রামাই ভূত – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
লাভপুর। বীরভূম জেলার লাভপুর। আমার বাড়ি সেখানে। লাভপুরে চারখানা দুর্গাপুজো হয়, বারোখানা কালীপুজো হয়। শিব আছেন কয়েক গণ্ডা। এ ছাড়া বুড়ো শিব আছেন। এঁদের সঙ্গে অনেক ভূতের আসা—যাওয়া। তবে তারা আসে আবার চলে যায় দেব—দেবীর সঙ্গে। এ ছাড়াও অন্য ভূত, যারা এখানে বিশেষ পরিচিত, তারাও কম নয়, সংখ্যায় তারাও অনেক। এদের মধ্যে লালুকচাঁদা পুকুরের পাড়ে বটগাছটায় যে পেতনিটা থাকত তার নাম তো সেই ছেলেবয়েস থেকে শুনে আসছি। সে বটের ডালে দাঁড়িয়ে ডালটা দুলিয়ে দোল খেত। চট্টরাজদের বাড়িতে একটা ভূত ছিল সেটার কাজ ছিল সমস্ত রাত্রি বাড়ির ঘুমন্ত লোকগুলির পায়ে বগলে সুড়সুড়ি কাতুকুতু দিয়ে জাগিয়ে দেওয়া। প্রথম প্রথম মানুষেরা চমকে উঠে ‘কে কে’ বলে জেগে উঠলেই সে খিলখিল শব্দে খোনা হাসি হেসে আরও সুড়সুড়ি দিত। শেষপর্যন্ত লোকে ভয় না করে গায়ে পায়ে হাত ঠেকলেই হাত—পা ছুঁড়ে ভূতটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিত। তখন সে আবার অন্য পথ ধরে জ্বালাতন করত, বাবলার কাঁটা ভেঙে এনে ফুটিয়ে দিয়ে জ্বালাতন করত। বৈরিগীতলার বষ্টুম ভূত ছিল। এখানে বৈরিগীদের একটা খুব ভালো আখড়া ছিল। সেখানে উৎকৃষ্ট বেলগাছ ছিল। লোকে বলত বাদশাহি বেল। এই বেলের লোভে অনেক বষ্টুম ভূত আসত। সকলকে তাড়িয়ে এখানে পাকাপোক্ত মোহন্ত ভূত হয়েছিলেন তিনি এক বষ্টুম পণ্ডিত ভূত। তিলক ফোঁটাকাটা মোটা চৈতনওয়ালা মহাপণ্ডিত। শুনেছি তাঁর মতো বৈষ্ণব শাস্ত্রে—সাহিত্যে পণ্ডিত দেশে দু—চারটের বেশি ছিল না। ক র গ চ শব্দগুলো শুনলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। ক—য়ে কৃষ্ণ, র—য়ে রাধা, গ—য়ে গৌরাঙ্গ—গোবিন্দ, চ—য়ে চৈতন্য। মৃত্যুর পর রথ এসেছিল তাঁকে নিতে, কিন্তু তিনি যাননি। বলেছিলেন—ওহে সারথি, তুমি বাবু রথ নিয়ে ফিরে যাও। আমার কিছু কাজ বাকি আছে, মানে গোটাকতক মামলা চলছে আদালতে। সে—কটা শেষ না—হওয়া পর্যন্ত যেতে আমি পারব না। রথ ফিরে গিয়েছিল। বৈষ্ণবপতি জীবনকালে শুধু বৈষ্ণবশাস্ত্র নিয়েই কারবার করেননি—তাঁর আইনজ্ঞান, মামলাজ্ঞান ছিল টনটনে। এ চাকলায় ফৌজদারি দেওয়ানি যে মামলাই হোক পণ্ডিত মোহন্ত তার একপক্ষের তদ্বিরে থাকতেনই। বৈষ্ণব শাস্ত্র নিয়ে কথা না বললে তাঁর বুক ধড়ফড় করত, মাথা ধরত। আর মামলা নিয়ে কোনো দিন যদি আলাপ আলোচনা না হত তা হলে তাঁর পেট কামড়াত এবং যা খেতেন তার একটি দানাও হজম হত না। সুতরাং মৃত্যুর সময় তাঁর হাতে চার—চারটে মামলা, এ খুব বেশি ব্যাপার নয়। বৈষ্ণবপণ্ডিত ভূত হয়ে দীর্ঘকাল থেকেছিলেন; থাকতেন ওই যে বেলবন, ওই বেলবনের মধ্যে একটা বকুলগাছে। বেলগাছের কাঁটা ফুটত বলে বেলগাছে থাকতেন না। প্রায় রোজই যাতায়াত করতেন সিউড়ি—রামপুরহাট। আদালতের সামনে একটা খোলা জায়গা সর্বত্র আছে এবং সেখানে বটগাছ আছে। সেই বটগাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতেন; কেউ যদি আইনের পরামর্শ চাইত তা হলে তিনি কূট পরামর্শ দিতেন; ফি সামান্যই, সামান্য বাতাসা—টাতাসা দিলেই হত। প্রতি বৎসর তাঁর মৃত্যুদিনে রথ আসত কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিয়ে বলতেন—আসছে বছর এসো। তাঁকে তাড়িয়েছিল গঙ্গাতীরের ভূতের দল এসে।
একবার শুনেছি গঙ্গাতীর থেকে এক ঝুড়ি বা চুপড়ি বোঝাই হয়ে ভূত এসেছিল আমাদের গ্রামে। ব্যাপারটা হল এই : আমাদের এখানে ‘বৈরাগী আখড়া’ বলে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। সেখানে গৌরাঙ্গ—নিত্যানন্দের সেবা ছিল। আর ছিল গোবিন্দ—সেবা। এঁদের চারপাশে ছিল ঝুড়িখানেক শালগ্রাম শিলা। মানেটা সেকালে সহজ ছিল, একালে ঠিক সহজ নয়। সেকালের ব্রাহ্মণদের বহুজনের বাড়িতে শালগ্রাম নারায়ণ—সেবা ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কালে লোকেরা দেখলে এই গোল নুড়িগুলো ‘কুছ কামকা নেহি’; কেবল পুজো ভোগের ঝঞ্ঝাট বাড়ায়; শালগ্রাম নিয়ে আর ব্যবসা চলে না; লোকে সত্যনারায়ণ করায় না, যাগযজ্ঞি করায় না, তখন তারা লুকিয়ে শালগ্রাম শিলাগুলি এনে এই আখড়ায় নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। আখড়া থেকে নিয়ম ছিল যে শালগ্রাম শিলা পেলে ওই শালগ্রাম শিলার সারিতে বসিয়ে রাখবে, দিনান্তে ছিটিয়ে দেবে কুশের ডগায় গঙ্গাজল, তুলসীর পাতা আর আতপের কণা। আখড়ায় এ জন্য জমি ছিল। এই বৈষ্ণব পণ্ডিতের পরামর্শে সেবাইত একদিন শিলাগুলি ঝুড়ি বোঝাই করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গার জলে ফেলে দিলে। ব্যস নিশ্চিন্ত। কিন্তু অদৃষ্টের বিপাক, সেইখানে ছিল একটা বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের ডালে ঝুলত অনেক বাদুড়। চ্যাঁ চ্যাঁ করে চ্যাঁচাত আর উড়ত। এদের মধ্যে ছিল অনেক চামচিকে। এরা কিন্তু আসলে বাদুড় চামচিকে নয়, এরা আসলে হল গঙ্গাতীরে মরতে এসে যারা গঙ্গা পায়নি তাদেরই অশান্ত অতৃপ্ত আত্মা, ভূত হয়ে ঝুলছে ডালে ডালে। শালগ্রাম শিলা ফেলে দিতে ঝুড়িটা যেই না খালি হল অমনি ঝুপঝুপ করে একঝুড়ি বোঝাই হবার মতো চামচিকে খসে পড়ল। মানে একঝুড়ি ভূত।
সেই একঝুড়ি—বোঝাই ভূত ওই বৈরাগীর মাথায় চেপে এল আমাদের লাভপুর। এবং বৈরাগী আখড়ায় পৌঁছবামাত্র ফরফর শব্দে উড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলে বকুলগাছে। বকুলগাছের ডালে বেশ শয্যা রচনা করে ওই পণ্ডিতজি তখন ওই নাকহীন মুখের নাসিকাগহ্বরে বাতাস টেনে নাক ডাকাচ্ছিলেন। এবং স্বপ্ন দেখছিলেন যে শালগ্রাম শিলাগুলো গেল, ঝঞ্ঝাট কমল, ওই অনাথ শালগ্রাম সেবার জন্যে যে জমিটা ছিল সেটার আয় থেকে এবার যুৎসই করে মালপো খাওয়া যাবে।
গোবিন্দ হে! কোথায় মালপো! কোথায় সুখ! দু—চারশো চামচিকে পণ্ডিতকে চিঁচিঁ শব্দ করে নখ দাঁত দিয়ে আক্রমণ করলে।
পণ্ডিত সেই যে সেদিন পালালেন আর ফেরেননি। এ চামচিকে আকারের ভূতগুলো একবার ঝড়ে ওই বকুলগাছের ডাল ভেঙে পড়ায় চাপা পড়ে চেপটে লেপটে ফুস ধা হয়ে গেছে।
এ ছাড়াও অনেক অনেক ভূত আছে।
সে সব এখন থাক। এখন আমি যম দত্তের ছকে দেওয়া লাইনে গবেষণা করব। সকলেই জানেন, রিসার্চ ওয়ার্কের নিয়মই তাই, একজনের অধীনে থেকে তাঁরই পরামর্শ এবং নির্দেশমতো রিসার্চ করতে হয়। আমার গবেষণা হল যম দত্ত মহাশয়ের অধীনে। তাঁর নির্দেশ হল রামাই ভূতের সূত্র ধরে কাজ আরম্ভ করো।
রামাই ভূতের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
সে আজকের কথা নয়—আমার ঠাকুরদাদারা তখন ছেলেপুলে মানুষ। সে ধরুন গিয়ে একশো চল্লিশ বছর আগের কথা। সে সময় রামাই ভটচাজ ছিলেন একেবারে ভরাভরতি জোয়ান; ভটচাজ বাড়ির এই জোয়ান ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ‘নিশি’তে। নিশিও একরকম ভূত। তারা রাত্রে মানুষের ঘুমন্ত অবস্থায় চেনা মানুষের গলায় ঘুমন্ত মানুষের নাম ধরে ডাকে। ঘুমন্ত মানুষ ঘুম ভেঙে উঠে বেরিয়ে এসে দেখতে পায় একটু দূরে তার একজন চেনা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে চলতে থাকে, এ লোকটিও চলে। অনেক দূর এসে কোনো খালে বা বিলে ডুবে কিংবা শক্ত মাটিতে কি পাথরে আছাড় খেয়ে এবং পড়ে মরে ভূত হয়। রামাইয়ের নিশি ভয়ানক নিশি, সে থাকত গোয়াল ঘরে। রামাই তার ডাকে বেরিয়ে এসে গোয়াল ঘরে ঢুকে গোরুর দড়ি গোয়ালের সাঙায় বেঁধে তাইতে গলায় ফাঁস পরে মরেছিল। অতঃপর রামাই আমাদের অলঙ্ঘনীয় শাস্ত্রবিধি অনুসারে ভূত হল। এবং নিজের বাড়িতেই তার বাসা গাড়লে। উঠানে একটি নিমগাছ ছিল, সেই গাছ হল তার বৈঠকখানা, বাড়ির বড়ো ঘরের চালের সাঙায় হল তার শোয়ার ঘর। ভূত হয়েও সে বাড়িরই একজন হয়ে রইল। রামাইকে নাকি দিনে রাত্রে যখন তখন দেখা যেত। শুনেছি আমার ঠাকুরদাদারাও তাকে দেখেছেন। তাঁরা বলতেন, রামাইদাদা, আমাদের ভয় দেখিয়ো না। রামাই বলত—নাঁ—নাঁ। চঁলে যাঁ। নিঁর্ভয়ে চঁলে যাঁ। আমাঁর দিঁকে তাঁকাস নাঁ। আঁমি কাঁজ কঁরছি। রাত্রে সে গোরুদের খেতে দিত। ঘরদোর ঝাঁট দিত। বাড়ির দোরে একটা কলকে ফুলের গাছ ছিল, সেটায় চড়ে টাটকা কলকে ফুল তুলে চুষে চুষে মধু খেত। বড়ো যে নিমগাছটা ছিল উঠোনে, সেই গাছটার নীচের একটা ডালে দাঁড়িয়ে সেই ডগার একটা ডাল ধরে ‘হেঁইয়ো মারি হেঁইয়ো মারি’ বলে দোল খেত।
বড়দাদা নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের স্ত্রীর কোলে তখন খোকা হয়েছে। বাড়িতে মেয়েছেলে বলতে নবকৃষ্ণের স্ত্রী মানদা এবং বিধবা বোন চণ্ডীদাসী; একজন রান্না করত, অন্যজন ঘরে শালগ্রাম—সেবার কাজ থেকে অন্য সব পাটকাম করত। ছেলেটি ঘরে কি দাওয়ায় বিছানায় শুয়ে ঘুমুত। হঠাৎ ঘুম তার ভাঙত, হয়তো গায়ে দুধের বা তেলের গন্ধ পেয়ে পিঁপড়ে এসে কামড়াত, নয়তো ছোটো মাদুর বা বিছানায় উঠে—থাকা কোনো কাঠির খোঁচা লাগত, নয়তো দেয়ালা করার মধ্যে স্বপ্নে ভয় পেয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠত। মায়ের আসতে দেরি লাগত কারণ ভটচাজ বাড়িতে লোকের কাজ থেকে দেবতার কাজ বেশি। তারপর গোরুবাছুর আছে। মায়ের ছুটে আসা সম্ভবপর হত না। তখন রামাই নিমগাছের ডাল বা ঘরের সাঙা বা কলকে ফুলের গাছ বা গোয়াল ঘর যেখানেই থাকত সেখান থেকে দুই হাত লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে (সাঁতারুরা যেমন ভাবে ডাইভ করে তেমনি ভাবে আর কী!) সাঁ করে এসে হাজির হত ছেলেটির কাছে এবং ওপরের সাঙায় বসে লম্বা হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে তুলে নিত। বাচ্চা কচি ছেলে তার ভূতের ভয় ছিল না। ভূত আর মানুষে ঠিক তফাত করতে পারত না—সে কোল পেয়ে চুপ করত। রামাই তাকে দোলা দিতে দিতে আদর করে ফিসফিস খোনা আওয়াজে বলত—আ হা রে জিঁভে আমার জল সঁরছে, কঁচি কঁচি মাংস তাঁজাতাঁজা রক্ত, ইঁচ্ছে কঁরে ঘাড় মটকে চুষে খেঁয়েনি। কিন্তু দাঁদার ছেঁলে বংশধর, পিণ্ডি দিবি আমাকে, তোঁর ঘাড় কী কঁরে ভাঙি!
ছেলেটা এর মানে বুঝত না ফিকফিক করে হাসত।
বউদি এসে দেখত বিছানায় ছেলে নেই—ছেলে সাঙার কাছে শূন্যে দোল খাচ্ছে। রামাইকে সে দেখতে পেত না। অনুমানে বুঝত রামাই দোলাচ্ছে। তখন বলত, ঠাকুরপো, খোকাকে নামিয়ে দাও ভাই। ওর খিদে পেয়েছে দুধ খাওয়াবো।
রামাই সুড়সুড় করে নামিয়ে দিত ছেলেটিকে।
রামাই একটি শর্ত করিয়ে নিয়েছিল বউদিকে। শর্ত করিয়ে নিয়েছিল এই—ছেলে যেন বড়ো হয়ে কখনো গয়া না যায়।
বউদি জিজ্ঞেস করেছিল—কেন ঠাকুরপো?
খোনা আওয়াজে রামাই বলেছিল—ন্যাঁকা আমার! জাঁনো না বুঝি?
কী জানি না?
জানো না গয়ায় পিণ্ডি দিলে ভূতজন্ম থেকে মুক্তি হয়?
তা তো ভালো গো!
ভালো? তাহলে তো মানুষের মরণও ভালো! মুক্তি হয়! দোঁব নাকি তোমার ঘাড়টা ভেঙে?
ভয় পেয়ে বউদি বলত—দোহাই ভাই তোমার পায়ে পড়ি।
পায়ে পড়ি! কেন—মানুষজন্মে কত হাঙ্গামা বলো তো? খাওয়া—দাওয়া, বিষয়—সম্পত্তি করা, চাষবাস, পুজো—আর্চা, ঝগড়াঝাঁটি—
না ভাই। তবু মনুষ্যজন্ম সুখের—
রামাই ধমক দিয়ে উঠত—চুঁ—প বঁলছি! ভূঁতজন্ম আঁরও সুঁখের। স্বঁগগেও এত সুঁখ নাই। হুঁ—হুঁ
বলেই নাকি রামপ্রসাদী সুরে গান ধরে দিত—
মঁন, তুঁমি আঁসল খঁবর জাঁনো না—
ভূঁতজন্ম, সুঁখ—জন্ম, বিনি আঁবাদে ফঁলে সোঁনা!
গাঁছের ডাঁলে ঘঁরের কোঁণে
শ্মঁশানে মঁশানে বঁনে—
বাঁসা বাঁধো রাঁন্না রাঁধো
শুঁধু লঁঙ্কাতে সঁম্বরা দিঁয়ো না,
যেঁথায় খুঁশি সেঁথায় যেঁয়ো,
শুঁধু অ্যাঁযোধ্যার ধাঁরে যেঁয়ো না।
গানটাই শোনা যেত, রামাইয়াকে দেখা যেত না, দেখা যেত ভটচাজ বাড়ি থেকে খাড়া পশ্চিম দিকে প্রায় শ পাঁচেক হাত দূরে শা পুকুরের পাড়ের উপর যে শ খানেক হাত উঁচু শিমুলগাছটা আছে সেই গাছটার মগডালটা বিনা বাতাসে একেবারে ভেঙে পড়বার মতো ঝাপটা খেল কিছুর। সেকালের লোকে এর মানে বুঝত। তারা বলত—রাম রাম রাম রাম। কেবল রামাইয়ের বউদি জানত, এ হল রামাই। মনের আনন্দে এখান থেকে একলাফে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে গাছটার উপর। গাছটা হল গ্রামটার মধ্যে ভূতেদের একটা পার্ক বা বেড়াবার, হাওয়া খাবার জায়গা!
বউদির সঙ্গে বনত রামাইয়ের কিন্তু বোনের সঙ্গে বনত না। বোন চণ্ডীদাসী বালবিধবা। ভূতকে সে অপবিত্র ভাবত—ঘেন্না করত, বলত—মহাপাপী ছিলি, ছোড়দা তুই। রাত্রে বিছানায় শুয়ে চণ্ডীদাসীর কথা বলবার অবকাশ হত। চণ্ডী থাকত মেঝেতে শুয়ে রামাই থাকত সাঙায়—অবশ্য তাকে দেখা যেত না।
রামাই ধমক দিত—চুঁ—প।
কেন? চুপ করব কেন? পাপ না করলে ভূত হলি কেন তুই?
সেঁ গঁলায় দঁড়ি দেঁওয়ার জন্যে।
তাই বা দিলি কেন?
নিঁশি ভূঁতে দেঁওয়ালে যেঁ?
তুই দিলি কেন?
বঁললে যে খুঁব মজা হঁবে।
মজা হবে! দেখছিস মজা?
দেঁখছি না? তুঁই দেঁখছিস না?
কী দেখব? দেখবার কী আছে?
তঁবে দেঁখ।
কী?
দেঁখ না ওঁপরের দিকে চেঁয়ে!
চণ্ডীদাসী দেখত—সাঙার ওপর থেকে থামের মতো একখানা পা আস্তে আস্তে নেমে আসছে তার বুক বরাবর। কিন্তু চণ্ডীদাসী ভয় পায় না, সে দিব্যি সেই থামের মতো পা—খানাকে বলে—নাম নাম—নাম দেখি! এই পা!
পা কিন্তু নামতে পারে না। থেমে যায়।
সাঙার ওপর থেকে কথা ভেসে আসত—ওঁরে চঁণ্ডী, ওঁরে মুঁণ্ডী, তোঁর মঁতো বঁদমাশ আঁমি দেঁখিনি। মঁনে মঁনে সেই দঁশরথ রাঁজার বেটার নাম কঁরছিস!
পা—খানাকে সে সজোরে দোলাতে থাকত। সে দোলায়মান পা—খানার এক লাথি খেলে চণ্ডীদাসী যে চেপটে যাবে এতে কোনো সন্দেহ থাকবার কথা নয়।
বউদি বলত—ও চণ্ডী, ক্ষমা চা ভাই। ও চণ্ডী!
কাকে বলেছে? চণ্ডী সেই কথা শুনবার মেয়ে! সে কী করত, এই মস্ত হাঁ করে দাঁত বেলে বিছানায় উঠে বসত এবং বলত কামড়াব তোর পায়ে।
আঁ—!
পা—খানা সড়াৎ করে গুটিয়ে যেত ফুটো হয়ে যাওয়া লম্বা বেলুনের মতো। চণ্ডীদাসী খিলখিল করে হাসত। তবে মধ্যে মধ্যে অতর্কিতে ছরছর শব্দে বালি ছিটিয়ে দিয়ে কিংবা কখনো পিঠের ওপর গুম করে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে অথবা চণ্ডীর মাথায় গোবরের তাল ফেলে দিয়ে তাকে জব্দ করত রামাই।
রামাই ভয় করত আর খাতির করত দাদাকে। দাদা যজমান বাড়ি থেকে ফিরত চাল কথা মিষ্টি মণ্ডা ফলমূল বেঁধে নিয়ে; পিছন পিছন রামাই পাহারা দিয়ে নিয়ে আসত বাড়ি। তবে দাদার সামনে কখনো যেত না। দাদা তাকে সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়াবার সময় বাখারি দিয়ে পিটত। এবং বরাবর পিছন থেকে হঠাৎ কান চেপে ধরত। ওই ভয়ে সামনে আসত না রামাই।
দাদা একলা মানুষ, চাষের সময় বলত—রামাই, মাঠের খোঁজ একটু রাখিস। একলা মানুষ। এবার টানের বছর, দেখিস যেন চুরি করে জল কেটে না নেয়।
রামাই সারারাত্রি জমির চারধারে ঘুরে বেড়াত। একবার চাষি সদগোপদের ভীমের মতো জোয়ান বহুবল্লভ, ভটচাজদের জমির জল চুরি করে কেটে নিতে এসে দেখেছিল—সেখানে একটা আচমকা তালগাছ দাঁড়িয়ে! আচমকা মানে অচেনা অর্থাৎ তালগাছ সেখানে ছিল না; আচমকা অচেনা তালগাছটাকে দেখে বহুবল্লভ থমকে দাঁড়িয়েছিল। এ তালগাছ এল কোত্থেকে?
তালগাছটাই উত্তর দিয়েছিল—আঁয় নেঁ, জঁল কাঁট!
বহুবল্লভ সাহসী এবং বলবান। সে বলেছিল—কে রে তুই?
আঁমি রাঁমাই!
এবার বহুবল্লভ চোঁচা দৌড় দিয়েছিল। রামাই তার বাড়ি পর্যন্ত ‘ধঁর ধঁর ধঁর’ বলে ছুটে এসেছিল পিছন পিছন।
লোকে বলে রামাই নয়। এটা ছিল ওর ওই দাদা নবকৃষ্ণের কাজ। রামাই ভূত হয়েছে এই কথা রটনা যখন হল তখন সে মধ্যে মধ্যে তেলকালি মেখে ভূত সেজে এইভাবে মাঠে নিজের জল রক্ষাও করত আবার পরের জল চুরি করেও নিত।
তা বলুক লোকে। সে লোকেরা নিন্দুক লোক। নাস্তিক লোক। ও কাজ রামাইয়ের! রামাই ছিল অসাধারণ ভূত। বাড়ির হিতৈষী ভূত। তার প্রমাণ আছে। রামাই একবার বউদি আর বোন চণ্ডীদাসীর অনুরোধে রাসের সময় কান্দীর রাজবাড়ি থেকে একঝুড়ি মালপো, একঝুড়ি মেঠাই, একঝুড়ি রাধাপ্রসন্ন—কৃষ্ণপ্রসন্ন মিষ্টি এনে খাইয়েছিল। ব্যাপারটা বলতে হয় নইলে পরিষ্কার হবে না। সে বছর রাসের দিন দুই ননদ ভাজে গল্প করছিল কান্দীর রাজবাড়ির রাসের খাওয়ার সমারোহের।
কান্দী রাজবাড়িতে রাধাবল্লভ ঠাকুরের নিত্যভোগেই এক অন্ন পঞ্চাশ ব্যঞ্জন একান্ন পদের ব্যবস্থা; সেই অবস্থার উপর বিশেষ ব্যবস্থা রাসযাত্রা পর্বে। দীয়তাম ভুজ্যতাম ব্যাপার। খেতে বসে পদের পর পদ খেতে খেতে লোকের পেট ভরে উঠে এমন চড়চড় করে যে হেউঢেউ শব্দে চারিদিক ভরে যায়। দু—দশজন ‘ত্রাহি, ত্রাহি, ত্রাহি মাম পুণ্ডরীকাক্ষ’ বলে গড়াগড়ি খায়।
বউটির বাপের বাড়ি কান্দীর কাছে, সে—ই গল্প করছিল। বলছিল—এমন মালপো, মনোহরা আর রাধাপ্রসন্ন—কৃষ্ণপ্রসন্ন মেঠাই আর কোথাও হয় না ভাই ঠাকুরঝি। প্রতি বার বাবা রাসের সময় কান্দীর রাজবাড়ি থেকে ছাঁদাতে নিয়ে আসত।
চণ্ডীদাসী বলেছিল—আমি ভাই কখনো খাইনি।
বউ বলেছিল—আমি খেয়েছি, আরও খেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কে খাওয়াবে বলো? তোমাকে কী বলব, মনে পড়ে নোলা সপসপ করছে।
ঘরে সাঙার ওপরে চালের নীচে এক টুকরো খোনা হাসি বেজে উঠেছিল—হিঁ—হিঁ—হিঁ!
চণ্ডী বলেছিল—এই! কী হাসছিস তুই ছোড়দা! ভারি তো ভূত হয়েছিস! শুধু ঝুঁটি ধরে টানতেই পারিস! কই খাওয়া না দেখি! মনোহরা, মালপো, ফেষ্টফসন্ন—টসন্ন না কী বলছে বউ সেই মিষ্টি।
কেষ্ট কি প্রসন্ন নাম করতে পেত না চণ্ডী; কেষ্টদাসী নাম ছিল চণ্ডীর শাশুড়ির আর প্রসন্নকুমার নাম ছিল স্বামীর! তাই বলেছিল ফেষ্টফসন্ন। যাক সে কথা। এখন যা হয়েছিল তাই বলি। ঘরের ভিতরে যেন একটা দমকা বাতাস উঠল এবং ঘরের দরজা দড়াম শব্দে ঠেলে খুলে বেরিয়ে গেল; হাওয়াটা পাকাতে পাকাতে নিমগাছটার গোড়ায় গিয়ে গাছটার কাণ্ডটাকে ঘিরে পাক দিয়ে ডালপালায় ঝড়ের মতন ঝটপটানি জাগিয়ে, একেবারে গোড়া থেকে সেই মগডালে উঠে সেখান থেকে মাথার ওপরে আকাশ কাঁপিয়ে (আজকালকার জেট প্লেনের মতো) একটা গোঙানি শব্দ তুলে ঝপাং শব্দে গিয়ে পড়ল শিমুলগাছের মগডালে—সেখান থেকে আর একটা শব্দ।
চণ্ডীদাসী বলেছিল—মরণ! রকম দেখ। ভূতের কি সবই বিটকেল, যাচ্ছে তারই বিটকেলেমি দেখ তো!
এই বিটকেলেমি তো যেমন তেমন। এরপর যে বিটকেলেমি করলে রামাই তা শুনেই আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। আধঘণ্টা হবে, তারপরই চালের ওপর সে যেন চার চারটে বীর হনুমানের সমান ওজন নিয়ে দমাস শব্দে লাফ খেয়ে পড়ল। পড়ল—তো পড়ল একেবারে আচমকা পড়ল। চণ্ডীদাসীদের গল্প তখন সদ্য শেষ হয়েছে। চুপ করেছে। এই শব্দে দুজনেই চমকে উঠে—বু—বু—বু—বু শব্দে কেঁদে উঠেছিল।
চালের ওপর তখন মচমচ শব্দ উঠতে শুরু করেছে। চাল যেন ভেঙে পড়বে। তারপরই তাদের চোখে পড়ল চাল থেকে ঠিক মধ্যি—উঠোনে এসে নামছে একটি গোদা পা, তা পা—খানা প্রায় নিমগাছের ডালের মতো বা তালগাছের মতো তো হবেই। তারপরই আর একটা পা, ক্রমে দুটো পায়ের ওপর গোটা একটা মূর্তি। মূর্তিটা একেবারে মিশকালো। তবে গায়ে অসংখ্য জোনাকি পোকা লেগে রয়েছে এবং শরীরের রেখায় রেখায় লেগে দিপদিপ করছে। পূর্ণিমার রাত্রি—জ্যোৎস্নায় সব ফটফট করছে—তারই মধ্যে জোনাকি পোকা—খচিত ওই অপূর্ব কালো মূর্তিটা উঠোনে দাঁড়াল; তার মাথার ওপর ঝুড়ির গন্ধমাদন—চার চারটে ঝুড়ি থাকবন্দি সাজানো। আর থেকে কী সুবাসই না উঠছে! আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য! মূর্তিটা ক্রমে খাটিয়ে গুটিয়ে মানুষের মতো হল এবং চারটে ঝুড়ি মাথায় বয়ে ঘরে এসে ঢুকে নামিয়ে দিলে—নেঁ—খাঁ। এঁকেবাঁরে টাঁটকা। উঁনোন থেঁকে নেঁমেছে আঁর তুঁলে এনেছি। খাঁ। বলেই চণ্ডীদাসীর ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়ে দুম শব্দে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে লাফ মেরে ঘরের সাঙার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে খোনা গলায় গান ধরে দিয়েছিল।
মাঁ গোঁ আঁমায় বাঁচিয়ে রাঁখো।
এই ভূঁতজন্মে মাঁ—জঁন্মে জঁন্মে চিঁ—র জঁন্ম বাঁচিয়ে রাঁখো।
ইঁন্দ্র—চঁন্দ্র দেঁবতা থেঁকে মাঁনুষ দেঁখলাম লাঁখো লাঁখো—
সব ফেলে মা ভূতভাবনের বুকেই তুমি দাঁড়িয়ে থাকো—
মা গো আমায় বাঁচিয়ে রাখো—এই ভূতজন্মে!
ভূতের কত সুখ বলো মা—দুখ নাইকো তিন সীমানায়
অমাবস্যার ভূতের নাচন—নাচছি দেখো মা আজকে রাস পূর্ণিমায়,
ধিতাং ধিতাং ধিতাং ধিতাং—নাচ—ছি দেখো পূর্ণিমায়।
সে গান সে দিন সকলে শুনেছিল এ গ্রামের। এমন খোনা মিষ্টি গলা আর কেউ কখনো শোনেনি। শুনেছিল আর দেখেছিল নিমগাছটার ডালে পাতায় জোনাকি পোকাগুলো ছুটে গিয়ে নিভে যাচ্ছে। তার মানে রামাই জোনাকি পোকাগুলো ধরে ধরে খাচ্ছিল।
চণ্ডীদাসী জিজ্ঞাসা করেছিল—ওগুলো খাচ্ছিস কেন? মা গোঃ!
রামাই বলেছিল—জোনাকি পোকা ভূতের জিভে ভারি মিষ্টি আর জোনাকি পোকা খেলে ভূতের রং ফরসা হয়।
চণ্ডীদাসী বলেছিল—তার চেয়ে জোনাকি পোকা দিয়ে গয়না করে পরিস সেই তো ভালো।
রামাই বলেছিল—তুই গলায় দড়ি দিয়ে মর পেতনি! আমি তোকে জোনাকি পোকার গয়না গড়িয়ে দেব।