রাত বারোটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
আমি তখন মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দিতে পোস্টেড। যে দোতলা বাড়িটাতে আছি, সেটা আমাদের দুজনের পক্ষে বেশ বড়। উপরে-নিচে অনেকগুলি ঘরই ফাঁকা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বাঁহাতি পুবের ঘরটা আমার লেখাপড়া করবার, আর লম্বা-চওড়া বড় একটা বারান্দা পেরিয়ে পশ্চিমের ঘরটা শোবার। দক্ষিণের বারান্দায় ক’খানা চেয়ার ফেলা।
নির্ঝঞ্ঝাট নিরিবিলি বাড়ি। চারদিক গাছগাছালিতে ঢাকা। ইলেকট্রিক নেই। লণ্ঠনের টিমিটিমি।
তখন ঘটনাচক্রে পরলোকের চর্চার মধ্যে গিয়ে পড়েছি। বিকেলে কোর্ট থেকে আর কোথাও যাই না। টেবল নিয়ে বসে পড়ি দুজনে।
ঠিক প্ল্যানচেট নয়, বলা যেতে পারে টেবল-টার্নিং—স্বয়ং-লেখন। এমনিতে ক’পাতা জবানবন্দি লিখতে হাত বেঁকে বসে, আর এ দিন্তের পর দিস্তে ওড়াচ্ছি, ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নেই। এমন বোধ হয় কিছু লেখা আসে, যা অচেতন মনেরও বাইরে! হয়তো তারই জন্যে।
টেবলটাই বেশি আশ্চর্য করে। একটা ছোট চারপেয়ে টাইপরাইটার টেবল। এমনিতে বেশ ভারীই, কিন্তু যখন হাতের থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়, এঁকে-বেঁকে চলে আপনা থেকে, দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায়, তখন মনে হয় না এ শুধু আমাদের মনের জোরে হচ্ছে।
কত কে যে আসে। মানে লেখা হয়ে আসে। আমি অমুক, আমি তমুক। চেনার থেকে অচেনাই বেশি। আমি রেণু, আমি চুনী, আমি তারাপ্রসন্ন। আমি মহেশ্বরপাশার বিভূতি ঘোষ, মালদার নিরঞ্জন ব্যানার্জি, আমি তোমার সঙ্গে পড়তাম নোয়াখালি জিলা স্কুলের মহম্মদ সোলেমান।
কিছুই প্রমাণ হয় না। কত জায়গায় চিঠি লিখে খোঁজ নিয়েছি মেলেনি। লোক নয়, ঠিকানা নয়, বিবরণ নয়। সবই ধোঁয়া।
তবু কী জানি কেন, আবার বসি। কখনো-কখনো দুপুর রাত পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। কখনো কখনো তারও বেশি। মনে হয়, কী যেন আছে। আকাশে শব্দ ঠিক আছে, আমি কাঠের বাক্স হয়ে আছি বলেই ধরতে পারছি না। রেডিও সেট হয়ে উঠতে পারলেই ঠিক বেজে উঠব।
আমি সম্প্রতি অসম্পূর্ণ বলেই, আমি সম্প্রতি অসমর্থ।
ঢাকা গেণ্ডোরিয়ায় বিজয়কৃষ্ণের কাছে রামকৃষ্ণ গিয়েছিলেন আর বিজয়কৃষ্ণ গা টিপে টিপে দেখেছিলেন সত্যিই রামকৃষ্ণ। কিন্তু আসলে রামকৃষ্ণ তো যাননি। তেমন আধারই তেমন বস্তুকে আকর্ষণ করতে পারে।
আমি পারি না, আমি জানি না বলেও তো কিছু অপ্রমাণ হবার নয়।
সেদিন যেন অন্যরকম শুনলাম।
বসতেই লেখা হল: ‘সেই কখন থেকে বসে আছি।’
‘কে তুমি?’
একটি মেয়ের নাম লেখা হল। আত্মীয় নয় যদিও, চিনলাম। কে না চেনে। একটি সুগায়িকা কুমারী মেয়ে। কোকিলকণ্ঠী।
‘তা তুমি আমাদের চিনলে কী করে?’
‘বিকেলে গ্রামোফোনে আমার একটা রেকর্ড বাজালেন, তাই শুনে এসেছি।’ লেখা হল: ‘নিজের গান শুনতে এত ভাল লাগল। যদি আবার বাজান।’
এতেও কিছু প্রমাণ হয় না।
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী।
বিকেলে যথারীতি বসেছি টেবলে, শোবার ঘরে। যেমন আসেন, আমাদের হিতৈষী আত্মীয়েরা সঙ্গীসাথী নিয়ে এসেছেন। নাম-আদি লেখা হবার পর লেখা এল: ‘আমরা আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, আমাদের ছেড়ে দাও।’
এরকম তো হয় না কোনদিন। তাই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম: ‘কেন, এত তাড়া কিসের?’
লেখা হল: ‘আমাদের এখানে এইমাত্র একজন মহাপুরুষ এসেছেন। তাঁকে দেখবার জন্যে সবাই চলেছে, আমরাও যাব। আমাদের ছেড়ে দাও।’
ছেড়ে দিলাম: টেবল শান্ত হল।
রাত্রে আমার সহকর্মী এসে বললে, ‘রেডিওতে খবর এসেছে, মহাত্মা গান্ধীকে আজ বিকেলে গুলি করে খুন করা হয়েছে।’
তবে এই মহাপুরুষকে দেখবার জন্যেই কি ওখানে অত সোরগোল?
এতেও কি কিছু প্রমাণ হয়?
একটা লেখা শেষ হতে না হতেই আরেকটা লেখা—মনে হত একাধিক স্পিরিট এসে হৈ-চৈ করছে। পরস্পর ঠেলাঠেলি করছে।
‘আমি এই নতুন এলাম, আমারটা আগে শুনুন—’
‘আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি—’
ধমক দিয়ে উঠলাম: ‘তোমরা কেউ এসেছ বিশ্বাস করি না। কাজে প্রমাণ দিতে পার?’
‘ছোটখাটো কাজ দিলে হয়তো পারি।’
‘আমার পড়ার ঘরে তাকের থেকে কটা বই টেনে মেঝেতে ফেলে দিতে পার?’
পড়ার ঘরের জানালার পাল্লায় জোর শব্দ হল।
হাওয়া উঠছে বুঝি। জানালাটা বোধ হয় বন্ধ করিনি। টর্চ নিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি। দেখি কটা বই মেঝেতে পড়ে আছে।
বুক কাঁপতে লাগল। কিন্তু প্রমাণ হয়েছে বলে মানলাম না। বললাম ‘হওয়ার কাণ্ড।’
ফিরে টেবলে এসে বসতেই হিতৈষী আত্মার দল ধমকে উঠল: ‘খবরদার, এসব ম্যাজিক দেখতে চেও না। অনেক নিম্নস্তরের স্পিরিট আসে। সদ্য মৃতেরা নিম্নস্তরেই বেশি ঘোরাফেরা করে। নিম্নস্তরের স্পিরিটদের মধ্যে অনেকে মিথ্যাবাদী, প্রতারক। নানা বিভ্রান্তি ঘটিয়ে ক্ষতি করতে পারে। ওদের প্রশ্রয় দিও না।’
‘কিন্তু সদাত্মা পাব কোথায়?’
লেখা এল: ‘রাত বারোটার পর বসে! তখনই মহাপুরুষের অবতরণ করেন।’
‘শুধু অবতরণে কী হবে? চোখ যে শরীরায়ন দেখতে চায়? যাকে বলে মেটিরিইয়্যালাইজেশন।’
তারপরইে এল নমিতা চক্রবর্তী।
ইস্টারের ছুটিতে কলকাতা যাচ্ছি, যাবার মুখে বসলাম একদিন। চিনি না, জানি না, ডাকিনি, খুঁজিনি, হঠাৎ লেখা এল: ‘আমি নমিতা চক্রবর্তী।’
‘কী করতে?’
‘বি. এ পড়তাম।’
‘ঠিকানা?’
স্পষ্ট ঠিকানা দিল। লিখল, ‘আমি গত রবিবার মারা গেছি। আপনি আমার মাকে বলুন যেন অত কান্নাকাটি না করেন। মার কান্না দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। আর বলবেন—’
আর কোন স্পিরিট এসে বোধহয় নমিতাকে সরিয়ে দিল।
সৌভাগ্যক্রমে ঠিকানাটা আমাদের কলকাতার বাড়ির কাছে। ভাবলাম খোঁজ নিয়ে দেখি। হয়তো দেখব আমারই ‘রিসিভিং’ ভুল হয়েছে। ‘আজমীর গিয়া’-কে ‘আজ মর গিয়া’ লিখেছি।
নির্দিষ্ট রাস্তায় নির্দিষ্ট নম্বরের বাড়ি পেলাম।
‘এই বাড়িতে নমিতা চক্রবর্তী বলে কেউ থাকে?’ রাস্তার দরজার কাছে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম।
‘থাকত। গত রবিবার মারা গেছে।’
‘মারা গেছে?’
কেন, কী দরকার আর কোন কথাই যেন উঠতে পারে না এর পর। আস্তে আস্তে সরে পড়লাম।
নমিতার মার সঙ্গে দেখা করলে হত। কিন্তু দেখা করলেই অনেক ঝামেলার মধ্যে পড়ে যেতাম। মার কান্না আরো বাড়ত।
স্ত্রীকে বললাম, ‘এর পরেও প্রমাণ চাই? একটি ঠিকানাই বা কেন মিলবে?’
কান্দিতে ফিরে এসেছি। শুক্ল পক্ষ।
যথারীতি রাত বারোটায় পড়ার ঘর থেকে উঠেছি। লণ্ঠন দিয়ে বারান্দায় বেরুবার মুখে দাঁড়িয়েছি দরজায়। দেখি একটা দক্ষিণমুখো চেয়ার পুবমুখো করা, আর তাতে একটি তরুণী বসে। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে।
আমাকে দেখা মাত্রই তরুণীটি উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে পুবমুখো চেয়ার আবার দক্ষিণমুখো হয়ে গেল।
তরুণীটিকে আর দেখা গেল না।
শোবার ঘরে এসে স্ত্রীকে জাগালাম। বললাম, ‘টেবলে এখন একবার বসতে হয়।’
বসলাম। পেন্সিল স্ত্রীর হাতে চালান করে দিলাম।
‘আমি এসেছিলাম।’ লেখা পড়ল।
‘কে?’
‘আমি সেই নমিতা চক্রবর্তী।’
‘এসেছিলে মানে এখনও আসোনি?’
‘তখন মূর্তি ধরে এসেছিলাম, এখন—’
চারদিকে তাকালাম। কিছু দেখা গেল না। লেখা হল: ‘মাকে আমার কথা বলেননি কেন? আমার আরও কথা আছে। বারোটার আগে বসবেন।’
বললাম, ‘আমরা আসানসোলে বদলি হয়ে যাচ্ছি। সেখানে এস।’
‘আচ্ছা—’
‘পৃষ্ঠার বাকি অংশে একটা লম্বা দাগ দিয়ে চলে গেল নমিতা।
পরের বার কলকাতা যেতে কিছু দেরি হল। নমিতাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দু-তিনবার হেঁটে গিয়েছি। ইচ্ছে হয়েছে ওর ফটোটা দেখে আসি। কিন্তু কী জানি, যদি দেখা মূর্তির সঙ্গে মিলে যায়, যদি প্রমাণ অকাট্য হয়ে ওঠে, সেই ভয়ে যাইনি। মন্দ কী, সবই একটা সংশয়ের ধার ঘেঁষে রহস্যময় হয়ে থাক না।
নমিতার মা নিশ্চয়ই এতদিনে সামলে উঠেছেন।
আর তারপরেই তো আসানসোল।