রামখেলাওন
ছারপোকা মারার পর ট্রাঙ্কের মধ্যে রাখা পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটছিলাম। ঘাঁটতে ঘাঁটতে খুঁজে পেলাম সৈয়দ ভাইজানের ছবি। টেবিলে একটা খালি ফ্রেম পড়ে ছিল। তুলে নিয়ে ছবিটা ওতে ঢুকিয়ে দিলাম। ফ্রেমবন্দি ছবিটাকে টেবিলের একপাশে রেখে চেয়ারে বসে থাকলাম ধোপার অপেক্ষায়।
প্রত্যেক রবিবার এভাবেই আমার ধোপার অপেক্ষায় কাটত। তার অবশ্য কারণ ছিল। রবিবার অবধি আমার সপ্তাহের জামাকাপড়ের স্টক শেষ হয়ে যেত। স্টক কী বলছি, সামান্যই জামা ছিল। ছ’সাতদিন আমার কাজ চলে যাওয়ার মতো।
ওদিকে আমার বিয়ের কথা চলছিল। সেই ব্যাপারে গত দু’তিনটে রবিবার আমি নিয়মিত মাহিম যাচ্ছিলাম। আমার ধোপা খুবই ভদ্রলোক বলতে হবে, যে সময়মতো টাকা না দিতে পারা সত্ত্বেও প্রতি রবিবার সকাল দশটা বাজলেই এসে আমার জামাকাপড় দিয়ে যেত। আমার সারাক্ষণ ভয় লেগেই থাকত, কবে আমার দুর্দশা আর অক্ষমতায় তিতিবিরক্ত হয়ে সে চোরাবাজারে আমার জামা বিক্রি করে দেবে! সম্বন্ধ দেখতে যাওয়ার আর পোশাক থাকবে না! বলাই বাহুল্য, বিনা পোশাকে নিজের বিয়ের কথা বলতে যাওয়াটা সম্ভব না।
আমার খুপরি ঘরে তখন চারদিকে মরা ছারপোকার গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠছে। কিভাবে এই গন্ধ চাপা দেওয়া যায় এই ভাবতে-ভাবতেই ধোপা চলে এল।
‘সাহেব, সেলাম!’
পুঁটুলি খুলে আমার জামা ক’টা বের করে সে টেবিলের উপর রাখল। রাখতে গিয়েই তার চোখ পড়ল সৈয়দ ভাইজানের ছবিতে। সে চমকে উঠে ভীষণ মন দিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। আর অদ্ভুত এক গলায় বলল, ‘আরে আরে আরে, এ কী!’
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কী হল?’
সে ছবির দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, ‘এ তো সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব না?’
‘হ্যাঁ?’
এবার ধোপা আমার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘এ তো সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব।’
‘তুমি এঁকে চেনো?’
সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ! এরা তো দুই ভাই! এই তো কোলাবায় বাড়ি। সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব! আমি সাহেবের কাপড়জামা ধুতাম।’
আমার মনে হল যে, নিশ্চয়ই দু’বছর আগের কথা বলছে। সৈয়দ ভাইজান আর মুহম্মদ ভাইজান তো এখন ফিজি আইল্যান্ডে। যাওয়ার আগে বছরখানেক বোম্বাইতে ওকালতি প্র্যাক্টিস করেছিল। আমি ধোপাকে বললাম, ‘দু’বছর আগের কথা বলছ?’
সে আবারো জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ!…সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব যাওয়ার সময় আমায় পাগড়ি দিল, একটা ধুতি দিল, আবার একটা কুর্তা দিল…নতুন! খুব ভালো লোক ছিল…! একজনের দাড়ি ছিল, এত্ত বড়…’ হাত দিয়ে দাড়ির দৈর্ঘ্য বুঝিয়ে দিল। আবার ছবির দিকে দেখিয়ে বলতে লাগল, ‘এই সাহেব ছোট ছিল। এর তিনটে বাচ্চা ছিল…দু’ছেলে, এক মেয়ে। খুব খেলত আমার সঙ্গে…কোলাবায় এত্ত বড় বাড়ি ছিল।’
আমি বললাম, ‘ইনি আমার দাদা।’
ধোপা আবার অদ্ভুত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ!? হ্যাঁ! সে কী!? সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব তোমার দাদা!’
আমি ওর বিস্ময় দূর করতে বললাম, ‘ছবিতে ইনি সৈয়দ হাসান ভাইজান। দাড়ি আছে মুহম্মদ হাসান ভাইজানের। তিনি আমাদের মধ্যে সবার বড়।’
ধোপা আমার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর আমার নোংরা খুপরির চারদিকে চোখ বোলাল। ছোট্ট একটা ঘর। কোনো ইলেকট্রিক বাতি নেই। একটা চেয়ার, একটা টেবিল, আর একটা ছারপোকা-সমন্বিত মোটা কোট।
তার বোধহয় বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেবের ভাই। ভাইজানের সম্বন্ধে অনেক গল্প বলার পর অবশেষে সে অদ্ভুত কায়দায় বলল, ‘সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব কোলাবায় থাকত আর তুমি এখানে?’
আমি দার্শনিকের মতো বললাম, ‘কী বলব বলো! এই তো দুনিয়ার অবস্থা!…কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার! হাতের পাঁচ আঙুল কি আর একরকম হয়!’
‘ঠিক বলেছ সাহেব, একদম ঠিক বলেছ।’ বলে সে পুঁটুলি তুলে রওনা দিল।
হঠাৎ আমার মনে পড়ল তার টাকার কথা। পকেটে মাত্র আট আনা পড়ে আছে। তাও দিয়ে দিলে মাহিম যাওয়া-আসার টাকা থাকবে না। তাও যাতে ধোপার মনে না হয় যে আমি টাকা মারতে চাই, আমি তাকে আটকালাম। বললাম, ‘তুমি হিসাব রাখছ? কত হল গো? আল্লা জানে কত কাপড় ধুয়েছ।’
ধোপা ধুতির খুঁট বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘আমি হিসেব টিসেব রাখি না, সাহেব। সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেবেরও কাজ করেছি…যা দিয়েছে, নিয়ে নিয়েছি…আমি হিসেব করতে জানি না।’
এই বলে সে চলে গেল। আমিও বিয়ের ব্যাপারে মাহিম যাওয়ার জন্য তৈরি হতে শুরু করলাম।
কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল।
আমার বিয়েও হয়ে গেল।
আমার অবস্থারও উন্নতি হয়েছে ততদিনে। আমরা মাসে ন’টাকা ভাড়ার সেকেন্ড পীর খাঁ স্ট্রিটের খুপরি ঘর থেকে পঁচিশ টাকার ক্লিয়ার রোডের ফ্ল্যাটে চলে এসেছি।
ধোপাও মাসে মাসে পুরো টাকা পেতে লাগল।
সে খুব খুশি ছিল যে আমার পয়সাকড়ি বেড়েছে। আমার বউকে বলত, ‘বেগমসাহেব, সাহেবের ভাই খুব বড়লোক ছিল। সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব। ওই কোলাবায় থাকত…যাওয়ার সময় আমাকে পাগড়ি দিল, একটা ধুতি দিল, আবার একটা কুর্তা দিল!…তোমার সাহেবও একদিন অনেক বড়লোক হবে!’
আমি বউকে আগেই ছবির গল্পটা বলেছিলাম। এটাও বলতে ভুলিনি কীভাবে দারিদ্র্যের সময় ধোপা আমার সঙ্গে ছিল…যা দিতাম তাই নিত… কোনোদিন একবারের জন্য নালিশ করেনি…।
ক’দিন পর থেকেই আমার বউয়ের নালিশ শুরু হল যে ধোপা হিসাব রাখে না। আমি বললাম, ‘ও চার বছর ধরে আমার কাজ করছে। কখনো হিসাব রাখেনি।’
বউ বলল, ‘হিসাব করবে কেন! দিব্যি দু’চারগুণ টাকা উসুল করে নিচ্ছে!’
‘মানে?’
‘তুমি জানো না, বাড়িতে বউ না থাকলে এরা এমনি করেই বোকা বানায় আর বেশি টাকা নিয়ে নেয়।’
প্রায় প্রত্যেক মাসেই তার ধোপার সঙ্গে লাগত যে সে কাপড়ের হিসাব কেন রাখে না। ধোপা সরলভাবে উত্তর দিত, ‘বেগমসাহেব, আমি হিসেব জানি না। তুমি তো আর মিথ্যে বলবে না! তোমার সাহেবের দাদা সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেবের কাজ এক বছর করেছি। তার বেগম বলত, ভাই তোমার এত টাকা হয়েছে; আমি বলতাম, ঠিক আছে।’
এক মাসে আড়াইশো জামা ধোয়া হয়েছিল। আমার বউ পরীক্ষা করার জন্য বলল, ‘ভাই, এ মাসে ষাটটা জামা হয়েছে।’
সে বলল, ‘ঠিক আছে বেগমসাহেব।’
তাকে ষাটটা জামার টাকা দেওয়ায় সে মাথায় টাকা ছুঁইয়ে সেলাম ঠুকে যাওয়ার জন্য রওনা দিল। আমার বউ তখন তাকে আটকাল, ‘দাঁড়াও। আড়াইশো জামা হয়েছে। আমি ইয়ার্কি করছিলাম। এই নাও বাকি টাকা।’
‘বেগমসাহেব, তুমি তো আর মিথ্যে বলবে না!’, বলে বাকি টাকাটা নিয়ে মাথায় ছুঁইয়ে আবার সেলাম ঠুকে সে চলে গেল।
বিয়ের দু’বছর পর আমি দিল্লি চলে গেলাম। তার দেড় বছর পর আবার ফিরে এলাম বোম্বাইতে। এবার ফিরে মাহিমে থাকতে শুরু করলাম আমরা।
তিনমাসে আমাদের চারবার ধোপা বদলাতে হল। কেউ অসৎ তো কেউ ঝগড়ুটে। প্রত্যেকবার ধোয়া জামাকাপড় নিয়ে আসত আর কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া বাঁধত। কখনো কম জামা ফেরত দিত, কখনো বিচ্ছিরি করে ধুতো—পুরোনো ধোপার কথা মনে পড়ত আর আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।
তখন আমাদের প্রায় কোনো ধোপাই আর নেই। এমন সময় হঠাৎ একদিন সে হাজির।
‘সাহেবকে আমি একদিন বাসে দেখলাম। আমি ভাবলাম তাই কী করে হয়! সাহেব তো দিল্লিতে! তখন ওই বাইকুল্লার দিকে খোঁজ করলাম তো ছাপাওয়ালা বলল মাহিমে খোঁজ নিতে। পাশের ওই বাড়িতে সাহেবের এক বন্ধু থাকে না? তাকে জিগ্যেস করে এবাড়ির হদিশ পেলাম।’
আমাদের আনন্দের আর শেষ ছিল না। আমাদের জামাকাপড়গুলোরও অবস্থা ফিরে গেল।
এসময় কংগ্রেস সরকারে এল। বেআইনি মদের ঠেকগুলোর উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেল। শুধু বিদেশি মদ পাওয়া যেতে লাগল। দেশি মদ তৈরি আর বিক্রি দুইই পুরো বন্ধ হয়ে গেল। নিরানব্বই শতাংশ ধোপা মদের নেশা করত। সারাদিন জলে ডুবে থাকার পর সন্ধেয় মদে ডুব দেওয়াটা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের ধোপাও ব্যতিক্রম নয়। সে অচল হয়ে পড়ল। তখন বিষাক্ত মদ লুকিয়ে লুকিয়ে বেআইনী ভাবে বিক্রি হচ্ছিল। আমাদের ধোপা সুস্থ হতে সেই মদের দ্বারস্থ হল। ফলস্বরূপ তার শরীর আরো অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রায় মরো-মরো অবস্থা।
আমার তখন খুবই ব্যস্ততা চলছিল। সকাল ছ’টায় বাড়ি থেকে বেরোতাম আর রাতে দশটা-সাড়ে দশটায় ফিরতাম। আমার বউ ধোপার অসুস্থতার খবর জানতে পারল। জানতে পারা মাত্রই সে ট্যাক্সি নিয়ে তার বাড়ি গিয়ে তাকে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।
ডাক্তার অভিভূত হয়ে গেছিলেন। তিনি টাকা নিতে অস্বীকার করলেন। আমার বউ তাঁকে হেসে বলল, ‘ডাক্তারসাহেব, সব পুণ্য আপনিই চান?’
শুনে তিনিও হেসে ফেললেন, ‘তবে অর্ধেক পুণ্যই সই।’
ডাক্তার অর্ধেক ফি নিলেন।
ধোপার চিকিৎসা চলল। কিছু ইঞ্জেকশনেই তার শরীর প্রায় ঠিক হয়ে গেল। শরীর যদিও দুর্বল ছিল কিন্তু ওষুধ খেয়ে ধীরে ধীরে তাও সেরে গেল। কয়েক মাসের মধ্যেই সে একদম সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল।
আমাদের মঙ্গলকামনায় তার কোনো বিরাম ছিল না, ‘ভগবান সাহেবকে সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেবের মতো উন্নতি দিক! কোলাবায় বাড়ি হোক! ঘর ভরে বাচ্চা থাকুক! অনেক টাকা হোক!…বেগমসাহেব ধোপাকে নিতে এসেছিল…মোটরে করে…ওদিকের কেল্লায় অনেক বড় ডাক্তার আছে…তার কাছে নিয়ে গেল…ডাক্তারের কাছে মেমও আছে…ভগবান বেগমসাহেবকে খুশি রাখুক!’
বেশ ক’বছর কেটে গেল। বহু রাজনৈতিক অস্থিরতা এল-গেল। ধোপা কিন্তু ফি রবিবার আসত। তার শরীর তখন খুবই ভালো। নেশাও বন্ধ। প্রথম প্রথম মদের জন্য মন আনচান করলেও ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে গেছিল। দিনভর জলে ডুবেই সে ক্ষান্ত থাকত; সন্ধের ডুব আর দিত না। আর এত বছর পরেও তার কৃতজ্ঞতায় ভাঁটা পড়েনি।
এরপর দেখা দিল আরো টালমাটালের সময়। দেশভাগ! হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা! হিন্দু এলাকায় মুসলমান আর মুসলমান এলাকায় হিন্দুদের নির্বিচারে খুন করা শুরু হল। দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে…।
আমার বউ লাহোর চলে গেল।
অবস্থার আরো অবনতি হতে আমি একদিন ধোপাকে বললাম, ‘দেখো, এখন তুমি এদিকের কাজ বন্ধ করো। এটা মুসলমান পাড়া। কেউ তোমায় মেরে ফেললে—?’
সে হেসে উত্তর দিল, ‘সাহেব, আমায় কেউ মারবে না।’
আমাদের পাড়াতেও বেশ কিছু গণ্ডগোল হল। কিন্তু ধোপার আসা বন্ধ হল না।
এক রবিবার। আমি বসে কাগজ পড়ছি। সামনের পাতায় দাঙ্গায় মৃতদের পরিসংখ্যান আর পেছনের পাতায় ক্রিকেট ম্যাচের স্কোর। এই দুয়ের ভয়াবহ মিলের কথা ভাবছি, এমন সময় ধোপা এল।
খাতা খুলে কাপড়ের হিসাব শুরু করলাম। ওদিকে সে হাসিমুখে গল্প জুড়ে দিল।
‘সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব খুব ভালো লোক ছিল। যাওয়ার সময় আমাকে পাগড়ি দিল, একটা ধুতি দিল, আবার একটা কুর্তা দিল…তোমার বেগমসাহেবও বড় ভালো মানুষ! সে বাইরে গেছে, না? কোথায় গেছে? দেশে ফিরে গেছে? ওখানে চিঠি লিখলে আমার সালাম বোলো। মোটর নিয়ে এসেছিল আমার বস্তিতে…আমার এইরকম পেট খারাপ ছিল…মরেই যেতাম…ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গেল…সুঁচ ফুটিয়ে ঠিক করে দিল…চিঠি লিখলে আমার সেলাম দিও কিন্তু সাহেব…বোলো, রামখেলাওন বলেছে ওকেও চিঠি দিতে…!’
আমি বেশ কড়া গলায় তাকে জিগ্যেস করলাম, ‘তুমি আবার মদ খাওয়া শুরু করে দিয়েছ?’
সে হাসল, ‘মদ! মদ কোথায়? পাওয়া গেলে তো খাব সাহেব!’
আমি আর কিছু বললাম না। সে পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে সেলাম ঠুকে চলে গেল।
আরো বেশ কিছু দিন পরের কথা। শহরের অবস্থা আরো শোচনীয়। লাহোর থেকে বারবার চিঠি আসছে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য। শেষে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম যে ফিরে যাব। আসছে রবিবার জাহাজে করে রওনা দেব।
রবিবার সকালে তাড়াতাড়ি বেরোনোর ছিল, এদিকে জামাকাপড় ধোপার কাছে। আমি ঠিক করলাম কার্ফুর আগে আগে ওর ওখানে গিয়ে সেসব নিয়ে আসব। এই ভেবে শনিবার বিকেলে একটা অটো নিয়ে মহালক্ষ্মীর দিকে রওনা দিলাম।
কার্ফু শুরু হতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। রাস্তায় লোকজন তখনো যাতায়াত করছে। ট্রাম চলছে। ব্রিজের কাছে অটো পৌঁছতেই হঠাৎ শুনতে পেলাম প্রচণ্ড শোরগোল। লোকজন দিশেহারার মতো এদিক-ওদিক পালাচ্ছে। ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতো।
একটু ভিড় কমতে দেখলাম, দূরে ধোপার দল লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। আমার ওদিকেই যাওয়ার ছিল। কিন্তু অটোওয়ালা যেতে রাজি হল না। আমি ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়লাম। হাঁটতে শুরু করলাম।
দলটার কাছে পৌঁছতে আমায় দেখে ওরা শান্ত হয়ে গেল। আমি এগিয়ে ওদের মধ্যে একজনকে জিগ্যেস করলাম, ‘রামখেলাওন কোথায় থাকে?’
একজন ধোপা লাঠি হাতে টলতে টলতে এগিয়ে এল, ‘কী জানতে চাও?’
‘জিগ্যেস করছি, রামখেলাওন কোথায় থাকে?’
নেশায় চুর সে প্রায় আমার গায়ের উপর পড়ে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে?’
‘আমি?…রামখেলাওন আমার ধোপা।’
‘রামখেলাওন তোমার ধোপা!? তুমি কোন ধোপার পো?’
আরেকজন চিৎকার করল, ‘হিন্দুর পো না মোছলমানের পো?’
সবাই আমার চারপাশে জড়ো হল। হাতে লাঠি। আমায় শুধু একটাই প্রশ্নের উত্তর দিতে হত, হিন্দু না মুসলমান।
আমি ভয়ে গুটিয়ে গেলাম। পালানোর প্রশ্নই ছিল না। ওরা আমায় ঘিরে ছিল। কাছাকাছি কোনো পুলিশও ছিল না যে সাহায্য করতে আসবে! মাথা গুলিয়ে গেছিল। শেষে কোনরকমে বললাম, ‘রামখেলাওন হিন্দু।…জিগ্যেস করছি সে কোথায় থাকে? তার বাড়ি কোথায়? দশ বছর ধরে সে আমার কাজ করছে।…একবার খুব অসুস্থ হয়েছিল…আমার বেগম…আমার মেমসাহেব মোটর নিয়ে এসে তাকে নিয়ে গেছিল…’ বলতে বলতে হঠাৎ আমার মনে হল, এ আমি কী বলছি! প্রাণ বাঁচাতে কোথায় নেমে এসেছি আমি! ভিতরে কেমন একটা জেদ এসে গেল। আমি বললাম, ‘আমি মুসলমান।’
জোর চিৎকার, ‘মেরে ফেল, হারামজাদাকে মেরে ফেল!’
নেশায় চুর আরেকজন হঠাৎ আমার পিছনদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘দাঁড়া…একে রামখেলাওন মারুক।’
আমি ঘুরে দেখলাম, পিছনে মোটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রামখেলাওন। টলছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে মুসলমানদের গাল দিতে শুরু করল। লাঠি তুলে গাল দিতে দিতে আমার দিকে এগিয়ে এল।
আমি হুকুমের স্বরে বললাম, ‘রামখেলাওন!!’
সে জড়ানো গলায় বলল, ‘চুপ শালা, রামখেলাওনের…’
আমার শেষ আশাও নিভে এল। সে আরো কাছে আসতে আমি শুকনো গলায় আস্তে আস্তে বললাম, ‘আমায় চেনো না রামখেলাওন?’
রামখেলাওন লাঠি মাথার উপর তুলে মারতে উদ্যত হল। দু-চারবার চোখ কুঁচকে দেখল। ভালো করে দেখতে তার হাত থেকে লাঠি মাটিতে পড়ে গেল। আমার কাছে এসে আরো মন দিয়ে আমায় দেখে আর্তনাদ করে উঠল, ‘সাহেব!’
তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘এ মোছলমান না! এ আমার সাহেব! বেগমসাহেবের সাহেব! যে মোটর নিয়ে এসেছিল… ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল…আমায় বাঁচিয়েছিল।’
রামখেলাওন বাকিদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। কেউ মেনে নিল, কেউ না। সবাই মদে ডুবে ছিল। ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। কেউ রামখেলাওনের পক্ষ নিল, কেউ অন্য পক্ষ নিল। প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায় এমন অবস্থা। তৎক্ষণাৎ আমি সুযোগ বুঝে ওখান থেকে পালিয়ে গেলাম।…
রবিবার সকাল ন’টা। আমার জিনিসপত্র গোছানো শেষ। জাহাজের টিকিটের অপেক্ষায় বসে। এক বন্ধু কালোবাজার থেকে টিকিট আনতে গেছে।
আমার মন অস্থির। মনে হাজারো প্রশ্ন। টিকিট তাড়াতাড়ি এলে তখন বাঁচি! মনে হচ্ছিল বাড়িটা আমায় গিলে ফেলবে আরেকটুক্ষণ থাকলে। এমন সময় দরজায় শব্দ। ভাবলাম, টিকিট এসে গেছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে খুললাম।
ধোপা বাইরে দাঁড়িয়ে।
‘সাহেব সেলাম!’
‘সেলাম।’
‘ভেতরে আসব?’
‘এসো!’
সে নীরবে ঘরে ঢুকল। পুঁটুলি খুলে কাপড় বের করে খাটে রাখল। ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় জিগ্যেস করল, ‘তুমি চলে যাচ্ছ, সাহেব?’
‘হ্যাঁ!’
সে কাঁদতে শুরু করল, ‘সাহেব আমায় মাপ করো। সব এই মদের জন্য! মদ…মদ…আজকাল বিনে পয়সায় পাওয়া যাচ্ছে! শেঠরা বিলিয়ে দিচ্ছে, খাও আর মোছলমানদের মারো! বিনে পয়সার মদ কে ছাড়ে বলো সাহেব?…আমায় মাপ করো…আমি নেশা করেছিলাম…সৈয়দ শালেম বালিস্টার সাহেব আমায় অনেক দয়া করেছে!…আমাকে একটা পাগড়ি, একটা ধুতি, আবার একটা কুর্তা দিয়েছে…তোমার বেগমসাহেব আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে!…মোটরে করে এসে আমায় ডাক্তার দেখিয়েছে…এত টাকা খরচ করেছে…তুমি দেশে ফিরে যাচ্ছ!…বেগমসাহেবকে বোলো না সাহেব যে রামখেলাওন…’
তার গলা বুজে এল। পুঁটুলি কাঁধে তুলে সে রওনা দিল। আমি পিছন থেকে ডাকলাম, ‘দাঁড়াও রামখেলাওন!’
রামখেলাওন ধুতির খুঁট বাঁধতে বাঁধতে জোরে হেঁটে বেরিয়ে গেল।