রানি ও অবিনাশ

রানি ও অবিনাশ

অবিনাশের চেহারাটা এমনিতেই বেশ লম্বা, পা ফাঁক করে দাঁড়ালে অনেকটা বড়ো ছায়া পড়ে। কিন্তু এখন ছায়াটা একটু বেশি লম্বা—রাস্তা পেরিয়ে গেছে। সকাল সাড়ে দশটা বাজে, এখন সকলেরই ছায়া ছোটো-ছোটো, আর একটু বাদেই বিন্দু হয়ে যাবে—অথচ অবিনাশের ছায়াটা এমন বিচ্ছিরি লম্বা হল কী করে? রাত্তিরের দিকে পিছন থেকে আলো পড়লে ছায়া আপনি লম্বা হয়ে যায়, অনেক সময় অতিকায়, পঞ্চাশ-ষাট ফুট পর্যন্ত, কিন্তু এখন সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। অবিনাশ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আলাদা কোনো আলোর খোঁজ করল—কিছুই নেই। তা হলে কী করে এতবড়ো ছায়া—পিচের রাস্তা পেরিয়ে ওপাশের গ্যাসপোস্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে তার মাথা। যাই হোক, ও নিয়ে আর অবিনাশ ব্যস্ত হল না, বিজ্ঞানের আবিষ্কার-ফাবিষ্কার যত বেশি হচ্ছে—ততই অলৌকিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে—সে ভাবলে।

ভারী ভারী বাসগুলো তার ছায়ার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, অনেক ব্যস্ত মানুষ, রিকশা—এমনকি ঠেলাগাড়িও চলে যাচ্ছে তার ছায়ার বা কাঁধের ছায়া মাড়িয়েই—যাই হোক, ব্যথা তো আর লাগছে না। তবু, অবিনাশ কয়েকবার সরে সরে দাঁড়াল।

প্রজাপতিরঙা ছোটো ছোটো মেয়েরা স্কুল ছুটির পর বেরিয়ে আসছে—অবিনাশ দ্রুত চোখ চালিয়ে দিচ্ছে ওদের মধ্যে একবার করে—না সর্দারনিরা এখনও বেরোয়নি। মেয়েদের সাইজ ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। কচি কচি মেয়েদের পর এখন আসছে ডাঁসা মেয়েরা। ওয়ান-টু থেকে ক্লাস নাইন-টেনের মেয়েদেরও ছুটি হয়ে গেল। এমনকি দু-একটা মেয়ের চেহারা দেখে এখন আর ছাত্রী কি মাস্টারনি বোঝা যায় না। তবে, চশমা-পরা কালো ঠোঁট দুজন শিক্ষয়িত্রী না হয়ে যায় না। এমনও হতে পারে, রানি আজ স্কুলে আসেনি। অথবা অন্য স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। কতদিন আগেকার শোনা খবরে এসেছে অবিনাশ। অথবা, রানি হয়তো এখন আর চাকরি-টাকরি করে না। ওর স্বামীর এতদিনে যথেষ্ট পদোন্নতি হবার কথা। অফিসারদের বউদের কি আর মাস্টারি করলে মানায়! কিন্তু অবিনাশ শেষপর্যন্ত দেখে যাবে। আর ক-মিনিট—এরপরই তো দুপুরের ছেলেদের স্কুল শুরু হয়ে যায়—সুতরাং, আর বেশিক্ষণ নিশ্চিত ভিতরে বসে থাকবে না রানি, যদি স্কুলে এসে থাকে।

প্রথমে যেমন জাহাজের মাস্তুলটুকু শুধু দেখা যায়, তেমনি দূরে অবিনাশ দেখতে পেল রঙিন প্যারাসোল, একটি সুডৌল হাত—মুখ না দেখতে পেলেও অবিনাশ চিনতে পেরেছে—ওই হাঁটার ভঙ্গিটা তার খুব চেনা। হুঁ, এখনও বেশ শৌখিন আছে দেখছি, চমৎকার কায়দায় শাড়িটা পরেছে, ফুলহাতা মিডভিকটোরিয়ান ব্লাউজ, শান্তিনিকেতনের চটি। ইস্কুলে কাজ করলে তো এসব শখ বেশিদিন থাকে না। দিদিমণি দিদিমণি দেখাচ্ছে না যা হোক। তবে একটু মোটা হয়েছে ঠিকই।

অবিনাশ এগিয়ে গেল না। আর একটা সিগারেট ধরাল। আগে চোখাচোখি হোক না। আধ ঘন্টার ওপর অবিনাশ দাঁড়িয়ে আছে, লোকেরা কি তাকে লক্ষ করছে? পাড়ার ছোঁড়ারা না আবার আওয়াজ দেয়। যাকগে। বাসে উঠে পড়বে না তো টপ করে।

রানি কিন্তু এদিকে তাকাল না। ছাতা না বন্ধ করে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। সুতরাং, অবিনাশই এগিয়ে গিয়ে ঘুরে কোনো কথা না বলে ওর সামনে দাঁড়ালো। বললে, চিনতে পারো?

একি, তুমি? রানি যেন খুব বেশি অবাক হয়নি। কিন্তু প্রকাশ্য রাস্তাতেই অবিনাশের হাত চেপে ধরলো। এতদিনে মনে পড়ল অভাগিনীকে? একটু দয়া-মায়া নেই শরীরে তোমার? মেয়েটা বেঁচে আছে কি মরে গেছে, একটা খবরও নিলে না।

সত্যি, কতদিন পর তোমাকে দেখলুম, রানি।

পাঁচ বছর আট মাস।

অবিনাশ চমৎকৃত হয়ে গেল। রানি কি প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস গুনছে নাকি? না, টপ করে মুখে যা এল বলে দিল। পরে মিলিয়ে দেখতে হবে। শেষ কবে দেখা হয়েছিল—সেই আলিপুরের ট্রামে না শশাঙ্কর বিয়ের সময়, না, —যাকগে যাক। রানি ওর বাহু ছুঁয়ে আছে। অবিনাশেরও ইচ্ছে করল রানির কাঁধে হাত রাখে—কিন্তু এইভাবে রাস্তায় ওর ছাত্রী-ফাত্রি বোধহয় দেখে অবাক হবে। থাক। তুমি কেমন আছ রানি?

ভালো নেই। তোমার জন্য সবসময় মন কেমন করে। বলেই রানি হেসে ফেলল। তারপর হাসতে হাসতেই দুষ্টুমির হাসি, গোপন করতে না পেরে বলল, বিশ্বাস হল না তো? সত্যিই কিন্তু হেসে ফেলল, তোমার জন্য খুব মন কেমন করে!

থাক আর ইয়ার্কি করতে হবে না। শরীরটা নষ্ট করলে কেন? এরকম মোটা হতে হয়? কি সুন্দর ফিগার ছিল তোমার। এখন অত বড়ো বড়ো—

এই, অসভ্যতা করো না, লোকে শুনতে পাবে। কী হবে আর এই পোড়া শরীরের দিকে নজর দিয়ে। আর তো আমার কেউ স্তুতি করার লোক নেই। আমি ঘরের বউ।

কেন, স্কুলের সেক্রেটারি? তিনি বাড়িতে মাঝে মাঝে চা খেতে ডাকেন না? কিংবা, পাড়ার ছেলেরা, স্বামীর বন্ধু, অথবা পাশের ফ্ল্যাটের কোনো সংগীতরসিক, তোমার স্তাবক নিশ্চিত এখনও অসংখ্য।

না, রানি ছদ্মম্লান গলায় বলল, আবিসিনিয়ার রাজকুমার ছাড়া আমার রূপের প্রশংসা আর কেউ করেনি!

এটা একটা পুরোনো ঠাট্টা। রানির চেহারাটা ছেলেবেলায় ছিল ভারি সুন্দর, খুব কোঁকড়ানো চুল আর ফরসা রঙের জন্য ওকে অনেকটা রানি এলিজাবেথের (প্রথম) মতোই দেখাত। ওর নাম আসলে প্রতিমা, কিন্তু সবাই ‘রানি! রানি’ বলে ডাকে। কিন্তু অবিনাশকে কোনোক্রমেই রাজা বা রাজকুমার বলা যেত না ছেলেবেলায়। ছেলেবেলা থেকেই ওর চেহারাটা চোয়াড়ে, কাঠখোট্টা, রং বেশ কালো। তাই রানি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘আহা, সব রাজকুমারই কি সুন্দর হবে নাকি? আফ্রিকার রাজকুমাররা, যত বড়ো রাজার ছেলেই হোক না—কালো কুচ্ছিৎতো হবেই! তুমি আমার আবিসিনিয়ার রাজকুমার!’

রানি জিজ্ঞাসা করল, এখন কি চাকরি-টাকরি করছ?

কিচ্ছু না। বিদেশে গিয়েছিলুম, ফিরে এসে আবার বেকার!

ফিরলে কেন?

আমি বিদেশে গিয়েছিলুম, তুমি জানতে?

জানতুম না? সব খবর রাখি। দেখা না হলে কি হয়। ফিরলে কেন এত তাড়াতাড়ি?

তোমার জন্য মন কেমন করছিল!

দুজনেই আবার হেসে উঠল অনেকক্ষণ। রানি বলল, জান, আমার এখন সাড়ে তিনশো—চারশো টাকা রোজগার। আমাকে বিয়ে করলে এখন তোমাকে বসিয়ে খাওয়াতুম। কি, আমাকে বিয়ে না করার জন্য এখন তোমার অনুতাপ হয় না?

মোটেই না। খুব বেঁচে গেছি। প্রথম প্রথম, তুমি যখন ওই হুঁৎকোটাকে বিয়ে করলে, প্রথম দু-তিন মাস বিষম কষ্ট হয়েছিল। মনে হত, অবিশ্বাসিনী, ছলনাময়ী নারী। বুক ফেটে যেত। মনে হত, সব মেয়েই এই রকম। তারপর বুঝতে পারলুম, খুব বেঁচে গেছি! ওফ! বন্ধু-বান্ধবদের তো দেখেছি—বিয়ে করে এক একজন লেধরুস হয়ে যাচ্ছে, কীরকম বোকা বোকা তেলতেলে মুখ হচ্ছে এক একজনের। আমি কত খোলা হাত পা আছি—যখন খুশি বাড়ি ফিরতে পারি, জামার তলায় ময়লা গেঞ্জি পরলে ক্ষতি নেই, পকেটে পয়সা থাকল বা না থাকল যে-কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে পারি।

কী নিষ্ঠুর, বাবা। অন্তত মিথ্যে করেও তো বলতে পারতে আমার জন্য কষ্ট হয় তোমার।

মিথ্যে কথা বলার কি আর বয়স আছে! বুড়ো হয়ে গেলুম প্রায়, আমার বয়েস বত্রিশ, তোমারও তো আটাশ! নাকি আরও বেশি, তখন বয়েস ভাঁড়িয়েছিলে!

এখন সে-সন্দেহ হচ্ছে কেন?

বাঃ, পাঁচ বছরে যদি কারুকে দশ বছরের বুড়ি হতে দেখি, তবে সন্দেহ হবে না!

যাঃ মিথ্যে! মোটেই দশ বছর নয়! দু-বছর ভাঁড়িয়েছিলুম, এখন আমার তিরিশ। আর প্রেম করা—বাহাদুরি তো জানি, লাজুক কোথাকার—এখনও নিশ্চয়ই মেয়েদের গায়ে হাত দিতে হাত কাঁপে। আমিই তো তোমাকে প্রথম সিডিউস করেছিলুম। তাও কী ভয়—

সেদিন আর নেই! বিদেশে অন্তত শ-খানেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছি।

ওসব বীরত্ব আমার কাছে দেখাতে হবে না। আমার চেয়ে আর কেউ বেশি চেনে না তোমাকে।

একটু থেমে রইল দুজনেই। অবিনাশ রানির সারা শরীরে চোখ ঘোরায়। রানি পাশ-চোখে তা লক্ষ করে হাসে।

সত্যিই বুড়ি হয়ে গেলুম। ইস্কুলে যখন মাস্টারনি সেজে বসে থাকি গম্ভীর হয়ে, এক এক সময় কীরকম হাসি পায়। জীবন কাটিয়ে দেওয়া তাহলে এত সহজ! কালকে জান—একটা মজার ঘটনা হয়েছিল। ক্লাস টেনের মেয়েরা একটা কাগজ গোপনে চালাচালি করছিল, আমি ধরে ফেললুম। প্রেমপত্র। একজন লিখেছে, বাকিরা সেটা কপি করে নিচ্ছে। খুব বকুনি দিলুম, আসলে কিন্তু মনে মনে খুক খুক করে হাসছিলুম। বেশ লিখেছে, আমারও কপি করে নিতে ইচ্ছে করছিল। এক জায়গায় কী লিখেছে জান, ‘তোমার জন্য আমার বুকের মধ্যে ব্যথা করে, যেন অসম্ভব জ্বর হয় আমার।’ কীরকম অসভ্য! আমাদের সময় আমরা লিখতুম ‘হৃদয়’, এখনকার মেয়েরা লেখে ‘বুক’। একটু দুঃখও হল আমার, আর কেউ নেই যাকে আমি আজ আর প্রেমপত্র পাঠাতে পারি।

কেন, আমার ঠিকানা জানতে না?

ইস! শখ কম নয়! জান চিঠিতে একটা রবীন্দ্রনাথের কোটেশান পর্যন্ত দেয়নি। তার বদলে কোন আধুনিক কবির, কি জানি, তোমারই হয়তো।

কেন, আমার কবিতা চেনো না? পড়ো না বুঝি আজকাল?

যা তা রাবিশ লিখছ তো এখন! কে পড়ে ওসব!

তোমার ইস্কুলের দু-একটা কচি মেয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও না।

ফাজলামি করতে হবে না। বাড়ি যাই—

রানি, তোমার সঙ্গে একটা দরকারি কথা ছিল।

আর দরকারে কাজ নেই। ঢের বেলা হল, তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলে আমার বাড়িতে হাঁড়ি ঠেলবে কে?

ও এবার বুঝি রাগ হল।

না রে, পাগলা, সত্যি বাড়ি যেতে হবে। এগারোটায় ঝি চলে যাবে—তারপর ছেলেটাকে ধরতে হবে না

দ্যাখ, খুকি, চালাকি করিস না। এতদিন পরে দেখা হল, অমনি বাড়ি আর বাড়ি! আচ্ছা ঠিক আছে, আমিও তোর সঙ্গে বাড়িতে যাই।

অত খাতির নয়। আমার কত্তা ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছে। দেবে গলা ধাক্কা।

তবে চল কোনো চায়ের দোকানে বসি। সত্যি একটা খুব দরকারি কথা আছে তোর সঙ্গে।

আবার তুই-তুকারি শুরু করেছিস!

তুই-ই তো প্রথম আরম্ভ করলি। তোর ছেলের কী নাম রেখেছিস?

তোর নামে নয়। ভাবছি অবিনাশ নাম দিয়ে একটা বাচ্চা কুকুর পুষব, সবসময় বুকে জড়িয়ে থাকব তাকে।

রানি তোকে খুব জরুরি একটা কথা বলতে এসেছিলুম!

কোনো দরকার নেই।

সত্যি, একটা বিশেষ কথা আছে।

না, অবি, কেন এসেছিস এতদিন পর। কেন ভেঙে-চুরে দিতে এসেছিস? বেশ তো আছি সংসার পেতে, চাকরি করছি, স্বামী-পুত্র নিয়ে ছেলেবেলার পুতুল খেলার মতো বউ বউ খেলছি। তুই চাস, সব টান মেরে ফেলে দিই আবার? কিন্তু তুই তো পাগল, তুই তো আমার পাশে থাকবি না জানি। কেন এসেছিস আমার সর্বনাশ করতে। তুই যা।

না রে, আমি এসেছি মাত্র একদিনের জন্য। শুধু একদিন। চল, কোথাও গিয়ে একটু বসে কথা বলি।

উপায় নেই যে। সবাই ব্যস্ত হয়ে খোঁজাখুজি শুরু করবে। এত দেরি করে তো কোনোদিন ফিরি না। ওই বাসটায় উঠি।

একটু দাঁড়া। আচ্ছা মনে কর খুব ট্রাফিক-জ্যাম। বাসে ওঠার কোনোক্রমে উপায় নেই। তাহলে কী করতিস, দেরি তো হতোই।

তাহলে হেঁটে যেতাম।

আচ্ছা চল, হেঁটেই যাই। এইটুকু সময় তোকে একটা কথা বলি। এখনও শীত যায়নি, রোদ্দুরের তাত নেই।

অবিনাশ এতক্ষণ লক্ষ করেনি যে, রানি ওর ছায়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বস্তুত, সূর্য এখন মাথার কাছে এসেছে, স্বাভাবিক এবং ছোটো হয়ে গেছে অবিনাশের ছায়া। অবিনাশ ঘুরে এসে রানির ছায়ার ওপরে দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে বেশ আরাম পেল।

রাস্তার লোকজন অনেক কমে গেছে। কোথায় পরের বাড়ি জলের দরের মতো নিলাম হচ্ছে, অধিকাংশ লোক সেখানেই ছুটে যাচ্ছে সন্দেহ কি। দুজনে দুজনের ছায়া সরিয়ে হাঁটতে লাগল।

রানি ওর রঙিন ছাতাটা অল্প অল্প দোলাচ্ছে। অবিনাশ ওর সুন্দর কারুকাজ করা হাতব্যাগটা টেনে নিয়ে বলল, দেখি কী আছে? ঠোঁট উলটে রানি বলল, কিছুই নেই, কী আর থাকবে—বাড়ি থেকে ইস্কুল আর ইস্কুল থেকে বাড়ি যাই। কটা খুচরো পয়সা আছে।

ভেবেছিলুম, কটা টাকা চুরি করব।

একসময় তো অনেক চুরি করেছ বাপু।

তা সত্যি। অনেক টাকা নিয়েছি তোর কাছ থেকে, রানি।

কেন আজ দেরি করিয়ে দিলি, এতক্ষণে কবে বাড়ি পৌঁছে যেতুম।

সত্যিই তোর ইচ্ছে করছে না আমার সঙ্গে থাকতে? একসময় তো আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করতিস।

ছেলেবেলায় ওরকম হয়। আগে তো বৃষ্টির জন্যও ছটফট করতুম। এখন বৃষ্টি পড়লে বিরক্ত লাগে।

অবিনাশ হঠাৎ গম্ভীর গলায় ডাকল, রানি?

রানি তখুনি জল কুলকুচি করার মতো হেসে বলল, এবার বুঝি বোকা-বোকা প্রেমের কথা শুরু করবি? খবরদার! এখন আর কচি খুকিটি নেই যে ভোলাতে পারবে!

কবেই-বা তোকে ভোলাতে পেরেছি। ছেলেবেলা থেকেই তো তুই পাকা একটি। প্রেমের কথা তো তুই-ই আমায় শিখিয়েছিস। তোর ওপরের ঠোঁটে পাতলা পাতলা ঘাম জমেছে। খুব ইচ্ছে করছে একটা চুমু খাই। এতক্ষণ কথা বলছি অথচ একটাও চুমু খাইনি তোকে। এরকম আগে কখনও হয়েছে?

তবে আর কি, রাস্তার মধ্যে শুরু করো। হাজারটা ক্যামেরায় ছবি উঠুক।

ওই জন্যই তো বলছিলুম কোথাও গিয়ে বসি।

ইস, কোথাও বসলেও যেন দিতাম আর কি! এখন থেকে কোথাও বসলে আমরা বসব টেবিলের দুপাশে।

দেখিস চেষ্টা করে। তোর স্বামী যখন থাকবে না, দুপুরে একদিন বাড়িতে গিয়ে হাজির হব।

শাশুড়ি থাকে।

থাকুক। শাশুড়ি যেদিন গঙ্গায় স্নান করতে যাবে, আমি তক্কে তক্কে থাকব।

আমি দরজায় খিল দিয়ে থাকি। খুলব না। কেন খুলব? তুই আমার কে?

আমি জলের পাইপ বেয়ে উঠব।

কেন? তুই আমার কে?

আমি তোর সর্বস্ব! তুই-ই তো বলতিস।

ইস, কোথাকার সর্বস্ব রে! দেখি মুখখানা।

তুই আমাকে একেবারে গ্রাহ্যই করিস না রানি। আমি বিলেত ঘুরে এলুম হাজার হোক, আমি এখন একটা বিলেতফেরত।

ওরকম বিলেতফেরত গন্ডায়গন্ডায় রাস্তায় ঘুরছে। তুই আমাকে এতদিন পর বিলেত দেখিয়ে ইমপ্রেস করতে এসেছিস! কী অধঃপতন তোর।

রাস্তা থেকে একদিন জোর করে ধরে নিয়ে যাব।

চেষ্টা করে দেখিস। আমার গায়ে এখনও জোর আছে। তা ছাড়া এমন চেঁচাব যে রাস্তার হাজারটা লোক এসে গাঁট্টা মেরে তোর মাথা ফাটিয়ে দেবে। বেশ হবে।

ওসব লোকফোক আমাকে দেখাসনি। আমি অবিনাশ মিত্তির, ছেলেবেলা থেকেই গুন্ডা। একটা গাড়ি নিয়ে এসে চলতি রাস্তা থেকে তোকে টেনে তুলে নিয়ে যাব।

নিয়ে গিয়ে কী করবি?

তোর পায়ের তলায় আমার মুখ ঘষব।

রানি হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, এখুনি ঘষ না, এই যে দাঁড়িয়েছি, লোকে দেখুক, ক্ষতি নেই।

তারপর তোর মুখও ঘষবি, আমার পায়?

তার দরকার নেই। তোর ওই কুচ্ছিৎ পা-জোড়া সবসময় রাখা আছে আমার বুকের মধ্যে।

ও, তাহলে রানি সান্যাল রোমান্টিক হতে জানে।

সান্যাল নয়, রায়চৌধুরী এখন। পরস্ত্রী, মনে থাকে না বুঝি?

বাঃ। পরস্ত্রী। আয় না রানি, আমরা লুকিয়ে অবৈধ প্রেম করি। পরকীয়া প্রেম খুব ফাস্টক্লাস জিনিস।

অবৈধ প্রেমই যদি করব তবে পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে কেন? আমি বুঝি নতুন একজন জোগাড় করতে পারি না?

করেছিস নাকি এর মধ্যেই।

অবিনাশ রানির ছাতার একটা খোঁচা খেলো। ছাতার বাঁটের নীচে কাদা ছিল। অবিনাশের জামায় একটা গোল দাগ পড়ল। অবিনাশ যে সে-দাগটা তোলার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে আর একটা সিগারেট ধরাল—তাতেই খুশি ছড়িয়ে পড়ল রানির মুখে। ঈশ্বরের রাজত্বে কে কীসে খুশি হয় বোঝা যায় না। খুশি হয়ে রানি বলল, আজকাল এত বেশি সিগারেট খাস কেন?

তুই খাবি নাকি? আগে তো দু-একটা খেয়েছিস।

হ্যাঁ, আমি পরপুরুষের সঙ্গে দিনেরবেলায় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে রাস্তা দিয়ে যাই। তাহলে আর আমার বাকি থাকে কী?

অবিনাশ একটু চুপ করে রইলো। তাকিয়ে দেখল, ওদের ছায়া-টায়া কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এমন বিশ্রি রাস্তা—কোথাও একটা গাছ পর্যন্ত নেই যে ছায়া পড়বে। নিছক রোদ্দুর, কোনো মানে নেই। সিগারেটে জোর টান দিয়ে অবিনাশ বলল, সত্যি রানি, আমরা অনেক দূর সরে গেছি—অথচ মাত্র ছ-সাত বছর। তোর মুখ থেকে ‘পরপুরুষ’ শব্দটা কীরকম অদ্ভুত শোনাল, যেন একটা বিদেশি শব্দ, যেন আমি একটা লৌহমানব, হাতে তলোয়ার নিয়ে তোর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ, মনে আছে, প্রত্যেকদিন সকালে—তুই যখন কলেজে যেতিস—

থাক, পুরোনো কথা। আমি ভালো আছি অবিনাশ।

আমিও খুব ভালো আছি। বিশ্বাস কর আমি কোনো দুঃখের কথা বলতে আসিনি।

রাস্তাটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটা পথ আছে—নীচ দিয়েও আছে একটু সরু কাঠের রাস্তা। ওরা নীচ দিয়েই গেল। রেলিং ধরে দাঁড়াল দুজনে। নোংরা জলে অল্প স্রোত—অবিনাশ ওর সিগারেটের টুকরোটা ফেলল জলে, ব্রিজের নীচ দিয়ে ভেসে গেল। রানি একেবারে জল ভালোবাসে না। অবিনাশ রানিকেই পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে জানে—জলের প্রতি যার বিন্দুমাত্র আসক্তি নেই। যেমন রানি এক্ষুনি ওই জলে থুতু ফেলল।

রানি বলল, এইবার শুনি কী দরকারটা? কী এমন দরকার আমার কাছে? ইস, কত বেলা হয়ে গেল যে!

অবিনাশ জানত রানি এইবার ওকথা বলবেই। কিন্তু অবিনাশ দ্বিধা করছে। ঠিক কিরকমভাবে আরম্ভ করবে বুঝতে পারছে না। রানি ওর দিকে দুটো সম্পূর্ণ চোখ তুলে বলল, কী?

তোকে একটা কথা বলব রানি। তুই কিন্তু কিছু মনে করতে পারবি না। দূরে সরে গেলেও আমি তো তোর সেই অবিনাশই আছি।

অত ভনিতার দরকার কী? কী চাই বল না।

রানি তোর বুকে সেই তিলটা আছে এখনও।

হুঁ। ওর খুব একা একা লাগত—তাই পাশে আর একটা নতুন তিল উঠেছে। যাক বাজে কথা—দরকারি কথাটা কী? কী চাইতে এসেছিস এতদিন পর?

মুক্তি। এককথায় বলতে গেলে—

সে আবার কী? তুই-ও আমাকে মুক্তি দিয়েছিস আমিও তোকে দিয়েছি।

বন্ধনটা আর কোথায়?

সে রকম নয়। তুই আমার শরীরকে মুক্তি দিসনি। আমার মন ছাড়া পেয়ে গেছে কিন্তু—

রানি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এই প্রথম অবিনাশের একটা কথা সে বুঝতে পারল না। সেই জন্যই বোধহয় অবিনাশের সারা মুখটা ও তন্নতন্ন করে খুঁজল। কোনো সংকেত নেই। অবিনাশ আবার বলল, বেশ থেমে থেমে ঠান্ডা গলায়—তোর কথা ভুলে যাবার পর—আমি বেশ কয়েকটি মেয়ের সংস্পর্শে এসেছি, আর, ইয়ে, মানে শুয়েছিও কয়েকজনের সঙ্গে—কোথাও তৃপ্তি পাইনি ঠিক। কেন পাইনি জানিস, সবসময় মনে হয়েছে, সত্যিকারের রহস্য যেন তোর শরীরেই লুকিয়ে আছে। তোর শরীর তো আমি জানি না।

এবার বাড়ি যাই।

না, না, শোন, আমার পক্ষে খুব জরুরি কথা। আমার জীবনমরণ সমস্যা। আমার পুরো ছেলেবেলাটা কেটেছে তোর সঙ্গে—তোর কথা, হাসি, পাগলামি, শরীরের গন্ধ অর্থাৎ যা কিছু ফেমিনিন—তার স্বাদ আমি তোর কাছেই পেয়েছি। তোকে মনে হত একটা রহস্যের সিন্দুক। তোকে চুমো খেয়েছি, তোর জামার বোতাম খুলে বুকে মুখ চেপে ধরেছি—কী অসম্ভব উথালপাথাল করত তখন মাথার মধ্যে। ছেলেবেলায় সক্কলেরই যা হয় আর কী। কিন্তু কোনোদিন তোর সঙ্গে শুইনি, সাহস পাইনি—ভাবতুম, অতখানি আমার সইবে না। ওই অসম্ভব মাধুর্য আমাকে পাগল করে দেবে। আমি টুকরো টুকরো হয়ে যাবো। এইসব আর কী। এখন দেখ, কত বদলে গেছি। চোয়ালের কাছে শক্ত দাগ পড়েছে, প্রেম-ফ্রেম ঘুচে গেছে মন থেকে, মদ খেতে শিখেছি খুব, মেয়েদের এখন অন্যভাবে চাই। অর্থাৎ মেয়েদের জানতে দিতে চাই না ওদের কাছ থেকে আমি কতখানি পাচ্ছি—খুব গোপনে, ওদের একদম বুঝতে না দিয়ে—আমার যেটুকু বিষম দরকার আমাকে নিতেই হবে। ওরা ভাববে বুঝি সাধারণ কাণ্ডকারখানাই হচ্ছে—আসলে কাক যেমন কোকিলের ছানাকে পালন করে না জেনে আমাকে একটা দুর্লভ জিনিস দিয়ে যাবে। তেমনি মেয়েরা সম্পূর্ণ নিজেদের অজ্ঞাতসারে ওদের শরীরটা পুষে রাখে। কিছুই মানে বোঝে না শরীরের। আমি চাই ওরা না জেনে—ওদের কোনোদিন বলব না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই আমি সম্পূর্ণ পাচ্ছি না কখন—সব সময় মনে হয় কিছু বাকি থেকে যাচ্ছে, একটি সম্পূর্ণ মেয়েকে কখনও পাইনি। তখনই তোর কথা মনে পড়ে—তোর কত-কিই তো আমি জানি—প্রায় গোটা জীবন—কিন্তু আমি তোর সম্পূর্ণ শরীর জানি না। তাই মনে হয়, সমস্ত রহস্য বা তৃপ্তি লেগে আছে তোর শরীরে, আমার জীবনের প্রথম নারীর কাছে। মানে, তুই কিছু মনে করছিস না তো—আমি অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি এ কথা বললুম বলে। তুই-ও তো তোর স্বামীর সঙ্গে শুচ্ছিস—আমি কি আর কিছু মনে করছি। তুই নিশ্চয়ই আশা করিসনি—আমি সারা জীবন তোর বিরহে ব্রহ্মচারী হয়ে থাকব।

বয়ে গেছে আমার মনে করতে। যাক, এ সব প্রলাপ শুনে আমার লাভ কি। আমি কী করব?

তুই বুঝতে পারছিস না রানি? তোর উচিত আমাকে সাহায্য করা।

কীরকম সাহায্য? আমার কাছে কী চাইছিস?

একটি দিন।

তার মানে?

আমি তোর সঙ্গে একবার—

তাতে কী লাভ হবে?

আমি নিঃসন্দেহ হতে চাই যে—আসলে তুই-ও খুব সাধারণ। অন্য মেয়েদেরই মতো। তোর শরীরেও কোনো আলাদা রহস্য নেই। তোকে হারিয়ে অন্য মেয়েকে পেলেও আমি আসলে একটি সম্পূর্ণ মেয়েকেই পাব। তার বেশি আর কিছু পাবার নেই।

রানি হঠাৎ চোখ দুটো খুব নীচু করল। যেন ওর চোখ দুটো একেবারে ঢুকে গেল মুখমণ্ডলের মধ্যে। কপালের নীচে আর কিছু নেই, সাদা। সেইরকম ভাবেই বলল, অসভ্য, ইতর কোথাকার।

অবিনাশ বিষম অবাক হয়ে গেল। একটু দ্বিধা করে আলতোভাবে রানির কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, একি রানি, তুই রাগ করছিস? আমি কিন্তু তোকে আঘাত করার জন্য বলিনি। আসলে, ভেবে দ্যাখ, আমরা দুজনেই তো খুব সাধারণ। অন্যদেরই মতো। আমি শুধু নিঃসংশয় হতে চাই।

রানি ফুঁসে উঠে বলল, না, আমি সাধারণ নই। আমি অসাধারণ!

এটা তো ছেলেমানুষি! আমাদের এত বয়েস হল, এখন তো আমরা জানি। তোকে না পেলে আমি সবটুকু রহস্য পাব না—একি সম্ভব নাকি!

হ্যাঁ তাই। তুই যেখানেই যা—তৃপ্তি পাবি না। তোর প্রাণ একটা কৌটোয় পোরা ভ্রমরের মতো আমার কাছেই থাকবে। আমি তাকে মুক্তি দেব না।

ওসব কিছু না, রানি। জীবন অন্য রকম। মানুষ বিষম ভুলে যেতে পারে। অনেক বদলে যেতে পারে। তুই একবার—

তারপর আমার কী হবে? একজন মাত্র মানুষের কাছেও আমি অসাধারণ থাকব না? অবি, তোকেও তো আমি সম্পূর্ণ পাইনি। একদিন পেয়ে যদি দেখি, তুইও সাধারণ, আমার স্বামীরই মতো—তাহলে আর আমার জীবনে কি রইল? তোকে দেখলে এখনও আমার বুক কেঁপে ওঠে। আজ প্রথম দেখে বিষম রক্ত ছলাৎ করে উঠল। যদি দেখি,—তুইও তাহলে, আমার এই চাকরি-করা, স্বামীর সংসার, ছেলে মানুষ-করা সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে না? আমার আর কী থাকবে তা হলে? আমার একটিও না-দেখা স্বপ্ন থাকবে না? একজনের কাছে অন্তত রানি হয়ে থাকব না? আমার জীবনে থাকবে না একজন অদেখা রাজকুমার? আমার আবিসিনিয়ার রাজকুমার! না, অবি, আমি সব কিছু জানতে চাই না। তুই দূর হয়ে যা।

কিন্তু জানাই তো ভালো। নিশ্চিত হবার মতো এমন তৃপ্তি আর নেই। জীবন শেষ করার আগে জেনে যেতে হবে, জীবনে আমার কী কী প্রাপ্য ছিল। রহস্যের ভাবনায় কাটানো খুব কুচ্ছিত।

তুই আর আমার সামনে আসিস না। কোনোদিন না। সবচেয়ে ভালো হয় তুই যদি এখন মরে যাস। তাহলে তোকে জেনে ফেলার কোনো ভয়ই আর থাকে না। তাহলেই তোকে আমি চিরকাল ভালোবাসতে পারব।

তুই ভুল করছিস। ওকে ভালোবাসা বলে না। কী দরকার ভালোবাসার। ভালোবাসা ছাড়াও জীবন খুব সুন্দর কেটে যেতে পারে। বড়ো কথা হল জানা। যদি তোকে—

আমি তোকে আর সহ্য করতে পারছি না, অবিনাশ। তুই আমার চোখের সামনে থেকে সরে যা। তোর চোখে আমি ফের পাগলামি দেখতে পাচ্ছি। তোর জন্য আমার মায়া হয়।

পাশ দিয়ে যে সমস্ত লোক হেঁটে যাচ্ছে—তারা কিছুই বুঝতে পারছে না, এমন শান্তভাবে কথা বলছে রানি! কিন্তু ওর মুখের একটি সামান্য রেখা দেখেও বোঝা যায়, ও দাঁড়িয়ে আছে ত্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো। অবিনাশ সত্যি বুঝতে পারছে না, হঠাৎ রানি কেন এমন রাগ করল। রানির ওপর জোর ছিল কত। কত হুকুম করেছে একসময়। ওর কথায় রানি একবার একহাত চুল কেটে ফেলেছিল নিজের। কলেজের মাইনের টাকা দিয়ে দিয়েছে অবিনাশকে। আজ একটা সামান্য কথায়—অবিনাশ বললে, আমি ঝোঁকের মাথায় বলছি না, রানি। অনেক ভেবেচিন্তে এসেছি। আমরা দূরে সরে গেছি, কিন্তু আমাদের শারীরিক মুক্তি হয়নি। তোর সংসার আমি নষ্ট করতে চাই না মোটেই। আমাদের জীবন আলাদা হয়ে গেছে—আমরা দূরে দূরেই থাকব। কিন্তু তার আগে—

হঠাৎ অবিনাশ দেখল রানি চলতে শুরু করেছে। পিছনে ফিরল না, যেন ও একাই চলে যাবে। কী ভেবে অবিনাশ ওকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না। মনে মনে আন্তরিকভাবে বিদায় জানাল রানিকে। ওখানে দাঁড়িয়েই ও আর একটা সিগারেট ধরাল। একা একা কিছু না ভেবে সিগারেট শেষ করল। সত্যি সেইটুকু সময় ওর কিছু মনে পড়ল না, রানির কথা তো নয়, সম্পূর্ণ সাদা মন ও নীচের ময়লা জলের স্রোত দেখল। পকেটে হাত দিয়ে একবার খুচরো পয়সাগুলো গুনে দেখল অনাবশ্যক। তারপর একটা ট্রামের টিকিট পাকিয়ে কান খুঁচতে খুঁচতে রানির জন্য হঠাৎ ও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল, আমি কি রানিকে অপমান করলাম? আমি তো মোটেই চাইনি। আসলে, যত বয়েস বাড়ছে, রানি ততই ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছে। আবার বছর পাঁচেক বাদে রানিকে এই কথাটা বুঝিয়ে বলা যায় কিনা—অবিনাশ পরে ভেবে দেখবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *