রামকৃষ্ণ ভগবান
ঠাকুর একদিন তাঁর জামাটি উলটে পরেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের চতুর্থ ও কনিষ্ঠ সহোদর ঠাকুরের কৃপাধন্য অতুলচন্দ্রের শিক্ষা হলো, সংসারের জ্ঞান উলটো করে নিতে হয়। চাবি উলটো করে ঘোরালে তালা খুলে যায়। জীবনের চাকা উলটো দিকে ঘোরালে বন্ধন ঘুচে যায়।
চাকার সোজা ঘোরাটা কি?
যে-পথে সংসার চলে আসছে এবং অনাদিকাল ধরে চলবে, সেই প্রবাহে নির্বোধের মতো ভেসে চলা। খাও, দাও, ‘হাহা হুহু’ করতে করতে বুড়ো হয়ে বিদায় নাও। বিষয়, সম্পত্তি, প্রতাপ, প্রতিপত্তি, যশ, খ্যাতি, আকাঙ্ক্ষা, আকাঙ্ক্ষা! মেধা আর ইন্দ্রিয় দিয়ে বিশাল এই পৃথিবীকে ধরব। হৃদয় দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে নয়। আমি ‘ব্রুট’ হব। চোখের দেখা দেখব, মনের দেখা দেখব না।
ষড়ৈশ্বর্যবান ভগবানকে চাই না। যাঁকে পেলে সব পাওয়া হবে তাঁর থেকে ক্রমশই দূরে, আরো দূরে যাওয়ার সাধনা করব। সংসার যেদিকে যাচ্ছে তার বিপরীতে যাওয়ার সাহস নেই। এদিকেও ভয়, ওদিকেও ভয়। সংসার-পথের ভয়টা জানা ভয়। বিপরীতের ভয়টা অজানার ভয়।
এক পিতার তিন সন্তান। তিনজনই সাবালক হয়েছে দেখে পিতা একদিন তাদের ডেকে পাঠালেন। তিনজনে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেককে দশ হাজার করে টাকা দিয়ে তিনি বললেন : “তোমরা লায়েক হয়েছ, এইবার তোমাদের উপার্জনের পালা। যাও, ব্যবসা কর। একবছর পরে খবর নেব, তোমরা কে কি করলে!”
বছর ঘুরে গেল। ছেলেদের ডেকে পাঠালেন।
বড় ছেলে হাসতে হাসতে বেশ গর্বের সঙ্গে বলল : “আপনার দেওয়া টাকা আমি ডবল করে ফেলেছি।”
পিতা বললেন : “বাঃ! বাহাদুর!”
মেজ বলল : “দাদা যা করেছে আমি তার কিছুই পারিনি। তবে একটাই কৃতিত্ব আমার, মূলধন নষ্ট করে ফেলিনি। দশহাজার দশহাজারই আছে।”
ছোট কোথায়? দরজার বাইরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার সামনে আসার সাহস নেই।
“তোমার কি হলো! তুমি আসছ না কেন?”
ছোট ছেলে অতি সঙ্কোচে বলল : “আমাকে প্রশ্ন করবেন না। উত্তর- আমার চেহারা।”
ছেঁড়া পোশাক, শীর্ণকায়, চুলে তেল নেই। “আপনার দেওয়া টাকা আমার পাটোয়ারি বুদ্ধির অভাবে সবটাই নষ্ট করে ফেলেছি।”
পিতা তখন বড় ও মেজ ছেলেকে বললেন : “দেখো, তোমাদের হবে। তুমি বাড়িয়েছ, এ ধরে রেখেছে, কিন্তু এর অবস্থা শোচনীয়—এর বিষয়জ্ঞান একেবারেই নেই। তাই আমি সিদ্ধান্ত করলাম, আমার গলার এই সোনার হারটা আমি ওকে দেব। এই হারের ভেলকি হলো, এটি রোজ এক পোয়া করে সোনা পাড়ে। আশা করি, এতে তোমাদের আপত্তি হবে না। তোমাদের ছোট ভাই তো! না খেয়ে মরে যাবে!”
বড় আর মেজ ভাবছে—”আহা! আমরা যদি আজ এমন নিঃস্ব হতে পারতাম, তাহলে কী অমূল্য সম্পদই না আমাদের লাভ হতো!”
কি তিনি দিতে পারেন আমাদের জানা নেই। অযাচিত দান। যাচিত দান নয়। ভিখারির আবার কদর কি! ঠাকুর বলছেন : “জমিদার। রোজ সকালে উমেদাররা ভিড় করে আসে। দাও, দাও। জমিদার মশাইয়ের হুকুমে নায়েব যাকে যা পারেন তাই দেন। এদের মধ্যে একজনই আশ্চর্য ব্যতিক্রম। রোজ আসে, একপাশে আলাদা বসে থাকে। একসময় উঠে চলে যায়।
“জমিদার একদিন থাকতে না পেরে প্রশ্নই করে ফেললেন, ‘তোমার ব্যাপারটা কি বল তো! রোজ আস, বসে থাক, চলে যাও। কোনদিন তো কিছু চাও না! তোমার কি কিছু চাইবার নেই? ‘
“‘আজ্ঞে না। আমি চাইতে আসি না, আমি আপনাকে দেখতে আসি। আপনাকে আমি ভীষণ ভালবাসি যে! না দেখে থাকতে পারি না!’”
জগতের সবকিছু শর্তাধীন। তুমি দেবে, আমি তোমাকে দেব। বাতাসে চির ভাসমান প্রশ্ন—তুমি আমাকে কি দিয়েছ? তুমি আমার জন্য কি করেছ যে, আমি তোমার জন্য করব? কি করে প্রত্যাশা কর! জানবে, সংসার হলো আয়নায় মুখ দেখা।
পিতামাতার ভালবাসাও নিঃস্বার্থ নয়। সবই গরুর ভালবাসা। যতদিন কর্তার রোজগার, মাস-পয়লায় টাকা ততদিনই জাবনা, গোয়ালে সাঁজাল, নিপাট একটি চট দিয়ে পিঠ চাপা, মাঝে মাঝে গলকম্বলে সোহাগের কুচুরমুচুর। অবসরের দিন এগিয়ে আসছে, দুধ কমছে, খাতিরও কমছে। সকাল সাতটার চা স্লিপ করে আটটা-নটাতে দেখা দিচ্ছে। তেমন লিকারও নেই, ফ্লেভারও নেই। এরপর লিপইয়ার হয়ে যাবে। খেয়াল হলে দেবে, সে দুদিনে একবার কি চারদিনে একবার হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। খেতে বসে এমনও হতে পারে, শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্যে প্রশ্ন—”তোমাকে কি মাছ দিয়েছিলুম? দিইনি! বলবে তো! বাক্যি রোধ হয়ে গেছে নাকি! না বললে জানব কি করে?”
টসটসে অভিমান নিয়ে কর্তা সংসারে পড়ে আছেন একটেরে হয়ে। গিরিশচন্দ্রের কথায়, পিছনে গোধূলি, সামনে অন্ধকার। কার ওপর অভিমান! কে দাম দেবে সে-অভিমানের! গিরিশচন্দ্র বলছেন :
“পঞ্চভূত ধরি করে, মহাকাল নৃত্য করে
সংযোগ-বিয়োগ নিত্য ছেলেখেলা প্ৰায়,
একত্র যখন বাঁধে পঞ্চভূত হাসে কাঁদে
খুলে দিলে ভেঙে যায় কোথায় মিশায়।”
সংসারে সব অভিনেতা। কত সব ঢঙ। খাবার সময় স্ত্রী সামনে বসে আছে। রুলি-পরা হাত নেড়ে নেড়ে বলছে, আহা এঁটে, এটে আরেকটু নাও। আবার বলছেন, কড়ে রাঁড়ি বাপকে ডাকছে। সে কেমন সোহাগের গলা। সবই স্বার্থ।
গিরিশচন্দ্র তো সংসারীই ছিলেন, সন্ন্যাসীর সন্ন্যাসী নরেন্দ্রনাথকেও কপাট খুলে সংসার দেখিয়েছিলেন গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর দেহাবসানের পর পরিব্রাজক বিবেকানন্দ গাজীপুর থেকে প্রমদাবাবুকে লিখছেন সেই সংসারচিত্র-
“তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি কখনো আমার প্রার্থনা গরমঞ্জুর করেন নাই— আমার লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন—এত ভালবাসা আমার পিতামাতায় কখনো বাসেন নাই। ইহা কবিত্ব নহে, অতিরঞ্জিত নহে, কঠোর সত্য এবং তাঁহার শিষ্যমাত্রেই জানে। বিপদে, প্রলোভনে, ‘ভগবান রক্ষা কর’ বলিয়া কাঁদিয়া সারা হইয়াছি—কেহই উত্তর দেয় নাই—কিন্তু এই অদ্ভুত মহাপুরুষ বা অবতার বা যাই হউন, নিজ অন্তর্যামিত্বগুণে আমার সকল বেদনা জানিয়া নিজে ডাকিয়া জোর করিয়া সকল অপহৃত করিয়াছেন।” স্বামীজী বলছেন : “কঠোর সত্য।” এই ‘কঠোর সত্য’টা কি! “কাঁদিয়া সারা হইয়াছি—কেহই উত্তর দেয় নাই।” ঠাকুর কৃপা করে যুবক নরেন্দ্রনাথকে সংসারের এই নির্লজ্জ সত্যটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। নরেন্দ্রনাথ, এই হলো সংসারের পাটোয়ারি। তুলসীদাসজী কি বলছেন শোন—
“অর্থ অনর্থকরহি জগত মাহী।
দেখহু মন সুখলেশো নাহি।।
যাকো ধন তাকো ভয় অধিক।
ধন কারণ মারত পিতু লড়িক।।
ধনতে পতিহিঁ বিঘাতহিঁ নারী।
ধনতে মিত্র শত্রুতা-কারী।
ধনমদ নর অন্ধের জগ কয়সে
দেখ নমি নহি রতোঁ ধি জৈসে।।”
—সকলেই জানি, অর্থই অনর্থের মূল। থাকা মানেই গেল গেল ভয়। সারা রাত “নিদ নাহি আঁখি পাতে”। টাকার জন্য ছেলে বাপকে, স্ত্রী স্বামীকে খুন করতে পারে। বন্ধু শত্রু হয়ে যেতে পারে। তবু মানুষ টাকার পিছনে ছুটবে। জ্ঞান, উপদেশ, উদাহরণ—সব ব্যর্থ। কারণ, রাতকানা যেমন চোখের অসুখ বুঝতে পারে না, সেইরকম টাকার দন্তে ধনী সব ভুলে যায়।
স্বামীজী কৌপীন সার করতে চেয়েছিলেন। ঠাকুরের হাতে তৈরি চেলা! বলছেন, বুদ্ধদেব আমার আদর্শ, কিন্তু সংসার ছেড়ে বুদ্ধ অথবা কপিলের মতো পালাব না। সন্নাপি অসন্নাপি, ভিন্নাপি অভিন্নাপি—আছে অথচ নেই, ভিন্ন অথচ অভিন্ন। এই যে জগৎ, এর তথ্য আমি জানব—দুঃখ আছে কি কী আছে; জুজুর ভয়ে আমি পালাই না। আমার গুরু পরমহংসদেব, মমৈক শরণদাতা রামকৃষ্ণ ভগবানও পলায়ন করেননি। নরলীলায় দেহযন্ত্রণা, অবতারলীলায় পরমানন্দ— উভয়ের দেহাতীত সমন্বয়ে শতাব্দীর ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। যিনিই রাম, তিনিই কৃষ্ণ—এই দেহে রামকৃষ্ণ।