে।

অরেলস্টাইনের মতো গুণী বলে গেলেন এ তল্লাটে কিছু পাবে না– এমনকি শ্ৰীযুত ঘোষ যেসব জায়গা খুঁজেছেন তারও দু একটা স্টাইন খুঁড়ে নাকচ করে দিয়ে গিয়েছিলেন আর তখন যদি ঘোষ সেখানে গিয়ে দুম করে হারাপ্পা মোন-জো-দভোর খোঁজ পান তখন ব্যাপারটা কীরকম হয় বলুন তো?

এই বেলা পাঠককে একটু সাবধান করে দিই।

যারা মোন-জো-দড়ো সভ্যতা খুঁটিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁরা জিগ্যেস করবেন, তবে কি ঘোষ মোন-জো-দড়া সভ্যতার নরনারীর জাত-গোত্র ঠিক করে ফেলেছেন তারা আর্য দ্ৰবিড় না অন্য কোনও জাত– তবে কি ঘোষ হারাপ্পা-লিপির পাঠোদ্ধার করতে পেরেছেন, তবে কি তিনি সপ্রমাণ করতে পেরেছেন যে, আর্য এবং হারাপ্পা সভ্যতাতে সঙ্ঘর্ষ বেধেছিল, তবে কি তিনি বলতে পারেন হারাপ্পা সভ্যতা হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে গেল কী প্রকারে?

ঘোষ এসব প্রশ্নের একটারও উত্তর দেননি। তবুও আমি ঘোষের প্রত্নতাত্ত্বিকতায় এত উল্লাস বোধ করছি কেন?

প্রথমত, দৃঢ়নিশ্চয় সপ্রমাণ হয়ে গেল যে, মোন-জো-দড়ো হারাপ্পা সভ্যতা শুধু সিন্ধু দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পূর্বদিকে উজিয়ে উজিয়ে বিকানির পেরিয়ে পূর্ব পাঞ্জাব অবধি এসে ঠেকেছিল অর্থাৎ আগে যে বলা হয়েছিল মোন-জো-দড়ো হারাপ্পা সভ্যতা গুটিকয়েক জায়গাতে (শহরে) সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সপ্রমাণ হল বেলুচিস্তান থেকে পূর্ব পাঞ্জাব এই সাত শো মাইল এক বিরাট সভ্যতার লীলাভূমি ছিল এবং এই বিস্তৃতি সে যুগের পৃথিবীর যে কোনও সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।

দ্বিতীয়, এ সভ্যতা লোপ পাওয়ার পর এক দ্বিতীয় সভ্যতার সন্ধান ঘোষ পেয়েছেন। তার বৈশিষ্ট্য যে সে হারাপ্পার রঙ ও নকশার হাঁড়ি কলসি বানায়নি তার রঙ গ্রে (মেটে) এবং একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে এ সভ্যতা হারাপ্পার পরের সভ্যতা। এই মেটে সভ্যতার (গ্রে ওয়েসার) নরনারী কারা সে সম্বন্ধেও এখনও কিছু বলা যায় না, তাদের যুগনির্ণয়ও সুকঠিন, তবে মোটামুটি আন্দাজে বলা যেতে পারে যে, এদের সভ্যতার কেন্দ্রক্ষণ খ্রি. পূ. ৬০০। তা হলে নিচের দিকে হয়তো মৌর্যদের সঙ্গে এদের পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু উপরের দিকে হারাপ্পার সঙ্গে এর সংযোগ হয়নি। কারণ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, হারাপ্পা সভ্যতা যেসব আবাসভূমি পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিল (কিংবা নৈসর্গিক কোনও কারণে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল) সেগুলোতে এরা আপন বাসভূমি নির্মাণ করেনি। (মুসলমানরা রায় পিথৌরা, অর্থাৎ পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে তাঁরই রাজধানীতে আসন গেড়েছিল; সাত শো বছর পরে আজও রায় পির্থেীরার দুর্গের দেয়াল কুতুবমিনারের চতুর্দিকে দেখতে পাওয়া যায়। তা যাই হোক না কেন, এদেরই খেই ধরে ভবিষ্যতে মেলা আবিষ্কার হতে পারে সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।

তৃতীয়ত, যে আরেক সভ্যতার সন্ধান ঘোষ পেয়েছেন তার নাম দিয়েছেন, রঙ্গমহল সভ্যতা, কারণ বিকানিরের আধুনিক রঙ্গমহল অঞ্চলে এ সভ্যতার বিস্তর উদাহরণ তিনি পেয়েছেন। রঙ্গমহল মুসলমানি যুগের শব্দ– অর্থাৎ এ সভ্যতার অন্তত হাজার বছর পরেকার, কিন্তু রঙ্গমহল জায়গাটি বিকানিরে সুপরিচিত বলে এ নামকরণ করা হয়েছে।

এ সভ্যতা মেটে সভ্যতার পরবর্তী এবং নিঃসন্দেহ কুশান যুগ পর্যন্ত পৌঁছেছিল, এমনকি গুপ্ত যুগ পর্যন্ত, কারণ, গুপ্ত যুগের গান্ধার শিল্পের নিদর্শনও এতে রয়েছে।

এ তিন সভ্যতার নির্মাতা কারা, ঠিক ঠিক কোন যুগে এরা ভারতবর্ষে বসবাস করেছিল, একে অন্যের সঙ্গে এদের দ্বন্দ্ব হয়েছিল কি না, এসব তত্ত্ব এবং তথ্য জোর গলায় আজ বলা অসম্ভব।

শ্রীঅমলানন্দ ঘোষ বিকানিরে যে অদ্ভুত অধ্যবসায়ের সঙ্গে অনুসন্ধান করেছেন তাতে মেলা প্রশ্ন মাথা তুলেছে।

যেসব প্রশ্নের তিনি উত্তর দিয়েছেন সেগুলো পূর্বেই নিবেদন করেছি, কিন্তু নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করাও প্রত্নতাত্ত্বিকের কর্ম। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সুযোগ এবং সুবিধা পেলে– ঘোষ এখনও যুবক– তিনি অনেক কাজ করে বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ হবেন।

গত বৃহস্পতিবার আমাদের এক ঘরোয়া বৈঠকে ঘোষ আমাদের এ বাবদে বক্তৃতা দিয়ে তালিম দেন। সব জিনিস ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি বলে হয়তো ঘোষের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। ঘোষ সহৃদয় লোক, এ লেখা যদি তার হাতে পৌঁছয় তিনি মাপ করে দেবেন এ আশা মনে পোষণ করি। আমার উদ্দেশ্য, গুণীরা যেন এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে শ্রীমান ঘোষকে উৎসাহিত করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *