রাতের ট্রেনে দেখা হয়েছিল
আপনি ‘সুনন্দা’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। তাই আপনাকেই শোনাব এই বিচিত্র কাহিনি। তারপর আপনাকে একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ করব: যদি পারেন আমাকে একটু সাহায্য করবেন, কারণ আপনিই পারেন আমাকে বাঁচাতে। শুধু আমি কেন, আপনার কাছ থেকে সামান্য একটু সাহায্য পেলে প্রায় দেড়শোটা পরিবার বেঁচে যাবে। ওদের সকলের সমস্যা মাথায় নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি উদভ্রান্তের মতো। দূরপাল্লার ট্রেনগুলোয় এলোমেলোভাবে উঠে পড়ছি, নেমেও পড়ছি একইভাবে। যে-কোনও স্টেশন থেকে ট্রেন ধরছি, নেমে পড়ছি যে-কোনও স্টেশনে। ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি একজনকে। রাতের ট্রেনেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
ঘটনাটা শুনলে আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে যা বলব তার একটি বর্ণও মিথ্যে নয়।
আমি একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করি। সেই হাউসের চারটি ম্যাগাজিন আছে। তিনটি ইংরেজি, একটি বাংলা। বাংলা পত্রিকাটি পাক্ষিক। নাম ‘চারুলতা’। নাম শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন পত্রিকাটির চরিত্র ‘সুনন্দা’র মতোই। আমি এই পত্রিকার সারকুলেশানের দায়িত্বে রয়েছি।
তিন বছর ধরে ‘চারুলতা’ প্রকাশিত হচ্ছে। নামী লেখকরা নিয়মিত এই পত্রিকায় লেখেন। অনেক খরচ করে যত্ন নিয়ে এই রঙিন পাক্ষিকটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু তিন বছরে এই পত্রিকার সারকুলেশান পনেরো হাজারেও পৌঁছয়নি।
আমাদের হাউসের মালিক সর্বেশ্বর নাগ অনেক আশা নিয়ে ম্যাগাজিনটি বের করেছিলেন। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করার আগে চুলচেরা মার্কেট সার্ভে করা হয়েছিল। তার পজিটিভ আউটকাম দেখেই যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।
তিন বছর ধরে আমি মুখে রক্ত তুলে ‘চারুলতা’-র বিক্রি বাড়াতে চেষ্টা করেছি। ইস্টার্ন রিজিওনের বাঙালি অঞ্চলে ঘনঘন টুর করেছি। কিন্তু কিছুতেই ‘চারুলতা’-র মাইনাস পয়েন্ট বের করতে পারিনি।
গত কয়েকমাসে মিস্টার নাগ আমাকে ডেকে বেশ কয়েকবার প্রচ্ছন্ন ধমক দিয়েছেন। যার অর্থ হল, যদি আগামী ছ-আট মাসে ম্যাগাজিনের বিক্রি বাড়াতে না-পারি, তা হলে উনি ম্যাগাজিন বন্ধ করে দেবেন। আর যদি শুধু ইংরেজি পত্রিকাই বের করতে হয়, তা হলে কোনও অবাঙালি বিজনেস পার্টনার নিয়ে দিল্লি বা মুম্বই থেকে তিনি সেগুলো বের করবেন। অর্থাৎ, কলকাতা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেবেন। যার বাংলা মানে হল, প্রায় দেড়শো স্টাফ বেকার হবে। সেইসঙ্গে দেড়শো পরিবার এক চরম অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াবে।
এইরকম একটা বিপন্ন অবস্থায় আমি পত্রিকার বিক্রি বাড়ানোর কাজে আসাম আর উত্তরবঙ্গ টুরে গিয়েছিলাম। অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম ফেলে দুটো সপ্তাহ মরিয়া হয়ে কাজ করেছি। তারপর নিতান্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে উঠে পড়েছি হাওড়া ফেরার ট্রেনে।
নভেম্বরের শেষ। এ-সময়ে কলকাতায় শীত তেমন জাঁকিয়ে না-বসলেও এদিকটায় ঠান্ডা আছে।
আমার ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে দূরপাল্লার যাত্রী কেউ ছিল না। তাই কারও সঙ্গেই তেমন করে আলাপ জমেনি। কিন্তু সন্ধের পর একটা বড়সড় ব্রিফকেস হাতে এমন একজন যাত্রী কেবিনে ঢুকলেন, যাঁর চেহারা রীতিমতো নজর কেড়ে নেয়।
ভদ্রলোকের বয়েস ষাট-বাষট্টি হবে। ফরসা স্বাস্থ্যবান শরীর। পরনে গাঢ় রঙের সুট, টাই। মাথার সামনেটা টাক পড়লেও পিছন দিকে ঘন কাঁচাপাকা বাবরি চুল। কপালে সমান্তরাল কয়েকটা ভাঁজ। চোখে কালো চওড়া ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচ এতই পুরু যে, কয়েকটা সাদা রিঙের মতো দাগ চোখে পড়ছে।
ভদ্রলোকের পুরুষ্টু গোঁফ আর জুলপি দেখে মনে হয় এককালে মিলিটারিতে ছিলেন। মুখেও সেই ধাঁচের একটা রাশভারী ভাব। আর তীব্র চোখের নজর যেন তির বেঁধানো।
কামরায় উঠেই ভদ্রলোক একটা চুরুট ধরালেন। তারপর ব্রিফকেস খুলে একটা বই বের করে নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলেন। বইটার নামটা অদ্ভুত বলেই আমার মনে আছে: ‘হেটেরোসাইক্লিক কেমিস্ট্রি।’
আমি ‘সুনন্দা’-র নতুন সংখ্যাটা নিয়ে চোখ বোলাচ্ছিলাম। আজই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ওটা কিনেছি। পত্রিকাটা কী ম্যাজিক জানে আমি বলতে পারব না। তবে লক্ষ করেছি, ম্যাগাজিনটা হাতে নিলে আমার আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না।
ঘণ্টাখানেক পরেই কেবিনের অন্য দুজন যাত্রী নেমে গেল। ফলে কামরায় শুধু আমরা দুজন। আমার সহযাত্রী এইবার বোধহয় আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চাইলেন।
‘হাওড়া পর্যন্ত যাবেন বুঝি?’ ওঁর গলার স্বর বেশ ভারী। ঠোঁটের কোণে সামান্য একচিলতে হাসি।
এইভাবেই আলাপ শুরু।
কথায়-কথায় আমার ম্যাগাজিনের কথা বললাম। ব্যাগ থেকে এককপি ‘চারুলতা’ দেখিয়ে বললাম, ‘আমি এই ম্যাগানিজের সারকুলেশান ডিভিশনের চিফ।’
ভদ্রলোক কৌতুকের হাসি হেসে বললেন, ‘ম্যাগাজিনটা খুব একটা বিক্রি হচ্ছে না তো—।’
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই ভেতরের খবরটা উনি কী করে জানতে পারলেন?
ভদ্রলোক সবজান্তা হাসি হাসলেন চাপা গলায়। তারপর বললেন, ‘না, না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনি ‘চারুলতা’-র লোক হয়ে ‘সুনন্দা’ পড়ছেন, তাই বললাম—’চুরুটের ঘন ধোঁয়ায় নিজেকে ঝাপসা করে দিয়ে বললেন, ‘তা ছাড়া ম্যাগাজিন লাইনে আমারও একটু-আধটু ইন্টারেস্ট আছে।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। হাউসের সিক্রেট যাকে-তাকে বলা ঠিক নয়। তবে ভদ্রলোকের কথায় একটা ঠান্ডা অস্বস্তি আমার শিরদাঁড়ায় কাঁকড়াবিছের মতো হেঁটে বেড়াতে লাগল।
প্রশ্ন করে জানলাম, ভদ্রলোক পেশায় কনসালট্যান্ট। তবে ঠিক কীসের কনসালট্যান্ট তা উনি স্পষ্ট করে বললেন না। ওঁর কথায়, আচরণে, আর হাসিতে কোথায় যেন একটা রহস্য জড়িয়ে রইল। উনি আবার ওঁর কেমিস্ট্রি বইটায় মন দিলেন। আমিও ‘সুনন্দা’-র পাতায় ফিরে গেলাম।
‘সুনন্দা’-র পাতা ওলটাতে-ওলটাতে একটা গল্পে আমার চোখ আটকে গেল। আমি ভুল দেখছি না তো! গল্পের নামটা একটু রহস্যময়। কিন্তু তার প্রথম লাইন দুটো আমাকে পাথর করে দিল।
রাতের ট্রেনে দেখা হয়েছিল
সোমদত্ত সেনচৌধুরী
আপনি ‘সুনন্দা’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। তাই আপনাকেই শোনাব এই বিচিত্র কাহিনি। তারপর আপনাকে একটা…
গল্পটা পড়তে-পড়তে আমি অন্য কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হুবহু আমার কথা লিখেছেন লেখক। আমাদের হাউসের গোপন খবর কেউ কি বেনামে গল্প লিখে ফাঁস করে দিচ্ছে? সোমদত্ত সেনচৌধুরী নামটা বেশ অদ্ভুত। চারটে পদবি নিয়ে তৈরি নাম। নিশ্চয়ই কারও ছদ্মনাম। কিন্তু এই ছদ্মনামের আড়ালে কে লুকিয়ে রয়েছে?
গল্পটায় ঘটনা হুবহু একইভাবে এগিয়েছে। অন্তত সহযাত্রী ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হওয়া পর্যন্ত। তবে লেখকের পত্রিকার নাম ‘চারুলতা’ নয়, ‘কাজললতা’। এ ছাড়া সবকিছুতেই আশ্চর্য মিল। এমনকী ‘হেটেরোসাইক্লিক কেমিস্ট্রি’ পর্যন্ত।
আমি নিশি-পাওয়া মানুষের মতো গল্পটা পড়তে শুরু করলাম:
…’সুনন্দা’-র পাতা ওলটাতে-ওলটাতে কী মনে হওয়ায় ব্যাগ থেকে ‘কাজললতা’-র নতুন সংখ্যাটা বের করলাম। ‘সুনন্দা’-য় এমন কী আছে যা আমার পত্রিকায় নেই? এবারের টুরে পরের মাস থেকে সারকুলেশান কতটা বাড়বে কে জানে! যে করে হোক, আগামী ছ-মাসের মধ্যে সারকুলেশান আমাকে বাড়াতেই হবে। তা না-হলে মালিকের কাছ থেকে ‘হে বন্ধু বিদায়।’
‘সারকুলেশান কিছুতেই বাড়াতে পারছেন না, তাই না?’ ভদ্রলোকের গম্ভীর গলা মোক্ষম প্রশ্ন ছুড়ে দিল আমার দিকে।
আমি চমকে ওঁর মুখের দিকে তাকালাম।
মিলিটারি গোঁফের কোণে দুর্জ্ঞেয় হাসি। হাতের চুরুট মাপে ছোট হয়ে এলেও তার ধোঁয়ায় তেজ কমেনি।
ভদ্রলোক আমার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বেশ মজা পেলেন। বারকয়েক মাথা নেড়ে বাবরি চুলে হাত চালিয়ে বললেন, ‘ওপর-ওপর দেখলে মনে হবে ‘সুনন্দা’-য় যা-যা আছে সবই আপনার ম্যাগাজিনে আছে। নামী-দামি লেখক, সুন্দর-সুন্দর ছবি, দামি কাগজ, ভালো ছাপা—বলতে গেলে তেমন কোনও তফাত নেই।’
আমি চটপট বারতিনেক ঘাড় নাড়লাম। কনসালট্যান্ট ভদ্রলোক ঠিক আমার মনের কথাটি বলেছেন। কিন্তু কিছু বলতে গিয়ে টের পেলাম, আমার মুখের ভেতরে জিভটা যেন গিরগিটির খসখসে লেজ। একই সঙ্গে গলা শুকিয়ে কাঠ।
ভদ্রলোক তাঁর হাতের বইটা ব্রিফকেসের ওপরে নামিয়ে রাখলেন। চুরুটে আয়েস করে ঘনঘন দুটো টান দিলেন। হাত নেড়ে চোখের সামনে থেকে ধোঁয়া সরিয়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে নিছকই ট্রেনে আলাপ। এ বিষয়ে বেশি কথা বলা ঠিক হবে কি না জানি না। তবে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব মানসিক চাপের মধ্যে আছেন…তাই বলছি…।’
আমি দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
রাতের ট্রেন কোনও একটা স্টেশনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ট্রেনের খটাখট শব্দ হঠাৎ যেন কয়েক ধাপ বেড়ে গেল। বন্ধ কাচের জানলার ফাঁক দিয়ে শীতের ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল। কিন্তু আমি শীত গ্রাহ্য না-করে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওঁর চশমার ডান-কাচে কেবিনের একটা আলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ওঁর বাঁ-চোখ লেন্সের ভেতর দিয়ে আমাকেই দেখছিল।
ভদ্রলোক সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ”সুনন্দা”-র বিক্রি আড়াই লাখেরও বেশি। শুধুমাত্র ভালো লেখা, ছাপা, রংচঙ বা দামি কাগজ দিয়ে এই সারকুলেশানে পৌঁছনো যায় না। এর অন্য একটা সিক্রেট আছে…।’
‘কী সিক্রেট?’ আমি চাপা গলায় প্রশ্ন করার সঙ্গে-সঙ্গে ভদ্রলোকের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়লাম।
ভদ্রলোক চুরুটটা আশট্রেতে গুঁজে দিয়ে সামান্য হাসলেন: ‘সিক্রেটটা হল হিউম্যান কেমিস্ট্রি। আমি জানি, আপনি এর নাম শোনেননি—শোনার কথাও নয়। কারণ ব্যাপারটা সতেরো শতকের অ্যালকেমির মতোই খুব গোপনে চর্চা করা হয়…।’
হিউম্যান কেমিস্ট্রি! কেমিস্ট্রির এরকম কোনও শাখা আছে বলে কখনও শুনিনি। তা ছাড়া সেই ছোটবেলা থেকেই কেমিস্ট্রিকে ভয় পেয়ে বড় হয়েছি। প্রায় রোজই করুণাময় ঈশ্বরকে প্রাণপণে ডেকেছি, কবে কেমিস্ট্রি আমার নগণ্য জীবন থেকে অদৃশ্য হবে। আর শেষকালে ম্যাগাজিনের রেকর্ড সারকুলেশানের সিক্রেট কিনা ‘ইয়ে’ কেমিস্ট্রি!
‘বুঝতে পারছি, রসায়নশাস্ত্র ব্যাপারটার প্রতি আপনার খুব একটা শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই। অ্যালকেমি সম্পর্কেও বেশিরভাগ মানুষের এইরকম ধারণা ছিল। অ্যালকেমি শব্দটার বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে অপরসায়ন। কিন্তু যাঁরা জানার তাঁরা ঠিকই জানেন কোন-কোন ধাতু থেকে কীভাবে সোনা তৈরি করা যায়। সুতরাং, অ্যালকেমি একেবারে অলীক ব্যাপার নয়।’
প্রসঙ্গ পালটে যাচ্ছে দেখে আমি অধৈর্য হয়ে ভদ্রলোককে খেই ধরিয়ে দিতে চাইলাম: ‘কিন্তু সারকুলেশানের সঙ্গে হিউম্যান কেমিস্ট্রির কী সম্পর্ক?’
‘সম্পর্ক আছে—খুব গভীর সম্পর্ক। অ্যালকেমির মতো হিউম্যান কেমিস্ট্রিও খুব গোপনে চর্চা করা হয়। সারা পৃথিবীতে এই বিষয় নিয়ে এখন গবেষণা করছে বড়জোর শ-দুয়েক বিজ্ঞানী। আমি এই লাইনে গবেষণা করছি প্রায় ৪০ বছর…।’
‘আপনি যে বললেন, ‘আপনি…ইয়ে…মানে, কনসালট্যান্ট?’
ভদ্রলোক ভরাট গলায় নীচু পরদায় হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, ম্যাগাজিনের সারকুলেশান কনসালট্যান্ট—যদিও আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি হিউম্যান কেমিস্ট্রি।’
আমি আর থাকতে না পেরে একটু খোঁচা দিয়েই বললাম, ‘আপনার ওই হিউম্যান কেমিস্ট্রি দিয়ে সারকুলেশান বাড়ানো যায় না কি?’
ভদ্রলোক বিন্দুমাত্রও আহত না-হয়ে জবাব দিলেন, ‘একমাত্র হিউম্যান কেমিস্ট্রি দিয়েই কোনও ম্যাগাজিনের সারকুলেশান ফিনোমিনাল জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব—ঠিক যেমনটা ”সুনন্দা” করেছে। দাঁড়ান, ব্যাপারটা আপনাকে একটু বুঝিয়ে বলি…।
‘আপনি বোধহয় জানেন না, আমাদের প্রত্যেকটা অ্যাকশন বা রিঅ্যাকশনের জন্যে আমাদের শরীরের ভেতরে নানারকম জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে যায়। যেমন ধরুন, আপনি হঠাৎ রেগে গেলেন, কিংবা ভয় পেলেন, অথবা উত্তেজিত হলেন—এইরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপনার শরীরের ভেতরে ভিন্ন-ভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া হবে। এই বিক্রিয়াগুলো এতই জটিল যে, এর অনেকটাই এখনও বিজ্ঞানীদের ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে থেকে গেছে। আমাদের শরীরে কতরকম অ্যামিনো অ্যাসিড আর প্রোটিন মলিকিউল রয়েছে। এরা আবার নানারকম কেমিক্যাল চেইন তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে সে এক মিরাকিউলাস ব্যাপার। সেইজন্যেই এর বেশিরভাগটাই রহস্য থেকে গেছে।’ একটু থেমে নতুন একটা চুরুট ধরালেন ভদ্রলোক। তারপর চুরুটে বারকয়েক টান দিয়ে জড়ানো গলায় বললেন, ‘তবে আমি এই মিস্ট্রির কিছুটা সলভ করেছি। কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলে যে আমাদের শরীরের ভেতর কী করতে পারে তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।’ হেসে কথা শেষ করলেন তিনি। ধোঁয়া ছাড়লেন আয়েস করে।
ভদ্রলোকের কেমিস্ট্রির কচকচি আর চুরুটের ধোঁয়ার কটু গন্ধে আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কনসালট্যান্ট ভদ্রলোক কয়েকবার কেশে উঠলেন। তারপর মাথা নেড়ে ঠোঁটের কোণে হেসে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এবারে আসি ট্যাকটাইল ফিডব্যাকের কথায়…।’
‘ট্যাকটাইল ফিডব্যাক?’ নিজের অজান্তেই উচ্চারণ করে ফেললাম শব্দ দুটো।
‘হ্যাঁ, ট্যাকটাইল ফিডব্যাক। মানে, আমাদের স্পর্শ অনুভূতির যে-খবর মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় তাকেই বলে ট্যাকটাইল ফিডব্যাক। এই খবর পৌঁছনোমাত্রই আমাদের শরীরের ভেতরে জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়…।’
আমি উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলাম, ‘হিউম্যান কেমিস্ট্রি!’
ভদ্রলোক বেশ জোরে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন। আচ্ছা, বলুন তো, কোনও কিছু টাচ করলে কী করে আপনি সেটা টের পান?’
‘কেন, চোখে দেখে।’ সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিলাম আমি।
‘উহুঁ, হল না। চোখ বুজে টাচ করলে বুঝি টের পান না?’
একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘হ্যাঁ, পাই।’
‘শুধু তাই নয়, চোখ বুজে কোনও জিনিস ছুঁয়ে আপনি অনেক সময় এটাও বলে দিতে পারেন, জিনিসটা কী। যেমন, লোহা ছুঁলে যেরকম অনুভূতি হবে কাঠ ছুঁলে সেরকম হবে না। তেমনই কাচ, কাপড়, কিংবা কোনও মেয়ের নগ্ন শরীর—এসবের স্পর্শ অনুভূতিও একরকম নয়। এক-একরকম স্পর্শ অনুভূতির জন্যে আমাদের শরীরের ভেতরে এক-একরকম বিক্রিয়া হয়। একটা বিক্রিয়ার সঙ্গে আর একটা বিক্রিয়ার কোনও মিল নেই। দাঁড়ান, আপনাকে ব্যাপারটা একটু দেখাই…’ বলে ভদ্রলোক চুরুটে জোরালো টান দিয়ে বাঁ-হাতে নিজের ব্রিফকেসটা খুলে ফেললেন। একটা মোটাসোটা ডায়েরি বের করলেন ভেতর থেকে। অতি ব্যবহারে পাতাগুলো সেলাই কেটে খানিকটা করে বেরিয়ে এসেছে। ভদ্রলোক ডায়েরিটা খুলে সাবধানে তার পাতা ওলটাতে লাগলেন।
আমি অদ্ভুত মানুষটিকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, শেষ পর্যন্ত পাগলের পাল্লায় পড়লাম না কি! হিউম্যান কেমিস্ট্রি, ট্যাকটাইল ফিডব্যাক…আমার কপালের পাশটা দপদপ করছিল।
‘এই দেখুন—’ বলে ভদ্রলোক খোলা ডায়েরিটা আমার সামনে এগিয়ে দিলেন।
ডায়েরির দুটো পৃষ্ঠা জুড়েই নানারকম রাসায়নিক সংকেত আর সমীকরণ। তবে একটা ব্যাপার ভারি অদ্ভুত মনে হল। কেমিস্ট্রিতে আমার যেটুকু জ্ঞান, তাতে দেখেছি সবরকম রাসায়নিক সমীকরণেই শুধুমাত্র যোগচিহ্ন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভদ্রলোকের ডায়েরির খোলা পাতায় যে-সব সমীকরণ লেখা রয়েছে সে-গুলোতে উনি অকাতরে যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ চিহ্ন ব্যবহার করেছেন—ঠিক সরল অঙ্কের মতো। এ-আবার কী ধরনের রাসায়নিক সমীকরণ!
ভদ্রলোক শব্দ করে ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে দিলেন ব্রিফকেসের ভেতরে। চুরুটে টান দিয়ে কেবিনের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসব কেমিক্যাল ইকুয়েশন আপনি কিছুই বুঝবেন না। কারণ প্রথাগত বিজ্ঞান এখনও এই বিচিত্র বিজ্ঞানের খবর পায়নি। হিউম্যান কেমিস্ট্রির এই বিক্রিয়াগুলো আমার গত ১৮ বছরের গবেষণার ফল।
‘যাই হোক, যা বলছিলাম—’ ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসে আমার দিকে সরাসরি তাকালেন, ‘একটা বিশেষ ধরনের ট্যাকটাইল ফিডব্যাকের জন্যে শরীরের ভেতরে একটা বিশেষ ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়। এবার যদি এমন করা যায়, আপনি ছোঁবেন একটা জিনিস অথচ আপনার শরীরের ভেতরে তার জন্যে নির্দিষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াটি হবে না—হবে অন্য কোনও বিক্রিয়া। যার ফলে আপনার ব্রেন আপনাকে অন্যরকম অনুভূতির খবর দেবে। তা হলে কী হবে বলুন তো?’
‘স্পর্শ অনুভূতির ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যাবে।’
‘ঠিক তাই। এবার ধরুন, আপনি একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছেন—বা ম্যাগাজিনটা স্রেফ ছুঁয়ে আছেন। অথচ যে-স্পর্শ অনুভূতি আপনার মস্তিষ্কে পৌঁছচ্ছে সেটা কাগজ ছোঁওয়ার নয়—আপনার যেন মনে হচ্ছে, আপনি আপনার প্রিয়তম নারীর নগ্ন শরীর ছুঁয়ে আছেন। তখন কী হবে?’
সারকুলেশান বাড়ানোর সঙ্গে হিউম্যান কেমিস্ট্রির সম্পর্কটা এবারে যেন আমি আঁচ করতে পারছি। তাই ভেতরে-ভেতরে উত্তেজিত হয়ে পড়লাম।
ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘কিন্তু আমার চোখ তো দেখবে আমি একটা ম্যাগাজিন ছুঁয়ে আছি! তা হলে—।’
আমাকে বাধা দিয়ে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন। চোখ যে-ইনফরমেশান ব্রেনে পাঠাবে তার সঙ্গে ট্যাকটাইল ফিডব্যাকের ইনফরমেশান মিলবে না। তখন এই দুটো পরস্পরবিরোধী খবরের মধ্যে যেটা আপনার প্রিয় সেটাই আপনি মেনে নেবেন। এই কারণেই ”সুনন্দা” পত্রিকাটা আপনি কখনও কাছ-ছাড়া করতে চান না। ওটা সবসময় আপনার হাতের কাছে রাখতে ইচ্ছে করে।’
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বিমূঢ় চোখে আমার কোলের ওপর রাখা ‘সুনন্দা’ পত্রিকাটার দিকে তাকালাম। এটাই তা হলে ম্যাগাজিনটার গোপন ম্যাজিক!
‘ ”সুনন্দা”-র ব্যাপারটা আমি ভালো করেই জানি,’ ভদ্রলোক তখনও বলে যাচ্ছেন, ‘আমি ওদের কনসালট্যান্ট। অবশ্য এটা ওরা সিক্রেট রেখেছে। ”সুনন্দা”-র ট্যাকটাইল ফিডব্যাকের রাসায়নিক বিক্রিয়া পালটে দেওয়ার ব্যাপারটা আমার ওই হিউম্যান কেমিস্ট্রির কারিকুরি। জানি, আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু যা সত্যি তাই আপনাকে বললাম…বিশ্বাস করা-না-করাটা আপনার ব্যাপার।’
‘একটা ব্যাপারে একটু খটকা লাগছে…’ একটু ইতস্তত করে আমি বললাম, ‘ট্যাকটাইল ফিডব্যাকের ইনফরমেশানটা আপনি পালটাচ্ছেন কেমন করে?’
ভদ্রলোক আমার দিকে সরাসরি চোখ রেখে মুচকি হাসলেন। চুরুটে গভীর টান দিলেন। চুরুটের ডগার আগুনটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটু সময় নিয়ে তিনি বললেন, ‘ট্যাকটাইল ফিডব্যাক আমি চেঞ্জ করেছি পাইরোনিকিঅ্যামিনোথিলিন দিয়ে—।’
‘পাইরোনিকি…।’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, পাইরোনিকি-অ্যামিনোথিলিন। প্রথাগত রসায়নশাস্ত্র কখনও এই কেমিক্যালটার নাম শোনেনি। এটা হিউম্যান কেমিস্ট্রির ব্যাপার…আমার ল্যাবরেটরিতে অনেক ঝঞ্ঝাট করে তৈরি। ”সুনন্দা” যে-কাগজে ছাপা হয় তার মধ্যে এই কেমিক্যাল নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে দেওয়া আছে। এ-ব্যাপারে পেপার মিলের সঙ্গে ব্যবস্থা করা আছে। আর যে-কালিটা ওরা ছাপার জন্যে ব্যবহার করে তার মধ্যেও মেশানো আছে ওই পাইরোনিকিঅ্যামিনোথিলিন। এটাই হল ”সুনন্দা”-র গোপন ম্যাজিক। তাই আপনাকে বলছিলাম, শুধুমাত্র ভালো লেখা, ছাপা, রংচঙ বা দামি কাগজ দিয়ে আড়াই লাখ প্লাস সারকুলেশানে পৌঁছনো যায় না—এর অন্য একটা সিক্রেট আছে। এবার তো সেই সিক্রেট আপনি জেনে গেলেন।’
কথা শেষ করে ভদ্রলোক চুরুটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। কৌতুকের নজরে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।
শীতের মধ্যেও আমার কপালে বোধহয় ঘাম জমছিল। ভদ্রলোকের এই অবিশ্বাস্য কাহিনি কি বিশ্বাস করা যায়? কিন্তু ‘কাজললতা’-র সারকুলেশানের যা অবস্থা তাতে মরিয়া হয়ে কিছু একটা আমাকে করতেই হবে। আগামী ছ-আট মাসের মধ্যে সারকুলেশান বাড়ানোর কোনও ব্যবস্থা না করতে পারলে মালিক কলকাতার পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবেন দিল্লি অথবা মুম্বইতে। সুতরাং ডুবে যাওয়া মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো আমি ভদ্রলোককে অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘আমাদের ম্যাগাজিনটার একটা হিল্লে করে দিন না। আর কয়েক মাসের মধ্যে যদি ওটার সারকুলেশান না বাড়াতে পারি…।’
ভদ্রলোককে আমার দুরবস্থার কথা খুলে বললাম।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, ‘আপনার পজিশনটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। তবে আমারও একটা অসুবিধে আছে। ”সুনন্দা”-র সঙ্গে আমার পাঁচ বছরের এগ্রিমেন্ট হয়েছে। সেই কন্ট্রাক্ট পিরিয়ড শেষ হতে এখনও একটা বছর বাকি। আমি একটা ম্যাগাজিনের হয়ে কখনও পাঁচ বছরের বেশি কাজ করি না। কারণ, একটা ম্যাগাজিন চিরকাল সারকুলেশানের টপে থাকতে পারে না—অন্তত থাকা উচিত নয়—সেটাই ন্যাচারাল। সেই অর্থে আমি কখনও নেচারের বিরুদ্ধে যেতে চাই না। সুতরাং আপনার ম্যাগাজিনের সারকুলেশান কনসালট্যান্ট হতে আমার কোনও অসুবিধে নেই—শুধু ওই কন্ট্রাক্টের ব্যাপারটা ছাড়া। একটা বছর আপনাকে ওয়েট করতেই হবে।’
‘এক বছর!’
আমার হতাশা দেখে ভদ্রলোক উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘একটা বছর মানে ৩৬৫ দিন। ও দেখতে-দেখতে কেটে যাবে। তা ছাড়া আমার ফিজের ব্যাপারটা নিয়েও আপনার মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। আপনি যেভাবে হোক একটা বছর ম্যানেজ করে নিন। তারপর আমি এসে গেলেই দেখবেন ম্যাজিক। তখন আপনার ম্যাগাজিন সোয়াহিলি ভাষাতে ছাপা হলেও এই পাইরোনিকিঅ্যামিনোথিলিনের কৃপায় রমরম করে বিক্রি হবে—।’
খেয়াল করিনি কখন ট্রেনের গতি কমে এসেছিল। আর ভদ্রলোকও কাচের জানলা দিয়ে হঠাৎ একবার উঁকি মেরে আপনমনেই বললেন, ‘ও, এসে গেছে।’ তারপর চট করে ব্রিফকেস গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ছোট্ট একটা হাই তুলে বললেন, ‘চলি। যা বললাম, ওই একটা বছর কোনওরকমে ম্যানেজ করে নিন।’
কেবিনের দরজা ঠেলে তিনি করিডরে পা রাখতেই আমি পিছু ডেকে বললাম, ‘আপনার অ্যাড্রেসটা?’
ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে। মুচকি হেসে বললেন,’অ্যাড্রেসের দরকার নেই। এক বছর পর আমিই আপনার অফিসে ফোন করে কনট্যাক্ট করে নেব। ”কাজললতা” তো, আমার মনে থাকবে।’
ভদ্রলোক চলে গেলেন। ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে আমি একা বসে রইলাম।
কাচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে স্টেশনের নামটা পড়তে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কুয়াশা আর টিমটিমে মলিন আলো আমার চেষ্টায় বাদ সাধল।
ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করল। আমি ‘সুনন্দা’ পত্রিকাটা হাতে তুলে নিলাম। তারপর চোখ বুজে ‘সুনন্দা’-র পাতায় হাত বোলাতে লাগলাম। মনে হল, একটা অদ্ভুত আমেজ যেন টের পাচ্ছি। পাইরোনিকিঅ্যামিনোথিলিন তা হলে মিথ্যে নয়!
একটা বছর সত্যিই দেখতে-দেখতে কেটে গেল। কিন্তু কোনও টেলিফোন এল না আমার অফিসে। তারপর আরও দশটা দিন কেটে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই কনসালট্যান্ট ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেননি।
মালিককে অনেক বলে-কয়ে হাতে-পায়ে ধরে আমি পত্রিকাটা এখনও চালু রেখেছি। ওঁকে বলেছি ট্রেনের সেই ভদ্রলোকের কথা, পাইরোনিকিঅ্যামিনোথিলিনের কথা। তাতে উনি খুব হেসে ব্যাপারটাকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস তাতে এতটুকুও টলেনি। তাই আমি এখনও মরিয়া হয়ে একটা টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করছি। আমি জানি ফোন আসবেই। কারণ সেই ফোনটার ওপরে প্রায় দেড়শো পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
আর ‘সুনন্দা’-র পাঠক হিসেবে আপনাকে একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ করব। যদি কখনও সেই ভদ্রলোককে কোথাও দেখতে পান, দয়া করে আমাকে টেলিফোন করার কথাটা ওঁকে একবার মনে করিয়ে দেবেন। বলবেন, আমরা সবাই ওঁর মুখ চেয়ে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছি।
আমিও অবশ্য একেবারে হাত গুটিয়ে বসে নেই। দূরপাল্লার ট্রেনগুলোতে—বিশেষ করে রাতের ট্রেনে—খেয়ালখুশিমতো উঠে পড়ছি। ফার্স্ট ক্লাস কামরায় খুঁজে বেড়াচ্ছি সেই ভদ্রলোকেকে।
আমি জানি, একদিন-না-একদিন ওঁকে আমি খুঁজে পাবই। যে করে হোক খুঁজে আমাকে পেতেই হবে।
গল্পটা শেষ করে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। হাত-পা কাঁপতে লাগল। কপালের কাছটায় একটা অদ্ভুত ব্যথা শুরু হয়ে গেল।
এমন সময় চমকে উঠে খেয়াল করলাম, ট্রেনের গতি কমতে শুরু করেছে। বোধহয় সামনে কোনও স্টেশন আসছে।
কনসালট্যান্ট ভদ্রলোক ব্রিফকেস গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাচের জানলা দিয়ে বাইরে একবার উঁকি মেরে বললেন, ‘চলি, আমার স্টেশন এসে গেছে—।’
আমি তখন মরিয়া হয়ে ওঁকে বললাম আমার ম্যাগাজিনের কথা।
তাড়াহুড়ো করে বলতে গিয়ে অনেক কথা জড়িয়ে গেল। কিন্তু ভদ্রলোক আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে মসৃণ হেসে হাত নেড়ে বললেন, ‘কোনও চিন্তা নেই। সব বুঝতে পেরেছি। পাইরোনিকিঅ্যামিনোথিলিনের ব্যাপার তো! আসলে আমার সঙ্গে ”সুনন্দা”-র কন্ট্রাক্ট শেষ হতে এখনও এক বছর বাকি। এই একটা বছর কোনওরকমে ম্যানেজ করে নিন, তারপর…।’
‘আপনার অ্যাড্রেস বা ফোন নাম্বার যদি দেন—।’
ভদ্রলোক কেবিনের দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। মুচকি হেসে বললেন, ‘ওসবের দরকার নেই। এক বছর পর আমিই আপনার অফিসে ফোন করে কনট্যাক্ট করে নেব। ”চারুলতা” তো, আমার মনে থাকবে।’
ভদ্রলোক চলে গেলেন। ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে শুধু চুরুটের গন্ধ ভেসে রইল।
তারপর এক বছর কেটে গেছে, কিন্তু আমার অফিসে কোনও ফোন আসেনি। বছর পেরিয়ে আরও দশদিন কেটে গেছে, কিন্তু ওই কনসালট্যান্ট ভদ্রলোক আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি।
তবে আমি কিন্তু এখনও হাল ছাড়িনি। মরিয়া হয়ে একটা টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করছি। আর দূরপাল্লার ট্রেনগুলোতে—বিশেষ করে রাতের ট্রেনে—খেয়ালখুশিমতো উঠে পড়ে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি সেই ভদ্রলোককে।
আমি জানি, একদিন-না-একদিন ওঁকে আমি খুঁজে পাবই। যে করে হোক খুঁজে আমাকে পেতেই হবে।
আর ‘সুনন্দা’-র পাঠক হিসেবে আপনাকেও একান্ত অনুরোধ, যদিও কখনও সেই ভদ্রলোককে কোথাও দেখতে পান, দয়া করে আমাকে টেলিফোন করার কথাটা ওঁকে একবার মনে করিয়ে দেবেন। বলবেন, দেড়শোটা পরিবার ওঁর মুখ চেয়ে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছে।