রামবাগানের রসময় দত্তের পরিবারবর্গ
উচ্চ শিক্ষা ও সম্মানজনক সরকারি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য এই বংশের ব্যক্তিগণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রসময়ের পিতামহ নীলমণি তাঁদের হুগলী জেলার স্বগ্রাম ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন। এঁরা জাতিতে কায়স্থ। নীলমণির তিন পুত্র রসময়, শ্রীরাম ও পীতাম্বর।
১. রসময় সে-সময়ে অত্যন্ত প্রতিপত্তিসম্পন্ন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু মেসার্স ডেভিডসন অ্যান্ড কোম্পানির হিসাবরক্ষক হিসাবে। পরে তিনি কোর্ট অব রিকোয়েস্টস্ (পরিবর্তিত নাম, স্মল্ কজেজ কোর্ট)-এর কমিশনার ( জজ) নিযুক্ত হন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি বিচার বিভাগীয় এত উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, কাউন্সিল অব এডুকেশন (শিক্ষা সংসদ) ও সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক এবং জেলা দাতব্য সমিতির অপরিহার্য সভ্য। তাঁর পাঁচ পুত্র : কৃষ্টচন্দ্র, কৈলাসচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র, হরচন্দ্র এবং গিরীশচন্দ্র; এঁদের মধ্যে শেষোক্ত তিনজন ‘এখনও’ জীবিত; এঁরা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
কৃষ্টচন্দ্র কিছুকাল বোর্ড অব রেভেন্যুজ (রাজস্ব পর্ষদ)-এর সহকারী ছিলেন, পরে, দীর্ঘকাল যাবৎ ট্রেজারীর খাজাঞ্চি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র : হেমচন্দ্ৰ ও চারুচন্দ্র; হেমচন্দ্র খাজাঞ্চি পদে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ঐ বিভাগটির বিলোপের পর তাঁকে করা হয় টাকশালের সোনারূপার বাঁট রক্ষক (বুলিয়ন কীপার) এবং পদাধিকারবলে পেপার কারেন্সি ডিপার্টমেন্টের ও পরবর্তীকালে, রিজার্ভ ট্রেজারীরও ট্রেজারা। এই সকল পদে তিনি এখনও সগৌরবে অধিষ্ঠিত আছেন। চারুচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও বি এল পাস করেন। কিছুকাল তিনি টাকশালের ডেপুটি বুলিয়ন কীপার ছিলেন। তারপর ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসে বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি করছেন। তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন।
বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই কৈলাসচন্দ্র হিন্দু পায়োনিয়ার নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন আবগারি বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট, কলকাতার ডেপুটি কালেক্টর, এবং কিছুকালের জন্য পদাধিকারী কালেক্টর। তাঁর একমাত্র পুত্র উমেশচন্দ্র (Omesh Chandra) ছিলেন সরকারি সেভিংস ব্যাঙ্কের অ্যাকচুয়ারী; কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান। বর্তমানে তিনি কলকাতার পুরসভার কালেক্টর পদে অধিষ্ঠিত। তাছাড়া তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, ট্রেজারির ডেপুটি খাজাঞ্চি, (কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর) কিছুদিনের জন্য খাজাঞ্চি, সরকারি সেভিংস ব্যাঙ্কের অ্যাকচুরারী গভর্নমেন্ট এজেন্সির হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং প্রথমে কলকাতা ও পরে বোম্বাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। তাঁর দুই সন্তান অরু দথ ও তরু দত্ত। স্ত্রী ও কন্যাদ্বয়কে নিয়ে গোবিন্দচন্দ্র ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ভ্রমণে যান। অরু ও তরু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে শিক্ষা লাভ করেন। দুই বোনই খুব ভালভাবে ইংরেজি ও ফরাসী ভাষা শিখেছিলেন। এঁরা চমৎকার কবিতা রচনা ও অনুবাদ করেছেন। জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার জন্য এঁরা সকলেরই প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। একই অসুখে (যক্ষ্মায়) দুজনের মৃত্যু হয়। গোবিন্দচন্দ্র ইংরেজি, ফরাসী ও জার্মান ভাষায় সুপন্ডিত; প্রাচীন কয়েকটি ভাষাও তিনি জানেন। (কার্যে) তাঁর দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা বিস্ময়কর। নিঃসন্তান এই ভদ্রলোক বর্তমানে সকলের সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করে সম্পূর্ণ একা থাকেন।
হরচন্দ্র ছিলেন ট্রেজারীর খাজাঞ্চি ও সরকারি সেভিংস ব্যাঙ্কের অ্যাকচুয়ারী। লেখার অভ্যাস তিনি বজায় রেখেছেন। এখন মাঝে মাঝে ধর্ম সম্বন্ধীয় পুস্তিকা লেখেন।
গিরীশচন্দ্র ছিলেন সরকারি এজেন্সীর সহকারী এবং স্মল কজেজ কোর্টে জজের করণিক। কিছুদিন পূর্বে তিনি সস্ত্রীক ইংল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তিনি কবি। তাঁর কবিতা কোমলতা ও সৌন্দর্যের জন্য সবিশেষ প্রশংসিত। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত ভাষার বিশুদ্ধতাও উচ্চ প্রশংসিত।
২. নীলমণির মধ্যম পুত্র শ্রীরামের চার পুত্রের মধ্যে দুজন শ্রীকৃষ্ণ ও রাজকৃষ্ণ জীবিত আছেন। শ্রীকৃষ্ণ টাকশালের বুলিয়ন সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর রাজকৃষ্ণ পুরসভার সহকারী।
৩. নীলমণির তৃতীয় পুত্র পীতাম্বর ছিলেন ট্রেজারীর ডেপুটি খাজাঞ্চি। তাঁর দুই পুত্র ঈশানচন্দ্র ও শশীচন্দ্ৰ।
ঈশানচন্দ্র দীর্ঘকাল রেভেন্যু সার্ভে বিভাগের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। তাঁর তিন পুত্র। জ্যেষ্ঠ যোগেশচন্দ্র বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে একজন সহকারী; মধ্যম রমেশচন্দ্র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। কনিষ্ঠ অবিনাশচন্দ্ৰ ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে বর্তমানে হুগলী কলেজের অধ্যাপক।
পীতাম্বরের দ্বিতীয় পুত্র শশীভূষণ ছিলেন বেঙ্গল সেকরেটারিয়েটের অতি প্রয়োজনীয় একজন সহকারী। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত ও পেনসন ভোগী। তাঁর সুযোগ সেবার স্বীকৃতিতে সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করেছেন (২৫ এপ্রিল, ১৮৭৩)। তিনি জাস্টিস অব দি পীস এবং কয়েকখানি ইংরেজি পুস্তকের লেখক। স্বগুণেই পুস্তকগুলি উচ্চ প্রশংসিত।
উল্লেখযোগ্য যে, সরকার এই পরিবারটিকে সর্বদাই শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁদের কয়েকজনকে সম্মান ও বিশ্বাসের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য হল অধ্যয়নস্পৃহা এবং সমাজে মেলামেশা করার অনিচ্ছা। এই পরিবারে এমন ব্যক্তি কমই ছিলেন বা আছেন যিনি সমসাময়িক পত্র পত্রিকায় লেখেন নি। বিভিন্ন সময়ে এই পরিবারভুক্ত ব্যক্তিগণ যে সকল কবিতা রচনা করেছেন সেগুলির সংকলন হল ‘দত্ত ফ্যামিলি অ্যালবাম।” তাঁদের কবিতা-প্রিয়তার জন্য ক্যাপটেন রিচার্ডসন এই পরিবারটিকে বলতেন ‘গায়ক পক্ষীদের কুলায়’।