3 of 8

রাম ও রামকৃষ্ণ

রাম ও রামকৃষ্ণ

রামকৃষ্ণ শব্দটি অবশ্যই দ্বন্দ্ব সমাস। যার ব্যাসবাক্য হল রাম ও কৃষ্ণ। তবে কেউ কেউ জটিল করে ‘যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ’—এইরকম ব্যাসবাক্য করলে তাতেও খুব আপত্তি করা উচিত হবে না।

আমাদের এবারের নিবন্ধের বক্তব্য খুব সরল। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত। রামায়ণের রামচন্দ্র সম্পর্কে পরমপুরুষ যেসব উপাখ্যান বলেছেন তারই কিছু উদ্ধৃতি এবারের সম্বল।

দূরদর্শনের দৌলতে রামায়ণ ও মহাভারত—এই দুই মহাকাব্য আবার আসমুদ্র হিমাচলকে আকর্ষণ করেছে। সেই সূত্রেই আমার এবারের এই রামলীলা।

সব আখ্যান হয়তো সব পাঠকের কাছে সরস মনে হবে না। কিছু কিছু কাহিনী সরসতার এলাকা পার হয়ে চিরায়ত দর্শনের সীমানায় পৌঁছে গেছে।

প্রথমেই দর্শন দিয়েই শুরু করি।

সীতাহরণের পর লঙ্কায় যাওয়ার পথে সামনে সমুদ্র দেখে লক্ষ্মণ ধনুর্বাণ হাতে করে ক্রুদ্ধ হয়ে রামকে বলেছিলেন, ‘আমি বরুণকে বধ করব। এই সমুদ্র আমাদের লঙ্কায় যেতে দিচ্ছে না।’

রাম বললেন, ‘লক্ষ্মণ, এ যা কিছু দেখছ এসব তো স্বপ্নবৎ। অনিত্য। সমুদ্রও অনিত্য, তোমার রাগও অনিত্য। মিথ্যাকে মিথ্যা দ্বারা বধ করা, সেটাও মিথ্যা।

এর চেয়ে অনেক বেশি অনিত্য আখ্যান রাবণ জন্ম ও রাবণ বধের। পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অসামান্য কথকতায় এ আখ্যান যে ভাবে বিবৃত করেছেন, পরমা প্রকৃতি শ্ৰীশ্ৰীমার আশীর্বাদধন্য শ্ৰীম যেভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন এই রচনায় সেটা নিশ্চয় কেউ আশা করছেন না, সুতরাং ভরসা করে লিখি।

(ভরসা মানে, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ভরসা)।

কৈলাসে শিবঠাকুর আর তাঁর সুযোগ্য সহচর নন্দী বসে আছেন। হঠাৎ দুম করে একটা ভীষণ শব্দ হল। নন্দী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রভু এ কীসের শব্দ?’

শিবঠাকুর বললেন, ‘এই মাত্র রাবণ জন্মাল, তাই এত শব্দ।’

কিছুক্ষণ পরে আবার একটি ভয়ানক শব্দ হল। নন্দী আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রভু, এবার আবার কীসের শব্দ হল?’

শিব মৃদু হেসে বললেন, ‘এবার রাবণ বধ হল।’

* * *

রামকৃষ্ণ এরপর বলেছেন, ‘জন্ম মৃত্যু। এসব ভেলকির মতো। এই আছে। এই নেই। সব অনিত্য।…

…জলই সত্য। জলের ভুড়ভুড়ি। এই আছে, এই নেই। ভুড়ভুড়ি জলে মিশে যায়। যে জলে উৎপত্তি, সেই জলেই লয়।’

* * *

এরপরে রামকৃষ্ণ কথিত দুটি রামভক্তির গল্প স্মরণ করি। বলা বাহুল্য দুটিই রূপক গল্প। এর্তে লোককথার সঙ্গে ঈশ্বরভক্তির অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে।

প্রথম গল্পটি একটি কাক নিয়ে, দ্বিতীয়টি একটা কোলাব্যাঙ নিয়ে।

রাম-লক্ষ্মণ পম্পা সরোবরে গিয়েছেন। লক্ষ্মণ দেখলেন, একটি কাক ব্যাকুল হয়ে বারবার জল খেতে যায়, কিন্তু খায় না। রামকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, ‘ভাই এ কাক পরমভক্ত। অহর্নিশি রামনাম জপ করছে। একদিকে জলতৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু খেতে পারছে না। ভাবছে, খেতে গেলে পাছে রামনাম জপ ফাঁক হয়ে যায়।…’

কোলাব্যাঙের কাহিনীটি ততোধিক মর্মান্তিক। সে ঘটনাও পম্পা সরোবর তীরে।

রাম লক্ষ্মণ সরোবরের তীরের মাটিতে ধনুর্বাণ গুঁজে স্নান করতে নেমেছেন। স্নানের পরে উঠে লক্ষ্মণ মাটিতে গুঁজে রাখা বাণ তুলে দেখেন যে সেটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে রয়েছে। রাম তাই দেখে ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘ভাই দ্যাখো তো, বোধহয় কোনও জীবহিংসা হল।’

লক্ষ্মণ তখন মাটি খুঁড়ে দেখলেন একটি বেশ বড় কোলাব্যাঙ। শেষ অবস্থা। রাম করুণ স্বরে বললেন, ‘কেন তুমি শব্দ করোনি, চেঁচিয়ে ওঠোনি? আমরা তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। যখন সাপে ধরে তখন তো খুব চেঁচাও।’

কোলাব্যাঙ বলল, ‘রাম, যখন আমাকে সাপে ধরে তখন আমি চেঁচাই, রাম রক্ষা করো, রাম বাঁচাও এই বলে। এখন দেখলাম রামই আমাকে মারছেন। তাই চুপ করে ছিলাম।’

দুটি কাহিনীরই বক্তব্য খুবই সরল ও স্পষ্ট। সারমর্ম বুঝতে অতি অশিক্ষিত, অতি সাধারণ লোকেরও কোনও অসুবিধে হয় না, হতে পারে না। যে কোনও কথাশিল্পীর পক্ষে এ বিষয়ে পরমপুরুষের ধারে কাছে পৌঁছনো অসম্ভব।

রাবণকে নিয়েও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের অনেক গল্প। সীতা তখন অশোক কাননে বন্দিনী। সীতাকে পাওয়ার জন্যে অনেক রকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে রাবণ। সেই সময় রাবণকে প্রশ্ন করা হয়, ‘তুমি সীতার জন্যে নানারকম মায়ারূপ ধরেছ। একবার রামরূপ ধারণ করে সীতার কাছে গিয়ে দেখো না।’

রাবণ বলল, ‘যখন রামরূপ চিন্তা করি ব্রহ্মপদ পর্যন্ত তুচ্ছ হয়ে যায়, পরস্ত্রী তো সামান্য কথা তাহলে রামরূপ কী করে ধরব?’

সীতা এবং রাবণকে নিয়ে রামকৃষ্ণের অন্য একটা গল্প আরও বেশি অর্থবহ।

সীতা রাবণকে বলেছিলেন, ‘রাবণ পূর্ণচন্দ্র, আর রামচন্দ্র আমার দ্বিতীয়ার চাঁদ।’

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘সীতার এ কথার মানে রাবণ বুঝতে পারেনি। তাই রাবণ এ কথা শুনে ভারী খুশি। সীতার এ কথা বলবার হেতু এই-যে রাবণের যতদূর যা হবার তা হয়েছে। সে পূর্ণচন্দ্রের মতো বিকশিত, এইবার দিনদিন তার চন্দ্রকলার হ্রাস পাবে, সে কৃষ্ণপক্ষের দিকে এগোচ্ছে।…

…আর রামচন্দ্র হলেন দ্বিতীয়ার চাঁদ। তাঁর দিন দিন বৃদ্ধি হবে।’

* * *

পুনশ্চ:

এই রচনার অবশেষে অন্তত সামান্য একটু সরসতা না আনলে এই ধারাবাহিকের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি অন্যায় করা হবে। তবু বলি এই জন্যে যদি কারও মনে সন্দেহ হয় যে পরবর্তী খণ্ড আখ্যানটি এই সামান্য গদ্যকারের নিতান্ত বানানো, তিনি দয়া করে উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত (প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৮৪৬) দেখে নেবেন। উপমা রামকৃষ্ণস্য নামক শ্রীবিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর বইয়ের একশো তেইশ নম্বর সংকলন সূত্রেই এটি রয়েছে।

গল্পটি খুব ছোট, খুবই সংক্ষিপ্ত।

…এক রামভক্ত রাতদিন হনুমানের চিন্তা করত। মনে করত আমি হনুমান হয়েছি।

শেষে তার ধ্রুব বিশ্বাস হল যে তার একটু ল্যাজও হয়েছে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *