রাত্রি
ঋগ্বেদে একটিমাত্র রাত্রিসূক্ত আছে (১০:১২৭:১-৮), এর আটটি ঋকে সেকালের রাত্রির একটা রূপ ধরা পড়ে। প্রথমে ঋক ধরে ধরে অনুবাদে এর অভিধাগত মূল অর্থটা দেখা যাক। ১. নক্ষত্রদের দ্বারা তেজের যে প্রসার তা আকাশে বিশেষ ভাবে দীপ্ত, সর্বপ্রকারের শোভা ধারণ করে। ২. মৃত্যুহীন দীপ্ত রাত্রি অন্ধকারে আকাশ পূর্ণ করে রাখে। নীচের লতাগুল্ম ও উন্নত বৃক্ষগুলিকে নিজের তেজে পূর্ণ করে। তার পর সেই অন্ধকারকে নক্ষত্রের আলোতে পূর্ণ করে। ৩. আগন্তুক রাত্রি এসে তার ভগিনী উষাকে বহিষ্কৃত করে। তার পর রাত্রির তমসা পরাজিত হয়। ৪. সেই রাত্রি এখন আমাদের প্রতি প্রসন্ন হন। তাঁর আগমনে পাখিরা যেমন নীড়ে যায়, আমরাও তেমনি বাড়িতে যাই। ৫. রাত্রির আগমনে গ্রামের সব মানুষই শুতে যায়, গাভী ও অশ্বগুলিও গোশালায় যায়। বাজপাখিও তার বাসাতে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ৬. হে রাত্রি, হিংস্র নেকড়ে বাঘ ও বাঘিনির আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করো, চোরদের নিরস্ত করো, এবং আমাদের প্রতি সুখকরী হও। ৭. সমস্ত বস্তুকে আচ্ছন্ন করে যে-রাত্রি, তার তমসা আমাদেরও আচ্ছন্ন করে। লোকে যেমন ঋণ থেকে ঋণীকে মুক্ত করে, তেমনই ঊষা এসে আমাদের (অন্ধকার থেকে) মুক্ত করুন। ৮. বৎস যেমন গাভীকে দোহন করে, তেমনই স্তুতি দিয়ে আমরা তোমাকে আমাদের প্রতি অভিমুখ করব। আকাশের কন্যা রাত্রি শত্রুজয়ের উদ্দেশ্যে আমাদের এই স্তব গ্রহণ করুন, যেন আমরা শত্রুজয় করতে পারি।
ছোট সূক্ত, প্রায় কোনও বৈশিষ্ট্যই নেই এতে, শুধু দেখতে পাই অত প্রাচীন যুগের মানুষ রাত্রি নামক প্রতিদিনের এই ঘটনাটিকে কী ভাবে দেখত এবং কী ভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হত। আজকের দেখার সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায় ও কেন। সমস্ত সূক্তটির মধ্যে দেখা যাচ্ছে, রাত্রি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে মানুষের মনে একটি প্রচ্ছন্ন ভয়ের ভাব আছে এবং সেই কারণেই রাত্রির কাছে প্রার্থনাও করছে। বেদে কোথাও রাত্রিকে দেবী বলা নেই, কিন্তু প্রবল শক্তিমাত্রই অতিপ্রাকৃত, কাজেই তার অলৌকিক শক্তি আছে, এবং অসহায় মানুষের প্রার্থনা সে পূরণ করতে পারে।
বেদে ‘দেব’ শব্দটি আলোকবাচক ‘দিব্’ শব্দ থেকে উৎপন্ন, যার থেকে ‘দিব্য’ ইত্যাদি শব্দও নিষ্পন্ন হয়েছে। কাজেই দেবতার সঙ্গে আলোর একটা ব্যুৎপত্তিগত এবং অর্থগত যোগ আছে; তাই অন্ধকার রাত্রিকে নিয়ে একটা সংকট ছিল জনমানসে, সেটার তারা নিষ্পত্তি করেছিল এই অভিজ্ঞতা দিয়ে যে, এ অন্ধকারের দু’দিকেই আলো— অপরাহ্নের ও প্রভাতের। রাত্রি যেন কয়েক প্রহরের জন্য সে আলোকে আবৃত করে রাখে মাত্র, প্রতি প্রভাতে রাত্রির অপসরণ আলোকদেবতার আবির্ভাবে। কাজেই অন্ধকারই শেষ কথা নয়, আলোর জয় বস্তুত অব্যাহত। তবু ভয় অন্ধকারকে, দু’টি কারণে। প্রথমত, তখন মানুষ নিশাচর ভূত প্রেতকে ভয় করত এবং রাত্রিই তাদের সুবিধে করে দেয়, তখন কয়েক প্রহর ধরে তাদের স্বেচ্ছাবিচরণ এবং মানুষ যেখানে সম্পূর্ণ নিরুপায় এবং ওই অশুভ শক্তির প্রভাবের কাছে প্রতিহত।
দ্বিতীয়ত, সেই অন্ধকার কী গভীর, কী নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। বিদ্যুৎ বা গ্যাসের আলো, হারিকেন বা লণ্ঠনের আলো নেই; আছে শুধু মাটির প্রদীপের আলো, আর শুক্লপক্ষে ধীরে ধীরে চাঁদের কলাবৃদ্ধি। আর নক্ষত্র বিদ্যুৎ বা জোনাকির আলো। সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার মানুষকে অসহায় আতঙ্কের জগতে ঠেলে দেয়, যেখানে তার আশ্রয় নেই, ভরসা নেই। অথচ মানুষ বিশ্বাস করে, ‘আমি যে তোর আলোর ছেলে’, আলো তার ভরসাস্থল। রাত্রিতে আসে সাপ, বাঘ নানা অজানা বিপদ তাই রাত্রির কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন প্রসন্ন হন। (8) চোরও আসে রাত্রে, দেখতে পাচ্ছি রাত্রির সমস্ত সহচর, সমস্ত অনুষঙ্গ ক্ষতির, হিংসার, বিপদের; তাই এ প্রার্থনা, যেন রাত্রি মানুষের পক্ষে সুখকরী হয়।
এই গভীর কৃষ্ণত্বের প্রতীক রাত্রি, একে প্রসন্ন করা একান্তই প্রয়োজন, আত্মরক্ষার জন্যে, চতুষ্পদ প্রাণীর জন্যে, আশ্রিত সকলের জন্যে। রাত্রিকে প্রসন্ন করার উপায় স্তবস্তুতি। এইক্ষণেই রাত্রি দেবী হয়ে যায়। অন্য এক দেবী উষা হল রাত্রির ভগিনী, কাজেই রাত্রিরও দেবত্ব ব্যঞ্জিত হয়েছে। অবশ্য উষা রাত্রির একেবারে বিপরীত, আলোয় উজ্জ্বল। প্রাচীন ভারতীয় দেবকল্পনায় এমন বৈপরীত্য প্রায়ই দেখা যায়। যেমন, শিব ও কালী। আরও আছে। রাত্রিকে প্রসন্ন করার জন্য স্তব করার অর্থ এই নয় যে, রাত্রির অন্ধকার ঘুচে গিয়ে সবটা আলোকময় হয়। কারণ, তা হবার নয়, রাত্রি তমসাচ্ছন্না, কৃষ্ণবর্ণাই। তবে তাকে প্রসন্ন হতে বলা মানে রাত্রির যে-অনুষঙ্গ হিংস্র প্রাণীর, যারা নিশাচর, যারা রাত্রিতেই লোকালয়ে এসে মানুষ এবং গৃহপালিত প্রাণীকে হত্যা করে, তাদের থেকে সুরক্ষা প্রার্থনা। আর প্রার্থনা, নিশাচর চোরডাকাত যেন না অতর্কিতে আক্রমণ করে ধননাশ করে।
মানুষ চায় রাত্রিতে শান্তিতে ঘুমোতে। দিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি জুড়োয় রাত্রিতে, পরদিন যাতে চাষ বা পশুপালন বা শিল্পকর্মের শক্তি সঞ্চয় করে শরীর। নিশ্চিন্ত ঘুমের প্রত্যবায় ঘটায় যা-কিছু তা রাত্রিরই সহচর। রাত্রির অনুগ্রহ পেলে সেই সব বিপদের আক্রমণ থেকে মানুষ বাঁচতে পারে। এই কাজ তো দেবীরই, দেবতাদেরই, তাই রাত্রি দেবী। যে-তমসা থেকে বাঁচবার প্রার্থনা ঋগ্বেদের কেন্দ্রে (তমসো মা জ্যোতির্গময়) সেই তমসারই অধিষ্ঠাত্রী রাত্রি, কাজেই মানুষ তার কাছে নিজের আশঙ্কা বিপদ তুলে ধরেছে এবং একান্ত আগ্রহে কামনা করেছে তমসা এবং তার অনুষঙ্গে যে সব বিপদ আছে তার থেকে বাঁচবার জন্যে। তাই রাত্রিসূক্ত কবিত্বে এবং বাস্তব বিপন্মুক্তির জন্যে আকুতির এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ।