রাম ও অন্যান্যরা
রামায়ণ সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে সংক্ষেপে তার রচনাকাল, স্তরবিন্যাস এবং রচনার প্রক্রিয়া বিষয়ে কিছু বলে নেওয়া দরকার। পণ্ডিতেরা মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকের কাছাকাছি এর রচনার সূত্রপাত, এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় (কারও কারও মতে চতুর্থের প্রথমাংশে) এ রচনা তার বর্তমান কলেবর লাভ করে। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কাহিনির বিভিন্ন অংশ অবলম্বনে নানা স্থানে কিছু কিছু গাথা রচিত হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে কিছু কিছু গাথা পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়ে রামায়ণের কাণ্ডগুলির আংশিক কাঠামো প্রস্তুত করে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের বাল্মীকি বা কোনও মহাকবি এগুলিকে সংহত রূপ দেন। তারই শ’খানেক বছরের মধ্যে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ দিক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে মূল রামায়ণ অর্থাৎ, অযোধ্যা থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত গ্রন্থটি বর্ণনা ও অলংকারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এর পর এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রথম ব্রাহ্মণ্য বা ভার্গব প্রক্ষেপ, অর্থাৎ, আদিকাণ্ডের প্রথমার্ধ ও উত্তরকাণ্ড, যা সমাপ্ত হয় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে। পরের প্রক্ষেপ সম্ভবত দ্বিতীয় শতকে এবং হয়তো চতুর্থের শুরুতে এর শেষতম প্রক্ষেপ।
মূল এবং প্রক্ষেপের পার্থক্য নিহিত আছে ভাষায়, ব্যাকরণে, অলংকারে, বিষয়বস্তুতে ও ধর্মীয়-দার্শনিক মূল্যবোধে। এগুলি অনুধাবন করেই আমরা রচনার বিভিন্ন স্তরের চরিত্র ও রূপ আনতে পারি। এর দুটি প্রধান অংশ: মূল ক্ষত্রিয় কাহিনি, অযোধ্যা থেকে যুদ্ধ বা লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত এবং ব্রাহ্মণ্য বা ভার্গব প্রক্ষেপ অর্থাৎ, আদি বা বালকাণ্ডের প্রথমাংশ ও উত্তরকাণ্ড। মূল রামায়ণে রাম দেবতা নন, মানুষ; প্রক্ষিপ্ত অংশে, বিষ্ণুর অবতার। আদি কাণ্ডের শুরুতে বাল্মীকি নারদকে জিজ্ঞেস করছেন: ‘এই পৃথিবীতে কে এমন গুণবান্, বীর্যবান্, ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ, সত্যবাক্, দৃঢ়ব্রত, চরিত্রবান্, সর্বভুতে হিতকারী আছেন— যিনি বিদ্বান, সমর্থ, প্রিয়দর্শ, আত্মবান্, জিতক্রোধ, দ্যুতিমান্ ও পরশ্রীকাতর নন? যুদ্ধে ক্রুদ্ধ হলে কাকে দেবতারাও ভয় পান?’ (১:২-৪) উত্তরে নারদ বলেন, ‘এইসব গুণযুক্ত যিনি বীর্যে বিষ্ণুর সদৃশ, সেই মানুষের কথা বলছি।’ (১:২:১৮) অন্য একটি সংস্করণে নারদ বলেন, ‘যেসব গুণের কথা বলছ, তার আধার তো দেবতাদের মধ্যেও কাউকে দেখতে পাইনে, যে মানুষটি এইসব গুণযুক্ত, তার কথা বলছি, শোনো।’ (১:১১)
এই যে ‘অশেষবিধ গুণযুক্ত’ মানুষ রামচন্দ্র, তাঁর চরিত্রের ভিন্নভিন্ন কয়েকটি দিক আলোচনা করলে হয়তো রামায়ণের সামাজিক অর্থ ও তাৎপর্য আমাদের কাছে আরও খানিকটা স্পষ্ট হবে। রামায়ণে তাঁকে প্রথম দেখা যাচ্ছে পুত্ররূপে। প্রথম দিকে দেখি বাধ্য সন্তানের মতো তিনি পিতার আজ্ঞায় লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ-বিঘ্নকারী রাক্ষস মারতে গেলেন। এ সময়েই পদস্পর্শে অহল্যার শাপমুক্তি; এটা প্রক্ষিপ্ত অংশের, রামের দেবত্ব প্রতিপাদন করার জন্য সংযোজিত। তাড়কাকে বধ করতে রাম ইতস্তত করছেন দেখে বিশ্বমিত্র তাঁকে বললেন— এই স্ত্রীবধে কোনও অন্যায় হবে না। (১:২৫:২৭) রাক্ষসবধে শৌর্য প্রমাণ হল, পরে বিশ্বামিত্র দুই রাজপুত্রকে নিয়ে জনকরাজ-কন্যার বিবাহসভায় গেলেন। এই কন্যা বস্তুত ধরিত্রীদেবীর আত্মজা, জনকরাজা হলকর্ষণের সময়ে এঁকে ক্ষেতের মধ্যে পান বলে এঁর নাম সীতা। অর্থাৎ, ইনি প্রকৃতপক্ষে দেবকন্যাই। জনকরাজার সভায় এ কন্যা বীর্যশুল্ক। লক্ষণীয়, এটি কন্যাপণেরই একটি প্রকারভেদ, যে কন্যাপণ আগে সমাজে প্রচলিত ছিল। সভায় রাম অবলীলাক্রমে হরধনু ভঙ্গ করলে পর সীতার সঙ্গে তার বিবাহ হল। রাম বিয়েতে অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে দাসদাসী ও একশত কন্যাও যৌতুক পান। চার ভাই বধূদের নিয়ে অযোধ্যায় এসে কিছু কাল সুখে বাস করার পর দশরথের ইচ্ছে হল রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন। স্বাভাবিক নিয়মে জ্যেষ্ঠকুমারই রাজ্য পান, তবু রামায়ণে দেখি দশরথ ভরতকে কেকয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং বৈবাহিক জনককে কোনও নিমন্ত্রণ করেননি, খবরও দেননি। কৈকেয়ী যখন পুরোনো দুটি বরে রামের বনবাস এবং ভরতের রাজত্বপ্রাপ্তি চেয়ে নেন এবং তা শুনে লক্ষ্মণ ক্রোধে অধীর হয়ে কটূক্তি করতে থাকেন, তখন রাম লক্ষ্ম ণকে বলেন— ভাই, আগেই জননী কৈকেয়ীকে বিবাহ করার সময়েই পিতা মাতামহ কেকয়রাজের কাছে কৈকেয়ীর পুত্রকে রাজ্য দানে প্রতিশ্রুত ছিলেন।’ (২:১০৭:৩) অতএব কৈকেয়ী সেই কথা তুলে গোলমাল করতে পারেন বা ভরতও সে দাবি করতে পারেন এই আশঙ্কাতেই সম্ভবত ভরতকে মামার বাড়ি পাঠনো হয়েছিল। যদিও দশরথ বলেন— ‘ভরত তেমন ছেলেই নয়, সে রামের চেয়েও ধার্মিক।’ (২:১২৬১-৬২) কৈকেয়ী অবশ্য সে কথা তোলেননি। দশরথের দেওয়া বরের জোরেই ইষ্টসিদ্ধি করেন।
এখানে লক্ষণীয়, আগের দিন যাঁর অভিষেক ঘোষণা করা হয়েছে, আগের রাত্রে যিনি সীতার সঙ্গে ব্রতশীল হয়ে অগ্নিগৃহে কাটিয়েছেন, সকালে কৈকেয়ীর মুখে নিজের মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ জানতে পেরেও সেই রাম মাত্র একটিই অভিযোগ করেছেন, ‘আমি পিতার কথায় অগ্নিতে প্রবেশ করতে পারি। কেন পিতা আগের মতো আমায় অভিনন্দন করছেন না? একটি অলীক ব্যাপার আমার চিত্তকে দগ্ধ করছে; রাজা নিজে কেন আমাকে ভরতের অভিষেকের সংবাদ দিলেন না? বললে, আমি খুশি হয়েই ভাই ভরতের জন্য সীতা, রাজ্য, চাই কী, প্রাণও দিতে পারতাম।’ (২:১৯:৬০৭) লক্ষণীয়, যৌতুকে পাওয়া শত কন্যার মতো বিবাহিত ভার্যা সীতাকেও দানের কথা ওঠে; যেন তিনি ব্যক্তি নন, বস্তুমাত্রই; সমাজ নারীকে মুখ্যত এই দৃষ্টিতেই দেখত।
বনে যাওয়ার প্রসঙ্গে লক্ষ্মণ সঙ্গে যেতে চাইলে খানিকটা আপত্তির পর রাম রাজি হলেন। সীতা যেতে চাইলে, বনবাসের কষ্টের কথা বলে তাঁকে নিবৃত্ত করতে চাইলেন, বললেন, তুমি রাজধানীতে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা কর।’ ব্রাহ্মণ-সাহিত্যে আমরা পড়ি, ‘কুলায় কন্যা প্রদীয়তে’ অর্থাৎ, বধূটিকে শ্বশুরকুলে দান করা হয়। রামচন্দ্রও এখানে প্রায় তেমন কথাই বলেছেন। সীতা যে যুক্তি দিলেন তাতে শ্বশুরকুলের পরিচর্যা গৌণ হয়ে গেল। যে সীতাকে রাম খুশি হয়েই ভরতকে দান করতে পারতেন সেই সীতা বললেন, ‘তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গে বাস করতেও অভিরুচি নেই। তোমার বিরহে, হে রাম, আমি এখানে প্রাণত্যাগ করব।’ (২:২৭:২১, ২:১৯:৫) এ কথা কোনও রকম কর্তব্যবোধে উচ্চারিত হয়নি, সতী সাধ্বীর মর্যাদা পাওয়ার জন্যেও নয়, এর প্রেরণা এসেছে রামের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম থেকে। রাম সঙ্গে নিলেন সীতাকে; তেরো বছর বনবাসের সঙ্গিনী হলেন প্রেমিকা সীতা।
রামের সৌভ্রাতৃত্ব বারেবারেই প্রকাশ পেয়েছে। লক্ষ্মণ ও ভরতের সঙ্গে তিনি সস্নেহ ব্যবহার করেছেন, যদিও লক্ষ্মণ দাসের মতো নিরন্তর অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁদের পরিচর্যা করে গেছেন। রামের প্রতি ভরতেরও একটা দাস্যভাব দেখা গেছে: রাম যখন রাজচিহ্ন হিসাবে নিজের উত্তরীয় বা বল্কল না দিয়ে পাদুকা দুটি দিলেন, সেই পাদুকাকে সিংহাসনে রেখে নীচে বসে নন্দীগ্রামে চোদ্দো বছর রাজকার্য সম্পাদনের মধ্যে। এটা তখনকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত মনোভাব। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতার বিকল্প, এ কথা লক্ষ্মণকে বিদায় দেওয়ার সময়ে সুমিত্রার কথাতেও স্পষ্ট: ‘রামকে দশরথ বলেই মনে করো’। প্রাচীন জগতে বড় ভাইকে বাবার প্রতিনিধি বলেই মনে করা হত, অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতাতেই জ্যেষ্ঠত্বের দাবি ও সম্মান এ ধরনেরই ছিল। যখন ভরত এসে রামকে সিংহাসন নেওয়ার জন্য বহু মিনতি করলেন, তখন রাম পিতৃসত্য রক্ষায় ব্রতী বলে কোনও মতেই রাজি হলেন না। ভরতের ওপরে তাঁর এ বিশ্বাস ছিল যে, বনবাসকাল পূর্ণ হলে তিনি অবশ্যই রামকে রাজত্ব ফিরিয়ে দেবেন। তা ছাড়া নির্বাসনের কথা শুনে বারে বারে রাম বলেছেন যে, রাজ্যে তাঁর লোভ নেই। আবার সত্যই তিনি এমন যুক্তি এক বারও দেননি যে, জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে সিংহাসনে তাঁর অপ্রতিহত দাবি, কৈকেয়ীর কাছে দশরথের প্রতিজ্ঞার কোনও মূল্য নেই। এ ব্যাপারে তিনি প্রকৃতই নির্লোভতা দেখিয়েছেন। জাবালি, বশিষ্ঠ, লক্ষ্মণ ও কৌশল্যার যুক্তিতেও তিনি পিতৃসত্য রক্ষার দায়িত্ব ত্যাগ করেননি।
বনে যাওয়ার পথে প্রথম রাত্রে তিনজন এলেন রামের বন্ধু নিষাদ রাজ গুহকের রাজ্যে। গুহক নানা খাদ্যসম্ভারে আপ্যায়ন করতে চাইলে রাম বললেন, তাঁরা বনবাসী, ফলমূলই খাবেন, অন্যের দান প্রতিগ্রহণ করবেন না; গুহক যদি রথের ঘোড়াদের জন্য খাদ্য দেন তাহলে উপকার হয়। (২:৫০:৪৩,৪৪) গুহক তাই করলেন। বনবাসে কিন্তু রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, অত্রি-অনুসূয়া, ভরদ্বাজ ও অন্যান্য মুনিদের দেওয়া ফলমূল ভোজন করেছেন। গুহকের কাছেও তা করতে পারতেন, কিন্তু তা না করে রাত্রিতে তাঁরা উপবাসে কাটালেন। সেটা কি গুহক জাতিতে নিষাদ ছিলেন বলে?
রাবণের পরামর্শে মারীচ যখন সোনার হরিণ হয়ে এল এবং সীতা সেটা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন, তখন রাম সীতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেও না পেরে ধনুর্বাণ নিয়ে বেরোলেন, লক্ষ্মণের হাতে সীতার রক্ষার ভার দিয়ে। মারীচের মায়াতে বিপন্ন রামের ডাক শুনলেন সীতা, তখন আতঙ্কে হিতাহিতজ্ঞান-শূন্য হয়ে লক্ষ্মণকে কটুকথা বললেন, আদেশ করলেন রামের সাহায্যের জন্য তখনই যেতে। কাজটা অন্যায়, কিন্তু এই কটুকথার পেছনেও আছে প্রিয়তম রামের অমঙ্গল আশঙ্কা, এ পতিব্রতার কর্তব্য নয়, প্রেমের আকুতি।
লক্ষ্মণ চলে যাওয়ার পরে রাবণ প্রথমে সন্ন্যাসীর বেশে আশ্রমে আতিথ্য চাইলে সীতা পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁকে অপেক্ষা করতে বললেন, তখন রাবণ স্বরূপ ধারণ করে সীতাকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করেন। শক্তি ও ঐশ্বর্যের মোহ এবং প্রবল কামনার অভিব্যক্তির সঙ্গে ছিল দুর্বল নির্বাসিত মানুষ-স্বামীর সহদুঃখচারিণীর দৈন্য ও গ্লানির কথা। রাবণ এ কথাও বলেন যে, সীতা বিনা তিনি বাঁচতেই পারবেন না। (৩:৬২:১৩) উত্তরে সীতা বললেন:
তুমি শৃগাল হয়ে সিংহীকে পেতে চাইছ। কাল সাপের মুখে হাত দিয়ে তার বিষদাঁত ওপড়াতে চাইছ। কালকূট বিষ পান করে স্বস্তিতে থাকতে চাইছ, সূচী দিয়ে চক্ষু ভেদ করতে বা জিহ্বা দিয়ে ক্ষুর লেহন করতে চাইছ। রাঘবের প্রিয়াকে তুমি পেতে চাইছ? কণ্ঠে শিলাখণ্ড বেঁধে সমুদ্র উত্তরণ করতে চাইছ? দুই হাত দিয়ে চন্দ্র সূর্য ধরতে চাইছ? তুমি রামের প্রিয়া বধূকে ধর্ষণ করতে চাইছ? জ্বলন্ত অগ্নিকে কাপড় দিয়ে আহরণ করতে চাইছ, তাই রামের কল্যাণী বধূকে পেতে চাইছ? বনে সিংহ আর শৃগালের যে পার্থক্য, ছোট খাল ও সমুদ্রের যে পার্থক্য, শ্রেষ্ঠ বীর আর কাপুরুষের যে পার্থক্য, হস্তি আর বিড়ালের যে পার্থক্য, গরুড় ও সর্পের যে প্রভেদ, পানকৌড়ি ও ময়ুরের যে প্রভেদ, হাঁস ও শকুনের যে প্রভেদ- দাশরথি রামের সঙ্গে তোমারও সেই প্ৰভেদ।
এই স্পর্ধিত উক্তি-পরম্পরা উদগত হয়েছে রামচন্দ্রের যোগ্যতায় একান্ত বিশ্বাস এবং তাঁর প্রতি গভীর প্রেম থেকে। সুখে-দুঃখে, প্রাসাদে-কান্তারে একান্ত ভাবে যে স্বামীকে তিনি দেখেছেন, বুঝেছেন, ভালবাসতে এবং নির্ভর করতে শিখেছেন, সেই স্বামীর সঙ্গে অন্য কারও তুলনা তাঁর কাছে এক হাস্যকর প্রয়াস, তা সে প্রতিদ্বন্দ্বী যতই প্রবল শক্তিমান ও ঐশ্বর্যবান হোক না কেন
রাম-লক্ষ্মণ জটায়ুর কাছে সীতা হরণের কথা শুনলেন। যেখানে কেউ সাক্ষী ছিল না, সেই নির্জন অরণ্যে জটায়ু বন্ধু দশরথের পুত্রবধূর অপমান ও অপহরণ দেখে, পরাজয়, আঘাত ও মৃত্যু অনিবার্য জেনেও একাকী রাবণের প্রতিকূলতা করে মুমূর্ষু অবস্থায় বেঁচে ছিলেন, শুধু সীতার খবরটুকু রামকে দেওয়ার জন্য। তাঁর মৃত্যুর পর রাম-লক্ষ্মণ পিতৃতর্পণের মতো করেই তাঁর অন্ত্যেষ্টি ও তর্পণ করলেন। এ রাম কর্তব্যনিষ্ঠ, সৌজন্যপরায়ণ। সীতা-বিরহে লক্ষ্মণের সামনেই রাম দীর্ঘ বিলম্বিত বিলাপ করতে থাকেন, লক্ষ্মণই তাঁকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। অযোধ্যা ত্যাগ করার সময় থেকে রামের মুখে একটি বারও শোনা যায়নি যে, নববিবাহিত লক্ষ্মণ বিনাবাক্যে ঊর্মিলাকে ফেলে রেখে তাঁর অনুগামী হয়েছেন এবং চোদ্দো বছর বিরহ যাপন করছেন স্বেচ্ছায়। শূর্পণখা প্রসঙ্গে বরং মর্মান্তিক পরিহাস করে রাম রাক্ষসীকে বলেন, ‘লক্ষ্মণ অবিবাহিত, তুমি ওকেই বেছে নাও।’ পরিহাস হলেও কথাটা মিথ্যা ও হৃদয়হীন। ভদ্র লক্ষ্মণ এ জন্যে রামকে কোনও অনুযোগও করেননি। রামের সৌভ্রাজের বিধানে এ কথা লেখে না যে, ছোট ভাইয়ের অকুণ্ঠ পরিচর্যার পশ্চাতে যে নীরব দীর্ঘ বিরহযাপন আছে তার কোনও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বা তার জন্য কৃতজ্ঞতার প্রয়োজন আছে। সীতাও কোনও দিন এর উল্লেখ করেননি। বয়ঃকনিষ্ঠের কাছ থেকে কোনও রকম সেবা অকুণ্ঠ ভাবে নেওয়া সমাজে অনুমোদিত ছিল। ভ্রাতৃস্নেহের প্রমাণ দেখি যুদ্ধে অজ্ঞান লক্ষ্মণের জন্য রামের বিলাপে ‘প্রাণ পেয়ে সীতা পেয়ে কী লাভ আমার? মর্তলোকে খুঁজলে সীতার মতো নারী আরও পাওয়া যাবে, কিন্তু লক্ষ্মণের মতো সচিব ও যোদ্ধা ভ্রাতা কোথাও পাওয়া যাবে না।’(৬:৪৯:৫) পরে আবার শক্তিশেলে অচেতন লক্ষ্মণের জন্য রামের হাহাকার: ‘দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, বন্ধুও পাওয়া যায়, কিন্তু তেমন দেশ তো দেখি না যেখানে সহোদর ভ্রাতা পাওয়া যায়।’ (৬:১০১:১৫) অথবা, ‘(লক্ষ্মণ) তুমি যখন মৃত্যুমুখে পতিত তখন আমার জীবন নিরর্থক, সীতা বা বিজয়লাভ করাও নিরর্থক’। (৬:১০১:৪৯)
বারবারই দেখছি ভ্রাতৃস্নেহের কাছে পত্নীপ্রেম তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। এরই সঙ্গে স্বভাবতই চোখে পড়ে রামের প্রতি সীতার প্রেমের যে ঐকান্তিকতা, সীতার প্রতি রামের প্রেমে সে গভীরতা নেই। স্ত্রী সুলভ, তাকে যত্রতত্র পাওয়া যায়, তাকে ইচ্ছামতো ত্যাগও করা যায়— এ বোধ রামের চিত্তে প্রথম থেকেই ছিল। যদি মেনেও নিই যে, শোকার্তের বিলাপে অত্যুক্তি কিছু থাকবেই, তবুও একই তুলনা— সীতার প্রতি প্রেমের সঙ্গে লক্ষ্মণের প্রতি স্নেহের— এটার কিছু ভিত্তি না মেনে উপায় থাকে না। এর অনেকটাই যুগধর্ম, এ বিষয়ে পরে আলোচনা করছি। কিন্তু মূল কথা হল, লক্ষ্মণ শুধু ভাই-ই নন, তিনি পুরুষ, অতএব সীতার ঊর্ধ্বে তাঁর স্থান।
কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ডে সুগ্রীবের সঙ্গে রামের যে বন্ধুত্ব হয় তার মূলসূত্র ছিল পরস্পরের উপকার। সুগ্রীবের দাদা বালী সুগ্রীবের রাজ্য ও স্ত্রী ভোগ করেছেন সুগ্রীবকে নির্বাসিত করে। রাম যেন সুগ্রীবের স্ত্রী ও রাজ্য উদ্ধার করে দেন, তাহলে সুগ্রীবও তাঁর বানর সেনাদের দিয়ে রামের অপহৃতা সীতার সন্ধান করবেন ও রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামের সহায়তা করবেন। দু’পক্ষই সত্য রক্ষা করেছিলেন। এর বাইরে যা তা রামের দিক থেকে সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কিন্তু প্রথমেই প্রয়োজন ছিল বালীকে পরাজিত করা। এ ব্যাপারে রাম তাঁর সামর্থ্য ঘোষণা করলেন একটি তিরে সাতটি তালগাছকে এক সঙ্গে ভেদ করে। পরে রামের প্ররোচনায় সুগ্রীব বালীকে আহ্বান করে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন, দু’ভাই একই রকম দেখতে বলে রাম বালীকে বধ করতে সাহস পেলেন না, পাছে তাঁর ভুলে সুগ্রীব নিহত হন। দ্বিতীয় বার সুগ্রীব গজপুষ্পীর হার পরে যাওয়ায় রাম গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে বাণ নিক্ষেপ করে বালীকে বধ করেন। বালী রামকে দেখতে পেয়ে প্রবল ধিক্কার দিলেন, ক্ষত্রিয় হয়ে যুদ্ধনীতির মূলসূত্র লঙ্ঘন করে আড়াল থেকে শত্রু নিধন করার জন্য।(৪:১৭:১৬) কাজটা যে একটুও বীরোচিত নয়, বরং অত্যন্ত গর্হিত, এ কথা রাম কি জানতেন না? আগে বালী রাম সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ রাম কেমন করে পাপ করবেন?’ (৪:১৬:৫) দেখা গেল পাপ করতে রামের বাধল না, সীতা উদ্ধারের জন্য সুগ্রীবের সহায়তা তাঁর মতো নির্বাসিত অসহায় মানুষের পক্ষে যে অপরিহার্য! তাই তিনি অনায়াসে বীরনীতি পরিত্যাগ করলেন। বালীর অনুযোগ শুনে রাম একটার পর একটা কু-যুক্তির অবতারণা করলেন, ক্ষত্রিয় রাজারা মৃগয়া করে ভক্ষ্য মাংস সংগ্রহ করেই থাকে। উত্তরে বালী বললেন, ‘যে পাঁচটি মাত্র পঞ্চনখ ভক্ষ্য, সজারু, কুমির, গোসাপ, খরগোস, কচ্ছপ— বানর তার মধ্যে পড়ে না।’ (৪:১৭:৩৯:৪০) রাম বললেন, ‘রাজ্য ভরতের, আমি তার আজ্ঞায় পাপীর দণ্ড দিই, তুমি ভ্রাতৃবধূকে গ্রহণ করেছ, অতএব দণ্ডনীয়।’ কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যটা ইক্ষ্বাকুদের ছিল না, ছিল বানরদের। রাম বললেন ‘শিকারি তো লুকিয়েই প্রাণীবধ করে।’ (৪:১৮:৩৮) বালী আগেই বলেছেন, ‘বানরমাংস ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের অভক্ষ্য’। কাজেই শেষ পর্যন্ত স্বীকার না করলেও প্রতিপন্ন হয়ে রইল যে, রাম অধার্মিক উপায়ে কাপুরুষের মতো বালীকে বধ করেছেন। কেন এমন করলেন? একটি মাত্র উত্তরই সম্ভব, স্বার্থসিদ্ধি। বালী এত বড় বীর যে রামের আশঙ্কা ছিল সম্মুখ সমরে তিনি পরাজিতও হতে পারেন, তাই ক্ষাত্র-ধর্ম, বীরধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে, যেন তেন প্রকারেণ ইষ্ট সিদ্ধি করলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বনবাসকালে চোদ্দো হাজার রাক্ষসবধ কেমন যেন অবাস্তব সাজানো কাহিনি, রূপকথার উপাদান মনে হয়। প্রথম সম্মুখ সমরে রাম নৈতিক ভাবে পরাজিত, বীরধর্মচ্যুত।