রাত্রির যাত্রী

রাত্রির যাত্রী

(১)

লোক-জনের ভিড়ে দমটা কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো৷ তাই আমি, প্রীতম আর বুবাইদা তিনজনে মিলে এই লোকারণ্যের ভিড় থেকে দূরে কোথাও নিরিবিলিতে গিয়ে একটু আড্ডা দেব বলে ঠিক করলাম৷ সত্যি, এই দুর্গা পুজোর সময় আমাদের পাড়ার পুজো মন্ডপ দেখে মনে হয় যেন শহরের সমস্ত মন্ডপের লোকের ভিড় এই আমাদের পাড়াতে এসে জমেছে৷ এমনিতেই আমার বেশি ঘিঞ্জি জায়গা ভালো লাগে না৷ তার উপর আবার ডাস্ট এলার্জির ভয়৷

বি-এড কলেজ থেকে একটু দূরে, পাকা রাস্তার এক ধারে, সিমেন্টের দাওয়াটায় এসে বসলাম আমরা তিন বন্ধু৷ আড্ডার কোন নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ শেষে আমি এই নীরবতা ভাঙলাম৷ বুবাইদার কাছে তার ভৌতিক অভিজ্ঞতা শুনতে চাইলাম৷

মিশমিশে কালো রাত৷ রাস্তার ওপারে পাঁচ ফুটের ভগ্নপ্রায় পাঁচিল৷ সেই পাঁচিলের ওপার থেকে শুরু হয়েছে সুবিশাল সেরিকালচার জঙ্গল৷ দিনে সেটার অরণ্যরাশির বাহার দেখলে যেমন প্রাণ জুড়িয়ে যায়, তেমনি অন্ধকার হতেই মনে হয় সেই জঙ্গলটাতে নিশি প্রাণের সঞ্চার হয়েছে৷ সে প্রাণে আনন্দ নেই, মায়া নেই, রয়েছে কেবল অশনি সঙ্কেত আর কাদের যেন হাতছানি৷ আমাদের দাওয়াটার ঠিক পিছনদিকে কয়েক হাতের ব্যবধানে রয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট খেজুর গাছ৷ রাত্রের মৃদুমন্দ বাতাস যখন তাদের পাতাগুলোর মধ্যে দিয়ে খস্ খস্ শব্দে বয়ে যাচ্ছে, তখন রাত্রের অন্ধকার মাখা গাছগুলোকে দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে৷ গাছগুলোর একটু পরেই ঢাল নেমে শুরু হয়েছে কলেজের মাঠ৷ সুদূর বিস্তৃত মাঠের শেষপ্রান্তে দেখা যাচ্ছে ডি.এড কলেজ৷ কলেজ হোস্টেলের দু’একটা রুমের আলো মিটমিট করে জ্বলছে৷ সবমিলিয়ে পরিবেশটা ভূতের গল্পের জন্য বেশ আদর্শই বটে৷

(২)

এবার আসল গল্পে আসা যাক৷ বুবাইদা বলা শুরু করল, প্রায় মাস তিনেক আগেকার কথা হবে৷ সেবার দাদার বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দিতে যেতে হয়েছিলো বহরমপুরে৷ ওখানে দাদার কোন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকে৷ বিয়ের আর বেশি দিন বাকি ছিলো না, সপ্তাহ ঘুরলেই বিয়ে৷ এদিকে তখনও অনেকগুলো নিমন্ত্রণ সারা বাকি৷ কাজেই আমাদের সেদিনেই ফিরতে হতো৷ কিন্তু সবসময় যে যেমন ভাবা তেমন কাজ হয় না৷ গন্তব্যে পৌঁছতে বেলা প্রায় আড়াইটা হয়ে গেলো৷ নিমন্ত্রণ পত্র দিতে গিয়ে, একপ্রকার নেমন্তন্নই খেয়ে নিলাম৷ সে কি অতিথি আপ্যায়ন৷ একদম এলাহি আয়োজন সব৷

‘আমি যে কেমন ভোজন রসিক আশা করি সেটা ভালোভাবেই জানিস তোরা, তাই…’ কথাটা শেষ না করেই, পকেট থেকে একটা ডার্কচকোলেট বের করে, নিমেষের মধ্যে মুখে পুরে নিলো৷

আমি বললাম, ‘কি হল এটা?’

‘গল্পটা শোন৷’

আমার কৈফিয়তের জবাব না দিয়েই, সেটা চিবোতে চিবোতে মুচকি হাসল কেবল৷ আমিও গল্পের স্বাদ উপভোগ করার জন্য, আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে শুনতে লাগলাম৷

তো খাওয়াদাওয়া তো হল৷ সেই ভীম প্রায় খাবার শেষ করার পর গায়ে একটু আলিস্যে ভাব ঠেকল৷ বাঙালির আবার দুপুরে ভাতঘুম না হলে চলে না৷ তাই একটু গা গড়িয়ে নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ উঠলাম৷ শীতকাল, বেলা এমনিতেই ছোট৷ বাইরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে৷ ফেরার জন্য রওনা দেব কি? বাড়ির লোকজন ছাড়েই না৷ তাদের দাবি, রাতটা সেখানে কাটিয়ে একেবারে সকালে বেরোনোর৷ আমরাও নাছোড়বান্দা৷ সেদিনেই বেরোতে হবে৷ কারন আগেই বলেছি, বিয়েতে আর বেশি সময় নেই৷ অনেক জোরাজুরির পর শর্তসাপেক্ষে ঠিক হল রাত্রের খাওয়া সেরে রওনা দেব আমরা৷ যদিও এতো রাত্রে এত দূরের পথ যেতে দিতে বাড়ির লোকের মত ছিলো না৷ তাও অগত্যা আমাদের জেদের সামনে তারা পরাজিত হল৷ পুলিশের চাকরিতে এমনিতেই ছুটি-ছাটা কম, তাই সেবার বহুদিন পর আসাতে একটু খাতির যত্ন করার সুযোগটা ছাড়তে চায় নি৷

খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরোতে বেশ রাত হয়ে গেলো৷ আমাদের গন্তব্য রামপুরহাট৷ আত্মীয় বাড়িতে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ সকালের ব্যস্ত রাস্তা এখন নির্জন৷ ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে৷

আমরা তখন অনেকখানি পথ পেরিয়েছি৷ জনবসতিশূন্য এলাকা, যতদূর চোখ যাচ্ছে দু’ধারে কুয়াশা ভরা ধূ ধূ মাঠ৷ রাস্তার এক একটা ল্যাম্পপোস্ট এতো দূরে দূরে আর এতো মলিন হলদে আলো যে ভালো করে রাস্তা দেখা যাচ্ছে না৷ তার উপর আবার কুয়াশা৷ রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে৷ মাঝে মধ্যে দু একটা লরি হুস হুস করে পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে৷ আর সেইসঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় আমাদের হাড়ের ভিতর পর্যন্ত কেঁপে উঠছে৷ রাত যত বাড়ছে, তত চারপাশের নিঝুম, নিস্তব্ধতা, ভয়ের এক রোমাঞ্চ নিয়ে আসছে মনে৷

বাইকটা আমি চালাচ্ছিলাম৷ ফাঁকা রাস্তা, শীতের রাত, লেট নাইট বাইক রাইড আর পোর্টেবল স্পীকারে আধুনিক বাংলা গান৷ জাস্ট অসাধারণ ফিলিং! কিন্তু, এরই মাঝে আমরা কি জানতাম, কোন আসন্ন বিপদ ঘাপটি মেরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে৷

তখন ফাঁকা রাস্তায় বাইক চলছে আশিতে৷ নির্জন রাস্তার বুক কাঁপিয়ে, ছুটে চলেছে আমাদের এনফিল্ড৷

রাস্তাটা ডবলওয়ে৷ বেশ চওড়া৷ কিছুটা দূরে, আন্দাজ পঁচিশ কি ছাব্বিশ ফুট হবে, দেখি রাস্তার অন্য পাশের ল্যাম্পপোস্টের মলিন হলদে আলোর তলায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে৷ ঘন কুয়াশায় চেহারা দেখতে পেলাম না তবে হাতের ইশারা দেখে আন্দাজ করলাম যে লিফট চাইছিল৷

কেমন যেন একটু খটকা লাগলো৷ জনমানবশূন্য এই রাস্তায়, এত রাত্রে একা একজন লোক৷ ছিনতাইকারীও হতেই পারে৷ এমনটাও হতে পারে যে, লিফট চাওয়ার নাম করে গাড়ি থামানোর ধান্দা৷ তারপর গাড়ি থামলেই লুকিয়ে থাকা ওর দলবল বেরিয়ে আসবে আর একটা রামপুরি পেটে ঠেকিয়ে সব লুঠ করে নেবে৷ প্রাণে মেরে দেওয়াটাও আশ্চর্যের কিছু নয়৷ বাইক, ফোন, ঘড়ি সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক টাকার মালপত্র তো বটেই, সঙ্গে বেঘোরে প্রাণটাও যাবে৷

পেছন থেকে দাদা বারণ করল গাড়ি থামাতে৷ আমি কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলাম৷ প্রায় মিনিট পনেরো পর বাইকটাকে থামালাম৷ অনেকক্ষণ বাইক চালিয়ে কোমরটা ধরে গেছিলো৷ আমি এবার বসলাম ব্যাকসিটে৷ আবার যাত্রা শুরু হল৷ আরো মিনিট পনেরো-কুড়ি কেটে গেল৷

‘ঠিক আগের মতই কিছুটা দূরে, রাস্তার ঠিক অপরদিকের পুরোনো ল্যাম্পপোস্টের মলিন আলোয় আবারও দেখলাম কেউ যেন দাঁড়িয়ে৷ আশ্চর্য ব্যাপার! সেই ছায়ামূর্তি যাকে কিছুক্ষণ আগেই পেরিয়ে এলাম৷ তবে কি হ্যালুসিনোজেন? পকেট থেকে তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে দেখলাম রাত তখন আড়াইটা৷ আমরা আবারও তাকে পেরিয়ে গেলাম, তবে এবার ঘুরে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম, যে কিছু ভুল দেখলাম কিনা৷ হ্যাঁ! সম্ভবত সেই লোকটাই, তবে এবার হাত নেড়ে ইশারা করছে না৷

বাইকের গতি বেড়ে গিয়েছে৷ দাদাকে বললাম, ‘দেখলি?’

‘হুম!’ ছোট্ট একটা উত্তর এল৷ বুঝতে পারলাম দাদা কিছু আন্দাজ করেছে৷

প্রথমে যেখানে লোকটাকে দেখেছিলাম, সেখান থেকে এই জায়গাটার দূরত্ব আন্দাজ দশ মাইল৷ ছিনতাইবাজ যদি হয় তাহলে এত তাড়াতাড়ি এখানে এল কি করে? গাড়ি নিয়ে এত তাড়াতাড়ি আমাদের আগে পৌঁছনো সম্ভব নয়৷ আর প্রায় আধাঘন্টার মধ্যে অন্য কোন গাড়িকেও আমাদের ওভারটেক করতে দেখিনি৷ সেই লোকটা আগে-ভাগে গিয়ে অপেক্ষা করবে সেটাও সম্ভব নয়৷ একটা ছোট্ট হিসেব কষে এই ব্যপারটার যুক্তিসম্মত একটা ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করলাম৷ এমন সময় এক দমকা ঠান্ডা হাওয়া আমাদের সারা শরীরে কাঁটা তুলে পেরিয়ে গেলো৷ সঙ্গে সঙ্গে বাইকটা এমনভাবে টলমলিয়ে গেলো যে আর একটু হলেই পড়ে যেতাম৷ পাকা ড্রাইভিং হাত, তাই দাদা সামলে নিলো৷

দাদা এবার সরব হল৷ বললো, ‘লোকালয়ে না ঢোকা পর্যন্ত বাইক থামানো যাবে না বুঝলি৷’

‘কেন?’

জিজ্ঞেস করার পরমুহূর্তেই আমার চিন্তাগুলো মাথা নাড়া দিল৷

‘তাহলে তুই বলতে চাইছিস…’

আমার মনের কথাটা যেন বুঝতে পেরেছিল দাদা৷ কথাটা শেষ করার আগেই নিজেই বললো, ‘ঠিক অনুমান করেছিস৷ ওটা কোন ছিনতাইকারী ছিলো না৷ মানুষ ছিল কিনা তাই সন্দেহ!’

ছ্যাঁত করে উঠলো বুকের ভেতরটা৷ দাদা আবার বলল, ‘এই কয়েক বছরের চাকরির জীবনে হাইওয়ের এরকম অনেক ঘটনার কথাই শুনেছি৷ অনেকের রোড অ্যক্সিডেন্টে মৃত্যু হলে তাদের অতৃপ্ত আত্মারা ঘুড়ে বেড়ায়৷ চট করে মুক্তি পায় না৷ অপঘাতে মৃত্যু কিনা৷ আমি এসবে কোনদিনই বিশ্বাস করিনি, আর হয়ত করতামও না, যদি না আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তাম৷’

‘আমি ড্যাম সিওর, এটাও কোন এক দুষ্ট আত্মা! আমাদের ক্ষতি করতেই পিছু নিয়েছে৷ বাইক থামিয়েছি কি মরেছি!’

হঠাৎ! আমি আমার বাঁ কাঁধে একটা হালকা চাপ অনুভব করতেই, চমকে উঠে পিছনে তাকালাম৷

দাদা জিজ্ঞেস করল, ‘কি হল?’

বললাম, ‘কিছু না৷’

দাদার কথাগুলো শুনে এবার আমার আরো ভয় করছিলো৷ আচমকা, এবার এক অদৃশ্য হাত আমার কাঁধটাকে খামচে ধরলো! ক্রমশই তার ধারালো নখওয়ালা আঙুলের চাপ বাড়তে লাগল৷ সেগুলো যেন আমার কাঁধে গেঁথে যাচ্ছে অল্প অল্প করে৷ প্রচন্ড ব্যথা! যেন সেই হাত খাবলে কাঁধের মাংস তুলে নিতে চায়৷

আমি চিৎকার করে দাদাকে কোমর থেকে জাপটে ধরলাম৷ দাদা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে?’

যন্ত্রনায় কাতর, তখন আমার মুখ থেকে কেবল কয়েকটা অসংলগ্ন শব্দ বের হল, ‘কেউ…পিছন থেকে…আমার কাঁধ…আ আ আ…!’

দাদা বাইকের স্পীড কমিয়ে থামাতে যাচ্ছিলো৷ আমি বাধা দিলাম৷ ব্যথা আর ভয়ে পিছনে ঘুরে তাকানোর অবস্থায় ছিলাম না৷ তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম এটা সেই অশুভ অশরীরির কাজ৷ আর এটাও বুঝতে পারছিলাম যে বাইক থামালেই দুজনেরই মৃত্যু নিশ্চিত৷ দাদা উদ্বিগ্ন হয়ে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল আমাকে৷ কি জানি কি মনে হল, পুরো হনুমান চল্লিশা মুখস্থ ছিলো, আমি জোরে জোরে সেটা আওড়াতে লাগলাম৷ ব্যথায় আমার কথাও ঠিক করে বেরোচ্ছিলো না৷ কিন্তু কালবৈশাখীর পরেই রামধনু ওঠার মত, মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথেই সেই অদৃশ্য হাতের চাপ কমতে লাগলো৷ নিমেষের মধ্যেই সমস্ত ব্যথা কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো৷

সেই একবার বলা শুরু করেছিলাম আর থামি নি, গোটা রাস্তা আমি মন্ত্র বলতে বলতে এসেছিলাম৷ ফোনে আবার সময় দেখলাম, ভোর চারটে৷ লোকালয়ও আর বেশি দূরে ছিল না৷ অন্ধকার তখনও কাটে নি, কুয়াশা তখনো বেশ ঘন, হিমবর্ষা ঠান্ডার প্রকোপ তখন সর্বস্তরে৷

বেশিক্ষন আর বাইক চালাতে হয় নি৷ একসময় বাইকের আলোয় দেখলাম কুয়াশার মধ্যে থেকে রাস্তার পাশে স্পষ্ট হচ্ছিল দু-একটা গুমটি৷ গুমটিগুলো খোলা থাকবে কিনা ভাবছিলাম৷ এমন সময় ভাগ্য জোরে, দূরের একটা গুমটিতে আলো দেখতে পেলাম৷ উনানের আগুন৷

কুয়াশার রেশ এবার একটু একটু করে কমে আসছিল৷ বাইকটা গুমটিটার সামনে লাগালাম৷ আমার সোয়েটার, জামা আরো যা যা পরেছিলাম সব খুলতে গিয়ে দেখলাম, বাঁ কাঁধের কাছটা ভিজে জ্যাব জ্যাব করছিল রক্তে৷ হাফ ইঞ্চি গভীর, আঙুল সমান মোটা, পাঁচটা গর্ত হয়েছিল৷ দাদা চুপচাপ, টুঁ শব্দটি করল না৷ জায়গাটায় তখন টনটন করে ব্যথা করছে৷ এই হাড়জমানো শীতেও সেদিন ঘেমে-নেয়ে গেছিলাম৷ কি ঘটে গেলো আমাদের সাথে কিছু বুঝতে পারছিলাম না৷ আপনমনে দু’জনে ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজছিলাম৷ সম্বিত ফিরল গুমটিওয়ালার ডাকে৷

‘চা দিব বাবু?’

আমার এই অবস্থা দেখে মাঝবয়সী চা-ওয়ালা লোকটার কপালে ভাঁজ দেখা দিল৷ কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না৷ চলে গেল৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এল৷ গরম চায়ে চুমুক দিয়ে আস্তে করে দাদা বলল, ‘বুঝলি তো, যমের দুয়োর থেকে ফিরেছি প্রাণ হাতে কোনরকমে!’

‘বুইতে পেরেচি৷ ও আপুনাদের পিচু লিয়েছিলো লয়?’ এবার পাশ থেকে বলে উঠল চা-ওয়ালা৷

আমি আৎকে উঠে বললাম, ‘ মানে, তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না? ও টা কে?’

‘আপুনারা কি এগারো মাইলের কাচে থেমে চিলেন?’

একটু ভেবে দাদা বলল, ‘কোন মাইল জানি না৷ তবে হ্যাঁ থেমেছিলাম, কেন?’

সে বড় বড় চোখে, হাতের নানা অঙ্গি-ভঙ্গী করে বলল,

উই রাস্তায় কেউ থামে লা বাবু৷ উ জাগাটা ভালো লয়৷ রেত দু’টোর পর তেনাদের হয়ে যায় উজাগা৷ উখানে কত এক্সিডান্টে কতজন পেরাণ হারিয়েচে৷ আমি ইখানে বহুবচর থেকে আচি, আমি তো জালি৷ আপুনার এই হাল, এ উদেরই কাজ৷ তাই তো রেতে এই রাস্তায় সেরকম গাড়ি যাওয়া আসা করে না৷ বাইরের অলেক লড়িবালা, রেতে হোটেলে থাকে, আলো ফুটলে তবে বেরোয়৷ রেতে তারা কিছুতেই এ রাস্তা পেরোবে লা, কারণ তারা জানে রেতে এ রাস্তায় যাওয়া মানে জীবলটো কে সঙ্গে করে লিয়ে যাওয়া৷

এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, করজোড়া কপালে ঠেকিয়ে বলল, ‘আপুনাদের সাথে ভোলালাথ ছিলো তাই আপুনারা এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেচেন বাবুরা৷ ভুলেও, আর কোন্দিন রেতে উ রাস্তা মারাবেন না৷ উঁহ, মামেগোটো কি করেচে দেখো বাবুটোর! রক্কে করেচো বাবা ভোলালাথ, তুমি রক্কে করেচো৷’

চা-ওয়ালা চলে গেলো৷ ওর কথা শুনতে শুনতে চা টা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো৷ কুয়াশার পর্দা ভেদ করে তখন একটু একটু ভোরের আলো পূবাকাশে দেখা দিচ্ছিল৷ কী একটা হাতে করে নিয়ে এসে চা-ওয়ালা বললো, ‘বাবু, এটা বিড়ির ছাই, ঘা’টায় লাগিয়ে লিন৷ আরাম হবে৷’ আমি বারণ করতে যাচ্ছিলাম দাদা বললো লাগিয়ে নিতে, পাড়া-গাঁ এর লোকেরা এসব ব্যবহার করে৷ ঘা, ফোঁড়াতে, ভালো কাজ দেয়৷

তারপর দাম মিটিয়ে আমরা রওনা দিলাম৷ বাকি রাস্তায় আর কোন অসুবিধা হয় নি৷ তবে মনে মনে সেদিন ঈশ্বরকে শতকোটি প্রনাম জানিয়েছিলাম৷ এর পরেও দু’একবার ওই রাস্তা দিয়ে গিয়েছি৷ তবে সেটা অবশ্যি দিনের আলো থাকতে থাকতে৷ রাত্রে? নৈব নৈব চ!’

(৩)

বুবাইদা জামাটা নামিয়ে পিঠের কাছটা দেখালো৷ দেখলাম গোলগোল, আঙুলের ব্যসের পাঁচটা ক্ষতচিহ্ন৷ এখনো দাগ গুলো সম্পূর্ণ মেলায় নি৷ ফোনে সময় দেখলাম, সাড়ে নটা৷ নিস্তব্ধ, ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারে দূরের মন্দিরের ঘন্টা, কাঁসর, ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *