রাজা সুখময়ের পরিবারবর্গ (পাথুরিয়াঘাটা)
এই পুরাতন ধনী বংশের প্রতিষ্ঠাতা কোটিপতি লক্ষ্মীকান্ত ওরফে নকুড় ধর কবে কোথা থেকে এসে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন, জানা মুকিল। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটায় যে অঞ্চলটিতে তিনি বাস করতেন তার বর্তমান নাম সুখ বাজার।
অতুল ঐশ্বর্যের অধিপতি লক্ষ্মীকান্ত ধনৈশ্বর্যের জন্য বিখ্যাত তো ছিলেনই, তিনি সকলের কাছে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি তাঁর ভক্তির জন্য। কর্নেল ক্লাইভ ও তাঁর পূর্ববর্তীগণ নকুড় ধরের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। মারাঠা যুদ্ধের সময়ও অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এঁর আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল। নকুড় ধরের বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তাঁর কন্যার একমাত্র জীবিত পুত্র রাজা সুখময় রায় বাহাদুর। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভক্তিতে দৌহিত্র মাতামহ অপেক্ষা কম ছিলেন না; অবশ্য জনহিতকর কার্যেও তিনি অনেক অৰ্থ ব্যয় করতেন। জগন্নাথধাম পুরীগামী তীর্থযাত্রীদের যাতায়াতের জন্য রাস্তা ও আশ্রয়ের জন্য যাত্রীনিবাস নির্মাণকল্পে তিনি লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেন। তাঁর এই দানের জন্য মার্কুইস অব হেস্টিংসের শাসনকালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে থেকে তিনি রাজা বাহাদুর খেতাব ও একটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এর কিছুদিন পর দিল্লীর বাদশাহ্ শাহ্ আমলও তাঁকে রাজাবাহাদুর খেতাব ও পাঁচ হাজার সওয়ার রাখবার অধিকার দান করেন। তাঁর দু’বার রাজা বাহাদুর খেতাব পাবার সংবাদের প্রতি পারস্যের মহামান্য সম্রাটের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়; তখন তিনিও কাউন্সিলের মারফত তাঁকে রাজা বাহাদুর খেতাব দ্বারা সম্মানিত করেন। মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ পুত্র রেখে যান; তাঁরা হলেন ১. রাজা রামচন্দ্র রায়, বাহাদুর, ২. রাজা কৃষ্টচন্দ্র রায়, বাহাদুর, ৩. রাজা বৈদ্যনাথ রায়, বাহাদুর, ৪. রাজা শিবচন্দ্র রায়, বাহাদুর এবং রাজা নৃসিংহচন্দ্র রায়, বাহাদুর।
১. রাজা সুখময়ের জ্যেষ্ঠপুত্র রাজা রামচন্দ্র একমাত্র পুত্র রাজা রাজ নারায়ণকে রেখে মারা যান। রাজনারায়ণ অপুত্রক ছিলেন; তাঁর পোষ্যপুত্র কুমার ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ও অপুত্রক ছিলেন; তিনি কুমার দীনেন্দ্রনারায়ণকে পোষ্য নেন। এই দীনেন্দ্রনারায়ণ এখন জোড়াসাঁকোয় বাস করছেন।
২. রাজা সুখময়ের মধ্যমপুত্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন অপুত্রক।
.
৩. রাজা সুখময়ের তৃতীয় পুত্র রাজা বৈদ্যনাথ রায় বাহাদুর রাজভক্তি ও দানে তাঁর পূর্বপুরুষের সমতুল্য ছিলেন। লর্ড আমহার্স্ট তাঁকে রাজা বাহাদুর খেতাব, একটি স্বর্ণপদক এবং অপূর্ব কারুকার্য খচিত একখানি তরবারি দান করেন। তরবারিটি তিনি সকল সমাবেশে পরিধান করতেন।
উপযুক্ত পিতার যোগ্য পুত্র ছিলেন রাজা বৈদ্যনাথ রায়; রাজভক্তি ও দানের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর আদর্শস্থানীয় পূর্বপুরুষদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। ফলে তিনি তাঁর সমসাময়িক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের অগ্রগণ্য হয়ে উঠেছিলেন। এখানে জনহিতকর কাজে তাঁর কয়েকটি দানের কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। হিন্দু কলেজকে তিনি দান করেছিলেন ৫০,০০০ টাকা; কাশীপুর গান ফাউন্ড্রি ঘাট ও দমদম থেকে ওই ঘাট পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণকল্পে দিয়েছিলেন ৪০,০০০ টাকা। নেটিভ্ হাসপাতালের জন্য ৩০,০০০ টাকা; মিস উইলসন প্রকল্পিত নেটিভ স্ত্রীলোকদের শিক্ষার জন্য ২০,০০০ টাকা; কর্মনাশা পুল নির্মাণ প্রকল্পে ৮,০০০ টাকা; ইংলন্ডের জুয়োলজিক্যাল সোসাইটিকে দান করেছিলেন ৬,০০০ টাকা এ দানের জন্য মার্কুইস অব ল্যান্সডাউন তাঁকে অতি উচ্চ প্রশংসাপত্র দেন এবং লন্ডন জুয়োলজিক্যাল সোসাইটি ১৮২৬-এর ২২ জানুয়ারি তাঁকে একখানা ডিপ্লোমা দান করেন।
রাজা বৈদ্যনাথের দুই পুত্র কুমার রাজকিষেণ রায় বাহাদুর এবং কুমার কালীকিষেণ রায়, বাহাদুর। কুমার রাজকিষেণ দুই পুত্র কুমার জয়গোবিন্দ ও কুমার শ্যামদাসকে রেখে পরলোক গমন করেন। কুমার জয়গোবিন্দের একমাত্র পুত্র কুমার মনোহরচন্দ্র সচ্চরিত্র যুবক। রাজা বৈদ্যনাথের কনিষ্ঠ পুত্র কুমার কালীকিষেণ জনহিতৈষণা সহ পিতার অনেক গুণ পেয়েছিলেন। তিনি পাইকপাড়ায় প্রথম সরকারি সাহায্যযুক্ত অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন; স্কুলটিকে তিনি বহু বছর সাহায্য করেছিলেন। চিৎপুরে নর্দার্ন সাবার্বান হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সময় তিনি ২,৫০০ টাকা এককালীন দান করেন, এবং মাসিক ১০০ টাকা হিসাবে চাঁদা দিতে থাকেন। মহিমান্বিত রাইট অনারেবল লর্ড নেপিয়ারের কলকাতায় আগমন উপলক্ষে কুমার কালীকিষেণ তাঁকে বিরাট অভ্রর্থনা ভোজে আপ্যায়িত করেন, যেমনটি তাঁর পিতা অভ্যর্থনা ভোজ দিয়েছিলেন ভরতপুর যুদ্ধে জয়লাভের জন্য লর্ড কম্বার মিয়ারকে। এই উপলক্ষে ভোজ ছাড়াও বলনাচ ও আতসবাজির বিপুল আয়োজন ছিল। একদিকে মহামান্যা মহারাণীর ৬২তম রেজিমেন্ট স্বাগত সুর বাজাচ্ছিল, অন্যদিকে কুমার কালীকিষেণ তখন মহামান্য অতিথিকে পান ও আতর উপহার দিচ্ছিলেন। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ সাফল্যমন্ডিত হয়। এ মন্তব্য করতে বড় আনন্দ হচ্ছে যে, এই অভিজাত পরিবারটির যোগ্য বংশধর পূর্বপুরুষদের অনুসৃত নীতি অনুযায়ী ঐ উপলক্ষে রাজভক্তির পরকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন; মহামান্য সেনানায়ক লর্ড নেপিয়ার অব ম্যাগডালাও যথাযোগ্যভাবে তার স্বীকৃতি জানান। লর্ড অকল্যান্ডের শাসনকালে কালিকিষেণকে ‘কুমার’ খেতাব, অভিজাত উপযোগী পরিচ্ছদ এবং হীরক সমন্বিত একটি ‘সরপচ্’ (পাগড়িতে আঁটবার রত্ন) দান করা হয়। লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁকে পারিবারিক তরবারি ব্যবহারের অনুমতি দেন। ১৮৭৮-এ কুমার কালীকিষেণের মৃত্যু হয়; মৃত্যুকালে তাঁর দুই সুশিক্ষিত পুত্র কুমার দৌলতচন্দ্র ও কুমার নগরনাথ জীবিত ছিলেন। পিতার জীবিতকালে দৌলতচন্দ্ৰ ১৮৭৫ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত সরকারি চাকরি করেছেন; তিনি ছিলেন কালীপুরের সাবরেজিস্ট্রার অব ডীডস অ্যান্ড অ্যাস্যুরেন্সেস। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক সম্পত্তি পরিচালনার জন্য তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। চাকরি করবার সময় ঐ দায়িত্বপূর্ণ পদে তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট করে কাজ করেছিলেন। এঁর দুই শিশুপুত্ৰ বৰ্তমান, কুমার তেজসচন্দ্র ও কুমার সতীশচন্দ্র। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগরনাথ ছিলেন নিঃসন্তান।
৪. রাজা সুখময় রায়ের চতুর্থ পুত্র রাজা শিবচন্দ্র রায়, বাহাদুর জনহিতৈষণামূলক বহু কাজ করায় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাজা খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।
৫. রাজা সুখময় রায়ের পঞ্চম ও কনিষ্ঠ পুত্র রাজা নৃসিংহচন্দ্র রায়, বাহাদুর তাঁর দানশীল স্বভাবের জন্য সকলের শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তাঁকেও ব্রিটিশ সরকার রাজা বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি একমাত্র পুত্র কুমার রাজকুমার রায়কে রেখে মারা যান। রাজকুমারের দুই পুত্র রাধাপ্রসাদ রায় ও কুমার দেবীপ্রসাদ রায়। কুমার রাজকুমার খুব সাদাসিধা জীবন যাপন করেন। সকল প্রকার বিলাসিতা বর্জন করে তিনি তাঁর সম্পত্তি প্রভূত পরিমাণ বাড়িয়েছেন। তাঁর পুত্র দুটিও ভাল শিক্ষা লাভ করেছেন। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তাঁরাও দেশের মঙ্গল সাধন করবেন।
রাজা সুখময় রায়ের বর্তমান বংশধরদের কলকাতা ও তার উপকণ্ঠে প্রচুর ভূসম্পত্তি আছে।