রায়বাড়ির কালো চাঁদিয়াল

রায়বাড়ির কালো চাঁদিয়াল

তপন বলল, চল, নাজিরের দোকানে যাবি?

শুনে আমার লোভও হল আবার ভয়ও হল৷ নাজিরের দোকান সেই ফড়েপুকুরে৷ অতদূরে যেতে হলে মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে৷ আর জিজ্ঞেস করলেই মা বলবে, না৷

তপন বলল, কীরে, যাবি তো বল৷ নাহলে আমি একাই যাব৷

তপনের বাবা-মা থাকেন জলপাইগুড়িতে আর ও থাকে এখানে মামাবাড়িতে৷ মামারা ওকে খুব আদর দেন বলে ও ইচ্ছে মতন ঘোরাঘুরি করতে পারে৷

আমার বাবা বলে দিয়েছেন, স্কুলে যতদিন পড়ব, ততদিন বাড়ির পারমিশান ছাড়া কোথাও যাওয়া যাবে না৷ কলেজে গেলে তখন ইচ্ছে মতন ঘোরাঘুরি করা যাবে৷

একদিন স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল, বন্ধুদের সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম দেশবন্ধু পার্কে৷ ফিরেছিলাম সন্ধ্যার আগেই৷ তবু বাবা কী করে যেন জানতে পেরে গেলেন৷ আমার ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে বাথরুমে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, আজই শাস্তি দেব না আজ ছেড়ে দেব? এরকম আর কোনোদিন করবি? তা হলে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে মারব, যাতে মা এসে ছাড়িয়ে দিতে না পারে৷

বাবা সেদিন মারেননি বটে কিন্তু বাবাকে আমি সত্যিই ভয় পাই৷

আমার আর তপনের এখন ক্লাস এইট৷ প্রত্যেকদিনই একবার করে ভাবি, ইস কবে যে আমার তিনটে বছর কাটবে আর আমি কলেজে গিয়ে স্বাধীন হয়ে যাব!

তপন বলল, তাহলে তুই থাক৷ আমার বড়মামা আমায় দুটো টাকা দিয়েছেন, আমি আজই নাজিরের দোকান ঘুরে আসব৷

আমি বললুম, একটু দাঁড়া না, আমি একটা ব্যবস্থা করছি৷

বাবা অফিসের কাজে পরশু পাটনা গেছেন, ফিরবেন বিকেলে৷ সুতরাং আজ রবিবার সকালটায় একটু ঘুরে আসা যায় যদি পারমিশান পাওয়া যায় মায়ের কাছ থেকে৷

মার কাছে গিয়ে খুব নরম গলায় বললুম, মা ভাস্করের বাড়িতে একটু ক্যারাম খেলতে যাব?

মা চোখ কপালে তুলে বলল, ভাস্করের বাড়ি? সে কোথায়, সে তো অনেক দূর?

আমি বললুম, মোটেই দূর নয়, এই তো কাছেই, পদ্মনাথ লেনে৷ তপনও আমার সঙ্গে যাবে৷

মা ফড়েপুকুর চেনেন কিন্তু পদ্মনাথ লেন চেনেন না, যদিও দুটো খুব কাছাকাছি৷ ফড়েপুকুরের নাম শুনলে নিশ্চয়ই রাজি হতেন না৷ ফেরার পথে পদ্মনাথ লেনে ভাস্করের বাড়িটা একবার ঘুরে এলেই হবে৷

মায়ের অনুমতি পেয়েই তপন আর আমি হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটে বেরিয়ে পড়লুম৷

আমাদের গ্রে স্ট্রিট পাড়াতেও ঘুড়ির দোকান আছে, কিন্তু নাজিরের দোকানের ব্যাপারই আলাদা৷ নাজিরের দোকান যেন ঘুড়ির রাজবাড়ি৷ মনে হয় যেন হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ ঘুড়ি আছে সেখানে৷ আর কয়েকখানা ঘুড়ি আছে মানুষের চেয়েও বড় সাইজের, সেগুলো সাজাবার জন্যে৷

নাজিরের দোকানের মাঞ্জাও খুব বিখ্যাত৷ তবে আমরা তো মাঞ্জা কিংবা ঘুড়ি কিনতে যাচ্ছি না৷ আমরা শুধু দেখতে যাচ্ছি৷

নাজিরের দোকানের সামনে সব সময় ভিড় লেগে থাকে৷ রোববার সকালে আরও বেশি ভিড়৷ বিশ্বকর্মা পুজোর আর বেশি দিন দেরি নেই৷ ভিড় ঠেলেঠুলে আমি আর তপন একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম৷

দোকানের সামনেই বসে আছেন দোকানের মালিক নাজির সাহেব, ফর্সা গায়ের রং, কাঁচা-পাকা গোঁফ, মাথায় টাক৷ পরনে একটা সাদা সিল্কের গেঞ্জি আর নীল-হলদে চেক চেক লুঙ্গি৷ দু’তিনজন কর্মচারী কেনাবেচায় ব্যস্ত, ভেতর দিকে আট-দশজন কারিগর চটপট ঘুড়ি বানিয়ে যাচ্ছে৷

দোকানের সামনে ঝুলছে সার সার লাটাই, তাতে নানা রঙের মাঞ্জা, লাটাইগুলোর খোঁচা লাগছে আমাদের মাথায়৷ অসংখ্য রকমের ঘুড়ির মধ্যে আমাদের দু’জনের চোখ খুঁজে চলেছে শুধু একটাই জিনিস৷

তপন বলল, ওই দ্যাখ!

তপন আঙুল তুলে দেখাল একটা কোনার দিকে৷ আমার শরীরটা কেঁপে উঠল সত্যিই তো, কালো চাঁদিয়াল! থাক থাক করে সাজানো, অন্তত একশো-দেড়শোখানা হবে৷

আকাশে কত ঘুড়ি ওড়ে, কিন্তু ওই রকম কালো শুধু এক জায়গাতেই দেখা যায়৷ এমনকি কালো চাঁদিয়ালও অনেক ওড়ে, কিন্তু এরকম ঠিক কালো চাঁদিয়াল আর কোথাও নেই৷

আকাশে ছাড়া এই কালো চাঁদিয়াল এত কাছ থেকে আমি আর তপন আগে কখনো দেখিনি৷ ভেবেছিলাম এই কালো চাঁদিয়াল বুঝি দো-তে ঘুড়ি, এখন দেখছি, দেড়-তে, কড়ি টানা তো বটেই৷ আমি দো-তে ঘুড়ি ওড়াতে পারি না৷ বড্ড টান লাগে৷ দেড়-তেই ভালো৷ কুচকুচে কালো গা৷ বুকের কাছে এক ফালি সাদা চাঁদ, তাতেও সাদা বর্ডার দেওয়া৷ কেন জানি না, ওই চাঁদটাকে দেখলে আমার মহাদেবের কপালের চোখটার কথা মনে পড়ে৷ ওই ঘুড়ির ল্যাজটাও লাল৷

আকাশের এই কালো চাঁদিয়াল ঠিক যেন রাজার মতন৷ দেখলেই আমরা ভয় পাই৷ আমাদের ছোটখাটো আধ-তে, এক-তে ঘুড়িগুলো তাড়াতাড়ি নামিয়ে নেবার চেষ্টা করি৷ তার আগেই কালো চাঁদিয়াল গোঁৎ খেয়ে নেমে আসে৷

নাজির সাহেব আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কী চাই খোকা?

তপন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল৷

নাজির সাহেব তবু জিজ্ঞেস করলেন, কোনটা?

ওই যে কালো চাঁদিয়াল!

তপনের কাছে দু’টাকা আর আমার কাছে এক টাকা আছে৷ আমাদের ছেলেবেলার কথা তো, তখন এক টাকাতেই পাঁচ-ছ’খানা বেশ ভালো ঘুড়ি পাওয়া যেত৷ কালো চাঁদিয়ালের দাম আর কত বেশি হবে?

নাজির সাহেব আমাদের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ও ঘুড়ি বিক্রি হয় না!

উত্তরটা আমরা জানতুম৷ যে কেউ ইচ্ছে করলেই যদি ওই কালো চাঁদিয়াল কিনতে পারত তো তাহলে অনেক বাড়ি থেকেই ওই ঘুড়ি উড়ত৷ কিন্তু ওই কালো চাঁদিয়াল শুধু দর্জিপাড়ার রায়বাড়ি থেকেই ওড়ে৷

তপন মিনতি করে বলল, অন্তত একটাও পাওয়া যাবে না?

নাজির সাহেব বললেন, উঁহুঃ! ওগুলো অর্ডার মাল৷

আমরা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম৷ দেখে দেখে যেন আশ মিটছে না৷ নাজির সাহেব আমাদের চলে যেতেও বললেন না অবশ্য৷

সেই সময় স্বয়ং মহাদেব এসে যদি বলতেন, তোমায় একটা বর দিতে চাই, কী নেবে বল! তা হলে আমি হাত জোড় করে কাতরভাবে বলতুম, প্রভু, একটা নয়, দয়া করে দুটো বর দিন৷ আমার করুণ প্রার্থনা শুনে মহাদেব যদি বলতেন, ঠিক আছে দুটো বই দেব, কী চাই? তাহলে আমি বলতুম, প্রভু, প্রথম বরে যেন তপন আর আমি দু’জনেই ভালোভাবে পাশ করে যাই৷ আর দ্বিতীয় বরে আমাদের একটা করে কালো চাঁদিয়াল ঘুড়ি দিন৷

মহাদেবও এলেন না, আমাদের কালো চাঁদিয়াল পাওয়া হল না৷

আমরা চলে আসব ভাবছি, ঠিক সেই সময় একটা গাড়ি থামল ওই দোকানের সামনে৷

নাজির সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে খাতির করে বললেন, আসুন রায়বাবু, আসুন!

গাড়ি থেকে নামল একজন যুবক৷ ধপধপে ফর্সা রং, বছর তেইশ-চব্বিশ বয়েস, মাথায় বাবরি চুল, কোঁচানো থুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরা৷

আমরা এতই অবাক হয়ে গেছি যে আমাদের চোখ যেন কপালে উঠে গেছে৷ রায়বাড়ির ছেলে? আমরা যেন চোখের সামনে রাজপুত্রকে দেখছি!

আমাদের ছাদ থেকে দর্জিপাড়ার রায়দের ছাদ অস্পষ্ট দেখা যায়৷ একদিন তপনের বড়মামার বায়নোকুলার এনে আমরা দেখেছিলুম ঘুড়ি ওড়াবার সময় ওই রায়বাড়ির ছাদে অনেক লোক এমনকি ও বাড়ির মেয়েরাও ঘুড়ি ওড়ায়৷ আমরা মেয়েদের গলার আওয়াজও শুনেছি৷

সেই রায়বাড়ির ছেলে আমাদের একেবারে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ আমরা ধন্য হয়ে গেলুম৷

নাজির সাহেবের দু’জন কর্মচারী সবগুলো কালো চাঁদিয়াল তুলে দিলে গাড়িতে৷ যুবক টাকাপয়সা কিছুই দিল না, নাজির সাহেবকে নমস্কার জানিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পড়ল৷ বোধহয় ওরা সারা বছরের টাকা একসঙ্গে দেয়৷

আর আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না৷ আমরা হাঁটতে হাঁটতে চললুম বাড়ির দিকে৷ আজকের সকালটা আমাদের জীবনে একটা দারুণ সকাল৷ আমরা একসঙ্গে অতগুলো চাঁদিয়াল আর রায়বাড়ির একটি ছেলেকে এত কাছ থেকে দেখেছি৷

এর আগে তপন আর আমি একদিন দেখতে গিয়েছিলুম ওই রায়বাড়ি৷ আমাদের বাড়ির পেছনের একটা গলি দিয়ে গেলে বেশি দূর নয়৷ পুরোনো আমলের দু’মহল বাড়ি৷ সামনে লোহার গেট৷ সেই গেটের ওপাশে মস্ত বড় উঠোনে বাঁধা রয়েছে চারটে ঘোড়া৷ রায়দের মোটরগাড়িও আছে৷ ঘোড়াও আছে, বাড়ির মধ্যে বড় বড় গোল গোল থাম৷ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক উঁকিঝুঁকি মেরেও সে বাড়ির কোনো লোককে আমরা দেখতে পাইনি৷

ঘুড়ি ওড়াবার সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছে ঘুড়ি ধরা৷ আমি আর তপন অনেক ঘুড়ি ধরেছি বটে, কিন্তু ওই কালো চাঁদিয়াল ধরতে পারিনি কখনো৷ সেইজন্য তো আমাদের কত দুঃখ!

ধরব কী করে, রায়দের ঘুড়ি যে কাটেই না বলতে গেলে৷ যদি বা কাটে, তাও অনেক দূরে৷

ঘুড়ি ওড়ানোটা যেন রায়বাড়ির একটা উৎসব৷ একসঙ্গে অনেকে ছাদে উঠে হৈ হৈ করে৷ আমাদের পাড়ার সমস্ত ঘুড়ি না কেটে দিলে যেন ওদের আনন্দ নেই৷ আকাশের অনেক উঁচু থেকে সোজা একটা বাজপাখির মতন গোঁৎ মেরে নেমে আসে ওদের কালো চাঁদিয়াল৷ আমাদের ঘুড়ির তলায় পড়ে পড়পড়িয়ে টেনে দেয়৷ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘুড়ি ভো-কাট্টা৷

রায়রা সব সময় টেনে খেলে, লাটিয়ে খেলে না৷ যারা ভালো খেলতে জানে না, তারাই লাটিয়ে খেলে৷ যাদের হাতের কব্জির জোর আছে, তারা পড়পড়িয়ে টানে৷

আমাদের বাড়ি থেকেও অনেক দূরে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের দিকে দু’একখানা বাড়ি থেকেও অনেক ঘুড়ি ওড়ে৷ রায়দের কালো চাঁদিয়াল আমাদের পাড়ার সব ঘুড়ি কেটে শেষ করে তারপর সুতো বেড়ে বেড়ে নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের দিকে খেলতে যায়৷

তখন আমরা লাটাই গুটিয়ে বসে দূরে ওদের প্যাঁচ খেলা দেখি৷ রায়দের কালো চাঁদিয়ালই বেশির ভাগ দিন জেতে, দু’একদিন হঠাৎ তাদেরটা কেটেও যায়৷ বেশি হাওয়া থাকলে জোরে টানার অসুবিধে, সেই রকম কোনো দিন৷

রায়দের ঘুড়ি কেটে গেলে, ওদের হাত্তা ধরতে কেউ সাহস পায় না৷ ওদের ছাদের সবাই মিলে এই, এই বলে চিৎকার করে আর একজন লাটাই গুটোয়৷ বিদ্যুৎবেগে সুতোটা বেরিয়ে যায়৷

তবু আমি একদিন ওদের হাত্তা ধরতে গিয়েছিলুম৷ আমাদের ছাদ দিয়ে সুতোটা যাচ্ছে দেখে আমি পাঁচিলের আড়ালে বসে পড়ে খপ করে ধরে ফেলেছিলুম৷

সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিতে হল অবশ্য, সেই সুতোয় এমন ধার যে কচ করে আমার হাত কেটে গেল৷

তার মধ্যেই একটা জিনিস দেখে আমি অবাক হয়েছিলুম৷ রায়দের মাঞ্জা কী রঙের তা জানার খুব কৌতূহল ছিল আমার৷ ছাই ছাই রঙের মাঞ্জা নাকি সবচেয়ে ভালো হয়৷ কিন্তু রায়দের সুতোর রং ধপধপে সাদা৷ রায়দের সব কিছুতেই বৈশিষ্ট্য আছে, ওরা মাঞ্জায় কোনো রং মেশায় না৷

রায়দের ঘুড়ি যদি একবার কাটে তাহলে প্রতিশোধ না নিয়ে ওরা কিছুতেই ছাড়বে না৷ পর পর দু’খানা কালো চাঁদিয়াল যমদূতের মতন ছুটে গিয়ে শত্রুপক্ষকে শেষ করবেই৷

পাড়ার ছেলেদের মুখে রায়দের সম্পর্কে আর একটা অদ্ভুত কথা শুনেছিলুম৷ ওরা নাকি যে-ঘুড়ি একবার আকাশে ওড়ায়, তা আর নামায় না৷ পাড়ার সব কটা ঘুড়ি কেটে আকাশ জয় করবার পর রায়েরা হাতের কাছে সুতো ছিঁড়ে দেয় সন্ধেবেলা৷ তখন সেই কালো চাঁদিয়াল একলা উড়তে উড়তে গঙ্গার জলে গিয়ে পড়ে৷ এই ভাবে ওরা গঙ্গাকে রোজ প্রণাম জানায়৷

সন্ধে হতে না হতেই আমার মাস্টারমশাই এসে যান, সেইজন্য ওটা আমার কখনো দেখা হয়নি৷

আমার আর তপনের শুধু এই দুঃখ ছিল আমরা একটাও কালো চাঁদিয়াল ধরতে পারলুম না কখনো৷

সুযোগ এসেছিল মাত্র দু’বার৷

তপনের মামাবাড়ির ছাদে অসুবিধে আছে বলে তপন আমাদের বাড়ির ছাদেই ঘুড়ি ওড়াতে আসে৷ এক ছাদ থেকে দুটো ঘুড়ি ওড়ানোর কোনো মানে হয় না বলে কখনো আমি লাটাই ধরি, তপন ওড়ায়৷ আবার কখনো তপন লাটাই ধরে৷

মাঝে মাঝে তপনের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেলে অবশ্য আমরা দু’জনেই তখন আলাদা ঘুড়ি ওড়াই, প্যাঁচও খেলি৷ তপন আমার চেয়ে ভালো টানতে পারে৷ রায়বাড়ির কালো চাঁদিয়াল দেখলে তপন ভয় পায় না৷ অবশ্য প্রত্যেকবারই তপনেরটাই কেটে যায়৷

তপন তখন দাঁত কিড়মিড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, একদিন তোকে ধরব, ঠিক ধরবই!

সেইজন্য অন্য ঘুড়ি ধরলেও আমাদের আনন্দ হয় না৷ কালো চাঁদিয়াল প্রত্যেকবার আমাদের কেটে দিয়ে যায় বলেই একখানা অন্তত কালো চাঁদিয়াল ধরতে না পারলে আমাদের শান্তি নেই!

রায়বাড়ির ছাদ আমাদের বাড়ি থেকে তিরিশ-পঁয়তিরিশটা বাড়ি দূরে৷ বেশির ভাগ দিনই আমাদের বাড়ির দিকে হাওয়া থাকে৷ ও বাড়ির ঘুড়ি বাড়তে বাড়তেই তরতর করে এগিয়ে আসে, প্রায় চোখের নিমেষেই আমাদের ছাদ পেরিয়ে অনেক দূরে চলে যায়৷

একদিন অন্যরকম হল৷ খুব ধারালো মাঞ্জা দেওয়া সুতো লাটাইতে ভুলভাবে গোটালে ভেতর থেকে আপনিই কেটে যায় অনেক সময়৷ তা টের পাওয়াও যায় না৷ তখন ঘুড়ি ওড়াতে গেলে প্যাঁচ না খেলেও নিজের ঘুড়ি ভো কাট্টা হয়ে যায়৷

একদিন বিকেলবেলা রায়বাড়ির প্রথম কালো চাঁদিয়াল উড়ছে, একটু এগোতে না এগোতেই সেই শক্তিশালী ঘুড়ি হঠাৎ কেমন দুর্বলভাবে ঘুরতে লাগল৷

দেখলেই বোঝা যায় সুতো কেটে গেছে৷

তপন দারুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠল, নীলু! নীলু!

আমিও দেখতে পেয়েছি ঘুড়িটা আমাদের ছাদের দিকেই আসছে৷

তপন আমায় বলল, নীলু, তুই ওপাশে দাঁড়া, আমি এদিকটায় আছি৷

ঘুড়িটা দুলতে দুলতে এগিয়ে আসতে লাগল৷ একেই বলে আশা-নিরাশার দোলা৷

একবার মনে হচ্ছে আমাদের ছাদে পড়বেই, আবার এক একবার ডান দিকে কিংবা বাঁ দিকে বেঁকে যাচ্ছে৷

আমি মনে মনে বলছি, হে ভগবান, হে ভগবান—

প্রায় আমাদের বাড়ির কাছে এসে দমকা হাওয়ায় ঘুড়িটা ওপরে উঠে গেল৷

আমি বুকে দু’হাত চেপে বললুম, যাঃ!

তপন আমার চেয়ে বেশি নজর রেখেছিল৷ আমি দেখছিলুম ঘুড়িটাকে, ও দেখছিল সুতো কোথায়৷

কালো চাঁদিয়ালটা ওপরে ওঠে গেলেও ওর সুতো গিয়ে পড়ল আমাদের পাশের বাড়িটার নীচু ছাদে৷

তপন বলল, ওই যে সুতো!

আর একটুও চিন্তা না করে তপন পাঁচিলের ওপর উঠে পাশের ছাদে দিল এক লাফ৷

সঙ্গে সঙ্গে ধড়াম করে একটা বিরাট শব্দ৷ আমি দৌড়ে এদিকে এসে দেখলুম, পাশের বাড়ির নীচু ছাদটায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে তপন, তার মাথা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে৷

ভয়ে আমার এমন বুক শুকিয়ে গেল যে একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারলুম না৷

অবশ্য ওই শব্দ বাড়ির সবাই শুনতে পেয়েছে৷ আমার মা আর পাশের বাড়ির রতনদা, খোকনদা ছুটে এল ছাদে৷

কালো চাঁদিয়ালটা তখন দুলতে দুলতে দূরে চলে যাচ্ছে৷

পাশের বাড়ির ওই ছাদটায় তপন আর আমি দু’জনেই আগে অন্য ঘুড়ি ধরবার জন্য আস্তে করে লাফিয়ে নেমেছি৷ এমন কিছু শক্ত নয়৷ কিন্তু উত্তেজনার মধ্যে তপনের পা পিছলে গিয়েছিল৷

তপনকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হল পাড়ার ডাক্তারখানায়৷ মাথার খানিকটা চুল কেটে ফেলে চারখানা সেলাই করতে হল৷ তপনের মামাবাড়িতে খবর দিতে যেতে হল আমাকেই৷

পরদিন সকালে জানা গেল, তপনের মাথার চেয়েও পায়ে চোট লেগেছে বেশি৷ বাঁ পায়ের হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে৷ পায়ে প্লাসটার বেঁধে তপনকে শুয়ে থাকতে হল বিছানায়৷

ঘুড়ি ধরতে গিয়ে তপন মাথা ফাটাল, পা ভাঙল, আর সেজন্য বকুনি আর মার খেলাম আমি৷ অনেকদিন বাদে সেদিন বাবা আমার কান ধরে দুটি থাপ্পড় মেরে বললেন, ঘুড়ির জন্য এত পাগলামি? আর কোনোদিন করবি?

আমি যত বলি, আমি তো কিছু করিনি, আমি পাঁচিলে উঠে লাফাইনি৷ সে কথা কে শোনে!

বাবা দারুণ রাগী, একবার রাগলে জ্ঞান থাকে না৷ সেই রাত্রেই বাবা আমার সব ঘুড়ি-লাটাই রাস্তার মোড়ে ফেলে দিয়ে এলেন৷ বস্তির ছেলেগুলো সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো তুলে নিয়ে চলে গেল৷

বাবা হুকুম দিলেন, আমার আর ছাদে ওঠা চলবে না৷ ঘুড়ি ওড়ানো একদম নিষেধ৷

তবু আমি লুকিয়ে লুকিয়ে অন্য বন্ধুদের বাড়িতে ঘুড়ি ওড়াতুম৷

তপন কিন্তু ঘুড়ি ওড়ানো একেবারেই ছেড়ে দিল৷ পা ভালো হয়ে যাবার পরও বলল, আমি আর কোনো দিন কালো চাঁদিয়ালের দিকে তাকাব না৷ ও আমার শত্রু!

আমি কিন্তু না তাকিয়ে থাকতে পারতুম না! স্কুল থেকে ফেরার পথে কিংবা ছাদে না উঠলেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি লোভীর মতন চেয়ে থাকতুম আকাশের দিকে, কালো চাঁদিয়ালকে আমার শত্রু মনে হয় না৷ মনে হয়, ওই কালো চাঁদিয়াল ঘুড়ি আকাশের রাজা৷

তারপর আমার জীবনে এল সেইদিন৷ তখন আমি ক্লাস নাইনে উঠে গেছি৷ বি-কে-পাল এভিনিউতে একটা স্কুলের সঙ্গে আমাদের স্কুলের ফুটবল ম্যাচ ছিল৷ বি সেকশানের প্রশান্ত ভালো হাফ ব্যাক খেলে, ওর জ্বর হয়ে পড়ায় স্কুল টিম থেকে চান্স দিল আমাকে৷

পাঁচ গোলে হেরে গেলুম আমরা৷ মোটেই আমার দোষ নয়, গোলকীপার জয়ন্তর দোষে৷ গোলপোস্টের যে-দিক দিয়ে বল ঢুকছে, ও যদি তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকে, তা হলে কি সেই টিম জিততে পারে?

সারা গায়ে জলকাদা মেখে দলের সঙ্গে আমি বাড়ি ফিরছি, প্রায় সন্ধে হব হব এমন সময়৷ আহিরীটোলার কাছে এসে হঠাৎ আকাশে চোখ চলে গেল৷ অমনি দেখতে পেলুম একটা কালো চাদিয়াল৷

আনন্দের চেয়ে অবাক হলুম বেশি৷ আমাদের পাড়া থেকে কত দূরে, এখানে কালো চাঁদিয়াল এল কী করে?

তখন মনে পড়ল, সেই যে পাড়ার ছেলেরা বলেছিল, রায়বাড়ির ছেলেরা ঘুড়ি আকাশে ওড়ায় আর নামায় না৷ সন্ধের সময় ঘুড়িটা অনেক উঁচুতে তুলে হাতের কাছ থেকে সুতো ছিঁড়ে দেয়৷ তারপর সেই ঘুড়ি গঙ্গায় গিয়ে পড়ে৷ এই দিকেই তো গঙ্গা!

এইজন্যই রায়দের মাঞ্জার রং সাদা৷ একটু অন্ধকার হলে আর কেউ সুতো দেখতে পাবে না৷

আমার বুকের মধ্যে দুমদুম শব্দ হতে লাগল৷ আজ এই ঘুড়িটা ধরতেই হবে৷ দরকার হলে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ব৷

বন্ধুদের কিছু না বলে আমি সুট করে কেটে পড়লুম৷

পাড়ায় পাড়ায় একদল বাজে ছেলে হাতে গাছের ডাল কিংবা বাঁখারি নিয়ে ঘুড়ি ধরবার জন্য ছোটে৷ আমি সেই রকম রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ির পেছনে ছোটার কথা ভাবতেই পারতুম না৷ কিন্তু এটা বে-পাড়া, আমায় কেউ চিনবেই না৷ আর আশ্চর্যের ব্যাপার এখানে পাড়ার ছেলের দল এই কালো চাঁদিয়ালটার পেছনে ছুটছে না৷

বোধহয় সন্ধে হয়ে এসেছে বলে ওই কালো রঙের ঘুড়িটাকে আর কেউ দেখতে পায়নি৷ আজকে ওই ঘুড়িটা শুধু আমার জন্যে!

কোন রাস্তা দিয়ে যে যাচ্ছি, তা কিছুই জানি না৷ আমার চোখ শুধু আকাশের দিকে৷ মনে মনে খালি ভাবছি, হে ভগবান, আজ ওকে পাবো না? হে ভগবান—

পরিক্ষার আগেও কখনো এত ভগবানকে ডাকিনি!

যদি ঘুড়িটা ধরে নিয়ে গিয়ে তপনকে দেখাতে পারি, তখন তপনের মুখটা কেমন হবে? তপনকে বলব, এই দ্যাখ, তোর শত্রুকে এনেছি৷

সেই কথা ভেবেই আমার গায়ে বেশি করে জোর এসে গেল৷

ঘুড়িটা ক্রমশ নীচু হতে লাগল৷ তাহলে কি কাছেই গঙ্গা! আমি সাঁতার জানি, গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়তেও আমার আপত্তি নেই৷

কিন্তু গঙ্গার আগেই ঘুড়িটা গোঁৎ খেয়ে নীচে নেমে এল৷ ঠিক যেন আমারই জন্য৷ কালো চাঁদিয়াল এতদিন বাদে বোধহয় বুঝেছে যে আমি কত করে ওকে চাই৷ সেইজন্য আজ গঙ্গায় না গিয়ে আমার কাছে আসছে৷

প্রায় আমার হাতের কাছে এসেও ঘুড়িটা সাঁ করে বেঁকে একটা পাঁচিল ঘেরা বাড়ির মধ্যে চলে গেল৷

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, যাঃ৷

কিন্তু এত কাছে এসেও ফস্কে যাবে? এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলুম পাঁচিলটার একপাশে লোহার গেট৷ সেদিকে ছুটে গিয়ে সেই গেটের রেলিং-এর ফাঁকে চোখ রাখতেই আমার চোখ জুড়িয়ে গেল৷

বাড়ির ভেতরটায় একটা বাগান৷ সেখানে কতকগুলো দোপাটি ফুলের গাছের ওপর আলতো ভাবে শুয়ে আছে কালো চাঁদিয়াল!

গেটটার ভেতর থেকে তালাবন্ধ৷ বাগানে কোনো লোক নেই, বাড়ির সব ঘর অন্ধকার, সেখানেও কোনো লোক আছে বলে মনে হল না৷ গেটে দারোয়ানই বা নেই কেন?

ওই তো পড়ে আছে আমার এত সাধের কালো চাঁদিয়াল, আমি এতদূর এসেও ওকে না নিয়ে চলে যাব? তা কি হয়!

কোনো লোকজন থাকলেও না হয় তার কাছে আমি কাকুতি-মিনতি করে বলতুম, আমায় ওই ঘুড়িটা দিন না৷ কিন্তু কোনো লোকজনও যে নেই!

পরের বাড়িতে ঢোকা উচিত নয়৷ কিন্তু একবার যদি টপ করে লোহার গেটটা পেরিয়ে ঘুড়িটা নিয়ে ফিরে আসি, তাতে কি কোনো দোষ হবে? আমি তো এ বাড়ির কোনো জিনিস নিচ্ছি না! ঘুড়িটা বাড়ির বাইরেও তো পড়তে পারত!

বেশিক্ষণ চিন্তা করার সময় নেই৷ যদি হঠাৎ কেউ এসে পড়ে৷ লোহার গেটে রেলিং-এর ফাঁকে ফাঁকে আমি তরতর করে উঠে গেলুম৷ ওপরটায় বর্শা বর্শা দেওয়া সাবধানে পার হয়ে উলটো দিকে লাফিয়ে ছুটে গেলুম বাগানে৷

কালো চাঁদিয়ালটার গায়ে হাত দিতে আমার বুকটা জুড়িয়ে গেল৷ তাহলে সত্যি এতদিন পর এল আমার হাতে?

ঘুড়িটা হাতে নিয়ে মুখ ফেরাবার আগেই কে যেন পেছন থেকে ধরল আমার চুলের মুঠি৷ তারপরই আমার চোখের ওপর এক থাপ্পড়!

কোনোক্রমে চোখ মেলে দেখলুম কালো রঙের দৈত্যের মতন চেহারার একটা লোক চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷

লোকটা বলল, তুই কে?

আমি বললুম, আমি, আমি, মানে—

এখানে কি করে ঢুকলি?

আমায় ছেড়ে দিন, আমি কোনো দোষ করিনি, দয়া করে ছেড়ে দিন৷

লোকটা আমার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল৷

অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা এক স্বার্থপর দৈত্যের বাগান সম্বন্ধে একটা অনুবাদ গল্প পড়েছিলুম, কয়েকদিন আগেই পড়েছিলুম, এত বিপদের মধ্যেও সেই গল্পটাই আমার মনে পড়ল৷ কিন্তু এ লোকটা তো দৈত্য হতে পারে না! পায়জামা আর গেঞ্জি পরা লোকটার গায়ে খুব জোর৷ ও ইচ্ছে করলেই আমার মাথার চুলগুলো পড়পড় করে উপড়ে ফেলতে পারে৷ এমন জোরে চেপে ধরেছে যে যন্ত্রণায় আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে প্রায়৷

আমি কোনোক্রমে বলতে লাগলুম, আমায় ছেড়ে দিন, আমায় ছেড়ে দিন, আর কখনো এরকম করব না৷

লোকটা আমায় টানতে টানতে নিয়ে এল বাড়ির মধ্যে৷ তারপর একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকে বলল, ওস্তাদ, এই ছেলেটা বাগানে ঘুরঘুর করছিল!

ঘরের মধ্যে একটা ছোট্ট মোম জ্বলছে৷ মেঝেতে বসে আছে আরও তিন- চারজন লোক৷ তাদের মাঝখানে রয়েছে একটা লোহার বাক্স, একজন লোক ছুরি দিয়ে সেই বাক্সটা খোলার চেষ্টা করছে৷

দেখলেই বোঝা যায় এরা ডাকাত৷

দৈত্যের মতন চেহারার লোকটা যাকে ওস্তাদ বলল, তার চেহারা কিন্তু অত বড়-সড় নয়৷ রোগা ছিপছিপে লোকটি, ফুলপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, গলায় একটা সিল্কের রুমাল বাঁধা৷

ওস্তাদ আমাকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, বাগানে ঢুকেছিস? এর গলাটা কেটে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আয়!

আমি হাত জোড় করে বললুম, মারবেন না, আমায় মারবেন না! আমার মা-বাবা কিছু জানতে পারবেন না!

তুই বাগানে ঢুকেছিলি কেন?

আমার এক হাতে তখনও সেই কালো চাঁদিয়াল৷

আমি বললুম, এই ঘুড়িটা নিতে এসেছিলুম, ভেবেছিলুম বাড়িতে কেউ নেই৷

দৈত্যের মতন লোকটা ঘুড়িটাতে এক ঘুঁষি মেরে ছিঁড়ে দিল৷

এবার আর সামলাতে পারলুম না আমি৷ আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল টপটপ করে৷

ওস্তাদ হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল, ঘুড়িটা ছিঁড়লি কেন! এই হাবু, ঘুড়িটা কেন ছিঁড়লি?

দৈত্যের মতন লোকটার নাম হাবু৷ সে আমার চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷

রোগা পাতলা চেহারার ওস্তাদ উঠে দাঁড়িয়ে দারুণ রাগের সঙ্গে বলল, এত কালো ঘুড়িটা তোকে কে ছিঁড়তে বলেছে, অ্যাঁ!

তারপরই ওস্তাদ হাবুর গালে প্রচণ্ড জোরে কষাল এক চড়!

হাবু গালে হাত বুলোতে বুলোতে নাকি নাকি গলায় বলল, বাঃ ওস্তাদ! এই ছোঁড়া বাগানে ঢুকে পড়েছিল, আমি ওকে ধরে আনলুম আর তুমি আমায় মারছ?

আমায় না জিজ্ঞেস করে ঘুড়িটা তোকে কে ছিঁড়তে বলেছে?

ভারি তো একটা ঘুড়ি!

তুই ঘুড়ি চিনিস? ছাই চিনিস! এরকম ভালো জাতের ঘুড়ি খুব কম দেখা যায়৷ এ আলাদা ভাবে তৈরি করা, এই দ্যাখ!

যে-লোকটা ছুরি দিয়ে বাক্স খোলার চেষ্টা করছিল, সে এবার বলল, কিন্তু এ ছোঁড়াটা যে এ জায়গাটা দেখে ফেললে, এখন ওকে নিয়ে কী করা যায়?

ওস্তাদ বলল, হাবুটার যেমন বুদ্ধি! ছেলেটা ঘুড়ি নিতে এসেছিল, নিয়ে চলে যেত, ওকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে আসতে তোকে কে বলল?

হাবু বলল, আমি যা-ই করি, তাতেই দোষ৷ যদি ছোঁড়াটাকে ছেড়ে দিতুম, তখন তোমরা বলতে, কেন ছাড়লি?

ওস্তাদ তাকে আবার এক ধমক দিয়ে বলল, চুপ মেরে থাক৷

তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওস্তাদ বলল, তাই তো হে খোকা, তোমাকে তো এখান থেকে আর জ্যান্ত বেরুতে দেওয়া যায় না?

আমি বললুম, বিশ্বাস করুন৷ আমি এ পাড়ার ছেলে নই৷ এ বাড়িটাও আর কোনোদিন চিনতে পারব না৷ ঘুড়ির পেছনে ছুটে এতদূর চলে এসেছি৷

তুমি ঘুড়ি ওড়াও?

হ্যাঁ৷

টেনে খেলো না লেটে খেলো?

টেনে৷

বল তো তলায় পড়ে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে টানতে হয়, না বাঁ দিক থেকে ডান দিকে?

ডান দিক থেকে বাঁ দিকে৷

হুঁ! একসময় আমিও ঘুড়ি ওড়াতে খুব ভালোবাসতুম৷

মাটিতে বসা ছুরি হাতে লোকটা বলল, ওস্তাদ, বাক্সটা খুলে গেছে৷

ওস্তাদ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যাও ভাগো! ফের যদি কোনোদিন এ দিকে দেখি, কিংবা কোনো লোককে এখানে ডেকে আনো, তাহলে জিভ কেটে দেব!

আমার পা এমন কাঁপছে যে আমি চলে যেতেও পারছি না৷

ওস্তাদ বকুনি দিয়ে বলল, দাঁড়িয়ে আছো যে? দৌড়াও! নইলে—

কী করে যে ছুটে এলুম, গেট পেরিয়ে অচেনা রাস্তা দিয়েও ঠিক নিজের বাড়ি পৌঁছে গেলুম একসময়, তা জানি না৷

এর কিছুদিন পরই আমরা বাড়ি পালটে দর্জিপাড়া ছেড়ে চলে গেলুম দমদমে৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে আর কোনোদিন সেই কালো চাঁদিয়াল দেখতে পাইনি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *