রামশঙ্করের বাঁশি

রামশঙ্করের বাঁশি

ছটা হাতে গড়া আটার রুটি আর আলুর তরকারি অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দিল দুলারি। রামশঙ্কর দুলারির হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ারটা নিল। এবার ওকে বেরোতে হবে। আজ নাইট ডিউটি। সি শিফট। রাত দশটা থেকে ভোর ছ’টা। ঘরে সোলার আলোর জোর কমে এসেছে। আরেকটু পরেই হ্যারিকেন জ্বালাতে হবে। ওই কম আলোতেই রামের আঠেরো বছরের ছেলেটা জোর গলায় পড়াশোনা করছে। রাম আর দুলারির ওই একটিমাত্রই ছেলে। নাম শিবশঙ্কর। পড়াশোনায় খুব ভালো। এখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আজাদনগর হাইস্কুলে পড়ে। এইবছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে। প্রতিবছর এক থেকে দশের মধ্যে নাম থাকে। ছেলেকে নিয়ে বাপ-মা দুজনেরই যেমন গর্ব, তেমনই সারাক্ষণের চিন্তা। চিন্তা ওর শরীর নিয়ে। বড্ড রুগ্ন। কিছুদিন পর পরই জ্বরজারিতে ভোগে।

এখন জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। এই বছর ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই ঠান্ডা পড়ে গিয়েছিল, গত এক সপ্তাহ হল প্রচণ্ড ঠান্ডা বেড়েছে। সন্ধের পর থেকে বাইরে বেরোনো বেজায় কঠিন। শরীর জমে যায় পুরো। খাকি প্যান্ট, সোয়েটার, পায়ে বুট, গলায় মাফলার জড়ানোর পর মাঙ্কি ক্যাপটাও মাথায় ভালো করে এঁটে তারপর ঘরের এককোণে রাখা লাঠিটা হাতে নিল। কাঁধের ঝোলায় টিফিন ক্যারিয়ার, জলের বোতল আর টর্চ। রাম ছেলের দিকে একবার তাকাল। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।

আর পনেরো মিনিট রয়েছে বি শিফট শেষ হওয়ার। তারপর পড়বে। দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিল রাম। তারপর কোয়ার্টারের করিডর ধরে খটখট শব্দ তুলে হাঁটতে থাকল।

রামের কোয়ার্টার তিনতলায়। আজাদহিন্দ মোটরস লিমিটেডের ফ্যাক্টরির ফোর্থ ক্লাস স্টাফদের কোয়ার্টারগুলো সব তিনতলার। এখানে ফ্যাক্টরির চৌকিদার, মালী, সাফাইওলা ইত্যাদিদের কোয়ার্টার। ডি ব্লক। ব্লকের একদিকে হনুমানজিউর মন্দির আর অন্যদিকে বিশাল বড় ঝিল। ওই ঝিলের এমাথা থেকে ওমাথা দেখা যায় না।

বুটের খটখট শব্দ তুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল রাম। দেখতে পেল প্রমোদ সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছে। সাইকেলটা নিজের গায়ে হেলান দিয়ে খৈনির দলায় থপ থপ করে দুবার থাপ্পড় মারল প্রমোদ। তারপর খৈনির দলাটা নিচের ঠোঁটের ফাঁকে পুরে দিল। প্রমোদেরও একই পোশাক। ওর সাইকেলের কেরিয়ারে উঠে বসল রাম। প্রমোদ সাইকেলে চেপে প্যাডেলে চাপ দিল।

প্রমোদের কোয়ার্টার রামশঙ্করের ঠিক মুখোমুখি। ওর দুই মেয়ে। বড়টা ক্লাস ইলেভেন আর ছোটটা সেভেনে পড়ে।

সাইকেল চালাচ্ছিল প্রমোদ। কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলছিল না। এইখানে অনেকদিন ধরেই কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। এমনকী নিজের পরিবারের সঙ্গেও নয়। নেহাত প্রয়োজনটুকু ছাড়া সকলেই আশ্চর্য রকমে চুপ। এখানকার মানুষগুলো শুধু দেখে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখে।

পুরো তিনশো চোদ্দ একর জমিতে বিশাল মোটরগাড়ি তৈরির কারখানা এই আজাদহিন্দ মোটরস। মোট চব্বিশ হাজার শ্রমিক কাজ করে। গোটা ভারতবর্ষের নানা ভাষার মানুষের বসবাস, রুজি রোজগারের জায়গা এই মোটরগাড়ি কারখানা। আজাদহিন্দ মোটরসকে শুধু কারখানা বলা ভুল হবে, এটা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ টাউনশিপও। স্কুল, হাসপাতাল, মার্কেট, পার্ক, ব্যাঙ্ক, মন্দির সবই রয়েছে এখানে।

সাইকেল চালাতে চালাতে ইউবিআই ব্যাঙ্কের ফ্যাক্টরি ব্রাঞ্চের দিকে তাকাল প্রমোদ। ব্যাঙ্কের সামনে কতগুলো চোখ জ্বলজ্বল করছে। তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। প্রমোদ বা রামশঙ্কর কেউই ওই জ্বলজ্বলে চোখগুলোকে দেখে সামান্যতম বিচলিত হল না। গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। প্রথমদিকে একটু ভয় ভয় করত…তারপর আর কিছুই হয় না। ভয়ও না।

আজ থেকে সাতাশ বছর আগে রামশঙ্করের মামা উমেশ তিওয়ারি বলেছিল, রাম একটা কথা মনে রেখো, চৌকিদারি করতে গেলে সবার আগে ভয়কে জয় করতে হবে। একজন চৌকিদারের কাজ হল ফৌজির কাজ। ফৌজি যেমন নিজের দেশকে পাহারা দেয়, তোমাকে মনে করতে হবে এই ফ্যাক্টরি তোমার দেশ। এর সুরক্ষার দায়িত্ব তোমার। এই লাঠি, বাঁশি আর টর্চ হল তোমার অস্ত্র। কোনও কিছুকেই ভয় পাবে না। সারা রাত একা একা ডিউটি করতে হবে, অনেক সময় ঝিলপাড়েও ডিউটি পড়বে, ওদিকে শিয়াল আছে, ভাম আছে। ওদিকে ডিউটিই সবথেকে কঠিন, কারণ ঝিলের ওইদিকটায় মস্ত জঙ্গল, জঙ্গল পার করে ঝিল শুরু। অনেকসময়ই ফ্যাক্টরির কাঁচামাল ওই পথে পাচার হয়ে যায়। তাই ওখানে যাদের ডিউটি পড়ে তাদের সঙ্গে চোররা রফায় যেতে চায়। উমেশ বলেছিল, বাবা রাম, ষাট সাল থেকে এই ফ্যাক্টরি আমার পরিবারের পেট পালছে। এই ফ্যাক্টরই আমার ভগবান। রামজীর দিব্বি, এই বত্রিশ সালের নৌকরিতে অনেক লোভ, অনেক অফার পেয়েছি। এই জনুই ছুঁয়ে বলছি একদিনের জন্যও গলদ কাজ করিনি। নিজের পৈতে ছুঁয়ে বেশ আবেগ নিয়ে কথাগুলো বলেছিল উমেশ।

তখন রামশঙ্কর মাত্র বাইশ বছর। মামার চিঠি পেয়ে ইউপি-র বলরামপুর গ্রাম থেকে চলে এসেছিল কাজ পাওয়ার আশায়। মামার আর তখন এক বছরের চাকরি বাকি। ইচ্ছে ছিল ভাগ্নেটার হিল্লে করে দেওয়ার। তাই চিঠি লেখা। চিঠি পেয়ে এখানে এসে অবাক হয়ে গিয়েছিল রাম। এত বড় মোটর কারখানা! এত সুন্দর ছবির মতো করে সাজানো! কত মানুষ! কিছুদিন মামার কোয়ার্টারে থাকতে থাকতে চারদিক দেখতে দেখতে উড়নচণ্ডী রামেরও ইচ্ছে জেগে গেল এখানে কাজ করার।

এই কারখানায় সামান্য বলা কওয়া করে একটা চাকরি জোটানো এমনকিছু কঠিন ছিল না। হয়ে গেল চাকরি। তারপর কতকিছু ঘটে গেল বছরগুলোতে। মামা রিটায়ার করার পর এই কোয়ার্টার পেল রাম। দুলারির সঙ্গে বিয়ে, শিবের জন্ম। কতগুলো বছর যে পেরিয়ে গেল সুখ, দুঃখে।

বিয়ের পরে ছুটির বিকেলগুলোতে রাম দুলারিকে সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে ঘুরতে বেরতো। কারখানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাত। এই দেখো এটা বডিশপ, এটা পেইন্টশপ…এটা অ্যাসিমিলেশন…এটা কোয়ালিটি কনট্রোল… দুলারি হাঁ করে তাকিয়ে দেখত এত মোটরগাড়ি! কী সুন্দর দেখতে! মাঝেমাঝে চাপতেও ইচ্ছে হতো। রাম বুকের ছাতি বেয়াল্লিশ বানিয়ে বলত, জানিস আমাদের ফ্যাক্টরি থেকে ডেইলি দেড়শো পিস গাড়ি বেরোয়। এই গাড়িতেই দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রাইমমিনিস্টার থেকে সবাই চাপে হুঁ হুঁ…এমনভাবে কথাগুলো বলত রাম যেন ফ্যাক্টরিটা ও পৈতৃকসূত্রে পেয়েছে।

দুলারির সবথেকে মজা লাগত টেস্টিং রোডে ঘুরতে যেতে। ডিমের মতো লম্বাটে গোল একটা রাস্তা। এবরোখেবরো কালো পাথর বিছানো। রাস্তাটার বিশেষত্ব হল—কিছুটা সোজা যাওয়ার পর রাস্তাটা পুরো পয়তাল্লিশ ডিগ্রি হেলানো। বিয়ের ঠিক মাস খানেক পর এক বিকেলে রামের সাইকেল চেপে ঘুরতে বেড়িয়ে দুলারি প্রথম এই অদ্ভুত রোডটা দেখেছিল। রাম বলেছিল, নতুন তৈরি গাড়িগুলো তৈরি হওয়ার পর এই রাস্তায় টেস্ট ড্রাইভ হয় তাই এর নাম টেস্টিং রোড। দুলারি রামের হাত চেপে ধরে দেখেছিল কী স্পিডে ধপধপে সাদা, ট্যাক্সিরঙের হলুদ, কালো, মেরুন গাড়িগুলো হুশ হুশ করে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তাটার দুইধারে সারসার ঝাউগাছ। রাম একবার দুলারিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কী রে, যাবি এই রাস্তায়?

আমাদের গাড়ি কোথায়?

এটাই আমাদের গাড়ি, বলে নিজের সাইকেলের সিটে আলতো একটা থাপ্পড় দিয়ে রাম বলেছিল চেপে বোস, আজ তোকে ঘোরাব।

না না, পড়ে যাব যে। এমন ঢালু রস্তা, তার ওপর এমন পাথর বসানো। পড়লে একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না।

আরে দুলারি, রামশংকর দুবে রামজীর কৃপায় কোনওদিন সাইকেল থেকে পড়েনি। আজও পড়বে না। তুই শুধু আমাকে শক্ত করে ধরে থাকিস।

মানুষটাকে ভরসা করে সত্যিই কেরিয়ারে টপ করে উঠে বসেছিল রোগা পাতলা দুলারি। তারপর দুইহাতে শক্ত বেড় দিয়ে জাপটে ধরেছিল তার রামকে। রামও মনে মনে রামজী আর হনুমানজীর কাছে নিজের মান ইজ্জত রাখার প্রার্থনা করে পাঁই পাঁই চালিয়েছিল সাইকেল। ঢালু রাস্তা তার ওপর চূড়ান্ত অমসৃণ। স্পিড একটু স্লো হলেই বা হাত একটু কেঁপে গেলেই সাইকেল সমেত পুরো ঢাল বেয়ে নীচে। শক্ত পাথরে আছড়ে পড়লে জখম হওয়ার পুরো সম্ভাবনা। কিন্তু নতুন নতুন বৌয়ের কাছে হিরোগিরি দেখানোর সুযোগটা ছাড়তে চায়নি রাম। তাই দাঁতে দাঁত চেপে ওই ভয়ঙ্কর রাস্তা দিয়েই প্রাণপণে প্যাডেল চালিয়েছিল। একসময় ঢালু রাস্তা আবার সমতল হয়ে আসার পর সাইকেল থামতেই এক লাফে কেরিয়ার থেকে নেমে পড়েছিল দুলারি। উরিবাবারে আমার কোমর পুরো ভেঙে গিয়েছে!

তারপর দুজনেরই প্রাণখোলা হাসি। টেস্টিং রোডের দুপ্রান্তেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি। পুরোটাই ফ্যাক্টরির অন্তর্গত। ওই জলাভূমিতে পানিফলের চাষ। সাইকেল স্ট্যান্ড করে রাম সরসর করে নেমে গিয়েছিল নিচে। ওখানে যারা পানিফল তুলছিল সেই চাষিদের কাছ থেকে এক আঁজলা পানিফল নিয়ে এসে দুজনে বসে শেষ বিকেলে পানিফল ছাড়িয়ে খেয়েছিল। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে লাল। রাম দিগন্তের দিকে হাত তুলে বলেছিল, এই যতদূর দেখছিস, তার থেকেও অনেক দূর পর্যন্ত আমাদের জমি। আমাদের ফ্যাক্টরি আরও বাড়বে। শুনেছি এয়ারপোর্ট হবে। প্লেনে করে মাল আসবে।

সত্যি! অবাক হয়েছিল দুলারি।

হুঁ। কোনওদিন কাছ থেকে এরোপ্লেন দেখেছিস?

না, তুমি?

আমিও না। এয়ারপোর্টটা হোক, তারপর দুইজনে একসঙ্গে দেখতে যাব।

এমন কতশত সুখের মুহূর্ত কাটাতে কাটাতে কবে যেন রাম আর দুলারির বেশ অনেকটা বয়স বেড়ে গেল, কিন্তু টেস্টিং রোড, জলাভুমি, সকলেই থেকে গেল একইরকম।

ফ্যাক্টরির একনম্বর গেটের সামনে সাইকেল থামাল প্রমোদ। নেমে পড়ল রাম। মেন গেটের সামনে একটা গুমটি ঘর। সিউকিউরিটি গার্ডদের জন্য। প্রমোদ যেমন চুপচাপ এসেছিল, তেমনই নিঃশব্দে চলে গেল। ওর ডিউটি তিন নম্বর গেটে।

রাম ধীর পায়ে গার্ডরুমে ঢুকল। ওখানে একটা টুল রাখা। কাঁধের ঝোলাটা ভেতরে রেখে টুলটা বাইরে নিয়ে এল রাম।

ফ্যাক্টরির চারপ্রান্তে চারজন সিকিউরিটি গার্ড। প্রতি শিফটে রামের মতো চারজন মিলিয়ে মোট বারোজন গার্ড রয়েছে। সকলেই ডি ব্লকের কোয়ারটারে থাকে। সবার যে পরিবার থাকে তা নয়। বারোজন সিকিউরিটি গার্ডের সাতজন থাকে পরিবার নিয়ে। বাকিরা একা।

আকাশের দিকে তাকাল রাম। কুচকুচে কালো আকাশে ভর্তি তারা। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এক নম্বর গেটের ঠিক পিছনেই বিশাল একটা জঙ্গল। ফ্যাক্টরির মধ্যে এটাই সবথেকে বড় জঙ্গল। কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা জঙ্গলে শুধুমাত্র মালীদের ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। শাল, সেগুন ইত্যাদি তো রয়েছেই বেশ কিছু ফলের গাছও রয়েছে। আজ ঠান্ডা হাওয়াতে একেবারে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। রাম গুমটির ভেতর আবার ঢুকে সেখানে জড়ো করা কিছু শুকনো কাঠকুটো নিয়ে এসে জড়ো করল টুলের পাশে। তারপর জঙ্গলটার দিকে তাকাল।

রোজের মতো আজও অজস্র চোখ জোনাকির মতো জ্বলছে জঙ্গলের মধ্যে। প্রথমদিকে এই চোখগুলো দেখলে ভয়ে শিঁটিয়ে যেত রামশঙ্কর। তারপর ধীরে ধীরে সয়ে গিয়েছে। ও বুঝতে পেরেছে যে ভয়ের দৃষ্টিতে ওই চোখগুলোর দিকে ও তাকায় ওই চোখগুলও তেমনই অবাক হয়ে দেখে ওকে। শুকনো কাঠের টুকরোগুলোর নিচে লাইটার জ্বালিয়ে ধরল। জ্বলে উঠল আগুন। এক নম্বর গেটে ঝোলানো শিকল প্যাঁচানো তালা। এই গেট থেকে বেরিয়ে সামান্য পথ গেলেই আজাদহিন্দ মোটরস রেলস্টেশন। রেলস্টেশন থেকে একটি সিঙ্গল লাইন একনম্বর গেটের গা দিয়ে সোজা ঢুকে গিয়েছে ফ্যাক্টরির ভেতর। রেকে করে কাঁচামাল সরাসরি ঢোকার জন্য এই ব্যাবস্থা। আগুনের আলোতে ওই লাইনদুটোর কিছু অংশ ঝিকমিক করে উঠল।

আগুনের পাশে টুলের ওপর বসল রামশঙ্কর। তারপর পকেট থেকে ওর পুরনো পিতলের হুইসেলটা বার করে প্রাণপণে তিনবার ফুঁ দিল। রাতের নৈঃশব্দ খানখান করে চারিদিকে ছড়িয়ে গেল সেই শব্দ। বাঁশিটা মুঠোয় ধরে ফ্যাক্টরির রাস্তায় তাকাল রামশঙ্কর। চকচকে কালো পিচের রাস্তা মসৃণ। দুধারে সারসার স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। ফ্যাকটরি শেড থেকে মেশিন চলার শব্দ হচ্ছে। প্রাণভরে শ্বাস নিল রামশঙ্কর।

এক এক শিফটে প্রায় আট হাজার ওয়ার্কার কাজ করে। মোটা স্যালারি, বোনাস, ইনসেন্টিভ। এই কোম্পানিতে একবার যে ঢোকে, রিটায়ারমেন্টের আগে কেউ ছাড়ে না। প্রকাণ্ড ফ্যাকটরি শেডের ভেতরে যখন মেশিনগুলো চলে তখন এক অদ্ভুত গমগম শব্দ শোনা যায় বাইরে থেকে। এই শব্দে অদ্ভুত এক নেশা রয়েছে। মনে হয় যেন অনেক মুণিঋষিরা মিলে মহাযজ্ঞে বসেছেন। কত রকমের কাজ, কত মানুষের ব্যস্ততা।

ওইশব্দগুলো শুনতে শুনতে আয়েশ করে টুলে বসল রাম। আরপর একটা বিড়ি ধরাল। কয়েকটা টান দিয়ে বিড়িটা ফেলে দিয়ে আবার উঠল। এবার এক চক্কর টহলে বেরোতে হবে। হাতের লাঠিটা মাটিতে দুই-তিনবার ঠুকে আবার পিইই করে হুইসেল দিল, তারপর হাঁটতে শুরু করল। চারগেটের চারজন গার্ডও নিশ্চয়ই এতক্ষণে টহলদারি শুরু করেছে। ফ্যাকটরি কম্পাউন্ডে এত আলো, যে টর্চ জ্বালাতে হয় না।

এইমাত্র বি শিফট শেষ হল। পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে হাজার হাজার ওয়ার্কার। তাদের সমবেত হাঁটার শব্দে, কোলাহলে এই রাত যেন এক মুহূর্তে দিন হয়ে গেল। এই ফ্যাক্টরির আশেপাশে যে বিস্তীর্ন জনবসতি রয়েছে সেখানের অধিকাংশ মানুষই তাদের বসবাস শুরু করেছিল এই ফ্যাক্টরিতে চাকরির সূত্রে।

মামা বলেছিল, সিকিউরিটি গার্ডের কাজ কিন্তু খুব কঠিন। নিজের মায়ের মতো, জরুর মতো, ভাইয়ের মতো ভালোবাসতে হবে কারখানাকে—তাকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখবি, এই বিশাল সাম্রাজ্য রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু তোরই।

কথাগুলো কতকাল আগের, এখনও মাঝেমাঝে মনের মধ্যে বাজে। আর এতগুলো বছর হয়ে গেল, কেউ বলতে পারবে না রামশঙ্কর দুবে তার ডিউটিতে কোনওদিন গাফিলতি করেছে। এই তিনশো চোদ্দ একর জমিই তার পৃথিবী। এই ফ্যাক্টরির হাসপাতালেই ছেলের জন্ম হয়েছে। এখানের স্কুলেই ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ছেলে পড়াশোনা করেছে। ছুটির দিনে দুলারি আর শিবকে সাইকেলে বসিয়ে এই চত্বরেই ঘুরত। কখনো ফ্যাক্টরির মধ্যে বিশাল লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দিরে, কখনও পার্কে। কখনও কারও নিমন্ত্রণে। ফ্যাক্টরি লাগোয়া একটা সিনেমা হল ছিল—দীপক। ওখানেও অনেক সিনেমা দেখেছে রাম। হলটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে এই বছর পাঁচেক আগে।

হোলি খেলা, তারপর জন্মাষ্টমীতে বিশাল মেলা, বিশ্বকর্মাপুজোর আনন্দ…এর বাইরেও যে একটা পৃথিবী রয়েছে কবেই ভুলে গিয়েছে রামশঙ্কর। কবে যেন বিশ্বাস করে ফেলেছিল পুরো দুনিয়া জুড়েই শুধু আজাদহিন্দ মোটরস। এত সুখ আর কোথাও নেই।

লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে হাঁটছিল রামশঙ্কর। রাস্তার ধারে প্রায় পঞ্চাশটা সদ্য তৈরি হলুদ ট্যাক্সি দাঁড় করানো। স্ট্রিট লাইটে তাদের শরীর চকচক করছে। কোনওটার নাম্বার প্লেট বসানো নেই। এগুলো হয়তো কাল কিংবা পরশু সকালেই ট্রেলারে চেপে চলে যাবে। এক একটা ট্রেলারে বারো-চোদ্দটা গাড়ি অনায়াসে উঠে যায়। গাড়িগুলোর পাস দিয়ে যেতে যেতে মেন শেডের সামনে একবার থামল রাম। বডিশপের বিশাল উঁচু টিনের শেড। ছাদটা অনেকগুলো ত্রিভূজের সমাহার। ফ্যাক্টরি যেমন হয় আর কি। ভেতর থেকে মেশিন চলার গমগমে শব্দ হচ্ছে। চিমনি দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

এনভয়…এনভয় ফিসফিস করে নামটা উচ্চারণ করল রাম। আজাদহিন্দ মোটরসের মোটরগাড়ির ব্র্যান্ডের নাম এটাই। গোটা দেশ এক নামে চেনে এই গাড়িকে।

মামার কাছে অনেকদিন আগে এইসব গল্প শুনেছে রাম। ভারত যেই বছর স্বাধীনতা পেল তারও চার বছর আগে এই দক্ষিণপাড়া আর কাননগর এই দুই রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী বিশাল জমিতে ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল কারখানার। দশ বছরের মধ্যেই দেশের মধ্যে একনম্বর মোটরগাড়ি।

রাম এই সাতাশ বছরের কর্মজীবনে বেশ কয়েকবার এনভয়ে চেপেছে। যারা টেস্টড্রাইভিং করে সেই ড্রাইভারদের মধ্যে অনেকেই রামের বন্ধু। তাদেরকেই বলে কয়ে কয়েকবার চেপেছিল। দুলারি আর শিবকেও চাপিয়েছিল। আহা, গাড়ি নয় তো যেন পক্ষীরাজ!

আবার সামনে কতগুলো জ্বলজ্বলে চোখ। রামকে দেখছে। হাতের লাঠিটা পিচের রাস্তায় জোরে দুবার ঠুকতেই চোখগুলো সরে দাঁড়াল। রাম হাঁটতে থাকল। এদিকটায় অফিসার-ম্যানেজারদের বাংলো। ফুলের বাগান থেকে সুইমিংপুল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট খেলার গ্রাউন্ড সবই রয়েছে। প্রতিটা বাংলোই একতলা। সামনে অনেকটা করে সবুজ ঘাসজমি।

হাঁটতে হাঁটতে, দেখতে দেখতে রোজের মতো আজও ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল রামশঙ্কর। আচমকাই কানে এসে বাজল মাইকের শব্দ, কেউ একটা প্রাণপণে চিৎকার করছে—বন্ধুগণ, ম্যনেজমেন্টের এই অন্যায় সিদ্ধান্তকে আমরা মানছি না, মানব না, এইভাবে আমাদের বকেয়া আটকে রেখে…শ্রমিকদের জোর করে ভি আর এস…

আআআহহ…দুইকান চেপে ধরল রামশঙ্কর। তবু হাতের তালু ফুটো করে গলন্ত সিসে যেন ভরে দিতে থাকল তার কানে…ম্যানেজমেন্টের এই সিদ্ধান্তকে আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। এ আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন…ম্যানেজমেন্ট কেন আগে ভাবেনি? আমরা বারবার সতর্ক করার পরেও কেন এনভয়ের মডেল আরও আধুনিক করেনি…

রাম আর সহ্য করতে পারল না…ওই আবার আবার, শব্দগুলো ওকে ধরবার জন্য ছুটে আসছে। রাম দৌড়তে শুরু করল। চারবছর আগে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরির ভেতরের ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে রাম ছুটতে থাকল। তিনশো একর জায়গা জুড়ে এই প্রকাণ্ড প্রেতপুরীতে শুধু তীব্র অন্ধকার, কান ফাটানো নৈঃশব্দ, ঘন জঙ্গল, জ্বলজ্বলে চোখওলা অসংখ্য শিয়ালের দলকে পেরিয়ে রাম দৌড়াতে থাকল। গত দেড় বছর আগে ফ্যাক্টরির ইলেক্ট্রিক লাইন, জলের সংযোগটুকুও কেটে দেওয়ার পরেও রামের মতো কয়েকটি পরিবার এখনও পড়ে রয়েছে এই শ্মশান- ভূমিতে। দক্ষিণপাড়া মিউনিসিপ্যালিটি থেকে সকালে একবার জলের গাড়ি আসে তখনই প্রয়োজনীয় জলটুকু নিয়ে নেয় বারোটি পরিবার। আলো বলতে ব্যক্তিগত সোলারই ভরসা। সন্ধের পর ঘণ্টা দুয়েক জ্বলে তারপর হয় ঘরভর্তি অন্ধকার, নয়তো কেরাসিনের হ্যারিকেন। পরিত্যক্ত অফিসার্স বাংলোগুলো আগাছায় ভর্তি, স্টাফকোয়ার্টারগুলো পরিচর্যার অভাবে প্রায় ভগ্নদশা। কতদিন হয়ে গেল এই পরিবারগুলো পাশাপাশি থাকে কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। যেন বোবায় ধরে কথা বলতেই ভুলে গিয়েছে। পরিবারের নিজেদের মধ্যেও সামান্যতম প্রয়োজনের কথাটুকু ছাড়া আর কেউ কথা বলতে যেন ভয় পায়। কেউ কারও খোঁজটুকুও নেয় না। শুধু ওই শিয়ালের মতো জুলজুলে চোখে একে অপরের দিকে তাকায়। কিছু একটা বোঝার, জানার চেষ্টা করে।

প্রায় আঠাশ হাজার মানুষের কলরবে যে ভূমি বছরের পর বছর ভরে থাকত সেখানে এখন শুধু জঙ্গলে ভরে যাওয়া কারখানা শেড, ভেঙে পড়া বিল্ডিং, মরচে পড়ে যাওয়া ভাঙা যন্ত্রাংশ, বিগ্রহহীন শূন্য মন্দির। দিনের বেলাতেও এই মহাশ্মশানে চলতে গা ছমছম করে। কেউ নেই…আর কিছু নেই। শুধু এই শশ্মানকে আগলে রাখার জন্য বারোটি পরিবার এখনও নিয়ম করে তিনবেলা ডিউটি দিয়ে চলে, ঠিকাদারের কাছ থেকে সামান্য কিছু মাইনা পায়। কেন যায়নি, কেন এই শীতের রাতে, এত অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে এরা এই প্রেতপুরীতে পড়ে রয়েছে তা নিজেরাও জানে না। মানুষ নয়, শুধু শিয়ালের পাল দিনে রাতে ঘোরে এখানে।

রাম এই জনশূন্য, নিস্তব্ধ, থেমে যাওয়া সাম্রাজ্যের, ইতিহাসের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় বুটের খটখট শব্দ তুলে পালাচ্ছিল আর মাইক থেকে বমির মতো বেরিয়ে আসা শব্দগুলো ওকে পাগলা কুকুরের মতো তাড়া করে চলেছিল। ‘তাই বন্ধুগন, ম্যানেজমেন্ট যে অন্যায়ভাবে জোর করে শ্রমিকদের ভি আর এস দিয়ে, লক-আউটের নোটিশ দিয়েছে…’

আআআহহ…বেদম হয়ে ছুটতে ছুটতে হাতের মুঠোয় ধরা বহুকালের পিতলের হুইসেলটা আবার মুখের সামনে নিয়ে এল রাম। ও জানে, একবার মাত্র পিইই করে হুইসেল দিলেই রোজের মতো আবার জ্বলে উঠবে সব আলো, কারখানা শেডের ভেতর থেকে মেশিন চলার গমগম শব্দ উঠবে। কারখানার চিমনি আর দুলারির চুলা থেকে গরম রুটির ঘ্রাণ মাত করে দেবে পুরো দুনিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *