রাত্রি ও সকালের মাঝখানে [বিটুইন নাইট এন্ড মন]
প্রচণ্ড ঝড়
প্ৰথম পৰ্ব
ইউসিফ আল ফখরীর বয়স যখন চৌত্রিশ বছর তখন সে সমস্ত সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল এবং চলে গেল উত্তর লেবাননের কেদিসা উপত্যাকার কাছাকাছি এক নির্জন আশ্রমে বসবাস করতে। কাছাকাছি গ্রামের বাসিন্দারা ইউসিফ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের গল্প শুনেছিল। এসব গল্প সম্পর্কিত ছিল তার সম্পদশালী পরিবার এবং পারিবারিক মহানুভবতার সঙ্গে। কেউ কেউ বলত, সে একটা নারীকে ভালোবাসত যে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছিল এবং সেই কারণে সে নির্জন জীবন যাপন করছে, আবার অন্যেরা বলত সে হচ্ছে একজন কবি, তাই সে পরিত্যাগ করেছে এই কোলাহলপূর্ণ নগর এবং নির্জনে বসবাস করছে তার চিন্তা ও প্রেরণাকে নথিভুক্ত করতে এবং অনেকেই নিশ্চিত ছিল যে সে একজন মরমি মাধক যে তার আধ্যাত্মিক জগৎ নিয়ে তৃপ্ত, যদিও অধিকাংশ মানুষই জোর দিয়ে বলত যে, সে একজন পাগল।
যেমন নিজের কথাই বলি, আমি লোকটি সম্পর্কে কোনো উপসংহার টানতে পারব না, কারণ আমি জানতাম যে, তার হৃদয়ে অবশ্যই একটা গভীর গোপনীয়তা আছে যার প্রকাশকে আমি ধারণা ছাড়া অন্যকিছু বলে বিশ্বাস করব না। দীর্ঘদিন ধরে আশা করছিলাম এই অদ্ভুত লোকটির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাবার। আমি চেষ্টা করেছিলাম অসরল পথেই তার বন্ধুত্ব লাভ করতে। তার বাস্তবতাগুলিকে অনুশীলন করে এবং জীবনের উদ্দেশ্যকে তদন্ত করে তার কাহিনীর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে, কিন্তু আমার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম যখন তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হল, সে তখন লেবাননের পবিত্র সিডার বনের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল এবং আমি সবচেয়ে পছন্দের শব্দগুলি উচ্চারণ করে তাকে সম্ভাষণ জানালাম, কিন্তু সে আমার সম্ভাষণের প্রতিউত্তরে শুধু মাথা ঝাঁকাল এবং লম্বা লম্বা পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করল না।
অন্য একসময় আমি দেখলাম একটা আশ্রমের পাশে একটা ছোট আঙুরক্ষেতের ভেতরে সে দাঁড়িয়েছিল এবং আবার আমি তার কাছে গেলাম এবং তাকে সম্ভাষণ জানালাম এই বলে, ‘গ্রামবাসীরা বলে থাকে চতুর্দশ শতাব্দীতে একদল সিরীয় এই আশ্রম নির্মাণ করেছিল। আপনি কি এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানেন?’ সে খুবই শীতল কণ্ঠে জবাব দিল, ‘আমি জানি না কে এই আশ্রম নির্মাণ করেছিল, এমনকি তা আমি জানতেও চাই না।’ তারপর সে আমার দিকে ঘুরল এবং যোগ করল, ‘কেন এসব আপনার পিতামহকে জিজ্ঞাসা করেন না, যে আমার চেয়ে অধিক বয়সী এবং যিনি এই উপত্যকার ইতিহাস সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জানেন?’ মুহূর্তেই উপলব্ধি করলাম আমার উদ্যোগ ব্যার্থ হয়েছে, আমি তাকে পরিত্যাগ করলাম।
এই ঘটনার পর দুই বছর কেটে গেল এবং এই অদ্ভুত লোকটির উদ্ভট জীবন আমার মনকে কুরে কুরে খেতে লাগল এবং বিরক্ত করতে থাকল আমার স্বপ্নকে।
দ্বিতীয় পর্ব
শরৎকালে একদিন আমি ইউসিফ আল ফখরীর আশ্রমের কাছে পাহাড় ও ছোট ছোট ঢিবির ভেতরে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই প্রবল বাতাস এবং মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল এবং প্রবল ঝড় আমাকে একবার এদিকে একবার সেদিকে নিক্ষেপ করতে লাগল একটা নৌকার মতো, যার হাল ভেঙে গেছে এবং মাস্তুল ছিন্নবিচ্ছিন্ন সমুদ্রের প্রবল বাতাসে। আমি খুবই কষ্ট করে ইউসিফ-এর আশ্রমের দিকে পা বাড়ালাম এবং নিজেকে বললাম, ‘এটা হল একটা মুখোশ, দীর্ঘদিন ধরে যা আমি অনুসন্ধান করেছি এবং এই প্রবল ঝড় হল আমার আশ্রমে প্রবেশের অজুহাত।’
আমি যখন আশ্রমে পৌঁছালাম তখন আমার খুবই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা এবং আমি দরজায় কড়া নাড়লাম এবং দরজা খুলে দিল সেই লোকটি যার জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম। সে একহাতে ধরে রেখেছিল একটা মৃতপাখি যার মাথা আহত এবং ডানাগুলি ভাঙা। আমি তাকে অভিবাদন জানিয়ে বললাম, ‘এই বিরক্তিকর এবং অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশের জন্য আপনার ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। উন্মত্ত ঝড়ের ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম আপনার আশ্রম থেকে এই কিছুটা দূরে।’ সে ভ্রূকুটি করে বলল, ‘এই বন্যতার ভেতরে অনেকগুলি গৃহ আছে যার ভেতরে আপনি আশ্রয় নিতে পারতেন।’ যাহোক, সে দরজা বন্ধ করে দিল না এবং আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগল কখন কী ঘটে তার পূর্বাভাসের জন্য এবং আমার বিশাল আকাঙ্ক্ষা বন্দি ছিল হাতের ভেতরে। সে পাখির মাথাটায় পরম যত্ন ও আগ্রহের সঙ্গে কোমলভাবে হাত বোলাতে শুরু করল, প্রদর্শন করল একটা গুণাবলি যা আমার হৃদয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম দুটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ্য করে যা পরস্পরের প্রতিপক্ষ। আমি দেখতে পেলাম সেই মানুষটিকে যার ভেতরে একই সঙ্গে রয়েছে ক্ষমা ও নিষ্ঠুরতা। সে আমার উপস্থিতিতে অসন্তুষ্ট হয়- আমি ইচ্ছা পোষণ করি থাকার
মনে হল, যদি সে ধরে ফেলে আমি কী ভাবছি, কারণ সে ওপরের দিকে তাকাল এবং বলল, ‘ঝড় থেমে গেছে এবং টক মাংস খাওয়ার ইচ্ছা পরিত্যাগ করুন। কেন আপনি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছেন?’ এবং আমি মৃদু রসিকতা করে উত্তর দিলাম, ‘এই ঝড়ের টক অথবা লবণাক্ত জিনিসে পরিণত হওয়ার ইচ্ছা নাও থাকতে পারে, কিন্তু এই ঝড় সব জিনিসকে ঠাণ্ডা ও নাজুক করে তোলে এবং নিঃসন্দেহে এই ঝড় আমাকে খেয়ে ফেলাটা খুবই উপভোগ করবে যদি আমাকে আবার আঁকড়ে ধরতে পারে।’ তার অভিব্যক্তি ছিল মারাত্মক যখন সে প্রতিবাদ করল, ‘এই প্রচণ্ড ঝড় আপনাকে বিশাল সম্মান প্রদান করবে। যদি সে আপনাকে গিলে ফেলত তাহলে এই সম্মান আপনি পেতেন না।’ আমি একমত হয়ে বললাম, ‘জি জনাব, আমি এই ঝড়কে ভাগিয়ে দিতে পারি কিন্তু আমি পুরস্কৃত হব না সেই সম্মানে আমি যার যোগ্য নই।’ সে আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, যা ছিল তার শ্বাসরুদ্ধকর একটা হাসির প্রচেষ্টা এবং তারপর ফায়ার প্লেসের পাশে একটা কাঠের বেঞ্চির দিকে সে এগিয়ে গেল এবং আমাকে আমন্ত্রণ জানাল বিশ্ৰাম নেওয়ার পাশাপাশি পোশাকগুলি শুকিয়ে নিতে।
আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং বসলাম। সে আমার উল্টোদিকে বসল পাথরে খোদাই-করা বেঞ্চির ওপর। তার আঙুলের ডগাগুলি একটা পোড়ামাটির পাত্রের ভেতরে সে ডোবাতে শুরু করল, যার ভেতরে একধরনের তেল হয়েছে। এই তেল সে ঘষে ঘষে লাগাচ্ছে পাখিটার মাথা ও পাখায়। কোনোদিকে না-তাকিয়েই সে বলল, ‘প্রবল বাতাসের কারণেই পাখিটা পাথরের ওপর পতিত হয়েছিল জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে।’ আমি উত্তরে বললাম, ‘এবং প্রবল বাতাস আমাকে ভাসতে ভাসতে পাঠিয়েছে আপনার দরজায়, মাথাকে আহত হওয়া এবং পাখাকে ভেঙে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে।’
সে আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল, ‘পাখির জন্মগত প্রকৃতিগুলি প্রদর্শন করবে মানুষ এটা আমার ইচ্ছা এবং প্রবল ঝড় মানুষের ডানা ভেঙে দেবে এটাও আমার ইচ্ছা। কারণ, মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রবণতা রয়েছে ভয় ও কাপুরুষতার এবং প্রবল ঝড় জেগে উঠলে সে মাটির গুহা এবং যে-কোনো ফাটলের দিকে হামাগুড়ি দেয় এবং নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।
আমার উদ্দেশ্য ছিল তার স্বেচ্ছা-আরোপিত এই নির্বাসনের কাহিনী টেনে বের করে আনা। আমি প্ররোচিত করলাম, ‘হ্যাঁ পাখিটা এক ঘণ্টা সময় এবং মনোবল আধিকার করে রেখেছিল যা মানুষের অধিকৃত নয়। …মানুষ বেঁচে থাকে আইন এবং নিয়মকানুনের ছায়ায়, যা সে তৈরি করে এবং পল্লবিত করে তোলে নিজের জন্য কিন্তু পাখিরা বাঁচে একই স্বাধীন ও চিরন্তন আইন অনুসারে, যার কারণে সূর্যের চারদিকে পরাক্রমশালী পথকে তাড়া করে ফেরে পৃথিবী। তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যেন সে আমার মধ্যে একজন শিষ্যকে খুঁজে পেয়েছে যার উপলব্ধির জগৎ স্বচ্ছ এবং সে হঠাৎ করেই বলে ফেলল, ‘খুব ভালো কথা। যদি আপনি আপনার নিজের কথা বিশ্বাস করেন তাহলে আপনার উচিত সভ্যতা, তার দুর্নীতিগ্রস্ত আইন এবং প্রথাকে পরিত্যাগ করা এবং বেঁচে থাকা সেইসব পাখিদের মতো যারা শূন্যতার ভেতরে বসবাস করে স্বর্গ ও পৃথিবীর মনোমুগ্ধকর আইন ছাড়াই।’
‘বিশ্বাস হচ্ছে একটা চমৎকার জিনিস, কিন্তু কোনকিছু সম্পন্ন করার কাজে এই বিশ্বাসকে স্থাপন করলে তা হয় সাফল্যের পরীক্ষা। তাদের ভেতরে অনেকেই, যারা সমুদ্রের গর্জনের মতো কথা বলে, কিন্তু তাদের জীবন সংকীর্ণ এবং নিরুদ্যম পচে যাওয়া জলাভূমির মতো। তাদের ভেতরে অনেকেই, যারা তাদের মাথাকে উত্তোলন করে পাহাড়শীর্ষের ওপরে, কিন্তু তাদের আত্মা থাকে গুহার অস্পষ্টতায়।’ কাঁপতে কাঁপতে সে তার আসন ছেড়ে উঠল এবং পাখিটাকে কাপড়ের ভেতরে ভাঁজ করে জানালার পাশে রেখে দিল।
সে আগুনে কিছু শুকনো কাঠ চাপিয়ে দিল, তারপর বলল, ‘স্যান্ডেল খুলে রেখে পাগুলি গরম করে নিন। কারণ স্যাঁতসেঁতে ভাবটা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ভালোভাবে আপনার পোশাক শুকিয়ে নিন এবং আরাম করে বসুন।’
ইউসিফের ধারাবাহিক আতিথেয়তা আমার আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দিল। আমি আগুনের কাছে গিয়ে বসলাম এবং আমার ভেজা পোশাক থেকে পানি বাস্পাকারে দূরীভূত হতে লাগল।
লোকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ধূসর আকাশের দিকে। আমার মন তাড়াহুড়া করে অনুসন্ধান করছিল তার উন্মুক্ত পটভূমি। আমি সরলভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি এখানে এসেছেন কতদিন আগে?’
আমার দিকে না তাকিয়ে সে শান্তভাবে জবাব দিল, ‘আমি এখানে এসেছিলাম যখন মাটি আকার নেয়নি ও শূন্যতায় পরিপূর্ণ এবং গভীরতার মুখমণ্ডলের ওপরেও ছিল অন্ধকার এবং জলের মুখমণ্ডলের ওপর গতিশীল ছিল ঈশ্বরের আত্মা।’
এসব কথা শুনে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। সংগ্রাম করতে শুরু করলাম আমার বোধশক্তি ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া রসালো অভিব্যক্তিকে একত্রিত করতে। আমি নিজেকে বললাম, ‘কী বিচিত্র এই লোকটি এবং কী পরিমাণ কঠিন সেই পথ যা তার বাস্তবতাগুলিকে নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু আমি তাকে আক্রমণ করব খুবই সতর্কতার সঙ্গে, ধীরে ধীরে এবং ধৈর্যের সঙ্গে যতক্ষণ তার স্বল্পভাষিতা যোগাযোগ স্থাপন না করে এবং তার বিস্ময় উপলব্ধিতে পরিণত না হয়।’
তৃতীয় পৰ্ব
রাত্রি ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার কালো পোশাক ঐসব উপত্যকাগুলির ওপর এবং ঝড় তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করছিল বুদ্ধি লোপ পাওয়া মানুষের মতো এবং বৃষ্টির বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। আমি কল্পনা করতে শুরু করলাম যে বাইবেলের সেই বন্যা আবার ধেয়ে আসছে জীবনকে নিশ্চিহ্ন করতে এবং মানুষের দূষণ ধৌত করতে ঈশ্বরের পৃথিবী থেকে। মনে হয়, প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের বিপ্লব ইউসিফের হৃদয়ে প্রশান্তি সৃষ্টি করেছিল, প্রায়ই যার আবির্ভাব ঘটত মেজাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এবং একাকিত্ব রূপান্তরিত হত মদ্যপানোৎসবপ্রিয়তায়। সে দুটো মোমবাতি জ্বালাল এবং আমার সামনে রাখল একটা মদের পাত্র এবং একটা বিশাল ট্রে, যার ওপরে রয়েছে রুটি, পনির, মধু, জলপাই এবং কিছু শুকনো ফল। তারপর সে আমার কাছাকাছি বসল এবং ক্ষমা চাইল পরিমাণের স্বল্পতার জন্য, কিন্তু সাধারণ খাবারের জন্য নয় এবং আমাকে আমন্ত্রণ জানাল তার সঙ্গে যোগ দিতে।
উপলব্ধিকৃত নৈঃশব্দের ভেতরে আমরা পান ও আহারে মগ্ন হলাম বাতাসের হু হু শব্দ এবং বৃষ্টির কান্না শুনতে শুনতে। একই সময়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম তার অবয়ব সম্পর্কে এবং চেষ্টা করছিলাম খুঁজে বের করে আনতে তার গোপনীয়তা, ধ্যান করে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিলাম তার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য যা তার অস্বাভাবিক অস্তিত্বের নিচে শায়িত ছিল। মদ্যপান শেষ হওয়ার পর আগুনের ওপর থেকে সে একটা তামার কেটলি তুলে নিল এবং সুগন্ধি কফি ঢালল দুটো কাপে। তারপর সে একটা ছোট্ট বাক্স খুলল এবং তা থেকে আমাকে সিগারেট নেবার প্রস্তাব দিল এবং সম্বোধন করল ‘ভাই’ বলে। আমি কফি খেতে খেতে একটা সিগারেট তুলে নিলাম, কিন্তু আমি বিশ্বাস করছিলাম না, যা আমার চোখ দেখছিল। সে হাসিমুখে আমার দিকে তাকাল এবং সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে কয়েক চুমুক কফি খেল এবং বলল, ‘নিঃসন্দেহে এই নির্জনে আপনি মদ, কফি ও সিগারেটের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবছেন এবং আমার খাবারদাবার ও আরাম-আয়েশ নিয়েও আপনি বিস্মিত হতে পারেন। এসব সম্পর্কে আপনার ঔৎসুক্য থাকা মোটেও বিচিত্র কিছু নয়, কারণ আপনি অনেকের ভেতরে একজন, যে বিশ্বাস করে মানুষের থেকে দূরবর্তী অস্তিত্বে, জীবন থেকে যে অনুপস্থিত এবং জীবনের সমস্ত উপভোগ থেকে যে বিরত থাকে।’ দ্রুত আমি তার সঙ্গে একমত হলাম, ‘হ্যাঁ এটা জ্ঞানীলোকদের সঙ্গে সম্পর্কিত, যারা শুধুমাত্র ঈশ্বরের প্রার্থনা করার উদ্দেশ্যে জাগতিক পৃথিবীকে পরিত্যাগ করে এবং তারাই পরিত্যাগ করবে যাবতীয় উপভোগের আনন্দ এবং পর্যাপ্ত জীবন, নিজেকে পরিতৃপ্ত করবে ঈশ্বরের সাধারণ সৃষ্টি দিয়ে এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে উদ্ভিদ এবং পানির ওপর।
কিছুক্ষণ থেমে সে চিন্তা করল এবং বলল, ‘আমি ঈশ্বরের প্রার্থনা করতে পারব যখন সে তার প্রাণীদের ভেতরে জীবন্ত, কারণ প্রার্থনার জন্য নির্জনতা অপরিহার্য নয়। আমি মানুষকে পরিত্যাগ করতে পারব না বিধিসম্মতভাবে ঈশ্বর দর্শনের জন্য, কারণ আমি তাকে সবসময়ই দেখি আমার পিতা ও মাতার গৃহে। আমি মানুষকে পরিত্যাগ করি তাদের প্রকৃতির জন্য যার কারণে আমার সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব হয়েছিল এবং তাদের স্বপ্নগুলি আমার স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি… আমি মানুষকে পরিত্যাগ করেছি, কারণ আমি দেখলাম যে আমার আত্মার চাকা একদিকে ঘুরছিল এবং রূঢ়ভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করছিল অন্যান্য আত্মাগুলিকে যা আবার ঘুরে যাচ্ছিল একেবারে বিপরীত দিকে। আমি সভ্যতা পরিত্যাগ করেছিলাম, কারণ আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে এটা একটা বৃদ্ধ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বৃক্ষ, শক্তিশালী এবং ভয়াবহ, যার শিকড়গুলি মাটির অস্পষ্টতার কারণে নিষ্ক্রিয় এবং যার শাখাগুলি পৌঁছেছে মেঘেরও ওপরে, এর ফুটে থাকার কারণেই লোভের জন্ম হয়, শয়তান খারাপ চিন্তা করে এবং অপরাধের জন্ম হয় এবং এর ফলগুলি হচ্ছে দুঃখ, দুর্দশা এবং ভীতি। ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা এর সঙ্গে ভালোকে মেশানোর দায়িত্ব নিয়েছে এবং দায়িত্ব নিয়েছে এর প্রকৃতি পরিবর্তন করার কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। তারা মারা গেছে হতাশায়, যন্ত্রণায় এবং ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে।
ইউসিফ ফায়ারপ্লেসের একদিকে ঠেস দিয়ে বসল যেন সে অপেক্ষা করছে আমার ওপর তার কথার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্য। আর আমি ভাবলাম শ্রোতা হওয়াই সবচেয়ে উত্তম এবং সে বলে যেতে লাগল, ‘না, আমি প্রার্থনার জন্য নির্জনতা সন্ধান করি না বরং আশ্রমবাসীর জীবন যেরকম হয় আমি সেভাবেই আমার জীবনকে নেতৃত্ব দিই … কারণ প্রার্থনা, যা হচ্ছে হৃদয়ের সংগীত। এই সংগীত ঈশ্বরের কানে পৌঁছাবে যখন তার সঙ্গে মিশ্রিত হবে হাজার হাজার কণ্ঠস্বরের চিৎকার এবং কান্না। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করার অর্থই হল আত্মা ও শরীরকে নির্যাতন করা এবং নম্রতাকে নিষ্প্রভ করে তোলা। এটা একধরনের অস্তিত্ব যা আমি পছন্দ করি না কারণ ঈশ্বর আত্মার জন্য শরীরগুলিকে সোজা করে তুলেছেন মন্দিরের মতো এবং এটা হল আমাদের বিশেষ দায়িত্ব একে যোগ্য করে তোলা এবং ঈশ্বরের দ্বারা আমাদের ভেতরে বিশ্বাস স্থাপন করা।
‘না, হে আমার ভাই, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে আমি কোনো নির্জনতা অনুসন্ধান করি না কিন্তু এককভাবে এড়িয়ে চলি, এড়িয়ে চলি তাদের শিক্ষা, প্রথা, ধারণাসমূহ, তাদের চিৎকার ও চেঁচামেচি, এমনকি তাদের হাহাকার পর্যন্ত।
‘আমি নির্জনতা সন্ধান করেছিলাম সেইসব মানুষের মুখমণ্ডল দর্শন করা থেকে বিরত থাকতে যারা নিজেদেরকে বিক্রি করে এবং কেনে একই মূল্যে, যা তাদের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম, আধ্যাত্মিকভাবে এবং বস্তুতগতভাবে।
‘আমি নির্জনতা অনুসন্ধান করেছিলাম যেন অপ্রত্যাশিতভাবে নারীদের মুখোমুখি না হই, যারা গর্বিত ভঙ্গিতে হাঁটে হাজার হাজার মাইল নিজের ঠোঁটের ওপর, যখন হাজার হৃদয়ের গভীরতার ভেতরে একটিমাত্র উদ্দেশ্য এসে জড়ো হয়।
‘আমি বিধিসম্মতভাবে নির্জনতা অনুসন্ধান করেছিলাম নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সেইসব আত্মতৃপ্ত একক ব্যক্তি থেকে যারা স্বপ্নের ভেতরে জ্ঞানের অপচ্ছায়া দেখতে পায় এবং বিশ্বাস করে তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।
‘আমি সমাজ থেকে পালিয়েছিলাম তাদেরকে এড়িয়ে যেতে, যারা তাদের জাগরণের ভেতরে সত্যের ভূত দেখতে পায় এবং পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, যা তারা অর্জন করেছে পুরোপুরিভাবে সত্যের নির্যাস থেকে।
‘আমি পৃথিবী পরিত্যাগ করেছিলাম এবং সন্ধান করেছিলাম নির্জনতা কারণ আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেইসব বিপুল সংখ্যক মানুষের সৌজন্য উপস্থাপন করতে যারা বিশ্বাস করে যে বিনয় হচ্ছে একধরনের দুর্বলতা, ক্ষমা হচ্ছে একধরনের কাপুরুষতা এবং অবজ্ঞা হচ্ছে একটি শক্তির প্রতিমূর্তি।
‘আমি নির্জনতা অনুসন্ধান করেছিলাম, কারণ আমার আত্মা সেইসব মানুষের সাহচর্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যারা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্র উদিত হয় না তাদের রত্নভাণ্ডার ছাড়া এবং অস্ত যায় না তাদের বাগান ছাড়া অন্য কোথাও।
‘আমি পালিয়ে এসেছিলাম অফিস-পাগল লোকদের কাছ থেকে যারা মানুষের জাগতিক নিয়তিকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, যখন তাদের চোখে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে সোনালি ধুলো এবং তাদের কান পরিপূর্ণ করে তুলছে অর্থহীন কথার ধ্বনিগুচ্ছ।
আমি প্রস্থান করেছিলাম সেইসব মন্ত্রীদের কাছ থেকে যারা তাদের বক্তব্য অনুসারে বাঁচে না নিজের সুখ-সুবিধার জন্য, এমনকি জনগণ চায় যা তারা নিজের জন্যও করে না। আমি অনুসন্ধান করেছিলাম নির্জনতা, কারণ সেই নির্জনতার ভেতরে ছিল আত্মা, হৃদয় ও শরীরের পরিপূর্ণ জীবন। আমি খুঁজে পেয়েছিলাম সীমাহীন তৃণভূমি যেখানে বিশ্রাম নেয় সূর্যের আলো এবং যেখানে ফুলেরা শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে মহাশূন্যতার ভেতরে এবং যেখানে নদীর স্রোতোধারা সমুদ্রের পথে যেতে যেতে গান গায়। আমি সেই পাহাড় আবিষ্কার করেছিলাম যেখানে আমি দেখতে পেয়েছিলাম বসন্তের পরিশুদ্ধ জাগরণ, গ্রীষ্মের বর্ণময় প্রতীক্ষা, শরতের সমৃদ্ধ সংগীত এবং শীতের চমৎকার রহস্য। আমি ঈশ্বরের রাজ্যের এই দূরবর্তী কোণায় এসেছিলাম, কারণ আমি ক্ষুধার্ত হয়েছিলাম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গোপনীয়তাগুলি জানতে এবং কাছাকাছি যেতে ঈশ্বরের সিংহাসনের।
ইউসিফ একটা গভীর নিশ্বাস ফেলল যেন সে বিশাল ভারী বোঝা থেকে মুক্ত হল। তার চোখ বিস্ময় ও ঐন্দ্রজালিক রশ্মি প্রদর্শন করেছিল এবং তার দীপ্তিমান চেহারার ওপর আবির্ভূত হয়েছিল গর্ব, ইচ্ছাশক্তি এবং পরিতৃপ্তি।
কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আমি শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং বিবেচনা করছিলাম যা লুকিয়ে ছিল তা উন্মোচন করার। তারপর আমি তাকে বললাম, ‘আপনি যা যা সম্পর্কে বলেছেন তার সবই ঠিক, কিন্তু আপনার সামাজিক অসুস্থতার ব্যবস্থাপত্রে একই সময়ে আপনি প্রমাণ করেছেন যে আপনি একজন ভালো চিকিৎসক। আমি বিশ্বাস করি অসুস্থ সমাজের জন্য এমন একজন চিকিৎসক ভীষণ প্রয়োজন এবং উচিত একে সুস্থ করে তোলা অথবা একে হত্যা করা। এই চরম বিপদাপন্ন পৃথিবী আপনার মনোযোগ প্রার্থনা করছে। পীড়িত রোগীদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া যথাযথ অথবা ক্ষমাপূর্ণ কাজ এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করা আপনার জন্য লাভজনক? সে স্থিরদৃষ্টিতে চিন্তিতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল এবং তারপর অন্তঃসারশূন্যতার সঙ্গে বলল, ‘পৃথিবীর শুরু থেকে চিকিৎসকেরা চেষ্টা করে আসছে ব্যাধি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে : কেউ ব্যবহার করেছে ছুরি, সেখানে অন্যেরা ব্যবহার করেছে বিষ কিন্তু মহামারী বিস্তার লাভ করেছে নৈরাশ্যজনকভাবে। আমার ধারণা নোংরা বিছানায় শুয়ে থেকেই রোগীরা তৃপ্ত হবে, ধ্যান করবে তার দীর্ঘকালীন ব্যাধির জন্য কিন্তু পরিবর্তে সে বিস্তৃত করবে তার হাতদুটো পোশাকের তলা থেকে, বজ্রমুষ্টিতে আঁকড়ে ধরবে প্রত্যেকের গলা যে তাকে পরিদর্শন করতে আসবে এবং শ্বাসরুদ্ধ করে তাকে মেরে ফেলবে। এটা কী ধরনের বিড়ম্বনা! মন্দ রোগীরা চিকিৎসককে হত্যা করে তারপর চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে, ‘সে একজন বড় চিকিৎসক ছিল। পৃথিবীতে কেউই মানুষের উপকার করতে পারে না ভাই। যাহোক, বীজবপনকারী জ্ঞানী এবং বিশেষভাবে পারদর্শী, সে পারতে পারে শীতের মাঠকে পল্লবিত করে তুলতে।’
আমি বললাম, ‘মানুষের শীতকাল পার হয়ে যাবে এবং তারপর আসবে মনোমুগ্ধকর বসন্ত এবং অবশ্যই মাঠে ফুল ফুটবে এবং ঝর্নাগুলি আবার লাফিয়ে পড়বে উপত্যকায়।’ সে ভুরু কোঁচকালো এবং তিক্তকণ্ঠে বলল, ‘হায়! ঈশ্বর কি মানুষের হৃদয় বিভক্ত করেছেন—যা হচ্ছে সম্পূর্ণ সৃষ্টি—বিভিন্ন ঋতুতে সেইসব বছরগুলির মতো?’ মনুষ্যপ্রজাতির কোনো গোত্র কি এখন ঈশ্বরের সত্য ও আত্মার ভেতরে বসবাস করে এবং পৃথিবীর ওপরে তারা পুনর্বার আবির্ভূত হতে চায়? এমন সময় কি আসবে যখন মানুষ স্থির হবে এবং মেনে চলবে সত্যের ডান হাতকে এবং উল্লসিত হবে দিবালোকে ও রাত্রির শান্তিপূর্ণ নৈশব্দের ভেতরে? স্বপ্ন কি বাস্তবতায় পরিণত হতে পারে? এটা কি বাস্তবায়িত হবে মানুষের চামড়ায় পৃথিবী ঢেকে যাবার এবং তা রক্তে সিক্ত হওয়ার পর?
ইউসিফ এবার দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে হাত তুলল যেন সে অন্য এক পৃথিবীর দিকে নির্দেশ করছে এবং সে বলে যেতে থাকল : ‘কিছুই নয় পৃথিবীর জন্য একটা ব্যার্থ স্বপ্ন, কিন্তু আমি এর সমাপ্তি খুঁজছি আমার জন্য এবং যা আমি আবিষ্কার করছি এখানে এবং যা আমার হৃদয় উপত্যকা এবং পাহাড়গুলিকে দখল করে আছে তার জন্য।’ সে তার তীক্ষ্ণকণ্ঠ আরও উত্তোলন করল, ‘প্রকৃতপক্ষে যা আমি জানি তা হল সত্য হয়ে ওঠা হচ্ছে আমার আত্মার অভ্যন্তরীণ ক্রন্দন। আমি এখানে বসবাস করছি এবং আমার অস্তিত্বের গভীরতায় রয়েছে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা এবং আমি জীবনের পুষ্পাধার থেকে পাওয়া মদ ও রুটিতে অংশগ্রহণ করে উল্লসিত হই, যা আমি তৈরি ও পল্লবিত করেছি আমার নিজের হাতে। সে কারণে আমি মানুষের রঙ্গমঞ্চ পরিত্যাগ করে এখানে এসেছিলাম এবং আমি শেষপর্যন্ত এখানেই থাকব।’
অস্থিরতায় সে কক্ষের ভেতরে সামনে-পেছনে হাঁটতে লাগল যখন আমি তার কথাগুলো বিবেচনা করে দেখছিলাম এবং গভীরভাবে ভাবছিলাম সমাজের মাঝখানের এই ক্ষতের বর্ণনা। আমি আবার চাতুর্যপূর্ণ একটা সমালোচনার উদ্যোগ নিলাম, ‘আপনার মতামত ও উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং আমি ঈর্ষা ও সম্মান করি আপনার নির্জনতা ও একাকিত্বকে। কিন্তু আমি জানি যে এই দুর্দশাগ্রস্ত জাতি এক বিশাল ক্ষতির ভেতরে টিকে আছে আপনার দেশত্যাগের কারণে, কারণ তাদের প্রয়োজন একজন উপশমকারী যার গভীর উপলব্ধি আছে এ সম্পর্কে, যে তাকে সাহায্য করবে তার সমস্যার ভেতর দিয়ে এবং জাগিয়ে তুলবে তার আত্মাকে।’
ইউসিফ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল এবং বলল, ‘এই জাতি অন্যান্য সব জাতির মতোই এমনকি মানুষগুলিও একই উপাদানে তৈরি এবং তাদের পারদর্শিতার তারতম্য ঘটে না বাহ্যিক অবয়ব ছাড়া যা আসলে কোনো ফলাফল নয়। আমাদের এই প্রাচ্যের জাতিগুলির দুর্দশা হচ্ছে পৃথিবীর দুর্দশা এবং পাশ্চাত্যে আপনারা যাকে সভ্যতা বলেন তা কোনো সভ্যতা নয়, তা হচ্ছে বিয়োগান্তক প্রতারণার অনেকগুলি ছায়াশরীরের ভেতরে অন্য একটি ভূত।
ভণ্ডামি সবসময়ই থাকবে, এমনকি তার আঙুলের ডগাগুলি হচ্ছে রঙিন এবং চকচকে এবং কপটতা কখনই পরিবর্তিত হবে না, এমনকি যদি তার স্পর্শ কোমল ও মনোমুগ্ধকরও হয় এবং তার মিথ্যাচার কখনও সত্যে পরিণত হবে না যদি তাকে আপনি রেশমি পোশাক পরান এবং তাকে স্থাপন করে রাজমুকুটে এবং লোভ কখনও পরিতৃপ্ত হবে না তার, অপরাধ পরিণত হবে না সদ্গুণে এবং অনন্ত দাসত্ব-শিক্ষা, প্রথা ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে দাসত্ব হিসেবেই রয়ে যাবে যদি সে তার মুখ রঙে চিত্রিত করে এবং কণ্ঠস্বরে ছদ্মবেশও পরায়। দাসত্ব দাসত্ব হিসেবেই রয়ে যাবে বিভিন্ন ভয়াবহ পদ্ধতিতে, যদি সে নিজেকে স্বাধীনতা বলে ডাকে—তারপরও।
‘না ভাই, না, পশ্চিম পূবের চেয়ে উচ্চতর নয়, নয় পশ্চিম পূবের চেয়ে নিম্নতর। এই দুয়ের পার্থক্য বাঘ ও সিংহের পার্থক্যের চেয়ে বৃহত্তর নয়। তবে সমাজের বাইরের দিকটার পেছনে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ন্যায্য ও যথাযথ আইন, যা দুর্গত সমৃদ্ধি এবং অজ্ঞতার ভেতরে ঐক্য সাধন করে। এটা এক জাতি থেকে অন্য জাতিকে অধিক পছন্দ করে না, এবং এক জাতিকে অধিকার করে না অন্য জাতিকে সমৃদ্ধ করতে।’
আমি চিৎকার করে বলি, ‘তাহলে সভ্যতা হচ্ছে অহংকার এবং এই অহংকারের ভেতরের সবকিছুই অহংকার।’ সে দ্রুত উত্তর দিল, ‘অবশ্যই সভ্যতা হচ্ছে একটা অহংকার এবং এর ভেতরকার সবই অহংকার … উদ্ভাবন এবং আবিষ্কার হচ্ছে শরীরের জন্য আয়েশ ও কৌতুক যখন শরীর ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত। দূরবর্তীকে জবরদখল করা এবং সমুদ্রের ওপর জয়লাভ করা হল কৃত্রিম ফল, যা আত্মাকে তৃপ্ত করে না, পরিচর্যা করে না হৃদয়ের, এমনকি উত্তোলন করে না সাহস, কারণ তারা প্রকৃতি থেকে দূরে অবস্থান করে। কাঠামোগুলো এবং তত্ত্বগুলো, যাকে মানুষ জ্ঞান ও শিল্পকলা বলে সেগুলি কিছুই নয় হাতকড়া এবং বেড়ি ছাড়া, যা মানুষ নিজের দিকে টেনে নেয় এবং উল্লসিত হয় তার প্রতিফলনের উচ্চতায় এবং চমৎকারভাবে বাজে। তারা হচ্ছে শক্তিশালী খাঁচা যার শিকগুলো মানুষ নির্মাণ করতে শুরু করেছিল বহুযুগ আগে, অসচেতন বলেই ভেতরের দিক থেকে নির্মাণ করতে শুরু করেছিল এবং সে তাড়াতাড়িই নিজের বন্দিতে পরিণত হবে চিরকালের জন্য। হ্যাঁ, ব্যর্থতাই হল মানুষের দলিল এবং ব্যর্থতাই হল তার উদ্দেশ্য এবং সবকিছুই হল অহংকার এই পৃথিবীর ওপর।’ সে একটু থেমে যোগ করল, ‘এবং জীবনের এইসব অহংকারের মধ্যে মাত্র একটি বিষয় হচ্ছে, আত্মা ভালবাসে এবং এই আত্মা ব্যাকুল হয়। একটা জিনিস দীপ্তিময় এবং একাকী।’
‘এটা কী?’শিহরিত কণ্ঠস্বরে আমি তদন্ত করেছিলাম। সে দীর্ঘ সময় ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং তারপর চোখ বন্ধ করেছিল। সে হাত রেখেছিল তার বুকের ওপর যখন তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এবং খুবই আন্তরিক কণ্ঠে সে বলল, ‘এটা হচ্ছে আত্মার ভেতরে একটা জাগরণ, এটা হচ্ছে একটা জাগরণ হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ গভীরতায়, এটা হচ্ছে একটা বিভ্রান্তিকর ও চমকপ্রদ ক্ষমতা যা হঠাৎ করেই মানুষের সচেতনতার ওপর নেমে আসে এবং সে চোখ খোলে, যেখানে সে দেখতে পায় চমৎকার সংগীতের স্রোতোধারার মধ্যে জীবনকে একটা বিশাল আলোর বৃত্ত দ্বারা বেষ্টিত, পৃথিবী ও নভোমণ্ডলের মাঝখানে সৌন্দর্যের স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষসহ। এটা হচ্ছে একটা শিখা যা আত্মার ভেতরে হঠাৎ করেই উন্মত্ত হয়ে ওঠে এবং পোড়ায় এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে তোলে, আরোহণ করে পৃথিবীর ওপরে এবং স্থির হয়ে ভেসে থাকে প্রশস্ত আকাশে। এটা হচ্ছে একটা করুণা, যা ব্যক্তির হৃদয়কে ঢেকে ফেলে, যার দ্বারা সে বিভ্রান্ত ও অগ্রাহ্য করবে সবাইকে যারা তা অস্বীকার করে এবং বিদ্রোহ করবে তাদের বিরুদ্ধে যারা এর বিশাল অর্থ উপলব্ধি করতে চায় না। এটা হচ্ছে একটা গোপনীয় হাত যা আমার চোখ থেকে অবগুণ্ঠন সরিয়ে দিয়েছিল যখন আমি আমার পরিবার, বন্ধু এবং দেশবাসীর ভেতরে ছিলাম সমাজের সদস্য।
‘বহু সময় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম এবং নিজেকে বলেছিলাম,
‘বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কী এবং কেন আমি তাদের থেকে আলাদা যারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং কীভাবে আমি তাদের চিনেছিলাম এবং কোথায় আমার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং কেন আমি তাদের ভেতরে বসবাস করছি? আমি কি তাদের ভেতরে একজন আগন্তুক অথবা এরাই এই পৃথিবীতে জীবন কর্তৃক নির্মিত আগন্তুক যারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে।’
ইউসিফ হঠাৎ নীরব হয়ে গেল যেন সে দীর্ঘকালে আগে দেখা কিছু একটা স্মরণ করছিল এবং অস্বীকার করছিল তা প্রকাশ করতে। তারপর সে তার বাহু প্রসারিত করল এবং ফিসফিস করে বলল, ‘এটা হচ্ছে চার বছর আগে আমার কী ঘটেছিল তাই, যখন আমি পৃথিবী পরিত্যাগ করেছিলাম এবং এই শূন্যস্থানে এসেছিলাম জীবনের জাগরণের ভেতরে বসবাস করতে এবং উপভোগ করতে দয়ার্দ্র চিন্তাভাবনা এবং মনোমুগ্ধকর নৈঃশব্দ।’
সে দরজার দিকে হেঁটে গেল, তাকিয়ে থাকল অন্ধকারের গভীরতার দিকে যেন ঝড়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু স্পন্দিত কণ্ঠস্বরে সে বলল, ‘এটা হচ্ছে আত্মার ভেতরে একটা জাগরণ, যে এটা বোঝে, শব্দে এটা প্রকাশিত হতে অক্ষম এবং যে জানে এটা কখনই চিন্তা করে না কাউকে কোনোকিছুতে বাধ্য করাতে এবং অস্তিত্বের রহস্যের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে।
চতুর্থ পর্ব
এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল এবং ইউসিফ আল ফখরী ঘরের ভেতরে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল, আবার হঠাৎ হঠাৎই থেমে ধূসর আকাশের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। আমি চুপচাপ ছিলাম, আমার ওপর প্রতিফলিত হচ্ছিল তার নির্জন জীবনের আনন্দ ও বেদনার বিস্ময়কর ঐক্য।
রাত্রি একটু গভীর হলে সে আমার কাছাকাছি হল এবং স্থিরদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যেন সেই লোকটার চেহারা স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনতে চায় যার কাছে সে তার জীবনের মূল্যবান গোপনীয়তাগুলি উন্মুক্ত করেছিল। আমার মন খুবই বিক্ষিপ্ত ছিল, চোখ ছিল ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। সে শান্তভাবে বলল, ‘আমি যাচ্ছি এখন ঝড়ের সঙ্গে সারারাত হাঁটতে, অনুভব করতে প্রকৃতির অভিব্যক্তি। এটা হচ্ছে একটা অনুশীলন শরৎ ও শীতে যা আমি উপভোগ করে থাকি। এই এখানে মদ রয়েছে, ওখানে সিগারেট, দয়া করে আজকের রাতের জন্য আমার বাড়িটা আপনার বলে গ্রহণ করুন।’
সে একটা কালো পোশাকে নিজেকে জড়াল এবং হেসে বলল, ‘আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি চলে যাবার সময় মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশ থেকে রক্ষা করার জন্য ঘরটা ভালোভাবে বন্ধ করে যাবেন, কারণ দিনটাও আমি পবিত্র সিডার বনের ভেতরে কাটানোর পরিকল্পনা করেছি।’ তারপর সে দরজার দিকে এগোল, হাতে একটা ছুরি এবং সর্বশেষ কথাটি বলল, ‘যদি ঝড় আপনাকে আবার বিস্মিত করে তোলে, যেহেতু আপনি এইসব অহংকারের ভেতরে আছেন, এই আশ্রমে আশ্রয় নিতে দ্বিধা করবেন না… আমি আশা করি আপনিই আপনাকে শিক্ষা দেবেন ঝড়কে ভালোবাসতে- তাকে ভয় না পেতে… শুভ রাত্রি, ভাই আমার।’
দরজা খুলে মাথা উঁচু করে সে অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম কোনোদিকে যায় তা দেখার জন্য, কিন্তু সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কারণ কয়েক মিনিট আমি উপত্যকার ভাঙা পাথরের ওপরে তার পা ফেলার শব্দ শুনেছিলাম।
পঞ্চম পর্ব
গভীর চিন্তার রাত্রি পেরিয়ে সকাল হল এবং ঝড়ও কেটে গিয়েছিল। আকাশ পরিষ্কার এবং সূর্যের উষ্ণ রশ্মিতে উদ্ভাসিত পাহাড় এবং সমতলভূমি। শহরে ফিরতে ফিরতে আমি অনুভব করলাম আধ্যাত্মিক জাগরণ যা ইউসিফ আল ফখরী বলেছিল এবং তা আমার অস্তিত্বের প্রতিটি তন্তুতে ক্রোধকে উন্মত্ত করে তুলছিল। আমি অনুভব করলাম আমার কাঁপুনি অবশ্যই দৃশ্যমান এবং আমার সবকিছু সম্পর্কে আমি যখন স্থির ছিলাম তখন তা ছিল সৌন্দর্য এবং উৎকর্ষতা।’
দ্রুত আমি কিছু পীড়াদায়ক মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছালাম এবং শুনলাম তাদের কণ্ঠস্বর এবং দেখলাম তাদের কর্মকাণ্ড। আমি থামলাম এবং মনে মনে বললাম, ‘হ্যাঁ আধ্যাত্মিক জাগরণ মানুষের জীবনের সবচেয়ে অপরিহার্য বিষয় এবং অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য। সকল করুন প্রতিমূর্তিসহ এটা কি সভ্যতা নয়? আধ্যাত্মিক জাগরণের জন্য সর্বময় চালক? কীভাবে আমরা অস্বীকার করতে পারি সেইসব বস্তুকে যা পৃথিবীতে অবস্থান করছে, যখন এইসব অস্তিত্ব হচ্ছে এর অসচেতন প্রমাণ আইনমান্যকারীদের ইচ্ছাকৃত উপযোগিতার ভেতরে। বর্তমান সভ্যতা একটা অপসৃত উদ্দেশ্যের অধিকারী হতে পারে, কিন্তু চিরন্তন আইন প্রস্তাব দিয়েছে সেই উদ্দেশ্যকে, যা হচ্ছে একটা মই, যার সিঁড়িগুলো একটা স্বাধীন বস্তুর দিকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
আমি আর কখনও ইউসিফ আল ফখরীকে দেখিনি, কারণ চেষ্টার ভেতর দিয়ে পীড়িত সভ্যতার কাছে পৌঁছাতে জীবন আমাকে একই বছরের শরতের শেষার্ধে উত্তর লেবানন থেকে বিতাড়িত করেছিল এবং আমি দূরবর্তী দেশে নির্বাসিত হয়েছিলাম, যার ঝড়গুলি গৃহপালিত এবং সেই দেশে আশ্রমবাসী হওয়া একধরনের মহিমান্বিত পাগলামি, কারণ এর সমাজ খুবই পীড়াদায়ক।
দাসত্ব
মানুষ হচ্ছে জীবনের দাস এবং এটা হল সেই দাসত্ব যা তাদের দিনগুলিকে দুর্দশা ও যন্ত্রণায় পূর্ণ করে তোলে এবং রাত্রিকে প্লাবিত করে অশ্রুজল ও তীব্র মনোবেদনায়।
আমার প্রথম জন্মের দিন থেকে সাত হাজার বছর কেটে গেছে এবং সেইদিন থেকে আমি জীবনের দাসত্বের সাক্ষী হয়ে আছি, টেনে নিচ্ছি তাদের ভারী হাতকড়া ও বেড়িগুলো।
আমি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছি এবং জীবনের আলো ও ছায়ায় সতর্কিত হয়েছি। আমি দেখেছি সভ্যতার মিছিল চলেছে আলো থেকে অন্ধকারে, প্রত্যেকেই পতিত হয়েছে নরকে অপমানিত আত্মার দ্বারা এবং দাসত্বের জোয়ালে তারা বাঁকা হয়ে গেছে। শৃঙ্খল হচ্ছে শক্তিশালী ও বশীভূত এবং বিশ্বস্ততা হল হাঁটু গেড়ে আরধ্য দেবতার সামনে প্রার্থনা করা। আমি মানুষকে অনুসরণ করেছি ব্যাবিলন থেকে কায়রো এবং আইন দৌউর থেকে বাগদাদ পর্যন্ত এবং পর্যবেক্ষণ করেছি বালির ওপর তার শৃঙ্খলের চিহ্ন। আমি পরিবর্তনশীল যুগের বেদনার্ত প্রতিধ্বনি শুনেছিলাম যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল চিরন্তন তৃণভূমি ও উপত্যকায়। আমি পরিদর্শন করেছিলাম মন্দির এবং বেদিগুলো এবং রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে বসেছিলাম সিংহাসনের সামনে। দেখেছিলাম শিক্ষানবিশরা দাসত্ব করছে দক্ষ কারিগরদের, দক্ষ কারিগররা দাসত্ব করছে নিয়োগদাতাদের, নিয়োগদাতারা দাসত্ব করছে সৈনিকদের, সৈনিকরা দাসত্ব করছে সরকারের এবং সরকার দাসত্ব করছে রাজার, রাজা দাসত্ব করছে যাজকের এবং যাজক দাসত্ব করছে তার আরধ্য দেবতার… এবং এই দেবতা আসলে কিছুই নয় শয়তানের তৈরি মাটির মূর্তি এবং তা মাথার খুলির ঢিবির ওপর খাড়া হয়ে উঠেছে।
আমি ধনীদের বিশাল গৃহ ও গরিবদের পর্ণকুটিরে প্রবেশ করেছিলাম। দেখেছিলাম মায়ের স্তন থেকে প্রবাহিত দাসত্বের দুগ্ধধারার পরিচর্যা করছে নবজাত শিশুরা এবং শিশুরাই বর্ণমালা দিয়ে শিখছে কীভাবে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়।
তরুণীরা পরিধান করেছিল নিষেধাজ্ঞা ও নিষ্ক্রিয়তার পোশাক এবং স্ত্রীরা আনুগত্য ও বৈধ সম্মতির বিছানার ওপর অবসর যাপন করছিল অশ্রুসজল চোখে।
আমি বিভিন্ন যুগের সঙ্গী হয়েছিলাম কাঞ্জির তীর থেকে ইউফ্রেটিসের তীর পর্যন্ত, নীলের উৎস থেকে অসিরীয় সমতলভূমি পর্যন্ত, এথেন্সের রণক্ষেত্র থেকে রোমের চার্চ পর্যন্ত এবং কনসটান্টিনেপল থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাসাদগুলি পর্যন্ত…। আমি দেখেছিলাম সর্বত্রই দাসত্ব হেঁটে চলেছে অজ্ঞতার দ্যুতিময় ও রাজকীয় মিছিলের সাথে সাথে। আমি দেখেছিলাম মানুষ আত্মোৎসর্গ করছে তার যৌবন এবং তরুণীদের বিগ্রহের নামে দেবতার পদযুগে। তাকে ঈশ্বর বলে ডাকছে সবাই। মদ এবং সুগন্ধ ঢেলে দিচ্ছে তার পায়ের ওপর এবং তাকে ডাকছে রানী বলে, পোড়াচ্ছে ধূপ তার প্রতিমূর্তির সামনে এবং তাকে ডাকছে নবী বলে, হাঁটুগেড়ে বসে প্রার্থনা করছে তার সামনে এবং তাকে ডাকছে আইন বলে এবং এই আইনের জন্য তারা যুদ্ধ করছে এবং মারা যাচ্ছে এবং তাকে তারা ডাকছে দেশপ্রেম বলে এবং আনুগত্য স্বীকার করছে তার ইচ্ছা এবং তাকে ডাকছে পৃথিবীর ওপর ঈশ্বরের ছায়া বলে এবং তার জন্য ধ্বংস ও বিনাশ করছে গৃহ এবং প্রতিষ্ঠানগুলি এবং ভ্রাতৃত্ব বলে ডাকছে তাকে, সংগ্রাম করছে, কৌশল গ্রহণ করছে এবং কাজ করছে তার জন্য এবং তাকে ডাকছে সৌভাগ্য ও সুখ বলে এবং হত্যা করছে তার জন্য এবং তাকে ডাকছে সাম্যতা বলে। সে বহু নামের অধিকারী কিন্তু বাস্তবে একটিই। তার বহু ধরনের আদল আছে কিন্তু সে একটি উপাদানেই তৈরি। সত্যের ভেতরে সে হচ্ছে একটা চিরন্তন অসুস্থতা যা তাকে দান করেছে প্রত্যেকটি প্রজন্ম এর উত্তরসুরি পর্যন্ত।
আমি লক্ষ্য করেছি অন্ধদাসত্ব, যা মানুষের বর্তমানকে তাদের পিতার অতীতের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলে এবং তাদেরকে তাড়া দেয় প্রচলিত প্রথা ও নিয়মকানুনের ভেতরে প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপন্ন হতে, স্থাপন করতে নতুন শরীরে পুরোনো আত্মা।
আমি দেখেছি নীরব দাসত্ব, যা একজন মানুষের জীবনকে বেঁধে ফেলে তার স্ত্রীর সঙ্গে যা সে ঘৃণা করে এবং নারীর শরীরটি স্থাপন করে ঘৃণিত স্বামীর বিছানায় এবং আধ্যাত্মিকভাবে দুটো জীবনই মারা যাচ্ছে।
বধির দাসত্বও দেখেছি আমি, যা হৃদয় ও আত্মার শ্বাসরোধ করে, মানুষকে উপস্থাপন করে, কিন্তু তা এক কণ্ঠস্বরের শূন্য প্রতিধ্বনি এবং একটি শরীরের দয়ার্দ্র ছায়ামাত্র।
নীরব দাসত্ব দেখেছি আমি, যা স্বৈরশাসকের নিপীড়নের নিচে গলা পেতে দেয় এবং বশ্যতা স্বীকার করে শক্তিশালী শরীরের এবং দুর্বল মানসিকতার যারা, তারা লোভের পুত্রে পরিণত হয় তাদের ক্ষমতার কাছে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে
কুৎসিত দাসত্বও দেখেছি আমি, যা নবজাতকের আত্মার সাথে নেমে আসে প্রশস্ত মহাশূন্য থেকে দুর্দশার গৃহে, যেখানে অজ্ঞতার মাধ্যমে প্রয়োজন বসবাস করে এবং অবমাননা বসবাস করে নৈরাশ্যের পাশাপাশি এবং শিশুরা বেড়ে ওঠে দুঃস্থ হিসেবে, বেঁচে থাকে অপরাধী হিসেবে এবং মারা যায় ঘৃণ্য অবস্থায় এবং পরিত্যক্ত হয় অস্তিত্বহীনতায়।
আমি দেখেছি সূক্ষ্ম দাসত্ব, যা বিভিন্ন জিনিসকে অধিকার প্রদান করে অন্য জিনিসে পরিণত হতে তাদের নামের চেয়েও—তারা বলে থাকে একে হত্যা, যা হচ্ছে একটা বুদ্ধিবৃত্তি এবং জ্ঞানের শূন্যতা এবং দুর্বলতা ও কোমলতা এবং কাপুরুষতা, যা হচ্ছে একটা শক্তিশালী প্রত্যাখ্যান।
আমি দেখেছি নিংড়ানো দাসত্ব, যা হচ্ছে দুর্বলের জিভ ভীতির সঙ্গে নড়াচড়া করা এবং অনুভূতির বাইরে এসে কথা বলা, কারণ তারা তাদের দুর্দশা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার ভান করে কিন্তু তারা পরিণত হয় খাটো পোশাকে, যা শিশুরাও ভাঁজ করতে অথবা ঝুলিয়ে রাখতে পারে।
আমি দেখেছিলাম বাঁকানো দাসত্ব, যা একটা জতির ওপর সাফল্য অর্জন করে অন্য জাতির নিয়মকানুন মেনে নেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়ে এবং সেই বক্রতা প্রতিদিন বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে থাকে।
বিরতিহীন দাসত্বও আমি দেখেছিলাম, যা রাজা হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানের পুত্রদের মাথায় মুকুট পরায় এবং প্রশংসনীয় গুণের প্রতি কোনো সুবিচার করার প্রস্তাবও দেয় না। আমি দেখেছি কালো দাসত্ব যা লজ্জা ও অপমানকে মিশ্রিত করে চিরকাল অপরাধীদের নিষ্পাপ সন্তানের জন্য।
গভীর চিন্তার ভেতরে ডুবে থাকা দাসত্বের ভেতরে দেখেছিলাম ধারাবাহিকতা ও সংক্রমণের কলুষিত ক্ষমতাসমূহের অধিকার।
যখন আমি এইসব চরিত্রহীন যুগের কর্মকাণ্ড অনুসরণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং এইসব ধীরস্থির মানুষের মিছিল দেখার ক্লান্তিতে আমি জীবনের ছায়ার উপত্যকায় একাকী হেঁটেছিলাম, যেখানে একে অপরাধ ও আত্মার ভবিষ্যৎ ভাঁজের ভেতরে লুকিয়ে রাখার অতীত উদ্যোগ রয়েছে এবং তা নিজের ভেতরেই বিশ্রাম নেয় দীর্ঘসময় সেখানে রক্ত ও অশ্রুর নদীর প্রান্তসীমা হামাগুড়ি দেয় বিষাক্ত নাগিনীর মতো এবং একজন দাগী অপরাধীর স্বপ্নের মতো তাকে নিংড়ে নেওয়া হয়। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম দাসদের প্রেতাত্মার ফিসফিসানি এবং স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম সেইদিকে যেখানে দেখার কিছুই নেই।
যখন মধ্যরাত এল এবং আত্মারা গোপন জায়গা থেকে উদ্ভুত হল আমি দেখতে পেলাম মরণাপন্ন এক লোক, হাঁটুর ওপর যার আত্মা আছড়ে পড়ে মারা যাচ্ছে, স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। আমি তার কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নাম কী?’ ফসলের মৃত্যুর মতো ছায়াগুলো উত্তর দিল, ‘আমার নাম স্বাধীনতা।’
আমি তদন্তের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার সন্তানেরা কোথায়?’ স্বাধীনতা অশ্রুসজল চোখে এবং দুর্বল ও শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল, ‘একজনকে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হয়েছিল, একজন ছিল পাগল এবং তৃতীয় জন এখনও জন্মায়নি।’
সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবারও বলল, ‘কিন্তু আমার চোখে ধোঁয়াশা এবং হৃদয়ের কান্না আমার দৃষ্টিকে অন্ধ এবং শ্রবণশক্তিকে বধির করে তুলেছে।’
শয়তান
জনতা এমনভাবে ফাদার সামানের দিকে তাকাল যেন তিনি তাদের আধ্যাত্মিক ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক পরিচালক, কারণ তিনি ছিলেন মার্জনীয় ও মরণশীল পাপ সংক্রান্ত গভীর তথ্যের উৎস এবং এ বিষয়ক কর্তৃপক্ষ, সেইসঙ্গে স্বর্গ, নরক ও স্বর্গে প্রবেশের আগে আত্মার শুদ্ধিকরণের গোপনীয়তা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অধিক প্রাজ্ঞ।
ফাদার সামানের দায়িত্ব হল উত্তর লেবাননের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, ধর্মপ্রচার করা এবং পাপের আধ্যাত্মিক অসুখ থেকে মানুষকে সারিয়ে তোলা এবং তাদেরকে রক্ষা করা শয়তানের ভয়াবহ ফাঁদ থেকে। শ্রদ্ধেয় ফাদার সবসময়ই শয়তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। কৃষকেরা এই যাজককে শ্রদ্ধা করত এবং সোনা ও রুপার বিনিময়ে তার অনুগ্রহ পাওয়ার ব্যাপারে তারা শঙ্কিত থাকলেও প্রতি ফসল তোলার মৌসুমে যাজককে তারা তাদের ক্ষেতের সবচেয়ে ভালো ফসলগুলি উপহার দিত।
শরতের এক সন্ধ্যায় ফাদার সামান একটা নির্জন গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পাহাড় ও উপত্যকা পেরিয়ে যাবার সময় তিনি শুনতে পেলেন রাস্তার পাশের খাদ থেকে যন্ত্রণাকাতর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। তিনি থামলেন এবং শব্দ অনুসরণ করে তাকালেন এবং দেখতে পেলেন পোশাকহীন একটি মানুষ খাদের ভেতরে শুয়ে আছে। তার মাথা ও বুকের ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তের ধারা। সে কাতরাচ্ছে এবং সাহায্যের আবেদন জানিয়ে বলছে, ‘আমাকে রক্ষা করুন, আমাকে সাহায্য করুন। আমি মারা যেতে বসেছি। আমার প্রতি দয়া করুন।’ ফাদার সামান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন লোকটার প্রতি এবং মনে মনে বললেন, ‘লোকটি নিশ্চয়ই চোর, সম্ভবত সে কোনো পথিকের সম্পদ লুট করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ তাকে আহত করেছে। এখন লোকটি মারা গেলে তার মৃত্যুর জন্য আমি অভিযুক্ত হতে পারি।’
অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। মৃত্যুপথযাত্রী তাকে থামাল এই বলে, ‘আমাকে পরিত্যাগ করে যাবেন না। আমি মারা যাচ্ছি।’ ফাদার আবার গভীরভাবে চিন্তা করলেন, তার মুখ মলিন হয়ে গেল যখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে তিনি সাহায্য করতে অস্বীকার করেছেন। তার ঠোঁট শিহরিত হচ্ছিল কিন্তু তিনি নিজেকে বললেন, ‘অবশ্যই সে সেইসব পাগলদের একজন, যে এই বন্যতার ভেতরে দীর্ঘ ভ্রমণ শুরু করেছে। তার ক্ষত দেখে আমার হৃদয় ভীত হয়েছে, এখন কী করব আমি? অবশ্যই একজন আধ্যাত্মিক চিকিৎসক আহত মাংসের শরীরকে চিকিৎসা করতে সক্ষম নয়।’ ফাদার সামান কয়েক পা সামনে এগোলেন। তখন আবার তার কানে এল একজন প্রায় মৃতমানুষের উচ্চারণ, যা ছিল একটা বেদনাপূর্ণ অভিযোগ এবং যা পাথরের হৃদয়কেও গলিয়ে ফেলে। সে শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল, ‘আমার কাছে আসুন, কারণ দীর্ঘদিন ধরে আমরা বন্ধু… আপনি হলেন ফাদার সামান, চমৎকার মেষপালক এবং আমি চোর কিংবা পাগল নই… আমার কাছে আসুন এবং আমাকে এই স্থানে মরতে দেবেন না। কাছে আসুন। আমি আপনাকে বলব আমি কে?
ফাদার সামান লোকটার কাছে এলেন, হাঁটু গেড়ে বসলেন এবং স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, কিন্তু তিনি অন্য একধরনের বিপরীত ও বিস্ময়কর মুখ সেখানে দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন খুনের প্রবণতার সাথে বুদ্ধিবৃত্তি, কদর্যতার সঙ্গে সৌন্দর্য এবং কোমলতার সঙ্গে অসততা। তিনি দ্রুত কাছে গেলেন এবং চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি কে?’
মূর্ছা যাওয়ার স্বরে মৃত্যুপথযাত্রী লোকটা বলল, ‘আমাকে ভয় পাবেন না ফাদার, কারণ দীর্ঘদিন ধরে আমরা ভালো বন্ধু। আমাকে দাঁড়াতে সাহায্য করুন এবং আমাকে নিয়ে চলুন ছোট নদীটার কাছে এবং আমার আহত স্থানটি পরিষ্কার করে দিন আপনার লিনেনের পোশাক দিয়ে।’ ফাদার আবার তদন্ত করলেন, ‘আমাকে বলো তুমি কে, কারণ আমি তোমাকে চিনি না, এমনকি তোমাকে দেখেছি বলেও মনে করতে পারছি না।’
যন্ত্রণাদায়ক কণ্ঠে লোকটি উত্তর দিল, ‘আপনি আমার পরিচয় জানেন। আপনি অন্তত আমাকে এক হাজার বার দেখেছেন এবং প্রতিদিন কথা বলেছেন আমার সঙ্গে… আপনার জীবনের চেয়েও আমি প্রিয় ছিলাম আপনার কাছে।’ ফাদার কঠোর স্বরে তিরস্কার করে বললেন, ‘তুমি একটা মিথ্যাবাদী, ভণ্ড। একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের উচিত সত্যকথা বলা… আমি তোমাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভোগাব, তোমার পলাতক জীবনের রক্তে ভেজাব তোমাকে।’ আহত লোকটা একটু নড়াচড়া করল এবং এই যাজকের চোখের দিকে তাকাল, তার ঠোঁটে ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি এবং সে খুব শান্ত, গভীর ও সুরেলা কণ্ঠে বলল, ‘আমি হলাম শয়তান।
এই ভীতিকর শব্দ শুনে ফাদার সামানের কণ্ঠে এক ভয়াবহ কান্না উচ্চারিত হল। ফলে কেঁপে উঠল উপত্যকার দূরবর্তী কোণাগুলিও। তারপর তিনি স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন এবং উপলব্ধি করলেন যে মৃত্যুপথযাত্রী এই লোকটির শরীরের সামঞ্জস্যহীন বিকৃতির সঙ্গে গ্রামের চার্চের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ধর্মীয় ছবির শয়তানের অসম্ভব মিল রয়েছে। সে ভীত হয়ে জীজ্ঞাসা করল ‘ঈশ্বর আমাকে তোমার নারকীয় প্রতিমূর্তি দেখিয়েছেন এবং এই মুহূর্তে তোমাকে ঘৃণা করার তা হচ্ছে যথাযথ কারণ। তুমি অভিশপ্ত হবে চিরকাল। এই সংক্রমিত শাবক মেষপালক দ্বারা অবশ্যই ধ্বংস হবে যেন সে অন্য শাবকদেরকে সংক্রমিত না করে।’
শয়তান উত্তর দিল, ‘তাড়াহুড়ো করবেন না ফাদার এবং সময় নষ্ট করবেন না বাজে কথা বলে… দ্রুত আমার ক্ষতের কাছে আসুন আমার শরীর থেকে জীবনটা বেরিয়ে যাবার আগে।’
যাজক প্রতিবাদ করলেন, ‘যে হাত প্রতিদিন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হয় তা নরকের নির্যাসে তৈরি শরীরকে স্পর্শ করবে না… তুমি মানবতা ও যুগের জিহ্বা দ্বারা অভিশপ্ত হবে, কারণ তুমি মানবতার শত্রু এবং তোমার অঙ্গীকারকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত সদ্গুণকে ধ্বংস করা।’
শয়তান তীব্র মনোকষ্টে নড়ে উঠল এবং কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে নিজেকে তুলে ধরল এবং বলল, ‘আপনি জানেন না আপনি কী বলছেন, এমনকি উপলব্ধি করতে পারছেন না নিজের ওপর কী ধরনের অপরাধ করার অঙ্গীকার আপনি করছেন। মনোযাগ দিন, কারণ আমি আমার কাহিনী এর সঙ্গে সম্পর্কিত করব। আমি আজ একাকী এই নির্জন উপত্যকায় ভ্রমণ করছিলাম। এই স্থানে যখন পৌঁছালাম তখন একদল দেবদূত অবতরণ করল আমাকে আক্রমণ করতে এবং তারা আমাকে মারাত্মকভাবে আঘাত করল। তাদের একজনের কাছে ছিল উজ্জ্বল আলোর দ্যুতি ছড়ানো একটা তরবারি যার দু’দিকই ধারালো। আমি তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই দীপ্তিমান তরবারির বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না।’ এক মুহূর্তের জন্য শয়তান থামল। তারপর আবার বলল, ‘এই অস্ত্রসজ্জিত দেবদূত- আমি বিশ্বাস করি সে ছিল মিখাইল— একজন দক্ষ যোদ্ধা। আমি কি নিজেকে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ছুঁড়ে দিইনি এবং ভান করিনি নিহত হওয়ার? নৃশংসভাবে সে আমাকে হত্যা করতে গিয়ে আমাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে।’
বিজয়ীর মতো সে স্বর্গের দিকে তাকাল। ফাদার বললেন, ‘মিখাইলের নাম আশীর্বাদপ্রাপ্ত হোক যে মানবতাকে রক্ষা করেছে পাপী শত্রু থেকে।’
শয়তান প্রতিবাদ করল, ‘মানবতার জন্য আমার ঘৃণা, আপনার নিজের প্রতি আপনার ঘৃণার চেয়ে বড় নয়… আপনি মিখাইলকে আশীর্বাদ করছেন যে কখনই আপনাকে উদ্ধার করতে আসে নাই… আমার পরাজয়ের মুহূর্তে আপনি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন, যদিও আমি ছিলাম এবং এখনও আছি আপনার প্রশান্তি ও সুখের উৎস… আপনি আমাকে আশীর্বাদ করতে অস্বীকার করেছেন এবং আপনি আমার প্রতি আপনার দয়াও দীর্ঘায়িত করবেন না, কিন্তু আপনি বেঁচে থাকবেন এবং সমৃদ্ধি লাভ করবেন আমার অস্তিত্বের ছায়ায়… আপনি গৃহীত হয়েছেন আমার অস্তিত্বের জন্য কৈফিয়ত হিসেবে এবং জীবন বিকাশের অস্ত্র হিসেবে এবং আপনার কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতাকে তুলে ধরার জন্য আপনি ব্যবহার করেন আমার নাম। আমার অতীত কি আপনাকে আমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে পরিণত করেনি? আপনি কি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছেছেন পুঞ্জীভূত সম্পদের ভেতরে যা আপনার প্রয়োজন? আপনি কি লক্ষ্য করেছেন আপনার অনুসারীদের কাছ থেকে আমার রাজ্যকে হুমকি হিসেবে ব্যবহার করে অধিক সোনা ও রুপা আদায় করা অসম্ভব?’
‘আপনি কি উপলব্ধি করেন না, আমি যদি মারা যাই তাহলে আপনি না-খেয়ে মারা যাবেন? আজ যদি আমাকে মারা যাওয়ার অনুমতি দেন তাহলে আগামীকাল আপনি কী করবেন? যদি আমার নাম অদৃশ্য হয়ে যায়, কোন্ বিশেষ প্রেরণাকে আপনি তাড়া করবেন? কারণ অনেকগুলি দশক ধরে আপনি এসব গ্রামের যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং জনগণকে সতর্ক করেছেন আমার হাতে যেন তারা ধরা না পড়ে। তারা আপনার পরামর্শ কেনে খুবই অল্পমূল্যে এবং ক্ষেতের ফসল দিয়ে। আগামীকাল তারা আপনার কাছ থেকে কী কিনবে, যদি তারা আবিষ্কার করতে পারে যে তাদের মন্দ শত্রুটির অস্তিত্ব আর থাকছে না? আমার সঙ্গে সঙ্গে আপনার পেশাও মারা যাবে, কারণ মানুষ পাপমুক্ত থাকবে। যাজক হিসেবে, আপনি কি মনে করেন না যে শুধুমাত্র শয়তানের অস্তিত্বই সৃষ্টি করেছে তার শত্রু—চার্চ? সেই প্রাচীন দ্বন্দ্বই হচ্ছে সেই গোপন হাত যা বিশ্বাসীদের পকেটের সোনা ও রুপাগুলোকে সরিয়ে নেয় এবং তা জমা করে চিরকালের জন্য ধর্মপ্রচারক ও মিশনারিদের পকেটে। কীভাবে আপনি আমাকে মারা যাওয়ার অনুমতি দিতে পারেন, যখন আপনি জানবেন যে এতে আপনার সম্মান হানি হবে, সম্মান হারাবে চার্চ, আপনার গৃহ এবং আপনার জীবনযাপন।’
শয়তান মুহূর্তের জন্য নীরব হল এবং তার বিনয় পরিবর্তিত হল আস্থাশীল স্বাধীনতায় এবং সে বলে যেতে লাগল, ‘ফাদার আপনি গর্বিত কিন্তু অজ্ঞ। আমি আপনার কাছে প্রকাশ করব ইতিহাস এবং তার ভেতরে আপনি দেখতে পাবেন সত্য আমাদের দুজনের অস্তিত্বকেই সংযুক্ত করেছে এবং আমার অস্তিত্বকে আপনার বিবেকের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে।
সময় শুরুর প্রথম ঘণ্টায় মানুষ সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়াল। দুবাহু বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে এবং চিৎকার করে প্রথম বলল, ‘আকাশের পেছনে আছে বিশাল, প্রেমময় ও দয়ালু ঈশ্বর।’ তারপর আলোর বিশাল বৃত্তের দিকে পেছন ফিরল এবং দেখল পৃথিবীর ওপর তার ছায়া এবং সে অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল, ‘পৃথিবীর গভীরতম প্রদেশে অন্ধকারময় অশুভ আত্মা বসবাস করে যে অন্যায় কাজ করতে ভালোবাসে।’
মানুষ সেই গুহা অভিমুখে হাঁটল এবং নিজের সঙ্গে ফিসফিস করল, ‘দুটি শক্তির মাঝখানে যারা পরস্পরকে বাধ্য করানোর চেষ্টা করছে, এর একটার ভেতরে আমাকে অবশ্যই আশ্রয় নিতে হবে এবং অন্যটির বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই সংগ্রাম করব। মিছিলে কুচকাওয়াজ করছে যুগেরা, যখন মানুষ দুটো শক্তির মাঝখানে অবস্থান করে তখন একজন আশীর্বাদ করে কারণ সে মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে ওঠে এবং অন্যজন অভিশপ্ত হয়, কারণ সে তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। কিন্তু সে কখনই একটি আশীর্বাদ ও একটি অভিশাপের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। সে ছিল দুজনের মাঝখানে একটা গাছের মতো, বসন্তে তা প্রস্ফুটিত হয় এবং শীতকালে তাতে কাঁপুনি ওঠে।’
‘মানুষ যখন সভ্যতার ভোরবেলাকে প্রত্যক্ষ করেছিল যা ছিল মানুষের উপলব্ধি এবং পরিবার একক হিসেবে অস্তিত্বে পরিণত হল। তারপর এল গোত্র, যেখানে শ্রম বিভক্ত হয়েছিল সামর্থ্য ও আকাঙ্ক্ষা অনুসারে। এক গোত্র ভূমি চাষ করবে, অন্য গোত্র নির্মাণ করবে আশ্রয়, অন্যেরা পোশাক বুনবে অথবা শিকার করবে খাবারের জন্য। পরবর্তীকালে বিভক্তিই পৃথিবীর ওপর এর মুখমণ্ডলকে তৈরি করেছিল এবং এটা হচ্ছে মানুষ কর্তৃক গৃহীত প্রথম পেশা যা কোনো অপরিহার্য আকাঙ্ক্ষা যা প্রয়োজনকে অধিকার করে রাখে না।
শয়তান মুহূর্তের জন্য কথা বলা বন্ধ করল। তারপর সে উচ্চহাসি হাসল এবং তার আনোন্দচ্ছ্বাস শূন্য উপত্যকাকে নাড়া দিল, কিন্তু তার উচ্চহাসি তার ক্ষতের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং সে ক্ষতের ওপর হাত রেখে ব্যথায় কষ্ট পেতে থাকে। সে আবার বলতে থাকে, ‘চতুর অনুমান বিস্ময়কর রীতিতে পৃথিবীতে আবির্ভূত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল।’
সেখানে প্রথম গোত্রের একজন মানুষ ছিল যাকে লা উইস বলে ডাকা হত। আমি তার নামের উৎস সম্পর্কে জানতাম না। সে ছিল একজন বুদ্ধিমান প্রাণী কিন্তু সে ছিল চূড়ান্তভাবে অলস এবং সে ঘৃণা করত চাষবাস করতে, আশ্রয় নির্মাণ করতে, পশুর পালকে ঘাস খাওয়ানো অথবা শরীরের প্রয়োজনে কাউকে তাড়া করতে অথবা যে-কোনো ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে। সেই যুগে খাবার পর্যন্ত কষ্টকর পরিশ্রম ছাড়া অর্জন করা সম্ভব ছিল না। লা উইস শূন্য পাকস্থলী নিয়ে বহু রাত্রি ঘুমিয়েছিল।
গ্রীষ্মকালের এক রাত্রে সেই গোত্রের সদস্যরা একত্রিত হল তাদের গোত্রপ্রধানের পর্ণকুটিরের সামনে, দিনের পরিণতি সম্পর্কে কথা বলল এবং তারা অপেক্ষা করছিল তাদের সুখনিদ্রার জন্য। হঠাৎ এক লোক তার পায়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল এবং চাঁদের দিকে লক্ষ্য করে চিৎকার করল, ‘রাত্রির ঈশ্বরের দিকে তাকাও। তার মুখমণ্ডল কালো এবং তার সৌন্দর্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সে পরিণত হয়েছে একটা কালো পাথরে যা আকাশের অট্টালিকায় ঝুলছে।’ জনতা চাঁদের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল, আতঙ্কে চিৎকার করল এবং ভয়ে কাঁপতে থাকল যেন অন্ধকারের হাত তাদের হৃদয়কে আঁকড়ে ধরেছে, কারণ তারা দেখছিল রাত্রির ঈশ্বর ধীরে ধীরে একটা কালো গোলাকার বস্তুতে পরিণত হচ্ছে, যা পৃথিবীর উজ্জ্বল প্রসন্নতাকে পরিবর্তন করেছিল এবং পাহাড় ও উপত্যকাগুলি তাদের চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল একটা কালো অবগুণ্ঠনের পিছনে।
সেই মুহূর্তে লা উইস, যে আগে একটা চন্দ্রগ্রহণ দেখেছিল, সে এই সাধারণ কারণটা উপলব্ধি করতে পারল এবং কয়েক পা এগিয়ে গেল এই গ্রহণের সুবিধা নেওয়ার জন্য। সে ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়াল, হাত তুলল আকাশের দিকে এবং কঠিন স্বরে তাদেরকে বলল, ‘হাঁটু গেড়ে বসো এবং প্রার্থনা করো, কারণ অখ্যাতির মন্দ ঈশ্বর সংগ্রামের ভেতরে শৃঙ্খলিত রাত্রির ঈশ্বরের আলোকসজ্জার সাথে, যদি এই মন্দ ঈশ্বর তাকে জয় করে নেয়, তাহলে আমরা প্রত্যেকেই ধ্বংস হয়ে যাব কিন্তু যদি রাত্রির ঈশ্বর তার ওপর জয়ী হয় তাহলে আমরা বেঁচে থাকব… প্রার্থনা করো এখন… পৃথিবীর আড়ালে তোমার মুখ ঢেকে ফ্যালো… বন্ধ করো তোমাদের চোখ, এবং আকাশের দিকে মাথা তোলো, কারণ এটা হল সেই, যে এই দুই ঈশ্বরের মল্লযুদ্ধের সাক্ষী এবং সে তার দৃষ্টিশক্তি হারাবে এবং তার মনে সৃষ্টি হবে বিভ্রান্তি এবং সে অন্ধ ও উন্মাদ হয়ে সারাজীবন কাটাবে। তোমাদের মাথাটা একটু নিচের দিকে বাঁকাও এবং তোমাদের হৃদয়ের সমস্ত প্ররোচনাসহ শত্রুর বিরুদ্ধে রাত্রির ঈশ্বর সক্রিয় হয়ে আছেন, যে হচ্ছে আমাদের মরণশীল শত্রু।’
লা উইস কথা বলে যেতে লাগল, তার নিজের বাছা বাছা দুর্বোধ্য শব্দাবলি দিয়ে, যা তারা কখনও শোনেনি। এইসব কুশলী প্রচারণার পর, চাঁদ তার নিজস্ব মহিমায় প্রত্যাবর্তন করল। লা উইস আগের থেকে গলা চড়িয়ে চিত্তাকর্ষক কণ্ঠে বলল, ‘জেগে ওঠো এবং চাঁদের ঈশ্বরের দিকে তাকাও যে তার শত্রুকে জয় করেছে। সে যাত্রাবিরতি করেছে নক্ষত্রদের ভেতরে। এটা জানা দরকার যে তোমাদের প্রার্থনাই তাকে সাহায্য করেছে অন্ধকারের অশুভ আত্মাকে অতিক্রম করতে। এখন সে খুবই খুশি এবং যে-কোনো সময়ের চেয়ে উজ্জ্বলতর।
জনতা জেগে ওঠে এবং চাঁদের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকায়, যা পূর্ণ দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছিল। তাদের ভয় পরিণত হল প্রশান্তিতে এবং তাদের দ্বিধা ছিল তাদের আনন্দ। তারা নাচতে ও গাইতে শুরু করল এবং তাদের হাতের মোটা ছড়ি দিয়ে তারা আঘাত করতে লাগল লোহার পাতের ওপর এবং উপত্যকা পরিপূর্ণ করে তুলল তাদের চিৎকার ও চেঁচামেচিতে।
‘সেই রাতে গোত্রপ্রধান লা উইসকে ডেকে বলল, ‘তুমি যা করেছ তা আগে কেউ কখনও করতে পারেনি… তুমি লুকানো জ্ঞান সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছ যা আমাদের কেউই আগে উপলব্ধি করত না। আমার জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে তুমি গোত্রের ভেতরে আমার পর সর্বোচ্চ সদস্যের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছ। আমি গোত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ এবং তুমি হলে সর্বোচ্চ জ্ঞানী ও বিদ্বান মানুষ… আমাদের জনগণ ও ঈশ্বরের ভেতর তুমিই হলে মাধ্যম যার আকাঙ্ক্ষা ও কর্মকাণ্ড তুমি ব্যাখ্যা করতে পারো এবং তুমি আমাদেরকে সেইসব শিক্ষা দেবে যা ঈশ্বরের ভালোবাসা ও আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়।
লা উইস প্রতারণার সঙ্গে নিশ্চিত করল, ‘স্বর্গীয় স্বপ্নের ভেতরে মানুষ-ঈশ্বর তার সবকিছুই আমার কাছে প্রকাশ করেছেন, যা জাগরণের ভেতরে তোমার কাছে বহন করে নেওয়া হবে এবং সম্ভবত তোমার ও তাঁর মাঝে আমি সরাসরি ক্রিয়াশীল এ ব্যাপারে তোমার আস্থা রয়েছে।’ গোত্রপ্রধান লা উইসকে নিশ্চিত করল এবং তাকে প্রদান করল দুটো ঘোড়া, সাতটা বাছুর, সত্তরটা ভেড়া এবং সত্তরটি মেষশাবক এবং বলল, ‘গোত্রের লোকেরা তোমার জন্য একটা মজবুত গৃহ নির্মাণ করবে এবং প্রতি ফসল তোলার মৌসুম শেষে আমরা তোমাকে ফসল উপহার দেব। সুতরাং তুমি বেঁচে থাকবে শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত প্রভু হিসেবে।
লা উইস উঠে দাঁড়াল এবং চলে যাবার উদ্যোগ নিল, কিন্তু গোত্রপ্রধান তাকে থামাল এবং বলল, ‘তুমি যাকে মানুষ-ঈশ্বর বলো সে কে এবং কী? কে সেই সাহসী ঈশ্বর যে মহিমান্বিত রাত্রির ঈশ্বরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে রত হয়? আমরা তার সম্পর্কে আগে কখনও ভেবে দেখি নাই।’ লা উইস হাত দিয়ে তার কপাল ঘষল এবং বলল, ‘হে আমার সম্মানিত প্রভু, প্রাচীনকালে মানুষ সৃষ্টিরও আগে সমস্ত ঈশ্বরেরা একত্রে শান্তিতে বসবাস করত নক্ষত্রের বিশালতার পেছনে অবস্থিত উচ্চতর পৃথিবীতে। ঈশ্বরদের ঈশ্বর ছিল তাদের পিতা এবং তারা জেনেছিল সেইসব যা তারা জানত না এবং তারা সেইসব করেছিল যা তারা করতে সক্ষম ছিল না। তিনি নিজের জন্য রেখেছিলেন ঐশ্বরিক গোপনীয়তা, অনন্তকালের আইনের ওপরে যার অবস্থান। দ্বাদশ যুগের সপ্তম বৈশিষ্ট্যসূচক সময়ে, বাহতার এর আত্মা, যে বিশাল ঈশ্বরকে ঘৃণা করেছিল, বিদ্রোহ করেছিল এবং দাঁড়িয়েছিল তার পিতার সামনে এবং বলেছিল, কেন আপনি নিজের জন্য সেই বিশাল কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাকে রক্ষা করছেন সমস্ত সৃষ্টির ওপর, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গোপনীয়তা ও আইন লুকিয়ে ফেলছেন আমাদের কাছ থেকে? আমরা কি আপনার সন্তান নই, যারা আপনাকে বিশ্বাস করে এবং আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করে উপলব্ধি ও অনন্ত অস্তিত্ব?’
‘ঈশ্বরদের ঈশ্বর রাগান্বিত হল এবং বলল, ‘আমি আমার জন্য সংরক্ষণ করব প্রাথমিক জ্ঞান, বিশাল কর্তৃপক্ষ এবং অত্যাবশ্যকীয় গোপনতা, কারণ আমিই শুরু এবং আমিই শেষ।’
বাহতার উত্তরে বলল, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমার সঙ্গে আপনার ক্ষমতা ও পরাক্রমশীলতা ভাগাভাগি না করছেন ততক্ষণ আমি, আমার সন্তান ও তাদের সন্তানেরা আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে!’ সেই মুহূর্তে স্বর্গের গভীরতায় ঈশ্বরদের ঈশ্বর তার সিংহাসনের ওপর উঠে দাঁড়ালেন এবং সামনে বাড়িয়ে ধরলেন তরবারি এবং ঢাল হিসেবে আঁকড়ে ধরলেন সূর্যকে এবং এমনভাবে চিৎকার করে কথা বললেন যা অনন্তকালের প্রতিটি বাঁককে কাঁপিয়ে তুলল, ‘নেমে এসো হে বিদ্রোহী বদমাশ এই নিম্নতর পৃথিবীতে যেখানে সমস্ত মন্দ আত্মা বসবাস করে। সেখানে সে জীবনের শপথ করে যুদ্ধ করবে তার পিতা ও ভাইদের সঙ্গে, যারা তাদেরকে ভালোবাসে তাদের আত্মাকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে।
গোত্রপ্রধান মনোযোগ দিয়ে সবই শুনলেন, তার কপালে ভাঁজ পড়ল এবং তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল, ‘তাহলে অশুভ ঈশ্বরের নাম বাহতার?’ লা উইস উত্তরে বলল, ‘যখন সে উচ্চতর পৃথিবীতে ছিল তখন তার নাম ছিল বাহতার, কিন্তু যখনই সে নিচের পৃথিবীতে প্রবেশ করল তখন সে সফলভাবে কতগুলি নাম গ্রহণ করে- বাল জাবউল, শাতানেহল, বালিল, জামিয়েল, আহরিমান, মায়া, আবদন, ডেভিল এবং সবশেষে শয়তান যে নাম সবচেয়ে খ্যাত।
গোত্রপ্রধান শিহরিত কণ্ঠস্বরে অনেকবার উচ্চারণ করল : ‘শয়তান, যা ছিল বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সময় শুকনো শাখায় যেরকম শব্দ ওঠে ঠিক সেরকম। তারপর সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন মানুষকে শয়তান ঘৃণা করে, ঈশ্বরকে ঘৃণা করার মতো?
লা উইস দ্রুত জবাব দিল, ‘মানুষকে ঘৃণা করে, কারণ মানুষ হচ্ছে শয়তানের ভাই ও বোনের বংশধর।’ গোত্রপ্রধান হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘শয়তান হচ্ছে মানুষের খালাতো ভাই’; সন্দেহ ও বিরক্তি-মেশানো কণ্ঠস্বরে সে প্রতিবাদ করল, ‘হ্যাঁ প্ৰভু, কিন্তু সে হল তাদের বিশাল শত্রু যে তাদের দিনগুলি দুর্দশায় এবং রাত্রিগুলিকে ভয়াবহ স্বপ্নে ভরে তোলে। সে-ই হচ্ছে ক্ষমতা যে ঝড়কে পরিচালিত করে তাদের কুঁড়েঘরের দিকে এবং শস্যক্ষেতে বহন করে আনে দুর্ভিক্ষ এবং আরও বহন করে আনে রোগব্যাধি তাদের ও তাদের পশুর জন্য। সে হচ্ছে একটি অশুভ আত্মা এবং শক্তিশালী ঈশ্বর। সে খারাপ এবং সে তখন উল্লসিত হয় যখন আমরা দুঃখে থাকি এবং আমরা যখন উচ্ছ্বসিত তখন সে বিলাপ করে। জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা অবশ্যই তাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখব, তার খারাপ গুণগুলিকে আমরা এড়িয়ে যাব। আমরা অবশ্যই তার চরিত্র বিশ্লেষণ করব, যেন আমরা তার ফাঁদ বিছানো পথে পা না দিই।’
গোত্রপ্রধান তার মাথাটা তার হাতের মোটা ছড়িতে ঠেস দিল এবং ফিসফিস করে বলল, ‘এই মাত্র আমি সেই বিস্ময়কর ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ গোপনীয়তা সম্পর্কে জেনেছি যে ঝড়কে পরিচালিত করে আমাদের গৃহের দিকে এবং বহন করে আনে মহামারী আমাদের ও আমাদের পশুগুলির ওপর। জনগণ সবকিছুই শিখবে যা যা আমি এখন উপলব্ধি করেছি এবং লা উইস আশীর্বাদপ্রাপ্ত, সম্মানিত ও মহিমান্বিত হবে তাদের কাছে, তাদের শক্তিশালী শত্রুর রহস্য উন্মোচন করার জন্য এবং তাদেরকে পরিচালিত করবে খারাপ পথ থেকে ভালো পথে যেতে।
লা উইস গোত্রপ্রধানকে তাগ করে তার অবসর গ্রহণের জায়গায় চলে গেল। নিজের উদ্ভাবন-কুশলতায় খুশি এবং আনন্দ ও অলীক-কল্পনার মদে সে নেশাগ্রস্ত। এই প্রথম গোত্রপ্রধান এবং গোত্রের প্রতিটি মানুষ শুধু লা উইস ছাড়া সুখনিদ্রার রাত্রি কাটিয়েছিল এবং তাদেরকে ঘিরে রেখেছিল উদ্ভট ভূত, ভীতিপূর্ণ অপচ্ছায়া এবং বিরক্তিকর স্বপ্নগুলি। শয়তান মুহূর্তের জন্য থামল। ফাদার সামান স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন এবং ফাদারের ঠোঁটের ওপর আবির্ভূত হল মৃত্যুর পীড়িত হাসি। তারপর শয়তান আবার বলতে শুরু করল, ‘অতিপ্রাকৃত উপায়ে ভবিষ্যৎ জানার পদ্ধতি এল পৃথিবীতে এবং সেটাই ছিল আমার অস্তিত্ব—এর আবির্ভূত হওয়ার কারণ। লা উইস হচ্ছে প্রথম ব্যক্তি যে বিশেষ প্রেরণা হিসেবে আমার নিষ্ঠুরতাকে গ্রহণ করেছিল। তার মৃত্যুর পর এই পেশা তার সন্তানদের দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে এবং সমৃদ্ধি লাভ করে যতক্ষণ-না তা ঐশ্বরিক পেশায় পরিণত হয়। এই পেশাকে তাড়া করে ফেরে তারাই যাদের মন পরিপক্ক হয়েছে জ্ঞানের দ্বারা, যাদের আত্মা মহৎ, হৃদয় শুদ্ধ এবং যাদের অলীক কল্পনা হচ্ছে বিশাল।
ব্যাবিলনে জনগণ প্রার্থনাকালে অভিবাদন জানিয়েছিল সেই যাজককে যে আমার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল তার অসংখ্য সদ্গুণ নিয়ে, নিনেভে তারা একটা লোকের দিকে তাকিয়েছিল, যে দাবি করেছিল সে আমার ভেতরের গোপনীয়তাগুলি জানে মানুষ ও ঈশ্বরের ভেতরের সোনালি সংযোগ হিসেবে… তিব্বতে তারা সেই লোককে আহ্বান জানিয়েছিল যে আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে রত হয়েছিল। চন্দ্র ও সূর্যের পুত্ররা… বিবলজ, ইফিসাস ও এ্যান্টিওচ-এ তারা তাদের সন্তানকে আমার প্রতিপক্ষের জন্য উৎসর্গ করেছিল… জেরুজালেম এবং রোমে তারা তাদের জীবনকে সেই ব্যক্তির হাতে অৰ্পণ করেছিল যে দাবি করেছিল যে তারা আমাকে ঘৃণা করেছে এবং তাদের সমস্ত পরাক্রমশীলতাসহ তারা যুদ্ধ করেছিল।
সূর্যের নিচে অবস্থিত প্রতিটি শহরে আমার নাম ছিল ধর্ম, শিল্পকলা ও দর্শন শিক্ষাকেন্দ্রের অক্ষরেখা। এটা আমার জন্য হয়নি, কোনো মন্দিরও নির্মিত হয়নি, নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ কোনো স্থানে। আমি হলাম উদ্দীপনা যা মানুষের ভেতরে দৃঢ়তা সৃষ্টি করে…. আমি হলাম সেই উৎস যা চিন্তার মৌলিকতাকে প্ররোচিত করে… আমি হলাম সেই হাত যা মানুষের হাতকে গতিশীল করে তোলে… আমি হলাম শয়তান এবং চিরস্থায়ী। আমি হলাম শয়তান যার সঙ্গে বিধিসম্মতভাবে যুদ্ধ করে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে হয়। যদি তারা আমার বিরুদ্ধে সংগ্রাম থামিয়ে দেয়, তাদের ভয়াবহ কল্পকাহিনীর রহস্যময় দণ্ড হিসেবে নিষ্ক্রিয়তা তাদের মন, হৃদয় ও আত্মাকে হত্যা করবে।
আমি হলাম রাগান্বিত এবং শব্দহীন প্রচণ্ড ঝড়, যা পুরুষের মন এবং নারীর হৃদয়কে নাড়া দেয় এবং আমার ভয়ের ভেতরে তারা ভ্রমণ করবে সেইসব প্রার্থনার স্থানগুলি আমাকে নিন্দা করতে অথবা পাপের স্থানগুলি আমাকে সুখী করতে আমার আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে। রাত্রির নীরবতায় যে সন্ন্যাসী প্রার্থনা করে তার বিছানা থেকে সরে যেতে বেশ্যাদের সে আমাকে তার কক্ষে নিমন্ত্রণ জানায়। আমি হলাম শয়তান চিরস্থায়ী এবং চিরন্তন। আমি হলাম গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের আশ্রম এবং ভয়ের ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা মঠের নির্মাতা। আমি নির্মাণ করি পানশালা এবং আরও নির্মাণ করি লালসা ও আত্মসন্তোষের ভিত্তির ওপর মন্দদের গৃহ। ভয়ের অস্তিত্ব যদি না থাকে তাহলে উপভোগ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং তাদের বিলুপ্তির ভেতর দিয়ে আশা ও আকাঙ্ক্ষার কোনো অস্তিত্ব মানুষের হৃদয়ে থাকবে না। জীবন শূন্য ও শীতল হয়ে যাবে ছেঁড়া তারের বাদ্যযন্ত্রের মতো। আমি হলাম শয়তান এবং চিরস্থায়ী।
‘আমি হলাম মিথ্যাচার, অপবাদ, প্রতারণা, কপটতা এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বিশেষ প্রেরণা এবং এসব প্রবৃত্তি যদি পৃথিবী থেকে অপসারিত হয় তাহলে মানবসমাজ একটা পরিত্যক্ত ভূমিতে পরিণত হবে, যেখানে কেউই সাফল্য অর্জন করতে পারবে না এবং পৃথিবী হবে সদগুণের সিংহাসন। আমি হলাম শয়তান এবং চিরস্থায়ী।
‘আমি হলাম পাপের পিতা ও মাতা। যদি পাপ বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে পাপের সংগ্রামকারীরাও এর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তাদের পরিবার ও কাঠামোসহ। সকল অশুভ আত্মার হৃদয় আমি। আপনি কি মানসিক গতিশীলতা কামনা করবেন বিরতির মাধ্যমে আমার হৃদস্পন্দনকে থামিয়ে দিতে? কারণ ধ্বংসের পর আপনি কি গ্রহণ করবেন এর ফলাফল? আমি হলাম সেই কারণ! আপনি কি আমাকে অনুমতি দেবেন এই পরিত্যক্ত বন্যতার ভেতরে মারা যেতে? আমাদের দুজনের মাঝখানে বিদ্যমান যে অন্ধকার তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলার আকাঙ্ক্ষা কি রয়েছে আপনার? হে যাজক, আমার কথার উত্তর দিন।’
শয়তান তার দুবাহু প্রসারিত করে মাথাটা সামনের দিকে একটু বাঁকা করল। তার মুখমণ্ডল ধূসর হয়ে গেল এবং সে তার মুখের সঙ্গে নীলনদীর তীরে বর্জ্য হিসেবে পড়ে থাকা মূর্তিগুলির মিল খুঁজে পেল। তারপর সে তার উজ্জ্বল চোখদুটো ফাদার সামানের মুখের ওপর স্থাপন করল এবং দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আমি ক্লান্ত এবং দুর্বল। আমি ভুল করেছিলাম আমার অসুস্থ শক্তিকে ব্যবহার করে সেইসব বিষয়ের ওপর কথা বলতে যা আপনি ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন। এখন আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করতে পারেন… আপনি আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন এবং চিকিৎসা করতে পারেন আমার ক্ষতের অথবা মারা যাবার জন্য এখানে আমাকে পরিত্যাগ করে যেতে পারেন।’
ফাদার সামান শিহরিত হলেন এবং কম্পিত দুহাত ঘষাঘষি করলেন এবং ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন ‘এখন আমি সেইসব জানি যা একঘণ্টা আগেও আমার জানা ছিল না। ক্ষমা কর আমার অজ্ঞতাকে। আমি জানি যে পৃথিবীতে তোমার অস্তিত্ব প্রলোভন সৃষ্টি করেছে এবং প্রলোভন হচ্ছে একটা পরিমাপ যার মাধ্যমে ঈশ্বর মনুষ্য-আত্মার মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। এটা একটা পরিমাপ-দণ্ড যা আত্মাকে পরিমাপ করার জন্য সর্বময় ঈশ্বর ব্যবহার করে থাকেন। আমি নিশ্চিত যে, যদি তুমি মারা যাও, প্রলোভনও মারা যাবে এবং এর অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ধ্বংস করবে সেই আদর্শ ক্ষমতাকে, যা মানুষকে উন্নত ও সতর্ক করে।
‘তোমার অবশ্যই বাঁচা উচিত, কারণ যদি তুমি মারা যাও এবং মানুষ তা জানতে পারে তাহলে নরকের ভয় দূরীভূত হবে। তারা প্রার্থনা করবে না, কারণ কেউই তখন পাপ করবে না। তোমার অবশ্যই বেঁচে থাকা উচিত, কারণ তোমার জীবনের ভেতরেই পাপ ও অনাচার থেকে মানবতার পাপমোচন হয়ে থাকে।
‘যেমন আমি আমার ঘৃণাকে বিসর্জন দেব কারণ মানুষের জন্য আমার ভালোবাসার বেদির ওপরে রয়েছ তুমি।
শয়তান উচ্চহাসি হাসল এবং বলল, ‘আপনি একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ফাদার। যৌক্তিক ঘটনা সম্পর্কে বিস্ময়কর জ্ঞান আপনি অর্জন করেছেন! আপনার জ্ঞানের শক্তির মাধ্যমে আপনি লক্ষ্য করেছেন আমার অস্তিত্বের জন্য একটি উদ্দেশ্য, যা আমি কখনও বুঝতে পারি নাই এবং এখন আমরা বুঝতে পারছি দুজনকেই আমাদের দুজনের প্রয়োজন।
‘হে আমার ভাই, আমার কাছে আসুন, অন্ধকারে ডুবে আছে সমতলভূমি এবং আমার শরীরের অর্ধেক রক্ত এই উপত্যকার বালির তলায় পালিয়ে গেছে এবং আমার কিছুই নেই ভাঙাচোরা এই শরীর ছাড়া, যা আপনার সাহায্য না-পেলে মৃত্যু তাড়াতাড়ি ক্রয় করে নেবে।’ ফাদার সামান তার জামার হাত গুটিয়ে তার কাছাকাছি এল এবং শয়তানকে নিজের পিঠে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।
সেই উপত্যকার মাঝখানে নৈঃশব্দ গ্রাস করে নিয়েছিল সবকিছু এবং অলংকৃত করে তুলেছিল অন্ধকারের অবগুণ্ঠন। ফাদার সামান ভারী বোঝার নিচে পিঠটা বাঁকা করে গ্রামের দিকে চলেছেন। তার কালো পোশাক এবং লম্বা দাড়ি ভিজে গিয়েছিল, কিন্তু সে সংগ্রাম করছিল সামনে এগোনোর জন্য, তার ওষ্ঠ কাঁপছিল মৃত্যুপথযাত্রী শয়তানের জন্য ঐকান্তিক প্রার্থনায়!
মৎস্যকন্যা
সমুদ্রের গভীরতায় অসংখ্য দ্বীপ পরিবেষ্টিত যে-স্থান সেখানেই সূর্য ওঠে এবং সেখানেই রয়েছে গূঢ় রহস্য। সেখানে মুক্তার প্রাচুর্য রয়েছে এবং একটা যুবকের মৃত দেহকে বৃত্তকারে ঘিরে রেখেছে সমুদ্রবালিকারা, স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে গভীর নীল চোখ মেলে, নিজেদের মধ্যে কথা বলছে গানের সুরে সুরে। সমুদ্রের গভীরতা শ্রবণ করছে সেই কথোপকথন এবং ঢেউয়ের মাধ্যমে তা প্রেরণ করছে তীরের দিকে। রঙ্গপ্রিয় মৃদুমন্দ বাতাস সেই কথোপকথন আমার কাছেও বহন করে এনেছিল।
তাদের একজন বলল, ‘এটা হচ্ছে মানুষ যে গতকাল আমাদের পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে, যখন আমাদের সমুদ্র উত্তাল ছিল।’
দ্বিতীয় জন বলল, ‘আমাদের সমুদ্র উত্তাল ছিল না। মানুষ, যারা দাবি করে তারা ঈশ্বরের বংশধর, কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং তার রক্ত ঝরেছিল যতক্ষণ পানির রঙ টকটকে লাল না হয়ে ওঠে। এই মানুষ হচ্ছে যুদ্ধের শিকার।
তৃতীয় জন বলল, ‘আমি অবশ্য জানি না এই যুদ্ধ কী; কিন্তু আমি সেই লোকটাকে চিনি, ভূমি নিয়ন্ত্রণে আনার পর সে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সমুদ্রকে পরাভূত করার। সে একটা অদ্ভুত বস্তু উদ্ভাবন করেছিল যা তাকে বহন করে নিয়েছিল সমুদ্রের ওপর, যেখানে আমাদের নেপচুন ক্রুদ্ধ হয়েছিল তার লোভের কারণে। বিধিসম্মতভাবে নেপচুনকে খুশি করার জন্য মানুষ উৎসর্গ ও উপহার প্রদান করতে শুরু করেছিল এবং সেই লৌহকঠিন শরীর হল আমাদের সামনে মানুষের সবচেয়ে সাম্প্রতিক উপহার, আমাদের বিশাল ও ভয়াবহ নেপচুনের প্রতি।’
চতুর্থজন দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করল, কী বিশাল আমাদের নেপচুন এবং কী পরিমাণ নিষ্ঠুর তার হৃদয়! যদি আমি এই সমুদ্রের সুলতান হতাম তাহলে এ-ধরনের দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করতাম…। এখন এসো এবং চলো আমরা এই মুক্তিপণ পরীক্ষা করে দেখি। সম্ভবত আমরা আমাদেরকেই জ্ঞান দান করতে পারি, যেভাবে মানবগোষ্ঠী করে থাকে।’
মৎস্যকন্যারা এবার সেই যুবকের আরও কাছাকাছি এল এবং তার বুকপকেট অনুসন্ধান করে তার হৃদয়ের কাছে একটা বার্তা পেল। একজন সেই বার্তা উচ্চৈঃস্বরে পড়ে শোনাল অন্যদের :
‘প্ৰিয়তম :
‘আবার মধ্যরাত এসেছে এবং ঝরে পড়া অশ্রু ছাড়া আমার আর কোন স্বান্তনা নেই এবং আয়েশেরও কিছু নেই যুদ্ধের রক্তাক্ত থাবার ভেতর থেকে আমার কাছে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া। তোমার চলে যাওয়ার সময়ের কথাগুলি আমি ভুলতে পারি না। প্রত্যেক মানুষেরই অশ্রুজলের ওপর আস্থা রয়েছে যা কোনো একদিন অবশ্যই ফিরে আসে।’
‘হে আমার প্রিয়তম, আমি জানিনা তোমাকে কী বলব, কিন্তু আমার আত্মা নিজেকেই ঢেলে দেবে…। আমার আত্মা যা পৃথকীকরণের মাধ্যমে কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু সান্ত্বনা পেয়েছে ভালোবাসার দ্বারা, যা উপস্থাপন করেছে বেদনা, যা মূলত আনন্দ এবং দুঃখ, যা মূলত সুখ। যখন ভালোবাসা আমাদের হৃদয়কে একত্রিত করল এবং আমরা সেইসব দিনের দিকে তাকালাম যখন আমাদের দুটি হৃদয় যুক্ত হল ঈশ্বরের পরাক্রমশালী শ্বাসপ্রশ্বাসের ভেতরে। যুদ্ধ চিৎকার করে ভয়াবহ আহ্বান জানাল এবং তুমি তাকে অনুসরণ করলে এবং নেতার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তুমি তাকে আরও ক্ষিপ্রতা দান করলে।
এই দায়িত্ব কী, যা প্রেমিক-প্রেমিকাকে পৃথক করে এবং যা নারীদের বিধবা এবং শিশুদের এতিম হওয়ার কারণ? দেশপ্রেম কী যা যুদ্ধকে প্ররোচিত এবং সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভেতর দিয়ে। কী সেই কারণ যা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চেয়েও বড় যখন তা কারো জীবনের সঙ্গে তুলনীয়? এই দায়িত্ব কী যা গরিব গ্রামবাসীদের আমন্ত্রণ জানায় অত্যাচারী শাসকের মহিমাকে তুলে ধরার জন্য মারা যেতে? দায়িত্ব যদি কোনো জাতির শান্তি নষ্ট করে এবং দেশপ্রেম মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে তাহলে আমাদেরকে বলতে দাও, ‘দায়িত্ব এবং দেশপ্রেম হবে শান্তি।’ ‘না, না আমার প্রিয়তম, তুমি আমার কথায় কর্ণপাত কোরোনা। তোমার দেশের প্রতি সাহসী ও বিশ্বস্ত হও… ভালোবাসায় অন্ধ এক যুবতীর কথায় তুমি কর্ণপাত কোরোনা, যে বিদায়-সংবর্ধনা এবং একাকিত্বের ভেতরে নিঃশেষ হয়ে গেছে… যদি এ-জীবনে ভালোবাসা আমার কাছে তোমাকে ফিরিয়ে না আনে তাহলে আগামীজীবনে ভালোবাসা অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে।
তোমার অনন্তকাল
মৎস্যকন্যারা এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ যুবকের পোশাকের তলায় রেখে দিল এবং ধীরে ধীরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারা দূরে চলে গেল। মৃত সৈনিকের শরীর থেকে দূরে গিয়ে তারা একত্রিত হল এবং তাদের একজন বলল, ‘নেপচুনের নিষ্ঠুর হৃদয় থেকেও মানুষের হৃদয় অধিক কঠোর।’
আমরা এবং তোমরা
আমরা হলাম দুঃখের পুত্র এবং তোমরা হলে
আনন্দের পুত্র। আমরা হলাম দুঃখের পুত্র
এবং দুঃখ হচ্ছে ঈশ্বরের ছায়া, যা অশুভ আত্মার
রাজ্যে বাঁচে না।
আমরা হলাম দুঃখে পরিপূর্ণ আত্মা এবং এই ছোট্ট
হৃদয়ে দুঃখের অস্তিত্ব খুবই বিশাল।
যখন তোমরা হাসো তখন আমরা কাঁদি এবং
বিলাপ করি এবং যে নিজের অশ্রুজলে অন্যকে
পরিচ্ছন্ন ও শুকনো করে তোলে সে চিরকাল
শুদ্ধ থাকবে।
তোমরা আমাদেরকে বুঝতে পারো না, কিন্তু তোমাদের প্রতি
আমাদের সহানুভূতি রয়েছে। তোমরা জীবননদীর স্রোতের
সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে এবং তোমরা আমাদের কথা
বিবেচনা করো না, কিন্তু আমরা তীরেই বাসে আছি, দেখছি
তোমাদের এবং শুনছি তোমাদের বিস্ময়কর কণ্ঠস্বর।
তোমরা আমাদের ক্রন্দন উপলব্ধি করতে পারো না, কারণ
দিনের উচ্চ কলরব তোমাদের কর্ণকুহরকে কোলাহলে
পূর্ণ করে তুলেছে, সত্যের প্রতি তোমাদের উদাসীনতা
বাধাপ্রাপ্ত করে তুলেছে তোমাদের বছরগুলিকে, কিন্তু আমরা
শ্রবণ করি তোমাদের সংগীত, কারণ রাত্রির ফিসফিসানি
আমাদের অভ্যন্তরীণ আত্মাকে উন্মুক্ত করেছে। আমরা দেখি
তোমরা দাঁড়িয়ে আছ আলোর চিহ্নিত আঙুলের নিচে, কিন্তু
তোমরা আমাদেরকে দেখতে পাওনা, কারণ আলোকপ্রাপ্ত
অন্ধকারে আমরা হলাম আলকাতরার মতো।
আমরা হলাম দুঃখের পুত্র, আমরা হলাম, কবি, নবী ও
সংগীতজ্ঞ। আমরা ঈশ্বরীদের জন্য কাপড় বয়ন করি আত্মার
সুতো দিয়ে এবং দেবদূতদের হাত পূর্ণ করে তুলি
আমাদের অভ্যন্তরীণ সত্তার বীজ দিয়ে।
জাগতিক আনন্দ উল্লাসকে যারা তাড়া করে ফেরে
তোমরা হলে তাদের পুত্র। তোমরা হৃদয়কে স্থাপন
করো শূন্যতার হাতে, কারণ শূন্যতায় ঐ হাতের স্পর্শ
মসৃণ এবং আমন্ত্রণমূলক।
তোমরা বসবাস করো অজ্ঞতার গৃহে, কারণ ঐ গৃহে
কোনো আয়না নেই যেখানে তোমাদের আত্মারা দৃশ্যমান।
আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি এবং আমাদের দীর্ঘশ্বাস
থেকে উদ্ভূত হয় ফুলের ফিসফিসানি, পাতার খসখস,
আওয়াজ এবং ছোট্টনদীর মর্মরধ্বনি।
যখন তোমরা আমাদেরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করো, তখন
সেই বিদ্রূপ মিশে যায় চূর্ণবিচূর্ণ খুলি,
হাতকড়া ও বেড়ির ঝমঝম শব্দ এবং নরকের
হাহাকারের সাথে। যখন আমরা কাঁদি, তখন আমাদের
অশ্রু ঝরে পড়ে জীবনের হৃদয়ের ওপর, যেভাবে রাত্রির
চোখ থেকে সকালের হৃদয়ের
ওপর শিশির ঝরে পড়ে এবং যখন তোমরা হাসো তখন
তোমাদের উপহাসের হাসি ঝরে পড়ে
আহতের ওপর নাগিনীর বিষ ঝরে পড়ার মতো।
আমরা কাঁদি এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করি দুর্গত,
পথভ্রষ্ট এবং দুঃস্থ বিধবাদের প্রতি, কিন্তু তোমরা
সোনার ঔজ্জ্বল্য দেখলেই
উল্লসিত হও এবং হেসে ওঠো।
আমরা কাঁদি, কারণ আমরা গরিবের আহাজারি শ্রবণ
করি এবং শোক করি দুর্বল ও পীড়িতদের জন্য।
কিন্তু তোমরা হাসো কারণ তোমরা তা শুনতে
পাও না মদের পাত্রের সুখী শব্দগুচ্ছ ছাড়া।
আমরা তখনই কাঁদি যখন আমাদের আত্মা
ঈশ্বর থেকে আলাদা হয়, কিন্তু তোমরা হাসো কারণ
তোমাদের শরীর উদাসীনভাবে সেঁটে থাকে পৃথিবীর সাথে।
আমরা হলাম দুঃখের পুত্র এবং তোমরা হলে আনন্দের
পুত্র… চল সূর্যের সম্মুখে ফলাফল পরিমাপ করি
তোমাদের আনন্দের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের দুঃখের।
দাসদের আত্মার ওপরে তোমরা নির্মাণ করেছ পিরামিড,
কিন্তু বর্তমানে পিড়ামিড দাঁড়িয়ে আছে বালির ওপরে
যুগের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে আমাদের
অমরতা এবং তোমাদের বিলুপ্তি।
দুর্বলদের হাড়ের ওপর তোমরা নির্মাণ করেছ ব্যাবিলন এবং
নিনেভে দুর্গতদের সমাধির ওপর নির্মাণ করেছ
রাজপ্রাসাদ। ব্যাবিলন বর্তমানে মরুভূমির গতিশীল বালির
ওপর উটের পদচিহ্ন ছাড়া আর কিছু নয় এবং এর ইতিহাস
সেই জাতির কাছে পুনরাবৃত্তি করা হয় যারা আমাদেরকে
আশীর্বাদ করে এবং তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়।
নিখুঁত মার্বেল পাথরে আমরা খোদাই করেছি
ইসতার-এর প্রতিমূর্তি এবং নির্জনতায় একে শিহরিত
করে তুলেছি এবং কথা বলেছি এর শব্দহীনতার মাধ্যমে।
আমরা গান সৃজন করেছি এবং তারের ওপর নাহাওয়ান্দ
এর প্রাণবন্ত গানের সুর তুলেছি এবং কারণ হয়েছি
অত্যন্ত প্রিয় আত্মার মহাশূন্যে আমাদের কাছাকাছি
ভেসে থাকার। আমরা প্রার্থনায় এবং কর্মে প্রশংসা করেছি সেই সর্বময়
অস্তিত্বের। প্রার্থনার শব্দাবলি ঈশ্বরের কথায় পরিণত হয়েছিল
এবং কর্মকাণ্ড অভিভূত হয়েছিল দেবদূতদের ভালোবাসায়।
তোমরা তার হাস্যকৌতুক অনুসরণ করো, যার তীক্ষ্ণ নখর
রোম ও এ্যান্টিওচের রণক্ষেত্রের হাজার শহীদকে
ছিঁড়ে ফেলেছে… কিন্তু আমরা অনুসরণ করছি
নীরবতা, যার সতর্ক আঙুল বয়ন করে ইলিয়াড,
জীবিকার তালিকাসমৃদ্ধ গ্রন্থ এবং জেরেমিয়াহ-এর বিলাপ।
তোমরা শুয়ে থাকো যৌনলালসা নিয়ে, যার প্রচণ্ড ঝড়
ঝেঁটিয়ে দূর করেছে নারীর আত্মার এক হাজার মিছিল
লজ্জা ও আতঙ্কের গর্তে… কিন্তু আমরা নির্জনতাকে
আলিঙ্গন করি, যার ছায়ার ভেতরে হ্যামলেট ও দান্তের
সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়।
তোমরা লোভের অনুগ্রহ লাভ করো এবং লোভের ধারালো
অস্ত্র প্রবাহিত করে একহাজার রক্তের নদী… কিন্তু
আমরা অনুসন্ধান করি সত্যের সঙ্গ এবং সত্যের হাত
আলোর বৃত্তের বিশাল হৃদয় থেকে বহন করে এনেছে জ্ঞান।
আমরা হলাম দুঃখের পুত্র এবং তোমরা হলে আনন্দের
পুত্র এবং আমাদের দুঃখ ও আনন্দের মাঝখানে রয়েছে
এবড়োথেবড়ো এবং সংকীর্ণ প্রবেশপথ, যা তোমাদের
সাহসী ঘোড়ারা ভ্রমণ করতে পারে না এবং যার ওপর দিয়ে
অতিক্রম করতে পারে না তোমাদের চমৎকার যানবাহন।
তোমাদের ক্ষুদ্রতাকে আমারা ঘৃণা করি যেভাবে তোমরা
আমাদের বিশালতাকে ঘৃণা করো এবং আমাদের
করুণা ও তোমাদের ঘৃণার মাঝখানে সময় বিভ্রান্ত
হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা তোমাদের কাছে আসি
বন্ধু হিসেবে, কিন্তু তোমরা শত্রু ভেবে আমাদেরকে আক্রমণ
করো এবং আমাদের বন্ধুত্ব ও তোমাদের শত্রুতার মাঝখানে
একটা গভীর উপত্যকা অশ্রু ও রক্তে প্লাবিত হচ্ছে।
আমরা নির্মাণ করেছি রাজপ্রাসাদ তোমাদের জন্য এবং
তোমরা আমাদের জন্য খনন করেছ কবর এবং
রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য এবং কবরের অস্পষ্টতার মাঝখানে
মানবতা লোহার অস্ত্রসহ প্রহরীর মতো হেঁটে বেড়ায়।
আমরা গোলাপফুল দিয়ে তোমাদের চলার পথ
ঢেকে দিলাম আর তোমরা ঢেকে দিলে আমাদের
বিছানা কাঁটা দিয়ে এবং কাঁটা ও গোলাপের মাঝখানে
সত্য থেকে থেকে সুখনিদ্ৰা যায়।
পৃথিবীর শুরু থেকে আমাদের মার্জিত ক্ষমতার
সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ করেছ তোমাদের অমার্জিত দুর্বলতা
নিয়ে এবং যখন তোমরা আমাদের ওপর সাফল্য
অর্জন করো অন্তত একঘণ্টার জন্য তখন উৎফুল্ল হয়ে
কর্কশস্বরে ডাকাডাকি ও উচ্চ কলরবে মত্ত থাক
ব্যাঙের মতো। যখন আমরা তোমাদেরকে
জয় করে নিই এবং বশীভূত করি তোমাদের
এক যুগের জন্য তখন আমরা পরিণত হই
দৈত্যাকার নীরবতায়।
তোমরা যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিলে এবং তোমরা
দাঁড়িয়েছিলে নিচে, অশালীন ভাষায় নিন্দা করেছিলে ঈশ্বরের
এবং তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপও করেছিলে, কিন্তু সবশেষে
সে নেমে এল এবং অতিক্রম করে গেল প্রজন্মগুলিকে
এবং হেঁটে গেল তোমাদের ভেতর দিয়ে বীরের মতো,
পরিপূর্ণ করে তুলল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তার সৌন্দর্য ও মহিমায়।
তোমরা সক্রেটিসকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছিলে, পলকে
মেরেছিলে পাথর ছুঁড়ে, আলি তালিবকে ধ্বংস করেছিলে,
গুপ্তহত্যা করেছিলে মাধত পাশাকে, যদিও তারা
অমর এবং আমাদের সঙ্গে চিরকাল আছেন
অনন্তকালের মুখের ওপর।
কিন্তু তোমরা বেঁচে থাকবে পৃথিবীর মুখের ওপর
পড়ে থাকা মৃতদেহের স্মৃতির ভেতরে এবং তোমরা
কোনো বন্ধু খুঁজে পাবে না, যারা তোমাদেরকে সমাহিত করবে
বিস্মৃতি ও অস্তিত্বহীনতার অস্পষ্টতার ভেতরে, যা তোমরা
পৃথিবীতে অনুসন্ধান করেছিলে।
আমরা হলাম দুঃখের পুত্রসন্তান এবং দুঃখ হচ্ছে
একটা সমৃদ্ধ মেঘ, সত্য ও জ্ঞান বর্ষণ করছে
জনতার ওপর। তোমরা হলে আনন্দের পুত্রসন্তান
এবং তোমাদের আনন্দের মতো উচ্চতায় পৌঁছাতে
পারো ঈশ্বরের আইনের মাধ্যমে, যা অবশ্যই স্বর্গের
বাতাসে ধ্বংস হবে এবং তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে
কোনোকিছু না-থাকার ভেতরে, কারণ এটা কিছুই নয়
একটা পাতলা এবং দোদুল্যমান ধোঁয়ার স্তম্ভ ছাড়া।
নিঃসঙ্গ কবি
এই পৃথিবীতে আমি একজন আগন্তুক এবং আমার নির্বাসনের ভেতরে রয়েছে ভয়াবহ নির্জনতা এবং কষ্টকর একাকিত্ব। আমি একা কিন্তু আমার একাকিত্বের ভেতরে আমি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখতে পাই অপরিচিত এবং মোহময় এক দেশ এবং এই ধ্যান আমার স্বপ্নকে পরিপূর্ণ করে তোলে এক বিশাল ও দূরবর্তী ভূমির ভবিষ্যৎ আতঙ্কে, যা আমার চোখ কখনও দেখেনি।
আমি আমার লোকদের ভেতরেই আগন্তুক এবং আমার কোনো বন্ধু নেই। কাউকে দেখলে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলি, ‘কে সে এবং কোন্ পদ্ধতিতে আমি তাকে জানতে পারি এবং কেন সে এখানে এবং কোন্ আইন আমাকে তার সাথে যুক্ত করেছে?’ আমি আমার নিজের কাছেই একজন আগন্তুক এবং যখন আমি আমার জিভকে কথা বলতে শুনি তখন আমার কণ্ঠস্বর শুনে আমার কান বিস্মিত হয়। আমি দেখি আমার অন্তরাত্মা হাসছে, কাঁদছে, সাহস প্রদর্শন করছে, আতঙ্কিত হচ্ছে এবং আমার অস্তিত্ব বিস্মিত হয় যখন আমার আত্মা আমার হৃদয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে, কিন্তু আমি অপরিচিতই রয়ে যাই এবং ভয়াবহ নীরবতা আমাকে গ্রাস করে।
আমার চিন্তাভাবনাগুলিও আমার শরীরের কাছে আগন্তুক এবং আমি আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমার মুখমণ্ডলে আমি কিছু-একটা দেখি যা আমার আত্মা তৈরি করে কিন্তু সে দেখতে পায় না এবং আমার চোখ খুঁজে ফেরে সেইসব যা আমার অন্তরাত্মা দেখতে পায় না।
কোলাহলপূর্ণ শহরের রাস্তা দিয়ে আমি যখন শূন্যদৃষ্টিতে হেঁটে বেড়াই তখন শিশুরা আমাকে অনুসরণ করে চিৎকার করে, ‘এখানে একজন অন্ধ মানুষ আছে। চলো আমরা তাকে একটা হাঁটার ছড়ি দান করি যেন সে তার চলার পথটা অনুভব করতে পারে।’ তাদের কাছ থেকে দৌড়ে আমি একদল তরুণীর ভেতরে গিয়ে পড়ি। তারা আমার পোশাকের প্রান্ত আঁকড়ে ধরে বলে, ‘সে হচ্ছে পাথরের মতো বধির। চলো তার কান প্রেমের সংগীত দিয়ে পূর্ণ করে দিই।’ আমি তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যেতেই একদল বয়স্কা মানুষ আমার দিকে তাদের শিহরিত আঙুল তুলে বলল, ‘সে একজন পাগল। জ্বিন ও পিশাচদের পৃথিবীতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।’
এই পৃথিবীতে আমি একজন আগন্তুক। আমি ইতস্তত ঘুরে বেড়িয়েছি পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে কিন্তু এমন কোন্ জায়গা পাইনি যেখানে আমার মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে পারি, চিনি না এমন কোনো মানুষকে আমি যার মুখোমুখি হব, এমনকি নির্দিষ্ট কোন্ মানুষকে পাইনি যে আমার মনের কথা শুনবে।
ভোরবেলায় যখন আমি আমার নিদ্রাহীন চোখ খুলি, নিজেকে দেখতে পাই একটা অন্ধকার গুহার ভেতরে বন্দি অবস্থায়, যার কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে কীটপতঙ্গ এবং মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে ভাইপার।
যখন আমি আলোর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বাইরে যাই তখন আমার শরীরের ছায়া আমাকে অনুসরণ করে, কিন্তু আমার আত্মার ছায়া আমার চেয়েও অগ্রগামী হয় এবং নেতৃত্ব দেয় একটা অচেনা জায়গায় যেতে, আমার উপলব্ধিরও ওপরের যা-কিছু তা অনুসন্ধান করতে এবং আঁকড়ে ধরতে সেইসব বিষয় যা আমার কাছে অর্থহীন।
সন্ধ্যায় আমি ফিরে আসি এবং আমার বিছানায় শুয়ে পড়ি, যা নরম পালক দিয়ে তৈরি হলেও তা কাঁটা দিয়ে আবৃত এবং আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম এবং অনুভব করলাম পীড়াদায়ক ও সুখী আকাঙ্ক্ষা এবং বোধ হচ্ছে বেদনাদায়ক ও হর্ষোৎফুল্ল প্রত্যাশা। মধ্যরাতে অতীত যুগের প্রেতাত্মারা এবং বিস্মৃত সভ্যতার আত্মারা গুহার ফাটল দিয়ে প্রবেশ করেছে আমাকে পরিদর্শন করতে… আমি স্থিরদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাই এবং তারা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে থাকে… আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি এবং তারাও হাসিমুখে আমার কথার জবাব দেয়। তারপর তাদেরকে আঁকড়ে ধরার জন্য আমি তদন্ত করি, কিন্তু তারা আমার আঙুলের মাধ্যমে স্থানান্তরিত এবং ধোঁয়াশার মতো অপসৃত হয়, যা বিশ্রাম নেয় জলাভূমির ওপর।
এই পৃথিবীতে আমি একজন আগন্তুক এবং এই পৃথিবীতে কেউ নেই যে আমার ভাষা বুঝতে পারে। উদ্ভট স্মরণের রীতি আমার মনের ভেতরে হঠাৎ আকারপ্রাপ্ত হয় এবং আমার দৃষ্টি অদ্ভুত ও বেদনার্ত প্রেতাত্মাদের প্রতিমূর্তিকে আমার সামনে নিয়ে আসে। আমি পরিত্যক্ত তৃণভূমির ভেতর দিয়ে হাঁটছি, পর্যবেক্ষণ করছি দ্রুতবেগে দৌড়াচ্ছে ছোট্ট নদীটা ওপরের দিকে, আরও ওপরের দিকে, উপত্যকার গভীরতা থেকে পাহাড়ের শীর্ষদেশ পর্যন্ত। আমি লক্ষ্য করি নগ্ন বৃক্ষরাজিতে ফুল ফুটছে এবং বহন করছে ফলের সম্ভার এবং ঝরিয়ে দিচ্ছে পাতা এবং তারপর আমি দেখি শাখারা পতিত হচ্ছে এবং পরিণত হচ্ছে সাপের চামড়ায়। আমি দেখি পাখিরা পাখা না-নাড়িয়ে বাতাসে স্থির হয়ে ভাসছে, গান গাইছে এবং হাহাকার করছে। তারপর তারা থামে এবং পাখা উন্মুক্ত করে এবং পরিণত হয় অনাবৃত তরুণীতে যার দীর্ঘ চুল রয়েছে। সুরমা দেওয়া মোহগ্রস্ত চোখের পেছন থেকে আমার দিকে তাকাচ্ছে এবং পুরো ঠোঁটজুড়ে তার হাসি মধুতে ভেজা। তাদের সুরভিত হাতগুলি তারা আমার দিকে প্রসারিত করছে। তারপর তারা আমার দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ছায়ার মতো এবং মহাকাশে পরিত্যাগ করে গেল তাদের বিদ্রূপ ও উপহাসের উচ্চহাসির প্রতিধ্বনির অনুরণন।
আমি এই পৃথিবীতে একজন আগন্তুক… আমি একজন কবি, যে সৃজন করে। সেই গদ্য যা জীবন রচনা করেছে এবং সে রচনা করেছে সেই গদ্য যা জীবন সৃজন করেছে। এ-কারণে আমি একজন আগন্তুক এবং আমি আগন্তুকই থেকে যাব যতক্ষণ না মৃত্যুর বন্ধুত্বপূর্ণ সাদা পাখা আমার চমৎকার দেশে আমার গৃহে আমাকে বহন করে নিয়ে যায়। সেখানে আলো, শান্তি এবং উপলব্ধি পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত। আমি অপেক্ষা করব অন্য আগন্তুকদের জন্য, সময়ের বন্ধুত্বপুর্ণ ফাঁদ যাদেরকে উদ্ধার করবে এই অন্ধকার পৃথিবী ও সংকীর্ণতা থেকে।
যুগের ছাই এবং অনন্ত আগুন
প্ৰথম পৰ্ব
খ্রিস্টপূর্ব ১১৬ সালের বসন্ত
রাত্রি নেমেছিল এবং নীরবতা সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করছিল টিকে থাকার জন্য, যখন সূর্যের নগরে[১] জীবন সুখনিদ্রায় মগ্ন। বিচ্ছিন্ন বাড়িঘর এবং অলিভ ও লরেল গাছের মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাজকীয় মন্দিরগুলোর বাতি ছিল নেভানো। চাঁদ তার রুপালি জোছনাধারা ঢেলে দিয়েছিল সাদা মার্বেল পাথরের স্তম্ভগুলির ওপর, যা রাত্রির নীরবতায় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়েছিল, পাহারা দিচ্ছিল ঈশ্বরের মন্দিরে এবং তাকিয়েছিল সন্দেহের দৃষ্টিতে লেবাননের উঁচু স্তম্ভগুলির দিকে, দূরবর্তী পাহাড়ের কপালের ওপর যা খোঁচাখোঁচা দাড়ির মতো বসেছিল।
সেই সময় যখন আত্মারা সুখনিদ্রায় প্রলুব্ধ হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, তখন উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন যাজকের পুত্র নাথান ইসতার-এর মন্দিরে প্রবেশ করল। তার শিহরিত হাতে একটা মশাল। সে আলো জ্বালল এবং ধূপদানি থেকে গন্ধরস ও রজনের ঝাঁঝালো সুগন্ধ পৌঁছে গেল মন্দিরের দূরবর্তী বাঁকগুলিতে। তারপর সে হাঁটু গেড়ে বেদির সামনে বসল, হাতির দাঁত এবং সোনা দিয়ে তা অলংকৃত করল এবং ইসতার[২]–এর দিকে দুহাত তুলে বেদনার্ত এবং শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করুন হে বিশাল ইসতার, প্রেম ও সৌন্দর্যের ঈশ্বরী। দয়া প্রদর্শন করুন এবং আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষের ওপর থেকে মৃত্যুর হাতকে অপসারিত করুন, যাকে আমার আত্মা আপনার ইচ্ছায় পছন্দ করেছে।… চিকিৎসকের ওষুধ এবং জাদুকরেরা তার জীবন ফিরিয়ে আনতে পারবে না। যাজকেরাও ব্যর্থ। আপনার পবিত্র ইচ্ছা ছাড়া কোনোকিছুই পরিত্যক্ত হবে না। আপনার সৌন্দর্যপ্রকাশের ক্ষমতা আমাকে পরিচালিত ও সহযোগিতা করে। আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার প্রার্থনা আপনি অনুমোদন করে নিন। স্থির দৃষ্টিতে আমার চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয় ও ব্যথাতুর আত্মার দিকে তাকান। আমার প্রিয়তমার জীবনকে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকুন যেন আমরা আপনার ভালোবাসার গোপনীয়তা ও যৌবনের সৌন্দর্যের মহিমার ভেতরে উৎফুল্ল হয়ে উঠতে পারি, যা আপনার শক্তি ও বিচক্ষণতার রহস্যকে উন্মোচিত করে। হৃদয়ের গভীর থেকে আমার হৃদয় আপনার জন্য কাঁদে। হে মর্যাদাসম্পন্ন ঈশ্বর ইসতার, রাত্রির অন্ধকারাচ্ছন্নতার পেছন থেকে আমি আপনার ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। আমার কথা শ্রবণ করুন হে ইসতার! আমি আপনার দাস নাথান, উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন যাজক হিরাম এর পুত্র এবং আমি আমার সমস্ত কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যকে আপনার বেদির বিশালত্বের প্রার্থনায় একান্তভাবে নিয়োজিত করেছি।
‘সমস্ত যুবতীদের ভেতরে আমি ভালোবাসি একজন যুবতীকে এবং তাকে আমি আমার সঙ্গী করেছি। কিন্তু জ্বিনের পাখিগুলো তাকে ঈর্ষা করে এবং তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় একটা বিস্ময়কর দুর্ভোগের ভেতরে এবং তার কাছে মৃত্যুর দূত পাঠায় যে তার বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুধার্ত ভূতের মতো, বিছিয়ে দিচ্ছে তার ওপর কালোরঙের পাঁজরযুক্ত পাখা, শিকারের প্রস্তুতি হিসেবে সামনে প্রসারিত করছে তার তীক্ষ্ণ নখর। আমি এখন এখানে এসেছি এবং সনির্বন্ধ প্রার্থনা করছি আমাকে ক্ষমা করুন এবং সেই ফুলের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকুন, যে তার জীবনে গ্রীষ্মের সঙ্গে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেনি কখনও।
‘মৃত্যুর আগ্রাসন থেকে তাকে রক্ষা করুন যেন আনন্দের সঙ্গে আমরা আপনার প্রশংসা- সংগীত গাইতে পারি এবং আপনার সম্মানে পোড়তে পারি ধূপ, উৎসর্গ করতে পারি আপনার বেদির পায়ে, পূর্ণ করে দিতে পারি পুষ্পাধারগুলি সুগন্ধি তেলে এবং ছড়িয়ে দিতে পারি গোলাপ এবং উদ্যান-উদ্ভিদ আপনার প্রার্থনার স্থানের সামনে এবং পোড়াতে পারি রজন আপনার পবিত্র স্মৃতিচিহ্নসম্বলিত সমাধির সম্মুখে। হে ইসতার, তাকে রক্ষা করুন, হে অলৌকিকত্বের ঈশ্বরী এবং ভালোবাসাকে অতিক্রম করতে দিন মৃত্যু, দুঃখের বিরুদ্ধে আনন্দের এই সংগ্রামের ভেতরে।’
তারপর নাথান নীরব হয়ে গেল। তার দুচোখ প্লাবিত হল অশ্রুজলে এবং তার হৃদয় উচ্চারণ করছিল বেদনাকাতর দীর্ঘশ্বাস। তারপর সে আবার বলল, ‘হায়! আমার স্বপ্নগুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে হে ঈশ্বরী ইসতার এবং আমার হৃদয় তার ভেতরেই গলে যাচ্ছে। প্রাণবন্ত করে তুলুন আমাকে আপনার ক্ষমার মাধ্যমে এবং আমার প্রিয়তমার ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকুন।’
সে-সময় তার এক দাস মন্দিরে প্রবেশ করল। দ্রুত নাথানের কাছে এল এবং ফিসফিস করে তাকে বলল, ‘সে তার চোখ খুলেছে প্রভু এবং বিছানার চারপাশে আপনাকে খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। তারপর সে আপনার নাম ধরে ডাকাডাকি করেছে।’ নাথান দ্রুত প্রস্থান করল এবং দাস তাকে অনুসরণ করল।
নাথান সেখানে পৌঁছে পীড়িত যুবতীর কক্ষে প্রবেশ করল এবং তার বিছানায় ঠেস দিয়ে বসল। সে তার দুর্বল হাতখানা ধরল এবং কয়েকটি চুম্বনের ছাপ এঁকে দিল তার ঠোঁটে যেন যুবকের নিজের জীবন থেকে একটা নতুন জীবন যুবতীর শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার জন্য সংগ্রাম করছে। যুবতী রেশমি কুশনের ওপরে রাখা তার মাথাটা নাড়াল এবং চোখদুটো খুলল এবং তার ঠোঁটের ওপর আবির্ভূত হল একটি হাসির অপচ্ছায়া, যা ছিল বর্জ্য হিসেবে তার পরিত্যক্ত শরীরের ভেতরে জীবনের মূর্ছিত অবশিষ্টাংশ… একটি হৃদয়ের আহ্বানের প্রতিধ্বনি যা একটা বিরতির দিকে যাবার জন্য প্রতিযোগিতা করছে একটি কণ্ঠস্বরের সঙ্গে, যা একজন বিবর্ণ মায়ের স্তনের ওপর শুয়ে থাকা একটি ক্ষুধার্ত নবজাতকের দুর্বল কান্নাকে নির্দেশ করে। যুবতী বলল, ‘ঈশ্বরী আমাকে আহ্বান জানিয়েছে, হে আমার জীবন এবং মৃত্যু এসেছে আমাকে তোমার কাছ থেকে ডেকে নিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে। কিন্তু ভয় পেয়ো না, কারণ ঈশ্বরীর ইচ্ছা হচ্ছে ঐশ্বরিক এবং মৃত্যুর দাবিও যথাযথ। আমি এখন প্রস্থান করছি এবং আমি শুনতে পাই শুভ্রতা অবতরণের শব্দ, কিন্তু প্রেম ও যৌবনের পাত্রগুলি এখনও আমাদের হাতে পূর্ণ হয়ে আছে এবং সুন্দর জীবনের পুষ্প-বিছানো পথগুলি আমাদের সামনে দীর্ঘায়িত হয়েছে। হে আমার প্রিয়তমা, আমি জাহাজযাত্রা করছি আত্মার আর্ক [হযতর নুহ (আ.)-এর জাহাজ] এ চড়ে এবং আমি আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসব, কারণ বিশাল ঈশ্বর ইসতার সেইসব প্রেমময় মানুষের আত্মাকে ফিরিয়ে আনবেন যারা প্রেমের মধুরতা ও যৌবনের উল্লাস উপভোগ করার আগেই প্রস্থান করেছিল অনন্তকালের উদ্দেশ্যে।
‘আমাদের আবার দেখা হবে হে নাথান এবং এসো একত্রে ভোরের শিশির পান করি পদ্মফুলের পাপড়ির পেয়ালা থেকে এবং উল্লসিত হও রঙধনুর রঙের ওপরে উঠতে থাকা শস্যক্ষেতের পাখিদের সঙ্গে, যতক্ষণ আমাকে চিরকালীন বিদায়-সংবর্ধনা না-দেওয়া হয়। যুবতীর কণ্ঠস্বরও নিচু হয়ে এল এবং তার ওষ্ঠ একটা নিঃসঙ্গ ফুলের মতো শিহরিত হচ্ছিল ভোরের আকস্মিক দমকা বাতাসে। অশ্রুসজল চোখে নাথান তাকে আলিঙ্গন করল এবং যখন সে তার ঠোঁট চেপে ধরল যুবতীর ঠোঁটের ওপর তখন অনুভব করল তা পাথরের মতো ঠাণ্ডা। ভয়াবহ কান্নার শব্দ উচ্চারিত হল তার কণ্ঠ থেকে এবং তার কান্নায় ভিজে যেতে থাকল তার পোশাক। সে নিজেকে যুবতীর মৃতদেহের ওপর নিক্ষেপ করল যখন তার কাঁপতে থাকা আত্মা পাল তুলছিল জীবনের পাহাড় এবং মৃত্যুর খাড়া হয়ে ওঠা পিঠের মাঝখানে।
রাত্রির সুখনিদ্রার ভেতরে আচ্ছন্ন আত্মাগুলি জেগে উঠল। নারী ও শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে উঠল সর্বময় ক্ষমতার শব্দ করে এগিয়ে যাওয়া শুনে এবং ব্যথাতুর হাহাকার ও তিক্ত বিলাপ ভেসে আসছিল ইসতার-এর উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন যাজকের প্রাসাদের প্রত্যেক বাঁক থেকে।
ক্লান্ত বিলাপকারীরা উপস্থিত হওয়ার পর জনগণ নাথান সম্পর্কে জানতে চাইল সহানুভূতি জানানোর জন্য কিন্তু তাদেরকে বলা হল যে সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে এবং একপক্ষকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর পূর্ব থেকে এক মরুযাত্রী দলের প্রধান উপস্থিত হল এবং সে জানাল যে, নাথানকে সে দূরবর্তী ঊষর জনহীন প্রান্তরে দেখতে পেয়েছিল একপাল গাজলা হরিণের সঙ্গে দীর্ঘভ্রমণে যেতে।
সময় অতিক্রান্ত হল সভ্যতার সমস্ত কর্মকাণ্ড তার অদৃশ্য পায়ে মাড়িয়ে যেতে যেতে এবং ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের ঈশ্বরী ঐদেশ পরিত্যাগ করল। তার স্থান দখল করল একজন বিস্ময়কর ও প্রায়ই পরিবর্তনশীল এক ঈশ্বর। সে সূর্যের নগরের চমৎকার মন্দিরগুলো ধ্বংস করল এবং বিনাশ করল সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রাসাদগুলো। প্রস্ফুটিত ফল বাগান এবং উর্বর তৃণভূমিগুলো পড়ে থাকল বর্জ্য হিসেবে এবং সেখানে আর কিছুই পরিত্যক্ত হয়নি গতকালের প্রেতাত্মাদের আত্মাকে স্মরণীয় করে রাখার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া এবং তা পুনরাবৃত্তি করছিল ব্যথিত আত্মাদের কাছে তার মহিমার স্তোত্রগীতির প্রতিধ্বনি। কিন্তু এই ভয়াবহ সময়গুলি মানুষের কর্মকাণ্ডকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছিল কিন্তু তাদের স্বপ্নগুলিকে ধ্বংস করতে পারেনি, পারেনি তাদের ভালোবাসাকে দুর্বল করতে; কারণ স্বপ্ন এবং ভালোবাসা অনন্ত আত্মার সঙ্গে চিরজীবন্ত। একটা সময়ের জন্য তারা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে সূর্যকে তাড়া করতে করতে যখন রাত্রি আসে এবং নক্ষত্রকে তাড়া করতে করতে যখন সকাল আবির্ভূত হয়, কিন্তু স্বর্গের আলোর মতো তারা অবশ্যই ফিরে আসবে।
দ্বিতীয় পর্ব
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের বসন্ত
দিনশেষে প্রকৃতি সুখনিদ্রার জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল এবং সূর্য তার সোনালি রশ্মি তুলে নিয়েছিল বালবেক-এর সমতলভূমি থেকে। আলী আল হোসেইনী তার পশুর পালকে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে অবস্থিত ছাউনির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। সে বসেছিল প্রাচীন স্তম্ভগুলির কাছাকাছি যা যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে আসা সৈন্যদের গণনাহীন হাড়কে প্রতীকায়িত করছিল। ভেড়াগুলো তার চারপাশে জড়াজড়ি করে শুয়েছিল আর মুগ্ধ হয়ে শুনছিল আলীর বাঁশির সংগীত।
মধ্যরাত এল এবং স্বর্গ পরবর্তী দিনগুলির বীজ বপন করল অন্ধকারের হলরেখায়। বিনিদ্রতার ভেতরে অলীক কল্পনায় আলীর চোখদুটো ক্লান্ত হয়ে এল এবং তার মনও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ল বিধ্বস্ত দেয়ালগুলোর মাঝখানে ভয়াবহ নৈঃশব্দের ভেতরে কুচকাওয়াজরত প্রেতাত্মাদের মিছিলের কারণে। সে তার বাহুতে ঠেস দিয়ে বসেছিল এবং ঘুম তার ইন্দ্রিয়গুলিকে দখল করেছিল তার বিনুনি-করা অবগুণ্ঠনের শেষপ্রান্ত দিয়ে, একটা কোমল মেঘের মতো যা স্পর্শ করছে শান্ত লোকের মুখমণ্ডল। সে তার প্রকৃত আত্মার কথা ভুলে গিয়েছিল এবং মুখোমুখি হয়েছিল অদৃশ্য আত্মার যা ছিল স্বপ্নে সমৃদ্ধ এবং আদর্শে উন্নততর মানুষের আইন এবং শিক্ষার চেয়ে। কল্পনার বৃত্ত বিস্তৃত হয় তার চোখের সামনে এবং জীবনের গোপনীয়তাগুলি ক্রমে ক্রমে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার আত্মা সময়ের দ্রুত কুচকাওয়াজকে পরিত্যাগ করে অস্তিত্বহীনতাকে বেপরোয়াভাবে তাড়া করতে থাকে, এটা একাকী দাঁড়িয়েছিল শুদ্ধ চিন্তা এবং স্বচ্ছ ধারণার মুখোমুখি। কারণ জীবনে এই প্রথমবার আলী সচেতন ছিল আধ্যাত্মিক দুর্ভিক্ষের কারণ সম্পর্কে, যা তার যৌবনকে সঙ্গ দিয়েছিল… দুর্ভিক্ষ, যা জীবনের তিক্ততা ও মধুরতার মাঝখানের গর্তটি ভরাট করে দেয়… সেই তৃষ্ণা যা পরিতৃপ্তির ভেতরে ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস ও নৈঃশব্দের সন্তুষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে। সেই আকুল আকাঙ্ক্ষা যা পৃথিবীর মহিমার কাছে পরাভূত হতে পারে না, দলে-মুচড়ে একাকার হয়ে যেতে পারে না সময়ের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে। আলী এক বিস্ময়কর ভালোবাসার উচ্ছ্বাস অনুভব করল এবং তার ভেতরে একধরনের কোমলতা জন্ম নিল, যা ছিল মূলত স্মৃতি এবং তা জ্বলন্ত কাঠের ওপর ফেলে দেওয়া ধূপের মতোই প্রাণবন্ত… এটা ছিল একটা জাদুকরি ভালোবাসা যার কোমল আঙুল আলীর হৃদয় স্পর্শ করছিল যেভাবে একজন সংগীতজ্ঞের আঙুল শিহরিত তারকে স্পর্শ করে। এটা ছিল একটা নতুন শক্তি যা প্রকাশিত হচ্ছে অস্তিত্বহীনতা থেকে এবং বেড়ে উঠছে বলিষ্ঠভাবে, আলিঙ্গন করছে তার প্রকৃত সত্তাকে এবং তার আত্মাকে পরিপূর্ণ করে তুলছে ভালোবাসা দিয়ে, যা একই সঙ্গে তিক্ত ও মধুর।
আলী ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকাল এবং তার ভারী চোখের পাতা সতর্ক হয়ে উঠল, যেভাবে সে ঐসব বিধ্বস্ত সমাধিমন্দিরের মহিমাকে কল্পনা করেছিল, যা দীর্ঘকাল ধরে পরাক্রমশালী, অজেয় এবং চিরন্তন মন্দির হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখ স্থির হয়ে এসেছিল এবং হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল এবং আলী হচ্ছে সেই অন্ধ লোকের মতো যার দৃষ্টিশক্তি হঠাৎ করে ফিরে এসেছিল। সে দেখতে, চিন্তা করতে এবং ধ্যান করতেও শুরু করেছিল। সে সংগ্রহ করেছিল বাতি এবং ধূপদানিগুলো যা ঘিরে রেখেছিল একজন ঈশ্বরীর প্রতিমূির্ত যাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা ও পূজা করা হয়.. সে স্মরণ করেছিল সেইসব যাজকদের যারা হাতির দাঁত ও সোনার তৈরি বেদির সামনে উৎসর্গ করে… সে কল্পনায় দেখছিল নৃত্যরত যুবতী, খঞ্জনীবাদক ও শিল্পীদের, যারা প্রেম ও সৌন্দর্যের ঈশ্বরীর প্রশংসাসংগীত গেয়ে মুগ্ধ করছিল সবাইকে। সে সবকিছুই তার সামনে দেখতে পাচ্ছিল এবং অনুভব করছিল তাদের অখ্যাতির প্রতিক্রিয়া হৃদয়ের গভীরতায় রুদ্ধশ্বাসের ভেতরে। কিন্তু স্মৃতি একাকী কোনোকিছুই বহন করে না, দীর্ঘকাল আগে শোনা শব্দের প্রতিধ্বনি ছাড়া। তাহলে কি সেই উদ্ভট সম্পর্ক এইসব শক্তিশালী ও বয়নকারী স্মৃতি এবং একজন সাধারণ যুবকের প্রকৃত অতীতজীবনের মাঝখানে, যে তাঁবুতে জন্ম নিয়েছিল এবং যে তার জীবনের বসন্তগুলি কাটিয়েছিল উপত্যকায় মেষ চরিয়ে?
আলী ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। এবং যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিগুলি তার চিন্তা থেকে বিস্মৃতির অবগুণ্ঠন হঠাৎ করেই ছিঁড়ে ফেলল। সে মন্দিরের বিশাল ও গুহাময় প্রবেশপথের কাছে পৌঁছাল। এগোতে গিয়ে একটু থামল, যেন এর আকর্ষণী ক্ষমতা তাকে আঁকড়ে ধরেছে এবং গতিসম্পন্ন করে তুলেছে তার পদযুগ। নিচের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল, একটা মূর্তি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। সে অদৃশ্যের আগ্রাসন থেকে নিজেকে মুক্ত করল এবং তক্ষুনি তার আত্মা ঝরিয়ে দিল অশ্রুজল এবং একটা গভীর ক্ষত থেকে রক্তের মতো তা ঝরে পড়তে লাগল। তার হৃদয় ভাটার সময় গর্জন করে উঠল এবং প্রবাহিত হল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। সে তিক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং ব্যথিত চিৎকার করে উঠল, কারণ সে এমন একটা একাকিত্ব অনুভব করল যা তাকে ছুরিকাঘাত করছে এবং একটা বিধ্বস্ত দূরবর্তী অঞ্চলকে তুলে ধরল যেন তা একটা নরক, তার হৃদয় এবং এই জীবনে প্রবেশ করার আগে তাকে যে আত্মা থেকে ছিঁড়ে আনা হয়েছিল তার মাঝখানে। সে অনুভব করল আর আত্মার উপাদানগুলি ছিল একটা জ্বলন্ত মশাল থেকে বেরিয়ে আসা অগ্নিশিখা, যা ঈশ্বর তার কাছ থেকে আলাদা করেছিলেন যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই। সে প্রত্যক্ষ করল তার জ্বলন্ত হৃদয়ে কোমল পাখার মৃদু স্পর্শ এবং এক বিশাল ভালোবাসা তাকে অধিকার করে নিচ্ছে.. এমন একটা ভালোবাসা যার ক্ষমতা মনকে আলাদা করেছে পরিমাণ ও পরিমাপের পৃথিবী থেকে… এমন একটি ভালোবাসার কথা বলে যখন জীবনের জিভ থাকে নীরব … এমন একটা ভালোবাসা যা নীল আলোর সংকেত হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে পথ দেখাতে, কারণ দৃশ্যমান কোনো আলোর রেখাও সেখানে নেই। সেই ভালোবাসা অথবা সেই ঈশ্বর যে নেমে এসেছিল সেই প্রশান্ত সময়ে আলীর হৃদয়ের ওপর, যা শুকিয়ে গিয়েছিল তার অস্তিত্বের ভেতরে, একটা তিক্ত ও মধুর ভালোবাসা, বিকশিত ফুলের চারপাশে বেড়ে ওঠা কাঁটার মতো।
কিন্তু কে এই ভালোবাসা এবং কোথা থেকে সে এসেছিল? কী সে চায় একজন মেষপালকের কাছে যে হাঁটু গেড়ে ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে বসে আছে? এটা কি একটা বীজ যা একজন বেদুঈন যুবতী সচেতনতা ছাড়াই হৃদয়ের রাজ্যে রোপণ করেছিল? এটা কি একটা স্বপ্ন যা রাত্রির নৈঃশব্দের ভেতরে কাছাকাছি এসেছিল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে? অথবা এটা একটা সত্য, শুরু থেকেই যার অস্তিত্ব ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব থাকবে? আলী তার অশ্রুসজল চোখদুটো বন্ধ করল এবং দুই বাহু সমনের দিকে বাড়িয়ে দিল ভিক্ষুকের মতো এবং হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে বলল, ‘কে তুমি আমার হৃদয়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছ কিন্তু দৃষ্টিসীমার ভেতরে তুমি নেই, যদিও দাঁড়িয়ে আছ একটা বিশাল দেয়াল হিসেবে আমার ও আমার প্রকৃত আত্মার মাখখানে, বেঁধে ফেলছ আমার আজকের দিনকে বিস্তৃত অতীতের সঙ্গে। তুমি কী একটা ভূতের অপচ্ছায়া অনন্তকাল থেকে এসেছ আমাকে জীবনের অহংকার এবং মানবতার দুর্বলতা দেখাতে? অথবা একটি জ্বিনের আত্মা আবির্ভূত হয়েছে পৃথিবীর ফাটল থেকে আমাকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে এবং আমাকে একটা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করতে আমার গোত্রের যুবকদের মধ্যে? জীবনের যে জলধারা আমি পান করি তা কি আমাকে দেবদূতে পরিণত করেছে, আমি দেখছি এবং শুনছি পৃথিবীর রহস্যময় গোপনীয়তাগুলি অথবা এটা শুধুই একটা মদের অবগুণ্ঠন যা আমাকে অন্ধ ও নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে এবং আমাকে আলাদা করে ফেলেছে আমার সত্তা থেকে।
সে নীরব হয়ে এল যখন তার দুশ্চিন্তা বাড়ল এবং উল্লসিত হল তার আত্মা। তারপর সে বলল, ‘কোন্ সেই আত্মা নিজেকে প্রকাশ করে এবং রাত্রি তাকে গোপন করে… সেই মনোমুগ্ধকর আত্মা আমার স্বপ্নের আকাশে, তুমি পাখা না নাড়িয়ে স্থির হয়ে ভেসে আছ এবং আমার ভেতরে জেগে আছ একটা ঘুমন্ত পরিপূর্ণতা, বরফের চাদরের নিচে লুকানো স্বাস্থ্যবান বীজের মতো। তুমি আমাকে অতিক্রম করে গেছ একটা রঙ্গপ্রিয় বাতাসের মতো, বহন করে এনেছ আমার ক্ষুধার্ত আত্মার কাছে স্বর্গীয় ফুলের গন্ধ, তুমি আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে স্পর্শ করেছ এবং তাদেরকে নাড়িয়েছ এবং শিহরিত করেছ গাছের শাখার মতো। যদি তুমি মনুষ্যপ্রজাতির কেউ হয়ে থাকো তাহলে তোমার দিকে আমাকে তাকানোর অনুমতি দাও যেন আমার অন্তরাত্মার ভেতর দিকে আমি তোমার বিশালতা দেখতে পারি। তোমাকে স্পর্শ করতে দাও এবং শুনতে দাও তোমার কণ্ঠস্বর। চোখের জলের এই অবগুণ্ঠন সরিয়ে দাও, যা আমার সমস্ত উদ্দেশ্যকে গোপন করে রেখেছে এবং ধ্বংস করো এই দেয়াল যা গোপন করেছে আমার ঈশ্বর আমার স্বচ্ছ চোখ থেকে এবং আমাকে একটা পাখা দাও যেন আমি তোমার পেছনে উড়তে পারি সর্বময় ব্রহ্মাণ্ডের কক্ষগুলি পর্যন্ত অথবা সম্মোহিত করো আমার দুচোখ যেন আমি অনুসরণ করতে পারি তোমাকে সেই পর্যন্ত যেখানে অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য জ্বিনেরা ওঁৎ পেতে আছে, যদি তুমি তাদের পাখিগুলির ভেতরে একটা হয়ে থাকো। যদি আমি প্রশংসা করার মতো কিছু করে থাকি তাহলে হাত রাখো আমার হৃদয়ের ওপর এবং আমাকে অধিকার করে নাও।’
আলী এসব কথা ফিসফিস করে বলছিল রহস্যময় অন্ধকারের ভেতরে এবং তার সামনে হামাগুড়ি দিচ্ছিল রাত্রির প্রেতাত্মারা, যেন তার যা ছিল বেরিয়ে আসছিল তার ফুটন্ত অশ্রু থেকে। সে কল্পনা করল মন্দিরের দেয়ালের ওপর রঙধনুর তুলি দিয়ে আঁকা জাদুর মতো একটা ছবি।
একঘণ্টা পর আলী চোখের জল ফেলছিল, প্রকাশ করছিল তার দুর্গত অবস্থা, শুনছিল হৃদস্পন্দন এবং দেখছিল যাবতীয় বস্তুর ওপরে, যেন সে পর্যবেক্ষণ করছিল জীবনের প্রতিমূর্তি ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে এবং পুনস্থাপিত হচ্ছে একটা স্বপ্নের সঙ্গে, যা এর সৌন্দর্যের ভেতরে বিস্ময়কর এবং বিশালত্বের ভেতরে ভয়াবহ। একজন নবীর মতো যিনি স্বর্গের নক্ষত্রের ধ্যান করেন, তিনি অপেক্ষা করছেন নক্ষত্রের অবতরণ ও তার বিস্ময়কর প্রকাশ, তিনি বিবেচনায় আনেন সেই ক্ষমতা এইসব ধ্যানের ওপরে যে অবস্থান করছে। সে অনুভব করল তার আত্মা তাকে পরিত্যাগ করেছে এবং মন্দিরের মাধ্যমে অনুসন্ধান করল তার নিজের মূল্যহীন কিন্তু অপরিচিত ছিন্ন অংশ যা ধ্বংসস্তূপের ভেতরে হারিয়ে গিয়েছিল।
সকাল হল এবং প্রবহমান মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে গর্জন করে উঠল নীরবতা। সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মিগুলি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আলোকিত করে তুলল ইথারের ভেতরের যাবতীয় বস্তুকে এবং আকাশ হাসল স্বপ্নদ্রষ্টার মতো, যে তার প্রিয়তমার অপচ্ছায়াকে প্রদর্শন করছে। দেয়ালের ফাটলের অভয়ারণ্য থেকে অনুসন্ধানের জন্য বেরিয়ে এল পাখিরা এবং উদ্ভূত হল কলাম কক্ষের ভেতরে এবং তারা গাইছিল তাদের ভোরের প্ৰাৰ্থনাসংগীত।
আলী তার হাতদুটো কপালের ওপর রাখল এবং চকচকে চোখ মেলে নিচের দিকে তাকাল। আদমের মতো ঈশ্বর যখন তার পরাক্রমশালী শ্বাসপ্রশ্বাসের ভেতর চোখ খুললেন, আলী দেখল একটা নতুন বস্তু, বিস্ময়কর এবং অভূতপূর্ব। তারপর সে তার মেষগুলোর কাছে গেল এবং আহ্বান জানাল তাদের এবং তারা তাকে শান্তভাবে অনুসরণ করল সেই ভূমি পর্যন্ত যেখানে প্রচুর ঘাস গজিয়ে উঠেছে। সে পশুর পালকে নেতৃত্ব দিতে দিতে আকাশের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল দৈব দার্শনিকের মতো এবং গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গোপনীয়তা সম্পর্কে। সে একটা ছোট নদীর কাছে পৌঁছাল যার কুলুকুলু ধ্বনি আত্মাকে শান্তি দিচ্ছিল এবং সে বসেছিল উইলো গাছের নিচে বসন্তের প্রান্তসীমায়, যার শাখাগুলো নদীর জলে ডোবানো, যেন তারা নদীর ঠাণ্ডা গভীরতা থেকে পান করছে ক্রমাগত। ভোরের শিশির চিকিচিক করছিল মেষপালের পশমের ওপর এবং তারা চরে বেড়াচ্ছে ফুল এবং সবুজ ঘাসের মাঝখানে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আলী আবার অনুভব করল তার হৃদস্পন্দন দ্রুত বাড়ছে এবং তার আত্মা হিংস্রভাবে কাঁপতে শুরু করেছে যা প্রায় দৃশ্যযোগ্য। শিশুর কান্না শুনে সুখনিদ্ৰা ছেড়ে হঠাৎ করে জেগে ওঠা মায়ের মতো সে দ্রুত বেগে তার অবস্থান পরিবর্তন করল এবং তার চোখ দেখতে পেল একজন সুন্দর যুবতী একটা মাটির পাত্র কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট নদীটার দিকে। নদীর তীরে পৌঁছে যখন সে তার পাত্র ভরতে গেল তখনই হঠাৎ তার চোখ পড়ল আলীর চোখে। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে উঠল এবং পানির পাত্র হাত থেকে পড়ে গেল। সে ঘুরল স্থিরদৃষ্টিতে আলীর দিকে, তাকাল চিন্তিতভাবে এবং তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠল অবিশ্বাস।
এক মিনিট কেটে গেল, যার সেকেন্ডগুলো ছিল উজ্জ্বল বাতি, যা তাদের হৃদয় ও আত্মাকে আলোকিত করে তুলছিল এবং নীরবতা বহন করে আনছিল অস্পষ্ট স্মৃতি, যা তাদের কাছে নদী ও গাছগুলোর দূরবর্তী অঞ্চলের প্রতিমূর্তি ও দৃশ্যাবলি প্রকাশ করছিল। নৈঃশব্দের ভেতরে তারা পরস্পরের আত্মার শব্দ শুনল, মনোযোগ দিয়ে আরও শুনল পরস্পরের আত্মা ও হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস যতক্ষণ-না দুজনের মাঝে জয়ী হল পরিপূর্ণ জ্ঞান।
রহস্যময় ক্ষমতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আলী লাফিয়ে নদীটা পার হল এবং যুবতীর কাছে গেল। আলিঙ্গন করল তাকে এবং তার ঠোঁটে এঁকে দিল দীর্ঘস্থায়ী চুম্বনের ছাপ। আলীর আদর-সোহাগের মধুরতা নারীর ইচ্ছাকে অন্যায়ভাবে দখল করেছিল যেন সে নড়াচড়া করতে না পারে এবং আলীর এ-ধরনের স্পর্শ তার সমস্ত শক্তিকে চুরি করে নিয়েছিল। সে বশীভূত হয়েছিল আলীর, যেভাবে যুঁইফুলের সুগন্ধ মৃদুমন্দ বাতাসের কম্পনের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে রাখে এবং তাকে বহন করে নিয়ে যায় প্রশান্ত মহাকাশে। নারী তার মাথা রাখে আলীর বুকের ওপর একজন নির্যাতিত মানুষের মতো যে অনুসন্ধান করছে বিশ্রাম। সে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল… একটা দীর্ঘশ্বাস, যা একটা ছেঁড়া হৃদয়ের ভেতরে সুখের পুনর্জন্ম ঘোষণা করল এবং আরও ঘোষণা করল পাখার বিপ্লব, যা আরোহণ করেছিল তাদের ওপর পৃথিবীর কাছে অঙ্গীকার করার পর
সে মাথা তুলে আলীর দিকে তাকাল… একজন মানুষের দৃষ্টি, যার মধ্যে রয়েছে ঐশ্বরিক নীরবতা, মানবতার ভেতরে প্রচলিত শব্দাবলিকে যা খর্ব করে এবং অভিব্যক্তিরা হৃদয়ের অকথিত ভাষার ভেতরে অসংখ্য চিন্তার প্রস্তাব দেয়। নারী সেই ব্যক্তিকে দেখে বিরক্ত হয়, যে ভালোবাসাকে কথার আত্মা হিসেবে গ্রহণ করে না, কিন্তু দুটি আত্মা ঈশ্বর কর্তৃক বিভক্ত ও যুক্ত হবার পর পুনর্মিলনীর আয়োজন করে।
মুগ্ধ দম্পতি উইলো গাছের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল এবং দুটি আত্মার এককত্ব তাদের একত্রীকরণ সম্পর্কে কথা বলার জন্য একটি জিভে পরিণত হয়েছিল, চার চোখ পরিণত হয়েছিল একচোখে সুখের মহিমা দেখার জন্য এবং তারা পরিণত হয়েছিল একজন নীরব শ্রোতায় ভালোবাসার ভয়াবহ প্রকাশ শোনবার জন্য।
মেষপাল চলে বেড়াচ্ছিল মাঠে এবং আকাশে পাখিগুলি পাখা না নাড়িয়ে স্থির হয়ে তাদের মাথার ওপর ভাসছিল, গাইছিল ভোরের গান এবং অনুসরণ করছিল রাত্রির শূন্যতাকে। তারা উপত্যকার প্রান্তে পৌঁছালে সূর্য আবির্ভূত হল, বিস্তৃত করল সোনালি পোশাক পাহাড় ও ছোট ছোট ঢিবিগুলোর ওপর এবং তারা একটা পাথরের পাশে বসল, যেখানে উদ্যান- উদ্ভিদ লুকিয়ে থাকে। নারী আলীর কালো চোখের দিকে তাকাল, বাতাস তখন তার চুলের সঙ্গে খেলা করছিল, মনে হচ্ছিল ঐ ঝিকমিক করতে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ চুলে ঢেউ উঠছে চুম্বন গ্রহণের জন্য। সে আরও অনেক জাদুকরি স্পর্শ অনুভব করল এবং শক্তিশালী পেলবতা স্পর্শ করল তার ওষ্ঠ এবং সে শান্ত ও মোহনীয় স্বরে বলল, ‘ইসতার আমাদের আত্মাকে জীবনের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে অন্যদের কাছ থেকে। সুতরাং হে আমার প্রিয়তম, ভালোবাসার আনন্দ ও যৌবনের মহিমা থেকে আমরা প্রত্যাখ্যাত হব না।’ আলী চোখ বন্ধ করল, যেন সেই নারীর সুরেলা কণ্ঠস্বর তাকে সেই স্বপ্নের প্রতিমূর্তির ভেতরে বহন করে নিয়ে গেল যে-স্বপ্ন সে আগে দেখেছিল এবং সে অনুভব করল একজোড়া পাখা, যা দৃশ্যমান নয় এবং তা তাকে বহন করে নিচ্ছে এক বিস্ময়কর কক্ষে একটা বিছানার পাশে যেখানে শুয়ে আছে একজন মৃত যুবতী, মৃত্যু যার সৌন্দর্য দাবি করেছিল। আলী ভয়ে কেঁদে ফেলল, তারপর চোখ খুলল এবং দেখতে পেল সেই একই নারী তার পাশে বসে আছে এবং হাসছে। জীবনের রশ্মিতে তার চোখদুটো উজ্জ্বল। আলীর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল ও হৃদয় সতেজ হয়ে উঠল। দুজন প্রেমিকা-প্রেমিকা পরস্পরকে আলিঙ্গন করল, পান করল চুম্বনের মদ মাতাল না-হওয়া পর্যন্ত। তারা পরস্পরের বাহুতে জড়াজড়ি করে সুখনিদ্রায় মগ্ন হল যতক্ষণ অবশিষ্ট ছায়াটুকু অপসৃত না হল অনন্ত ক্ষমতার দ্বারা, যা তাদের জাগিয়ে দিয়েছিল।
***
১. বালাবেক অথবা বাল নগরী। প্রাচীনকালে মানুষ বলত ‘সূর্যের নগর’। হেলিওপোলিসের সূর্যঈশ্বরের সম্মানে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা দাবি করেন, বালবেক ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সুন্দর শহর। এই শহর ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে এর ধ্বংসাবশেষ পর্যবেক্ষণ করলে স্থাপত্যরীতিতে ব্যাপক রোমান-প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে। রোমানদের সিরিয়া বিজয় এর অন্যতম কারণ।
২. ইসতার ছিল ফিনিসীয়দের বিশাল ঈশ্বর। টাইরি, সিডোন, সুব, ডিজাবেল এবং বালবেক শহরে তার পূজা করা হত। তাকে বর্ণনা করা হত জীবনের মশালের দহনকারী এবং যৌবনের অভিভাবক। ফিনিসীয়দের পরে গ্রিকরা তার পূজা করতে থাকে। তারা তাকে বলত প্রেম ও সৌন্দর্যের ঈশ্বরী। রোমানরা তাকে ডাকত ‘ভেনাস’ বলে।
.
রাত্রি ও সকালের মাঝখানে
হে আমার হৃদয় শান্ত হও, কারণ শূন্যতা তোমার কথা
শুনতে পায় না, শান্ত হও, কারণ কান্না এবং বিলাপে ইথার
পরিপূর্ণ হয়ে আছে এবং সে পারে না তোমার গান ও
স্তোত্রগীতি বহন করে নিতে।
হে আমার হৃদয় শান্ত হও, কারণ রাত্রির প্রেতাত্মা তোমার
গোপনীয়তার ফিসফিসানিতে কর্ণপাত করবে না,
দাঁড়াবে না তোমার সম্মুখে অন্ধকারের মিছিল।
হে আমার হৃদয় শান্ত হও, ভোরবেলা না-আসা পর্যন্ত
যে ধৈর্যের সঙ্গে ভোরের অপেক্ষা করবে সে-ই তোমার
সঙ্গে নিশ্চিতভাবে মিলিত হবে এবং যে আলো
ভালোবাসবে, তাকেই ভালোবাসা দেবে আলো।
হে আমার হৃদয় শান্ত হও এবং আমার কাহিনী শোনো
আমি দেখেছিলাম আমার স্বপ্নের ভেতরে
একটা নাইটিংগেল শিখাযুক্ত আগ্নেয়গিরির
কণ্ঠনালির ওপরে বসে গান গাইছে এবং আমি
দেখেছিলাম বরফের ওপর মাথা তুলেছে একটা পদ্মফুল
এবং একজন নগ্ন হুরী কবরের মাঝখানে
নেচে চলেছে, যখন হাসতে হাসতে একটা নবজাতক
খেলা করছে মাথার খুলি নিয়ে।
আমি এইসব প্রতিমূর্তি আমার স্বপ্নের ভেতরে দেখেছিলাম
এবং যখন আমি আমার চোখ খুলি এবং আমার
দিকে তাকাই, দেখি আগ্নেয়গিরি এখনও উন্মত্ত কিন্তু
নাইটিংগিলের গান আর শুনি নাই, দেখি নাই তাকে
পাখা না-নাড়িয়ে আকাশে স্থির হয়ে ভেসে থাকতে।
আমি দেখেছিলাম আকাশ শস্যক্ষেত ও উপত্যকায় বরফ
ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং পদ্মফুলের স্থির হয়ে থাকা শরীর
লুকিয়ে ফেলছে সাদা অবগুণ্ঠনের ভেতরে, আমি দেখেছিলাম
অসংখ্য যুগের নীরবতার মুখোমুখি একসারি কবর,
কিন্তু সেখানে ছিল না নৃত্যরত কেউ অথবা কেউ
প্রার্থনা করছিল না কবরের মাঝখানে বসে। আমি
দেখেছিলাম মাথার খুলির স্তূপ কিন্তু কাউকে
হাসতে দেখি নাই বাতাস ছাড়া।
আমার জাগরণের ভেতরে দেখেছিলাম দুঃখ ও মর্মপীড়া।
কী হবে আমার স্বপ্নের আনন্দ ও মধুরতার? কোথায় গিয়েছে
আমার স্বপ্নের সৌন্দর্য এবং কোন্ প্রক্রিয়ায় প্রতিমূর্তিরা
অদৃশ্য হয়ে যায়?
আত্মা কীভাবে ধৈর্যশীল হবে যতক্ষণ সুখনিদ্রা
আশা ও আকাঙ্ক্ষার সুখী প্রেতাত্মাকে ফিরিয়ে
না আনবে?
হে আমার হৃদয় আমার প্রতি মনোযোগ দাও
এবং আমার কাহিনী শোনো, গতকাল আমার আত্মা
ছিল একটি মজবুত ও প্রাচীন বৃক্ষের মতো, যার
শিকড়গুলি আঁকড়ে ধরেছিল মাটির গভীরতাকে
এবং যার শাখাগুলি পৌঁছে গিয়েছিল অসীম শূন্যতায়।
আমার আত্মা বসন্তে প্রস্ফুটিত হয়,
ফল দেয় গ্রীষ্মে এবং যখন শরৎ আসে, তখন
আমি তা জড়ো করি একটা রুপালি থালায় এবং
তা রেখে দিই মানুষ চলাচলের পথের ওপর,
সবাই নিজের ইচ্ছায় তা তুলে নেয় এবং আবার
হাঁটতে শুরু করে।
তারপর যখন শরৎ চলে গেল, তখন তার উল্লাস
চাপা পড়ে গেল হাহাকার ও বিলাপের
নিচে; আমি আমার রুপালি থালার দিকে
তাকালাম এবং দেখলাম একটা ফল তখনও
রয়ে গেছে। আমি তা তুলে নিলাম এবং
মুখে পুরে দিলাম এবং অনুভব করলাম তা
শক্ত আঙুরের মতোই তিক্ত ও টক,
এবং আমি নিজেকে বললাম, দুর্ভাগ্য আমার,
আমি মানুষের মুখে তুলে দিয়েছি অভিশাপ
এবং শরীরের জন্য দিয়েছি অসুখ। সুমধুর প্রাণরস
নিয়ে তুমি কী করেছ আমার আত্মা, যা তোমার
শিকড়গুলি মাটি থেকে চুষে নিয়েছিল এবং সেই সুগন্ধ
যা তুমি আহরণ করেছিলে আকাশ থেকে।’
ক্রোধের ভেতরে আমি প্রতিটি সংগ্রামী শিকড়সহ
মাটির গভীরতা থেকে আমার আত্মার
শক্তিশালী ও প্রাচীন বৃক্ষগুলিকে উপড়ে ফেলেছিলাম।
আমি আমার অতীত থেকেও একে উপড়ে
ফেলেছিলাম এবং তুলে নিয়েছিলাম তাকে হাজার বসন্ত
ও হাজার শরতের স্মৃতি থেকে এবং আমি
আমার আত্মার বৃক্ষকে রোপণ করেছিলাম
অন্য জায়গায়, এখন এটা ছিল সময়ের পথ থেকে
দূরবর্তী এক শস্যক্ষেতে এবং দিন রাত্রি আমি তার
তত্ত্বাবধান করি এবং নিজেকে বলি, ‘জাগরণ
আমাদেরকে বহন করে নেবে নক্ষত্রদের কাছাকাছি।’
আমি একে রক্ত এবং চোখের জলে ধুয়েছিলাম এই
বলে বলে, ‘রক্তের একটা গন্ধ আছে এবং চোখের
পানিতে আছে মিষ্টতা’। যখন বসন্ত ফিরে
এল, আমার বৃক্ষ আবার প্রস্ফুটিত হল এবং গ্রীষ্মে
তার শাখা বহন করল ফল। এবং যখন শরৎ এল
তখন আমি সমস্ত পাকা ফল জড়ো করলাম একটা
সোনালি থালায় এবং তা রেখে দিলাম
মানুষ চলাচলের পথের ওপর এবং মানুষ তা
অতিক্রম করে গেল কিন্তু কেউ কোনো ফল নিল না।
তারপর আমি একটা ফল তুলে নিয়ে মুখে দিলাম
এবং এটা ছিল মধুর মতো মিষ্টি, ব্যাবিলনের
মদের মতোই উদ্দীপক এবং জুঁইফুলের মতো সুরভিত।
আমি কেঁদে কেঁদে বললাম, ‘জনগণ চায় না
তাদের মুখে আশীর্বাদ প্রবেশ করুক, চায় না হৃদয়ে
প্রবেশ করুক সত্য, কারণ আশীর্বাদ হচ্ছে
অশ্রুজলের কন্যা এবং সত্য হচ্ছে রক্তের পুত্রসন্তান।
আমি আমার আত্মার নির্জন বৃক্ষের ছায়ায় বসতে
কদর্য নগর পরিত্যাগ করেছিলাম, যে বৃক্ষ জীবনের
পথ থেকে দূরবর্তী এক শস্যক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হে আমার আত্মা, শান্ত হও, ভোর না-হওয়া পর্যন্ত
শান্ত হও এবং মনোযোগ দিয়ে শোনো আমার কাহিনী :
গতকাল আমার চিন্তাগুলি ছিল একটা নৌকা যা পাল
তুলেছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝখানে এবং চলাচল
করেছিল বাতাসের সঙ্গে একভূমি থেকে অন্য ভূমিতে।
সাতটি পাত্র ভর্তি রঙধনুর রঙ ছাড়া আমার
নৌকা ছিল শূন্য এবং সমুদ্রের মুখের ওপর
দিয়ে চলাচল করতে করতে যখন আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম
তখন নিজেকে বললাম, ‘আমি ফিরে আসব
আমার চিন্তার শূন্যতরীসহ আমার জন্মের ক্ষুদ্র দ্বীপের
পোতাশ্রয়ে।’
আমি আমার নৌকাকে রঙ করেছিলাম সূর্যাস্তের মতো হলুদ,
বসন্তের হৃদয়ের মতো সবুজ, আকাশের মতো নীল
এবং নক্ষত্রসদৃশ বনফুলের মতো লালরঙ দিয়ে
এবং মাস্তুল ও হাল চিত্রিত করেছিলাম
বিস্ময়কর চিত্রাবলিতে যা আকর্ষণ সৃষ্টিকারী এবং চোখ-ধাঁধানো।
আমি আমার কাজ শেষ করে ফেলেছিলাম, চিন্তার
নৌকাটাকে আমার মনে হল একজন নবীর অন্তর্দৃষ্টি, যা
পাল তুলেছে দুই অনন্তের মাঝখানে,
সমুদ্র এবং আকাশ।
আমি আমার ক্ষুদ্র জন্মদ্বীপের পোতাশ্রয়ে প্রবেশ
করলাম এবং মানুষ উৎফুল্ল হয়ে গান গাইতে গাইতে
আমন্ত্রণ জানাল আমাকে শহরে প্রবেশ করতে
এবং তারা তাদের যন্ত্রগুলি তুলে নিল এবং
শব্দ ভেসে আসতে থাকল তাদের খঞ্জনি থেকে।
এরকম অভ্যর্থনা আমার পাওনা ছিল কারণ
আমার নৌকা ছিল চমৎকারভাবে সজ্জিত এবং কেউ
যেখানে প্রবেশ করেনি এবং দেখেনি আমার চিন্তার
নৌকার ভেতরটা, জানতে চায়নি কী আমি
বহন করে এনেছিলাম সমুদ্রের ওপর থেকে।
এমনকি তারা দেখেনিও যে আমি আমার নৌকাটা
ফিরিয়ে এনেছিলাম একেবারে খালি অবস্থায়,
কারণ ঔজ্জ্বল্য তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছিল।
তারপর আমি নিজের ভেতরে কথা বললাম, ‘আমি
জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছি ছাইদানিতে নিক্ষিপ্ত
হতে এবং সাতটি রঙের পাত্র দিয়ে
আমি তাদের চোখকে প্রতারিত করেছিলাম।’
তারপর আমি আমার চিন্তার নৌকায় চড়লাম
আবার পাল তুলতে, আমি পরিদর্শন করলাম
পূর্ব দ্বীপগুলি এবং জড়ো করলাম গন্ধরস,
রজন এবং চন্দনকাঠ এবং এসব নৌকায় তুললাম
…পশ্চিম দ্বীপগুলিতে ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম এবং
বহন করে আনলাম হাতির দাঁত ও মূল্যবান রত্ন
… আমি ভ্রমণ করলাম দক্ষিণের দ্বীপগুলো এবং
ফিরিয়ে আনলাম আমার অস্ত্রসজ্জিত চমৎকার
সামরিক কাহিনী, চকচকে তরবারি, বল্লম এবং সবধরনের
অস্ত্র… আমি আমার চিন্তার নৌকাকে পূর্ণ করেছিলাম
পৃথিবীর সবচেয়ে পছন্দের এবং সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু দিয়ে
এবং আমার জন্মের ক্ষুদ্র দ্বীপের পোতাশ্রয়ে ফিরেছিলাম একথা
বলতে বলতে : ‘জনগণ আবার আমাকে মহিমান্বিত
করবে সততা ছাড়াই এবং তারা আমাকে আবার
আমন্ত্রণ জানাবে তাদের ঘরে প্রবেশ করতে
কোনো প্রশংসনীয় যোগ্যতা ছাড়াই।’
যখন আমি পোতাশ্রয়ে পৌঁছালাম, কেউ
আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এল না… আমি
আমার পূর্বতন গৌরবের পথে হাঁটলাম
কিন্তু কেউ আমার দিকে তাকাল না… আমি
বাজার এলাকায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আমার
নৌকার সম্পদের কথা বললাম এবং তারা আমার
কথায় কর্ণপাত করল না, তারা আমাকে
নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করল।
আত্মাহীন হৃদয় নিয়ে আমি পোতাশ্রয়ে
ফিরেছিলাম এবং আমার ভেতরে ছিল হতাশা এবং দ্বিধা।
এবং যখন আমি আমার নৌকার দিকে
স্থিরদৃষ্টিতে তাকালাম, তখন দেখতে পেলাম
একটা জিনিস যা সমুদ্রযাত্রার সময় আমি
দেখি নাই এবং আমি হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলাম:
‘সমুদ্রের ঢেউ আমার নৌকার রঙ এবং চিত্রিত
চিত্রাবলিকে বাতিল করেছে, ফলে তা এখন
কঙ্কালের মতো দেখায়।’ বাতাস এবং জ্বলন্ত
সূর্য মুছে ফেলেছে আমার নৌকার উজ্জ্বল রঙ
ফলে তা এখন ছেঁড়া ও ধূসর পোশাকের মতো দেখায়।
আমি আমার সম্পদের মধ্যে বসে এসব পরিবর্তন
প্রত্যক্ষ করতে পারব না, কারণ
ভেতর থেকে আমার দুচোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আমি একত্রিত করেছিলাম পৃথিবী ওপরের সবচেয়ে
মূল্যবান জিনিসগুলি এবং তা স্থাপন করেছিলাম
জলের মুখের ওপরে ভাসমান একটি বক্ষের ওপর
এবং প্রত্যাবর্তন করেছিলাম আমার লোকজনের কাছে,
কিন্তু তারা আমাকে দেখতে পায়নি, কারণ
তাদের চোখ প্রলুব্ধ হয়েছিল ঝিকমিক করতে
থাকা একটা শূন্যতার প্রতি।
সেসময় আমি আমার চিন্তার নৌকা পরিত্যাগ
করলাম মৃতের শহরের জন্য এবং বসলাম
পরিপাটি কবরের মাখখানে, তাদের গোপনীয়তাগুলি
সম্পর্কে গভীরভাবে ধ্যান করতে।
শান্ত হও হে আমার হৃদয় ভোর না-হওয়া পর্যন্ত,
শান্ত হও, কারণ উন্মত্ত ঝড় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ
করছে তোমার অন্তরাত্মার ফিসফিসানিকে
এবং উপত্যকার গুহাগুলি তোমার তারের কম্পনের
প্রতিধ্বনি তোলে না।
হে আমার হৃদয় শান্ত হও যতক্ষণ ভোরবেলা না আসে
কারণ যে ধৈর্যের সঙ্গে ভোরের আগমনের
অপেক্ষায় থাকে, আকুল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাকেই
আলিঙ্গন করবে ভোরবেলা
ভোরবেলা অতিক্রান্ত হয়েছে, হে আমার হৃদয়
যদি সক্ষম হও তবে কথা বলো। এখানে ভোরবেলার
মিছিল চলেছে… কেন তুমি কথা বলো না?
রাত্রির নৈশব্দ কি তোমার অন্তরাত্মার
গভীরতায় একটি গান পরিত্যাগ করে যায়নি
যার সঙ্গে তুমি ভোরবেলায় দেখা করতে পারো?
এখানে, আছে পায়রার ঝাঁক
এবং উপত্যকার দূরবর্তী অঞ্চলে চলাচল করছে নাইটিংগেল,
পাখিদের সঙ্গে তুমি উড়ে যেতে সক্ষম অথবা এরকম ভয়াবহ
রাত্রি কি আছে যা তোমার পাখাকে
দুর্বল করে দেয়? মেষপালকেরা তাদের মেষকে নেতৃত্ব
দিচ্ছে খোঁয়াড় ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য, রাত্রির
সেই প্রেতাত্মা কি তোমার কাছে তার ক্ষমতাকে
পরিত্যাগ করে গেছে, যেন তুমি
মেষপালের পেছনে পেছনে সবুজ তৃণভূমিগুলি
অতিক্রম করে যেতে পারো? যুবক-যুবতীরা মার্জিতভাবে
হেঁটে যাচ্ছে আঙুরক্ষেতের দিকে।
তুমি কি সক্ষম হবে দাঁড়াতে এবং তাদের সঙ্গে হাঁটতে?
জেগে ওঠো আমার হৃদয় এবং ভোরবেলার সঙ্গে হাঁটো
কারণ, রাত্রি কেটে গেছে এবং অপসৃত হয়েছে
অন্ধকারের ভীতি, কালো স্বপ্ন,
ভয়ংকর চিন্তাভাবনা ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে।
জেগে ওঠো আমার হৃদয় এবং তোমার কণ্ঠ উঁচু
করে তোলো গান গেয়ে, কারণ যে তার গানকে
ভোরবেলার সঙ্গে ভাগাভাগি করে না, সে হচ্ছে চিরকালীন
অন্ধকারের অনেকগুলির মধ্যে একটি পুত্রসন্তান।