রানি
শতচ্ছিন্ন ফ্রকপরা বাচ্চা একটি মেয়ে, কাঁধে তার একটা চটের ব্যাগ কাশীপুর, চিৎপুরের রাস্তার বাঁ-ধারের ফুটপাথ ধরে নেচে-নেচে চলেছে। মেয়েটির মুখটি ভারী মিষ্টি। চুলে জট ধরেছে। তার শীর্ণ হাত দুটোয় কে দুটো কাচের চুড়ি পরিয়ে দিয়েছে। সে রাস্তা থেকে এটা-ওটা তুলে তার চটের ব্যাগে পুরছে আর মাঝে-মাঝে নেচে নিচ্ছে। কীসের এত আনন্দ? কিছু না থাকার আনন্দ। কোমরের কাছ থেকে লাল রঙের ফ্রক ফালা হয়ে ঝুলছে মেয়েটি মাঝে-মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে। মাঝে-মাঝে আপন মনে হাসছে। অদৃশ্য কী যেন একটা একমাত্র সেই দেখতে পাচ্ছে, যা খুব আনন্দের। এক জায়গায় তিনটে বাচ্চা কুকুর ঘোঁতঘোঁত করে খেলা করছিল। কাঁধের ঝোলা নামিয়ে মেয়েটি বসে পড়ল। কুকুর তিনটে তাকে ঘিরে নাচতে লাগল। যেন হারানো বোনটি তাদের ফিরে এসেছে। একটা বাচ্চা তার পায়ের কাছে ওলটপালট খাচ্ছে। একটাকে সে কোলে নিয়েছে। আরে একটা তার পিঠ বেয়ে কাঁধে ওঠার চেষ্টা করছে। এদিকে ব্যস্ত রাজপথ ধরে বিষয়ী বুঝদার মানুষেরা নিজের-নিজের ধান্দায় ছুটছে। ছুটছে মোটর গাড়ি। পেছনের আসনে এলিয়ে আছে অর্থক্লিষ্ট কাতর মানুষ। কারুর নজর নেই দরিদ্র অথচ তৃপ্ত ওই দেবশিশুটির দিকে। টাকার চাকার ঘোরা এই দুনিয়ায় মেয়েটি একটি পরগাছা। আগাছার মতো। তার আপনজনেরা নিশ্চয় আছে। হয় তো মা-ও আছে, কোথায় কোনও বস্তিতে কোলের আর একটা শিশুকে নিয়ে বড়ই ব্যস্ত। এই মেয়েটির কাঁধে চটের একটা ব্যাগ তুলে দিয়ে বলেছে, যা, যা-পারিস কুড়িয়ে নিয়ে আয়। এমনও হতে পারে, এই কাজটা তার মায়েরই। নিজে অসুস্থ হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। মেয়ে বলেছে, আমিই যাচ্ছি, মা। মেয়েটির ধারণাই নেই। কত ধানে কত চাল। একটা পেট চালাতে কত মেহনত। চটের ঝোলাটা তার চেয়ে বড়। রাস্তায় ঠেকে যাচ্ছে।
কুকুর তিনটেকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। পাশেই ছিল একটা ল্যাম্প পোস্ট। ল্যাম্প পোস্টটাকে এক হাতে ধরে সে ঘুরতে লাগল। একজন ব্যস্ত মানুষ পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে বাধা পেয়ে মাথায় একটা চাঁটা মারল। মেয়েটি কিছুই মনে করল না। সে জানে, অনেক কাক আছে। সুযোগ পেলেই ঠোকরাবে। ঘোরা বন্ধ করে সে আকাশের দিকে তাকাল যেন প্রিয় সখাকে দেখছে। মনে হয়, কিছু বার্তা বিনিময় হল। তা না হলে হাসবে কেন?
ফুটপাথের একপাশে সেই মজার মানুষটি তার মজার দোকান পেতে বসে আছে। একটা নীল প্ল্যাস্টিকের চাদরের ওপর খুচরো খাচরা নানা জিনিস। প্ল্যাস্টিকের ফুল। খেলনা। রবারের বল। চিরুনি। গা ঘষার বুরুশ। কাঁচি। ছোট ছোট প্ল্যাস্টিকের বালতি, মগ, সেফটিপিনের পাতা, নাইলনের দড়ি। মেয়েটি কিছুটা দূরে উঁচু হয়ে বসে দু-গালে ছোট-ছোট দু-হাত রেখে এক মনে অনেকক্ষণ দেখল। দেখতে-দেখতে আপনমনে হাসল। মনে-মনে তার অনেক কিছু কেনা হয়ে গেল। চুলে জট হয়ে হলুদ রঙের চিরুনিটা সে অবশ্যই কিনে থাকবে। ছিটছিট রঙের একটা বল কি আর কেনেনি? কিনেছে ছোট একটা বালতি। রাস্তার কলে জল ধরে মাথায় ঢালবে। মায়ের জন্যে কিনেছে একপাতা সেফটিপিন। কেনাকাটা শেষ করে সে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। চোখে-মুখে বেশ একটা তৃপ্তির ভাব। জরুরি একটা কিছু মনে পড়েছে তার। বিশাল থলেটা কাঁধে তুলে নিয়ে আবার তার চলা শুরু হল। একজন ফলওয়ালা বসে আছে। পরনে চেকলুঙ্গি। পেটের ওপর থেকে গেঞ্জিটা ভাঁজ করে বুকের ওপর তুলে দিয়েছে। বিশাল ভুঁড়িটা লটকে আছে কোলের ওপর। নিটোল একটা ভুঁড়ি। সামনের ডালায় খোলা খোলা আঙুর আর আপেল। মেয়েটি থমকে দাঁড়াল। সে আঙুর বা আপেল দেখছে না। ওসব তার কাছে অখাদ্য। মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লোকটির ভুঁড়ির দিকে। এত সুন্দর ভুঁড়ি সে কম দেখেছে। ফলওয়ালার ভারী মুখে ছেলেমানুষের মতো সরল দুটি চোখ। লোকটি ইশারায় মেয়েটিকে কাছে ডাকল। অ্যালমুনিয়ামের একটা গেলাস দিয়ে রাস্তার উলটো দিকের কল থেকে জল এনে দিতে বললে। থলেরেখে গেলাস হাতে মেয়েটি রাস্তার এপারে থমকে দাঁড়াল। ভারী-ভারী লরি যাচ্ছে। স্কুটার যাচ্ছে। এই বয়সেই সে পথের নিয়মকানুন শিখে গেছে। রাস্তা ফাঁকা হতেই সে ছুটে ওপারে কলের কাছে চলে গেল। অনেকেই জল নিচ্ছে। মেয়েটি একজনের হাতের তলা দিয়ে গেলাসটি পেতে দিল জলের ধারায়। এইটুকু বুদ্ধি তার আছে যে, গেলাসটা জলভরার আগে ধুয়ে নিতে হয়। এক গেলাস জল ভরে তার কচি ক্ষুদ্র হাতের চাপা দিয়ে ফিরে এল ফলওয়ালার কাছে। ফলওয়ালা ঢকঢক করে জল খেল। মেয়েটি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার্তের সেই তৃপ্তিটুকুর স্বাদ নিল। ফলওয়ালা গেলাসটি গোপনীয় স্থানে রেখে গোটাচারেক আঙুরের ছোট্ট একটা স্তবক মেয়েটির হাতে দিতে গেল। সে তার থলেটা কাঁধে তুলে নিয়ে আঙুর নেওয়ার ভয়ে ছুটে পালাল। লোকটির তৃপ্তিই তার পারিশ্রমিক, চারটে আঙুর নয়। এরপর সেই স্বর্গীয় মেয়েটিকে আর দেখা গেল না। রাজপথ ছেড়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। অন্য কোনও লোকালয়ে চলে গেল জীবনের অন্যতর বিস্ময়ের সন্ধানে। রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজের দিকে তার লক্ষ্য নেই। সে বেরিয়েছে টুকরো-টুকরো জীবনের বিস্ময় কুড়োতে। তার লালফ্রকের আধখানা কোমরের পাশ থেকে ছিঁড়ে পায়ের কাছে ঝুলছে, তবু সে এই পৃথিবীর ছোট্ট একটি রানি।