রাত তিনটের পর
হাত বাড়িয়ে রেডিয়োটা বন্ধ করে পাশ ফিরে শুলাম৷ বিছানার পাশে রাখা হাত ঘড়িটায় রাত ঠিক তিনটে বাজে৷ একটু আগেই ঝড় হয়ে গিয়েছে৷ বৃষ্টি পড়েছে কি না জানি না৷ মাথার কাছের জানলাটায় আম গাছের ছায়াটা দুলে উঠছে বারবার৷ খানিকটা দূরে একটা কুকুর কয়েকবার ডেকে চুপ করে গেল৷ অন্যদিন হলে এসব ভাবনা মাথাতেই আসত না৷ আমার ছোট থেকেই রাত বারোটার আগে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস৷ মাঝে মাঝে দু-একটা দিন ছাড়া সে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি বললেই চলে৷ অথচ দিন-তিনেক হল কিছুতেই আমার ঘুম আসছে না৷ প্রথমদিন ঘুম হয়নি বলে একটা ঘুমের ওষুধও খেয়েছিলাম৷ তাতে কোনও কাজ হয়নি৷ আজ ওষুধের মাত্রাটা বেশি হয়ছে৷ আশা করেছিলাম তাতে কাজ দেবে, তবুও এই রাত তিনটে পর্যন্ত আমি দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি৷
আমার শরীর খারাপ নেই একেবারেই৷ এই ক-দিনে সেরকম পরিশ্রমও করিনি, শুধু রাতে শুতে এলেই এই সমস্যা৷ ঘুম আসছে না৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তাতে আমার সেরকম অসুবিধাও হচ্ছে না৷ রাতে ঘুম না হলে যেরকম চোখ লাল বা মাথা ব্যথা হওয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র লক্ষণও নেই৷ এই ক-দিনে কীরকম যেন পরিবর্তন হয়েছে আমার৷ একা থাকার জন্য কি না জানি না, চারপাশ সম্পর্কে আমার ইন্দ্রিয়গুলো বেশি সজাগ হয়ে পড়েছে৷
একা অবশ্য আমি আগে থাকিনি, তা নয়৷ আগের বছর বসন্ত উৎসবের সময় সুপর্ণা শান্তিনিকেতন চলে যাওয়ায় আমি একাই ছিলাম৷ তখন দিব্যি কেটেছে, দিনে অফিস, রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে লম্বা ঘুম৷ দিনগুলো যে কোথা দিয়ে কেটে যেত খেয়ালই হত না৷ এবার কিন্তু তেমন হচ্ছে না৷
দিন কতক হল আমার চিকেন পক্স হয়েছে৷ এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি তবু বুকে পিঠে মিলিয়ে প্রায় গোটা তিরিশেক ফোঁড়া ইতিমধ্যে গজিয়েছে৷ সুপর্ণার এর আগে পক্স হয়নি, তাই রোগটা শরীরে ঢুকেছে বুঝেই আমি তাকে একরকম জোর করেই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি৷ প্রথমটা গাঁই-গুই করলেও পরে গায়ে ফোঁড়া বেরোনোর ভয়ে কি না জানি না, সে যেতে রাজি হয়ছে৷ তারপর থেকে আমি একা, তার সঙ্গে এই অনিদ্রা৷
এ তো আচ্ছা জ্বালাতনে পড়া গেল৷ চিরকাল আমি একটু ঘুমকাতুরে, তিনদিন না ঘুমিয়ে কী করে যে সুস্থ আছি সেটাই আশ্চর্যের৷ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ ঘুম যখন হবে না, তখন ঘরের আলোটা জ্বালানো যাক৷ আমাদের ঘরটা ছোটখাটো, আসবাবপত্র সেরকম কিছু নেই৷ দুটো মানুষের দিন চলে যাওয়ার মতো যতটা দরকার, তার বেশি কিছু নেই৷ চেয়ার-টেবিল ছাড়া আছে একটা আলমারি, একটা দেরাজ, একটা বিছানা আর একটা পুরোনো স্টিলের বাক্স—লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট, চওড়ায় ফুট দুয়েক৷
বিয়ের আগে সুপর্ণার বাবার কলকাতায় একটা শাড়ির দোকান ছিল৷ একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর সে দোকানটি বেচে দিয়ে তিনি বিধবা বোনের কাছে চলে যান৷ তো এই দোকানের অবশিষ্ট শাড়ি আর গয়নাগাটি তিনি জমা রেখে যান সুপর্ণার কাছে৷ সেগুলো জমা না দান তা আমি বলতে পারি না৷ মোটকথা সেগুলোর স্থান হয়েছে ওই প্রমাণ সাইজের বাক্সের ভিতরে৷ ভিতরে কিছু গয়নাগাটি ও শাড়ি আছে বলে চাবি সুপর্ণা যখের ধনের মতো আগলে রাখে, কখনও কাছ–ছাড়া করে না৷ এই ক-বছরে ওর ভিতরে চোখ দেবার সুযোগ আমার হয়েছে প্রায় বার দশেক৷
যাই হোক, ও-ছাড়া ঘরে আর আসবাব নেই বললেই চলে৷ কলসি থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে একটু গলায় ঢাললাম৷ খানিকটা মাথাতেও দিলাম৷ অস্বস্তিটা কমল৷ আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আড়মোড়া ভাঙলাম৷ একটু ছাদে গেলে হয়, ঘরের ভিতরটা কেমন যেন গুমোট হয়ে রয়েছে৷ জানলাগুলো খুলে দেওয়া যায়, কিন্তু খোলা জানলার দিকে বারবার চোখ চলে যায় আমার৷ মনে হয়, এই বুঝি কেউ এসে দাঁড়াবে৷ সত্যি বলতে কী এই ভূতের ভয়টা আমার এখনও এই বয়সে পৌঁছেও যায়নি৷
টেপ রেকর্ডারটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে এলাম৷ চারপাশ জমাট অন্ধকারে ভরে আছে৷ আকাশে একদম বুড়ো আঙুলের নখের মতো চাঁদ উঠেছে৷ হালকা মায়াবি আলোয় ঢেকে আছে চারপাশটা৷ ফিনফিনে ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে৷ মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল৷ টেপটা পাঁচিলের উপরে রেখে চালিয়ে দিলাম৷ শীতের হাওয়ায় গাছে গাছে ঘষা লেগে ঝরঝর করে একটা আওয়াজ হচ্ছে৷ তার সঙ্গে রুপোলি জ্যোৎস্না৷ মনে হল, ঘুম না-এসে ভালোই হয়েছে৷ এমন একটা মায়াবি রাত ঘুমিয়ে কাটানো অর্থহীন৷ গান শোনার একটা বাতিক থাকলেও আমার নিজের গানের গলাটা একেবারেই আশাপ্রদ নয়৷ ছোটবেলায় গানের ইস্কুলে কী এক বেয়াদবি করেছিলাম বলে মাস্টার গোপীবাবু বেত্রাঘাত সমেত বিতারণ করেছিলেন৷ তারপর থেকে এখন অবধি শুধু শোনা নিয়েই আছি৷ কারও সামনে গাইবার সাহস হয়নি৷ এখানে অবশ্য কেউ নেই, চারপাশের বাড়িগুলোও অন্ধকার জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে৷ আমি আস্তে আস্তে গাইলে কেউ শুনতে পাবে না কিন্তু তা-ও গান গাইবার ভরসা পেলাম না৷ গানের গুঁতোয় ক-টা ভূত এসে যদি উপস্থিত হয়৷ হঠাৎ মনে হল এক কাজ করলে কেমন হয়? টেপ রেকর্ডারটা যখন সঙ্গেই এনেছি, তখন কবিতা রেকর্ড করলে কেমন হয়? তার তো আর বেসুরো হবার জো নেই৷ খাসা আইডিয়া৷ একটা ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট ঢুকিয়ে রেকর্ডিংয়ের বাটানটা টিপে দিলাম৷
আমার কবিতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির ঠিক নীচ থেকে একটা কুকুর ডেকে উঠল৷ সেটাও বোধহয় রেকর্ড হয়েছে, যা-ই হোক ক্যাসেটটা আবার ব্যাক রিল করে চালিয়ে দিলাম৷ আমার দুর্ভাগ্য সেটা থেকে কবিতা দূরে থাক শোঁ-শোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরল না৷ বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে দিলাম৷ কালই সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে৷ নামী কোম্পানির জিনিস হলেও বেশিদিন চলে না৷ ধুর… মনটা খিঁচড়ে গেল৷ আবার নীচে নেমে যাব কি না ভাবছি এমন সময় মনে হল, পাশের বাড়ির ছাদ থেকে দুমদুম করে যেন আওয়াজ আসছে৷ কেউ যেন খালি ছাদের উপর লোহার হাতুড়ি পিটছে৷
আওয়াজটা সন্দেহজনক৷ কয়েকদিন হল এ পাড়ায় চোরের উপদ্রব হয়েছে৷ জানলা দিয়ে হাতের সামনে কিছু পেলেই তুলে নিচ্ছে৷ তবে এমন অদ্ভুত শব্দ করে কেউ চুরি করবে বলে মনে হয় না৷ আমার একটু কৌতূহল হল৷ আওয়াজটা ছাদ থেকে আসছে তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু পুরো ছাদটাই তো আমি হালকা চাঁদের আলোয় দেখতে পাচ্ছি, কোথাও কেউ নেই৷ অন্তত এমন বিকট আওয়াজ করার মতো কেউ নেই৷ ভাবলাম, একবার নিজেই গিয়ে দেখা যাক৷ চুরি ছাড়া অন্য অপরাধ হতে বাধা কোথায়?
আমাদের ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদটা বেশি দূরে নয়৷ মোটামুটি মিটার খানেকের দূরত্ব৷ আমি পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে কার্নিসের উপরে নামলাম৷ ব্যাপারটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না৷ রাত-বিরেতে নানারকম শব্দ হতেই পারে, তা ছাড়া নিজের বাড়ির ছাদ হলেও কথা ছিল, আমাকেই আবার কেউ চোর না ভেবে বসে৷ ভেবে দেখলাম নীচে গিয়েও আমার করার কিছু নেই৷ ঘুম তো আসবে না, অগত্যা বিছানার উপর পড়ে থেকে একঘেয়েমি লেগে যাবে৷ তার থেকে এইরকম অ্যাডভেঞ্চার ভালো৷ সামনের দিকে তাকিয়ে অবশ্য একটু দমে গেলাম৷ এ বাড়ি থেকে ও বাড়ির কার্নিসে যেতে হলে বেশ বড়সড় একটা লাফ দিতে হবে৷ কিন্তু সমস্যা সেটা না৷ লাফানোর জন্য আমার শরীরে যে মোমেন্টাম তৈরি হবে, তাতে দেওয়ালে একটা ছোটখাটো ধাক্কা খাব৷ ভারটা যদি কার্নিসের ওপরে না-রাখতে পারি তাহলে সোজা নীচে এসে পড়ব৷ দোতলা থেকে পড়ে হয়তো বেশি চোট লাগবে না, কিন্তু তাতে লোক জেগে যাবার ভয় আছে৷ সাত-পাঁচ না-ভেবে আমি লাফানোই ঠিক করলাম৷ পকেটে ঘরের চাবিটা আছে, পড়ে গেলে আবার সামনে দিয়ে এসে ঘরে ঢুকতে অসুবিধে হবে না৷
মনে মনে ইষ্টনাম জপ করে আমি লাফ মারলাম৷ যেটা ভয় পাচ্ছিলাম ঠিক সেইটাই হল৷ দেওয়ালে ধাক্কা লেগে আমার শরীরটা বেশ খানিকটা পিছিয়ে এল৷ দেওয়ালের ঠিক গায়েই বেরিয়ে ছিল একটা লোহার রড৷ সেটা ধরে অর্ধেক ঝুলে রইলাম৷ আমার একটা পা কার্নিসে, একটা হাওয়ায়৷ আমি আর একটা হাত দিয়ে রডটা চেপে ধরলাম৷ বাঁ পা-টা এমনভাবে ঝুলছে যে সেটাকে উপরে নিয়ে আসা এক কথায় অসম্ভব৷ অথচ সেটা না-করতে পারলেও চলবে না৷ দেওয়ালে পিঠ দিয়ে আধঝোলা হয়ে থাকতে থাকতে ল্যাম্প পোস্টের আলোটা আমার চোখে পড়ল৷ হলুদ উজ্জ্বল আলো৷ এতক্ষণে অন্ধকারটা চোখ-সওয়া হয়ে গিয়েছে৷ তীব্র আলোটা চোখে পড়তেই আমার মাথা ঝনঝন করে উঠল৷ আমি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম৷ হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ কার্নিসে যে পাশে আমি ঝুলে আছি তার কাছেই একটা বক্স জানলা৷ মনে হয়, দোতলার ভাড়াটেদের৷ কার্নিস থেকে ডান পা-টাও আমি নীচে নামিয়ে নিলাম৷ দু-হাতে রড ধরে কয়েকবার দোল খেয়ে নিতেই জানালাটা হাতের কাছে চলে এল৷ আমি একটা হাত দিয়ে জানলার গ্রিলটা ধরলাম৷ রীতিমতো অভিজ্ঞ চোরের ন্যায় যখন পাশের বাড়ির ছাদে এসে পৌঁছোলাম তখন আমার শরীরে নানা জায়গায় কাটা-ছড়ার দাগ৷ ছাদে পা রেখে কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না৷ এদিক-ওদিক তাকাতে চোখ পড়ল ছাদের উলটো দিকের কোনায় কী যেন একটা সাদা মতো জিনিস পড়ে আছে৷ আমি সেদিকে এগিয়ে যেতেই সেটা হঠাৎ এক লাফে জীবন্ত হয়ে উঠে আমার দিকে সরে এল৷ একটা মোটা বিড়াল৷ আরাম করে ছাদে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল৷ আমাকে দেখে খুব-একটা খুশি হয়ছে বলে মনে হল না৷ দু-বার রাগে ফোঁসফোঁস করে অন্যদিকে সরে পড়ল৷ কিন্তু আওয়াজটা আসছিল কোথা থেকে? এখনই বা আসছে না কেন? ছাদের লাগোয়া একটা ঘর আছে৷ দোতলা থেকে উঠেই সেটা ডান দিকে পড়ে৷ যতদূর জানি সেখানে কেউ থাকে না৷ আগে এক বুড়ো ভাড়াটে থাকত, গত মাসে তিনি রক্তবমি করে মারা যাবার পর থেকে ঘরটা ফাঁকাই পড়ে আছে৷ ওখান থেকেই কি আসছিল আওয়াজটা? ঘরের জানলা খোলা ছিল, সেদিকে এগিয়ে গেলাম৷ ভিতরটা কুপকুপে অন্ধকার, প্রায় কিছুই দেখা যায় না৷ গ্রিলটা ধরে আমি মুখটা কাছে নিয়ে গেলাম৷ ভালো করে কান পেতে শুনতে পেলাম ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ আসছে, যেটাকে দাঁত দিয়ে কোনও শক্ত খাবার ছেঁড়ার আওয়াজ বলা যেতে পারে৷ তবে এত জোরে শব্দ করে কোনও মানুষ খায় বলে তো আমার জানা ছিল না৷ শব্দটা বোঝার উপায় নেই, কী আশ্চর্য! এত জোরে শব্দ হচ্ছে অথচ বাড়ির কারও ঘুম ভাঙার নাম নেই, কী ঘুম রে বাবা!
আমি জানলার কাছ থেকে সরে এলাম৷ বেড়ালটা ছাদ পেরিয়ে কোথায় গেল কে জানে৷ আমি এসে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ায় নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ছে৷ ক-টা বাজে জানি না৷ সাড়ে তিনটে তো নিশ্চয়ই বেজেছে৷ ভাবলাম, এবার ঘরে ফিরে যাই৷ আর ব্যাপারটা মাথায় আসতেই আমার হাসি পেল৷ এই গভীর রাতে আমি নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ছাদে লাফিয়ে জানালার ভিতর উঁকি দিচ্ছি, কেউ দেখতে পেলে নিশ্চয়ই চোর ভাবত৷ নাহ, নিজের পাগলামিতে নিজেই অবাক হয়ে যাই৷ ক-দিন থেকেই মনে হচ্ছে আমার নার্ভগুলো হঠাৎ বেশি সজাগ হয়ে পড়েছে৷ সে জন্যই বোধহয় রাতে ঘুম হয় না৷ এর একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে৷ কালই… আমার যে চিকেন পক্স হয়ছে সেটা এখনই বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই তবুও রাস্তায় বেরোতে আমার ইচ্ছা করে না৷ ফোন করে বাড়িতে ডেকে নেওয়াই ভালো৷ এরকম না-ঘুমিয়ে অন্যের বাড়িতে উঁকি দিয়ে আর কতদিন চালাব? দেখতে দেখতে একেবারে চোর না হয়ে যাই৷ আমি জানলাটা ছেড়ে সবে পাঁচিলের দিকে সরে আসতে যাচ্ছি, এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে ঘুম-জড়ানো গলায় কে যেন চেঁচিয়ে উঠল,—‘কে? কে ওখানে?’
এই সেরেছে! ঘরে বোধহয় লোক ছিল৷ আমার হাত লেগে জানলায় একটু শব্দ হয়েছে, আর তাতেই জেগে উঠেছে লোকটা৷ গলা শুনে অবশ্য চেনা কেউ বলে মনে হল না৷ এখন কী করা যায়? ধরতে পারলে নিশ্চয়ই চোর ভাববে৷ দৌড়ে পালানোর উপায় নেই৷ পাঁচিল থেকে কার্নিসটা অনেকটা নীচে৷ ধীরে-সুস্থে নামতে হবে৷ অতএব লোকটা দরজা খুলে বেরিয়ে এলে ছাদেই কোথাও গা আড়াল করা ছাড়া উপায় নেই৷ কোথায় লুকোই? সেরকম কোনও জায়গাও তো নেই৷ দরজায় খসখস শব্দ শুনেই বুঝেছি, লোকটা ছিটকানি খুলছে৷ হঠাৎ মনে পড়ল, ছাদের ঘরটার পিছনের দিকে একটা ছোট খুপরি আছে৷ একটা মানুষের ঢুকে দাঁড়ানোর মতো জায়গা৷ দিনেরবেলা হলে সেখানে লুকানোর কথা ভাবতেও পারতাম না, কিন্তু রাতের অন্ধকার এখনও কাটেনি এবং চাঁদটাও আকাশের এদিকে নেই তাই খুপরিটার ভিতরের দিকে ঢুকে দাঁড়ালে লোকটার খেয়াল না করার একটা আশা আছে৷ ব্যাপারটা নিজের পছন্দ না-হলেও আর কোনও উপায় নেই দেখে তা-ই করলাম৷ বুকের ভিতরটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে৷ লোকটা আমাকে দেখতে পেলে কেলেঙ্কারি হবে৷ শুধু আজকের নয়, এ পাড়ায় ইদানীং যত চুরি হয়ছে তার সব দায় আমার ঘাড়ে এসে পড়বে৷ সুপর্ণা ফিরলে তাকেই বা কী করে বোঝাব যে মাঝরাতে কীসের তাড়নায় পাঁচিল ডিঙিয়ে অন্যের ছাদে ঘোরাঘুরি করছিলাম৷
আমার নাকে একটা বিশ্রী গন্ধ এল৷ খুব ক্ষীণ, তবু কেমন যেন চেনা লাগল গন্ধটা৷ এদিকে লোকটা ছাদের চারপাশটা ঘুরে দেখছে৷ সিমেন্টের মেঝের ওপরে খসখস পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ হ্যাঁ… এবার আস্তে আস্তে বাড়ছে৷ মানে সে এদিকেই আসছে৷ আমি নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পেলাম৷ আর একটু ভিতরে ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু জায়গা নেই৷ খুপরিটা এতটাই ছোট যে আমার একটা হাত আড়াআড়ি বেরিয়ে আছে৷ লোকটা যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন আমার দুটো হাঁটু কাঁপছে৷ কোনওরকমে পিছনের দেওয়ালে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছি৷ সে কিন্তু এখনও দেখতে পায়নি আমাকে৷ ভাগ্যিস হাতে টর্চ নেই, এই অন্ধকারের চাদরটাই আমার একমাত্র সম্বল৷
‘নাহ, এ পাড়াটা চোরের আখড়া হয়ে উঠেছে, একটা ব্যবস্থা করতে হবে৷’
নীচুস্বরে বিড়বিড় করতে করতে লোকটা ফিরে গেল৷ আমারও ঘাম দিয়ে জ্বর সারল৷ ওফফ…! এমন বদনামের ভয় জীবনে পাইনি৷ খুব শিক্ষা হয়ছে, এবার থেকে পাশের বাড়িতে বোম পড়লেও বাইরে বেরব না৷ পা টিপে টিপে খুপরি থেকে বেরিয়ে এলাম৷ টেনশনটা কেটে যেতে খেয়াল করলাম, গন্ধটা আগের থেকে বেড়েছে৷ খানিকটা দূর থেকে আসছে তাই বোধহয় তীব্রতাটা একটু কম৷ কোথাও ইঁদুর মরল নাকি? আমি আবার কার্নিস ডিঙিয়ে এদিকে ছাদে চলে এলাম৷ এতক্ষণে নিশ্চিন্ত৷ নিজের ছাদ, যত খুশি ঘুরি না-কেন কেউ কিচ্ছু বলার নেই৷ কিন্তু আমার আর বেশিক্ষণ ওপরে থাকতে ইচ্ছা করল না৷ টেপ রেকর্ডারটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম৷ গন্ধটা কিন্তু ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷ এখনই সেটার উৎস খুঁজে বের করতে না-পারলে ঘুম কেন, কাল সারাদিন বাড়িতে টিকতেই পারব না৷
ঘরের চারপাশটা খুঁজে দেখলাম৷ নাহ, কোথাও কিচ্ছু নেই৷ হঠাৎ একটা ব্যাপার চোখে পড়তেই আমার গলার কাছটা শুকিয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল৷ ছাদে যাওয়ার সময় ঘরে হাওয়া ঢুকবে বলে জানলার একটা পাল্লা খুলে রেখেছিলাম৷ এখন সেটা বন্ধ৷ শুধু বন্ধই নয়৷ রীতিমতো ছিটকানি দিয়ে ভিতর থেকে বন্ধ করা৷ কে বন্ধ করল? ঘরে তো কেউ ছিল না৷ বাইরে থেকে কারওর ঢোকা সম্ভব নয়৷ একমাত্র যদি না কেউ ছাদ দিয়ে ঢুকে থাকে, কিন্তু তাই বা কী করে… ব্যাপারটা মনে হতেই আমার ভয়টা আরও বেড়ে গেল৷ আমি পাশের বাড়ির ছাদে ছিলাম সেই সময়ে কেউ আমার ঘরে ঢুকেছে এবং যদি ঢুকে থাকে তাহলে সে এখনও বেরিয়েছে কি না আমি জানি না৷ যদি চোর হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই৷ কারণ আমার ঘরে মহামূল্য তেমন কিছু নেই৷ ওই বাক্সের ভিতরে গয়নাগুলো ছাড়া৷ কিন্তু সেটার চাবিও তো আমার কাছে নেই৷ সুপর্ণার ব্যাগেই থাকে সেটা৷ আমি লাইট জ্বালালাম না৷ চোর অস্ত্রধারী কি না আমি জানি না৷ অতএব সম্মুখ-সমরে গিয়ে আমার লাভ নেই৷ আগের মতোই বিছানার ওপর শুয়ে গভীর ঘুমের ভান করলাম৷
হঠাৎ একটা চেনা গলা শুনে আমি চমকে উঠলাম৷ সুপর্ণা! এত রাতে সে পাশের ঘরে কী করছে? তার তো এখানে থাকার কথা নয়৷ তা ছাড়া সে যদি এখানে আসেই, আমাকে জানাবে না কেন৷ মাঝ রাতে ছাদ ডিঙিয়ে… ধুর, আমার মনের ভুল৷ একটু পরেই বুঝলাম আমার মনের ভুল নয়৷ সে ধীরে ধীরে এই ঘরে এসে ঢুকল৷ একটা কালো শাড়িতে গোটা শরীরটা ঢাকা৷ আঁচলটা মাথার পিছন দিয়ে ঘোরানো৷ যাতে দরকার পড়লেই সেটা দিয়ে মুখ ঢাকা যায়৷ আমি উঠলাম না৷ কেমন যেন খটকা লাগছে আমার৷ কী একটা ব্যাপার যেন আমি ভুলে যাচ্ছি৷ সব কিছুই আমার জানা অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না৷ সুপর্ণা কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকাল না৷ সে তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে বাক্সের চাবি বের করছে৷ আমার এই অবস্থাতেও হাসি পেল৷ নিজের জিনিস নিজেই রাত দুপুরে এসেছে চুরি করতে৷ হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল হতেই আমার হৃৎপিণ্ডটা প্রায় আধ মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে গেল৷ মনে পড়েছে, খুব অস্পষ্ট ছেঁড়া-ছেঁড়া ছবির মতো কয়েকটা দৃশ্য, না দৃশ্য নয়— অনুভূতি৷ দৃশ্যগুলো সব আমার কল্পনা৷ আমি টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে উঠে পড়লাম৷ এক-পা এক-পা করে হেঁটে চলে এলাম পাশের ঘরে৷ সুপর্ণা এখনও বাক্স খোলায় মশগুল৷ আমি ঘরের টেবিলের উপর টেপটা রেখে অন করলাম৷ তারপর যে ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটটায় একটু আগে কবিতা রেকর্ড করেছিলাম সেটা ঢুকিয়ে প্লে-বাটনটা টিপে দিলাম৷ আবার আগের মতোই শোঁ-শোঁ শব্দ৷ কিচ্ছু রেকর্ড হয়নি৷ কিন্তু সেটা আমার উদ্দেশ্য নয়৷ আমি অপেক্ষা করে আছি শেষটার জন্য৷ শব্দটা কিছুক্ষণ চলার পর অদ্ভুতভাবে খারাপ হয়ে-যাওয়া টেপ রেকর্ডারের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল সেই কুকুরের ডাকটা৷ তার মানে? সব রেকর্ড হয়ছে, হয়নি খালি আমার গলাটা৷ কেন?
আমি আর অবাক হলাম না৷ চলে এলাম পাশের ঘরে৷ এতক্ষণে বাক্সটা খুলে ফেলেছে সুপর্ণা৷ আমার অনিদ্রা, আমার নার্ভগুলোর অতিসক্রিয়তা, আমার অন্ধকারে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা, আমার গলা রেকর্ড না হওয়া—সব প্রশ্নের উত্তর ওই বাক্সটার ভিতরে৷ ধীরে ধীরে বাক্সের ডালাটা সরিয়ে ফেলল সুপর্ণা৷ শাড়ি নয়, গয়না নয়, ওর ভিতরে হাত-পা মোড়া অবস্থায় একটু কুঁকড়ে শুয়ে আছে একটা লাশ, আমার লাশ৷ তিনদিনের বাসি মরা৷ পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে৷ স্থানে স্থানে পচন ধরা শুরু হয়ছে৷ সে গন্ধ অবশ্য অন্য কারও পাওয়ার কথা নয়, অন্তত দু-একদিনের মধ্যে নয়৷ আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ একটা কালো কাপড়ে মৃতদেহটাকে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে সাবধানে ঘরের চাবিটা খুলছে সুপর্ণা৷ আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না, সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে আমি এক দৌড়ে ছাদে চলে এলাম কালো কাপড়ে জড়ানো দেহটাকে একটা গাড়ির পিছনে তুলল সে৷ আমি ছাদের পাঁচিল ধরে একদৃষ্টে দেখতে লাগলাম৷ ধীরে ধীরে আমার চিন্তাভাবনাগুলো ছোট হয়ে আসতে লাগল৷ আমার গলন্ত মনের কোনও এক গহ্বর থেকে অদ্ভুত আঁধার এসে গ্রাস করছে আমাকে, নিয়ে যাচ্ছে অন্তহীন সময়ে…