রাত্রির ভয়ঙ্কর
দ্রুত হস্তে লুসীকে সরিয়ে দিয়ে বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দক্ষিণ হস্তে উদ্যত রিভলভার। ভয়ঙ্কর লোকটা অট্টহাসি হেসে উঠলো, কেমন যেন উৎকট সে হাসির শব্দ।
অন্ধকার রাত্রির নিস্তব্ধতা যেন খান খান হয়ে ভেঙে পড়লো সে হাসির শব্দে।
বনহুর আজ পর্যন্ত কত লোকের সঙ্গে লড়াই করেছে–কত দুর্দান্ত দুর্বত্তের সঙ্গে, কত ভয়ঙ্কর দস্যুর সঙ্গে, কত সাংঘাতিক লম্পটের সঙ্গে কিন্তু এমন হাসি সে কোনোদিন শোনেনি। বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে গুলী ছুঁড়লো!
সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো বনহুর–জমকালো লোকটা তেমনি দু’হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসছে। রিভলভারের গুলীতে এতোটুকু টললো না লোকটা।
বনহুর পর পর কয়েকটা গুলী ছুঁড়লো, কিন্তু আশ্চর্য লোকটার কিছু হলো না, বরং সে যমদূতের মত এগিয়ে আসছে!
বনহুর পুনরায় গুলী ছুঁড়লো কিন্তু রিভলভারের গুলী না থাকায় কোনো শব্দ হলো না বা গুলী বেরুলো না। দুর্দান্ত দস্যু বনহুর ভীত হয়ে পড়লো–জীবনে এমন অবস্থায় সে কোনোদিন পড়েনি। লুসী তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো–বাঁচাও, বাঁচাও, কে আছো বাঁচাও…।
কিন্তু কোনোদিক থেকে কোনো সাড়া আসে না। ভয়ঙ্কর লোকটা ধরে ফেলে বনহুরকে, তার লোহার সাঁড়াশীর মত হাত দু’খানা দিয়ে টিপে ধরে বনহুরের গলা।
বনহুর বলিষ্ঠ বাহু দু’টি দিয়ে নিজের গলা মুক্ত করে নিতে যায় কিন্তু সক্ষম হয় না। গলার চাপ অত্যন্ত কঠিন হওয়ায় তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বনহুর সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে।
যখন জ্ঞান হলো বনহুর তাকিয়ে দেখলো তার চারদিকে জমাট অন্ধকার, কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। এখন সে কোথায় ভেবে পায় না। একি! হে হাত-পা কিছু নড়াতে পারছে না। বনহুর বুঝতে পারলো, তাকে মজবুত রশি দিয়ে এঁটে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার সমস্ত দেহটা জড়িয়ে বাঁধা হয়েছে শক্ত রশি দিয়ে। তাহলে কি সেই জমকালো লোকটা তাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে? সে তা হলে এখনও তাকে ত্যাগ করেনি? মনে পড়লো দুটি সাঁড়াশীর মত কঠিন হাতের কথা। কিন্তু লুসী কোথায়, তাকেও কি অন্ধকারে বেঁধে রাখা হয়েছে? সব যেন কেমন ঘোলাটে মনে হচ্ছে বনহুরের। মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করছে এখনও! গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। একটু পানির জন্য জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটখানা চাটতে লাগলো বার বার।
অনেক চেষ্টা করেও বনহুর এক চুল নড়তে পারলো না। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। লুসীর জন্য মনটা কেমন উতালা হলো। হয়তো তাকেও এই আশেপাশে তারই মত অবস্থায় রাখা হয়েছে। বনহুর ডাকলোলুসী…লুসী…লুসী…
কোনো সাড়াই এলো না তার আশেপাশে থেকে।
প্রতিধ্বনি হলো শুধু তার কণ্ঠের লুসী…লুসী….লুসী…
বনহুর অনেক চেষ্টা করতে লাগলো নিজেকে মুক্ত করে নেবার জন্য। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হলো না। ক্রমেই হতাশ হয়ে আসছে তার মন, এই বুঝি তার দস্যু জীবনের পরিসমাপ্তি। বনহুর দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে রশিগুলো ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। অত্যন্ত মজবুত রশি–তাই ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব হলো না বনহুরের পক্ষে। না হলে তাকে রশি দিয়ে এভাবে বেঁধে রাখে কার সাধ্য! লৌহ-শিকলও তাকে কোনোদিন বন্দী করে রাখতে পারেনি। আজ বনহুর কাবু হলো রাত্রির সেই ভয়ঙ্কর লোকটার কাছে।
নানাভাবে চেষ্টা করেও বনহুর তার দেহের বন্ধন এতোটুকু শিথিল করতে পারলো না।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কড় কড় শব্দ শোনা গেলো।
বনহুর বুঝতে পারলো, কোনো লৌহকপাট খুলে যাওয়ার শব্দ এটা। পরক্ষণেই কক্ষমধ্যে আলোকরশ্মি দেখা গেলো। বনহুর পূর্বের ন্যায় জ্ঞানশূন্যের মত নিশ্চুপ পড়ে রইলো, কিন্তু সে সামান্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে দেখতে লাগলো।
কক্ষমধ্যে কয়েকটা লোক প্রবেশ করলো। সম্মুখস্থ দুটি লোকের হস্তে জ্বলন্ত মশাল দপদপ করে জ্বলছে। বনহুর চমকে উঠলো, বিস্ময়ে আরষ্ট হলো সে দেখলো মশালধারী লোক দুটির মাঝখানে মিঃ মাহমুদ রিজভী। তার পাশে সেই ভয়ঙ্কর জমকালো মানুষটি। মশালের আলোতে বনহুর তীক্ষ্ণ নজরে দেখলো মাহমুদ রিজভীর পাশের কালো লোকটা এ দেশীয় মানুষ নয়। নিগ্রো বলেই মনে হলো তাকে। বিরাট দেহ, মাথাটা দেহের আকারে ছোট। মাথায় কদম-ছাটা চুল। চোখ দুটো যেন আগুনের গোলা। লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায় তার দেহে অসুরের শক্তি রয়েছে। সাধারণ মানুষের চেয়ে সে অনেক বেশি মোটা। মাংসপেশীগুলো যেন ফুটবলের মত ফুলে ফুলে উঠেছে। ঠোঁট দু’খানা মোটা, সাদা মত আর উল্টানো। দেহে কোনোরকম কাপড় নেই, শুধু একটা নেংটী ধরনের কিছু আটকানো রয়েছে লজ্জাস্থানে। বনহুর আরও অবাক হলো–কালো লোকটার বুকে মজবুত লোহার পাত দিয়ে তৈরি একটি বর্ম। এবার সে বুঝতে পারলো। পর পর গুলী ছুঁড়েও কেন তাকে কাবু করতে পারেনি সে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বনহুরকে বিচলিত করলো মিঃ রিজভীর আবির্ভাব। তাকে তার মৃত্যু কূপে বন্দী করে রেখে এসেছিলো, সে জানতো ওখান থেকে বের হবার আর কোনো উপায় নেই তার। এখন দেখছে মিঃ রিজভীর তাকে কৌশলে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছে। এতো দুঃখেও বনহুরের মনে হাসি পেলো। ঐ শয়তান রিজভীকেই একদিন সে অত্যন্ত ভদ্র এবং মহৎ জন বলে মনে করেছিলো।
বনহুর ঠিক সব দেখছিলো, কিন্তু পূর্বের মত নিশ্চুপ নিস্পন্দ-পড়ে ছিলো সে।
মিঃ রিজভী এগিয়ে এলো, ভালভাবে বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–এখনও জ্ঞান ফিরে আসেনি। বেশ, ওকে জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত এভাবে থাকতে দাও। তারপর জ্ঞান ফিরে এলে হবে ওর শাস্তি।
মশালধারী লোক দু’টির একজন বললো-হা সাহেব, সব মনে আছে। আপনি শুধু আদেশ করবেন, কাজ করবো আমরা। ব্রুই ওকে ঠিক করে।
কালো লোকটা গোঁ গোঁ শব্দ করে উঠলো।
বনহুর তখন চোখ বন্ধ করে পড়েছিলো, তবু অনুমানে বুঝতে পারলো, জব্রু নামটা ঐ জমকালো নিগ্রো লোকটার এবং সে বোবা বা ঐ ধরনের কিছু হবে। বনহুর একটুও নড়ছে না, ঠিক যেমন পড়ে ছিলো তেমনি রয়েছে।
মিঃ মাহমুদ রিজভী কঠিন কণ্ঠে বললো–সাবধানে এর বন্ধন উন্মোচন করে লৌহশিকল পরাবে। এর আসল পরিচয় আমি পেয়েছি, জানো এ কে?
মশালধারী প্রথম ব্যক্তি বললো–সাহেব, কে এই শয়তান?
বললো-মাহমুদ রিজভী–এর পরিচয় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। বিশ্ববিখ্যাত দুর্দান্ত দস্যু বনহুরের নাম শুনেছো? সেই দস্যু বনহুর।
দস্যু বনহুর! এক সঙ্গে মশালধারী লোক দুটো যেন অস্ফুট শব্দ করে উঠলো।
রিজভী বললো হাঁ, একে পুলিশ ফোর্স কোনোদিন বন্দী করে রাখতে পারেনি বা কেউ কোনোদিন ওকে কাবু করতে সক্ষম হয়নি। জর কৃতিত্বে আজ আমি তাকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছি। শোন, তোমরা অত্যন্ত হুশিয়ারীর সঙ্গে কাজ করবে।
আপনার আদেশ শিরোধার্য সাহেব। বললো মশালধারী একজন।
বনহুর নিস্পন্দ পড়ে ছিলো বটে কিন্তু ওদের কথাবার্তা সব শুনছিলো সে। বুঝতে পারলো, তার পরিচয় আর অজানা নেই। মাহমুদ রিজভী তাকে চিনে নিয়েছে।
রিজভী জমকালো জব্রুকে কিছু ইংগিত করলো।
জব্রু গোঁ গোঁ করে কি যেন জবাব দিলো তারপর বেরিয়ে গেলো সে। রিজভীওে তাকে অনুসরণ করলো।
মশালধারী দুইজন বনহুরের পাহারায় নিযুক্ত রইলো।
বনহুর নড়ে উঠলো এবার, বললো–উঃ পানি…পানি দাও।
মশালধারী লোক দুটোর চোখ জ্বলে উঠলো চক্ চক্ করে।
প্রথম ব্যক্তি বললো–বালা, যা সাহেবকে খবর দে, বল্ ওর হুঁশ ফিরে এসেছে।
দ্বিতীয় জন মশালটা দেয়ালের খুপড়ীতে গুঁজে রেখে চলে গেলো।
বনহুর আবার বললো–ভাই, একটু পানি দাও না।
সাহেব এলেই তোমাকে পানি দেওয়া হবে, বুঝলে?
লোকটার কথা বলার ভঙ্গী দেখে রাগে গ গস করে উঠলো বনহুরের দেহ। মনে হলো এই মুহূর্তে ওকে এক ঘুষিতে শেষ করে দেয়। কিন্তু এখন সে নির্জীব হয়ে পড়েছে, কৌশলে তাকে বন্দী করা হয়েছে। বনহুর বুঝতে পারলো, পানি তো দূরের কথা, শয়তান রিজভী এসে তাকে ঘোল খাওয়াবে, মানে তার উপর চালাবে অত্যাচার। বনহুর সেজন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো। বন্দী যখন সে হয়েছে, তখন আর ভেবে কোনো ফল হবে নন।
অল্পক্ষণ পর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলো মাহমুদ রিজভী আর দ্বিতীয় মশালধারী।
বনহুরকে সজ্ঞান অবস্থায় দেখে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো–আমাকে মৃত্যুকূপে বন্দী করে বাঁচবে ভেবে পালিয়েছিলে, এবার দেখো কে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করছে।
বনহুরকে একটি লোহার খাটিয়ার সঙ্গে মজবুত করে বেঁধে রাখা হয়েছিলো। খাটিয়াটা পাথরের মেঝের সঙ্গে কঠিনভাবে আটকানো। বনহুর ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো, রিজভীর মুখে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো–দস্যু বনহুর মৃত্যুভয়ে কাতর নয় রিজভী।
দেখা যাবে কাতর হও কিনা। ভেবেছো দস্যু বনহুর নাম শুনলে চমকে উঠবো?
বনহুর বললো–তোমার মুখেই আমি জানতে পেয়েছি, আমি নাকি দস্যু বনহুর।
আমার মুখে?
হাঁ, তুমি যখন আমার পরিচয় এদের কাছে দিচ্ছিলে তখন..
ও, তুমি তাহলে অজ্ঞান হওনি?
দস্যু বনহুর এতো সহজে অজ্ঞান হয় না।
আচ্ছা এবার দেখা যাবে। প্রথম মশালধারীর দিকে তাকিয়ে বললো–ভূজঙ্গ, জব্রুকে ডাকো।
আচ্ছা সাহেব। বেরিয়ে গেলো ভূজঙ্গ।
বনহুর কঠিন একটা শাস্তির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। জানে সে কতবড় ভয়ঙ্কর লোক ঐ নিগ্রো জব্রু।
একটু পরে ফিরে এলো ভূজঙ্গ, তার পিছনে গরিলার মত ঘৎ ঘৎ করে এগিয়ে আসছে জমকালো জু।
রিজভী ইংগিত করলো জব্রুকে।
জব্রু রিজভীর ইশারায় ওপাশ থেকে একটা চাবুক তুলে নিলো হাতে। জানোয়ারের মত একটা শব্দ করে হেসে উঠলো–যেমন করে হেসেছিলো জুব্ৰু ঐ রাতে।
বনহুর তাকালো জব্রুর ভয়ঙ্কর চেহারার দিকে, তার হাত-পা-দেহ বন্ধন অবস্থায় থাকলেও চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। দাঁত দিয়ে অধর দংশন করলো সে।
রিজভী এবার হাত দিয়ে ইশারা করলো জুকে।
অমনি জব্রু হিংস্র হয়ে উঠলো ভীষণভাবে, আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলো সে বনহুরের দেহে। যখন জব্রু বনহুরের দেহে আঘাত করছিলো তখন জব্রুর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছিলো। হুম হুম্ হুয়াম…হুম হুম্ হুয়াম
বনহুর যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করে ফেলছিলো। দাঁত দিয়ে অধর চেপে ধরছিলো ভীষণভাবে। তবু একটু শব্দ করছিলো না।
রিজভী বললো–বাদলা, লুসীকে নিয়ে আয়, দেখুক ওর শাস্তি মনে শান্তি পাবে।
বাদলা চলে গেলো। একটু পর ফিরে এলো লুসীকে নিয়ে।
লুসীর হাত দু’খানা পিছমোড়া করে বাঁধা। এসে দাঁড়ালো বাদলার পিছনে। বনহুরের উপর নজর পড়তেই তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো–মিঃ আলম, উঃ আপনার এই অবস্থা! মাগো…
হাঃ হাঃ হাঃ, মুখ ভেংচে বললো রিজভী–আলম! কে তোমার মিঃ আলম? জানো ওকে?
লুসী অশ্রুভরা চোখ তুলে তাকালো রিজভীর মুখের দিকে। কোনো জবাব দিলো না।
জব্রু আবার আঘাত করলো বনহুরের শরীরে।
লুসী বসে পড়লো তার পাশে না না ওকে মেরো না। ওকে মেরো না, ওর কোনো দোষ নেই।
আবার হেসে উঠলো রিজভী–জানো ও কে? ওর পরিচয় জানলে শিউরে উঠবে সুন্দরী!
লুসীর মনে ভেসে উঠে সেদিনের কথা, বলেছিলেন মিঃ আলম–লুসী, আমার পরিচয় তুমি জানো না, আমি মিঃ আলম নই। লুসী প্রশ্নভরা দৃষ্টি মেলে সেদিন তাকিয়েছিলো, কিন্তু মিঃ আলম বলেছিলেন, আজ নয় আর একদিন বললো। আজ রিজভীর কথায় লুসী অবাক হয়ে তাকালো।
বললো রিজভী লুসী, তুমি ওকে বিশ্বাস করেছিলে কিন্তু ও তোমাকে আত্মসাৎ করবার চেষ্টায় ছিলো। বিখ্যাত দস্যু বনহুর ওর নাম।
লুসী পত্রিকায় অনেকদিন আগে পড়েছিলো এই দস্যুনাম। পড়েছিলো এ দস্যু সম্বন্ধে অনেক কথা–আজ সেই দস্যু বনহুর তার সম্মুখের মিঃ আলম! লুসী অবাক হয়ে তাকালো বনহুরের ঘর্মাক্ত মুখখানার দিকে।
বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই লুসীর অন্তর মায়ায় আদ্র হয়ে উঠলো। করুণ চোখে তাকালো, দস্যুনাম শোনায় তার মনে কোনোরকম ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা এলো না। বরং ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
রিজভী জুকে পুনরায় ইংগিৎ করলো।
সঙ্গে সঙ্গে জব্ৰু চাবুকের পর চাবুক দিয়ে আঘাত করে চললো বনহুরের দেহে।
লুসী ছুটে এসে নিজের দেহ এগিয়ে দিলো আমাকে মারো তবু ওকে মুক্ত করে দাও…
লুসী বনহুরের দেহের উপর নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করতেই, রিজভী হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো জকে।
জব্রু হিংস্র জন্তুর মত ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।
রিজভী এক ঝটকায় লুসীকে টেনে তুলে নিলো, কঠিন কণ্ঠে বললো–লুসী, তোমার ক্ষমতা নেই দস্যুকে তুমি বাঁচাও। ওকে আমি হত্যা করবো। ধীরেনচরণকে ও হত্যা করেছে, তার প্রতিশোধ নেবো।
বনহুরের দিকে তাকিয়ে লুসী আকুল হয়ে কেঁদে উঠলো। তার দেহের জামা ছিঁড়ে গেছে, চামড়া কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁটের এক পাশেও কেটে গেছে অনেকটা। লুসী বলে উঠলো–মিঃ রিজভী, আপনি যা চান তাই দেবো, ওকে মুক্ত করে দিন।
বললো রিজভী–মুক্তি ও পাবে না কোনোদিন–তবে ওকে আমি মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারি যদি তুমি আমার কণ্ঠে মালা দাও–আমাকে স্বামী বলে গ্রহণ করো।
লুসী দৃষ্টি নত করে নিলো, তারপর ফিরে তাকালো বনহুরের দিকে।
বনহুরের ব্যথা-করুণ চেহারা লুসীর অন্তরে দারুণ আঘাত করলো! মিঃ আলম কতবার তাকে বাঁচিয়েছেন, কতবার তাকে শয়তানের কবল থেকে রক্ষা করেছেন–আর ওকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এটুকু পারবে না! নিজেকে না হয় উৎসর্গ করে দেবো মিঃ আলমের জন্য। বললো লুসী-আমি রাজি আছি।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–লুসী!—
না, না, আমি আপনার জন্য সব হাসিমুখে মেনে নিতে পারবো। তবু ওরা আপনাকে মুক্ত করে দিক।
লুসী, আমার জন্য তুমি নিজেকে বিনষ্ট করা না। আমার অভিশপ্ত জীবনকে এভাবে শেষ হতে দাও লুসী।
না না, ওকে মুক্ত করে দিন রিজভী, আমি আর ওর এ কষ্ট সইতে পারছি না। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।
রিজভীর মুখ উজ্জ্বল হলো, জুকে বেরিয়ে যাবার জন্য ইংগিত করলো সে।
জব্রু হাতের চাবুক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘৎ ঘৎ করতে করতে বেরিয়ে গেলো। রিজভীর আদেশে সে ক্ষান্ত হলো, কিন্তু আরও মারার জন্য সে উগ্রীব হয়ে উঠেছিলো।
জব্রু নিগ্রো এবং বোবা। তার রাগ অতি ভয়ঙ্কর। রিজভী এই জ্বর সাহায্যে দিল্লী শহরে বহু অসাধ্য কাজ সাধন করে থাকে। জব্রু জানোয়ারের মতই বুদ্ধিহীন, ওকে রিজভী যেভাবে চালনা করে সেভাবে সে চলে।
রিজভীর বাবা ত্রুকে ভিয়েৎকং-এর কোনো এক জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে এনেছিলো। তখন জব্রু ছিলো পাঁচ ছ’ বছরের বালক মাত্র। কথা বলতে পারতো না বলেই জ্বর বাবা-মা ওকে বনের মধ্যে ফেলে দিয়ে এসেছিলো। জব্রু বনে ফলমূল খেয়েই বেঁচে ছিলো বোধ হয়। রিজভীর বাবা লোকজন। নিয়ে ভিয়েৎকং-গিয়েছিলেন কোনো কাজে। হঠাৎ কোনো কাজবশতঃ তাদের বনে যাওয়ার দরকার পড়ে, তখন পায় ছোট্ট জমকালো গরিলা শিশুর মত জব্রুকে। নিয়ে আসে এবং তাকে লালন-পালন। করে। কিন্তু জব্রু সভ্য জগতে এলেও আর মানুষ হতে পারলো না। বোবা তো সে জন্ম-থেকেই ছিলো, তার হাবভাব সব যেন কেমন হলো। রাক্ষসের মত খেতো, আর ঘুমাতো। একদিন এক দারওয়ানের। বিছানার পাশে শুয়ে ঘোৎ ঘোৎ করে ঘুমাচ্ছে জব্রু। দারওয়ান এসে ওকে লাথি দেয়–বেটা আমার ঘরে কেন, ভাগ এখানে থেকে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় জব্রু বন্যহস্তীর মত তেড়ে উঠে এবং দারওয়ানজীকে টুটি টিপে হত্যা করে ফেলে।
সেদিন রিজভীর আত্নীয়-স্বজন–বাড়ির সবাই জঞর কাজ দেখে স্তম্ভিত হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। কারো মুখে কোনো কথা ছিলো না। সবাই জুকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো, কিন্তু রিজভীর বাবা কে পিঠ চাপড়ে তাকে বাহবা দিয়েছিলেন।
সেই জব্রু আজ রিজভীর দক্ষিণ হস্তে।
জব্রুর দ্বারা সে যে-কোনো অসম্ভব কাজ সমাধা করে! শুধু মাত্র একটি ইংগিতে।
জব্রু বেরিয়ে গেলো।
রিজভী লুসীর হাতের বন্ধন মুক্ত করে দিলো, বললো–আমাদের বিয়ের পর ওর বন্ধন উন্মোচন করা হবে।
চলো এ কক্ষ থেকে। লুসীর হাত ধরে রিজভী বেরিয়ে গেলো।
লুসী করুণ অশ্রুভরা নয়নে বার বার তাকালো বনহুরের দিকে।
বনহুর নিশ্চুপ পড়ে রইলো, দেহের আঘাতের চেয়ে তার মনে বেশি দুঃখ লুসীর জন্য! একটা লম্পট প্রৌঢ়কে বিয়ে করে লুসীর জীবন বিনষ্ট হবে! পিপাসায় কণ্ঠতালু শুকিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে এক ফোঁটা পানি পেলে সে আবার নবজীবন লাভ করতো।
মশালধারী বাদলা আর ভুজঙ্গ বেরিয়ে গেলো মশাল হস্তে। কড় কড় শব্দে বন্ধ হলো আবার লৌহকপাট। জমাট অন্ধকারে ভরে উঠলো কক্ষটা।
*
ঘুমন্ত নূর হঠাৎ জেগে উঠলো একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। বিছানায় বসে ডাকলো–মা, মা, বাপি এসেছে, ঐ দেখো বাপির সমস্ত শরীরে রক্ত…
ধড়মড় করে উঠে বসে উদ্ভ্রান্তের মত তাকায় মনিরা কক্ষের চারদিকে কোথায় বাবা তোমার। বাপি? কোথায় সে?
মাগো, ঐ তো বাপিকে তুমি দেখতে পাছো না?
মনিরা মনে করে–সত্যি বুঝি সে ফিরে এসেছে। তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে মেঝেতে নেমে দাঁড়ায়। সুইচ টিপে আলো জ্বালে–কই, কোথায় নূর, তোর বাপি কোথায়? মনিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে–আর কি সে ফিরে আসবে নূর! আর কি আমি তাকে পাবো বাপ?
মা, আমি কি তবে স্বপ্ন দেখলাম? ছোট নূর খাট থেকে নেমে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়।
মনিরা পুত্রকে বুকে চেপে ধরে–বাবা, কি স্বপ্ন দেখলি তুই?
মা, সেকি তোমায় বলবো। আমি বাপিকে ঠিক দেখেছি। বাপি ঐ জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকলো। তার সমস্ত দেহে রক্তের ধারা বইছে। মা, সত্যি বাপির কিছু হয়েছে।
দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকেন মরিয়ম বেগম–মা মনিরা, কি হয়েছে মা? দরজা খোল…দরজা। খোল…
মনিরা দরজা খুলে দেয়।
মরিয়ম বেগম কক্ষে প্রবেশ করেন– আমার মনির এসেছে? ওরে আমার মনির এসেছে? কোথায়? কোথায় আমার মনির?
মনিরা আঁচলে চোখের পানি মুছে, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে মামীমা, নূর স্বপ্ন দেখেছে, তার বাপি নাকি এসেছে।
তাহলে আমার মনির আসেনি? ফিরে আসেনি সে? ওরে নূর, কি দেখলি, কেমন দেখলি তোর বাপিকে? মরিয়ম বেগম নূরকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেন।
নূর স্বপ্নে যা দেখেছিলো বলে।
নূরের কথায় মরিয়ম বেগম কেঁদে আকুল হন, পুত্রের সন্ধান তিনি অনেকদিন হলো পান না, না জানি সে জীবিত আছে না মরে গেছে। হয়তো বা কোথায় কিভাবে আছে কে জানে! মায়ের প্রাণ আকুল হয়ে কেঁদে উঠে।
সমস্ত রাত আর ঘুম হয় না কারো।
শুধু আজ নয়, এমনি কত দিন, কত রাত এই চৌধুরী বাড়িতে শোকের হাওয়া বয়ে গেছে। বৃদ্ধ সরকার সাহেব এখন আরও বৃদ্ধ হয়েছেন। তারও কি কম চিন্তা–চৌধুরী বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তার জীবন।
মরিয়ম বেগম পুত্রশোকে কাতর।
মনিরার অবস্থাও তাই। মেয়েদের স্বামীই তো সব–হোক সে চোর-ডাকু বা খুনী-আসামী তবু স্বামী। মনিরা স্বামীর অভাবে জীবন্বত হয়ে পড়েছে। কোনো সময় তার মুখে হাসি নেই। যেন ধীরস্থির একটি প্রতিমূর্তি। যা না করলে নয়, তাই সে করে। নূরের জন্য একটু নড়তে হয়, নইলে তো একেবারে স্থবিরের মত হয়ে পড়তো।
মরিয়ম বেগম শুধু নামায আর কোরআন তেলাওয়াৎ নিয়ে কাটান, সব সময় তার কামনা শুধু পুত্রের জন্য। পুত্রের চিন্তায় তিনি সর্বক্ষণ বিভোর। মাঝে মাঝে সংসার দেখা-শোেনা তাকে করতে হয়; কিন্তু মন তার পড়ে থাকে কোথায়–কোন্ অজানা দেশে।
নূর স্কুলে পড়ে, আজকাল একটু-আধটু বুঝতে শিখেছে। মাঝে মাঝে কখনও বাপির কথা স্মরণ হল উদাস হয়ে পড়ে। পড়া শোনায় সে সেরা ছেলে, যদিও তার বয়স সামান্য তবু বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর। বাপির কথা মনে হলে মাকে গিয়ে প্রশ্ন করে–মাগো, আমার বাপি কোথায় গেছে? কবে আসবে? কেন সে এত দিন আসে না?
কিন্তু কি জবাব দেবে মনিরা, কি করে বলবে তার বাপি কোথায় গেছে! কবে আসবে তাই বা কে জানে! জীবিত আছে না নেই, তাই বা কে বলতে পারে!
মনিরা শিশু সন্তানের কথায় শুধু নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতো, স্বামীর মুখখানা বার বার স্মরণ হতো তার অন্তরে।
মাকে কাঁদতে দেখে নূর ব্যস্ত হয়ে পড়তো, মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলতো-মা, বাপির কথা বললে তুমি কাঁদো কেন? আর আমি বাপির কথা বলবো না। ছোট্ট নূর এখন অনেক কথা বলতে শিখেছে।
নূরের কথায় মনিরা ওকে বুকে চেপে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো–আমি এমনি কাঁদছি বাবা। তোমার বাপির কথা মনে করে কাঁদছি? তুমি কেন বলবে না?
মাগো, আমার বাপি কি করে বলো না মা? কোথায় থাকে সে?
তোমার বাপি মস্ত সৈনিক, দেশের কাজ তিনি করেন বাবা। কখন যে কোথায় থাকেন আমরা কেউ জানি না।
এবার বাপি এলে আমি কিছুতেই তাকে আর যেতে দেবো না। কিছুতেই যেতে দেবো না।
হায়রে অবুঝ শিশু, সে জানে না তার বাপিকে এ পৃথিবীর কেউ ধরে রাখতে পারবে না। কোনো শক্তিই তার চলার পথে বাধা দিতে পারবে না।
মনিরা নীরবে পুত্রের কথা শুনে যেতো আর আঁচলে চোখের পানি মুছতো।
মনিরা সদা উদাসীন থাকে বলে মামী মার চিন্তার অভাব নেই। সরকার সাহেবও ভাবেন এ ব্যাপার নিয়ে। মনিরার বয়স তো খুব বেশি নয়, এই বয়সে কোন্ মেয়ে স্বামী ছাড়া বাঁচতে পারে!
মাঝে মাঝে রহমান আসে, গোপনে সাক্ষাৎ করে যায় সে মনিরার সঙ্গে। সর্দার না থাকায় তাদের মনের অবস্থা ভাল নয়। সমস্ত আস্তানা জুড়ে এক মহা অশান্তির কালোছায়া নেমে এসেছে। তবে আস্তানার কাজ বন্ধ নেই, তাদের দলবল সব পূর্বের ন্যায় সঙ্গবদ্ধভাবেই রয়েছে। রহমান এখন এদের পরিচালনা করে। কায়েস তার সহকারী হিসেবে কাজ করছে।
নাসরিন তার কয়েকজন সঙ্গিনী মেয়েদের নিয়ে বনে বনে নেচে গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। বৃদ্ধা দাইমার অনুরোধে নাসরিনকে বিয়ে করেছে রহমান। অবশ্য বনহুর রহমানকে আদেশ দিয়েছিলো নাসরিনকে যেন রহমান জীবনসঙ্গিনী করে নেয়।
রহমানকে স্বামীরূপে পেয়ে নাসরিন গর্বিতা-আনন্দিতা, রহমান বলিষ্ঠ সুন্দর সুপুরুষ। তাছাড়া দস্যু বনহুরের সহকারী সে–কম কথা নয়।
তাজকে নিয়ে শুধু মুস্কিলে পড়েছে রহমান। তাজ সেই থেকে কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে। ভালভাবে খায় না, সব সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, হয়তো তার মনিবকে আর দেখতে পায় না– এটাই তার দুঃখ।
রহমান নিজের হাতে তাজকে খাওয়ায়। পিঠ চাপড়ে আদর করে। গা নেড়ে দেয়।
অশ্ব হলেও তাজ অত্যন্ত বুদ্ধিশীল ছিলো।
মাঝে মাঝে তাজকে নিয়ে যেতো রহমান কান্দাই শহরে। চৌধুরী বাগান বাড়ির অদূরে রেখে দাঁড়িয়ে থাকতো। মনিরা স্বামীর অশ্বের পাশে এসে দাঁড়াতো। তাজের পিঠে স্বামীর চেহারাটাই ফুটে উঠতো তার চোখের সামনে। জমকালো তাজের পিঠে জমকালো পোশাক পরা সৌম্য সুন্দর একটি পুরুষ।
মনিরার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। রহমান সান্ত্বনা দিতো, বলতো–বৌরাণী কাঁদবেন না। সর্দার নিশ্চয়ই ভাল আছেন। তিনি আবার ফিরে আসবেন।
কিন্তু মনিরার মনে সান্ত্বনা আসতো না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতো তার বুক চিরে।
রহমান ফিরে যেতো।
তাজ অদৃশ্য হতে দৃষ্টির অন্তরালে। মনিরা ঘরে ফিরে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়তো বিছানায়, শূন্যতায় হাহাকার করে উঠতো তার মন।
নূর তখন স্কুলে।
মামীমা হয়তো ঘরে বসে এবাদত করছেন। মনিরা একা একা, স্বামীর শিশুকালের ছবিটা বুকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতো নিশ্চুপ পাষাণমূর্তির মত।
পাশের বাড়ির এক বান্ধবী ছিলো মনিরার। কলেজে একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছে ওরা। অল্পদিন হলো বিয়ে হয়ে এসেছে, চৌধুরী বাড়ির অদূরেই তাদের বাড়ি। মনিরার বান্ধবীর নাম মাসুমা। মনিরার সঙ্গে ওর অত্যন্ত মিল ছিলো ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যখন পড়তো তখন হতে। তারপর কলেজ জীবনেও ওরা পড়াশোনা করেছে এক সঙ্গে।
এবার মাসুমা বিয়ে হয়ে এলো মনিরার বাড়ির পাশে। সময়ে অসময়ে মাসুমা আসতো মনিরার কাছে। মনিরা সন্তানের জননী হয়েছে, আর মাসুমা সদ্য বিবাহিতা।
মনিরার হৃদয়জোড়া হাহাকার আর মাসুমার জীবন আনন্দে ভরপুর।
মাসুমা স্বামীর কথা নিয়ে মেতে উঠতো–কত কথা!
মনিরা নিশ্চুপ শুনে যেতো, সামান্য দু’চারটে কথা বলতো। উদাস হয়ে পড়তো মনিরা, মাসুমার স্বামীর কথায় মনে হতো তার স্বামীকে।
বলতো মাসুমা–আমি তো তোকে সব কথাই বলি। কোনো কথা লুকোই না, কিন্তু তুই বড় চাপা মেয়ে–একটি কথাও তুই বলিস না আমাকে।
মনিরা হাসতো–ব্যথাকরুণ, বেদনাভরা সে হাসি।
মাসুমা নাছোড়বান্দা, একদিন মনিরাকে ধরে বসলো সে–শুনেছি তোর স্বামী নাকি দূরদেশে কাজ করেন, কিন্তু কি করেন তা তো কোনোদিন বললি না?
মনিরা বিব্রত বোধ করে, যদিও তার মিথ্যা বলা অভ্যাস নয় তবু মাসুমার কাছে তাকে মিথ্যা কথাই বলতে হয়েছিলো। মাসুমা বলেছিলো হাঁ ভাই, তোর স্বামী কি করেন?
জবাব দিয়েছিলো মনিরা বিদেশে থাকেন। চাকরী করেন।
মাসুমা আজ ধরে বসলো তোর স্বামী কি চাকরী করেন তা তো বললি না মনিরা! আজ তোর সব কথা বলতে হবে।
মাসুমার কাছে মনিরা অন্তরের কথা বলে, কিন্তু তাই বলে সব কথাইতো বলা চলে না বা যায় না! হেসে বললো মনিরা–তিনি সেনা বিভাগে কাজ করেন। সেনাপতি।
মাসুমার মুখে হাসি ফুটেছিলো পরক্ষণেই মুখ গম্ভীর করে বলেছিলো–তাই তো এমন বৌ ঘরে রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন, নইলে সারাদিন তোর আঁচলের তলায় পড়ে থাকতেন, বুঝলি?
একটা নিশ্বাস গোপনে চেপে বলেছিলো–মনিরা আঁচলের নিচে থাকবার মানুষ সে নয় মাসুমা, সে যে পাষাণের চেয়েও কঠিন।
বুঝেছি অভিমান হয়েছে। একবার দেখা হলে আমি তাকে ঠিক করে দেবো মনিরা। কেমন করে। তোকে ছেড়ে পালায় দেখবো! জানিস ভাই, আমার স্বামী একটি মুহূর্ত আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয়। অফিসে যান তাই না কতো, যতক্ষণ অফিসে থাকেন ফোনের পর ফোন করেন। সত্যি। ভাই, লজ্জায় আমার কেমন লাগে। বাড়িতে শ্বশুড়-শাশুড়ী কি যে ভাবেন—
মনিরা মাসুমার কথা শোনে আর ভাবে তার নিজের স্বামীর কথা সেও তো অমনি, একদণ্ড তাকে ছেড়ে সরে যেতে চায় না, কিন্তু পারেনা সে থাকতে। তার কাজ, তার নেশায় তাকে হাতছানি দিয়ে। ডাকে। তখন কোনো শক্তিই তাকে ধরে রাখতে পারে না। মনিরা জানে তার স্বামীর ভালবাসা অপূর্ব, যার কোনো দাম নেই। তার স্বামীর মত এমন ভালবাসতে বুঝি আর কেউ জানে না।
মনিরা স্বামীর চিন্তায় বিভোর হয়ে যেতো।
মাসুমা বলতো–একি, এমন নিশ্চুপ হয়ে গেলি কেননা মনিরা?
জবাব দিতো–কিছু না।
হাঁরে মনিরা, শুনেছি তোর স্বামী নাকি খুব সুন্দর দেখতে?
মোটেই না, কুৎসিৎ কদাকার তিনি।
বড় দুষ্ট তুই নিজের স্বামীর কথা বলবি না, এইতো?
এমনি নানা কথাবার্তায় দুই বান্ধবী মেতে উঠতো। মনিরার ভাল লাগতো মাসুমাকে, মাসুমা ভালবাসতো মনিরাকে। মনিরা সব কথা বান্ধবীকে বললেও আসল কথা কোনোদিন বলতো না, কারণ মাসুমার স্বামী পুলিশ অফিসার–পুলিশ সুপার সে। তরুণ পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরী।
কান্দাই শহরে ছুটিতে হাশেম এসেছে নতুন বৌকে নিয়ে বাপ-মার কাছে কটা দিন কাটাবে বলে। তারপর চলে যাবে সুদূর ভারতে। এর আগে ছিলো হাশেম চৌধুরী রেঙ্গুনে, সেখান থেকে বদলী হয়েছে সুদূর ভারতে। ইচ্ছা করেই হাশেম চৌধুরী ভারতে যাওয়া স্থির করে নিয়েছে। দিল্লী নগরীতে তার জয়েনের হুকুম এসেছে।
মাসুমার আনন্দ ধরে না–সে ভারতবর্ষ দেখতে পাবে! বিশেষ করে দিল্লী দেখার সখ তার অনেক। দিল্লীর বাদশাহদের জীবনকাহিনী তাকে চঞ্চল করে তোলে। আকবরের সমাধি, মমতাজের স্মৃতিসৌধ। তাজমহল, দিল্লীর চেরাগে দেহেলি মাজার–আরও কত কি!
মাসুমা গল্প করে মনিরা তন্ময় হয়ে শুনে। এসব দেশ দেখার সখ তারই কি কম! কিন্তু উপায়। নেই, কি করে যাবে, কে তাকে নিয়ে যাবে এই সব দেশে।
*
ছুটির দিন শেষ হয়ে আসে হাশেম চৌধুরীর।
মাসুমা বলে–ভাই, তোকে ছেড়ে যেতে হবে তাই আমার দুঃখ। সত্যি, তোকে যদি আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতাম!
হাসে মনিরা–সে সৌভাগ্য আমার কোনো দিন হবে না মাসু। আমি বড় হতভাগী।
কিসের অভাব তোর? লক্ষ লক্ষ টাকা যাদের রয়েছে তাদের আবার অভাব! ইচ্ছা করলে তুই সব পারিস।
কি যে বলিস ভাই। টাকা থাকলেই সব হয় না। তোর স্বামী পাশে আছে, তাই এতো বড় বড় কথা বলতে পারিস, আমার সব থেকেও আজ আমি সর্বহারা। জানিস মাসুমা, আমার বুকের মধ্যে কত ব্যথা জমাট বেধে আছে।
বলবি না তো কোনো কথা, জানবো কি করে!
সবতো বলবার নয়, তাই বলতে পারি না মাসু।
লক্ষ্মী বোনটি আমার, সত্যি তোর জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়। আমার স্বামী যখন পাশে আসে–হাসে, কথা বলে, তখন মনে পড়ে তোর কথা জানিস মনিরা, তোর কথা মনে হলে আমি কেমন বিমর্ষ হয়ে যাই। উনি বলেন, হঠাৎ গম্ভীর হলে কেন? আমি কোনো জবাব দেই না। মনিরা, তুই যদি বলিস তাহলে আমি ওকে বলবো তোর সব কথা। কে তোর স্বামী যে এমন মানুষ বছরে একটি বার স্ত্রীর কথা মনে করে না। বড় পাষাণ, বড় নির্দয় তোর স্বামী।
মনিরা মাসুমার মুখে হাত চাপা দেয়, না না, তার কোনো দোষ নেই মাসু। সে তো সব সময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাই আসতে পারে না।
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে মাসুমা–অমন চাকরী নাই বা করলো। কিসের অভাব তার? টাকার? কেন তোর তো অগাধ ঐশ্বর্য, যত টাকা সে চায় দিতে পারিস না?
উদাস কণ্ঠে বলে মনিরা–টাকার অভাব তার নেই মাসু। আমার ঐশ্বর্যের চেয়ে তার অনেক অনেক বেশি ঐশ্বর্য আছে।
তবে কেন সে চাকরী করে?
তার নেশা।
তোর মত স্ত্রীকে অবহেলা করে সে নেশা বজায় রাখে! বুঝেছি।
কি বুঝলি?
তোদের মধ্যে বনিবনাও নেই বুঝি?
ছিঃ ভুল বুঝিস নে মাসু। ওর মত মানুষ হয় না রে! ওর ভালবাসা যে একবার পেয়েছে সে ওকে কোন দিন ভুলতে পারবে না। মাসু, তোকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না, সে কেমন। মনিরার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে আসে।
মাসুমা বলতো বেশ, তোর স্বামীর মত আর কারও স্বামী হয় না। কাদিনে বোন। নিজের হাতে মাসুমা মুছে দিতো ওর চোখ দুটো। ভাবতো–স্বামীকে কত ভালবাসে মনিরা, স্বামীর কথায় সে আত্মহারা হয়ে যায়!
একদিন কথায় কথায় বলেছিলো মাসুমা-মনিরা, চনা আমার সঙ্গে একবার ভারতবর্ষ দেখে আসি।
তা কেমন করে হয় ভাই! মামীমা বুড়ো মানুষ কখন কেমন থাকেন। তাছাড়া নূরের পড়াশোনা
বলেছিলো মাসুমা–আমি মামীমাকে বলে সব ঠিক করে নেবো। আমার সঙ্গে থাকবি, চলে আসবি কয়েক মাস পরে।
সম্ভব নয় মাসু।
মাসুমা তবু বলেছিলো মরিয়ম বেগমকে–মামীমা, মনিরাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। ভারতবর্ষে যাচ্ছি–দুই বান্ধবী মিলে খুব করে ঘুরে বেড়াবো। আপনি অনুমতি দিলে খুব ভাল হয়।
মামীমা কিছু বলবার আগেই মনিরা বলে উঠে–তা হয় না, এদিকে কে সামলাবে সব বল্ দেখি। মামীমা বুড়ো মানুষ!
মরিয়ম বেগম মাসুমার কথায় খুশি হন, মনিরা দিন-রাত স্বামীর চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে, সব সময় কাদাকাটা করে। কচি বয়সে একদম যেন বুড়িয়ে গেছে সে। মরিয়ম বেগম বললেন–মাসুমা, ভাল কথাই বলেছে মা, যাওনা একবার ভারতবর্ষটা দেখে এসো। আমার কত সখ ছিলো ভারতে একটা বাড়ি করবো; কিন্তু হয়ে উঠেনি। বাংলাদেশের মানুষ আমরা অথচ বাংলাদেশ থেকে কত দূরে আজ রয়ে গেছি।
মামীমা, তোমার এই রোগ-জিরজিরে শরীর, তাছাড়া নূরের পড়াশোনা রয়েছে–
আমার শরীর আবার কবে ভাল থাকে মা, এই শরীর নিয়েই বেঁচে থাকবো। মরণ নেই আমার, নইলে এতো দুঃখ-বেদনা সইবে কে? নূর আমার কাছেই থাকবে, সরকার সাহেব আছেন। নূরকে দেখাশোনা করবার লোকের অভাব হবে না। যাও মা, মাসুমা যখন এতো করে ধরেছে তখন যাও ভারতবর্ষটা একবার ঘুরে এসো।
মামীমার কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না মনিরা, নিশ্চুপ রয়ে যায় সে।
মাসুমার আনন্দ আর ধরে না, মনিরা যাবে তার সঙ্গে–এযে কত বড় আনন্দের কথা! স্বামীকে বলে রাজি করিয়ে নেয় মাসুমা–ওগো, মনিরাকে নিয়ে যাবো সঙ্গে, খুব মজা হবে, তাই না?
তার স্বামী কি ভাববেন বলো তো?
স্বামী তোর আর এখন এখানে নেই। মামীমাই তার অভিভাবক। স্বামী বছরে আসনে না, কেমন লোক বলো তো? অমন লক্ষ্মী মেয়েকে এতো অবহেলা! মনিরাকে দূরে নিয়ে গিয়ে ওর স্বামীকে খুব করে জব্দ করবো। দেখবো তখন বৌ-এর কথা মনে পড়ে কি না!
*
এলোমেলো চুল, বিক্ষিপ্ত বসন, সমস্ত দেহ ঘেমে নেয়ে উঠেছে। আঁচলখানা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। দক্ষিণ হস্তে জ্বলন্ত মশাল, কক্ষে প্রবেশ করে লুসী। ঠিক যেন পাগলীর ন্যায় তাকে দেখাচ্ছে।
বনহুর এতো কষ্টেও জ্ঞান হারায় নি, সে ফিরে তাকাতেই বিস্মিত হলো লুসীর চেহারা দেখে।
লুসী বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালো, চাপা কণ্ঠে বললো–মিঃ আলম।
লুসী। অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো বনহুর।
লুসী হস্তস্থিত মশালের আগুনে বনহুরের বন্ধন অগ্নিদগ্ধ করে চললো। অল্পক্ষণে বনহুরের শরীরের মজবুত রশি খসে পড়লো।
বনহুর নিজেকে মুক্ত করে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো, নিজের ক্ষত-বিক্ষত দেহের দিকে না তাকিয়েই লুসীকে জাপটে ধরলো লুসী, তোমার এ অবস্থা কেন?
লুসী বাষ্পরুদ্ধ ব্যথাকরুণ কণ্ঠে বলে উঠলো আমার সব শেষ হয়ে গেছে মিঃ আলম– আমার সব শেষ হয়ে গেছে–
লুসী!
আপনাকে বাঁচাবার জন্য আমি নিজেকে বিসর্জন দিয়েছি।
লুসী, আমার জন্য কেন তুমি নিজের সর্বনাশ করলে? কেন, কেন তুমি নিজেকে এমন করে বিনষ্ট করলে লুসী!
আর নয় মিঃ আলম, আপনি এ মুহূর্তে পালিয়ে যান।
আর তুমি?
কি হবে আর আমার ফিরে যেয়ে। মিঃ আলম, আমি আর ফিরে যাবো না।
এ তুমি কি বলছো লুসী?
হাঁ, মৃত্যুই এখন আমার কামনা।
তা হয় না লুসী, মরতে আমি তোমাকে দেবো না।
এ নিকৃষ্ট অপবিত্র জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কি লাভ হবে! পারবো না এ দুর্বিসহ জীবন নিয়ে বাঁচতে। যান, যান আপনি–
কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না লুসী।
আপনার পায়ে পড়ি আপনি চলে যান, জানেন না ঐ শয়তানা মাহমুদ রিজভী কতবড় ভয়ঙ্কর!
লুসী, দস্যু বনহুর কোনো দিন ভয়ঙ্করকে ভয় করে না। এখন আমি মুক্ত দেখে নেবো মাহমুদ রিজভীর দেহে কত শক্তি। আর তার সেই নিগ্রোটারই কত বুদ্ধি-কৌশল। কৌশলে সে আমাকে ঐ রাতে কাবু করে ছিলো, আমি জানতাম না তার কালো দেহে লৌহ বর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত ছিলো। বনহুর লুসীর হাত মুঠায় চেপে ধরে লুসী তুমিও চলো আমার সঙ্গে?
এ পাপময় জীবন নিয়ে–
কেউ তোমাকে গ্রহণ না করুন, তুমি থাকবে আমার পাশে।
আমার বোন নেই, তোমাকে আমি বোনের আসনে প্রতিষ্ঠা করবো লুসী।
মশালের আলোতে বনহুর দেখলো লুসীর চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আবেগ ভরা গলায় বললো বনহুর দস্যুর বোন হতে আপত্তি নেই তো?
দাদা, আপনি দস্যু কিন্তু আমার প্রাণদাতা আপনি। লুসী বনহুরের পায়ে প্রণাম করলো।
বনহুর বললো–আর বিলম্ব নয় লুসী, চলো তাহলে।
চলুন। শয়তান মাহমুদ রিজভী এখন নেশায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার অনুচরগণ সবাই এখন ওদিকে শরাব পান নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে আছে। ব্রু এক ড্রাম নেশা ভক্ষণ করে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। চলুন, এ মুহূর্তে সরে পড়তে হবে।
বনহুর বললো–চলো বোন।
লুসী হাত থেকে মশালটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
বনহুর লুসীর হাত ধরে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। অন্ধকার কক্ষের লৌহদরজা পেরিয়ে বাইরে আসতেই বনহুর লক্ষ্য করলো কক্ষটা গভীর মাটির নীচে, কক্ষের মুখ একটা সুড়ঙ্গ পথের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে। আর একটা পথ সোজা চলে গেছে নিচের দিকে।
বনহুর কোন্ পথে অগ্রসর হবে ভাবছে।
লুসী বললো–দাদা, এই যে পথ দেখছেন এটা দিয়েই শয়তান মাহমুদ রিজভী আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। ওটা চলে গেছে রিজভীর আস্তানার দিকে। আর এ পথটা আমি জানিনা কোথায় গেছে।
জমাট অন্ধকার হলেও ঝাপসা আকারে সুড়ঙ্গ মুখগুলো দেখা যাচ্ছিলো। তাছাড়া বনহুরের চোখে অন্ধকার স্বচ্ছই লাগে, কারণ এসব তার অভ্যাস আছে।
বনহুর লুসীসহ দ্রুত দ্বিতীয় সুড়ঙ্গপথে অগ্রসর হলো।
চলেছে তো চলেছেই। সে পথের যেন শেষ নেই।
অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ। বনহুরের হাতের মুঠায় লুসীর হাত–পাশাপাশি এগুচ্ছে ওরা।
একবার বললো বনহুর–লুসী, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
না। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?
আমার কষ্ট সহ্য করার অভ্যাস আছে লুসী।
কিছুক্ষণ নীরবে উভয়ে এগুলো, বললো বনহুর-লুসী, আমি দস্যু বনহুর জেনেও তুমি আমার সঙ্গে আসতে সাহস করলে?
জানি আপনি ঐ সব লম্পট শয়তানদের চেয়ে অনেক ভাল। দাদা, আপনি দেবতা–মানুষ নন।
বোন, চিরদিন যেন তোমার এ বিশ্বাস অটুট থাকে।
লুসী হাঁপিয়ে পড়েছিলো, বললো–একটু জিরিয়ে নি।
ঠিক সে মুহূর্তে পিছনে শোনা যায় অনেকগুলো লোকের কণ্ঠস্বর, সমস্ত কণ্ঠ ভেদ করে আরও একটা শব্দ ভেসে আসে সুড়ঙ্গ পথে–হুম হুম হোঃ হোঃ–
বনহুর আর লুসী চমকে উঠে।
বনহুর বলে–নিগ্রো বোবাটাও জেগে উঠেছে লুসী। এবং তারা জানতে পেরেছে আমরা পালিয়েছি। আর একটু দেরী করা ঠিক নয়, দ্রুত পা চালাও লুসী।
চলুন দাদা, ওদের হাতে ধরা পরার চেয়ে মরণ ভাল।
বনহুর আর লুসী ছুটতে শুরু করলো।
পিছনে হই-হুল্লোড় আর হট্টগোল চলেছে। বোধ হয় দ্রুত ছুটে আসছে ওরা। বনহুর পিছনে তাকিয়ে বললো-লুসী, মশালের আলো দেখতে পাচ্ছো? ওরা মশাল নিয়ে আসছে।
এখন উপায়?
আরও জোরে ছোট লুসী আরও জোরে—
বনহুর লক্ষ্য করছে, লুসী বড় হাঁপিয়ে পড়েছে।
কিন্তু কোনো উপায় নেই–লুসীকে বাঁচাতেই হবে। নিজের জন্য ভাবে না বনহুর, লুসীর জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ক্রমেই জব্রুর হুঙ্কার আর লোকজনের চিৎকার নিকটে মনে হয়। মশালের আলোও অনেক বেশি মনে হচ্ছে। বনহুর আর লুসী অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে দ্রুত ছুটে চলেছে।
হঠাৎ সম্মুখে বাধা পায় বনহুর আর লুসী, দেখতে পায় পথ রুদ্ধ, একটা কপাট দিয়ে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
লুসী হাপাচ্ছে, এবার কেঁদে উঠে লুসী–দাদা এবার কি হবে?
বনহুর কোনো কথা বলে না বা বলবার সময় পায় না। প্রচণ্ড ধাক্কা দিতে শুরু করে সে কপাটে।
বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুর আঘাতে দুলে উঠে কপাটখানা। এবার সমস্ত শক্তি দিয়ে কপাটের কজা খুলে ফেলে মোচড় দিয়ে, তারপর কপাটখানা ঠেলে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে লুসীর হাত ধরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু মুহূর্তে চুক্ষ স্থির হয়ে যায় বনহুর আর লুসীর।
সুড়ঙ্গমুখেই এক খরস্রোতা নদী ভীমগর্জন করে ছুটে চলেছে। সেকি প্রচণ্ড প্রচণ্ড ঢেউ আছাড় খেয়ে পড়ছে–সুড়ঙ্গমুখের পাথর খণ্ডের গায়ে।
লুসী বনহুরকে চেপে ধরে দু’হাত দিয়ে।
বনহুর কি করবে উপায় খোঁজে।
সম্মুখে নদীর ভীষণ জলোচ্ছাস আর পিছনে ভয়ঙ্কর সেই নিগ্রো জব্ৰু। বনহুর বললো লুসী, মরতে চাও না রিজভীর কাছে ফিরে যেতে চাও? বলো এক মুহূর্ত বিলম্বের সময় আর নেই।
মরতে আমি প্রস্তুত আছি দাদা, তবু রিজভীর পাশে ফিরে যাবো না।
তবে এসো নদীবক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ি, এই হয়তো তোমার আমার শেষ দেখা লুসী—
দাদা!
বোন, তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।
বনহুর লুসীর হাত ধরে ভীষণ রূপধারী নদীবক্ষে লাফিয়ে পড়লো। লুসীর হাত সে কিছুতেই ছেড়ে দিলো না।
তরঙ্গবক্ষে ডুবছে আর উঠছে ওরা।
কিন্তু বেশিক্ষণ লুসীকে ধরে রাখতে পারলো না বনহুর। তার হাতের মুঠা থেকে লুসীর হাতখানা খসে গেলো প্রচণ্ড ঢেউ-এর আঘাতে।
বনহুর সাঁতার কেটে নিজেকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করে ডাকলো–লুসী–লুসী–লুসী।
কিন্তু কোথায় লুসী! কোনো সাড়া এলো না।
চারদিকে জমাট অন্ধকার আর মেঘের গর্জনের মত তরঙ্গায়িত নদীর হুঙ্কার।
বনহুর সাঁতার জানে ভালো, ছোট বেলায় নূরীর আর সে নদীর বুকে সাঁতার কাটতো। দু’জনে পাল্লা দিয়ে ভেসে যেতো দূরে অনেক দূরে।
আজ বনহুর ভয়ঙ্করী নদীবক্ষে সাঁতার কাটার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে পারলো না। ঢেউ-এর আঘাতে বার বার তলিয়ে যেতে লাগলো সে।
যতই শক্তিশালী হোক কতক্ষণ টিকতে পারে। উত্তাল তরঙ্গায়িত নদীবক্ষে বনহুর তলিয়ে গেলো ধীরে ধীরে।
*
ফুল কলসী কাঁখে নদী তীরে এসে দাঁড়ালো। রোজ সে নদী তীরে আসে পানি নিতে। প্রতিদিনের মত ফুল আজও অবসর সময়ে নদী থেকে পানি নিতে এসেছে।
আজ সে একা আসেনি, কেশব তার সঙ্গে এসেছে। সন্ন্যাসী বাবা বলেছেন ফুল যেন একা কোথাও না যায়। কারণ এদেশে তারা নতুন এসেছে। দিল্লী নগরীর নিকটবর্তী কোনো এক জঙ্গলে আস্তানা নিয়েছে তারা।
ফুলের জন্য সন্ন্যাসী বাবার অনেক চিন্তা। যুবতী সুন্দরী মেয়ে ফুল, একা গহন বনে বা নদীর কূলে যাওয়া তার জন্য মোটেই উচিৎ নয়, কেশবকে তাই তিনি বলে দিয়েছেন সব সময় ফুলের সঙ্গে থাকতে।
আজও তাই কেশব এসেছে ফুলের সঙ্গে।
ফুল এগিয়ে গেলো নদীর দিকে।
কেশব দাঁড়িয়ে রইলো অদূরে।
হঠাৎ ফুল চিৎকার করে উঠলো–কেশব ভাইয়া, দেখো ঐ যে বালির মধ্যে একটা লোক উবু হয়ে পড়ে আছে!
কেশব তাকালো, সত্যি একটা লোক অদূরে বালির মধ্যে উবু হয়ে পড়ে আছে। ছুটে গেল কেশব, ফুলও এগিয়ে গেলো ব্যস্ত হয়ে। কেশব লোকটার পাশে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়লো। বললো– কোনো নৌকা বা জাহাজডুবি লোক–আহা, বেচারা মরে গেছে!
লোকটা উবু হয়ে পড়ে থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। শুধু পিঠটা দেখা যাচ্ছিলো। জামা ছিঁড়ে গেছে, পিঠের কিছু অংশ বেরিয়ে পড়েছে, কিন্তু পিঠে ক্ষতের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।
বললো ফুল–আহা, লোকটাকে কেউ বা কারা চাবুক দিয়ে মেরেছে। দেখছো না কেশব ভাইয়া, ওর পিঠের চামড়াগুলো ছিঁড়ে কেটে উঠে গেছে।
হাঁ ঠিক বলেছো।
চলো যাই কেশব ভাইয়া?
যাবে, কিন্তু লোকটা?
মরে গেছে, কি আর হবে ওকে দেখে।
দাঁড়াও ফুল, দেখি লোকটা সত্যিই মরে গেছে না বেঁচে আছে। কেশব লোকটাকে চীৎ করে। শুইয়ে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে ফুল অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–হুর! তার হাতের কলসীটা পড়ে গেলো মাটিতে। ফুল লুটিয়ে পড়লো ওর বুকে হুর, তুমি–তুমি—
কেশব বিস্ময়ে হতবাক, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কে এ লোক, ফুল ওকে চিনলো কি করে!
নদীর ঢেউ-এর আঘাতে বনহুর তলিয়ে গেলেও প্রাণপণে সাঁতার কেটে ভেসে থাকার চেষ্টা করেছিলো। এবং যতদূর সম্ভব নিজেকে রক্ষা করার জন্য ঢেউ-এর বুকে দেহটা এলিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু কখন যে তার সংজ্ঞা লুপ্ত হয়েছিলো সে জানে না। হয়তো খোদার ইচ্ছা, তাই বালুচরে আটকা পড়ে গিয়েছিলো সে।
ফুল মুখে-মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে–হুঁর, আমার হুর, তুমি সত্যি মরে গেছো? কেমন করে তুমি এলে এখানে? কে তোমার এ অবস্থা করেছে! রোদন করতে লাগলো ফুল।
কেশব বললো–ফুল, ওকে তুমি চেনো?
আমার স্বামী!
তোমার স্বামী?
হাঁ। কেশব ভাইয়া, দেখোনা ও বেঁচে আছে কিনা?
কেশব তাড়াতাড়ি বনহুরের বুকে কান লাগিয়ে আনন্দসূচক শব্দ করে উঠে–ফুল, তোমার অদৃষ্ট ভাল। তোমার স্বামীর মৃত্যু হয়নি, সে জীবিত আছে। এই দেখো বুকের কাছে–
ফুল বনহুরের বুকে কান লাগিয়ে দেখে, সত্যি বুকের মধ্যে স্পন্দন হচ্ছে। ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ফুল–কেশব ভাইয়া, ওকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো। ওকে বাঁচাও তোমরা।
কেশব উঠে দাঁড়ায়–ফুল, তুমি ওর কাছে থাকো, আমি বাবাজীকে ডেকে আনছি। তিনি ঔষধ দিলেই বাঁচবে বলে মনে হয়।
যাও, যাও কেশব ভাইয়া, ওকে বাঁচাতেই হবে।
কেশব চলে যায়।
ফুল লুটিয়ে পড়ে বনহুরের সংজ্ঞাহীন বুকের উপর। আকুল হয়ে কাঁদে–বনহুর, তোমার এ অবস্থা কেন। হায়, কে তোমার এ অবস্থা করেছে। বুকে-মাথায়-ললাটে হাত বুলিয়ে চলে ফুল। মুখের ধুলাবালি হাত দিয়ে মুছে দেয়। চুলগুলো সরিয়ে দেয় ললাট থেকে। তারপর নিজেকে সে স্থির রাখতে পারে না, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় সে বনহুরের গণ্ড ঠোঁট আর ললাট।
অল্পক্ষণ পরে ফিরে আসে কেশব আর সন্ন্যাসী বাবাজী, ফুল সরে দাঁড়ায়।
কেশব বলে–বাবাজী, এই সেই লোক, দেখুন তো বাবাজী বাঁচবে কিনা?
সন্ন্যাসী বাবাজী বনহুরের অজ্ঞান দেহটার পাশে বালির মধ্যে বসে পড়লেন, তারপর বহুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে বললেন–অত্যন্ত ক্ষীণ আশা। বাঁচতে পারে, তবে আজ রাত্রি না কাটা পর্যন্ত কোনো ভরসা নেই।
ফুল লুটিয়ে পড়লো সন্ন্যাসী বাবাজীর পায়ে–বাবাজী, ওকে বাঁচান। ওকে বাঁচান বাবাজী। ও না বাঁচলে আমিও বাঁচবো না!
সব কেশবের মুখে শুনলাম মা। সব জানতে পেরেছি। তবে সবই সেই সর্বশক্তিমানের ইচ্ছা। কেশব, এসো ওকে কোন রকমে কুঠিরে নিয়ে যাই।
কেশব শক্তিমান যুবক।
বৃদ্ধ হলেও সন্ন্যাসী বাবাজী বলিষ্ঠ পুরুষ।
ফুলের দেহেও তো কিছু বল আছে।
সবাই মিলে বনহুরের সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে এলো কুঠিরে।
ফুল নিজের শয্যায় বনহুরকে শুইয়ে দিলো।
সন্ন্যাসী বাবাজীর চললো চিকিৎসা। গাছের পাতার রস আর কতরকম শিকড় থেতলে তার রস খাওয়াতে লাগলেন।
সমস্ত দিন চলে গেলো বনহুরের জ্ঞান ফিরলো না। পরপর নানা দুর্ঘটনায় তার পালস্ বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। সন্ধ্যা হলো, তারপর শুরু হলো রাত্রি।
ফুল অবিরত অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে। আর তালপাতার পাখায় বনহুরের মাথায় বাতাস করে যাচ্ছে। কেশব করছে সেবা আর ঔষধের পর ঔষধ জোগাচ্ছে সে।
সন্ন্যাসী বাবাজী নানাভাবে নানা ঔষধ খাওয়াচ্ছেন, আর দেহের ক্ষতে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছেন।
রাত্রি শেষ প্রহর–এবার হতাশ হয়ে পড়লেন সন্ন্যাসী বাবাজী।
ফুল সব সময় তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে। আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে সে সন্ন্যাসী বাবাজীর মুখে।
রাত্রি ভোর হয়ে এলো, সন্ন্যাসী বাবাজীর মুখ কালো হয়ে উঠলো, বললেন তিনি–মা, তোর অদৃশ্য মন্দ, ওকে বাঁচাতে পারলাম না।
ফুল আছাড় খেয়ে পড়লো মাটিতে, মাথা ঠুকে কাঁদতে লাগলো।
সন্ন্যাসী বাবাজীর চোখেও অশ্রু ঝরে পড়লো।
কেশব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে এমন ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে মোটেই অভিজ্ঞ নয়। লোকসমাজের অনেক কিছুই সে জানে না। শিশুকাল হতে সে সন্ন্যাসী বাবাজীর সঙ্গে গহন বনে বাস করে। নিজের সম্বন্ধেই কেশব জানে না কিছু। নারী-পুরুষ কি সম্বন্ধ তাও অভিজ্ঞতা ছিলো না ওর। ফুলকে দেখার পূর্বে কোনো নারীর সংস্পর্শে আসেনি সে কোনোদিন। তাই কেশব ফুলকে অবাক হয়ে দেখতো। ফুল সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন জাগতো তার মনে। কিন্তু ফুল তাকে কোনোদিন ধরা দেয়নি। ফুলের মধ্যে সে খুঁজে ফিরেছে তার অতৃপ্ত হৃদয়ের স্বাদ আহ্লাদ কিন্তু তা পূর্ণ হয়নি।
কেশব তাই অবাক হয়ে গেলো একটি পুরুষের জন্য একটি নারীর কত আকুতি। বনহুরের জন্য ফুল যখন ব্যাকুলভাবে রোদন করছিলো, তখন কেশব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো এ দৃশ্য।
হঠাৎ সন্ন্যাসী বাবাজী বলে উঠেন–মা ফুল, এক কাজ করতে চাই।
বলুন বাবাজী?
আমি শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই, ওকে বাঁচাতে পারি কিনা। রাত ভোর হয়ে এলো তার পূর্বেই আমাকে সে কাজ করতে হবে। ফুল, আমি ওকে একটা জীবন্ত বড়ি খাওয়াবো। ঐ বড়ি সেবন করলে ও বাঁচবে কিন্তু ছয় মাস কোনো নারী মুখ দর্শন করা চলবে না!
তাই করুন, চাই না আমি ওর সম্মুখে আসতে, তাই করুন দেব। তবু যদি ও বেঁচে থাকে, সেই হবে আমার জীবনের পরম সম্পদ।
বেশ তাই হোক। সন্ন্যাসী বাবাজী তার ঔষধের থলে হতে একটি স্বর্ণকৌটা বের করলেন, এবং তার ভিতর হতে একটি জমকালো বড়ি বের করে হাতের তালুতে রাখলেন। কেশবকে বললেন– তিনি সামান্য পানি দিতে।
কেশব পানি দিলো।
সন্ন্যাসী বাবাজী বড়িটা হাতের তালুতে আংগুল দিয়ে পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন, তারপর বনহুরের ঠোঁটের ফাঁকে ঢেলে দিলেন।
এবার তিন জোড়া চোখ অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে।
সন্ন্যাসী বাবাজী মন্ত্রপাঠ করছেন বিড়বিড় করে। আর মাঝে মাঝে ফুঁ দিচ্ছেন বনহুরের চোখেমুখে।
সেকি ব্যাকুল প্রতীক্ষা সকলের।
ভোর হয়ে আসছে।
গহন বনের কোনো অঞ্চলে বন্য মোরগ ডেকে উঠলো।
হঠাৎ কেশব আনন্দধ্বনি করে উঠলো– বাবাজী, দেখো দেখো ও বেঁচে উঠেছে। ও বেঁচে উঠেছে, নড়ছে।
সন্ন্যাসী বাবাজী আর ফুল তাকালো একসঙ্গে।
বনহুর মাথাটা একটু একটু করে গড়াচ্ছে।
ফুলের মুখমণ্ডল খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলো, আনন্দে আত্মহারা হলো সে। অস্ফুট কণ্ঠে ডাকলো –বনহুর–
সঙ্গে সঙ্গে সন্ন্যাসী বাবাজী বললেন –ফুল, আমার নিষেধ অমান্য করো না। তুমি বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
ফুল নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো, বিমর্ষ হলো তার আনন্দ উচ্ছল মুখমণ্ডলখানা। ধীরে ধীরে উঠে কুঠির ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলো বাইরে।
কেশব আর সন্ন্যাসী বাবাজী বসে রইলা বনহুরের শিয়রে।
ফুল কুঠিরের বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইলো বনহুরের কণ্ঠস্বর শুনবার জন্য মন তার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। নিজকে যেন কোনোমতে সামলাতে পারছে না সে।
কিছুক্ষণ পর কানে ভেসে এলো তার বহু কামনার, বহু সাধনার সেই অতি পরিচিত কণ্ঠের ব্যথা কাতর আওয়াজ–উঃ–উঃ-উঃ–
ফুলের মন ছটফট করে উঠলো, পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার জন্য আকুল হয়ে উঠলো তার প্রাণ। কিন্তু উপায় নেই, সন্ন্যাসী বাবাজীর আদেশ তাকে পালন করতেই হবে। দু’হাতে বুক চেপে দাঁড়িয়ে রইলো ফুল।
আবার শোনা গেলো–মা, মাগো–উঃ–উঃ–পানি পানি—
ফুল ছুটে পাশের কুঠির থেকে গেলাসে পানি ঢেলে নিয়ে এসে দরজায় দাঁড়ালো।
কেশব বেরিয়ে আসতেই তার হাতে দিলো, বললো–কেমন আছে ও?
অনেক ভাল। পানির গেলাস নিয়ে ভিতরে চলে গেলো কেশব।
সূর্যের আলোর সঙ্গে বনহুর চোখ মেলে তাকালো।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে পেলো সন্ন্যাসী বাবাজীকে। পাশেই ছিলো কেশব, তাকেও দেখলো বনহুর। কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বললো–আমি কোথায়?
সন্ন্যাসী বাবাজী বললেন–দিল্লীর অদূরে কোনো এক জঙ্গলে তুমি এখন আছো।
বনহুর নিশ্চুপ পড়ে রইলো।
সন্ন্যাসী বাবাজী কেশবকে ছাগলের দুধ গরম করে আনতে বললেন।
ফুল সব শুনছিলো বাইরে দাঁড়িয়ে, সে তাড়াতাড়ি ছাগলের বাট থেকে দুধ সংগ্রহ করে গরম করে দিলো।
গরম দুধ খাওয়ার পর বেশ কিছু সুস্থ বোধ করলো বনহুর। নতুন করে জীবন লাভ করলো, দেহের ব্যথা অনেক কমে গেছে বলে মনে করলো সে। বনহুর বিছানায় উঠে বসতে যাচ্ছিলো, বাধা দিলেন সন্ন্যাসী বাবাজী–অনেক কষ্টে, অনেক সাবধানে তোমাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি বৎস। আমার আদেশ–তুমি আমার অবাধ্য হবে না। তোমাকে তিন দিন তিন রাত্রি সম্পূর্ণ শয্যায় শয়ন করে থাকতে হবে।
বনহুর সন্ন্যাসীর দীপ্ত শুভ্র দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে নিপ পড়ে রইলো, পারলো না তার অবাধ্য হতে।
বনহুর চোখ বুজে স্মরণ করতে লাগলো তার পূর্বের ঘটনা। খোদা তাকে কিভাবে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। ভয়ঙ্করী নদীর বুক থেকে কেমন করে এলো সে এ জঙ্গলে। মনে পড়লো লুসীর কথা। বেচারী মেয়ে মানুষ সাঁতার তেমন জানতো না, তাছাড়া ভীষণ ঢেউ-এর বুকে কোথায় তলিয়ে গেছে। কে জানে। লুসীর ব্যথা করুণ মুখখানা বারবার ভাসতে লাগলো তার চোখের সম্মুখে। ওকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টাই সে করেছিলো, ওর জন্য সে অনেক করেছে, শেষ পর্যন্ত ওকে বাঁচাতে পারলো না সে। বনহুরের বুকে এজন্য অনেক বেদনা–লুসীকে সে রক্ষা করতে পারেনি। লুসী মরে ভালই হয়েছে– তার অভিশপ্ত জীবনের হয়েছে সলিল সমাধি। বনহুর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, কিন্তু তার গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে আসে দু’ফোঁটা পানি।
বনহুর কুঠিরের মধ্যে একা বিছানায় নিশ্চুপ পড়ে আছে সন্ন্যাসী বাবাজী তার আশ্রমের কাজে ব্যস্ত। কেশব গেছে ফল আহরণে বনের মধ্যে।
ফুল একা ছট ফট করে কুঠিরের বাইরে। গুরুদেবের নিষেধ–বনহুরের পাশে তার যাওয়া হবে না। আকুলি বিকুলি করে সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।
কুঠিরের মধ্য হতে ভেসে আসে বনহুরের কণ্ঠের আওয়াজ –উঃ উঃ মা, মাগো—
ফুলের চোখের পানি বাধা মানে না, পাষাণের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
চমকে উঠে ফুল–কে যেন তার কাঁধে হাত রাখে।
ফিরে তাকায় ফুল, দেখতে পায় সন্ন্যাসী বাবাজী হাস্য-উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বলেন তিনি ফুলকে লক্ষ্য করে–মা ধৈর্য ধরো, ওকে যদি বাঁচাতে চাও তবে নিজেকে শক্ত করে নাও। মনে রেখো, ছয় মাস তোমার বনহুরের নারীদর্শন নিষেধ আছে।
ফুল বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে–কিন্তু আমি যে ওকে না দেখে থাকতে পারছি না বাবাজী?
নিজেকে পাষাণ করে নাও ফুল–তুমি সন্ন্যাসী কন্যা।
বাবাজী!
ফুল, ওর যাতে অমঙ্গল না হয় সেজন্য তোমাকে কঠিন সাধনা করতে হবে।
আমি তাই করবো বাবাজী। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন, আমি যেন নিজেকে পাষাণ করে নিতে পারি।
যাও মা, আজ থেকে তুমি এ কুঠিরের আশে পাশে আসবে না। কারণ নিজেকে স্থির রাখতে পারবে না তুমি।
তাই হবে, আর আমি এখানে আসবো না বাবাজী।
ফুল চলে যায়। তখনও তার কানে ভেসে আসে অস্ফুট কণ্ঠ বনহুরের –মা, মাগো, উঃ–উঃ–
সন্ন্যাসী বাবাজী কক্ষে প্রবেশ করলেন, শান্ত-সৌম্য জ্যোতির্ময় দেবপুরুষ। শিয়রে এসে বসলেন বনহুরের, হাত রাখলেন তার মাথায়, ডাকলেন–বৎস?
বনহুর চোখ মেলে তাকালো, সন্ন্যাসী বাবাজীর মুখে নজর পড়তেই বললো–বাবা!
এখন কেমন বোধ করছো?
ভাল নয়।
খুব কি অসুস্থ বোধ করছো?
না, কিন্তু মন বড় অস্থির হয়ে পড়েছে। আমাকে উঠবার আদেশ দিন বাবা?
আর একটা দিন তোমাকে এভাবে শুয়ে থাকতে হবে।
বনহুর হতাশভাবে চোখ বন্ধ করলো।
সন্ন্যাসী বাবাজী উঠে গেলেন তখনকার মত।
তিন দিন পর বনহুর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলো। আবার তার দেহে পূর্বের সেই অসামান্য শক্তি ফিরে এলো। সন্ন্যাসী বাবাজীর স্নেহে আর কেশবের গভীর ভালবাসায় বনহুর মুগ্ধ হলো। ফলমূল আর নিরামিষ ভক্ষণ করতে লাগলো বনহুর সন্ন্যাসী বাবাজী আর কেশবের সঙ্গে।
*
বনহুর সুস্থ হয়ে উঠার পর একদিন সন্ন্যাসী বাবাজীর নিকটে এসে বললো–বাবাজী?
সন্ন্যাসী বাবাজী একটি হরিণ-শিশুকে আদর করছিলেন, বললেন তিনি–বলো বৎস?
এখন তো আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি, এবার আমাকে বিদায় দিন।
আমি জানতাম তুমি এ কথাই আমাকে বলবে, কিন্তু তোমাকে যখন আমি কুড়িয়ে পেয়েছি তখন তুমি আমার সন্তানসম। তোমার ভাল-মন্দ এখন আমার। কাজেই তোমাকে এখানে ছ’মাস থাকতে হবে। তারপর যেখানে খুসি চলে যেও, আমি বাধা দেবো না।
সন্ন্যাসী বাবাজীর কথায় আঁতকে উঠে যেন বনহুর। তার মত উচ্ছল জনের একস্থানে স্থির হয়ে থাকা একেবারে অসম্ভব। এ কদিনেই বনহুর হাঁপিয়ে পড়েছে যেন। এরপরও ছ’মাস তাকে এ বনে নির্জীবের মত কাটাতে হবে–না না, পারবে না সে এক যায়গায় স্থির হয়ে থাকতে। বললো বনহুর আমাকে আপনি গভীর স্নেহ করেন জানি। কিন্তু আমার পক্ষে ছ’মাস এখানে থাকা সম্ভব নয় বাবাজী।
সবই সম্ভব বৎস, এ দুনিয়ায় কিছুই অসম্ভব নয়। অসম্ভবকে সম্ভব করাই হলো সাধকের সাধনা। আমার সঙ্গে তোমাকে তপস্যা করতে হবে ছ’মাস।
তপস্যা?
হ বৎস। কি তপস্যা, কেন করতে হবে–এ প্রশ্ন তুমি আমাকে করবে না কোনোদিন।
বাবা!
যদি মঙ্গল চাও আমার কথা মত কাজ করো।
কিন্তু–
জানি, যে রত্ন তুমি হারিয়েছে এই ছ’মাস কঠোর সাধনা করে তুমি তা লাভ করতে সক্ষম হবে।
আমার জীবন সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না বাবা, তাই আপনি আমাকে এসব কথা বলছেন। আমার জীবন অত্যন্ত অস্বাভাবিক।
আমার জীবনের চেয়ে তোমার জীবন অস্বাভাবিক নয় বৎস। আমি একদিন তোমাকে আমার জীবন-কাহিনী বলবো, দেখবে আমার মত অদ্ভুত জীবন কারো নেই।
বাবা!
জানি তুমি কে, কোথায় তোমার বাড়ি, কি তোমার আসল পরিচয় সব আমি জানি বৎস। দস্যু হলেও তুমি মহান, তোমার আত্মা অতি পবিত্র–
বনহুরের চোখে রাজ্যের বিস্ময় জেগে উঠে–এ সন্ন্যাসী কি করে জানলো তার আসল পরিচয়! কি করে জানলো দস্যু হলেও মহান সে, তার আত্মা অতি পবিত্র!
সন্ন্যাসী বাবাজী সব শুনেছিলেন ফুলের কাছে। বনহুরের সব কথা সে নিঃসন্দেহে খুলে বলেছে। সন্ন্যাসী বাবাজীর নিকটে। কোনো কথাই সে লুকোয়নি–লুকোতে পারেনি।
বনহুরকে বিস্মিত হতে দেখে বললেন সন্ন্যাসী বাবাজী–শক্তিমান বীরপুরুষ তুমি। তোমার বীরত্বের কাহিনী আমি জানি, আরও জানি তুমি অসহায়ের বন্ধু। বৎস, তাইতো তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার আমার এতো প্রচেষ্টা!
বনহুর অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–বাবা!
বস, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি–তুমি ছ’মাসের মধ্যে কোথাও যাবে না।
বনহুর নিশ্চুপ; মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর আদেশ যেন তার সমস্ত ধমনীকে শিথিল করে দেয়। একটি কথা সে প্রতিবাদ করতে সাহসী হয় না।
খুশি হন সন্ন্যাসী বাবাজী।
ববহুরকে সন্ন্যাসী বাবাজী তাদের গেরুয়া বসন পরতে দেন। খালি গা, একটা গেরুয়া কাপড় কাঁধের পাশ দিয়ে জড়ানো।
মাথায় একটি কাপড় পাগড়ির মত করে বাঁধে সে।
এ ড্রেসে বনহুরকে অদ্ভুত মানায়।
সন্ন্যাসী বাবাজী অস্ফুট কণ্ঠে বললেন–অপূর্ব! জয়শ্রী জয়শ্রী মা দয়াময়ী–যাও বস, কেশবের সঙ্গে যাও।
বনহুর চলে গেলো কেশবের সঙ্গে।
ফুল এতোক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে দেখছিলো।
বনহুর চলে যেতেই বেরিয়ে আসে আড়াল থেকে, চোখ তার অশ্রুসিক্ত।
সন্ন্যাসী বাবাজী বলেন–ফুল, মা তোমার চোখে জল! কেন মা এতো বেদনা তোমার?
ফুল বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে–বাবাজী!
জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে–কিন্তু কি করব মা, যতদিন না সময় পূর্ণ হয়েছে ততদিন তোকে এভাবে সাধনা করতে হবে। জয়ী হলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে মা।
*
দিন যায় রাত আসে, রাত যায় দিন হয়।
ফুল সব সময় বনহুরের দৃষ্টির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। ফুল নিজের হাতে রান্না করে, সন্ন্যাসী বাবাজীকে খাওয়ায়, তারপর সাজিয়ে রাখে বনহুর আর কেশবের জন্য। সব শেষে নিজে খায়। পূর্বের সে চঞ্চলতা আর নেই ফুলের। ধীর-স্থির শান্ত বন-দুহিতার মত নিশ্চঞ্চল হয়ে পড়েছে সে।
কেশব আর বনহুর ফিরে আসার পূর্বেই কুঠিরের সব কাজ সমাধা করে আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ফুল। সন্ন্যাসী বাবাজী মানা করে দিয়েছেন বনহুরকে কোনো সময় ভুল করেও যেন সে দক্ষিণ দিকের কুঠিরে প্রবেশ না করে।
বনহুর জীবনরক্ষাকারীর আদেশ অমান্য করতে চায় না। মনে নানা প্রশ্নের উদয় হলেও সে নিজেকে কঠিনভাবে সংযত করে রাখে।
বনহুর ফুলের অস্তিত্ব টের না পেলেও ফুল কুঠিরের বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখে দেখে বনহুরকে। দেখে প্রাণ ভরে–কত দিন ওকে দেখেনি সে।
বনহুরের সেই হাসি, সেই কথার সুন্দর ভঙ্গী, সেই অপূর্ব মনোমুগ্ধকর আঁখি দুটি ফুল অপলক চোখে দেখে। ছুটে এসে ওর প্রশস্ত বুকে মাথা রাখতে ইচ্ছা করে–কিন্তু উপায় নেই। কার যেন কঠিন আদেশে মনকে স্থির করে নেয় ফুল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে।
কেশব বনহুরের সঙ্গী-সাথী-বন্ধু–গহন বনে নিসঙ্গ অবস্থায় কেশব ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। কেশব অবশ্য বনহুরের চেয়ে বয়সে কিছু ছোটই হবে। তবু বনহুর আর কেশবের মধ্যে অত্যন্ত মিল।
বনহুর শুয়ে থাকে, কেশব বসে থাকে তার পাশে।
বনহুর বলে –কেশব!
বলো বন্ধু! কেশব বনহুরকে বন্ধু বলে ডাকে।
বনহুর বলে–কেশব, কেমন করে আমাকে পেয়েছিলে ভাই?
নদীতীরে জল আনতে গিয়ে।
কই, তুমি তো কোনোদিন নদী থেকে জল আনো না?
তখন আনতাম।
তুমিই তাহলে আমাকে দেখেছিলে?
না–হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি –আমিই তোমাকে দেখেছিলাম। কিন্তু বাবাজী না হলে তোমাকে আমরা কেউ বাঁচাতে পারতাম না।
আচ্ছা কেশব?
বলো?
এ বনে কি শুধু তোমরা দু’জনাই বাস করো?
এ প্রশ্ন কেন বলো তো?
না এমনি করলাম।
আর একদিন।
নদীতীরে এসে দাঁড়ায় বনহুর আর কেশব। শুকনো কাঠ সংগ্রহ করছিলো ওরা দু’জনা। হঠাৎ কেশব বলে উঠে–বন্ধু, দেখ ঐ খানে তোমাকে ফুল প্রথম দেখেছিলো– না না, ফুল নয় আমি– আমি তোমায় প্রথম দেখেছিলাম।
ফুল!
কেশব কথাটার মোড় ঘোরালেও বনহুর ধরে ফেলেছিলো। বললো ফুল কে কেশব?
বললাম তো আমার আর এক নাম ফুল।
ওঃ তাই বলো।
চলো বন্ধু কাঠ সংগ্রহ হয়ে গেছে চলো।
বনহুর ছোট্ট কাঠের বোঝাটা কেশবের মাথায় তুলে দিয়ে নিজের মাথায় মস্ত বড় বোঝাটা উঠিয়ে নেয়। দস্যু সর্দার বনহুর আজ বনে বনে কাঠ সংগ্রহ করে ফেরে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ফুল আর হাসে।
বনহুর যখন খেতে বসে অবাক হয়ে ভাবে, তাদের খাবারগুলো রোজ এত সুন্দর করে কে পাক করে! সন্ন্যাসী বাবাজীতে সর্বক্ষণ তার জপ তপ আর সাধনা নিয়ে থাকেন। কেশব তো তারই সঙ্গে কিন্তু এতো সব রান্না করে কে?
বনহুর বলে খেতে খেতে কেশব, কে এমন সুন্দর করে আমাদের জন্য রোজ রান্না করে, খাবারগুলো পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখে ভাই?
কেন ফুল–না না, সন্ন্যাসী বাবাজী নিজেই তো রোজ রান্না করেন। তুমি জানো না বন্ধু, বাবাজী কত সুন্দর পাকান!
কেশব বললেও বনহুরের যেন বিশ্বাস হয় না তার কথা। ফুল–কে সেই ফুল! কার নাম ফুল, তবে কি কেশবের আর এক নাম ফুল। হয়তো হবে সন্ন্যাসীদের বাবার নাম!
বনহুর খেয়ে-দেয়ে শোয়।
বনহুরের জন্য পূর্বদিকের কুঠিরখানা ছেড়ে দিয়েছে কেশব। ওটা আগে কেশবের কুঠির ছিলো। এখন সন্ন্যাসী বাবাজী আর কেশব শোয় পশ্চিমের কুঠিরে! পাশাপাশি তিনখানা কুঠির ছিলো সন্ন্যাস বাবাজীর। তালপাতার আর খেজুর পাতার ছাউনি করা এসব কুঠির সন্ন্যাসী বাবাজী আর কেশব নিজের হাতে তৈরি করেছে।
ফুলের জন্য আলাদা কুঠির।
সন্ন্যাসী বাবাজী রাতের বেলা ঘুমান না, তিনি গহন বনের মধ্যে অশ্বথ বৃক্ষতলে অগ্নিকুরে সম্মুখে বসে যোগ সাধনা করেন। কাজেই তার কুঠিরের এমন কোনো প্রয়োজন হয় না।
বনহুর নিজের কুঠিরে শয়ন করে।
খেজুর পাতার চাটাই এর উপর বালিশবিহীন তাকে শুতে হয়। শুধু তাকেই নয় সন্ন্যাসী বাবাজীর এখানে সকলের জন্য একই ব্যবস্থা।
ফুল নিজের জন্য ভাবে না, ভাবে না সন্ন্যাসী বাবাজী বা কেশবের জন্য, কারণ এদের অভ্যাস আছে এ সবে। ফুল ভাবে বনহুরের কথা। না জানি বালিশবিহীন শয়ন করতে ওর কত কষ্ট হচ্ছে।
বনহুর দস্যু ছোটবেলা হতেই সে মানুষ হয়েছে কঠিনভাবে। নানারকম কষ্ট সহ্য করাই হলো তার রীতি। বালিশবিহীন কেন, কতদিন সে শুধু পাথরের উপরে শুয়ে নিদ্রা গেছে। কত বন-জঙ্গলে কেটেছে তার রাত। তবু ফুল ওর জন্য ভাবে কত কথা।
*
একদিন বনহুর নিদ্রা গেছে তার কুঠিরের মেঝেতে।
হাতের উপর মাথা রেখে শয়ন করেছে সে। এখানে আসার পর বনহুর অনেকটা নিশ্চিন্ত ঘুমাতে পারে। তাকে রাত জেগে গোয়েন্দাগিরি করতে হয় না। দুষ্ট দমনে সজাগ হয়ে থাকতে হয় না। লুসীকে উদ্ধারের জন্য নেই আর তার দুশ্চিন্তা। লুসী তার বিদগ্ধ জীবন নিয়ে সলিল সমাধির বুকে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েছে। বনহুর এখন নিশ্চিন্ত। প্রাণভরে ঘুমায় সে আজকাল।
প্রতিদিনের মত আজও বনহুর ঘুমিয়ে আছে তার খেজুর পাতার চাটাই-এর উপর। হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে সে।
সন্তর্পণে কুঠিরের দরজা খুলে প্রবেশ করলো ফুল।
ওদিকে মাটির প্রদীপটা নিভু নিভু ভাবে জ্বলছে।
প্রদীপের ক্ষীণালোকে ফুল তাকালো কক্ষমধ্যে। অদূরে মেঝেতে খেজুর পাতার চাটাই-এর উপর নিদ্রিত বনহুর।
ফুল লঘু পদক্ষেপে বনহুরের শিয়রে এসে বসলো। নির্নিমেষ নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে। ফুল অতি কষ্টে নিজেকে সংযত রাখলো। মনে পড়লো সন্ন্যাসী বাবাজীর সাবধান বাণীর কথা। যেমন এসেছিলো ফুল তেমনি ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো সে।
এমনি আরও কতদিন ফুল এলো বনহুরের কুঠিরে।
বনহুর ঘুমাতো, ফুল অপলক নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রাণভরে দেখতো।
একদিন ফুল বনহুরের মাথায় হাত রাখলো আস্তে করে। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
অমনি বনহুর জেগে উঠলো–কে?
সঙ্গে সঙ্গে ফুল ছুটে পালিয়ে গেলো কুঠিরের মধ্য হতে।
অবাক বিস্ময়ে বনহুর তাকিয়ে আছে দরজার দিকে–ছায়ার মত অস্পষ্ট একটা নারীমূর্তি যেন সে দেখতে পেলো। বনহুর ভাবে, আরও কতদিন অন্ধকারে সে যেন তার কুঠিরে কারো অস্তিত্ব অনুভব করেছে। তার শিয়রে কারো দীর্ঘশ্বাস উপলব্ধি করেছে কে কে তবে সে? কোনো অশরীরী আত্মা? লুসীর আত্মা কি তবে তার পিছু নিয়েছে? হয়তো তাই হবে, কিংবা তার মনের খেয়াল। নইলে সন্ন্যাসীর আশ্রমে নারীমূর্তি আসবে কোথা হতে। বনহুর চাদর গায়ে দিয়ে ভাল হয়ে শোয়। মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করে সব চিন্তা। কিন্তু কি করে সে বিস্মৃত হবে, এ যে স্বপ্ন নয়–সত্য। এখনও তার মাথায় কারো যেন কোমল হস্তের স্পর্শ লেগে রয়েছে। এখনও তার কানে একটা নিশ্বাসের শব্দ যেন ভেসে আসছে।
তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে বনহুর।
এমনি করে কতদিন ফুল লুকিয়ে থাকবে, অসহ্য যন্ত্রণার ছট ফট করে সে। বনহুরকে দূর থেকে যত দেখে ততই যেন অস্থির বোধ হয় তার মনে। কেঁদে কেঁদে ফুলের চোখ দুটো ফুলে গেছে, লাল হয়ে উঠেছে–তবু সে সহ্য করে থাকে।
সন্ন্যাসী বাবাজী সব বোঝেন, নীরবে তিনি সান্ত্বনা দেন। বলেন–এই তো আর কটা মাস, তাহলেই তোমাদের মিলন শুভ হবে মা, শুভ হবে। আমাদের সন্ন্যাসী ধর্মের রীতি অনুযায়ী তোমাকে মানতেই হবে আমার আদেশ।
মাথা নত করে ফুল মেনে নেয় সন্ন্যাসী বাবাজীর কথা।
কিন্তু বনহুর বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে, তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে আজকাল। কার যেন অস্তিত্ব তাকে আকর্ষণ করে। কার নিশ্বাসের শব্দ যেন তার চারপাশে শুনতে পায়। কার যেন পদধ্বনি বাজে তার কানে। কার এক অস্পশীয় ম্লান ছায়া যেন ভাসে তার চোখের সামনে।
বনহুর আর কেশব একদিন বসে ফল সংগ্রহ করছিলো! এক সময় তারা বিশ্রামের আশায় একটি বৃক্ষতলে এসে বসে ফুল ভক্ষণ করছিলো।
বনহুর বৃক্ষটায় ঠেশ দিয়ে একটা ফল হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো দৃষ্টি তার উদাস–কি যেন গভীরভাবে চিন্তা করছে সে।
বললো কেশব–খেয়ে নাও।
কেশবের কথা কানে না নিয়ে বললো বনহুর-কেশব!
বলো?
একটা কথা সত্যি করে বলবে?
একটা কেন, যা জিজ্ঞাসা করবে সব বলবো।
আচ্ছা কেশব, তোমাদের আস্তানায় কি কোনো অশরীরী আত্মা আছে?
অশরীরী আত্মা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো কেশব।
হাঁ, আমি দেখেছি একটা শুভ্রবসনা নারীমূর্তি।
আমাদের আশ্রমে নারীমূর্তি, বলো কি বাবু?
কেশব বনহুরকে মাঝে মাঝে বাবু বলে ডাকতো।
বললো বনহুর–কেশব, আমি যখন ঘুমাই তখন আমার শিয়রে যেন কেউ বসে থাকে। অন্ধকারে কেউ যেন আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। আমি স্পষ্ট অনুভব করি কারো শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।
কেশব বলো–কে সে? কে সে শুভ্র বসনা নারীমূর্তি।
কেশবের চোখেমুখে বিষ্ময় জাগে, ভাবে তবে কি ফুল সন্ন্যাসীর আদেশ অমান্য করে বাবুর কুঠিরে যায়! তবে কি ফুল অন্ধকারে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়! নিশ্চয়ই সে যায়।
কি ভাবছো কেশব?
কিছু না। হ্যাঁ, ভাবছি কে সে শুভ্র বসনা নারীমূর্তি। যে প্রতিদিন তোমার কুঠিরে প্রবেশ করে।
কেশব, আমি ভাবি আজ জেগে থাকবো, দেখবো সে কে। কিন্তু পারি না, কেন যেন নিজেকে কিছুতেই জাগিয়ে রাখতে পারি না। কেমন যেন সংজ্ঞাহারার মত হয়ে পড়ি আমি রাত্রিবেলায়।
কেশবের চোখদুটো ছানাবড়া হয়, কোনো কথা বের হয় না তার মুখ দিয়ে। হাতের অর্ধ-খাওয়া ফলটা তেমনি রয়ে যায় কেশবের হাতে।
বনহুর বলে–আমি সন্ন্যাসী বাবাজীকে জিজ্ঞাসা করবো একথা।
অমনি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় কেশব না না, ওকথা সন্ন্যাসী বাবাজীকে বলবে না। তাকে বললে মন্দ হবে।
তবে কি আমি—
আমি নিজে সন্ধান নেবো আমাদের আশ্রমে কোনো অশরীরী আত্মার আবির্ভাব ঘটেছে কিনা।
বনহুর বলে উঠে কেশব, আমার মনে হয় শুভ্র বসনা নারীমূর্তি অশরীরী আত্মা।
কেমন করে জানলে বাবু?
আমি জানি, ও আত্মা কার।
কার বাবু?
জানো কেশব, একটা মেয়েকে বাঁচবার জন্যই আমি নদীগর্ভে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারিনি। নদী বক্ষের প্রচণ্ড তরঙ্গ তাকে আমার কাছ হতে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গিয়েছিলো, কোথায় তলিয়ে গিয়েছিলো সে কে জানে। নিশ্চয়ই তার মৃত্যু ঘটেছে। আমার মনে হয়, সেই অসহায় নারীর আত্মাই রাত্রির অন্ধকারে আমার চারপাশে বিচরণ করে ফেরে!
কেশব ঢোক গিলে বললো হয়তো তাই হবে।
*
সন্ধ্যার অন্ধকারে পা টিপে টিপে কেশব প্রবেশ করলো রান্নার চালা ঘরটায়। এক পাশে মাটির প্রদীপ জ্বলছে। ফুল রান্না শেষ করে সকলের জন্য থালায় খাবার সাজিয়ে রাখছিলো।
পিছনে এসে দাঁড়ালো কেশব।
ফুলের চুলগুলো পিঠে এলিয়ে পড়েছে। সাদা ধপধপে শাড়ি তার দেহে। ললাটে চন্দনের ফোঁটা। হাতে-গলায় ফুলের মালা জড়ানো।
প্রত্যেকটা থালায় সুন্দর করে খাবার সাজাচ্ছিলো ফুল।
সন্ন্যাসী বাবাজীর থালাটা ভিন্ন।
বনহুরের থালা ভিন্ন।
কেশব আর ফুলেরও তেমনি ভিন্ন ভিন্ন থালায় খাবার সাজিয়ে রাখছিলো! প্রতিদিন এমনি করেই খাবার সাজিয়ে রাখে সে।
দৈনন্দিনের মত আজও রাখছিলো।
বনহুর এখনও ফিরে আসেনি, সন্ন্যাসী বাবাজীর সঙ্গে সে গেছে নদীতীরে।
ফুল এই অবসরে খাবার গুছিয়ে রেখে সরে পড়বে।
কেশব দেখলো, ফুল খাবার সাজিয়ে একটা ছোট্ট মাটির বাটি থেকে কিছু তরল সবুজ পদার্থ ঢেলে দিলো বাবুর খাবারের থালায়।
সঙ্গে সঙ্গে কেশব চেপে ধরলো ফুলের হাত।
চমকে উঠলো ফুল।
কেশব বললো–একি করছো ফুল? বাবুর খাবারে তুমি একি মেশাচ্ছো?
ফুল নিশ্চুপ হয়ে পড়ে।
কেশব ফুলের হাত থেকে মাটির বাটিটা হাতে নেয়। লক্ষ্য করেই বলে উঠে ফুল, তোমার উদ্দেশ্য আমি জানতে পেরেছি। তুমি চুরি করে সন্ন্যাসী বাবাজীর নেশার ঔষধ বাবুর খাবারে মেশাচ্ছো?
অস্ফুট শব্দ করে ফুল–কেশব ভাই!
এ তুমি কি করছো ফুল?
আমাকে তুমি তিরস্কার করো!
ফুল, আমি সব শুনেছি বাবুর মুখে। তুমি তার খাবারে নেশার ঔষধ মিশিয়ে তাকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলো। তারপর তার পাশে যাও। জানো এর পরিণতি কি হবে?
কেশব ভাই, আমি যে ওর পাশে না গিয়ে পারি না। আমার মন যে অস্থির হয়ে পড়ে।
তাই তুমি ওর খাবারে—
হাঁ, সত্যি আমি তার খাবারে রোজ বাবাজীর—
বুঝেছি। কিন্তু যদি জানতে পারেন সন্ন্যাসী বাবাজী তখন কি হবে!
ওর কাছে না গেলে আমি বাঁচবো না কেশব ভাই। এতো কাছে থেকেও ওর পাশে যেতে পারবো না?
তা হবে না। যা করেছে এতোদিন তাই গোপন রাখতে চেষ্টা করো। নইলে আমি সন্ন্যাসী বাবাজীকে বলে দেবো।
তোমার পায়ে পড়ি কেশব ভাই। আমার দুঃখ তুমি বোঝ, জানো আমি কত বড় হতভাগী! আমাকে তুমি বাঁচাও–
এমন সময় দূরে শোনা যায় সন্ন্যাসী বাবাজী আর বনহুরের গলার আওয়াজ।
ফুল চলে যায় নিজের ঘরে।
কেশব বেরিয়ে আসে বাইরে।
*
একদিন কাঠ সংগ্রহে গিয়েছিলো বনহুর একা।
কেশব সেদিন আশ্রমের কোনো কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলো। সন্ন্যাসী বাবাজীও গিয়েছিলেন আশ্রমের বাইরে।
বনহুর শরীর অসুস্থ বোধ করায় আজ সকাল সকাল ফিরে এলো কুঠিরে।
ফুল তখন উঠানে ওদিক মুখ করে মালা গাঁথছিলো।
বনহুর উঠানে পা দিতেই ফুল চমকে উঠে ফিরে না তাকিয়েই ছুটে পালিয়ে যায় কুঠিরের মধ্যে।
বনহুর কাঠের বোঝাটা কাঁধ থেকে ফেলে দিয়ে অবাক হয়ে তাকালো।
ফুল কুঠিরে প্রবেশ করে দরজা খিল বন্ধ করে দিলো।
বনহুর ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো দরজার সামনে, মৃদু ধাক্কা দিলো।
কিন্তু ফুল দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
পর পর আঘাত করতে লাগলো বনহুর দরজায়। ওদিকে ফুল বিপদে পড়লো। সে দ্রুত খিড়কি জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো, যেখানে কেশব কাজ করছিলো। বললো ফুল–কেশব ভাই, সব ফাঁস হয়ে গেছে, আমাকে সে দেখে ফেলেছে–হঠাৎ অসময়ে এসে গেছে হুর।
তা আমি এখন কি করবো?
শোন,আমি যা বলি তাই করো, আমাকে এ বিপদ থেকে বাঁচাও কেশব ভাই। এই নাও আমার কাপড় এনেছি, এটা পরে মেয়েমানুষ সেজে নাও।
তারপর?
তারপর আমার কুঠিরের খিড়কি জানালা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দরজা খুলে দেবে।
কেশব বিস্ময়ে হতবাক হয়, বলে সে–এসব কি বলছো ফুল, আমি সাজবো মেয়েমানুষ?
কেশব ভাই, এ ছাড়া উপায় নেই। আমার বনহুর দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাকুল আগ্রহে সে বারবার দরজায় আঘাত করছে। যাও, যাও কেশব ভাই, তুমি তার মনের সন্দেহ দূর করো, সে যেন বুঝতে না পারে–এ আশ্রমে কোনো নারী আছে।
বেশ যাচ্ছি।
যাও কেশব ভাই।
কেশব চলে যায়।
দরজায় দাঁড়িয়ে বনহুর ডাকে–দরজা খোল, কে তুমি–আমি দেখতে চাই। দরজা খোল।
দরজা খুলে গেলো।
কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর। দেখলো সে, একপাশে জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি নারীমূর্তি।
বনহুর বললো কে তুমি?
তবু নিরুত্তর।
বনহুরের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো, সে খপ করে ধরে ফেললো, তারপর মাথার কাপড় সরিয়ে ফেলতেই বিষ্ময়ে অস্কুট ধ্বনি করে উঠলো–কেশব!
হেসে উঠলো কেশব, বললো–মা করো বাবু।
একি তামাসা?
বাবু।
তুমিই তা হলে এতোদিন আমাকে ধোকা দিয়ে এসেছো কেশব?
হ।
তোমার উদ্দেশ্য কি?
আমার সখ।
বনহুর বেরিয়ে গেলো কুঠিরের মধ্য হতে।
*
অত্যন্ত সাবধানে নিজেকে বনহুরের অগোচরে লুকিয়ে রাখলো ফুল। যতক্ষণ বনহুর উঠানে থাকতো ততক্ষণ ফুল তার কুঠিরের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো। বনহুর বেরিয়ে গেলে তবে বের হতো সে।
চঞ্চলা ফুল কত কষ্ট করে যে নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলো, সেই জানে। বনহুর চলে যেতো, ফুল তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করতো।
হয়তো কোনোদিন পিছন থেকে সন্ন্যাসী বাবাজী এসে কাঁধে হাত রাখতেন।
চমকে উঠতো ফুল। তাড়াতাড়ি আঁচলে অশ্রু মুছে ফেলতো।
সন্ন্যাসী বাবাজী বলতেন–পাগলী মেয়ে, ছিঃ কাঁদতে আছে! এই তো তোর সাধনা শেষ হয়ে এলো বলে।
ফুল নিশ্চুপ হয়ে শুনতো।
এমনি করে একদিন শেষ হলো ফুলের সংযম সাধনা।
ছ’মাস পূর্ণ হলো।
কেশব একরাশ বন্য ফুল নিয়ে হাজির।
বনহুর বললো –এসব কি হবে?
বলল কেশব–আজ যে নবরাত্রি।
নবরাত্রি মানে? প্রশ্ন করলো বনহুর।
মানে নতুন রাত, বলে হাসে কেশব।
কেশব বনহুরের কুঠিরখানা আজ ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিলো। বাঁশের খুঁটিগুলোতে জড়িয়ে দিলো ফুলের মালা। ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দিলো রাশিকৃত ফুল। নতুন খেজুর পাতার চাটাইখানায় ফুল দিয়ে শয্যা তৈরি করলো।
হাসে বনহুর, বলে সে–এসব কি পাগলামি হচ্ছে তোমার কেশব?
আজ তোমার সাধনা শেষ হয়েছে বাবু।
কই, আমি তো কোনো সাধনা করিনি?
কে বললো তুমি সাধনা করোনি। যেদিন তুমি জ্ঞান লাভ করেছে বাবু সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে। তোমার যোগ সাধনা। আজ তুমি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে।
কেশব!
হা বাবু।
সন্ধ্যা হয়ে আসে।
আজ ফুলের মনে সেকি চঞ্চলতা, কিসের যেন এক উন্মাদনায় ফুল আত্মহারা! যেমন তার আনন্দ, তেমনি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর সংকোচ তাকে কুঁকড়ে ফেলেছে। লজ্জায় সে আজ সন্ন্যাসী বাবাজীর সম্মুখে আসতে পারেনি।
কেশবকে দেখে কুঠিরে প্রবেশ করেছে, তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনি ফুল।
রাত বেড়ে আসছে।
সন্ন্যাসী বাবাজী চলে যান তাঁর যোগ সাধনা স্থানে। যাবার সময় বলে যান–মা ফুল, তুমি তোমার স্বামী-সেবায় আত্মনিয়োগ করবে।
সন্ন্যাসী বাবাজী চলে যান।
ফুল আরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। সমস্ত শরীরে, শিরায় শিরায় তার এক অভূতপূর্ব শিহরণ জাগে। কিসের যেন এক অনুভূতি তার বুকের মধ্যে টিপ টিপ করতে থাকে।
বনহুর কুঠিরে প্রবেশ করে।
পিছনে কেশব।
ধূপ আর চন্দনের গন্ধে কুঠিরখানা মোহিত হয়ে আছে। ওপাশে মাটির প্রদীপে ঘি-এর বাতি জ্বলছে। ফুলে ফুলে সমস্ত কুঠির ছেয়ে আছে যেন। মেঝের এক পাশে খেজুর পাতার চাটাইখানায় ফুলের শয্যা পাতা।
কুঠিরে প্রবেশ করে বলে বনহুর–এ সব কি হয়েছে?
হাসে কেশব।
বনহুর শয্যায় এসে বসে বলে কেশব, আজ কি আমার ফুলশয্যা?
বলে কেশব মনে করো তাই
কিন্তু কনে কই?
সন্ন্যাসী বাবাজীর তপস্যায় কনেও আসবে। কথাটা বলে বেরিয়ে যায় কেশব।
বনহুর শয্যায় শুয়ে পড়ে।
কেশব এসে দাঁড়ায় ফুলের কাছে–ফুল, যাও ও তোমার প্রতীক্ষা করছে।
ফুল নত করে মাথা।
কেশব চলে যায় নিজের শয়ন স্থানে।
ফুল তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে তার নিজের কুঠিরের মেঝেতে। একটি পা সে আজ নড়াতে পারছে না। কে যেন শিকল দিয়ে তার পা দু’খানা বেঁধে ফেলেছে। কই, ফুলের তো এমন লজ্জা ছিলো না। কোনোদিন আজ এমন হচ্ছে! বুকের মধ্যে কেন এমন আলোড়ন জাগছে।
রাত ক্রমেই গম্ভীর হয়ে আসছে।
ফুল নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।
বনহুর তার কুঠিরে শুয়ে ভাবছে কত কথা। আজ ফুল ছড়ানো বিছানায় শুয়ে, ধূপ আর চন্দনের গন্ধে বার বার কেন যেন মনে পড়ছে একজনের কথা–সে হলো নূরী। এমনি এক রাতে গহন জঙ্গলে, হিংস্র জীবজন্তুর গহ্বরে শয়ন করে পাশে পেয়েছিলো সে নূরীকে। তার ছোটবেলার সাথী, সঙ্গিনী, সহচরী নূরী।
আজ কেন বার বার ওর মুখখানাই ভাসছে বনহুরের চোখের সম্মুখে। সেই চঞ্চল বনবালা। পাহাড়ে পাহাড়ে বনে বাদাড়ে ঝরণার ধারে ধারে সেই চঞ্চল চরণের নুপুর ধ্বনি। বনহুর আনমনা হয়ে যায়, বেদনায় ভরে উঠে তার মন–আর কোনোদিন সে ফিরে আসবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে। পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে।
ওদিকে প্রদীপটা প্রায় নিভু নিভু হয়ে এসেছে।
ঘুমিয়ে পড়েছে বনহুর।
আজ পূর্ণিমা।
জ্যোছনা প্লাবিত আকাশ।
সমস্ত বনভুমি ঝলমল করছে জ্যোছনার আলোতে।
রাতজাগা পাখি গাছে গাছে পাখা ঝাপটায়।
বনহুরের দরজা খুলে যায়।
কক্ষে প্রবেশ করে ফুল।
মন্থর গতিতে এগিয়ে যায় বনহুরের বিছানার পাশে।
চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে, নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে বনহুরের ঘুমন্ত সুন্দর মুখমণ্ডলের দিকে। চোখের পাতা যেন পড়তে চায় না। ফুল হারিয়ে ফেলে আপন সত্তা। বসে পড়ে সে বনহুরের শয্যার পাশে। হাত রাখে ফুল বনহুরের ললাটে।
বনহুর হয়তো তখন কোনো এক সুন্দর মধুময় স্বপ্ন দেখছিলো। ফুলের স্পর্শে নিদ্রা টুটে যায়, আচমকা জেগে উঠে বসে বনহুর।
খপ করে ধরে ফেলে ওর হাতখানা। বলে উঠে–কে তুমি? কেশব! কনে সাজার এতো সখ তোমার?
ফুল মাথাটা নত করেছিলো।
বনহুর মুখের নিচে হাত দিয়ে এক ঝটকায় সোজা করে দেয়।
প্রদীপের আলো ফুলের মুখে পড়তেই অস্কুট ধ্বনি করে উঠে বনহুর–নূরী!
ফুল স্থির হয়ে বসে থাকে।
বনহুরের দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময়, অবাক হয়ে বলে সে–একি স্বপ্ন দেখছি!
নূরী এবার কথা বলে–হুর, স্বপ্ন নয়।
তুমি বেঁচে আছো নূরী, এ যে আমার কল্পনার অতীত!
বনহুর প্রবল আবেগে নূরীকে নিবিড়ভাবে চেপে ধরে বুকে। ব্যাকুল কণ্ঠে বলে আবার–নূরী, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না সত্যি তুমি আমার সেই নূরী কিনা, না তুমি কোনো মায়াবিনী?
নূরীর দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা আনন্দ অশ্রু, কোনো কথা সে বলতে পারে না। সমস্ত ভাষা যেন তার হারিয়ে গেছে আনন্দের আতিশয্যে।
বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে শান্ত স্থির কণ্ঠে ডাকে –হুর! আমার বনহুর!
নূরী, বলো–তুমি সত্য না মিথ্যা?
আমি সত্যই তোমার সেই নূরী–
বনহুর নূরীর দেহটা বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে। ললাটে গণ্ডে চিবুকে অসংখ্য চুম্বন করে চলে। বনহুর যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। তার হারানো রত্ন যেন ফিরে পেয়েছে সে।
নূরী ওকে বাধা দেয় না কোনো।
মাটির প্রদীপটা নিভে যায়।
বেড়ার ফাঁকে জ্যোছনার আলো লুটিয়ে পড়ে কুঠিরের মেঝেতে।
বনহুরের বাহু বন্ধনে নূরী।
খেজুর পাতার চাটাই-এর উপরে ছড়িয়ে আছে ফুলগুলো, জ্যোছনার আলোতে হাসছে যেন ওরা।
বনহুর ডাকে–নূরী!
বনহুরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নূরী। বনহুরের হাতখানা তার হাতের মুঠায়, বলে–উ।
আমার সঙ্গে এতো ছলনা করলে কেন?
ছলনা নয় হুর, তোমাকে পাওয়ার সাধনা। সন্ন্যাসী বাবাজী যখন বললেন ওকে বাঁচানোর একমাত্র ঔষধ আছে আমার কাছে, সেই ঔষধ খেলে ও বাঁচবে কিন্তু ছ’মাস কোনো নারীমুখ দর্শন করা চলবে না। পারবে তুমি ওর কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে?
এবার বুঝেছি, তাই তুমি পালিয়ে ছিলে আমার দৃষ্টির আড়ালে। কি কঠিন তুমি নূরী! পারলে ছ’মাস ধরে এমনিভাবে আত্মগোপন করে থাকতে?
হুর, জানো না কি দুর্বিসহ বেদনা নিয়ে আমি রাতের পর রাত ছটফট করেছি। সন্ন্যাসী বাবাজীর আদেশ তবু অমান্য করার সাহস পাইনি, আবার যদি তোমাকে হারাতে হয়!
হেসে উঠে বনহুর হাঃ হাঃ করে, হাসি থামিয়ে বলে–এ যুগের মানুষ তুমি ওসবে বিশ্বাস করো?
না না, ও কথা মুখে এনো না হুর। আমি যে অনেক কষ্ট করে, অনেক সাধনা করে তবেই তোমায়। ফিরে পেয়েছি। বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে নূরী–এবার তোমাকে ছাড়ছি না হুর।
আমিও তোমাকে হারাতে চাই না নূরী।
*
বনহুরের স্পর্শে নূরী ফিরে পায় তার আগের জীবন। চঞ্চলা হরিণীর মত ক্ষিপ্র হয়ে উঠে; বনে বনে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। কেশব-আর বনহুর যখন বনে কাঠ কাটে, নূরী তখন কাঠগুলো বোঝা বাঁধে। বনহুর যখন গাছের উপর চেপে ফল পাড়ে, নূরী তখন ফলগুলো কোঁচড়ে কুড়িয়ে নিতে থাকে।
বনহুর আর কেশব নূরীকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা।
পাহাড়ী ঝরণার মত নূরী নাচে।
বনহুর আর কেশব মাদল বাজায়।
সন্ন্যাসী বাবাজীও দেখেন তাকিয়ে তাকিয়ে। তিনিও মুগ্ধ হয়ে যান। গোটা বনভূমি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠে। গাছে গাছে নতুন স্পন্দন জাগে। ডালে ডালে পাখি গান গায়। ঝরণার সচ্ছ জলে রাজহংসী ডানা মেলে সাঁতার কাটে। আকাশে উড়ে বেড়ায় শুভ্র বলাকার ঝাক।
বনহুর যখন শুয়ে থাকে ঘাসের বিছানায় তখন নূরী বসে থাকে তার পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
বনহুর যখন যেখানে যায়, নূরী সর্বক্ষণ তার পাশে পাশে থাকে ছায়ার মত।
সন্ন্যাসী বাবাজীর আনন্দ আর ধরে না, তিনি এই যুবক আর যুবতীর মিলনে হৃদয়ে তৃপ্তি অনুভব করেন।
কেশবও তাই, সে সব সময় ওদের খুশি রাখার চেষ্টা করে। কেমন করে ওরা দু’জনা নিশ্চিন্ত মনে আনন্দে থাকবে, এই করতো সে।
নূরী নদীতীরে যেতো পানি আনতে; সঙ্গে যেত বনহুর। নদীবক্ষ থেকে কলসী ভরিয়ে দিতো সে। নদী তীরে দাঁড়িয়ে কলসী কাখে তুলে নিতো নূরী।
এমনি এক বৈকালে নূরী আর বনহুর নদীতীরে গেলে পানি আনতে।
এখন নদী শান্ত। বর্ষাকালের মত আজ আর তার ভয়ঙ্করী রূপ নেই। নেই সেই প্রচণ্ড দাপট আর ভয়ঙ্কর ঢেউ-এর উচ্ছলতা।
বনহুর আর নূরী নদীতীরে এসে দাঁড়ালো।
নূরী বললো–এমনি এক বৈকালে আমি তোমায় নদীতীরে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। জানিনা হুর, সেদিন কার মুখ দেখেছিলাম।
নূরী, সত্য আমি বড্ড অপেয়।
নূরী বনহরের মুখে হাতচাপা দেয়–একি কথা বলছো হুর। তুমি যে অমূল্য সম্পদ। লক্ষ লক্ষ রত্নের চেয়ে তুমি মূল্যবান–
বনহুর হেসে উঠলো–হাঃ হাঃ হাঃ।
নূরী স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে, এমন করে বনহুরকে কতদিন সে হাসতে দেখেনি।
নূরীকে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো বনহুর–কি দেখছো নূরী?
হুর! আরও হাসো, হাসো তুমি, তোমার হাসি আমি যে কতো দিন দেখিনি।
নূরী!
বলো হুর?
আমি যদি অপেয় না হবে, তাহলে এতোবার পানিতে ডুবে তবু বেঁচে যাই! নদীবক্ষ আমাকে তার শান্ত কোলে আশ্রয় দিতে রাজি নয়, তাই ডুবেও বেঁচে আছি নূরী।
কি যে বলো? খোদা তোমাকে রক্ষা করেছেন। তোমার মত একটা নিষ্পাপ জীবন বিনষ্ট করবেন না তিনি কখনও।
আবার বনহুর হেসে উঠলো, অট্টহাসির শব্দে নদীতীরে প্রতিধ্বনি জাগলো, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–নিষ্পাপ! নিষ্পাপ জীবন আমার? হাঃ হাঃ হাঃ নূরী তুমি কি পাগল হয়েছো?
বনহুর!
নূরী তুমি জানোনা আমি জীবনে কত পাপ করেছি। কত ধনবানের ধন-ভাণ্ডার লুটে নিয়ে সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করেছি। কত জীবন আমি বিনষ্ট করেছি আমার এ হাত দুখানা দিয়ে। আর তুমি। বলছো আমি নিষ্পাপ।
এ সব কি আমি জানিনা বনহুর? আমি কি আজ তোমায় নতুন দেখছি। তোমার কিছুই আমার অজানা নেই।
তবে কেন আমাকে এত উঁচুতে তুলে ধরো তোমরা। তোমাদের মুখে আমার এ সুনাম সহ্য হয় না নূরী।
হুর! অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো নূরী।
বনহুর বললো–নূরী, তুমি জানো না আমি কত বড় অন্যায় কাজ করেছি। কত বড় জঘন্য কাজ আমি করেছি। মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করে, মিথ্যা ভালোবাসা দেখিয়ে একটি নিষ্পাপ সরল মেয়েকে প্রবঞ্চনা করেছি।
এ সব কি বলছো হুর?
হাঁ, বাংলাদেশে একটি মেয়ে আমাকে ভালোবেসেছিলো। নূরী, ওর জন্যই আমি নিজেকে ফিরে পেয়েছিলাম আমার মধ্যে। ওর মধ্যে আমি পেয়েছিলাম আমার হারানো সুর। মেয়েটি আমাকে সরল বিশ্বাসে উজাড় করে দিয়েছিলো তার সব কিছু।
কথাটা শোনামাত্র নূরী ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস করে উঠে–কি বললে? তুমি অস্পৃশ্য—
হাসে বনহুর।
নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে–তুমি, তুমি তার সব কিছু গ্রহণ করেছিলে? পারলে তুমি এতো নিচে নামতে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ ন্যায়-নীতি কিছুই কি নেই তোমার?
দস্যুর আবার ন্যায়-নীতি। তাই তো বললাম, আমি নিষ্পাপ নই নূরী। শুধু তাই নয়–আমি প্রবঞ্চক।
বনহুর দেখলো, নূরীর মুখ কালো হয়ে উঠেছে। রাগতঃভাবে চলে যাচ্ছিলো সে বনহুরের কাছ থেকে। চট করে বনহুর ধরে ফেললো নূরীর হাতখানা। ওর চিবুক তুলে ধরে বললো–তুমি ভুল। বুঝছো নূরী। সবকিছুর মানে কি তুমি ব্যভিচার মনে করেছো?
নূরী অধর দংশন করছিলো।
বললো বনহুর নিষ্পাপ ছিলো ওর ভালবাসা। নুরী, আমার ভালবাসা ছিলো ছলনামাত্র। তাইতো সে দিলেও আমি গ্রহণ করতে পারিনি। আর পারিনি বলেই আজ আমি অনুতপ্ত।
নূরী অবাক হয়ে তাকালো, বনহুরের কথাগুলো ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছে না সে।
বললো আবার বনহুর–নিজকে কতখানি পাষাণ করে নিয়েছিলাম, তাইতো আমি পেরেছি তাকে প্রবঞ্চনা করতে। সরল-সহজ একটি মেয়েকে প্রবঞ্চনা করার মত পাপ বুঝি আর কিছু নেই। নূরী, আমি তার সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করে তুলে দিয়েছিলাম তাকে আর একজনের হাতে। তার সঙ্গে আমি করেছি চরম ছলনা।
কে সে মেয়ে? কি তার নাম?
অজানা অচেনা এক মেয়ে, হিন্দু বা মুসলমান সে নয়। খিষ্টান জাতি-নাম তার শ্যালন। অদ্ভুত মেয়ে ছিলো শ্যালন। নূরী, ওর মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তোমাকে।
হুঁ, এতোই যদি ভাল লেগেছিলো তাহলে তাকে সঙ্গী করে নিলে না কেন?
অহেতুক রাগ করছে নূরী। আমি তার ভালবাসায় অভিভূত হয়েছিলাম সত্য কিন্তু পারিনি তাকে গ্রহণ করতে। তার ভালবাসার বিনিময়ে সে পায়নি আমার কাছে কিছু। হয়তো এতোটুকু দিতে পারলে আজ আমি এতোখানি অনুতপ্ত হতে পারতাম না। নূরী, জীবনে বহু নারীই আমার সংস্পর্শে এসেছে বা আমিই গিয়ে পড়েছি তাদের সান্নিধ্যে। আমি দেখেছি তাদের আসল রূপ, কারো আচরণে বিস্মিত হয়েছি, কারো আচরণে ব্যথায় মুষড়ে পড়েছি, কারো আচরণে হয়েছি মুগ্ধ। সবাই যেন আমার কাছে কিছু চেয়েছে, কিসের আশায় যেন উন্মুখ রয়েছে ওরা। নূরী, আমি পাষাণ নই–মানুষ। নিজেকে কিভাবে যে আমি সংযত রেখেছি তুমি তা জানোনা।
হুর!
নূরী, তোমাকে ফিরে পেয়েছি–এই আমার জীবনের চরম পাওয়া। আমি ভাবতেও পারিনি তোমাকে আবার পাবো।
হুর, চলো তবে আবার আমরা আস্তানায় ফিরে যাই। কান্দাই জঙ্গলের আকাশ বাতাস আমায় ডাকছে। নাসরিন, দাইমা–ওরা সবাই যে আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে হুর।
হাঁ, আমার মনও মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে উঠে আস্তানায় ফিরে যাবার জন্য। অনেক দিন হলো আস্তানা ত্যাগ করে চলে এসেছি। না জানি সেখানের অবস্থা এখন কেমন।
হুর, সত্যিকার একটা কথা আমায় বলবে আজ?
নূরী, তোমার কাছে আমার না বলার তো কিছুই নেই।
আমার মনি কোথায় তুমি জানো?
মনি! সে এখন তার মায়ের কাছে।
মায়ের কাছে? অবাক কণ্ঠে বলে নূরী।
হ নূরী তোমার মনি তার মায়ের কাছে ভালই আছে।
তার মা! কে–কে আমার মনির মা? বললা–বলো হুর?
তুমি রাগ করবে না তো?
না। আমার মনি যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে তার কথা শুনে আমি রাগ করবো, কি যে বলো!
সত্যি বলছো?
হাঁ এই তোমাকে স্পর্শ করে শপথ করছি, আমি আমার মনির মায়ের পরিচয় জানতে পারলে খুশি হবো। আমি কান্দাই ফিরে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাবো।
পারবে! পারবে তাকে অভিনন্দন জানাতে?
আমার মনি যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে সে যে আমার পরম শ্রদ্ধেয়–
নূরী–অস্কুট ধ্বনি করে বনহুর। একটু থেমে বলে সে–নূরী, মনে করো মনি তোমারই সন্তান কারণ আমি তার জন্মদাতা।
সঙ্গে সঙ্গে নূরী ছটকে সরে যায় বনহুরের কাছ থেকে। মুখমণ্ডল অমাবস্যার অন্ধকারের মত নিষ্প্রভ হয়ে যায়।
বনহুর হতভম্ভ হয়ে পড়ে।
নূরী ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। এ মুহূর্তে সে মনিকে সম্মুখে পেলে ছিঁড়ে ফেলতো যেন টুকরা টুকরা করে। পরক্ষণেই বনহুরের বুকের কাছে জামাটা এঁটে ধরে ভীষণভাবে। তারপর উন্মাদিনীর মত কিল-চড় দিতে থাকে বনহুরের বুকে –না না, এ হতে পারে না। এ হতে পারে না।
বনহুর মৃদু হাসে–কি হলো নুরী? কি অন্যায় আমি করেছি?
আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু তোমার পাশে আমি অন্য নারীকে ভাবতে পারি না। অসহ্য অসহ্য– কেন, কেন তুমি বললে এ কথা? নূরী কেঁদে উঠে উচ্ছ্বসিতভাবে।
বনহুর নূরীকে টেনে নেয় কাছে, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে–নূরী, তুমি জানো মনিরাকে আমি বিয়ে করেছি আমাদের মুসলমান ধর্ম অনুসারে। আমার স্ত্রী সে।
মনি তা হলে—
হাঁ, সে মনিরার সন্তান, আমারও।
দাঁতে দাঁত পিষে বলে নূরী– চৌধুরী কন্যা মনিরার সন্তান মনি। না না, আমি সহ্য করতে পারবো না। আমাকে এ কথা কেন শোনালে হুর? আমাকে এ কথা কেন শোনালে–
বনহুর গম্ভীর হয়ে পড়ে, নূরীকে সজোরে সরিয়ে দিলে বলে–নূরী, অন্যায় আমি করিনি। মনিরাকে আমি বিয়ে করেছি, তার গর্ভে আমার সন্তান জন্মেছে।
উঃ আমি কেন বেঁচে রইলাম। কেন আমার মরণ হলো না। আমি জানি এক জিনিস কোনোদিন দু’জনার হয় না। বনহুরের জামাটা আবার মুঠায় চেপে ধরে নূরী–তুমি যে শুধু আমার, এটাই আমি জানি।
নূরী, আমি তো তোমারই রয়েছি।
তা হয় না। তোমার স্ত্রী-পুত্র রয়েছে। তোমাকে আমি আর ধরে রাখতে পারবো না।
নূরী, বিশ্বাস করো আমি যেমন তোমার তেমনি মনিরার।
এক হৃদয় কোনোদিন দু’জনাকে দেওয়া যায় না হুর। কেউ তা পারে না।
তুমি তো জানো নূরী, বনহুর কারো সমকক্ষ নয়। কেউ যা করে না, তাই সে করে। কেউ যা ভাবে তাই সে ভাবে। অসম্ভবকে সম্ভব করাই হলো তার নীতি। মনিরাকে ইসলাম ধর্মমতে বিয়ে করেছি, আর তোমাকে খোদা সাক্ষী রেখে। লোক সমাজের কেউ জানে না তুমি আমার কে–শুধু রহমান ছাড়া। তবু তোমরা দু’জন আমার কাছে সমান অধিকারী–নূরী, আমার উপর রাগ করোনা লক্ষীটি!
নূরী নীরবে অশ্রু মোছে।
বনহুর ওর মুখখানা তুলে ধরে হাসো। হাসো নূরী। নিজের হাত দিয়ে নূরীর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়, ললাটে একে দেয় চুম্বন রেখা।
নূরী বলে–আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে না তো কোনোদিন?
না। তোমার পাশেই তো থাকবো আমি। নূরী, তুমি যোগাবে আমার মনে দুর্দমনীয় সাহস আর উৎসাহ। মনিরা যোগাবে সান্ত্বনা আর শক্তি। তুমি দেবে প্রেম-ভালবাসা উজাড় করে আর মনিরা দেবে স্নেহ-প্রীতি আর প্রেরণা। তোমাদের দু’জনার কাছেই আমি চাই আমার অতৃপ্ত হৃদয়ের অফুরন্ত খোরাক। বলো পারবে দিতে?
নূরী বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে উঠে–পারবো।
বনহুর ওকে প্রবল আবেগে নিবিড়ভাবে আবেষ্টন করে।
ঠিক সে মুহূর্তে পিছনে কেশে উঠে কেশব।
বনহুর নূরীকে মুক্ত করে দিয়ে ফিরে দাঁড়ায়, হেসে বলে–তুমি কখন এলে কেশব?
বললো কেশব–এই তো এখনই এলাম। সন্ধ্যা হয়ে এলো তবু তোমাদের ফিরবার নাম নেই।
বললো বনহুর–তাই বুঝি এসেছে বোনের সন্ধানে?
কেশব বললো–চলো এবার।
কেশব, তুমি যখন এসেছে তখন বসো, কথা আছে তোমার আর নূরীর সঙ্গে।
বাবাজী ব্যস্ত হবেন।
কেশব বললো–বাবাজী শহরে গেছেন, এখনও ফিরে আসেননি।
অবাক কণ্ঠে বললো বনহুর –সেই যে সকালে গেছেন এখনও ফিরে আসেননি তিনি?
না, তাছাড়া শহর তো আর নিকটে নয়। বহু দূরের পথ। এমনি বুঝি রাত হয়ে যায় তার ফিরতে! বললো বনহুর। কেশব বললো–রাত কোনোদিন হয় না, তবে সন্ধ্যা হয়।
নদীতীরে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফিরে এলো তারা কুঠিরে।
কিন্তু কি আশ্চর্য, তখনও ফিরে আসেননি সন্ন্যাসী বাবাজী।
চিন্তিত হলো সবাই।
কেশবের চোখ অশ্রু ছলছল হলো।
নূরীর অবস্থাও তাই। সন্ন্যাসী বাবাজী তাদের পিতার মত।
রাত বেড়ে চললো।
বনহুর, কেশব আর নূরীর মুখ অন্ধকার হলো। সবাই উঠানে বসে প্রতীক্ষা করছে।
রাত যত বাড়ছে ততই সকলের মনে আশঙ্কার ছায়া ঘনীভূত হয়ে আসছে–এমন তো কোনোদিন হয় না।
কেশব আর নূরী প্রায় কেঁদেই ফেললো।
ছোট্টবেলা হতে কেশব সন্ন্যাসী বাবাজীর কাছেই মানুষ।
তাই সন্ন্যাসী বাবাজীর জন্য তার সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা।
দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে এলো।
সন্ন্যাসী বাবাজী আর ফিরে এলেন না।
ভোর হতেই কেশব ধরে বসলো সে শহরে যাবে। সন্ন্যাসী বাবাজী কেন ফিরলেন না তাঁকে খুঁজে আনবে।
বনহুর বললো–এতো ব্যস্ত হলে চলবে না। তুমি বরং থাকো আমি গিয়ে তাঁর অন্বেষণ করে আসি।
আমিও যাবো তোমার সঙ্গে। বললো কেশব।
বনহুর বললো–তা হয় না। নরী একা থাকবে?
কেন, আমাকেও নিয়ে চলো না হুর! আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।
পাগল হলে তোমরা দু’জনার কেউ নয়। দিল্লী শহর অনেক দূরে।
বনহুর সাধারণ সন্ন্যাসীর ড্রেসে সজ্জিত হয়ে নিলো। তার দেহে গেরুয়া কাপড়, ললাটে চন্দনের তিলক আর হাতে-গলায়-বাজুতে রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় কোকড়ানো চুল। সুন্দর সুপুরষ এক সন্ন্যাস যুবকের বেশে বনহুর কেশব আর নূরীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
নূরী দীপ্তভরা উজ্জ্বল চোখে তাকালো, বললো–শীগগির ফিরে এসো।
কেশব বললো–বাবু, তোমাকে ঠিক সন্ন্যাসী বলেই মনে হচ্ছে। যাও বাবাজীকে নিয়ে ফিরে এসো।
বনহুর চলে গেলো।
কেশব, আর নূরী রইলো এখানে। আজ ওরা নতুন নয়, এমনি কতদিন কেশব আর নূরীর কেটেছে।
শহরে পৌঁছতে বনহুরের সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।
এতোটা পথ তাকে পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে। শহরে পৌঁছেও তাকে পায়ে হেঁটে পথে পথে ঘুরতে হচ্ছে।
শহরের বিজলী বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে পট পট করে। দোকান-পাট, রেষ্টুরেন্ট আলোয় আলোময় হয়ে উঠেছে সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে।
মোটরগুলোর সার্চলাইট তীব্র আলো ছড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে এদিক থেকে সেদিকে। পিছনের লাল আলোগুলো যেন রাক্ষসের দুটো চোখের মত জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।
বনহুর রাজপথের পাশে এসে দাঁড়ালো।
দিল্লীর ফাহারা রোড এটা। এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে দিল্লী। রাজধানী বা আসল শহর। বনহুর এতোবড় শহরে কোথায় খুঁজবে সন্ন্যাসী বাবাজীকে। কেশব আর নূরীর জন্যই না সে বিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়েছে। পকেট পয়সাশূন্য। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। অনেক পথ হাটার জন্য। দেহটাও শিথিল হয়ে এসেছে। বনহুর একটা লাইট পোষ্টে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। পকেট থেকে একটা কাপড়ের টুকরা বের করে মুখ মুছে নিলো, রুমাল নেই–এ কাপড়ের টুকরাটাই এখন রুমাল। এমন কোনো সম্বল নেই যা দিয়ে বনহুর ক্ষুধা নিবৃত্ত করে বা করতে পারে।
বিখ্যাত দস্যু সর্দার আজ সম্বলহীন।
ছ’মাস সে গহন জঙ্গলে সন্ন্যাসীর আশ্রমে বাস করে হয়ে উঠেছে ঠিক সন্ন্যাসীর মতই। সিগারেটের নেশা ছিলো যার চরম আকারে, আজ সব নেশা তার ছুটে গেছে।
বনহুর চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বিশ্রামের আশায় বসে পড়লো।
এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামলো তার অদূরে। একটি তরুণ আর একটি তরুণী নেমে এলো। গাড়ি থেকে। বাঙালি বলেই মনে হলো বনহুরের প্রথম নজরে।
বনহুর দেখলো ওরা ঠিক তার দিকেই আসছে।
চোখ বন্ধ করে বনহুর বসে রইলো, মাঝে মাঝে মৃদু দৃষ্টি মেলে দেখছে।
হাঁ, ওরা তার দিকেই আসছে।
বনহুর বিড় বিড় করে মন্ত্রজপের মত কিছু উচ্চারণ করতে লাগলো।
যুবক আর যুবতী এসে দাঁড়ালো বনহুরের সম্মুখে। যুবক বললো–সন্ন্যাসী বাবা! সন্ন্যাসী বাবা!
চোখ মেলে তাকালো বনহুর, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–কে ডাকে?
বললো এবার তরুণী-বাবাজী দয়া করুন। দয়া করুন আমাদের!
তরুণ বললো–আমরা বড় বিপদে পড়েছি বাবা।
বললো বনহুর–আমি জানি তোমরা কি বিপদে পড়েছ।
ব্যাকুল কণ্ঠে বললো তরুণী–বাবাজী, আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
বসো। বসো তোমরা।
বসে পড়লো তরুণ এবং তরুণী।
বনহুর বললো–দেখি হাত। তরুণের দিকে হাত বাড়ালো সে।
হাতখানা মেলে ধরলো তরুণ বনহুরের দিকে।
বনহুর ওর হাতখানা নিজের হাতে টেনে নিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে বললো–বৎস, তোমাদের বিপদ আরও ঘনীভূত আমি দেখতে পাচ্ছি।
তরুণী প্রায় কেঁদে ফেললো, বললো সে–কি করে আমরা এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবো বলুন বাবাজী? কি করে আমরা ভাইবোন দুষ্ট কুচক্রী কাকার কবল থেকে রক্ষা পাবো বলুন?
বনহুর আন্দাজে বলছিলো সব, আসলে সে জপ-তপ আর মন্ত্র কিছু জানে না। এবার সে অনেকটা বুঝতে পারলো–এরা তাদের কাকার কবল থেকে উদ্ধার পেতে চায়। ভাগ্যিস বলে বসেনি সে– তোমাদের বিয়ে হবে, কোনো চিন্তা নেই। যাক, এবার বনহুর আঁচ করে নিয়েছে–ওরা দু’জন ভাই আর বোন। বললো বনহুর–বৎস, তোমাদের কাকার কবল থেকে বাঁচতে পারো, যদি এক কাজ করো।
বলুন বাবাজী, আমরা বাঁচতে চাই। যা বলবেন তাই করবো।
পারবে! তোমার কাকাকে আমার নিকটে আনতে পারবে?
চমকে উঠে তরুণ-তরুণী। বলে তরুণ–আমার কাকা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর মানুষ। তিনি আমাদের হত্যা করার চেষ্টায় আছেন। আজ রাতে আমাদের হত্যা করবেন।
কি করে এ কথা তোমরা জানলে?
আমার কাকা একটা লোকের সঙ্গে গোপনে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। আমার বাবার বিষয় আসয় যাতে আমার কাকার নিজস্ব হয়, এই তার চেষ্টা।
আমি সব অবগত হয়েছি।
আমাদের বাবা-মা জীবিত নেই, এবং সেই কারণেই আমার দুষ্ট কাকা আমাদের হত্যার চেষ্টা করছেন। আমরা যদি না থাকি তাহলে আমার কাকা নিশ্চিন্ত মনে বাবার এবং কাকার উভয়ের ঐশ্বর্য একাই ভোগ করবেন।
বুঝলাম বৎস। নিশ্চিন্ত থাকো, তোমাদের কাকা পারবে না তোমাদের হত্যা করতে।
তরুণ-তরুণী বনহুরের পায়ের উপর উবু হয়ে পড়লো। বাঁচার জন্য সে কি আকুতি!
বনহুরের মন মায়ায় আদ্র হয়ে উঠলো! বললো সে–বৎস, কোনো চিন্তা করো না। ঈশ্বরের কৃপায় আমি তোমাদের রক্ষা করতে সক্ষম হবো।
পারবেন আপনি আমাদের রক্ষা করতে?
হ বৎস।
তাহলে কি উপায়ে আপনি রক্ষা করবেন বাবাজী? বললো যুবক।
যুবতীও প্রশ্নভরা ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সন্ন্যাসীবেশী বনহুরের মুখে।
যুবক-যুবতীর দেহের পোশাক-পরিচ্ছদে বুঝতে পারলো বনহুর–ওরা সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান হবে। যুবকের বয়স কুড়ির বেশি নয়। যুবতী ষোল-সতেরো হবে। সুশ্রী চেহারা উভয়ের।
বনহুর বললো–আমার আদেশ তোমরা ফিরে যাও।
শিউরে উঠলো যেন উভয়ে।
বনহুর বললো–ভয় নেই, আমিও যাবো তোমাদের সঙ্গে।
তরুণ-তরুণীর মুখ যেন খুশিতে উজ্জ্বল হলো। বললো তরুণ–বাবাজী, আপনি দয়া করে চলুন। আমাদের সঙ্গে।
বললো বনহুর–যাবো, কিন্তু গোপনে। তোমাদের বাড়ির একটি প্রাণীও যেন জানতে না পারে সন্ন্যাসী বাবাজী এসেছেন।
না, পারবে না। আসুন, আমাদের সঙ্গে চলুন।
চলো বৎস। বনহুর গাড়ির পিছন আসনে চেপে বসলো।
তরুণটি ড্রাইভিং আসনে বসলো আর তরুণী বসলো তার পাশে!
বনহুর বললো–বাড়ির পিছন দিকে দিয়ে যাবে। তোমার কাকা যেন টের না পায় তোমরা বাইরে গিয়েছিলে। আর শোন, আমি শুধু তোমাদের বাড়ির নিকটে যাবো–বাড়িতে নয়!
তাহলে আমাদের রক্ষা করবেন না? বাঁচাবেন না আমাদের কাকার কবল থেকে।
হ বৎস, তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো। প্রতিদিনের মত আজও তোমরা নিজ বিছানায় শোবে! যেন তোমরা কিছু জানোনা।
কিন্তু… কো
নো কিন্তু নেই। আমি যেভাবে বললাম ঐভাবে কাজ করবে।
তরুণটি মোটর ষ্টার্ট দিলো। গাড়ি ছুটতে শুরু করলো।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গ্র্যাণ্ড রোডের অদূরে একটা বিরাট বাড়ির পিছনে এসে গাড়ি থেমে পড়লো।
তরুণ বললো–গুরুদেব, এটাই আমাদের বাড়ি। আমার বাবা-মা মারা যাবার পর আমরা এ বাড়িতেই থাকি। আর থাকেন আমার কাকা।
বনহুর নেমে গেলো অন্ধকারে।
তরুণ গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।
বনহুর সন্ন্যাসী বাবাজীর বেশে বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালো। গেটের পাশে নেমপ্লেটে নামটা পড়ে নিলো বনহুর রাজনারায়ণ। আপন মনেই উচ্চারণ করলো বনহুর– অদ্ভুত নাম-রাজনারায়ণ।
সন্ন্যাসী দেখে এগিয়ে এলো দারওয়ান, প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলো গুরুবাবা, কোন্ চিজ মাঙ্গতা–
বনহুর বললো–হর হর শিবও শঙ্করও– একটু থেমে বললো– রাজনারায়ণের সাক্ষাৎ কামনায় এসেছি।
আপ থোরা রহিয়ে গুরু বাবা, হাম আভি মালিক সে বাত পুছকে আতা হ্যায়।
বনহুর জোরে জোরে উচ্চারণ করলো- হর হর শিবও শঙ্করও– হর হর শিবও শঙ্করও—
অল্পক্ষণ পরে ফিরে আসে দারওয়ান আইয়ে গুরুবাবা।
গেট খুলে দিলো।
বনহুর অনুসরণ করলো দারওয়ানকে।
মস্তবড় বাড়ি।
রাজা-মহারাজার বাড়ির মতই পর পর কয়েকটা ফটক পেরিয়ে মস্তবড় হলঘর। বনহুর হলঘরে প্রবেশ করতেই দারওয়ান কুর্ণিশ জানালো– সম্মুখের আসনে বসে আছ রাজনারায়ণ।
বনহুর তাকালো রাজনারায়ণের মুখে, সঙ্গে সঙ্গে ভীষণভাবে চমকে উঠলো। কোথায় রাজনারায়ণ–এ যে গুলেশান হোটেলের মালিক মাহমুদ রিজভী! এখন তার মুখে আগলা দাড়ি-গোঁফ নেই। পায়জামা-আচকানও নেই। সম্পূর্ণ হিন্দু ড্রেস তার শরীরে।
বনহুর হকচকিয়ে গেলেও ভড়কে যাবার বান্দা সে নয়। চট করে নিজকে সামলে নিলো। গম্ভীর। কণ্ঠে উচ্চারণ করলো হর হর শিবও শঙ্করও…হর হর শিবও শঙ্কর…
হাতে তার চিমটা আর রুদ্রাক্ষের মালা। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো চুল। বনহুরের মুখে আলগা দাড়ি-গোঁফ। এক গাদা দাড়ি-গোঁফের মধ্যে সুন্দর দীপ্তময় দুটি আঁখি। তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সে আঁখি দুটিতে।
বনহুর মাহমুদ রিজভীকে চিনতে পারলো কিন্তু মাহমুদ রিজভীর সাধ্য নেই সে বনহুরকে চিনতে পারে। তাছাড়া মাহমুদ রিজভী জানে, মিঃ আলমবেশী দস্যু বনহুর আর লুসীর গভীর নদীবক্ষে মৃত্যু ঘটেছে। ভাবতেও পারবে না সেমিঃ আলমের মৃত্যু হয়নি–সে আজ তার সম্মুখে।
সন্ন্যাসী বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় রাজনারায়ণবেশী মাহমুদ রিজভী। দু’হাত জুড়ে অভিবাদন করে, তারপর বলে–বসুন সন্ন্যাসী বাবাজী।
বনহুর আসন গ্রহণ করে।
মাহমুদ রিজভী বলে এবার–বাবাজী, হঠাৎ কি মনে করে এসেছেন জানতে পারি কি?
হ বৎস, সব জানতে পারবে এবার।
বলুন বাবাজী?
বৎস, আমি যোগ সাধনায় বসে জানতে পারলাম, এ শহরে রাজনারায়ণ নামক ব্যক্তি অচিরেই রাজ ঐশ্বর্য লাভে লাভবান হবেন। কিন্তু পথে দুটি কাটা আছে। ঐ কাঁটা দুটি যতক্ষণ উপড়ে ফেলা না যাবে, ততক্ষণ ঐ রাজ ঐশ্বর্য লাভ হলেও স্থায়ী হবে না। আমি তাই অনেক সন্ধান নিয়ে তবে তোমার নিকটে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। আমার এই প্রচেষ্টায় তোমার যদি রাজ ঐশ্বর্য লাভ হয় তবে আমি ধন্য হবো।
খুসিতে মাহমুদ রিজভীর চোখ দুটো জ্বলে উঠে, বলে সে–বাবাজী, আপনার সেবা করতে পারলে ধন্য হবো। বহুদূর থেকে এসেছেন, নিশ্চয়ই আপনি ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত।
হাঁ বৎস, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত।
মাহমুদ রিজভী কলিং বেলে চাপ দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলো একটি বয়। ছালাম করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
রিজভী বললো–সন্ন্যাসী বাবাজীর খাবার জন্য দুধ, আর কিছু ফলমূল নিয়ে এসো।
চলে গেলো বয়।
রিজভী আগ্রহভরে এগিয়ে এসে বসলো বনহুরের পাশের আসনে। বললো–বাবাজী, আপনি যোগ সাধনায় যা দেখেছেন তা সত্য। রাজ ঐশ্বর্য আমার হাতের মুঠায়, কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত নই। আমার পথে দুটো কাঁটা আছে।
হাঁ, আমি জানি।
বাবাজী, আমি আজ রাতে ঐ কাঁটা দুটোকে শেষ করে ফেলবো মনস্থ করেছি। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে নেয়–ঐ কাঁটা দুটো হলো…থামলো রিজভী।
বনহুর বলে উঠলো–আমি জানি তারা কে? তোমার মৃত ভাই-এর পুত্র এবং কন্যা।
হাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন বাবাজী। রিজভীর বিশ্বাস আরও গাঢ় হয়।
বলে আমার বনহুর–কিন্তু বৎস, তুমি যে ভাবে ওদের হত্যা করতে মনস্থ করেছে তাতে অসুবিধা আছে।
তাহলে উপায় বলে দিন বাবাজী? আমি সেভাবেই ওদের খতম করবো।
ধীরে ধীরে কাজ করতে হবে বৎস। বেশি উতালায় সব পণ্ড হতে পারে।
এমন সময় বয় ট্রের উপরে নানারকম ফল এবং এক গেলাস খাঁটি দুধ নিয়ে আসে।
রিজভী নিজের হাতে বনহুরের সম্মুখে ফলমূল আর দুধের গেলাস সাজিয়ে রাখে, তারপর বলে– ভক্ষণ করুন বাবাজী।
বনহুর ক্ষুধার্ত ছিলো, কোনোরকম আপত্তি না করে পেট পূর্ণ করে খেয়ে নেয়।
ক্ষুধা নিবৃত্ত হবার পর সে বলে– বৎস, এবার আমার বিশ্রামের প্রয়োজন।
মাহমুদ রিজভী কিছু চিন্তা করলো, তারপর বললো–বাবাজী, একটি কথা আমাকে বলে আপনি বিশ্রাম করুন।
বলো বৎস?
আজ আমি আমার ভ্রাতুস্পুত্র রাজা মহেন ও ভ্রাতুস্পুত্রী মোহিনীকে শেষ করবো মনস্থ করেছিলাম। কিন্তু…
বলো বৎস, আমার কাছে সঙ্কোচের কোনো প্রয়োজন নেই।
আমার প্রধান অনুচর জব্রু এদের দু’জনাকে গলা টিপে হত্যা করবে, তারপর জব্রু মৃতদেহ দুটিকে যমুনাবক্ষে ফেলে দিয়ে আসবে। কেউ জানবে না ওরা কোথায় গেছে।
শুভাংশু…শুভাংশু…জয় জয় হর হর শিবও শঙ্করও…সব ঠিক আছে।
তাহলে এভাবেই কাজ করবো?
হাঁ, কিন্তু এতো ব্যস্ত হলে কার্য সফল নাও হতে পারে।
তাহলে বলে দিন বাবাজী?
সব বলছি, সেভাবে কাজ করবে।
শয়তান মাহমুদ রিজভী সন্ন্যাসীবেশী দস্যু বনহুরকে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করে নিলো। বললো রিজভী–বলুন আমি কিভাবে কাজ করতে পারি?
বলছি বৎস, বলছি। তোমার ভ্রাতুস্পুত্র এবং ভ্রাতুস্পুত্রী কি শিশু? বনহুর নিজেকে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বিবেচিত করার জন্য প্রশ্ন করলো।
রিজভী বললো–না, তারা পূর্ণবয়স্ক।
হোক, তাতে ক্ষতি নেই।
বলুন কিভাবে কার্য করা যাবে বা যেতে পারে–বলুন সন্ন্যাসী বাবাজী?
বললো বনহুর–এক কাজ করলে সবচেয়ে মঙ্গল হয়। গভীর রাতে কোনো এক জায়গায় যাওয়ার নাম করে সোজা তাদের নিয়ে যেতে হবে গহন জঙ্গলে, ঠিক যমুনার তীরে–তারপর…দু’জনাকে নিঃশেষ করে ফেলে দিবে যমুনাবক্ষে। কেউ জানবে না, কেউ বুঝবে না কোথায় গেলো ওরা। শুধু আমি চাই তাদের রক্ত…হাঃ হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে উঠে বনহুর।
রিজভী সন্ন্যাসীর পায়ের ধূলো মাথায় নেয়। করজোড়ে বলে–বাবাজী আপনি যদি সহায় হন, কার্য যদি সিদ্ধি হয় তবে আমি আপনাকে শুধু রক্তই দেবো না, দেবো অজস্র অর্থ–প্রচুর ঐশ্বর্য।
হর হর শিবও শঙ্করও অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই আমার, শুধু চাই ওদের রক্ত, রক্ত পেলেই আমার চলবে।
বলুন কি ভাবে কাজ করবো?
আজ রাতেই তোমার ভ্রাতুস্পুত্র এবং ভ্রাতুস্পুত্রীকে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও।
বাবাজী, আপনি সঙ্গে থাকবেন আমার?
হাঁ, আমি সঙ্গে থাকবো। হর হর শিব ও শঙ্কর ও শিবও শঙ্করও…
জব্রুকে নেবো?
হাঁ, তাকে নিতেই হবে, কারণ তার হস্তেই কাঁটা দুটোকে উপড়ে ফেলতে হবে।
হাতঘড়ি দেখে রিজভী–সন্ন্যাসী বাবাজী, রাত এখন দশটা বেজে গেছে।
রাত দুটোয় আমাদের রওয়ানা দিতে হবে। বললো সন্ন্যাসীবেশী বনহুর। তারপর আবার বললো সে–আমি যাই, ঠিক সময় পৌঁছে যাবো।
কিন্তু অতোরাতে আপনি যদি ঠিভাবে এসে না পৌঁছান, তাহলে?
আমার জন্য কোনোরকম ভাবনা ভাবতে হবে না। দুই-দুটো লোকের রক্তের নেশা কম নয়। উঠে দাঁড়ায় বনহুর।
রিজভী পদধূলি গ্রহণ করে।
সন্ন্যাসীবেশী বনহুর হাত তুলে আশীর্বাদ জানায়।
বেরিয়ে যায় সন্ন্যাসীবেশী বনহুর।
*
বনহুর সন্ন্যাসীর বেশে, সন্ন্যাসী বাবাজীকে খুঁজতে শহরে চলে গেলো। কেশব আর নূরী রইলো জঙ্গলের কুঠিরে।
এদিকে বনহুর চলে যেতেই সন্ন্যাসী বাবাজী এসে হাজির হলেন। শহরে রাত্রি হয়ে যাওয়ায় তিনি ফিরতে পারেননি–গত রাত্রি তাই তিনি শহরে কাটিয়েছিলেন। আশ্রমে পৌঁছে তিনি যখন শুনলেন, বাবুজী তার খোঁজে চলে গেছে শহরে, তখন সন্ন্যাসী বাবার মুখ গম্ভীর হলো। কারণ শহর এ জঙ্গল ছেড়ে বহু দূরের পথ। এতো দূর সে যাবে কি করে, তারপর কোথায় তাকে খুঁজে ফিরবে!
কেশব আর নূরী সন্ন্যাসী বাবাজীর সঙ্গে চিন্তিত হয়ে পড়লো। এখন বনহুরকে ফিরিয়ে আনার উপায় কি!
বিশেষ করে এসব জায়গা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন।
এখানে যখন সন্ন্যাসী বাবাজী, কেশব আর নূরী বনহুরকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির তখন বনহুর রাজা নারায়ণবেশী মাহমুদ রিজভীকে শায়েস্তা করার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছিলো। বনহুর জানে, সন্ন্যাসী বাবাজী ছোট্ট বাচ্চা শিশু নন যে, হারিয়ে যাবেন, তিনি শহরের কোথাও আছেন তাকে খুঁজে এখন কোনো ফল হবে না; ভাগ্যক্রমে শয়তান রিজভীর সাক্ষাৎলাভ যখন ঘটেছে তখন তাকে তার কর্মফলের উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে স্বস্তি নেই বনহুরের।
রিজভীকে আজ এভাবে না পেলেও বনহুর যে তাকে ছেড়ে দেবার লোক নয় দিতো না এটা সুনিশ্চয়। রিজভী শুধু তাকেই শাস্তি দান করেনি–লুসীকে হত্যা করেছে। তার অমূল্য সতীত্ব বিনষ্ট করেছে সে। বনহুরের শিরায় শিরায় যে বহ্নিশিখার মত সে আগুন জ্বলছে। এতো সহজে বনহুর রিজভীকে যে হাতের মুঠায় পাবে ভাবতে পারেনি। বনহুর খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করে নেয়।
বনহুর এসে দাঁড়ায় রাজ নারায়ণের কক্ষের পিছনে। সমস্ত বাড়িখানা সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে। হয়তো রাজনারায়ণ তার কার্য সিদ্ধির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বনহুর পিছনের পাইপ বেয়ে তর তর করে উঠে গেলো উপরে। রেলিং টপকে বেলকুনিতে এসে নামলো। ওদিকের দরজা খুলে উঁকি দিলো ভিতরে, কক্ষ খালি–কেউ নেই। বনহুর দ্রুত প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে। এ কক্ষটিই যে রাজনারায়ণের শয়নকক্ষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনারায়ণবেশী রিজভী কোথায়। এমন সময় কানে ভেসে এলো ওদিকের কোনো এক কামরা থেকে রিজভীর কণ্ঠ স্বর–স্বপন, কল্পনা, তোমরা তৈরি হয়ে নাও, এক জায়গায় তোমাদের যেতে হবে। রাত দুটোয় রওয়ানা দেবেন।
সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, তরুণের গলা শোনা গেলো–কাকা, এতো রাতে আমাদের আপনি কোথায় নিয়ে যাবেন?
বনহুর বুঝতে পারলো, শয়তান রিজভী ভ্রাতুস্পুত্র এবং ভ্রাতুস্পুত্রীকে তৈরি করে নিচ্ছে। ওদের নাম স্বপন আর কল্পনা এ কথাও বনহুরের জানা হয়ে গেলো।
ওদিকে যখন রিজভী নিঃসন্দেহে স্বপন আর কল্পনাকে বুঝিয়ে বাগে এনে নিচ্ছিলো, তখন বনহুর দ্রুত হস্তে তার কাজ সমাধা করে নিলো। বালিশ তুলে দেখলো, তারপর আলনায় ঝোলানো কোটের পকেট হাতড়ে পেলো চাবীর গোছা। চাবী দিয়ে খুলে ফেললো লৌহ্ আলমারী,ক্ষিপ্রতার সঙ্গে রিভলভারখানা পকেটে রাখলো। পকেটে রাখবার পূর্বে দেখে নিলো তাতে গুলী মজুত আছে কিনা। বনহুর জানে, শয়তানের রিভলভার কোনো দিন শূন্য থাকার নয়। গুলীভরা রিভলভার পকেটে রেখে টাকার কয়েকটা বাণ্ডিল উঠিয়ে নিলো। তারপর বেরিয়ে গেলো কক্ষ হতে।
একটু পরে ফিরে এলো রিজভী তার কক্ষে। বেশ নিশ্চিন্ত সে, কারণ স্বপন আর কল্পনা তার কথায়। রাজি হয়েছে।
কক্ষে প্রবেশ করে অবাক হলো–লৌহ আলমারী খোলা পড়ে রয়েছে। তবে কি কেউ তার কক্ষে প্রবেশ করেছিলো? কিন্তু কি করে তা সম্ভব! সমস্ত বাড়ি মজবুত প্রাচীরে ঘেরাও রয়েছে। সিঁড়ির মুখে দরজায় তালা বন্ধ, তাছাড়াও গেটের পাশে সজাগ পাহারা দিচ্ছে পাহারাদার। সিঁড়ির মুখে খুপড়ীতে ঘুমাচ্ছে জব্রু। কারো সাধ্য নেই তার কক্ষে প্রবেশ করে।
আজ দশ বছর হলো এ বাড়িতে আছে রিজভী। এ বাড়ি আসলে তার নয়, তার বড় ভাই শ্যামনারায়ণের বাড়ি এটা। রাজনারায়ণ হলো তার নাম। বহুদিন বিদেশে কাটিয়ে রাজনারায়ণ যখন দিল্লী তার বড় ভাই-এর বাড়ি এসে হাজির হলো তখন সে দীনহীন ভিখারীর চেয়েও কাঙাল। এক পয়সা তার সম্বল ছিলো না, ছিন্নভিন্ন তার জামা-কাপড়।
ছোটবেলা থেকেই রাজনারায়ণ ছিলো ভয়ানক দুষ্ট প্রকৃতির। নানারকম উচ্ছলতা তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিলো পূর্ব হতেই। শ্যামনারায়ণ ছিলেন তেমনি মহৎপ্রাণ লোক। ছোট ভাই-এর এতো দোষ থাকা সত্ত্বেও তাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন তিনি।
কিন্তু রাজনারায়ণ বড় ভাইকে মোটেই ভক্তি করতো না বরং কিসে বড় ভাই-এর অমঙ্গল করতে পারবে সেই চেষ্টা করতো সে। একদিন ভীষণ এক মন্দ কাজ করে বসে রাজনারায়ণ। তখন শ্যামনারায়ণ তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেন।
রাজনারায়ণ চলে যায় বটে কিন্তু সে সবসময় বড় ভাইকে নিঃশেষ করার চেষ্টা করে।
ফিরে আসে অনেক দিন পরে দিল্লীতে বড় ভাই-এর বাড়িতে।
ক্ষমাশীল শ্যাম নারায়ণের রাগ তখন পড়ে এসেছিলো, তিনি ছোট ভাইকে বিশ্বাস করে আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজ বাড়িতে।
তিনি সেদিন জানতেন না তার সহোদয় তাকে চরমভাবে শাস্তি দেবে। উপরে সাধু সেজে নিচে নিচে জঘন্য কাজে লিপ্ত হলো রাজনারায়ণ। জব্রুকে সে নিজের আয়ত্তে এনে নিলো কৌশলে।
তারপর একদিন শ্যামনারায়ণকে জ্বর দ্বারা হত্যা করলো রাজনারায়ণ, বৌদিও বাদ গেলো না।
একদিন রাতে স্বামীশোকে কাতর বৌদি কচি দুটি বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছেন নিজের শয়নকক্ষে। এমন সময় তার কক্ষে প্রবেশ করে রাজনারায়ণ, তার পিছনে জমকালো ভূতের মত নিগ্রো শয়তান জব্রু।
জব্রুকে দেখে শিউরে উঠেছিলো বৌদি এতো রাত্রে তার কক্ষে সে কেন। কিন্তু রাজনারায়ণকে দেখে বুকে সাহস হয়েছিলো, পরক্ষণেই তার মুখে দৃষ্টি পড়তেই বৌদির দেহের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিলো। রাজনারায়ণের দু’চোখে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।
করুণ কণ্ঠে বলেছিলো বৌদি ঠাকুরপো, এতো রাত্রে তোমরা আমার ঘরে কেন?
রাজনারায়ণ দাতে-দাত পিষে বলেছিলো একটু পরেই টের পাবে কেন এসেছি আমরা। পরক্ষণেই রাজনারায়ণ জব্রুর দিকে তাকিয়ে কিছু ইংগিত করেছিলো।
সঙ্গে সঙ্গে জব্রু তার লৌহসবল হাত দু’খানা বাড়িয়ে চেপে ধরেছিলো বৌদির গলা। একটু-টু শব্দ বের হয়নি তার কণ্ঠ দিয়ে।
পরদিন স্বপন আর কল্পনা তাদের শয্যায় মাকে মৃত অবস্থায় দেখেছিলো।
কচি শিশু তখন স্বপন আর কল্পনা। ওরা জানে না, কি করে তাদের মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
শয়তান রাজনারায়ণ বড় ভাই এবং বৌদিকে সরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও একেবারে নিশ্চিন্ত হলো না। কিন্তু চট করে কচি দুটি শিশুকে হত্যা করতেও সাহসী হলো না সে। ভাবলো ওদের হত্যা করতে আর কতক্ষণ। এখন তো আর তার কাজে বাধা দেয়ার নেউ নেই। যা খুসি সে করে যাবে। এ বাড়ি ঘর ঐশ্বর্য সব এখন তার। বাচ্চা দুটি তো চুনের ফোঁটা। জ্বর নখের টিপ দিলেই ওরা চলে যাবে পরপারে। কাজেই বাচ্চা দুটোর জন্য আর বেশি ভাবতে হবে না।
রাজনারায়ণ দাদা শ্যামনারায়ণের গদি দখল করে নিয়ে জেঁকে বসলো। এখন সে পূর্বের সেই দীনহীন রাজনারায়ণ নয়। এখন সে রাজ-রাজেশ্বর, কোটি টাকার মালিক রাজনারায়ণ। সে গোপনে দিল্লীর বুকে নানারকম কুকর্ম শুরু করলো। মুসলমান নাম ধারণ করে গুলশান হোটেলের ম্যানেজার সেজে চালালো তার নানারকম মন্দ ব্যবসা। জব্রু হলো তার দক্ষিণ হস্ত। জব্রুকে দিয়ে সে রাতে শহরে নানা রকম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে চললো। জব্রুকে কেউ যেন নিহত করতে না পারে সেজন্য তার দেহে লৌহ বর্ম পরিয়ে দিতো রাজনারায়ণ।
গভীর রাতে রাজনারায়ণ তার ভূগর্ভের আস্তানায় যেতো এবং জব্রু তখন বিচরণ করতো রাতের ভয়ঙ্করের মত পৃথিরাজের রাজপ্রসাদের আনাচে-কানাচে। কারণ পৃথিরাজের শিব মন্দিরেই ছিলো রাজনারায়ণবেশী রিজভীর আস্তানার সুড়ঙ্গ মুখের গোপন দ্বার।
রাজনারায়ণ পরম নিশ্চিন্তে তার কার্য সাধন করে চললেও মনে তার কাঁটার খোঁচা ছিলো, যতক্ষণ স্বপন আর কল্পনাকে তার পথ থেকে সরাতে না পেরেছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই।
ক্রমেই বড় হয়ে উঠেছে ওরা, পিতামাতা সম্বন্ধে তাদের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। পিতার ঐশ্বর্যের প্রতি আসছে মোহ, কাজেই আর বিলম্ব নয়।
এবার পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতেই হবে।
খুনের নেশায় উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে রাজনারায়ণ। রিভলভার খুঁজে না পেয়ে বের করলো তার সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরাখানা। আংগুল দিয়ে ধার পরীক্ষা করে দেখলো, তারপর বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে।
হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে রাজনারায়ণ বার বার।
রাত দুটো প্রায় বাজতে চলেছে। সন্ন্যাসীর জন্য প্রতীক্ষা করছে সে।
জব্রুও জেগে উঠে সজাগ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোনো অস্ত্রের প্রয়োজন হয় না। জব্রুর হাত। দু’খানাই হলো লৌহ সাড়াশী। এ হাত দু’খানা দিয়ে সে যা খুসি তাই করতে পারে। শুধু রাজনারায়ণ রিজভীর সামান্য ইঙ্গিত মাত্র।
জব্রুর দেহে লৌহ বর্ম পরিয়ে দেয়া হয়েছে।
রাজনারায়ণের পাশে নিদ্রাজড়িত চোখে দাঁড়িয়ে আছে স্বপন আর কল্পনা। মুখ তাদের বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। কই, সন্ন্যাসী বাবা তো তাদের বাঁচাতে এলেন না। তবে কি সব ফাঁকি? সন্ন্যাসী বাবাও কি। তাদের সঙ্গে ছলনা করেছে!
প্রথমে স্বপন আর কল্পনা কিছুতেই রাজি হয়নি তাদের কাকার সঙ্গে যেতে। কিন্তু রাজনারায়ণ যখন তাদের ভীষণভাবে শাসন করেছিলো তখন রাজি না হয়ে কোনো উপায় ছিলো না। ভেবেছিলো, একদিন যখন মরতে হবে তখন মরবে তারা। দু’ভাই বোন সানন্দে মৃত্যুকে বরণ করে নেবে।
হঠাৎ সন্ন্যাসী এসে হাজির হলো।
রাজনারায়ণের চোখ দুটো খুসিতে ভরে উঠলো।
তেমনি খুসি হলো স্বপন আর কল্পনা। মনে তাদের সাহস হলো সন্ন্যাসী বাবাজী এসেছে, আর হয়তো তাদের যেতে হবে না। হয়তো এবার তিনি রক্ষা করবেন তাদের দুজনকে।
কিন্তু একি, সন্ন্যাসী বাবাজী তাদের হয়ে দুটো কথাও বললেন না। বরং তাদের যেন দেখেননি কোনোদিন, এমনি ভাব দেখাচ্ছেন। কিন্তু তিনি যদি তাদের মঙ্গলের জন্যই না আসবেন তবে এতো রাতে কি করতে এসেছেন এখানে। তবে কি তাদের কাকার সঙ্গে তারও যোগ আছে। শিউরে উঠলো ওরা-হয়তো তাই হবে, নাহলে…
একটা লোক এসে বললো–গাড়ি প্রস্তুত মালিক।
রাজনারায়ণ এবার সন্ন্যাসী বাবাজীসহ অগ্রসর হলো। তাদের পিছনে স্বপন আর কল্পনা এলো।
জব্রুও আছে সকলের পিছনে।
জব্রু স্বপন আর কল্পনার অপরিচিত নয়। আরও কত দিন ওর সঙ্গে বেড়াতে গেছে ওরা। তবু আজ এতো রাতে ব্রুকে তাদের সঙ্গে যেতে দেখে কেমন সন্দেহ জাগলো তাদের মনে।
স্বপন আর কল্পনার মুখে কোনো কথা নেই।
মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপছে ওরা।
গাড়ি ছুটে চলেছে।
গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতায় পথ থম থম করছে। ট্রাফিক পুলিশ নেই, কিন্তু ট্রাফিক আলোগুলো পথের বাকে নিয়মিত কাজ করে চলেছে।
ট্রাফিক আলো তার রক্তচক্ষু বিস্ফারিত করে গাড়িখানাকে ক্ষান্ত হবার জন্য নির্দেশ দিলো কিন্তু খুনের নেশায় উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে রাজনারায়ণ, ট্রাফিক আলোর রক্তচক্ষুর ভয়ে সে ক্ষান্ত হলো না। তার গাড়িখানা তীব্রগতিতে চলে গেলো পার হয়ে।
ড্রাইভিং আসনে রাজনারায়ণ স্বয়ং উপবেশন করেছে। নিজে গাড়ি চালাচ্ছে সে।
তার পাশে বসে সন্ন্যাসী বাবাজী।
পিছন আসনে জব্রু আর স্বপন ও কল্পনা।
স্বপন আর কল্পনা বলির পশুর মত যেন কুকুঁড়ে গেছে, বিশেষ করে কল্পনা নীড়হারা পাখির মত ভাইকে আঁকড়ে ধরে কাঁপছে।
শহর ছেড়ে নির্জন পথে গাড়ি ছুটছে এখন।
দুই ধারে গহন বন।
ভয়ে শিউরে উঠে স্বপন আর কল্পনা।
কল্পনা বলে উঠে–কাকা, আমাদের আপনি কোথায় নিয়ে চলেছেন? ড্রাইভ আসন থেকে বলে রাজনারায়ণ–নিরাপদ স্থানে। ভয় নেই চুপচাপ বসে থাকো।
সন্ন্যাসী বাবাজী মাঝে মাঝে উচ্চারণ করছিলো হর হর শিবও শঙ্করও…হর হর শিবও শঙ্কর…
ক্রমেই এমন পথে গাড়ি এসে পড়েলো, যে পথে আলোর কোন সন্ধান নেই।
সন্ন্যাসীবেশী বনহুর তার চোরা পকেটে রিভলভারের অস্তিত্ব অনুভব করে নিলো।
এবার স্বপন আর কল্পনার সন্দেহ সত্য বলে মনে হলো। সন্ন্যাসীও যে তার কাকার লোক তাতে কোনো ভুল নেই। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো তারা।
রাজনারায়ণ জীপগাড়ি অসমান বনভূমির মধ্যে অগ্রসর হচ্ছে। দু ধারে গহন জঙ্গল, গাড়ির সার্চলাইটের আলোতে পথের পাশে বন্য জন্তুগুলো ছুটে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিলো।
বনহুর আপন মনে হাসছে।
রাজনারায়ণের মনে আজ খুনের নেশা। এদের দুজনকে হত্যা করতে পারলেই সে নিশ্চিন্ত। আর কেউ থাকবে না তার পথে বাধা হিসেবে। সন্ন্যাসী বাবাও তার পরম হিতৈষী। তার কথা-মতই স্বপন আর কল্পনাকে নিয়ে চলেছে সে গহন বনের মধ্যে, হত্যা করে ভাসিয়ে দেবে ওদের মৃতদেহ যমুনা নদীবক্ষে। তারপর আপদ চুকে যাবে। সন্ন্যাসী বাবার শুধু চাই কুমার এবং কুমারীর তাজা রক্ত।
এক সময় রাজনারায়ণের গন্তব্য স্থানে তারা পৌঁছে যায়।
গাড়ি রেখে নেমে পড়লো রাজনারায়ণ। দরজা খুলে ধরে অনুনয়ের সুরে বললো–আসুন গুরু বাবাজী!
সন্ন্যাসীবেশী দস্যু বনহুর নেমে দাঁড়ালো–হর হর শিবও শঙ্করও!
জব্রুও নামলো গাড়ি থেকে।
অসহায়ের মত কাঁপছিলো স্বপন আর কল্পনা।
রাজনারায়ণ বললো এবার–নেমে এসো তোমরা দু’জনা।
কল্পনা স্বপনের হাত দু’খানা জড়িয়ে ধরলো–না, আমরা নামবো না। আপনি আমাদের এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন?
কঠিন কণ্ঠে বললো রাজনারায়ণ–নেমে এসো তোমরা।
স্বপন এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আমাদের আপনি হত্যা করবেন জানি। তা বাড়িতেই করলে পারতেন?
নেমে এসো, কথা বাড়িও না বলছি। বললো রাজনারায়ণ।
কল্পনা তো হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো–দাদা, এবার কি হবে আমাদের! দাদা গো, দাদা…
স্বপন নেমে পড়লো গাড়ি থেকে, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো সন্ন্যাসীর পা দু’খানা। কেঁদে ফেললো। সে–সন্ন্যাসী বাবাজী, আমাদের বাঁচান… বাঁচান…
রাজনারায়ণ এক ঝটকায় টেনে তুলে নিলো স্বপনকে। তারপর জব্রুকে ইংগিত করলো!
জব্রু অমনি কোমরের বেল্ট থেকে খুলে নিলো সূতীক্ষ ধার ছোরাখানা। জীপ গাড়ির সার্চলাইট জ্বলছে, তারই আলোতে বনভূমি আলোকিত হয়ে উঠেছে। জব্রুর হাতে ছোরাখানা ঝক্-ম করে। উঠলো।
স্বপন আর কল্পনা শিউরে উঠলো।
রাজনারায়ণ এবার কল্পনাকে টেনে নামিয়ে আনলো গাড়ি থেকে।
সন্ন্যাসী বাবাজী শব্দ করে উঠলো–হর হর শিবও-শঙ্করও…হর হর শিবও শঙ্করও…
জব্রু স্বপন আর কল্পনাকে টেনে নিয়ে গেলো যমুনার তীরে। গাড়ির আলো এখানে স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে।
রাজনারায়ণ গেলো তাদের সঙ্গে।
রাজনারায়ণ প্রথম স্বপনকে হত্যা করার জন্য ইংগিত করলো।
জব্রু হুঙ্কার ছাড়লো–হুম হুম হুয়াম–সঙ্গে সঙ্গে সে ছোরাখানা উদ্যত করে রুখে দাঁড়ালো।
কল্পনা আর্তনাদ করে দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেললো।
পরক্ষণেই বনভূমি প্রকম্পিত করে গর্জে উঠলো রিভলভারের শব্দ।
অমনি ভয়ঙ্কর একটা তীব্র শব্দ করে খুরপাক খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো জব্রু ভূতলে!
সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকালো রাজনারায়ণ। রাগে ক্ষোভে, বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো, দেখলো সন্ন্যাসী বাবাজীর দক্ষিণ হস্তে উদ্যত রিভলভার। তার মুখের দাড়ি খসে পড়েছে, অস্পষ্ট হলেও রাজনারায়ণের চিনতে বাকি রইলো না–এ যে মিঃ আলম–স্বয়ং দস্যু বনহুর।
রাজনারায়ণ প্রথমে হকচকিয়ে গেলো, পরক্ষণেই আঁচ করে নিলো ব্যাপারটা। মুহূর্তে বিলম্ব না। করে ভূতললুণ্ঠিত মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট্ত জর হাতের মুঠা থেকে ছোরাখানা তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।
কল্পনা তখন ছুটে এসে স্বপনকে জাপটে ধরলো–দাদা, দাদা…
স্বপন তখন শুদ্ধ হয়ে দেখছে, এ যেন তার কল্পনার বাইরে।
সন্ন্যাসী বাবার প্রতি তার যে একটা ভুল ধারণা জন্মেছিলো এক্ষণে তার দূরীভূত হয়ে যায়।
ভাই এবং বোন দু’জন দু’জকে আঁকড়ে ধরে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত তাকিয়ে থাকে। থরথর করে কাঁপছে দু’জনা।
দস্যু বনহুর রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছে, অন্ধকারে চোখ দুটো জ্বলছে তার। এগিয়ে আসছে বনহুর রাজনারায়ণের দিকে। দক্ষিণ হস্তে উদ্যত রিভলভার।
রাজনারায়ণ ভড়কে গেলেও সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরা বাগিয়ে ধরে রুখে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু এগুবার সাহস পাচ্ছে না সে।
বনহুর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠে–রক্ত চেয়েছিলাম, এক জনের নিয়েছি। এবার তোমার রক্ত চাই। …হাঃ হাঃ হাঃ বনহুরের হাস্যধ্বনিতে বনভূমি প্রকম্পিত হয়ে উঠে।
শয়তান দুবৃত্ত, রাজনারায়ণ সে হাসির শব্দে ভড়কে যায়। তবু সে ছোরাখানা ঠিকভাবে বাগিয়ে রাখে।
বনহুর বলে উঠে আবার–জব্রুর দ্বারা অনেক করেছো, এবার তোমার শক্তি পরীক্ষার পালা রাজনারায়ণ।
স্বপন আর কল্পনার চোখেমুখে বিস্ময়। সন্ন্যাসী বাবাজী যে অদ্ভুত শক্তিশালী ব্যক্তি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে তারা। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসছে ওদের, কৃতজ্ঞতায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছে না বা বলার মত অবস্থাও এখন নয়। ওরা তাকিয়ে আছে শুধু।
গাড়ির সার্চলাইটের আলোতে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
জমকালো জব্রুর পাহাড়ের মত দেহটা কিছুক্ষণ ছট ফট করে নীরব হয়ে গেছে। আজ বনহুর তার পিছন দিক থেকে পিঠে গুলী করেছিলো। বনহুর জানতো, জব্রুর বুকে লৌহবর্ম আঁটা থাকে, তার বুকে কিছুতেই গুলী বিদ্ধ হবে না। এবার তাই সে পিছন থেকে গুলী করেছিলো।
রাজনারায়ণের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, সে ভীত নজরে তাকাচ্ছে বনহুরের দিকে।
বনহুর বললো–জীবনে অনেক পাপ করেছো রাজনারায়ণ। শুধু পাপই করোনি, তুমি বহু নিষ্পাপ প্রাণ বিনষ্ট করেছো। মিস লুসীর ফুলের মত একটা জীবনকে তুমি সমূলে ধ্বংস করেছে। আবার এই দু’টি অসহায় কচি জীবন-প্রদীপ আজ নিভিয়ে ফেলতে চেয়েছিলে, ক্ষমা তোমাকে করা যায় না…
ঠিক সে মুহূর্তে রাজনারায়ণ ছোরা হস্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে যায় বনহুরের উপর।
কিন্তু সে সুযোগ আর দেয় না বনহুর তাকে, তার হস্তের রিভলভার গর্জে উঠে।
অমনি তীব্র আর্তনাদ করে ঘুরপাক খেয়ে জব্রুর বুকের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে রাজনারায়ণ। রাজনারায়ণের বুকের রক্ত আর জুরুর রক্ত মিশে এক হয়ে যায়।
যমুনার তীরে পাশাপাশি পড়ে থাকে দু’টি মৃতদেহ।
রাজনারায়ণের দেহ নীরব হয়ে যায়।
বনহুর এগিয়ে আসে স্বপন আর কল্পনার দিকে।
স্বপন আর কল্পনা বনহুরের পায়ে প্রণাম করতে যায়।
ধরে ফেলে বনহুর, বলে–আমি সন্ন্যাসী নই, তোমাদের মতই একজন মানুষ।
স্বপন আর কল্পনার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে, কোনো কথা তাদের মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। তারা যে জীবনে বেঁচে আছে একথা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। কে এ মহান ব্যক্তি যে এতো শক্তিমান। যে এতো সহজে দুটি হিংস্র প্রাণ ধ্বংস করতে সক্ষম হলেন।
বললো বনহুর–তোমরা এবার নিশ্চিন্ত। তোমাদের মৃত্যুদূতকে আমি সরিয়ে দিয়েছি। চলো, তোমাদের বাসায় পৌঁছে দি।
স্বপন বললো এতোক্ষণে–আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বাবাজী…
হেসে বললো বনহুর–বাবাজী নয়, বলো দাদা। আর ধন্যবাদ দিতে হবে না, আমি তোমাদেরই একজন।
বনহুর দু’ভাই-বোনকে গাড়িতে তুলে নিলো।
বললো স্বপন–এ জঙ্গলে আমি তো গাড়ি চালাতে পারবো না দাদা।
বনহুর বললো–তোমাকে চালাতে হবে না ভাই, তোমরা চুপ করে বসো, আমি তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।
অবাক হয়ে কল্পনা বললো–আপনি গাড়ি চালাতে জানেন?
তোমাদের দাদা সব জানে, বসো বোন। বনহুর ড্রাইভিং আসনে বসে গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো।
গহন বনে বনহুরের হাতে গাড়িখানা ছুটতে শুরু করলো। পিছনে পড়ে রইলো জুক্ত আর রাজনারায়ণের প্রাণহীন দেহ দুটো।
নিয়তির কি পরিহাস!
মারতে গেলে কাদের আর মরলো কারা।
রাজনারায়ণ কি জানতো আজ তাদের আয়ু শেষ হয়ে গেছে।
ভেবেছিলো সে–স্বপন আর কল্পনাকে পথ থেকে সরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে পৃথিবীর বুকে বিচরণ করে ফিরবে।
*
সেদিন স্বপন আর কল্পনা কিছুতেই বনহুরকে ছেড়ে দিলো না। বনহুরও ফেলতে পারলো না ভাই বোনের অনুরোধ। তারা যেন বহুদিন পর আপন দাদাকে ফিরে পেয়েছে। সেকি আনন্দ তাদের!
এ শহরে দস্যু বনহুরকে কেউ চেনে না।
কাজেই স্বপন আর কল্পনার দাদা হতে তার কোনো অসুবিধা হলো না। বনহুর সাবধান করে দিয়েছে স্বপর আর কল্পনাকে–তারা যেন কারো কাছে ভুলেও কোনোদিন না বলে তার কাকা রাজনারায়ণ আর জব্রু কোথায় গেছে।
স্বপন আর কল্পনা বনহুরকে পেয়ে আনন্দে অধীর! বনহুর যেন তাদের কত পুরোনো বন্ধু বা দাদা। ওরা দু’জনা দাদা বলতে পাগল।
বনহুরের সঙ্গেই সারাদিন দিল্লী শহরটা ওরা চষে ফেরে। অবশ্য বনহুরের উদ্দেশ্য তার সন্ন্যাসী বাবাজীকে অন্বেষণ করা। কাজেই সেও রয়েই গেলো কয়েকদিনের জন্য।
এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায় তিন জনা।
কিন্তু বনহুর সন্ন্যাসীর সন্ধান পেলো না। মনটা তার ছট-ফট করে উঠলো, তবে কি সন্ন্যাসীর বাবা শহরে কোথাও আটকা পড়েছে? হয়তো তাই হবে। বনহুর নিজে সন্ন্যাসী সেজে শহরে সন্ন্যাসীদের আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। অবশ্য স্বপন আর কল্পনার অগোচরে সে একাজ করতো।
বলতো স্বপন দাদা, আপনি মাঝে মাঝে কোথায় চলে যান বলুন তো?
হেসে জবাব দিতে বনহুর–আমার যে অনেক কাজ ভাই, তাই আমাকে যেতে হয়!
সত্যিই বনহুর শুধু এক কাজ নিয়ে মেতে থাকে না। সন্ন্যাসীদের আখড়ায় আড্ডা দিয়ে সন্ন্যাসী বাবাজীর সন্ধান করে, আরও খোঁজ নেয়–সত্যিই এরা আসল সন্ন্যাসী কিনা বা এরা কোনো শয়তান দলের লোক কিনা।
*
বেশিদিন বিলম্ব করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। একদিন স্বপন আর কল্পনার কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে যায় বনহুর কেশব আর নূরীর কাছে।
কিন্তু আশ্রমে গিয়ে অবাক হয়ে যায়, কুঠির শূন্য–কেউ নেই। বনহুর ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে–নূরী– নূরী–নূরী কোথায় তুমি…
প্রতিধ্বনি ফিরে আসে, নেই নেই নেই–সে নেই…
দুর্দান্ত দস্যু সর্দার বনহুর মুষড়ে পড়ে, ধপ করে বসে পড়ে সে কুঠিরের বারান্দায়। বেদনা কাতর চোখে চারদিকে তাকিয়ে অন্বেষণ করে সে, কোথায় নূরী আর কেশব। সন্ন্যাসী বাবাজীও হয়তো আর ফিরে আসেননি। কেশব আর নূরী গেলো কোথায়? তবে কি কেশবের সঙ্গে নূরী চলে গেছে? কিন্তু কেন সে যাবে তার সঙ্গে। বনহুরের শরীরের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠে। তাহলে কি কেশবের সঙ্গে নূরীর কোনো সম্বন্ধ ছিলো? বহুদিন একত্রে বসো-বাস করার দরুণ হয়তো…না না, তা হয় না, নূরী সে ধরনের মেয়ে নয়। পরক্ষণেই আবার মনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে নূরী আর কেশবের উপর।
উঠে দাঁড়ায় বনহুর, অবশ শিথিল পা দু’খানা টেনে নিয়ে চলে নদীতীরে। যেখানে নূরী আর সে বসে বসে দু’জনার জীবনের ঘটনা বর্ণনা করতো। একটা গাছের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ায় বনহুর। তাকিয়ে থাকে সে নদীবক্ষে। একটা মুখ ভেসে উঠে নদীর জলে–অসহায় করুণ মৃত্যুমলিন সে মুখ– লুসী। বনহুরের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রু!
গোটাদিন ধরে সমস্ত বনটা চষে ফিরলো বনহুর। নূরী বা কেশবের কোনো সন্ধান পেলো না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো একসময়।
বনহুর নীরবে প্রবেশ করলো সেই কক্ষে, যে কক্ষে সে পেয়েছিলো নূরীর সাক্ষাৎ। এক পাশে গুটানো রয়েছে খেজুর পাতার চাটাইখানা।
বনহুর চাটাইখানা বিছিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো চীৎ হয়ে। অন্ধকার কক্ষ, আলো জ্বালার কোনো উপায় নেই। পিপাসায় কণ্ঠ শুকিয়ে এসেছে। গোটা দিন তার মুখে কিছু পড়েনি।
শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, পকেট থেকে ম্যাচ বের করে জ্বাললো। কক্ষটা ক্ষণিকের জন্য আলোকিত হলো, দেখলো ওপাশে মাটির প্রদীপটা তৈলবিহীন অবস্থায় দীপগছায় রয়েছে। শুষ্ক সলতেটায় ম্যাচের কাঠিটা বাড়িয়ে ধরলো বনহুর, কিন্তু তেলহীন সলতে জ্বললো না।
অত্যন্ত পিপাসা বোধ হওয়ায় এগিয়ে গেলো বনহুর কলসীটার দিকে। কিন্তু কলসী শুন্য, বনহুর হাত দিতেই কলসীটা গড়িয়ে পড়লো একদিকে।
বনহুর ফিরে এলো শয্যায়।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো কত কথা। ভাবলো, আগের মত আজও যদি তার শিয়রে এসে বসতো নূরী, হাত রাখতো তার মাথায়। বনহুর ওকে খপ করে ধরে ফেলতো, বলতো কোথায় গিয়েছিলে তুমি? হেসে জবাব দিতো নূরী, সে অনেক দূর গিয়েছিলাম–সাত সমুদ্র তের নদী পার…না না এসব আবোল-তাবোল কি চিন্তা করছে সে। নূরী তার সঙ্গে ছলনা করেছে, তাকে ধোকা দিয়েছে সে। নূরী সম্বন্ধ গড়ে তুলেছে কেশবের সঙ্গে। নিশ্চয়ই কেশব আর নূরীর মধ্যে অস্পৃশ্য একটা…বনহুর নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে লাগলো। অধর দংশন করতে লাগলো সে।
সমস্ত রাত্রি অসহ্য যন্ত্রণায় কাটলো বনহুরের। এতোটুকু ঘুম এলো না তার চোখে। কেনই বা নূরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিলো, কেনই বা আবার বিচ্ছেদ ঘটলো। তার জীবন থেকে মুছে গিয়েছিলো নূরী সেই ভালো ছিলো!
বনহুর আবার ফিরে এলো দিল্লী নগরীতে। আনন্দে আপ্লুত হলো স্বপন আর কল্পনা। বনহুরকে পেয়ে খুসিতে উচ্ছল হলো তারা।
বনহুর নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। মনের জমাট ব্যথা-বেদনা আর দুশ্চিন্তাকে ভুলে থাকার জন্য স্বপন আর কল্পনাকে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। তাজমহল, দিল্লীর দুর্গ, আকবরের সমাধি–বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায় বনহুর ওদের নিয়ে। সন্ন্যাসী। বাবাজী, কেশব আর নূরীর কথা সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করে।
কিন্তু কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারে না, ভুলতে পারে না কদিন আগের স্মৃতিগুলো। হাতড়ে চলে সে কেশব আর নূরীর আচরণের প্রতিটি ধাপ। সত্যিই কি নূরী আর কেশব…না না, ভাবতেও তার মন ঘৃণায় বিষিয়ে উঠে!
বনহুর সারাদিন স্বপন আর কল্পনাকে নিয়ে মেতে থাকলেও রাত্রির অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ে তার সেই চিরপরিচিত জমকালো ড্রেসে। দিল্লী শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ায় আত্মগোপন করে। সন্ধান করে ফেরে কোথায় কাঁদছে অসহায় জনগণ এক মুষ্টি অন্নের তরে। কোথায় ধুকে ধুকে মরছে বিনা ঔষধে মুমূর্ষ রোগিগণ। কোথায় অসহায় নারীর অমূল্য ইজ্জৎ বিনষ্ট হতে চলেছে কোন শয়তান লম্পটের পাপময় নিষ্পেষণে। বনহুর বিনা দ্বিধায় হত্যা করে চললো এই সব পাপ-জর্জরিত কুৎসিৎ লোকদের। তাদের অর্থ লুটে নিয়ে বিলিয়ে দিতে লাগলো নিঃসহায় সম্বলহীন রিক্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে।
শহরে জাগলো আতঙ্ক। এক মহা ভীতিকর ভাব। কে এসব হত্যা সংঘটিত করে চলেছে। কে এসব অর্থ লুটে নিচ্ছে। পুলিশ মহলে সাড়া পড়ে গেলো। সি আই ডি পুলিশ সমস্ত শহরে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো কিন্তু কেউ হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো না।
এমন দিনে দিল্লীর পুলিশ সুপার হয়ে এলো মনিরার বান্ধবী মাসুমার স্বামী হাশেম চৌধুরী। মাসুমা শেষ পর্যন্ত মনিরাকে নিয়ে এলো সঙ্গে। মনিরার অমত টিকলো না, মামীমাও জেদ করে পাঠিয়ে দিলেন তাকে। কারণ, মনিরা সবসময়ে গভীরভাবে চিন্তা করে। দিন দিন সে ক্ষীণ দুর্বল হয়ে পড়ছে, কিছুদিন বিদেশে ঘুরে এলে তবু একটু মনোভাব পাল্টাতে পারে তার।
নূর রয়ে গেলো তার দাদীমার কাছে। সরকার সাহেব আর দাদীমা মিলে নূরের সেবায় রইলেন। পড়াশোনা করছে, তাই সে মায়ের সঙ্গে আসতেও চাইলো না। বিশেষ করে মরিয়ম বেগমকেই নূর বেশি ভালবাসতো।
মরিয়ম বেগম নূরকে বুকে নিয়ে পুত্রশোক ভুলতে চেষ্টা করতেন, তাই তিনি সব সময় ওকে নিজের কাছে কাছে সস্নেহে আঁকড়ে ধরে রাখতেন। নূরও তাকে মায়ের চেয়ে বেশি সমীহ করতো।
মনিরা দিল্লী এলো বটে কিন্তু মনের অবস্থা তার মোটেই প্রসন্ন হলো না।
হাশেম চৌধুরী আর মাসুমা বান্ধবী মনিরাকে নিয়ে এখানে-ওখানে দিল্লীর প্রসিদ্ধ স্থানগুলো দর্শন করে বেড়াতে লাগলো। পুলিশ সুপার-পত্নী মাসুমা ও তার বান্ধবী যখন যেখানে যায়–সঙ্গে থাকে পুলিশ, আদালী আর থাকে বন্দুকধারী দেহরক্ষী।
স্বপন আর কল্পনাদের বাড়ির অদূরেই পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরীর বাংলো।
কল্পনা অত্যন্ত মিশুক মেয়ে। সে ছোটবেলা হতেই যে পুলিশ সুপার আসেন তার কন্যার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিতো। হাশেম চৌধুরী এখানে আসার পূর্বে এক বয়স্ক ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁর মেয়ে মিস জেসমিন্ ছিলো কল্পনার বান্ধবী। তারা চলে যাবার পর এসেছেন হাশেম চৌধুরী তার স্ত্রী এবং মনিরাকে নিয়ে এ বাংলোয়।
একদিন কল্পনা গিয়ে ভাব জমিয়ে নিলো মাসুমা আর মনিরার সঙ্গে। কল্পনাকে পেয়ে মুগ্ধ হলো মাসুমা আর মনিরা। ওকে বড় ভালো লাগলো এই বিদেশ বিভূঁয়ে। নানা গল্পসল্পের মধ্যে অল্প সময়ে কল্পনা ওদের আপন করে নিলো।
তারপর প্রায়ই আসতো কল্পনা হাশেম চৌধুরীর বাংলোয়। একদিন মাসুমা বললো–কল্পনা, তোমার মাকে বেড়াতে আসতে বলো, কেমন?
কল্পনার মুখ বিষণ্ণ মলিন হলো, বললো সে–আমার বাবা-মা কেউ নেই। গলা ধরে আসে কল্পনার, চোখ দুটো অশ্রু ছলছল হয়ে উঠে।
মাসুমা আর মনিরা ব্যথা অনুভব করে তার কথায়।
মনিরার হৃদয়েই বেশি আঘাত করে তার কথাটা। কারণ সেও পিতৃ-মাতৃহারা অসহায়। কল্পনার বেদনা সে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে। বলে মনিরা বোন, তোমার কে আছে তবে?
আমার শুধু একটি ভাই, আর একটি দাদা আছেন। আমার ভাই বড় দুষ্ট কিন্তু আমার দাদা বড় ভাল, আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করেন। আপনারা যাবেন দিদি আমাদের বাড়ি বেড়াতে?
কল্পনা মাসুমাকে বৌদি আর মনিরাকে দিদি বলে ডাকে।
কল্পনার কথায় বলে মনিরা–যাবো বোন, একদিন আমরা যাবো তোমাদের বাড়িতে।
এখানে কল্পনার সঙ্গে মনিরা যখন নানা গল্পে মেতে উঠেছে তখন তার দাদা দস্যু বনহুর এক। বাঈজীর বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছে, ধনকুবের রামচরণকে অনুসরণ করেই সে এসেছে এখানে। রামচরণ দিল্লীর সেরা ধনবান, তার অর্থ সৎ উপায়ে উপার্জিত নয়। নানারকম কুকর্ম দ্বারা সে প্রচুর। অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। দিনে সে অর্থ লুটে নেয়, রাতে তা উজাড় করে দেয় বাঈজীর চরণে।
বনহুর আজ কদিন হলো রামচরণকে অনুসরণ করে তার কার্যকলাপ লক্ষ্য করে চলেছে। সত্যিই। সে শয়তান কিনা, এ সন্ধানটাই সে সংগ্রহ করে যাচ্ছে।
কয়েক দিন বনহুর পর পর এসেছে এখানে।
বাঈজী বনহুরের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে তাকে বাগিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে। বনহুর অভিনয় করেছে, অর্থ ঢেলে দিয়েছে উজাড় করে। কিন্তু ধরা দেয়নি সে সম্পূর্ণরূপে।
বাঈজী নাচ দেখাচ্ছিলো। অপরূপ সজ্জায় সজ্জিত বাঈজী। চরণে নুপূর, সমস্ত দেহ মূল্যবান অলঙ্কারে আচ্ছাদিত তাকিয়ায় ঠেশ দিয়ে বসে আছে ধনকুবের রামচরণ। বয়স তার পঞ্চাশের উপর, তবু তার সখ কমেনি। বাঈজী বাড়ি আসা তার নিত্য অভ্যাস।
বনহুর রামচরণের পাশে বসেছে।
আরও কয়েক জন লোক বসে নেশায় ঢুলু ঢুলু করছে আর মাঝে মাঝে জড়িত কণ্ঠে আবোল তাবোল বকছে।
রামচরণ তেওয়ারী তখন মশগুল, বাঈজীর নাচ তাকে বিমুগ্ধ করে ফেলেছে। অভিভূতের মত তাকিয়ে আছে সে বাঈজীর দিকে।
বাঈজী আনন্দে আত্মহারা। বিশেষ করে বনহুরকে দেখে তার মনে খুসির উৎস বয়ে চলেছে। চরণে ঝঙ্কার তুলে নেচে চলেছে বাঈজী।
বনহুর আলগোছে তুলে নেয় রামচরণ তেওয়ারীর পকেট থেকে মানিব্যাগটা। তারপর উঠে দাঁড়ায় আলগোছে।
বাঈজীর নাচ তখন শেষ হয়ে এসেছিলো, বনহুরকে উঠতে দেখে এগিয়ে গেলো তার দিকে উঠলে কেন বাবুজী?
আজ ঐ বাবুজীদের খুসি করো সুন্দরী, আমি আর একদিন আসবো। কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে যায় বনহুর।
ফিরে আসে বাসায় বনহুর এবার।
পথের মধ্যে মানিব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নোটগুলো পকেটে রেখেছিলো বনহুর। আসার পথে স্বপন আর কল্পনার জন্য দুটো হীরক আংটি এনেছিলো বনহুর।
বনহুর আসতেই স্বপন আর কল্পনা ছুটে এলো গাড়ির পাশে। নেমে এলো বনহুর, স্বপন একটি হাত ধরলো আর কল্পনা ধরলো আর একটি হাত।
বনহুর এসে দাঁড়ালো হলঘরে।
কল্পনা বললো–দাদা, আজ আমি পুলিশ সুপারের বাংলোয় বেড়াতে গিয়েছিলাম। জানো দাদা, ও বাড়িতে দুটো বৌ আছে। বড় ভাল মেয়ে।
তাই নাকি? বেশ তো, তোমার তাহলে খুব মজা হলো। এবার দেখ আমি তোমাদের জন্য কি এনেছি। বনহুর পকেট থেকে বের করে মূল্যবান আংটি দুটো। বলো–কে কোন্টা নেবে?
কল্পনা আর স্বপন যার-যেটা পছন্দ তুলে নেয়।
স্বপন বলে–কি দরকার ছিলো দাদা এসব আনার?
কল্পনা বললো এবার –বারে, দাদা দেবেন না তো কে দেবেন?
হেসে বলে বনহুর–কল্পনা, ঠিক বলেছো বোন।
হঠাৎ কল্পনা উজ্জ্বল হয়ে উঠে–ঠিক্ কিন্তু ও বাড়ির দিদি এমনি করে আমাদের আদর করে। সত্যি দাদা, তোমার মত–
কল্পনা আর স্বপন বনহুরকে অত্যধিক আপন জনের মত তুমি বলে সম্বোধন করতো।
*
বনহুর এমনি করে স্বপন আর কল্পনার মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এক টেবিলে বসে খায় ওরা তিন জনা, এক সঙ্গে গল্প করে, এক সঙ্গে বেড়ায়। শুধু রাতের বেলা বনহুরের জন্য আলাদা কক্ষ। সে নিজে ইচ্ছা করে বেছে নিয়েছে তার থাকার জন্য ঘরখানা।
রাতের খাওয়া শেষ করে চলে আসে নিজের ঘরে। এ ঘরখানা সম্পূর্ণ বাড়ির পিছন ভাগে। স্বপন অনেক বলেও তাকে সম্মুখে ভাল সুন্দর কক্ষ নেওয়াতে পারেনি। বনহুর যে কক্ষে থাকে সে কক্ষ বেশ নিরিবিলি এবং এক পাশে। ওদিকেই বাগান। নানা রকম ফলমূল আর ফুলের বৃক্ষ রয়েছে এ বাগানে।
এ কক্ষটা বেছে নেবার কারণ আছে বনহুরের।
পিছন জানালা দিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে যায় সে গভীর রাতে। কাজ শেষ করে ফিরে সে ঐ পথেই। কাজেই কেউ জানে না তার গোপন অভিসন্ধির কথা।
বনহুরের দেওয়া হীরক অংগুরী পরে স্বপন আর কল্পনার আনন্দ আর ধরে না। সবচেয়ে বেশি আনন্দ হলো কল্পনার। সত্যি তার খুব পছন্দ হয়েছে এ আংটিটা।
রাতের খাওয়া শেষ করে শুতে যায় বনহুর।
স্বপন আর কল্পনা চলে যায় নিজ নিজ কক্ষে।
*
পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরী এবং তার পুলিশ মহল হিমসিম খেয়ে গেলো। কোনো রকমে এই গোপন লুটতরাজ আর দস্যুতা বন্ধ করতে পারলেন না। প্রতি রাতেই কোথাও না কোথাও চলেছে এই অদ্ভুত ডাকাতি। পুলিশ রিপোর্টে জানা যায়–জমকালো পোশাক-পরা এক ব্যক্তির হঠাৎ আবির্ভাব ঘটে; রিভলভার ধরে সব লুটে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ পর্যন্ত কয়েকটা খুনও সংঘটিত হয়েছে।
ব্যাপারটা সমস্ত শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও হাশেম চৌধুরী তার আদালী এবং অন্যান্যকে সাবধানে কথাটা গোপন রাখতে বললেন। কারণ মাসুমা আর মনিরা ছেলেমানুষ ভয় পেয়ে যেতে পারে। তাই হাশেম চৌধুরী নিজেও কোনোদিন এসব কথা বাসায় বলতেন না।
পুলিশ সুপারের বাংলোর কারো সাহস হলো না এসব জানাতে। বিশেষ করে পুলিশ সুপার বারণ করে দিয়েছেন সবাইকে।
কথাটা হয়তো মনিরার কানে গেলে তার বুক আনন্দে দুলে উঠতো, হয়তো বা তার মনে উঁকি দিতো আশার একটি আলো। শহরময় এতো হইহুল্লোড় চললেও বাংলোর মনিরা আর মাসুমা জানল না কিছু। তাদের কানে পৌঁছলো না এসব।
দিল্লীর পত্রিকায় নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হলেও পত্রিকা বাংলোয় দেওয়া মানা। দুবৃত্ত দস্যুর। হামলায় শহরবাসী কম্পমান। পুলিশ মহলে ভীষণ একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। সব সময় দিল্লীর পুলিশ বিভাগ এই অজ্ঞাত দস্যুর জন্য উৎকণ্ঠিত রয়েছে।
হাশেম চৌধুরীকে সব সময় এ ব্যাপারে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। কাজেই হাশেম চৌধুরী। পাশের শ্যামনারায়ণ মহাশয়ের বাড়ির সঙ্গে তার স্ত্রী এবং মনিরার পরিচয় হবার জন্য খুশিই হলেন তিনি। একদিন নিজে হাশেম চৌধুরী ঐ বাড়ি বেড়াতে গেলেন স্বাভাবিক বন্ধুত্বের খাতিরে। ইতিমধ্যে স্বপন গিয়ে ভাব জমিয়ে নিয়েছিলো তাঁর সঙ্গে।
হাশেম চৌধুরী স্বপনের সঙ্গেই বেড়াতে এলেন।
তখন বাসাতেই ছিলো বনহুর। হলঘরে বসে সেদিনের পত্রিকা পড়ছিলো সে।
হাশেম চৌধুরীসহ কক্ষে প্রবেশ করে স্বপন।
স্বপনই পরিচয় করিয়ে দেয়–দাদা, ইনিই পুলিশ সুপার মিঃ হাশেম চৌধুরী। আর ইনি আমার দাদা রঞ্জন।
বনহুর পুলিশ সুপার মিঃ হাশেম চৌধুরীর করমর্দন করলো।
উভয়ে আসন গ্রহণ করলো।
স্বপন কলিং বেল টিপে বয়কে ডেকে জলখাবারের আয়োজন করতে বললো।
হাশেম চৌধুরী অত্যন্ত মিশুক লোক, অল্পক্ষণেই বনহুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে ফেললেন। তরুণ যুবক হাশেম একথা-সে কথার মাধ্যমে এই রহস্যজনক দস্যুতার কথা তুললেন। বললেন–মিঃ রঞ্জন, আমি ভেবে পাচ্ছিনা কে এই দস্যু যে রাতের অন্ধকারে অশরীরী আত্মার মত দিল্লীর বুকে বিচরণ করে ফেরে। পুলিশ বাহিনী সতর্ক দৃষ্টি রাখা সত্ত্বেও প্রতিদিন চলেছে দস্যুতা।
বনহুর শুধু হাসলো।
হাশেম চৌধুরী বললেন–আপনারা আমাদের নিকটবর্তী পড়শী, কাজেই এখন আপনজন বলতে আপনারাই। সব সময় আপনাদের সহায়তা আমার কামনা।
বললো বনহুর–নিশ্চয়ই মিঃ চৌধুরী, সব সময় আমাদের পাশে পাবেন।
এরপর থেকে পুলিশ সুপার মিঃ হাশেম চৌধুরী মিঃ রঞ্জনবেশী বনহুরের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বে আবদ্ধ হলেন।
উভয়ের বয়স প্রায় সমান, তাছাড়া দু’জনাই বেশ মিশুক ধরনের লোক। হাশেম চৌধুরী বিশ্বাস করলেন বনহুরকে।
অবসর সময় হলেই হাশেম চৌধুরী আসতেন শ্যামনারায়ণ মহাশয়ের বাড়ি। বনহুরের সঙ্গে গল্প। করতে বড় ভাল লাগতো তার। বনহুরও যেতো মাঝে মাঝে স্বপনের সঙ্গে বাংলোয়।
ড্রইংরুমে বসে আলাপ করতো।
তারপর গল্পসল্প করে ফিরে আসতো অনেক রাতে।
*
সেদিন বাংলোর সম্মুখে বাগানে বসে আছে বনহুর আর হাশেম চৌধুরী। ক’দিন আগে একটা ব্যাংক লুট হয়ে গেছে–সে ব্যাপার নিয়েই আলোচনা চলছিলো। সন্ধ্যারাতেই একটা জমকালো পোশাক পরা দস্যু রিভলভার ধরে ব্যাংক থেকে বিশ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। পাহারাদার এবং ব্যাংকে কার্যরত লোকজন কেউ কিছু করতে পারেনি। পুলিশের এতো সতর্ক পাহারা থাকা। সত্ত্বেও প্রায়ই চলেছে এরকম অদ্ভুত ডাকাতি।
বনহুর কন্ঠে সহানুভূতি ভাব এনে বললো–বড় আফসোস্ দস্যু আপনাদের মত পুলিশ বাহিনীর চোখ ধুলো দিয়ে তার কাজ সমাধা করে যাচ্ছে।
শুধু আফসোস নয় মিঃ রঞ্জন, পরিতাপের বিষয় একটা দস্যু এতোগুলো পুলিশ বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে কার্য সিদ্ধি করে যাবে অথচ তাকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো না।
পুলিশ সুপার আর মিঃ রঞ্জনবেশী বনহুর যখন বসে আলাপ-আলোচনা করছিলো ঠিক তখন বয় এসে একটা এনভেলাপ হাতে দেয় হাশেম চৌধুরীর।
হাশেম চৌধুরী খুলে ফেলে খামখানা, মাত্র কয়েক ছত্র লিখা একখানা চিঠি। হাশেম চৌধুরী চিঠিখানা পড়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠেন–দস্যুর সাহস দেখুন। চিঠিখানা হাতে দেয় বনহুরের। বনহুর পড়ে–
প্রিয় বন্ধু
সাবধান, আজ রাতে আপনার বাংলোয় আমি আসবো। বিশ হাজার টাকা আমার জন্য মওজুদ রাখবেন।
—রাত্রির ভয়ঙ্কর
চিঠিখানা পড়ে দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে বললো বনহুর-রাত্রির ভয়ঙ্কর। অদ্ভুত নাম–
শুধু অদ্ভুতই নয় মিঃ রঞ্জন, একটা বিরাট আঁতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এ দস্যু।
যতই বলুন,পুলিশ সুপারের বাড়ি হানা দেয়া রাত্রির ভয়ঙ্করের কাজ নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মিঃ চৌধুরী।
কিন্তু–
কোনো কিন্তু নেই। আপনার বাড়ি পুলিশ ফোর্স দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবে, সাধ্য কি রাত্রির ভয়ঙ্কর বাংলোয় প্রবেশ করে।
তবু আমার সন্দেহ জাগছে মিঃ রঞ্জন। আপনি জানেন না, আমার স্ত্রী এবং আমার বোন কত ভীতু। তারা যদি জানতে পারে একথা, তাহলে অস্থির হয়ে পড়বে।
হেসে উঠে বনহুর–পুলিশ সুপারের মুখে একথা শোভা পায় না মিঃ চৌধুরী।
দেখুন মিঃ রঞ্জন, আপনার কথাবার্তায় আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি–আপনি অত্যন্ত সাহসী।
যদি মনে করেন তবে তাই।
দেখুন আমার একটা কথা রাখবেন বলে আশা করি।
নিশ্চয়ই, বন্ধুজনের কথা শিরোধার্য। বলে হাসে বনহুর।
আজ রাতে আমাদের বাংলোয় থাকবেন আপনি।
পুলিশ সুপার হয়ে আমাকে একি অনুরোধ–আপনি আমার বন্ধু এবং পরম আত্মীয়ের চেয়েও বেশি। বেশ, যদি ভাল মনে করেন তাহলে আসবো।
পুলিশ সুপার মিঃ হাশেম চৌধুরীর কাছে বিদায় নিয়ে তখনকার মত চলে গেলো দস্যু বনহুর।
বনহুর দিল্লী শহরে সন্ন্যাসী বাবাজীর সন্ধানে গেলেই, ফিরে এসেছিলেন সন্ন্যাসী বাবাজী। এসে যখন জানতে পারলেন কেশব আর ফুলের জেদে বাবুজী গেছে দিল্লী নগরে, তখন চিন্তিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার শরীর ভাল না থাকায় পুনরায় বাবুজীর খোঁজে যেতে পারেননি তিনি।
তাঁর এক কঠিন অসুখ দেখা দিয়েছিলো, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন হৃৎপিণ্ডের ব্যাধি এটা।
গহন বনে ডাক্তার-কবিরাজ নেই। সন্ন্যাসী বাবাজী নিজেই যা পারলেন গাছ-গাছড়ার রস খেলেন, কিন্তু আয়ু যখন ফুরিয়ে যায় তখন আর কোনো চেষ্টাই সফল হয় না। সন্ন্যাসী বাবাজী অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, কাজেই তিনি আর কিছুতেই নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। কেশব আর নূরীর। প্রচেষ্টা, সেবা-যত্ন সব ব্যর্থ করে দু’দিন পর চলে গেলেন তিনি পরপারে। নশ্বর দেহ পড়ে রইলো। পৃথিবীর বুকে, প্রাণপাখি গেলো উড়ে।
অনেক কাদলো কেশব আর নূরী। কেঁদে আর কি হবে!
তারপর সন্ন্যাসী বাবাজীর মৃতদেহটা ভাসিয়ে দিলো ওরা নদী বক্ষে।
দুটোদিন আরও প্রতীক্ষা করলো কেশব আর নূরী। গহন বনে একা একা দুটি তরুণ আর তরুণী। এভাবে কাটানো সম্ভব নয়। নূরী সাহসী নারী হলেও ভীত হলো, সন্ন্যাসী বাবাজীর মৃত্যুতে ভড়কে গেছে ওরা। এমন দিনে যদি বনহুর পাশে থাকতো তাহলে নূরী একটুও বিচলিত হতো না।
বনহুরের প্রতীক্ষায় কটা দিন কোনো রকমে কাটিয়ে দিলো বটে কিন্তু দিন যেন আর যায় না।
নূরী কেশবের কাছে জেদ ধরে বসলো তারা শহরে চলে যাবে–যেখানে তার বনহুর গেছে। যেমন। করে হোক খুঁজে বের করবেই তাকে।
একদিন জঙ্গলের আশ্রম ত্যাগ করে কেশব আর নূরী রওয়ানা দিলো দিল্লী নগরের দিকে।
সেই থেকে কেশব আর নূরী অহরহ খুঁজে ফিরছে বনহুরকে। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পায় না। ওরা।
কেশব আর নূরী আশ্রয় নিয়েছে এক সাপুড়ে দলে।
ওদের সঙ্গে সাপের ঝাঁকা নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় ফুল আর কেশব। বাবুদের বাড়ি বাড়ি সাপ খেলা দেখিয়ে পয়সা উপার্জন করে।
সারাদিন সাপ খেলা দেখিয়ে যা পায় তাই দিয়ে চাল-ডাল কিনে রাতের বেলা রান্না করে খায় ওরা। দিল্লী শহরের অনতিদূরে ঘেরুয়া পাড়ায় তাদের আস্তানা। ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে থাকে নূরী আর বারেন্দায় শোয় কেশব।
সেদিন বনহুর চলে গেলো যখন পুলিশ সুপারের বাংলো থেকে, পরক্ষণেই দূরে শোনা গেলো– বাবু, সাপ খেলা দেখিয়ে বাবু। সাপ খেলা–
অন্দরবাড়ি থেকে মাসুমা আর মনিরা বেরিয়ে এলো দ্রুত। আর্দলী দিয়ে সাপুড়েদের ডেকে পাঠালো।
মিঃ হাশেম চৌধুরীর মনের অবস্থা ভাল নয়, একটু পূর্বে যে চিঠি তিনি পেয়েছেন তার জন্য যদিও তিনি ভীত নন তবু একটা অহেতুক আতঙ্ক জাগছে তাঁর মনে।
মাসুমা আর মনিরার অনুরোধে কেশব সাপের ঝকা নামিয়ে রাখলো।
কেশবের দেহে সাপুড়ের ড্রেস, আর নূরীর পরণে ঘাগড়া, গায়ে ব্লাউজ আর ওড়না। উভয়ের কানেই বড় বড় বালা রয়েছে।
সাপ খেলা শুরু হলো।
কেশব বাঁশি বাজায় আর নূরী সাপ খেলার তালে তালে করুণ মিষ্টিসুরে গান গায়। অদ্ভুত পাহাড়ী গান বড় সুন্দর মধুর সে সুর।
মুগ্ধ হয়ে যায় মনিরা আর মাসুমা।
সাপ খেলা দেখানো শেষ করে বিদায় চায় কেশব আর নূরী।
মনিরা খুশি হয়ে নিজের হাতের দু’গাছা চুড়ি খুলে দেয় নূরীর হাতে।
হাশেম চৌধুরী টাকা দেন।
চলে যায় ওরা।
মনিরা আর মাসুমা বলে দেয়–তারা আবার যেন আসে।
কেশব আর নূরী কথা দেয়, আসবো।
ওরা চলে যেতেই বলে মাসুমা স্বামীকে লক্ষ্য করে–আজ তোমাকে বড্ড চিন্তিত লাগছে, ব্যাপার। কি বলো তো?
কিছু না। হাশেম চৌধুরী স্ত্রীর নিকটে কিছু না বললেও তাঁর অন্তরে একটা দুর্ভাবনা তালগোল পাকাচ্ছিলো।
হাশেম চৌধুরী গম্ভীর হয়ে রইলেন, সন্ধ্যার পর পরই তাকে তৈরি হয়ে নিতে হবে।
মাসুমা হেসে বললো–শুনলাম তোমার বন্ধু মিঃ রঞ্জন সেন এসেছিলেন। কি হলো, তিনি কি কোনো দুঃসংবাদ শুনিয়ে গেলেন?
না, তিনি নন। তবে আজ একটা দুঃসংবাদ শুনেছি যার জন্য আমার মনে স্বস্তি নেই।
মনিরা শিউরে উঠলো বললো সেকান্দাই থেকে কোনো সংবাদ আসেনি তো? আমার নূর ভাল আছে কিনা কে জানে–
আপা, আপনি অযথা চিন্তা করছেন, কান্দাই এর-কোনো সংবাদ নয়। এখানেই এবং আজ রাতের একটি ব্যাপার নিয়ে আমি অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত আছি।
কতকটা আশ্বস্ত হলো মনিরা।
মাসুমা তেমনভাবে আর জেদ করলো না স্বামীর কাছে। পুলিশের লোক তাদের কখন কোন্ চিন্তা কে জানে। সব কথাই তো আর তাকে বলেনও না হাশেম চৌধুরী।
বললেন হাশেম চৌধুরী এবার মাসুমা, আজ আমার বন্ধু রঞ্জন এখানে খাবেন এবং থাকবেন।
বেশ তো দু’বন্ধু মিলে গোটারাত গল্পেসল্পে কাটিয়ে দিও।
আর তোমরা দু’বান্ধবী খুব করে বুঝি ঘুমাবে?
মোটেই না।
তবে কি তোমরাও–
হা, আমাদের কত কথা আছে, কত গল্প আছে, যা গোটারাত ধরে শুনলে আর শোনালে ফুরোবেনা। কি বলিস ভাই মনিরা, তাই না?
মনিরা মাথা দোলালো।
বললো মাসুমা–তোমার বন্ধুকে আজও চোখে দেখলাম না। আজ কিন্তু পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তার সঙ্গে। শুনেছি তোমার বন্ধু নাকি সুন্দর পিয়ানো বাজাতে পারে।
তাই নাকি? কে বললো একথা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন হাশেম চৌধুরী।
বললো মাসুমা–স্বপন আর কল্পনার মুখে শুনেছি।
বেশ, তাহলে আজ সমস্ত রাত পিয়ানো শুনে কাটানো যাবে।
*
সন্ধ্যার পর।
বনহুর এলো।
হাশেম চৌধুরীর অনুরোধে পিয়ানোটা আনতে হয়েছে তাকে।
মাসুমা এসে পরিচয় করে নিলো এবার আগ্রহান্বিত হয়ে। কিন্তু মনিরা কিছুতেই এলো না তার সামনে। এ ছাড়া মনিরা কারো সম্মুখেই বড় আসতে চাইতো না। আজও মনিরা এলো না, এলে সে দেখতো তার আকাঙ্খিত জনই হলো মিঃ রঞ্জন সেন।
পাশের ঘর থেকে সে শুনবে পিয়ানো বাজানো–বললো মনিরা। অনেক বলেও যখন মাসুমা তাকে ড্রইংরুমে আনতে সক্ষম হলো না তখন সে একাই এসে গল্পেসল্পে মেতে উঠলো। স্বামীর বন্ধু হিসেবে মাসুমা তাকে যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন করলো।
হাশেম চৌধুরী সজাগ পুলিশফোর্স পাহারা রত রেখেও স্বস্তি পাচ্ছিলেন না নিজেও পকেটে রিভলভার রেখে বসে ছিলেন। কোন মুহূর্তে রাত্রির ভয়ঙ্কর হামলা করে বসবে কে জানে!
বনহুরের সঙ্গে স্বপনও এসেছে, সেও আনন্দে অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করছে –তার রঞ্জন দাদার পিয়ানো বাজানো শুনবে।
নানা গল্প-গুজবের পর বনহুর পিয়ানোর পাশে এসে বসলো।
পাশাপাশি সোফায় বসে আছে হাশেম চৌধুরী আর স্বপন। একপাশে বসেছে মাসুমা।
পাশের ঘরে মনিরা বসে বই পড়ছিলো।
মাঝে মাঝে ড্রইংরুম থেকে ভেসে আসছিলো ওদের হাসি গল্পের আওয়াজ আর হাসির শব্দ।
এবার শুরু হলো পিয়ানোর ধ্বনি।
পিয়ানোর সুর ভেসে আসছে।
অপূর্ব অদ্ভুত সে সুর।
মনিরা বই পড়ছিলো, বই রেখে ঠিক হয়ে বসলো। এমন পিয়ানো সে কোনোদিন শোনেনি। তন্ময় হয়ে শুনছে মনিরা। তার সমস্ত অন্তর যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো সে সুরে।
রাত বেড়ে আসছে।
এতো সুরেও হাশেম চৌধুরীর মনে স্বস্তি নেই, বার বার তিনি ড্রইংরুমের মেঝেতে পায়চারী করছেন। পকেটে তার গুলীভরা রিভলভার। বাংলোর চারপাশে পাহারা দিচ্ছে সর্তক রাইফেলধারী পাহারাদার।
বনহুর পিয়ানো বাজাচ্ছে।
মাসুমাও তন্ময় হয়ে গেছেন যেন।
স্বপন সোফার হাতলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আজ কৃষ্ণ একাদশী।
চাঁদ এখন উঠেনি।
আকাশ অন্ধকার। শুধু তারার মালা জোনাকীর মত পিট পিট করে জ্বলছে।
বাংলোর আশেপাশের বাড়িগুলো একসময় নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে।
বনহুরের হাতে পিয়ানো যেন থামতে চায় না। একি, এমন মন মাতানো সুর এর আগে তো কোনোদিন কেউ শোনেনি।
পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরী বার বার হাই তুলছেন।
মাসুমার চোখেও নিদ্রা দেবী আসন গেড়ে নিয়েছেন।
পাশের ঘরে মনিরা অভিভূতের মত স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
বাংলোর চারপাশে পুলিশ ফোর্স রাইফেল হস্তে ঝিমুচ্ছে–এমন সুর তারাও যে শোনেনি কোনোদিন।
হাশেম চৌধুরী বললেন–মিঃ রঞ্জন আর যে পারছি না ভাই। বড় ঘুম পাচ্ছে আমার।
বললো বনহুর–আমারও দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে।
না না, তা হয় না বন্ধু, আরও একটু বাজান। আমি জেগে থাকতে চাই।
বেশ, বাজাচ্ছি, আপনি শুনুন মিঃ চৌধুরী।
বনহুর আবার পিয়ানো বাজাতে শুরু করলো।
এবার মনিরা স্থির থাকতে পারলো না, সে নিজের অজ্ঞাতে ড্রইংরুমের দরজার আড়ালে এসে দাঁড়ালো। কে এই পিয়ানো বাদক, যার সুর সৃষ্টি করে এক অভিনব পরিবেশ। মনিরা পর্দার ফাঁকে দৃষ্টি ফেললো ড্রইংরুমের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে থ’মেরে গেলো মনিরা–একি দেখলো সে–তবে কি তার চোখের মোহ। দু’হাতে চোখ রগড়ে তাকালো আবার না তো, কোনো ভুল নেই–
এ যে তার স্বামী। মনিরা দুই হাতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিলো।
একটু স্থির হয়ে আবার তাকালো সে ড্রইংরুমের মধ্যে। কিছুতেই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারছে না। নিশ্বাস দ্রুত বইছে; বুকের মধ্যে টিপ টিপ করছে। ছুটে গিয়ে স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছা হলো তার কিন্তু পারলো না সত্যিই যদি সে না হয়।
ঠিক সে মুহূর্তে বনহুর পিয়ানো রেখে ফিরে বসলো।
এবার মনিরা বনহুরকে স্পষ্ট দেখতে পেলো, আনন্দে নিজেকে কিছুতেই যেন ধরে রাখতে পারছে না সে। তবু শক্ত হলো মনিরা কঠিন করে নিলো নিজেকে। এতোদিন যদি সহ্য করে থাকে আর সামান্য সময় অপেক্ষা করতে পারবে না! শত শত বার মাসুমাকে অন্তর দিয়ে ধন্যবাদ জানালো। ভাগ্যিস সে ওর সঙ্গে এসেছিলো, না হলে এই সুদূর ভারতবর্ষে তার আসাও হতো না, পেতো না স্বামীকে।
মনিরা এবার বুঝতে পারলো কেন মনির আর যায় না তার পাশে। রহমান তার বিশ্বস্ত অনুচর হলেও সন্ধান জানে না–কোথায় রয়েছে তাদের সর্দার।
মনিরা খুশিতে উচ্ছল।
দরজার পাশ থেকে খাটে এসে বসলো মনিরা।
মাসুমাও এলো এবার।
মনিরা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বান্ধবী মাসুমাকে–মাসু অপূর্ব!
নিদ্রায় মাসুমার চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু করছিলো–মনিরাকে আনন্দে অধীর হতে দেখে নিদ্রা ছুটে গেলো, অবাক হয়ে বললো–খুব যে খুশি দেখছি! মিঃ রঞ্জনবাবুর পিয়ানো দেখছি তোকে একেবারে উজ্জ্বল করে তুলেছে?
হাঁ মাসুমা, আমি যেন ওর সুরে আত্মহারা হয়ে পড়েছি।
ওকে দেখিসনি, দেখলে বুঝতিস্ যেমন তার রূপ তেমনি তার পিয়ানোর সুর। চলনা দেখা করবি?
না আজ নয় আর একদিন।
নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে সমস্ত বাংলোটা।
শুধু জেগে আছে বাংলোর বাইরে পুলিশ ফোর্স। তারা রাইফেল কাঁধে সজাগ পাহারা দিচ্ছে।
হাশেম চৌধুরীও তাঁর কক্ষে জেগে বসেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না। তিনি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন এক সময়। মাসুমা তো অনেকক্ষণ শুয়েছে, তার ঘুম গম্ভীর হয়ে এসেছে।
শুধু পাশের ঘরে জেগে মনিরা। আজ কি তার চোখে ঘুম আসে! ড্রইংরুমের পাশের কামরা গেষ্টরুম। ও ঘরে আছে স্বপন আর রঞ্জন সেন।
মনিরা জানে, নিশ্চয়ই তার স্বামী এ বাড়িতে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে রাত্রি যাপন করতে এসেছে। তাই মনিরা সজাগ প্রহরীর মত জেগে। মনিরা এবার উঠে এসে গেষ্টরুমের পাশে অন্ধকারে দাঁড়ালো, পাশের জানালার ফাঁক দিয়ে নজর ফেললো কক্ষমধ্যে। দেখলো সেবনহুর পিয়ানো খুলে বের করে নিলো জমকালো পোশাক। পরে নিলো দ্রুত হস্তে। তারপর পিয়ানোর মধ্য হতে বের করলো একটি রিভলভার। চেপে ধরে পা বাড়ালো দরজার দিকে।
অমনি পর্দার আড়াল থেকে নারীকণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো –খবরদার, এক পা এগুলে বা পিছলে মরবে।
বনহুর তাকালো ওদিকের জানালায়। অস্পষ্টভাবে নজর পড়ল–জানালার পর্দার ফাঁকে একটা আগ্নেয়াস্ত্রের মুখ দেখা যাচ্ছে। রিভলভার সেটা বুঝে নিতে বাকী রইলো না তার।