দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

রান্নার শুরু তো বাজারেই

রান্নার শুরু তো বাজারেই

পকেটে পয়সা থাক আর না থাক, হজম হোক আর না হোক খাওয়ার কথা ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। নানারকম খাবার। মন বেশ উৎফুল্ল হয়। বাইবেলেই আছে—লেট আস ইট অ্যান্ড ড্রিঙ্ক, ফর টুমরো উই শ্যাল ডাই। বাঙলাতেও বলে, মরব যখন খেয়েই মরি। রসিক চার্বাক বলেছিলেন, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। এক বন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মরব যখন তখন এই আক্ষেপ নিয়ে যাব, কত দেশ দেখা হল না, কত কী খাওয়া হল না!

বাঙালির বিশাল বদনাম—খেয়ে আর খাইয়ে ফতুর। এখন আর বাঙালির সে বোলবালা নেই। খোপের ভিতর হোমিওপ্যাথিক জীবন। জয়েন্ট ফ্যামিলি ডিসজয়েন্ট হয়ে গেছে। রাঁধিয়েরা সব বিদায় নিয়েছেন। শিল নোড়া শহিদ বেদি হয়ে গেছে। কয়লার উনুন বাতিল হয়ে গেছে। ফুরফুরে গ্যাস, ফিসফিসে প্রেসার কুকার। উদ্ব্যস্ত গৃহিণী, শর্করাপ্রবণ কর্তা। একবার হার্টে হোঁচ খাওয়া কর্তা। টেনশনে টেনস ছাত্রছাত্রী। খাওয়ার বারোটা বেজে গেছে। কবজি ডুবিয়ে মাংসর ঝোল খাব, বলতে আপত্তি নেই, কাজে করাটাই বিপদ। বাবুদের লিভারে আর সেই লিভার নেই। যে লিভার গর্ব করে বলতে পারত, লোহা খেয়ে হজম করি। এ দৃশ্য আমার স্বচক্ষে দেখা, পরিবেশনকারী ছুটছেন, পিছনে এঁটো হাতে তাড়া করেছেন এক নিমন্ত্রিত। ঘটনাটা ঘটেছিল আমার ছাত্র জীবনে এক বিশাল বনেদী পরিবারে বিবাহের অনুষ্ঠানে। নিমন্ত্রিত ভদ্রলোক আমার পাশেই বসেছিলেন। আমরা খেতে-খেতে একেবারে জেরবার হয়ে গেছি। প্রায় মরে যাবার দাখিল। ষাট সত্তর রকম আইটেম। শেষ আর হয় না। যেই মনে হল শেষ দেখা গেছে, সঙ্গে-সঙ্গে আর একটা। আর গৃহস্বামী চুনোট করা ধুতি আর গিলে করা ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরে পরীক্ষার হলের ইনভিজিলেটারের মতো ঘুরঘুর করছেন। হাতজোড় করে জনে-জনে বলছেন, ‘সামান্য আয়োজন, দয়া করে পাতে ফেলে রাখবেন না।’ আমার পাশের ভদ্রলোক চাপা অসন্তোষে অনেকক্ষণ গজগজ করছিলেন। পরিবেশনকারী যেই পাতে দুম-দুম করে গোটাকতক বোম্বাই আম ফেলেছেন, ক্ষিপ্ত ভোজনকারী এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে তাড়া, ‘তবে রে ব্যাটা! এই আম আমি তোর মুখে ঢোকাব।’

রোমানরা এইরকম প্রাণঘাতী আহারে অভ্যস্ত ছিলেন। খানাঘরের পাশে ছিল ‘ভমিটোরিয়াম’। ভোজনকারীরা মাঝে-মাঝে উঠে গিয়ে উগরে দিয়ে আসতেন। আমার এক বন্ধু প্রফেসানাল খাইয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন পোলাওভোজী। পরিবেশনকারী পোলাও এনেছেন। এক হাতা পাতে ফেললেন। তিনি অমনি ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘ওতে কী হবে ছোকরা! বালতিটা বসিয়ে দিয়ে যাও।’ এর পরের অবস্থাটা, আমার বন্ধু তার বাড়ির ছাতে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে আছে। পাশে এক লোটা জল। পেটে ভিজে গামছা। সারা রাত মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল ঢালছে।

আমার সহপাঠী সন্দীপ সান্যাল কমিক করত। তার একটা স্কেচ ছিল এইরকম : বিয়েবাড়ি। দু-জনের কাঁধে হাত রেখে মাথাটা উঁচু করে একজন বেরিয়ে আসছেন। ‘দাদা, এত খেয়েছেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি কি খেয়েছি, আমার পেছনে আসছে।’ পিছনে যিনি আসছেন, তিনি আসছেন ঝাঁকায় চেপে মুটের মাথায়। ‘দাদা এত খেয়েছেন?’ ‘আমি কি খেয়েছি, আমার পিছনে আসছে।’ পিছনে এল একটা খাট। বল হরি, হরি বোল।

সে-যুগ আর নেই। সে খাওয়াও নেই। এখন সব টুকটাকের যুগ। চামচিকির মতো ফিশফ্রাই। নুড়ির মতো রোল। শুকনো আলুর দম। ব্যাঙের নিতম্বের মতো মুরগির ঠ্যাং। হালুইকররা এখন ক্যাটারারদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। আমাদের ছাত্রজীবনে বাজার করার ট্রেনিং দেওয়া হত। ভালো খেতে হলে অভিজ্ঞ বাজার করিয়ে হতে হবে। সেই বয়সে মনে হত, এ কী যন্ত্রণা। পিতৃদেব আগে গোটা বাজারটা ঘুরে নিতেন। কয়েক হাজার লোক। গোটাকতক দামড়া গরু। সব একসঙ্গে চরকিপাক। তিন চারটে নানা মাপের চটের ব্যাগ হাতে ব্যাজার মুখে, পিছন-পিছন আমি। এই প্রাথমিক চক্করটাকে বলা হল, ‘সারভে’। এরপর ‘অ্যাটাক’। ওর কাছে পটল ভালো। লাগাও পটল। লাগাও, বলতে, বিক্রেতার ওপর নির্ভর নয়। ছোট্ট ঝুড়িতে বেছে-বেছে তোল। বাছার সময় মনে-মনে ছকে নাও, পটলের কী কী পদ হতে পারে। ফুল কচি ডালনায় যাবে। একটু ঘি ভাসা-ভাসা। মরিচ দেওয়া যেতে পারে। একটু পাকা—দু-ফালা করে ভাজা। মুগের ডালের সঙ্গে জমে যাবে। আর বেশ ডাঁটো—দোলমা হবে। ভিতর থেকে সব বীজ বের করে ভরে ফেল ছোলার ডালের পুর। মিহি মাছের পুরও যেতে পারে, অথবা নারকোল। পুর ভরার পর ‘স্টিচ’ করে ছেড়ে দাও ছাঁকা সরষের তেলে। ঝাঁঝালো, খাঁটি তেল। সুগন্ধে জল এসে যাবে নোলায়।

পটলের পাশেই পেঁপে। না ও পেঁপে চলবে না। পেঁপে আর একখানে। তার গড়ন পেটন ভালো। গা বেয়ে রস ঝরছে। টসটসে রঙ। দুটো জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। পাটনাই ছোলা ছাড়া পেঁপের তরকারি জমবে না। আর চাটনির জন্যে চাই আম আদা। পেঁপে মানেই চাটনি।

এইবার মোচা। মোচা দেখা গেছে বাজারের আর একপ্রান্তে এক চাষীর কাছে। ডউরে কলার মোচা। মোচার সঙ্গে নারকোল চাই। চলো এইবার নারকোল পাড়ায়। নারকোল, কাঁঠালি কলা, কলাপাতা, থোড়, রাঙালু, এইসব আর এক বিভাগ। ব্যাগ ক্রমশ ফুলছে। কোথায় যেন সাঁতরাগাছির ওল দেখা গিয়েছিল। চল সেইখানে। ওল ভাতে, সরষে বাটা দিয়ে মেখে, অতি সুস্বাদু। রক্ত পরিষ্কার হবে। রিয়েল সাঁতরাগাছি গলে একেবারে মাখন হয়ে যাবে। কালো কচুর ডাঁটা বড় লোভ দেখাচ্ছে। ছোলা আর নারকোল দিয়ে মিষ্টি-মিষ্টি এক ঘণ্ট অতুলনীয় স্বাদ।

হঠাৎ মনে হল, একটু সুক্তো খাওয়া দরকার। কাঁচা দুধ আর রাঁধুনির ফোড়ন দিয়ে। সুক্তোর জন্যে কী কী আনাজ চাই। ঝোলায় পেঁপে ঢুকেছে। কাঁচকলা চাই। কচি কাঁচকলা। একটু কচুর প্রয়োজন। কচু আবার শক্তি বর্ধক। লকলকে পলতা চাই। বরবটি চাই, বড়ি চাই। সরষে বাটা দিয়ে কচি ঢেঁড়স। আচ্ছা তা হলে ঢেঁড়স বাছতে হবে, একটি একটি করে। সে এক সুদক্ষ কাজ। ডানহাতের প্রথম আঙুল দিয়ে প্রতিটি ঢেঁড়সের ডগার দিকটা সামান্য নুইয়ে দেখতে হবে নমনীয় কি না! পটাস করে মুচড়ে গেলেই বুঝতে হবে বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে। খেতে গেলেই ত্রিশঙ্কুর মতো টাগরা আর গলার মাঝখানে আটকে থাকবে। হড়কে নেমে যাবে না। একটা ‘সেলফ প্রপেলড’ ‘অফিস টাইম’ মেনু আছে। অফিসে যাবার তাড়াহুড়োর সময় কিছু করতে হবে না, জিভে ফেলে দাও। হড়কে চলে যাবে পেটে। সেটা হল লাল গলাগলা ভাত। বিউলির ডাল, কচু আর ল্যাললেলে ঢেঁড়স। পা স্লিপ করে পড়ে যাবার মতো এক একটা দলা সাঁত করে পেটে। হঠাৎ মনে হল, ‘লিফি ভেজিটেবিলস’ কিছু প্রয়োজন। ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার, পেটের গুমোট ভাব কাটাবার জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাহলে পুঁইশাক কেনা যাক। পুঁইয়ের ফর্মূলাটা একবার ঝালাই করে নেওয়া হল। পুঁই চায় কুমড়ো। কুমড়ো কেনা কি অতই সহজ। লাল চিনি কুমড়ো। বিক্রতোর বঁটিতে যখন কাটা হবে, তখন মনে হবে মোলায়েম সিল্ক। ভূতি আর বীজ দুটোই কম হওয়া চাই। ক্ষার, ক্ষার অদ্ভুত এক গন্ধ। পুঁই হল, কুমড়ো হল, এইবার যে একটা মাছের মাথা চাই। কাঁটা কানকো মিশিয়ে যে-বস্তুটি হবে তারই নাম ছ্যাঁচড়া। খেতে সুস্বাদু। কিন্তু মানুষও ছ্যাঁচড়া হয়। ছ্যাঁচড়ামিটা অসহ্য।

সবাই বাজার করতে পারেন না। বাজার করতে-করতেই মেনুটা ভিস্যুয়ালাইজ করতে হয়। জানা চাই, কার সঙ্গে কী যাবে। সেইটাই তো আনন্দের। কে আর কত খেতে পারে। আর সময়ই বা কোথায়। খাওয়ার মজা তো নিরামিষে। পাতলা মুগের ডাল, কাঁচা সরষের তেলে কচা-কচা পোস্তোবাটার বাটিচচ্চড়ি। তাইতে আবার লম্বা লম্বা কাঁচা লঙ্কা ফেঁড়ে দেওয়া। পৃথিবীর কোথায় এমন সুস্বাদু পদ পাওয়া যাবে। মাছ, মাংস হল ফাঁকিবাজি। রাঁধুনির কেরামতি যত নিরামিষ রান্নায়। বাজরে গিয়ে লাল নটে দেখলে মন নেচে ওঠে। কি আর এমন জিনিস। এক অধ্যাপিকা আমাকে একবার সামান্য মশলা দেওয়া সেদ্ধ-সেদ্ধ নটে শাক খাইয়েছিলেন। সরু চালের ভাতে যেই ডলে দিলুম, অমনি ম্যাজেন্টা রঙ। সামান্য সেই শাকেরই কী স্বাদ রান্নার গুণে। এখনও জিভে লেগে আছে আমার। দুধ দিয়ে সামান্য চালকুমড়ো এমন রাঁধা যায়, সবাই মাছ-মাংস ফেলে ছুটে আসবেন। এই তো শীত আসছে। ভাবতেও ভালো লাগে। বাজার কেমন সেজে উঠবে। সামান্য মুলো তারও কী শোভা। যেন হাতির দাঁত। পেটে ঢোকার পর কী ফোর্স! আমি নাম রেখেছি—টাস্ক ফোর্স। হালকা ক্রিম রঙের ঠাস ফুলকপি। ওপরটা যেন ভেলভেটের মতো মসৃণ। গোট-গোটা মটরশুঁটি। চন্দ্রকান্ত না চন্দ্রমুখী আলু। প্রায় সেই সাবেককালের নৈনিতাল আলুর জাত। ছাঁকা তেলে আলু আর ফুলকপি ভেজে, কড়াইশুঁটি ছড়িয়ে, অল্প জলে একটু ভাপা-ভাপা তরকারি সঙ্গে ফুলকো লুচি। বরাতে জুটুক না জুটুক, চিন্তাতেও সুখ। প্রকৃত ভেটকি মাছ, বাঁধাকপি ও কড়াইশুঁটি সহযোগে, সুখের অপর নাম।

খাওয়ার চেয়ে নানারকম খাওয়ার চিন্তায় অনেক আনন্দ। মাঝেমধ্যে রান্নার বই, পত্রিকা খুলে বসি। রান্নার কথা পড়ি। রান্নার ছবি দেখি। একালে অনেক কিছুর ছবি দেখেই শান্ত থাকা ভালো, যেমন গলদা চিংড়ি কি গঙ্গার ইলিশ। মাঝে-মাঝে ভালোভাবে খাবার টেবিলটা সাজানো যেতে পারে। স্যালাডের চেয়ে সুন্দর ডেকরেশান আর কী আছে। মানুষের সুখের চিত্র যখন সে বাজার করে ফেরে। ব্যাগ থেকে উঁকি মারছে কচি একটা লাউ ডগা। সবুজ, সতেজ কিছু কড়াইশুঁটি। একটি বেগুনি রঙের চকচকে বেগুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *