বরদাচরণ ও টিকটিকি
চোরে ও পুলিশে
ভূত ও গা-ছমছমানি
গায়ে ও গত্তিতে
হাসি ও মজা
কল্পনা ও বিজ্ঞান
1 of 2

রামবাবু এবং কানাই কুণ্ডু

রামবাবু এবং কানাই কুণ্ডু

রামবাবুর খুব সর্দি হয়েছিল। বন্ধু শ্যাম কবিরাজ তাঁকে এক পুরিয়া কবরেজি নস্যি দিয়ে বললেন, শোওয়ার আগে এক টিপ টেনে শুয়ে পোড়ো।

তাই করলেন রামবাবু। ঘুম ভেঙে উঠে সকালে বেশ ঝরঝরে লাগল শরীরটা।

সকালবেলা দাড়ি কামাতে গিয়ে রামবাবু আয়নায় আবিষ্কার করলেন যে, তার বাঁ গালে একটা কালো এবং বড় জড়ুল দেখা দিয়েছে। প্রথমটায় ভেবেছিলেন কালির দাগ। আঙুল দিয়ে ঘষে দেখলেন, তা নয়, জডুলই। তবে আচমকা গালে একটা জড়ল দেখে রামবাবুর যতটা বিরক্ত বা বিস্মিত হওয়া উচিত ছিল ততটা হলেন না। কারণ, জড়লটা তার ফর্সা গালে মানিয়েছে ভাল।

ফর্সা! রামবাবু দাড়ি কামাতে কামাতে আবার একবার থমকালেন, ফর্সা? তিনি তো কস্মিনকালেও ফর্সা নন। বেশ কালোই তার গায়ের রঙ। তাহলে এরকম ধপধপে ফর্সাই বা তাকে লাগছে কেন এখন? রামবাবু জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ফুটফুটে আলোয় হাত-আয়না দিয়ে মুখখানা দেখলেন। নাঃ, দারুণ ফর্সাই তো তিনি! লোকে যে এতকাল কেন তাকে কালো বলে বদনাম দিয়ে এসেছে!

যাকগে, রামবাবু আজ বেশ খোশমেজাজেই দাড়ি কামিয়ে চান সেরে নিলেন। মাথা জোড়া টাক বলে রামবাবুকে চুল আঁচড়ানোর বিশেষ ঝক্কি পোয়াতে হয় না। ঘাড় আর জুলপি আঁচড়ে নিলেই চলে।

কিন্তু আজ রামবাবু চুল সামলাতে একেবারে হিমসিম খেয়ে গেলেন। মাথা ভর্তি কালো কুচকুচে এবং ঢেউ খেলানো চুল যে কোথা থেকে এল তা রামবাবু হদিস করতে পারলেন না। কিন্তু অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাপার নিয়ে ভাববার মতো ফুরসৎ হাতে নেই।

বাথরুম থেকে বেরিয়েই রামবাবু একটা হাঁক মারলেন, গিন্নি, খেতে দাও। তারপর চটপট পোশাক পরে ফেললেন।

তার গিন্নি বেশ মোটাসোটা, একটু থপথপে, গম্ভীর প্রকৃতির। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি রামবাবুর দিকে তার গম্ভীর চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, আপনি বাইরের ঘরে গিয়ে বসুন। উনি বাথরুমে গেছেন।

এটা কিরকম রসিকতা তা রামবাবু বুঝে উঠতে পারলেন না। তার গিন্নি খুব রসিক প্রকৃতির মানুষও নন।

রামবাবুকে খুব একটা বোকা বলা যায় না। তিনি একটু ভাবলেন এবং ফের বড় আয়নায় ভাল করে নিজেকে দেখলেন। বছর পঁচিশেক বয়সের বেশ কার্তিক ঠাকুরের মতো চেহারাবিশিষ্ট এই লোকটা যে তিনি নন তা টের পেতে আর এক লহমাও দেরি হল না তার।

প্রথমটায় একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও শেষ অবধি খুশিই হলেন রামবাবু। টাকওলা, কালো এবং নাদুসনুদুস চেহারার যে মানুষটা তিনি ছিলেন তাকে তার বিশেষ পছন্দ ছিল না।

রামবাবু এটাও বুঝলেন যে, এ বাড়িতে আর অবস্থান করা ঠিক হবে না। তিনি আর যেই হোন রামবাবু নন।

সুতরাং রামবাবু সদর খুলে গটগট করে বেরিয়ে পড়লেন।

সমস্যা হল তিনি যে রামবাবু নন এটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। কিন্তু তাহলে তিনি কে? এই নতুন চেহারার লোকটার তো একটা কোনও পরিচয় আছে? গোবর্ধন, রাজবল্লভ, বগলাপতি বা যাই হোক একটা নাম এবং পাল, সিংহ, ভট্টাচার্য যা হোক একটা পদবি তো তার থাকা উচিত।

বড় রাস্তায় পড়ার আগে দেখলেন গলির মোড়ে রকে-বসে ছেলেরা আড্ডা মারছে। তারই ছেলের বন্ধুরা সব।

রামবাবু যখন তাদের পেরিয়ে যাচ্ছেন তখন হঠাৎ তারা কথাবার্তা বন্ধ করে তার দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ ফিসফাস করতে শুরু করল, ওরে, ওই দ্যাখ কানাই কুণ্ডু যাচ্ছে।

কানাই কুণ্ডু! রামবাবু একটু চমকালেন, কানাই কুণ্ডু মানে কি? মোহনবাগানের সেই বিখ্যাত খেলোয়াড়টি নাকি? না, তার খেলা রামবাবু কখনো দেখেননি তবে নামটা প্রায়ই শোনেন। দারুণ নাকি ভাল খেলে। রোজই একটা দুটো করে গোল দেয় বিপক্ষ দলকে। তাহলে তিনিই কানাই কুণ্ডু?

রকের ছেলেরা হঠাৎ দৌড়ে এসে তাঁকে প্রায় ঘিরে ফেলল। এই যে কানাইদা; এখানে কোথায় এসেছিলেন? কানাইদা, আপনি তো বাগবাজারে থাকেন। আপনার ঠিকানাও জানি। ওয়ান বাই সি, বাগবাজার লেন।

কানাইদা, আজ ইস্টবেঙ্গলকে ক গোল দিচ্ছেন? একটা অটোগ্রাফ দেবেন কানাইদা? রামবাবু খুব উঁচু দরের হাসি হেসে সবাইকার সঙ্গেই একটু-আধটু কথা বললেন। এই ফাঁকে নিজের একটু পাবলিসিটিও করে নিলেন। বললেন, এই পাড়ায় রামবাবুর কাছে এসেছিলাম। উনি আমার দাদার মতো।

একটা ছেলে বলে উঠল, ধুস, রামবাবু তো কুমড়োপটাশ তার ওপর হাড়-কেন। একটু ছিটও আছে মাথায়।

রামবাবু আমতা আমতা করে বললেন, তোমরা ওঁকে ঠিক চেনো না। ওরকম সদাশিব লোক হয় না।

যাই হোক, রামবাবু ছেলেগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় ট্যাক্সি ধরলেন।

কোথায় যাবেন তা সঠিক জানেন না। ওয়ান বাই সি বাগবাজার লেন-এ কানাই কুণ্ডুর বাড়িতে হাজির হতে তার ঠিক সাহস হল না। সেখানে আবার কী গুবলেট হয়ে আছে কে জানে!

তবে তিনি এটা জেনে নিয়েছেন যে, ময়দানে আজ মোহনবাগানের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ আছে। কাজেই ট্যাক্সিটা তিনি ময়দানের কাছে এনে ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়লেন।

আর নেমেই পড়ে গেলেন বিপাকে। কোত্থেকে পিলপিল করে একগাদা লোক ছুটে এসে তাকে ঘিরে ফেলল।

এই কানাই, খুব ল্যাং মেরে খেলা শিখেছো! অ্যাঁ, সেদিন যে বড় আমাদের হাফ ব্যাকটাকে জখম করেছিলে! আজ তোমার ঠ্যাং খুলে নেবো।

কানাইয়ের খুব তেল হয়েছে রে কালু। আয় আজ ওর তেল একটু নিংড়ে নেওয়া যাক।

এই যে কানাইবাবু, বল না প্লেয়ার কাকে লাথি মারতে আপনার বেশি ভাল লাগে বলুন তো! চোখে ভাল দেখতে পান তো!

ওহে কানাই মস্তান, আজ ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করলে কিন্তু কলজে খেচে নেবো, বুঝলে।

এই সময়ে কিছু লোক দৌড়ে এসে রামবাবুকে ধরে বলল, এই যে কানাই, আজ এত বড় খেলা, আর তোমার পাত্তাই নেই। চলো চলো, টেন্টে চলো।

রামবাবু বুঝলেন এরা সব ক্লাবের কর্মকর্তা। তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

কর্তারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে টেন্টে ঢুকিয়ে দিলেন।

টেন্টের ভিতরে তখন প্লেয়াররা গম্ভীর মুখে বসে কোচের উপদেশ শুনছে। রামবাবুও শুনতে লাগলেন। তবে কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি জীবনে কখনও ফুটবল খেলেননি। একটু-আধটু হাডু-ডু-ডু খেলেছেন, অল্পস্বল্প ডাংগুলি। তার বেশি কিছু নয়।

কোচ রামবাবুকে বললেন, কানাই, তুমি একদম পাংচুয়াল নও। বি সিরিয়াস। সত্যেন তোমাকে বল ঠেললে তুমি ওয়াল পাস খেলবে কালিদাসের সঙ্গে, তারপর ডায়াগোনালি…।

রামবাবু বুঝলেন না। তবে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।

দুপুরে বেশ খাওয়াদাওয়া হল। তারপর বিশ্রাম।

তারপর সবাই উঠে বুটটুট পরতে লাগল। রামবাবুর খুব একটা অসুবিধে হল না। আড়চোখে অন্যেরটা দেখে দেখে তিনিও বুট এবং জার্সি পরে ফেললেন।

মাঠে নামতেই রামবাবুর বুক এবং পা কাঁপতে লাগল। চারদিকে

গ্যালারি ভর্তি হাজার হাজার লোক বিকট স্বরে চেঁচাচ্ছে। রামবাবুর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। মাঠে নেমে কী করতে হবে তা তিনি বেবাক ভুলে গেলেন।

তবে একটা ব্যাপার তার জানা আছে। মাঠের শেষে ওই যে জাল লাগানো তিনটে কাঠি ওর মধ্যে বল পাঠানোই হল আসল কাজ।

প্রথম কিছুক্ষণ রামবাবু বেমক্কা ছোটাছুটি করলেন। তারপর পায়ে একবার বল পেয়েই ছুটতে শুরু করলেন প্রাণপণে। আশ্চর্যের বিষয় তাকে কেউ আটকাতে পারছিল না। রামবাবু খুব উৎসাহের সঙ্গে আরও জোরে ছুটে প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে গিয়ে তিন কাঠির সামনে হাজির হলেন এবং খুব দক্ষতার সঙ্গে বলটা পাঠিয়ে দিলেন গোলের ভিতরে।

সমস্ত মাঠ হর্ষধ্বনি আর চিৎকারে ফেটে পড়ল।

রামবাবু এক গাল হাসলেন। একেই বলে খেলা।

কিন্তু চেয়ে দেখলেন তার দলের খেলোয়াড়রা কেমন অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। গ্যালারি থেকে কারা যেন চেঁচিয়ে বলছে, ও ব্যাটা ঘুষ খেয়েছে। বের করে দাও মাঠ থেকে।

রামবাবু একটু ভড়কে গেলেন। এবং খানিক বাদে বুঝতে পারলেন, গোল তিনি দিয়েছেন ঠিকই তবে নিজের দলকেই। তার দেওয়া গোলে মোহনবাগান এক গোলে পিছিয়ে পড়েছে।

কোচ মাঠের মধ্যে ঢুকে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, বেরিয়ে এসো!

রামবাবু বেরিয়ে এলেন। আর তারপরই পটাপট কিল চাপড় ঘুসি এসে পড়তে লাগল তার ওপর। কে একটা ল্যাংও যেন মারল। রামবাবু মাটিতে পড়ে চোখ উল্টে গোঁ গোঁ করতে লাগলেন। আর তখনই বোঝা গেল, লোকটা রামবাবু। কানাই কুণ্ডু নয়। আসল কানাই কুণ্ডু মামাবাড়ি গিয়েছিল কাঁঠাল খেতে। সবে ফিরেছে। বুটটুট পরে সে মাঠে নামবার জন্যে তৈরি হচ্ছে।

পরদিন সকালে যখন দাড়ি কামাতে গেলেন রামবাবু তখন তার কালো গালে জরুল ছিল না। মাথা জোড়া টাক, থলথলে শরীর। তবু রামবাবু নিজেকে দেখে বেশ খুশিই হলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *