রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র

রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র

ঘটনাটি ঘটল রাত এগারোটার সময়৷

কলকাতা থেকে দেশে যাচ্ছি৷ দেশ বলতে যেখানে আমি জন্মেছি৷ কলকাতা থেকে ট্রেনে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে৷

সকাল পাঁচটায় একটা ট্রেন আছে৷ তাতে গেলে মাজদিয়া রেলস্টেশনে সকাল আটটা-সাড়ে আটটা বেজে যায়৷ স্টেশনে নেমে আরো পাঁচ ক্রোশ হাঁটা৷ খুব তাড়াতাড়ি হাঁটলেও তাতে সময় লাগে আরো দু’ঘণ্টা৷

তারপর আর একটা ট্রেন আছে৷ সেটা ছাড়ে সকাল ন’টায়৷ তারপরে দুপুর দুটোয়৷ তারপর সন্ধে ছ’টায়৷

সন্ধে ছ’টার ট্রেনে গেলে রাত ন’টায় পৌঁছতে পারা যায় মাজদিয়া স্টেশনে৷ কিন্তু তাতে গেলে বাড়ি পৌঁছতে রাত এগারোটা বেজে যায় বলে সাধারণত সে ট্রেনে যাই না৷

তখন আমি কলকাতার একটা মেসে থেকে পড়াশুনা করি৷ প্রত্যেক শনিবার দিন দুপুর দুটোর ট্রেনে বাড়ি যাই৷ তাতে সুবিধে খুব৷ ট্রেনে ভিড়ও কম থাকে৷ আর সন্ধের আগেই বাড়িতে পৌঁছনো যায়৷

কিন্তু সব সময়ে সে ট্রেনে যাওয়ার সুবিধে হয় না৷ লেখা-পড়া ছাড়া ফুটবল খেলার নেশা ছিল৷ রবিবার দিনটায় দেশে না কাটিয়ে কলকাতায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কাটাতে বেশি ভালো লাগে৷

কোনো শনিবার বাড়িতে না গেলে বাবার চিঠি আসে৷ লেখেন—‘‘তুমি গত শনিবারে বাড়ি আস নাই কেন? আমরা তোমার পথ চাহিয়া বসিয়া ছিলাম৷ তোমার শরীর খারাপ হইল কিনা ভাবিয়া খুবই চিন্তিত আছি৷ পত্রপাঠ উত্তর দিবে…’’ ইত্যাদি…

আমি বাবার একই সন্তান৷ বাবার বয়স হয়েছে৷ আমাকে নিয়েই তাঁর যত ভাবনা-চিন্তা-স্বপ্ন সব কিছু৷ আমি বড় হব, আমি মানুষ হব, আমি বংশের মুখ উজ্জ্বল করব৷

কিন্তু ততদিনে আমারও একটা নিজস্ব জগৎ গড়ে উঠেছে৷ দেশের চেয়ে কলকাতার আকর্ষণই আমার কাছে বেশি৷ আমার জন্যে বাবা মোটা হাত-খরচ পাঠান৷ সেই টাকা দিয়ে আমি ময়দানে ফুটবল খেলা দেখি, ক্রিকেট খেলা দেখি, আবার কখনো-কখনো বা সিনেমা দেখতে যাই৷ কলকাতার জীবন গ্রামের জীবনের মতো একঘেয়ে নয়৷ সেখানে চারদিকে এঁদো পানা-পড়া পুকুর আর কেবল ক্ষেত-খামার আর বন-জঙ্গল৷ আমাদের মতো যাদের অবস্থা ভালো নয় তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কেবল বারোয়ারি-তলায় বটগাছের ছায়ায় হারু মুদির দোকানের মাচায় বসে আড্ডা মারে৷ তাস খেলে৷ আর আমি গেলে তারা আমার কাছে কলকাতার গল্প শোনে৷ কারোর কোনো কাজ নেই৷ বাড়ির অবস্থা খারাপ বলে তারা কলকাতায় আসতে পারে না৷ সে-পয়সা তাদের নেই৷ তাই আমাকে তারা একটু-একটু হিংসেও করে৷ আমার চাল-চলন, জামা-প্যান্ট দেখে তারা অবাক হয়ে যায়! আমার জুতো, আমার চুল-ছাঁটা, আমার সাবান-মাখা দেখে তাদের তাক লেগে যায়৷ কারণ আমাদের গ্রাম এমন এক গ্রাম যেখানে শহরের কোনো সভ্যতা ঢোকবার সুযোগ পায়নি৷

আমাদের বাড়ির পাশেই থাকতেন নসুকাকা৷ আসল নাম বোধহয় ছিল নৃসিংহ ভট্টাচার্য৷ বাবা তাঁকে নসু বলে ডাকতেন৷ তিনি গ্রামে গ্রামে যজমানদের বাড়িতে গিয়ে পুজো করে বেড়াতেন৷ বড় ভালো লোক৷ আমি দেশে গেলেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন৷ বলতেন, ‘‘কি রকম লেখা-পড়া হচ্ছে বাবা? ভালো তো?’’

আমি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম৷ বলতাম, ‘‘হ্যাঁ৷’’

তিনি বলতেন, ‘‘হ্যাঁ, খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করবে বাবা৷ এখন দিন-কাল খুব খারাপ আর কলকাতা শহরে যে-রকম গাড়ি-ঘোড়া-ট্রাম-বাস শুনেছি, খুব সাবধানে চলা-ফেরা করবে৷’’

নসুকাকা আমাদের দেশের নামকরা পুরুতমশাই৷ তিনি না হলে কারোরই কোনো পুজো-আচ্চচা হত না৷ কেউ হাতেখড়ি দেবে তাতেও যেমন তাঁর ডাক পড়ত, আবার তেমন কারো বাড়িতে ছেলের অন্নপ্রাশন হবে তাতেও তাঁকে চাই৷ তারপর আছে বারোয়ারিতলার দুর্গাপুজো, কালীপুজো থেকে আরম্ভ করে তিন ক্রোশ দূরে জমিদারবাবুদের বাড়িতে যত উৎসব, যত বিয়ে, ব্রত-উদযাপন, সবেতেই তাঁর ডাক পড়ত৷

তা এই আবহাওয়াতেই আমি মানুষ৷ কিন্তু এই আবহাওয়াতে মানুষ হয়েও যে ঘটনাটা ঘটল তার কথাই বলি৷

কলকাতায় তখন আমার স্কুলের পরীক্ষা চলছিল৷ তিন সপ্তাহ দেশে যেতে পারিনি৷ বাবাকে সে-কথা লিখে দিয়েছিলাম যে, আমি তিন সপ্তাহের জন্যে দেশে যেতে পারব না৷

পরীক্ষা যেদিন শেষ হল সেদিন শনিবার৷ মেসে এসে ভাবলাম দুটোর ট্রেন ধরব৷ কিন্তু কয়েকদিন ধরে রাত জেগে পড়বার পর বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম৷ ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা৷ আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়া যাক৷

কিন্তু যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম দেয়াল-ঘড়িতে বেলা সাড়ে তিনটে৷ আমার বন্ধু, যে আমার পাশের বিছানায় শুত, সেও দেখলাম অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷

মনে হল, সর্বনাশ! দুটোর গাড়ি তো কখন ছেড়ে দিয়েছে৷ এর পরে তো সেই সন্ধে ছ’টার আগে দেশে যাবার আর কোনো গাড়ি নেই৷ সে-গাড়িতে গেলে দেশের বাড়িতে পৌঁছতে তো সেই রাত এগারোটা বেজে যাবে৷

কিন্তু শেয়ালদা স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়তেই সেদিন কেন জানি না আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেল৷ ভাবলাম ট্রেনটা হয়তো একটু দেরি করেই মাজদিয়াতে পৌঁছবে৷ তার মানে যখন পাঁচ ক্রোশ হেঁটে বাড়ি পৌঁছব তখন রাত বারোটা বেজে যাবে৷

বাবা হয়তো বকাবকি শুরু করে দেবেন৷ বলবেন—দুপুর দু’টোর ট্রেনে আসতে পারলে না?

কিন্তু না, ট্রেনটা ঠিক সময়েই মাজদিয়া স্টেশনে গিয়ে পৌঁছল৷

আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম৷ এদিককার প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে টিকিট দেখিয়ে গেট পার হলাম৷ গেটের বাইরেই বাজার৷ অত রাত বলেই বাজারে লোকজনের ভিড় বেশ পাতলা৷ তাড়াতাড়ি বাজার ছাড়িয়ে বড়-রাস্তায় গিয়ে পৌঁছলাম৷ ভেবেছিলাম একটা সাইকেল রিকশা ভাড়া করে বাড়ি পৌঁছব৷

কিন্তু কোনো রিকশাওয়ালাই অত দূরে যেতে চাইলে না৷ বেশি টাকার লোভ দেখিয়েও কাউকে রাজি করাতে পারলাম না৷

সবাই-ই এক কথা বললে—অত দূরে সওয়ারি নিয়ে গেলে ফিরে আসতে রাত একটা বেজে যাবে৷

আমি বললাম—আমি তোমাদের ডবল ভাড়া দেব৷

তবু কেউ যেতে রাজি হল না৷

অগত্যা হাঁটতে শুরু করলাম৷ হাতে অনেক জিনিস ছিল আমার৷ বাবা কাশির ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে লিখেছিলেন৷ শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছবার আগে ওষুধের দোকান থেকে তা কিনে নিয়েছিলাম৷ মা’র জন্যে নিয়ে গিয়েছিলাম হাজার মলম৷ মা’র পায়ে হাজা হয়েছিল৷ তারপর গামছা কিনেছিলাম একটা বাবার জন্যে৷ আরো অনেক খুচরো-খুচরো জিনিস কিনেছিলাম—যা যা বাবা কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে যেতে বলেছিলেন৷

রাস্তা দিয়ে একলা-একলা হেঁটে চলেছি৷ চারদিকে নিশুতি অন্ধকার৷ রাতে গ্রামের লোকজন সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়ে৷ কারণ ভোর-ভোর উঠতে হয় সকলকে৷ বড় বড় গাছগুলোকে দূর থেকে অন্ধকারের পাহাড় বলে মনে হচ্ছে!

খানিকদূর গিয়েই পিচের রাস্তা শেষ হয়ে গেল৷ অমাবস্যার রাত৷ আকাশে শুধু তারাগুলো জ্বলছে মাথার ওপর৷ মাঝে মাঝে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া কানে আসছে৷ দু’একটা কুকুর আমাকে দেখে ঘেউ-ঘেউ করে ডেকে উঠল৷ কিন্তু আমাকে চিনতে পেরে আবার চুপ করে গেল৷ তবু আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগল৷ কিন্তু কিসের যে ভয় বলতে পারব না৷

একটা রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম৷ চারদিকে কয়েকটা বড়-বড় বটগাছ ডালপালা ছড়িয়ে জায়গাটিকে ঢেকে রেখেছে৷ শনি-মঙ্গলবার ও-জায়গাটায় হাট বসে৷ হাট বেলাবেলি শেষ হয়ে গেছে৷ চারদিকে দু’চারটে ছোট-খাট দোকান৷ তারাও দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে তখন যে-যার বাড়ি চলে গেছে৷

বহুদিন আগে ওই বটগাছের ডালে একজন মানুষ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল৷ সে ছোটবেলাকার ঘটনা৷ কিন্তু তখন থেকেই জায়গাটায় এসে দাঁড়ালেই দিনের বেলাতেও কেমন গা-ছমছম করত৷ আর তখন তো রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে৷

মনে পড়ল, বাবা-মা বোধহয় এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে রাত হয়ে গেল৷ তাঁরা ভাবছেন আমি আর আসব না৷ মা আমার জন্যে ভাত রান্না করে বসে ছিল৷

বাবা বলছেন—আর কেন বসে আছ, খোকা আজকে বোধহয় এল না, তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো৷

মাও বোধহয় তখন খেয়ে নিয়েছে৷ তারপর আমার কথা ভাবতে-ভাবতেই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷

এই সব কথা ভাবতে-ভাবতেই হেঁটে চলেছি৷ রাত তখন এগারোটা বেজে গেছে৷ রাস্তাটা গিয়ে নলগাড়ির নাবালে গিয়ে মিশেছে৷ আগে এখানে একটা নদী ছিল৷ আগে যখন নদীতে জল ছিল তখন খেয়া নৌকোয় এপার-ওপার করতে হত৷ কিন্তু এখন নদীটা শুকিয়ে গিয়েছে৷ সেখানে ঢালু জমিতে এখন চাষ-বাস হয়৷ তারই একপাশ দিয়ে গরুর গাড়ি যাবার রাস্তা হয়েছে৷ বর্ষার পর গরম পড়াতে রাস্তায় আবার ধুলো জমেছে৷ এখানকার লোক তাই ও-জায়গাটার নাম দিয়েছে, ‘নলগাড়ির নাবাল’৷

আমি ঢালু রাস্তায় নামতে লাগলাম৷ তারপর সামনের দিকে নজর পড়তেই যা দেখলাম তাতে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল৷

দেখলাম ওপারের রাস্তা দিয়ে একটা দাড়িওয়ালা মূর্তি ঢালু রাস্তা দিয়ে আমার দিকে নেমে আসছে৷ রাস্তায় তার পা নেই, শুধু হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতেই এগিয়ে আসছে আমার দিকে৷

আমি আর এগোলাম না৷ এগোতে ভয় করল৷ ও কি তবে সেই লোকটার মূর্তি যে একদিন বটগাছে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল? তখন কত লোকের মুখে শুনতে পেতুম যে, সে নাকি এই অঞ্চলে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়! কিন্তু আমি নিজের চোখে কখনো দেখিনি৷

হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করে মূর্তিটা কথা বলে উঠল৷

বলল, ‘‘কে ওখানে?’’

আমি কী জবাব দেব বুঝতে পারলাম না৷ শুধু একটু থেমে বললাম, ‘‘আমি৷’’

‘‘আমি কে?’’

বলতে-বলতে মূর্তিটা আমার দিকে আরো এগিয়ে আসতে লাগল৷

সামনে মুখের কাছে এসে বললে, ‘‘কে, কে তুমি?’’

আমি ভয়ে শিউরে উঠেছি তখন৷ কিছুই জবাব দিতে পারলাম না সেই মুহূর্তে৷

মূর্তিটা জিজ্ঞেস করলে, ‘‘ও, তুমি! বিমল! ধীরেশদার ছেলে?’’

আমার তখন যেন জ্ঞান ফিরে এল৷ চিনতে পারলাম মূর্তিটাকে৷ আমার নসুকাকা৷

বললাম, ‘‘নসুকাকা, আপনি?’’

নসুকাকা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি৷ তা তোমার আসতে দেরি হল যে?’’

বললাম, ‘‘দুপুরে দু’টোর ট্রেনটা ধরতে পারিনি, ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, তাই সন্ধে ছ’টার ট্রেন ধরে আসছি৷’’

নসুকাকা বললেন, ‘‘তা আজকে এই অমাবস্যার রাতে না এলেই পারতে! এই রাত-বিরেতে কি আসা ভালো? আমাদের গাঁয়ে যে পরশুদিন বাঘ বেরিয়েছিল৷ তারপর ক’দিন আগে বাবুদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল—৷’’

বললাম, ‘‘তা আপনি এত রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছেন?’’

নসুকাকা বললেন, ‘‘জমিদারবাবুর স্ত্রী হঠাৎ ডেকে পাঠিয়েছেন, তাঁর বড় ছেলের খুব অসুখ, আমাকে সেখানে গিয়ে শান্তি-সস্তেন করতে হবে৷ যত রাতই হোক আমাকে যেতেই হবে৷ তাঁর বড় ছেলের এখন-যায়-তখন-যায় অবস্থা৷ তাই খেয়ে নিয়েই দৌড়চ্ছি৷ আমাকে যে ডাকতে এসেছিল তাকে বলেছি, তুমি এগিয়ে যাও, আমি খেয়ে উঠেই যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে রাস্তায় কোনো লোকের দেখা হয়নি?’’

আমি বললাম, ‘‘কই, না তো—’’

নসুকাকা বললেন, ‘‘তা রাত্তির বেলা হয়তো ঠাহর হয়নি তোমার৷ তা তুমি বাবা একলা এত রাত্তিরে এসে ভালো করোনি৷ চলো, আমি তোমাকে গাঁ পর্যন্ত পৌঁছে দিই৷’’

বললাম, ‘‘আপনি আবার কেন এত কষ্ট করতে যাবেন৷ আর আপনারও তো তাড়াতাড়ি আছে৷’’

নসুকাকা বললেন, ‘‘সে কী কথা! এই এতরাতে তোমাকে কি এই অবস্থায় একলা ছেড়ে দিতে পারি? শুনলে ধীরেশদা যে আমার ওপর রাগ করবে৷ বলবে, তুমি খোকাকে ওই অবস্থায় একলা ফেলে কী করে চলে গেলে?’’

কী আর করা যাবে৷ ওদিকে জমিদারবাবুর বাড়িতে তাঁর বড় ছেলের এখন-যায়-তখন-যায় অবস্থা, আর তিনি কিনা নিজে আমাকে আমার বাড়ি পৌঁছে দিতে চান?

রাস্তায় যেতে-যেতে নসুকাকা বলতে লাগলেন, ‘‘তুমি তিন সপ্তাহ বাড়ি আসনি, সেজন্যে ধীরেশদা খুব ভাবছিলেন৷ কলকাতায় থাক তুমি, তোমার বয়েস হয়েছে৷ তোমার যত পড়াশোনাই থাক, হপ্তায় একদিনের জন্যে বাবা-মাকে দেখতে আসতে পার না? তুমি যখন বড় হবে, আর নিজে বাবা হবে, তখন বুঝবে ছেলেকে দেখতে না পেলে বাপের মনে কী কষ্ট হয়৷’’

আমি নসুকাকার কথা শুনে কোনো জবাব দিতে পারলাম না, চুপ করে নসুকাকার সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলাম৷ তারপর যখন বাড়ির কাছাকাছি এসেছি তখন নসুকাকা বললেন, ‘‘ওই দেখ, তোমাদের বাড়ি, এবার আর কোনো ভয় নেই, আমি চলি, আমার খুব তাড়া আছে৷’’

বলে তিনি চলে গেলেন৷

আমি আমাদের বাড়ির সদর দরজায় কড়া নেড়ে ডাকতে লাগলাম, ‘‘বাবা, বাবা, বাবা!’’

বাবা আমার ডাক শুনেই ধড়ফড় করে জেগে উঠেছেন৷ মা-ও জেগে উঠেছেন৷

তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে আমাকে দেখে বললেন, ‘‘খোকা, তুমি এসে গেছ? কোন ট্রেনে এলে? দুপুরের ট্রেনে আসতে পারলে না?

বললাম, ‘‘দুপুরবেলা পরীক্ষা দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, তাই—’’

বাবা বললেন, ‘‘তা বলে সন্ধের ট্রেনে আসতে হয়? জানো বাড়ি পৌঁছাতে রাত এগারোটা বেজে যাবে৷ তা ছাড়া গাঁয়ে পরশুদিন বাঘ বেরিয়েছিল, তা জানো? ক’দিন আগে বাবুদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল—’’

আমি বললাম, ‘‘আমি তো তা জানতুম না৷ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল নসুকাকার সঙ্গে, তিনিই আমাকে নিজে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন৷’’

‘‘নসু? নসুকাকা?’’

বললাম, ‘‘হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে নলগাড়ির নাবালে দেখা হয়ে গেল৷ তিনি জমিদারবাবুদের বাড়ি যাচ্ছিলেন, তাদের বড় ছেলে মরো-মরো, তাই তিনি শান্তি-সস্তেন করতে সেখানে যাচ্ছিলেন৷’’

বাবা আমার দিকে হতবাকের মতো চেয়ে রইলেন৷

মা-ও অবাক৷

বাবা বললেন, ‘‘তুমি ঠিক দেখেছ? তোমার নসুকাকা? তিনি তোমার সঙ্গে কথা বলেছেন? তুমি কী সব আবোল-তাবোল বকছ?’’

আমি বললাম, ‘‘বা রে, আমি ভুল দেখব কেন? আমি নসুকাকাকে চিনতে পারব না?’’

বাবা বললেন, ‘‘কিন্তু তোমার নসুকাকা যে পরশুদিন মারা গিয়েছেন, আমরা যে নবদ্বীপে গিয়ে তাঁর সৎকার করে এলুম—’’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *