রায় পিথৌরার কলমে – ১

১.

একদা হিন্দুকুশের উত্তরপ্রান্ত ও পারস্যের পূর্ব সীমান্তের বহিক ও কপিশা, গান্ধার (বর্তমান বখ, কাবুল, জালালাবাদ) এইসব অঞ্চল ভারতের অংশরূপে গণ্য করা হইত এবং এইসব প্রদেশ হইতে বহু বিদ্যার্থী ভারতে আগমনপূর্বক বিদ্যাভ্যাস করিত। পরবর্তী যুগে নালন্দা-তক্ষশিলায় দূরতর দেশ হইতে আগত বহু ছাত্র বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের চর্চা করিত, এ তথ্যও আমাদের অবিদিত নহে।

বৌদ্ধধর্মের পতনের পর মুসলমানরা এই দেশের বড় বড় নগরে বিস্তর মক্তব-মাদ্রাসা স্থাপনা করেন। প্রাচীন পন্থানুযায়ী তুর্কিস্থান, বখ, কাবুল, জালালাবাদ হইতে পূর্বেরই ন্যায় বহু মুসলমান ছাত্র এই দেশে জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য আগমন করিত। অদ্যাবধি বহু উজবেগ (বাংলায় তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত উজবুক), হাজারা, আফগান তুর্কমান ভারতের দেওবন্দ, রামপুর, রাদের মাদ্রাসায় আগমন করিয়া ন্যূনাধিক চতুর্দশ বৎসর যাপন করত শেষ উপাধি গ্রহণ করিয়া স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করিত। ভারতবিভাগের পরও এ স্রোতধারা অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে; কারণ পাকিস্তানে দেওবন্দ, রামপুরের মতো উচ্চ শ্রেণির বিদ্যায়তন নাই।

ব্রিটিশ যুগে ইতিহাস অন্যরূপ ধারণ করিল। ব্রিটিশ স্কুল-কলেজে যে শিক্ষা দিল, আমরা তাহা বাধ্য হইয়া গ্রহণ করিলাম, কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীরা এই শিক্ষা যে কতদূর পদার্থহীন, তাহা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইয়া আপন সাধ্যমতো স্বদেশে বিদ্যায়তন নির্মাণ করিতে যত্নবান হইল। এই ব্যবস্থা ইংরেজেরও মনঃপূত হইল। পৃথিবীর সহিত আমাদের যোগসূত্র যত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয় ইংরেজের স্বার্থ ছিল সেই দিকে।

স্বরাজ লাভের পর আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি যে উন্নততর হইয়াছে তাহা নহে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করার জন্য পুনরায় একটি ক্ষীণ স্রোত বাহিয়া অল্পবিস্তর বিদ্যার্থী এই দেশে আগমন করিতেছে।

বার্লিন, ভিয়েনা, প্যারিস, জিনিভা উদ্বাহু হইয়া বিদেশাগত ছাত্রকে অভ্যর্থনা করে, তাহাদের সুখ-সুবিধার জন্য বহু প্রকারের ব্যাপক ব্যবস্থা করে। এই দেশে সেই জাতীয় কোনও আন্দোলন অদ্যাবধি আরম্ভ হয় নাই।

তাই যখন দিল্পির জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী কয়েকদিন পূর্বে দিল্লিবাসী বিদেশি ছাত্রদের নিমন্ত্রণ করিয়া আদর আপ্যায়ন করিলেন তখন আমার অবিমিশ্র উল্লাস হইল। নিমন্ত্রণাগত একটি ছাত্র বলিল যে, প্রায় দুইশত বিদেশি ছাত্র দিল্লিতে অধ্যয়ন করিয়া থাকে এবং তাহাদের একটি আপন প্রতিষ্ঠানও আছে।

পূর্ব আফ্রিকাগত দুইটি নিগ্রো ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় হইল ও তাহাদিগের সঙ্গে আলাপ করিয়া হৃদয়ে বড়ই আনন্দ হইল। অতিশয় ভদ্র এবং নম্র স্বভাব এবং মনে হইল, এই দেশের প্রতি তাহারা ভক্তি পোষণ করে। আমাকে বিনয় এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল– তাহা হইতে তাহাদিগের বুদ্ধিবৃত্তির তীক্ষ্ণতাও অনুভব করিলাম। নিমন্ত্রণ হইতে প্রত্যাগমনের সময়ে আমাকে তাহারা পূর্ব আফ্রিকায় সহৃদয় নিমন্ত্রণ জানাইল।

দিল্লিবাসীর কর্তব্য ইহাদিগের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করিয়া ইহাদিগকে আতিথেয়তা প্রদর্শন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে আপন জ্ঞান অভিজ্ঞতার পরিধি প্রসার করা। রাষ্ট্রের কর্তব্য ইহাদিগের প্রবাসক্লেশ লাঘব করিবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।

***

এই শীতে বঙ্গদেশ হইতে যাহারা দিল্লি আগমন করিবেন, তাহাদিগকে আরও সদুপদেশ দিবার বাসনা হইতেছে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে দেখিতে পাই বহু সদুপদেশ বহুতর অমঙ্গলের সৃষ্টি করিয়াছে– অতএব নিবেদন, যাঁহারা সস্ত্রীক আসিবেন, এই উপদেশ তাঁহাদের জন্য নহে। কারণ আমার উপদেশ যদি গৃহিণীরা মাত্রাজ্ঞান হারাইয়া পালন করেন, তবে দাম্পত্যকলহ শুরু হইবার সমূহ সম্ভাবনা এবং বঙ্গভূমে প্রত্যাবর্তন করিবার পাথেয় অবশিষ্ট না থাকিবার গুরুতর ভয়ও রহিয়াছে। সবিস্তর নিবেদন করি।

চাঁদনি চৌকে গৃহিণী কত বস্তু ক্রয় করিবেন, তাহার অল্পবিস্তর ধারণা আপনার হয়তো আছে, কিন্তু অধুনা ভারত সরকার দিল্লিতে যে কটেজ ইন্ডাস্ট্রিস এম্পোরিয়াম প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, তাহাতে গৃহিণী প্রবেশ করিলে আপনার কী দুরবস্থা হইবে, তাহার কল্পনা আমি করিতে অক্ষম। অমৃতশহর হইতে ডিব্ৰুগড়, কুমায়ুন হইতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যত প্রকারের কুটির শিল্প আছে, তাহার তাবৎ নিদর্শন সরকার এই গৃহে সঞ্চয় করিয়া এক বিরাট প্রদর্শনী খুলিয়াছেন।

তাহাতে কাহার আপত্তি, কিন্তু হায় সেইগুলো বিক্ৰয়ার্থে। যাদুঘরে গৃহিণীকে লইয়া যান। পরমানন্দে, নির্ভয়ে। মানিব্যাগ, চেক বুক-পকেটে বিরাজমান– কোনও ভয় নাই– গৃহিণী অশোকস্তম্ভ কিংবা যক্ষিণীর প্রতিমূর্তি ক্রয় করিতে চাহিলেও আপনাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইতে হয় না, কিন্তু এই হলে যমুনার স্রোত পর্বতাভিমুখী। সরকার এই প্রতিষ্ঠানে যেসব তরুণীদিগকে নিযুক্ত করিয়াছেন, তাহারা বিক্রয় করার কলাকৌশল এমনি মোক্ষম আয়ত্ত করিয়াছে যে, আমার গৃহিণীর মতো কৃপণাও লোহিত-বর্তিকা প্রজ্বলন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন (এই বিষয়ে অত্যধিক বাক্যব্যয় করিব না, আমি আমার দাম্পত্যজীবনে শান্তি কামনা করি)।

যদিও-বা আপনি এই কুম্ভীরের চক্ষুতে ধূলি নিক্ষেপ করিতে সমর্থ হয়েন, তথাপি আপনার জন্য দিল্লিতে আর একটি ব্যাঘ্র রহিয়াছে।

কাশির সরকারের নিজস্ব কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান।

বড়ই মনোরম বিপণি। কত প্রকারের শাল-দুশালা, পট্টু-ধোসা, পাপিয়ের মাশের কলাসামগ্রী, ধাতুনির্মিত তৈজসপত্র দেখিতে দেখিতে আপনার গৃহিণী চঞ্চল হইয়া উঠিবেন, তাহার নিশ্বাস ঘন ঘন বহিতে থাকিবে, কল্পনার চক্ষে তিনি দেখিবেন কোন শাল ক্রয় করিলে তিনি ডলি মলি তাবৎ সুন্দরীদিগকে কলিকাতার সান্ধ্যক্লাবে নির্মমভাবে পরাজয় করিতে সক্ষম হইবেন আর আপনিও সঙ্গে সঙ্গে রক্তবর্তিকার যে বিভীষিকা দেখিতে পাইবেন, তাহার কল্পনা করিয়া আমার বিঘ্নসন্তোষী হৃদয় বিপুলানন্দ লাভ করিতেছে। আমার নিজস্ব নিদারুণ অভিজ্ঞতা এই স্থলে বর্ণন করিব না।

ধর্ম বলেন, আমার অনুচিত এইসব প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করা, কিন্তু আমি নিরুপায়। দিল্লিতে বাস করি, এই দুইটি মনোরম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি সুপরিচিত। আমার কি কর্তব্যবোধ নাই যে, আপনাদিগকে সত্যসুন্দর মঙ্গলের সন্ধান দিব না? আমি কি এতই কাপুরুষ যে, সামান্যা অবলাদিগের ভয়ে সত্য গোপন করিব?

অবশ্য আমার সাহস সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আনন্দবাজারের স্কন্ধ কর্তন করিলেও সেই মহাজনগণ আপনাকে আমার বাসস্থানের উদ্দেশ দিবেন না। তাহারা নরহত্যার ঘোরতর বিরোধী। আপনার মঙ্গলও তাহারা সর্বান্তঃকরণে কামনা করেন।

***

প্রাচ্য-প্রতীচ্যের দার্শনিকগণ দেহলিপ্রান্তে সমবেত হইয়া সপ্তাহাধিক কাল নানা প্রকারের গবেষণা আলোচনা করিবেন। ইহাদিগের প্রধান উদ্দেশ্য হইবে কী প্রকারে উভয় ভূখণ্ডের জ্ঞানবিজ্ঞান একত্র করিয়া পৃথিবীতে সত্যশিবসুন্দরের শাশ্বত প্রতিষ্ঠা করা যায়।

ফ্রান্স, জর্মনি, সুইটজারল্যান্ড, ইতালি, ইংলন্ড, জাপান, মিশর, তুর্কি, সিংহল, আমেরিকা ও ভারতের দর্শন-শার্দূলগণ ইতোমধ্যে স্ব স্ব সহানুভূতি ও সহযোগিতা স্থাপন করিয়া পত্র বিনিময় করিয়াছেন।

দর্শনের সেবা করিবার সৌভাগ্য না ঘটিয়া থাকিলেও দার্শনিকদের সেবা করিয়াছি বলিয়া ইহাদের সকলেই আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত নহেন।

বিশেষত জর্মনির অধ্যাপক হেলমুট ফন প্ল্যাজেনাপ। সংস্কৃতে ইহার পাণ্ডিত্য গভীর এবং বর্তমান ভারতের সঙ্গেও তাহার বিলক্ষণ পরিচয় আছে। ইহার অন্যতম পুস্তক বুদ্ধ হইতে গাঁধী পুস্তক পাঠ করিয়া আমি পুনঃপুন সাধুবাদ দিয়াছি। ইনি একাধারে দার্শনিক, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং আলঙ্কারিক। তাঁহার ভারত-প্রেম অতুলনীয়। ইনি জর্মনির পক্ষ হইতে ভারত আগমন করিবেন।

তাঁহার পিতা জর্মন ব্যাঙ্কে বহুকাল একচ্ছত্রাধিপত্য করিয়াছেন। তিনিও ভারতীয় বহু বিদ্যায় সুপণ্ডিত। স্পস্ট স্মরণ নাই, তবে বোধ হইত তিনি কবি ইকবালের সতীর্থ ছিলেন। তাঁহার কাব্যাংশ জৰ্মনে অনুবাদ করিয়া ইকবাল তাই লইয়া গৌরব অনুভব করিতেন।

পাঠক, দেহলি-প্রান্তের এই আসন্ন সভার প্রতি দৃষ্টি রাখিলে তুমি লাভবান হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *