রামকৃষ্ণ-শক্তি
শোন! কি চাইছ? আমার মহিমা কীর্তনে নিজের মহিমা বাড়াতে! বর্ষার ডোবায় মেঘার্ত কোলা ব্যাঙের গ্যাঙোর গ্যাং! শ্রীরামকৃষ্ণের জার্সি পরে সম্মানিত হওয়ার বিশেষ বাসনা! জেনে রাখ, আমার পরিচয় শুধু প্রেমিক, ভক্তবৎসল, করুণাময়, পরমহংস রামকৃষ্ণ নয়; আমার আরেক ভয়ঙ্কর রূপ- নিষ্ঠুর রামকৃষ্ণ, রুদ্র রামকৃষ্ণ। আমি ছেঁকে ছেঁকে তুলে নিই। ঝেড়েঝুড়ে খড়কুটো আলাদা করে ফেলি। যার হবে তাকে কাছে টানি। যার হবে না, তাকে কালের স্রোতে ফেলে দিই। ঘুরে ঘুরে বারে বারে এস। প্রারব্ধ ক্ষয় কর। শুভসংস্কার তৈরি কর। প্রদীপ সাজাও। তেল, সলতে লাগাও। তারপর রামকৃষ্ণ-দীপাধারের একটি স্ফুলিঙ্গ ছুটে যাবে। হাজার বছরের অন্ধকার ঘর তখন নিমেষে আলোকিত। তার আগে কিছু হওয়ার নয়। রামকৃষ্ণ ঝাঁকা-মুটে নয় যে, সবাইকে মাথায় করে ঈশ্বরের দরবারে হাজির করে দেবেন। তিনি সেই ফলেই নৈবেদ্য সাজাবেন, যে-ফল কাকে ঠোকরায়নি। সেই ফুলেই মালা গাঁথবেন, যে-ফুল কীটদষ্ট হয়নি!
আমার অনেক মহিমা, তাতে তোমার কি? তোমার মহিমা প্রকাশের কিছু আছে কি? বৈষয়িক ঐশ্বর্যের কি দাম? প্রচুর, প্রচুর টাকা, অগাধ সম্পত্তি, বিশাল কর্তৃত্ব—সেসবের স্থায়িত্ব কতদিন? মানুষ যত বড়লোক হয়, মানুষ হিসেবে সে তত ছোট হতে থাকে। সমস্ত মানবীয় গুণ গুটিয়ে আসতে থাকে। ‘ক্রোড়পতি’, কিন্তু হাত দুটো তার মুষ্টিযোদ্ধার দস্তানায় পোরা। বিপদে কেউ সাহায্য চাইলে এক ঘুষি, তার অধিক কিছু মিলবে না। আমার নরেন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে লিখলে : “কি দয়া এদের [আমেরিকাবাসী]! যদি খবর পেলে যে, একজন গরিব ফলানা [অমুক] জায়গায় কষ্টে রয়েছে, মেয়েমদ্দ চলল—তাকে খাবার, কাপড় দিতে, কাজ জুটিয়ে দিতে! আর আমরা কি করি!” বড় অভিমানে, নরেন লিখছে : “বাঙালীরা কেবল বাক্যসার, তাদের হৃদয় নেই, তারা অসার।”
নরেনকে ভার দিয়েছিলাম, বাঙালীদের ধরে বেশ করে একটু নাড়া দিতে। পুরনো, নোনাধরা, ঝুরঝুরে পলস্তারা চেঁছে ফেলে নতুন প্রলেপ লাগাতে হবে। যাবতীয় ভিটকেমি সমূলে উৎপাটিত না করলে ধর্মের প্রকাশ হয় কি করে! পাঁকের ওপর পাঁক, তার ওপর পাঁক, আত্মার দম বন্ধ। সাপের মাথায় মহামূল্য মণি, সে ব্যাটা স্বভাব-দোষে ডোবার ব্যাঙ খেয়ে মরে।
বাঙালীকে আমিও দেখেছি। অনেক রকমের বাঙালী। দু-চারজনকে তিরষ্কারও করেছি। বড়, ছোট, প্রতাপশালী-এ-বিচার করিনি। রামকৃষ্ণের কিসের পরোয়া! রামকৃষ্ণ হতে চায়নি কিছু। হওয়াতে চেয়েছে। আগুনের উপমা দিই আমি। আগুনের ধর্ম জ্বলা, উত্তাপ আর আলো দেওয়া। মানুষ সেই আগুন নানাভাবে ব্যবহার করে। ঘরে ঘরে পরিচিত ব্যবহার—রান্নার কাজে। পরিপাটি পরিপাক। ‘রামকৃষ্ণ অগ্নি’। ‘নাচিকেত অগ্নি’র মতো ‘রামকৃষ্ণ অগ্নি’। “অনন্তলোকাপ্তিমথো প্রতিষ্ঠাং বিদ্ধি ত্বমেতং নিহিতং গুহায়াম্।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।১।১৪) স্বর্গপ্রাপ্তির উপায়, জগতের আশ্রয়, বিদ্বানদের বুদ্ধিতে অন্তর্নির্বিষ্ট! “অমৃতত্বং ভজন্ত।” (ঐ, ১।১।১৩)
আমি বিদ্যাসাগরকে বলেছিলাম : “সূর্য শিষ্টের ওপর আলো দিচ্ছে, আবার দুষ্টের ওপরও দিচ্ছে।” উৎসারিত আলোকে শিষ্ট আর দুষ্ট উভয়েই আলোকিত। প্রদীপের সম্মুখে কেউ বা ভাগবত পড়ছে, আর কেউ বা দলিল জাল করছে। প্রদীপ নির্লিপ্ত। এইটি জানবে—যার সংস্কার আছে, সে নিত্য, সত্য, চৈতন্যস্বরূপ ভগবানের দিকে এগোবেই এগোবে। সেইটাই তার নিয়তি। যার নেই তাকে অর্জন করতে হবে। যার আছে মাপ, যার নেই কর। অর্জন কর। যদি না কর নাশ হও, নষ্ট হও। বারে বারে আস আর যাও। নচিকেতার সংস্কার ছিল, তাই বালক বয়সেই উদ্বিগ্ন হয়েছিল : “সস্যমিব মর্ত্যঃ পচ্যতে সস্যমিবাজায়তে পুনঃ।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।১।৬) মানুষ শস্যের মতোই জীর্ণ হয়ে মরে আবার শস্যের মতোই জন্মায়। মুক্তির পথ কি!
রামকৃষ্ণের মহিমা-কীর্তনে মনের সেই রুদ্ধ দুয়ার খুলবে কি, যেখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে কাল? ‘কাল সৰ্প’। যেটিকে শিব জড়িয়ে রেখেছেন গলায়। আর কালকে যিনি কলন করেন, গণনা করেন—সেই কালী তাঁর বুকে। লজ্জায় জিভ কেটে অনুচ্চারে বলতে চাইছেন : বারে বারে আস, যাও, তুমি জীব; তবু কেন বোঝ না, নিত্য আর অনিত্যের প্রভেদ। মহাকালের বুকে আমি খণ্ডকাল। নিজের আস্ফালনে লজ্জিত হয়ে জিভ কেটে স্থির। এরই নাম ‘চৈতন্য’।
আমি সেই চৈতন্যের জাগরণ চেয়েছি। তুমি হও। শাস্ত্র, স্তোত্র কপচে কিছু হবে না। দাঁড়ে বসে তোতা কপচায়—’রাধেকৃষ্ণ’। যেই বেড়ালে ধরে সেই আদি, অকৃত্রিম—’ক্যা ক্যা’। প্রকৃত ধার্মিক সহজে টলে না। জীবন-কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সখা কৃষ্ণকে প্রশ্ন কর—বল সখা! কর্তব্য কি? তিনি উত্তর দেবেন— এই নাও, জীবন আর মৃত্যুর সংযোগ-ভূমিতে রথ স্থাপন করেছি। তুমি দেখ। পৃথিবী মানুষের। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংসার-বন্ধন। প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সংগ্রাম ও সন্ধি। জন্মসূত্রে কর্মের বন্ধন। তুমি ক্ষত্রিয়। যুদ্ধই তোমার কর্ম। আর আমি তোমার সখা শ্রীকৃষ্ণ এইটিই বলতে চাইছি, কর্মই ধৰ্ম। কর্মকে ধর্মের স্তরে নিয়ে যেতে হলে আসক্তিশূন্য হতে হবে। ঈশ্বরের প্রীতির জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম ছাড়া অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ হয়। অতএব তুমি ভগবানের উদ্দেশে অনাসক্ত হয়ে বর্ণাশ্রমোচিত সমস্ত কর্ম কর।
“যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোঽয়ং কর্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।।” (গীতা, ৩।৯)
আমি রামকৃষ্ণ, এই কর্মকেই বলছি ‘কর্তব্য’। কর্তব্যকর্ম। অবশ্যই সৎকর্ম, সদ্ভাবনা। তা নাহলে সংসার দাঁড়াবে কোথায়! কর্তব্য শেষ হলে ঈশ্বরের সাধনাই হবে এক নম্বর কাজ। মানুষের নানা ঋণ। দেবঋণ, ঋষিঋণ, মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, স্ত্রীঋণ। মা-বাপের ঋণ পরিশোধ না করলে কোন কাজই হয় না। স্ত্রীর কাছেও ঋণ আছে। হরিশ[১] স্ত্রীকে ত্যাগ করে দক্ষিণেশ্বরে এসেছিল। যদি তার স্ত্রীর খাবার যোগাড় না থাকত, তাহলে বলতুম, ঢ্যামনা শালা! মাস্টারকে একদিন খুব ধমকেছিলাম। সেকথা সে নিজেই লিখে গেছে অকপটে। ভাবমুখে বলেছিলাম, যে-অবস্থায় রামকৃষ্ণ রাজা-মহারাজা কারোকেই কেয়ার করে না। বিচার! বড্ড বেশি বিচার। বললুম, দেখ, তুমি যা বিচার করছ, অনেক হয়েছে! আর না। বল আর করবে না!
[১. হরিশ কুণ্ডু। গড়পারে বাড়ি। ব্যায়াম শিক্ষকের কাজ করতেন। মাঝে মধ্যে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে আসতেন। সরল শান্ত স্বভাব। ঠাকুরের স্নেহভাজন। পরবর্তী কালে পাগল হয়ে যান।]
মাস্টার হাতজোড় করে বললে, আজ্ঞে না।
আমি বললুম, অনেক হয়েছে। তুমি প্রথম আসামাত্র তোমায় তো আমি বলেছিলাম—তোমার ঘর—আমি তো সব জানি। তোমার ঘর, তুমি কে, তোমার অন্তর বাহির, তোমার আগেকার কথা, তোমার পরে কি হবে—এসব তো আমি জানি?
মাস্টার নতমস্তক। আরো কিছু বাকি আছে বলার। পিতার সঙ্গে বৈরিতা। স্ত্রীর হাত ধরে গৃহত্যাগ। শোন, বাপ-মা মানুষ করলে, এখন ছেলেপুলেও হলো, স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে আসা! বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে, বাউল বৈষ্ণবী সেজে বেরয়! তোমার বাপের অভাব নাই বলে। তা নাহলে আমি বলতুম, ধিক্।
কি মনে হচ্ছে রামকৃষ্ণকে! যাকে ভালবাসি, যাকে তৈরি করতে চাই— তাকে আমার আগুনে লাল করে কর্তব্যবোধের নেহাইয়ে ফেলে চৈতন্যের হাতুড়ি পেটাই।
মাস্টারকে কাছে ডেকে বললাম, ছেলে হয়েছে শুনে বকেছিলাম। এখন গিয়ে বাড়িতে থাক। তাদের জানিও, যেন তুমি তাদের আপনার। ভিতরে জানবে তুমিও তাদের আপনার নও, তারাও তোমার আপনার নয়। আর বাপের সঙ্গে প্রীত করো। এখন উড়তে শিখে তুমি বাপকে অষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে পারবে না?
মাস্টার বললে, পারব।
রামকৃষ্ণের কৃপা লাভ করতে হলে নিজেকে গঠন করতে হবে। তার নির্দেশ মানতে হবে। নিছক ভজনায় সে ভজবে না। কারোকে ছেড়ে কথা বলিনি। মাথাওলা বাঙালীদের কাছে স্বেচ্ছায় এগিয়ে গেছি দেখতে—কে কোন্ অবস্থায় আছে, কি নিয়ে মেতে আছে। আমি পুজোপাঠ শেখাতে আসিনি। শাস্ত্রের মুখস্থ বুলি আওড়ে পণ্ডশ্রম করিনি। আত্মস্থ শাস্ত্রের সহজ নির্দেশে জড়চৈতন্য মানুষকে জাগ্রতচৈতন্য করতে চেয়েছি।
নরেন বলেছিল : “সর্বদা মনে রেখ যে, পরমহংসদেব জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন—নামের বা মানের জন্য নয়। তিনি যা শেখাতে এসেছিলেন, তাই ছড়াও। তাঁর নামের দরকার নেই—তাঁর নাম আপনা হতে হবে। ‘আমার গুরুজিকে মানতেই হবে’ বললেই দল বাঁধবে, আর সব ফাঁস হয়ে যাবে— সাবধান।”
রামকৃষ্ণ-ধর্মের সারকথা আমার নরেন—বচনে, আচরণে। Ramakrishna Power. “যে যা বলে বলুক, আপনার গোঁয়ে চলে যাও—দুনিয়া তোমার পায়ের তলায় আসবে, ভাবনা নেই। বলে—একে বিশ্বাস কর, ওকে বিশ্বাস কর। বলি, প্রথমে আপনাকে বিশ্বাস কর দিকি।” আবার নরেন বলেছে : “Have faith in yourself, all power is in you. Be conscious and bring it out. চৈতন্য।