রাজা সাহেব
প্রথম অংশ
প্রথম পরিচ্ছেদ
অঙ্কুরোদ্ভেদ
যে প্রদেশের প্রসঙ্গ লইয়া আজ এই পুস্তক লিখিত হইতেছে, তাহা এই ভারতবর্ষের মধ্যে একটি নিতান্ত ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য। এরূপ কিম্বদন্তী আছে যে, এই রাজত্ব নিতান্ত ক্ষুদ্র এবং এখন নিতান্ত অধিক না থাকিলেও, পুরাকালে ইহার প্রতাপ অতিশয় প্রবলই ছিল। কিন্তু এখন আর সে দিন নাই, কাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইহার সেই প্রবল প্রতাপ অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। নামে স্বাধীন রাজা হইলেও, কাজে এখন পরাধীন হইয়া পড়িয়াছে। ইংরাজ রাজত্বের সঙ্গে পূর্ব্বে ইহার কোনরূপ সংস্রব না থাকিলেও, এখন সম্পূর্ণরূপে ইংরাজ রাজত্বের অধীন হইয়া পড়িয়াছে। এখন এই ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজত্বের ভিতর একজন ইংরাজ রেসিডেন্ট প্রবেশাধিকার পাইয়াছেন। রাজা স্বাধীন হইলেও সেই ইংরাজ রেসিডেন্টের অনুমতি ব্যতিরেকে আর কোনরূপে রাজকার্য্য নির্ব্বাহিত হইবার উপায় নাই।
একজন যুবক পূর্ব্বোক্ত রাজত্বের এখন বর্তমান রাজা। ইনি যশের সহিতই এ পর্যন্ত আপন প্রজাদিগকে প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন। রাজকার্য্য পর্যালোচনা এবং প্রজাদিগকে প্রতিপালন করিতে হইলে, রাজাগণের যে সকল গুণের আবশ্যক হয়, জগদীশ্বর ইঁহাকে সেই সকল গুণ হইতে বঞ্চিত করেন নাই।
এদেশীয় বর্ত্তমান রাজা ও প্রধান প্রধান জমীদারগণ যে প্রকার সংক্রামক রোগে আজকাল আক্রান্ত হইতেছেন, যে সংক্রামক রোগের ভয়ানক প্রকোপে কেহ রাজ্যচ্যুত হইতেছেন, কেহ তাঁহার পৈতৃক জমীদারী নষ্ট করিয়া পরিশেষে পথের ভিখারী হইতেছেন, আমাদিগের পুস্তকোল্লিখিত রাজা রাজকার্য্য পর্যালোচনায়, এবং প্রজা প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ না হইলেও, সেই সংক্রামক রোগ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই।
পাঠকগণ! এই সংক্রামক রোগ যে কি, তাহা বুঝিতে পারিয়াছেন কি? ইহা আয়ুৰ্ব্বেদান্তর্গত কোন প্রকার রোগ নহে, এ রোগের নাম “ঋণ” রোগ। আজ তাঁহার রাজত্বের ভিতর লাটসাহেবের শুভাগমন হইয়াছে, তাঁহাকে সম্মানিত করিবার নিমিত্ত —তাঁহার অনুচরবর্গের সেবার নিমিত্ত দশ সহস্র মুদ্রার আবশ্যক; রাজকোষে অর্থ নাই, কাজেই ঋণ করিতে হইবে। আজ গবর্ণমেন্ট রাজার উপর সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে মহারাজা উপাধি প্রদান করিয়াছেন। সুতরাং কিছু অর্থের প্রয়োজন –একটি দরবারের আবশ্যক; কিন্তু রাজকোষ শূন্য, কাজেই ঋণের আবশ্যক। এইরূপ নানাকারণে আজকাল রাজা ও জমীদারগণের যেরূপ দুর্দশা ঘটিয়া আসিতেছে, বর্তমান মহারাজেরও আজ সেই দুর্দ্দশা। তিনি সেই সংক্রামক রোগের ভয়ানক যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া নিতান্ত কষ্টভোগ করিতেছেন।
সমস্ত দিবস রাজকার্য্য পর্য্যালোচনা করিয়া, একদিবস সন্ধ্যার পর তাঁহার প্রধান মন্ত্রীর সহিত নির্জ্জনে বসিয়া মহারাজ বৈষয়িক গুপ্ত পরামর্শে নিযুক্ত হইলেন। তাঁহারা যে যে বিষয় সম্বন্ধে পরামর্শ করিলেন, তাহার সমস্ত কথার উল্লেখ করা এই পুস্তকের উদ্দেশ্য নহে। এই নিমিত্ত সে সমস্ত বিষয় পরিত্যাগ করিয়া, কেবলমাত্র যে সূত্র অবলম্বনে একটি ভয়ানক জুয়াচুরির দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছিল, তাহারই দুই চারিটি কথা এইস্থানে বর্ণিত হইল মাত্র।
মহারাজ। মন্ত্রী মহাশয়! আপনি বুঝিতে পারিতেছেন কি যে, আমার এই রাজত্বে যে পরিমাণ আয় হইয়া থাকে তাহা অপেক্ষা ব্যয় দিন দিন ক্রমেই বৰ্দ্ধিত হইতেছে, এবং তজ্জন্য সঙ্গে সঙ্গে ঋণও বৰ্দ্ধিত হইতেছে? আপনি বলুন দেখি, এখন কি উপায় আছে, যাহা অবলম্বন করিলে উহা দিন দিন বৰ্দ্ধিত না হইয়া, ক্রমে উহার লাঘব হইতে পারে, বিশেষতঃ কিরূপেই বা উহা হইতে পরিত্রাণ পাইয়া মনের সুখে রাজকার্য্য করিতে সমর্থ হই? আমি অনেক সময়ে অনেকরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু এরূপ কোন উপায় স্থির করিতে পারি নাই যে, যাহাতে এই ঋণজাল হইতে ক্রমে পরিত্রাণ পাইতে পারি।
মন্ত্রী। মহারাজ! অনেক দিবস হইতে আমি এই বিষয় আপনাকে বলিব মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু উপযুক্তরূপ সুযোগ না ঘটায় এতদিবস তাহা আমি আপনাকে বলিতে সমর্থ হই নাই। ঋণের নিমিত্ত আপনি ভাবিবেন না। কারণ, এই জগতে এরূপ মনুষ্যই নাই যে, যাহার কোন না কোন প্রকারে কিছু না কিছু ঋণ আছে। অপরের কথার প্রয়োজন কি, যাঁহার রাজত্ব হইতে সূর্য্যদেব একবারে অস্তমিত হন না, সেই মহারাণী ভারতেশ্বরীরই দেখুন না কেন, কত টাকা দেনা। মহারাজ! আপনি যদি সেই প্রকার দেনা করিতেন, তাহ হইলে আমাদিগের চিন্তিত হইবার কোন কারণই থাকিত না। আপনার ঋণ অপরাপর রাজাগণের ঋণ অপেক্ষা সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন। এই নিমিত্তই আমরা অতিশয় ভীত ও চিন্তিত হইয়াছি, এবং এই নিমিত্তই আমি মহারাজকে কিছু বলিতে ও সৎপরামর্শ দিতে পূৰ্ব্ব হইতেই ইচ্ছা করিয়াছিলাম।
মহারাজ। আপনি কহিলেন যে, আমার ঋণের সহিত অপরের ঋণের প্রভেদ আছে, ইহার নিমিত্তই ভয় ও চিত্তা। কিন্তু আমি আপনার এই কথার তাৎপর্য্য কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। ঋণমাত্রই ভয় ও চিন্তার কারণ, ইহা সৰ্ব্বসম্মত। কিন্তু আমার ঋণ ও অপরের ঋণের প্রভেদ কি? যে প্রকারের ঋণই হউক, আমি সকল ঋণকে সমান দেখিয়া থাকি।
মন্ত্রী। অপরের ঋণের সহিত মহারাজের ঋণের বিশিষ্ট প্রভেদ আছে। আমি হিসাব করিয়া দেখিয়াছি, আপনার ঋণ প্রায় তিন লক্ষ টাকা হইবেক, এবং সেই তিন লক্ষ টাকা প্রায় শতাধিক লোকের নিকট হইতে অধিক সুদে ক্রমে ক্রমে লইয়া হইয়াছে; এমন কি, শতকরা মাসিক বার আনা সুদ হইতে আরম্ভ করিয়া দেড় টাকা পৰ্য্যন্ত সুদ দিতে হয়। ইহাতে শতকরা গড় এক টাকা হিসাবে সুদ ধরিলেও তিন লক্ষ টাকার বৎসরে ছত্রিশ হাজার টাকা সুদ লাগে। বিশেষতঃ এই রাজত্বের অনেক প্রজার নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করাতে অনেকেই রাজত্বের দেনার বিষয় অবগত হইয়াছে; সুতরাং ইহাতে মহারাজের অনিষ্ট ভিন্ন কোনক্রমেই ইষ্ট হইতে পারে না। অপরাপর রাজাগণ ঋণ করিতে হইলে একস্থান ভিন্ন অনেক স্থানে গমন করেন না, তাহাও কম সুদে ও আপন আপন রাজত্বের বহির্ভাগে। এই নিমিত্ত তাঁহাদিগের ঋণের কথা কেহ জানিতে পারে না; সুতরাং তাঁহাদিগের রাজত্বের অনিষ্ট ঘটিবার সম্ভাবনাও নিতান্ত কম।
মহারাজ। আমি এ সমস্তই যে একবারে জানি না ও বুঝি না, তাহা নহে। কিন্তু আমি এখন যেরূপ অবস্থায় পতিত হইয়াছি, তাহাতে কিছুতেই বর্ত্তমান অবস্থার পরিবর্তন করিতে সমর্থ হইতেছি না। আপনিও একটু বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখুন দেখি, অতঃপর কি উপায় অবলম্বন করিলে আমার ও রাজত্বের বিশেষ মঙ্গল হইতে পারে।
মন্ত্রী। মহারাজ! এ বিষয়ে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু আমি ইহার উক্ত একমাত্র উপায় ভিন্ন আর কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই; বিশেষতঃ এই উপায় কিছু নূতনও নহে। এই উপায় অবলম্বন করিয়াই রাজামাত্রেই রাজ্য চালাইয়া থাকেন। আমার বিবেচনায় আপনিও সেই উপায় অবলম্বন করুন। তাহা হইলে রাজ্যের মঙ্গল হইবে, এবং ক্রমে ক্রমে এই রক্তবীজ সদৃশ ঋণজাল হইতে পরিত্রাণ পাইতে পারিবেন।
মহারাজ। এমন কি প্রকার বন্দোবস্ত করা কর্তব্য?
মন্ত্রী। বন্দোবস্ত আর কিছুই নহে। এখন একজন ধনী লোকের নিকট হইতে অল্প সুদে সমস্ত টাকা কর্জ্জ করিয়া এখানকার সমস্ত ব্যক্তির দেনা পরিশোধ করিয়া দিউন। বর্তমান ঋণ পরিষ্কার করিতে যতই কেন ঋণের প্রয়োজন হউক না, তৎসমস্তই এক ব্যক্তির নিকট হইতে লইতে হইবে। রাজত্বের উপস্বত্ব হইতে সম্বৎসরের খরচ বাদে যাহা কিছু উদ্বৃত্ত হইবেক, তাহা ক্রমে বৎসর বৎসর দেনা দেওয়া যাইবেক। তদ্ব্যতীত অল্প সুদে এমন কি শতকরা বাৎসরিক ছয় টাকা সুদেও যদি টাকা পাওয়া যায়, তাহা হইলেও এখন বৎসর বৎসর যে সুদ দিয়া আসিতেছি, তাহা অপেক্ষা বাৎসরিক প্রায় আঠার হাজার টাকা কম দিতে হইবেক। সুতরাং বৎসর বৎসর সেই অবশিষ্ট আঠার হাজার টাকা নিশ্চয়ই আসল দেনা হইতে কমিবেক।
মহারাজ। এ উপায় যে সর্ব্বাপেক্ষা উত্তম, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু অল্প সুদে এত টাকা এক ব্যক্তির নিকট হইতে কোথায় পাইব? কাহার এত টাকা আছে যে, সে আমাকে এত অল্প সুদে ধার দিবে?
মন্ত্রী। মহারাজ! এ প্রদেশে সে প্রকার লোক নাই। বিশেষতঃ থাকিলেও সে এত টাকা এত অল্প সুদে যে ধার দিবে, তাহার আশা করা যায় না; ইহাও আমি উত্তমরূপে অবগত আছি। তথাপি আমার বিশ্বাস যে, একটু চেষ্টা করিলেই সেইরূপ ধনী মহাজন পাওয়া যাইবেক, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
মহারাজ। চেষ্টা করিলেই বা সেই প্রকার ধনী মহাজন কোথায় পাইবেন, এবং কাহার দ্বারাই বা সেইরূপ চেষ্টা হইতে পারিবে?
মন্ত্রী। কলিকাতায় উক্তরূপ ধনী মহাজনের অভাব নাই। সেইস্থানে একটু চেষ্টা করিলেই অক্লেশে কাৰ্য্য শেষ হইতে পারিবেক। কিন্তু একটি কথায় আমার সন্দেহ আছে, —- বিনাবন্ধকে বোধ হয়, কলিকাতায় কেহই অল্প সুদে টাকা দিতে সম্মত হইবেন না।
মহারাজ। তাহার নিমিত্ত কোন ভাবনা নাই। আবশ্যক হইলে আমার এই রাজত্বই বন্ধক দিতে পারিব। কারণ, কলিকাতা বা অন্য কোন দূরবর্তী প্রদেশে আমার রাজত্ব বন্ধক দিতে আমি অসম্মত নহি। যে কথা আমার রাজত্বের কোন প্রজার ঘুণাক্ষরেও জানিবার সম্ভাবনা নাই, তাহাতে আমার কোনরূপ অনিষ্ট হইতে পারে না; তথাপি এ প্রদেশীয় কোন ব্যক্তির নিকট আমি আমার রাজত্ব বন্ধক রাখিতে পারিব না। কারণ, ইহা অতিশয় লজ্জার, অবমাননার ও অনিষ্টের বিষয়।
মন্ত্রী। এ প্রদেশীয় কোন ব্যক্তির নিকট মহারাজের রাজত্ব কিছুতেই বন্ধক দেওয়া যাইতে পারে না। চেষ্টা করিলে কলিকাতা ভিন্ন অপর কোন স্থানে মহারাজকে গমন করিতে হইবে না।
মহারাজ। আমার কর্মচারীবর্গের মধ্যে এরূপ বিশ্বাসী ও উপযুক্ত কৰ্ম্মচারী কে আছেন, যাঁহাকে কলিকাতায় প্রেরণ করিলে, তিনি অনায়াসেই এই কার্য্য সমাধা করিয়া আগমন করিতে পারিবেন?
মন্ত্রী। মহারাজের বোধ হয়, স্মরণ থাকিতে পারে যে গুটিকতক ভাল মুক্তা খরিদ করিবার নিমিত্ত মহরাজের এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীর উপর আদেশ প্রদান করিয়াছেন। তিনি বোধ হয়, দুই এক দিবসের মধ্যে কলিকাতায় গমন করিবেন। মহারাজের এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী অনুপযুক্ত কর্ম্মচারী নহেন, তিনি একজন সুচতুর, বিশ্বস্ত, বুদ্ধিমান এবং কার্য্য্যাধ্যক্ষ
কৰ্ম্মচারী। আমার বোধ হয় যে, এ বিষয়ের ভার তাঁহার উপর অর্পণ করা যাইতে পারে। বিশেষতঃ এক কার্য্যের নিমিত্ত যখন কলিকাতায় গমন করিতেছেন, তখন অপর কার্য্যও তিনি তথায় অনায়াসেই সম্পন্ন করিয়া পুনরাবৃত্ত হইতে পারিবেন।
মহারাজ। এ অতি সৎপরামর্শ। আপনি এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীকে এখনই আমার নিকট ডাকাইয়া আনুন। আমি সমস্ত কথা তাঁহাকে তন্ন তন্ন করিয়া বুঝাইয়া দিব।
মহারাজের আদেশ পাইয়া মন্ত্রী মহাশয় তখনই একজন চাপরাশীকে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের উদ্দেশে প্রেরণ করিলেন, এবং অর্দ্ধঘণ্টা উত্তীর্ণ হইতে না হইতেই এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় আগমন করিয়া তথায় উপস্থিত হইলেন।
মহারাজ। মুক্তা খরিদ করিবার নিমিত্ত আপনি কোন্ তারিখে কলিকাতায় গমন করিবেন?
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী। ধর্ম্মাবতার! মুক্তা খরিদ করিবার নিমিত্ত অদ্যই আমি কলিকাতায় গমন করিতাম; কিন্তু অদ্য প্রাতঃকালে আমার শরীর একটু অসুস্থ বোধ হওয়ায় আজ যাইতে পারি নাই, কল্য প্রত্যুষে নিশ্চয়ই গমন করিব।
মহারাজ। কলিকাতায় কোন ধনবান লোকের সহিত আপনার পরিচয় আছে কি?
এঃ সেঃ। দুই একজন ধনী ব্যক্তির সহিত জানা শুনা আছে, কিন্তু বিশেষ বন্ধুত্ব নাই।
মহারাজ। কলিকাতায় কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির নিকট হইতে অল্প সুদে কিছু টাকা ধার করিবার যোগাড় করিতে পারিবেন কি?
এঃ সেঃ। টাকা ধার দিয়া থাকে, কলিকাতায় এরূপ ব্যক্তি বিস্তর আছে। চেষ্টা করিলে যে না হইতে পারিবে, এমন নহে।
মহারাজ। আমি নিজে তিন লক্ষ টাকা ঋণ করিব। কিন্তু সুদ নিতান্ত অল্প হওয়া আবশ্যক; ইহাতে যদি কোন বিষয় বন্ধক দিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আমি আমার রাজত্ব পর্যন্তও বন্ধক দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি কলিকাতায় গমন করিতেছেন, সেইস্থানে এই ঋণের যোগাড় করিয়া যত শীঘ্র পারেন, আমাকে সংবাদ দিবেন।
এঃ। সেঃ। যে আজ্ঞা মহারাজ। আমি সবিশেষরূপে চেষ্টা করিয়া যাহাতে শীঘ্র এই কার্য্য সম্পন্ন করিতে পারি, তাহাতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিব না। অগ্রে মুক্তা কয়েকটি খরিদ করিয়া মহারাজের নিকট পাঠাইয়া দিব, ও পরিশেষে আমি সেইস্থানে অবস্থিতি করিয়া যত শীঘ্র পারি, টাকার যোগাড় করিব। ইহাতে যে কৃতকার্য্য হইতে পারিব, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীর কথায় মহারাজ অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে আবশ্যকীয় অপরাপর উপদেশ প্রদান পূৰ্ব্বক বিদায় দিলাম।
মহারাজের আদেশ মত এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু সেইস্থান হইতে আপন বাসায় গমন করিলেন, এবং পরদিবস অতি প্রত্যুষে ক্ষুদ্র স্বাধীনরাজ্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।
[* The late swindling case —We are glad to hear that the suggestion thrown out by us other day has been acted upon, at the Commissioner and the Deputy Commissioner of Police have taken active steps in the case in which Babu Assistant Secretary of H. H. the Maharaja of Was swindeld out of a large sum of money. Owing to the indisfatigable exertions of the Detective Superintendent Mr. Johnstone and the Sub-Inspector Babu Priyanauth Mookerjee, the majority of the gang and the principal parties concerned in the swindling were arrested within a few hours of the receipt of warrants from the Presidency Magistrate’s Court.
The Statesman and Friend of India. Dated 28th September, 1886.]
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দালালের দালালী
সেক্রেটারী বাবু কলিকাতায় আসিয়া মেছুয়াবাজার স্ট্রীটে অশ্বিনীকুমার বসুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। অশ্বিনী কুমার বসু সেক্রেটারী বাবুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা, এখানে থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করিতেছেন। এবার তাঁহার বি-এ, পরীক্ষা দেওয়ার বৎসর; সুতরাং তিনি রাত্রিদিন পাঠেই নিযুক্ত আছেন। তাঁহার গৃহে সেক্রেটারী বাবু থাকিলে পাছে তাঁহার পড়াশুনার ব্যাঘাত জন্মে, বিশেষতঃ এবার তিনি যে কর্ম্মের নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, তাহা যে দুই চারি দিবসের মধ্যে সম্পন্ন হইবেক, তাহাও নহে; বোধ হয়, দুই চারি মাস লাগিলেও লাগিতে পারে; এই ভাবিয়া তিনি অশ্বিনীকুমারের গৃহের সংলগ্ন আর একটি ঘর ভাড়া লইয়া সেইস্থানেই অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
সেক্রেটারী বাবু নানাস্থানে গমন করিতে লাগিলেন। অনেক ব্যক্তির নিকট টাকার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনস্থানেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। কেহই এত টাকা দিতে স্বীকার করিলেন না; যদি বা কেহ স্বীকার করিলেন, তিনি স্বাধীনরাজ্য বন্ধক রাখিতে অস্বীকৃত হইলেন। কেহ বা সুদ অনেক অধিক চাহিলেন। এইরূপ নানা গোলযোগে প্রায় এক মাস অতীত হইয়া গেল। তখন একদিবস সেক্রেটারী বাবু কিছু কাপড় ও মুক্তা খরিদ করিবার মানসে বড়বাজারে গমন করিলেন।
দিবা প্রায় দুইটা বাজিয়াছে। বড়বাজারে গাড়ী ঘোড়ার এবং লোকজনের এত ভিড় যে, তাহার ভিতর সহজে প্রবেশ করে কাহার সাধ্য। এই ভিড়ের ভিতর একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ীতে কেবল একজন চাকর মাত্র সঙ্গে লইয়া, সেক্রেটারী বাবু প্রবেশ করিলেন; কিন্তু বহুস্থানে নানাপ্রকার প্রতিবন্ধক পাইয়া, বহুস্থানের পথ একবারে বন্ধ থাকা প্রযুক্ত গাড়ী থামাইয়া থামাইয়া তাঁহার গাড়ীর কোচমান ও গরুর গাড়ীর গাড়োয়াদিগের মুখনির্গত অশ্রাব্য ভাষায় উভয়ের উত্তর প্রত্যুত্তরে শুনিতে শুনিতে দিবা চারিটার সময় বড়বাজার মনোহর দাসের চকের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইস্থানে তাঁহার গাড়ী থামিতে না থামিতে তিন চারি জন লোক আসিয়া তাঁহার গাড়ীদ্বারে উপস্থিত হইল। সেক্রেটারী বাবু ইহাদিগকে দালাল বলিয়া চিনিতে পারিলেন। ইহাদিগের কাহারও সাহায্য না লইলে, বড়বাজারের কোন্ স্থানে কি দ্রব্য বিক্রীত হয়, তাহা সকলের —বিশেষতঃ বিদেশবাসী আগন্তুক লোকের পক্ষে জানা অসম্ভব বলিয়া, তিনি উহাদিগের মধ্যে একজনকে সঙ্গে করিয়া কিছু “কিংখাপ” খরিদ করিবার মানসে চকের উপর উঠিলেন। সেক্রেটারী বাবু যে দালালের সহিত উপরে উঠিলেন তাঁহার নাম দেবীলাল। দেবীলালের বাসস্থান মথুরার সন্নিকটস্থ একটি পল্লীগ্রামে। দেবীলালের বয়ঃক্রম যখন ষোল বৎসর, সেই সময়ে কোন একজন দালালের সঙ্গে সে কলিকাতায় আইসে, এবং তাহার সহিত সে সামান্য দালালী কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়; সেই কার্য্যে এতদিবস পর্য্যন্ত নিযুক্ত থাকিয়াও আজ পর্যন্ত তাহার সেই সামান্য দালালী ঘুচে নাই। এখন উহার বয়ঃক্রম প্রায় যাট্ বৎসর হইয়াছে, বয়ঃক্রমে দেবীলাল যেরূপ পরিপক্ক হইয়াছে, কাৰ্য্যে কিন্তু এখনও সেরূপ পরিপক্ব হইতে পারে নাই।
দেবীলাল সেক্রেটারী বাবুকে সঙ্গে করিয়া একজন মাড়ওয়াড়ির দোকানে লইয়া গেল, এবং তাঁহার দোকান হইতে বাবুর মনোনীত প্রায় সত্তর আশী টাকার বস্ত্রাদি ক্রয় করিয়া দিল। সেক্রেটারী বাবু দেবীলালের দালালীর গতিক দেখিয়া সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন, এবং পূর্ব্বে তিনি অন্য স্থান হইতে যেরূপ মূল্যে সেইপ্রকার বস্ত্র ক্রয় করিয়াছিলেন, অদ্য তাহা অপেক্ষা অনেক ন্যূন মূল্যে সেই প্রকার বস্ত্র পাইয়া দেবীলালের অনেক প্রশংসা করিলেন, এবং আপন পকেট হইতে একটি টাকা বাহির করিয়া দেবীলালকে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “দেবীলাল! তোমার কার্য্য দেখিয়া আমি তোমার উপর একান্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি। এখন হইতে বড়বাজারে আমার যে কোন দ্রব্য ক্রয় করিবার প্রয়োজন হইবে, তাহা তোমার সাহায্য ভিন্ন কখন ক্রয় করিব না।”
দেবীলাল। মহারাজ! আমি আপনার তাঁবেদার! হুকুম করিবামাত্র তাহা সম্পন্ন করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিব না। সেক্রেটারী। দেবীলাল! তোমাকে আমার যখন প্রয়োজন হইবে, তখন কোথায় তোমার সাক্ষাৎ পাইব? দেবীলাল। আমাকে যখন অনুসন্ধান করিবেন, তখনই এইস্থানে পাইবেন। আর যদি দৈবাৎ কখন দেখা না পান, তবে অন্য দালালদিগের মধ্যে যাহাকে বলিবেন, সেই আমার সন্ধান বলিয়া দিতে পারিবে।
সেক্রে। তোমার সহিত কোন ভাল জহুরির আলাপ আছে?
দেবীলাল। অনেক ভাল ভাল ও বিশ্বাসী জহুরির সহিত আমার জানাশুনা এবং লেনাদেনা আছে। আপনার যে কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইবেক, আমাকে বলিবেন, তাহা আমি আনিয়া দিব।
সেক্রে। মহারাজের নিমিত্ত কয়েকটি ভাল মুক্তা খরিদ করিবার প্রয়োজন আছে। বাজারে কি প্রকার মুক্তা পাওয়া যায়, একবার দেখিয়া গেলে হয় না?
দেবীলাল। মুক্তা যদি কেবলমাত্র দেখিতে চাহেন, তবে চলুন; যে প্রকারের মুক্তা চাহিবেন, দেখাইতে পারিব কিন্তু আমার কথার উপর আপনি যদি বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে বাজারে গিয়া মুক্তা প্রভৃতি কোন জহরত ক্রয় করিবেন না। বাজারে এ সকল দ্রব্য ক্রয় করিলে প্রায় ঠকিতে হয়। বিশেষতঃ ঠকিয়া ক্রয় করিয়া একবার লইয়া গেলে, এখানকার দোকানদারেরা আর কোনক্রমেই তাহা ফেরৎ লয় না। যদি আপনি অনুমতি করেন এবং আমার কথায় যদি বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে আমাকে আপনার ঠিকানা লিখিয়া দিউন, কল্য প্রাতঃকালে একজন জহুরিকে মুক্তা সমেত আপনার বাসায় লইয়া যাইব। মুক্তা দেখিয়া যদি আপনার মনোনীত হয়, তাহা হইলে দর দস্তুর ঠিক করিয়া আপনার নিকট উহা রাখিয়া দিবেন। পরে আপনার পরিচিত লোক দ্বারা উহার বাজার দর যাচাইয়া যদি সুবিধা বিবেচনা করেন, রাখিবেন, নচেৎ ফেরৎ দিবেন। পুনরায় অন্য জহুরিকে আমি ডাকিয়া আনিব; ইহাতে কোন প্রকারেই আপনার ঠকিবার সম্ভাবনা থাকিবে না। এবার আমরা মহাশয়দিগের ন্যায় সদাশয় ব্যক্তিগণের নিকটই প্রতিপালিত; সুতরাং যাহাতে আপনারা কোন প্রকারে প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, ইহাই আমাদের একমাত্র বাসনা ও কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম।
সেক্রেটারী বাবু মনে মনে ভাবিলেন যে, এ অতি উত্তম প্রস্তাব। ইহাতে কোন প্রকারেই ঠকিবার সম্ভাবনা নাই। মাল দেখিয়া, পছন্দ করিয়া, যাচাই করিয়া তাহার পর টাকা দিব, ইহাতে আর ঠকিব কি প্রকারে? দেবীলালের এ প্রস্তাব উত্তম। আমি জানিতাম না যে, বড়বাজারে এরূপ সৎ ও পরোপকারী দালালও আছে। প্রকাশ্যে বলিলেন, “আচ্ছা দেবীলাল! আমি তোমার প্রস্তাবেই সম্মত হইলাম। কল্য প্রত্যূষে তুমি একজন সদ্ব্যবসায়ী জহুরিকে ভাল মুক্তার সহিত আমার নিকট লইয়া যাইও। যদি মনোমত হয়, এবং সুবিধা বিবেচনা করি, তাহা হইলে আমি ক্রমে তোমাদ্বারা অনেক জরৎ প্রভৃতি ক্রয় করিব।” এই বলিয়া সেক্রেটারী বাবু তাঁহার মেছুয়াবাজারের ঠিকানা একখানি কাগজে লিখিয়া দেবীলালের হস্তে প্রদান করিয়া আপন গাড়ীতে আরোহণ করিলেন। তাঁহার চাকর সেই কাপড়গুলি গাড়ীর ভিতর রাখিয়া কোচবাক্সের উপর গিয়া বসিল। কোচমান গাড়ী চালাইয়া দিল। দেবীলাল তাহার মস্তক নিম্ন ও দক্ষিণহস্ত উত্তোলন করিয়া উপর্যুপরি তিন চারিবার সেলাম করিলে, গাড়ী ক্রমে ক্রমে ভিড়ের ভিতর যাইয়া মিশিল।
এই গাড়ী চলিয়া গেলে দেবীলাল মনে মনে ভাবিতে লাগিল যে, অদ্য কোন গতিকে সেক্রেটারী বাবুর মত পরিবর্তিত করিয়া তাঁহাকে ত ফিরাইয়া দিলাম; কিন্তু কল্য কি করিব? আমার কথায় ত কোন জহুরি মুক্তা লইয়া মেছুয়াবাজারে যাইবে না। আর আমি যে মুক্তা প্রভৃতি বহুমূল্য দ্রব্যের দালালী করিতেছি, ইহাও ত কেহ বিশ্বাস করিবে না। এখন কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে বাবুও সন্তুষ্ট হইবেন, আমিও কিছু উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হইব? পথের ধারে একখানি দোকানে বসিয়া দেবীলাল এইরূপ ভাবিতেছে, এমন সময় অন্য আর একজন দালাল আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল, এবং দেবীলালকে চিন্তিত দেখিয়া বলিল, “কি হে দেবীলাল! বসিয়া বসিয়া কি ভাবিতেছ?”
দেবীলাল। তুমি আসিয়াছ, ভালই হইয়াছে। তোমার বাসায় গিয়া তোমার সহিত দেখা করিব ভাবিতেছিলাম। একটি কাৰ্য্য উপস্থিত আছে, যোগাড় করিতে পারিলে উভয়েই কিছু কিছু পাইতে পারিব।
দালাল। এমন কি কাৰ্য্য উপস্থিত করিয়াছ যে, তাহাতে উভয়েই কিছু কিছু উপার্জ্জন করিতে পারিব? দেবীলাল। একজন বাবু অদ্য এখানে আসিয়াছিলেন, তাঁহার কিছু কাপড় ও কয়েকটি ভাল মুক্তা ক্রয় করিবার প্রয়োজন ছিল। আমি তাঁহার কাপড় ক্রয় করিয়া দিয়াছি, ইহাতে দোকানদারের নিকট হইতে আমি দুই টাকা দালালী পাইয়াছি। কিন্তু বাবু তাহা জানিতে না পারিয়া, আমাকে এক টাকা পারিতোষিক প্রদান করেন, এবং আমাকে মুক্তা ক্রয় করিয়া দিতে বলেন। আমার সহিত মুক্তা বিক্রেতার ভাল আলাপ পরিচয় না থাকায়, কোন ছল অবলম্বন করিয়া অদ্য আমি তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছি, এবং কল্য প্রাতঃকালে তাঁহার বাসায় মুক্তা লইয়া যাইব, ইহাও তাঁহাকে বলিয়া দিয়াছি। বাবুটির চাল-চলন কিছু উচ্চদরের। তাঁহার নিকট মুক্তা বেচিতে পারিলেই বিলক্ষণ কিছু লাভ করিতে পারিব। যদি কোন জহুরির সহিত তোমার সবিশেষ জানা শুনা থাকে, তাহা হইলে তাহাকে ঠিক কর; কল্য প্রাতঃকালেই মুক্তাসহ তাহাকে লইয়া আমরা সেইস্থানে গমন করিব। তাঁহার বাসার ঠিকানা আমাকেতিনি লিখিয়া দিয়া গিয়াছেন। দালাল। তাহার জন্য আর ভাবনা কি? একজন কেন, বল না, শতজন জহুরিকে মুক্তা সহিত তাঁহার বাসায় লইয়া যাইব; ইহার জন্য তুমি চিন্তিত হইও না। কল্য প্রত্যূষে আমার বাসায় যাইও; সেইস্থান হইতে সকলে একত্র বাবুর বাসায় গমন করিব।
এই বলিয়াই উভয়ে সে স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপন আপন কার্য্যে গমন করিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ মুক্তা খরিদ
ভগবান দাস একজন প্রকৃত দালাল। দালালী করিতে করিতে চল্লিশ বৎসর উত্তীর্ণ হইয়া এখন প্রায় পঁয়তাল্লিশে উপস্থিত। ইনি দালালীর রীতি-নীতি, ভাব-ভঙ্গী, বোল-চাল যেমন জানেন, মিষ্ট মিষ্ট কথায় ক্রেতা ও বিক্রয়কারীকে সন্তুষ্ট করিতে যেমন শিখিয়াছেন, সেরূপ আর কোন দালালেই শিখে নাই। তবে ইঁহার দোষের মধ্যে ইনি মিথ্যা কথা বলিতে এবং অপরকে প্রতারণা করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হয়েন না। এ সকল দোষকে তিনি দোষ বলিয়াই গ্রাহ্য করেন না, কোনরূপে অথ উপার্জ্জন করিতে পারিলেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। লোকে বলে যে, ইনি দুই একবার পুলিসের হস্তেও পড়িয়াছিলেন; কিন্তু ভাগ্যবলে শ্রীমন্দিরে গমন করেন নাই। ভগবান দাস দেবীলালের কথামত একজন জহুরির নিকট এই সকল প্রস্তাব করিয়া তাঁহাকে সম্মত করাইলেন, এবং মুক্তা লইয়া পরদিবস প্রাতে তিনজনে একত্র মিলিত হইয়া সেই সেক্রেটারী বাবুর বাসার উদ্দেশে চলিলেন। ক্রমে তাঁহার মেছুয়াবাজারের বাসা অনুসন্ধান করিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন।
সেক্রেটারী বাবু দেবীলালকে দেখিয়াই চিনিলেন, এবং তাহার কথার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম না দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।
দেবীলাল, ভগবান দাসের পরিচয় দিয়া সেক্রেটারী বাবুর নিকট কহিলেন, “আমাদিগের মধ্যে ইনিই সৰ্ব্বপ্রধান ও অতিশয় বিশ্বাসী ও উপযুক্ত লোক। এই নিমিত্ত আমি ইহাকেও সঙ্গে করিয়া আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি। আর অপর এই ব্যক্তি বড়বাজারের একজন প্রধান জহরত বিক্রেতা। আপনার কথামত ইনি কতকগুলি মুক্তাও সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন। ইহার ভিতর যদি আপনার কোন মুক্তা মনোনীত হয়, তাহা হইলে উহা আপনি লইতে পারেন।”
সেক্রেটারী বাবু ভগবান দাসের সহিত আলাপ করিয়া, সেই জহুরিকে মুক্তা দেখাইতে বলিলেন। জহুরি তাহার পকেট হইতে কয়েকটি মুক্তা বাহির করিয়া একটি একটি করিয়া সেক্রেটারী বাবুর হস্তে দিতে লাগিলেন, এবং সেই সঙ্গে সেই সেই মুক্তার উৎকর্ষ প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত যে কত কথা বলিলেন, তাহার স্থিরতা নাই। তিনি যে কত বড় লোকের নিকট, কত রাজা-মহারাজার নিকট, কত সাহেব সুবার নিকট মুক্তা, হীরা প্রভৃতি বিক্রয় করিয়া থাকেন, তাহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত যে কত লোকের নাম করিলেন, তাহার সংখ্যা নাই।
এই সকল কথা শুনিতে শুনিতে সেক্রেটারী বাবু মুক্তা দেখিতে লাগিলেন। দেখিয়া দেখিয়া কয়েকটি মুক্তা মনোনীতও করিলেন। তাহার দাম জিজ্ঞাসা করাতে মুক্তা-বিক্রেতা উহার এক প্রকার দামও বলিয়া দিলেন। সেক্রেটারী বাবু দাম শুনিয়া দেবীলালের ও ভগবান দাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। কিন্তু তাহাতে ভগবান দাস কহিলেন, “মহারাজ! আপনার যে যে মুক্তা মনোনীত হয়, আপনি গ্রহণ করুন। উহার এক প্রকার দামও শুনিলেন, পরে দেখিয়া শুনিয়া উহার দাম স্থির করা যাইবে। এখন আপনি উহা আপনার নিকট রাখিয়া দিন। ইনি দুই দিবস পরে আসিয়া হয় ইহার দাম—না হয় মুক্তা ফেরৎ লইয়া যাইবেন। আমরা কল্য প্রাতঃকালে আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।” ভগবান দাসের এই কথায় মুক্তা-বিক্রেতাও সম্মত হইলেন। তখন মুক্তা কয়েকটি সেক্রেটারী বাবুর নিকট রাখিয়া তাঁহারা সকলেই প্রস্থান করিলেন।
তাঁহারা যখন সেক্রেটারী বাবুর বাসা হইতে প্রত্যাগমন করেন, সেই সময়ে পথিমধ্যে ভগবান দাস দেবীলালকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভাই! বোধ হইতেছে, এই বাবুটি অতি সরল; সুতরাং ইহার নিকট হইতে কিছু অর্থ বাহির করিয়া লইতে হইবে। যাহাতে আমাদের দশ টাকা উপার্জ্জন হয়, এবং এই জহুরিও কিছু পায় তাহার এক সদুপায় করিতে হইতেছে।” এই বলিয়া সেই মুক্তা বিক্রেতাকে কানে কানে কি বলিয়া দিল। তিনি অতঃপর এই দালালদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিলেন।
দেবীলাল ও ভগবান দাস পরদিবস প্রত্যূষে সেক্রেটারী বাবুর বাসায় গিয়া পুনরায় উপস্থিত হইল, এবং বাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “মহাশয়! কল্য সেই জহরত বিক্রয়কারীর সম্মুখে আপনাকে আমরা কিছু বলিতে পারি নাই। যে সকল মুক্তা আপনি মনোনীত করিয়া রাখিয়া দিয়াছেন, তাহা অতি উৎকৃষ্ট দ্রব্য। তথাপি সেই জহুরি যে দাম বলিয়াছিলেন, তাহা কিন্তু আমাদিগের মনোনীত হয় নাই। এই নিমিত্ত আমি সেই মুক্তা আপততঃ রাখিয়া দিবার নিমিত্ত বলিয়াছিলাম। অদ্য আমাদিগের সহিত বাজারে চলুন—সেইস্থানে জহরতের বিস্তর দোকান আছে, তাহাদিগের নিকট যাচাই করিয়া দেখিলেই ইহার প্রকৃত দাম বুঝিতে পারিব। আপনাকে একটি কথা পূর্ব্বেই বলিয়া রাখি যে, জহরত বিক্রেতামাত্রই প্রায় একই প্রকৃতির লোক। যদি উহারা বুঝিতে পারে যে, আপনি সেই সকল মুক্তা ক্রয় করিবেন, তাহা হইলে তাহারা উহার দাম প্রকৃত দাম অপেক্ষা অনেক অধিক করিয়া বলিয়া দিবে। আপনি যাহাতে কোন প্রকারে প্রতারিত না হন, ইহাই আমাদিগের নিতান্ত ইচ্ছা বলিয়াই পূৰ্ব্ব হইতেই আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি। যে মুক্তা আপনি ক্রয় করিবেন, বাজারে গিয়া সেই সকল দ্রব্য বিক্রয়ের ভান করিবেন, তাহা হইলে আপনি ইহার প্রকৃত মূল্য অবগত হইতে পারিবেন। কারণ, সেই ব্যক্তি উহা যে মূল্যে প্রকৃতই ক্রয় করিতে পারিবে, সেই মূল্যই বলিবে; কেহ বা কিছু কম করিয়াও বলিতে পারে। এরূপ অবস্থায় উহার প্রকৃত মূল্য জানিতে আর বাকি থাকিবে না। সুতরাং কোনরূপে আমাদিগের ঠকিবার সম্ভাবনা থাকিবে না। প্রকৃত মূল্য অবগত হইতে পারিলে, জহরত-বিক্রেতা যদি সেই মূল্যে সেই মুক্তা বিক্রয় করে তাহা হইলে আপনি উহা গ্রহণ করিবেন। নচেৎ সেই মুক্তা ফেরৎ দিয়া পুনরায় অন্য কোন জহুরিকে মুক্তা সহিত আপনার নিকট আনয়ন করিব।”
উহাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া সেক্রেটারী বাবু অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং মনে মনে ভাবিলেন যে, ইহারা যাহা বলিতেছে, তাহা অপেক্ষা অন্য কোন সদুপায় আর নাই। ইহাদিগের প্রস্তাবিত উপায় অবলম্বন করিলে কিছুতেই আমাদিগের ঠকিবার সম্ভাবনা নাই। এই ভাবিয়া সেক্রেটারী বাবু মুক্তা কয়েকটি হস্তে লইয়া, দালালদ্বয়ের সহিত বড়বাজার অভিমুখে গমন করিলেন।
ভগবান দাস সেক্রেটারী বাবুকে একটি জহরতের দোকানে সৰ্ব্বপ্রথম লইয়া গেলেন। সেইস্থানে সেক্রেটারী বাবুকে একজন সাবেক বড়লোক বলিয়া পরিচয় দিলেন, এবং মুক্তা কয়েকটি বাহির করিয়া সেই দোকানদারের হস্তে প্রদান করিয়া কহিলেন, “বিশেষ কোন কারণবশতঃ ইঁহাকে এই মুক্তা কয়েকটি বিক্রয় করিতে হইবে। আর আপনারা প্রকৃত যে দরে লইতে পারেন, তাহা বলিয়া দিন। নিতান্ত লোকসান না হইলে এখনই ইহা আপনার নিকট বিক্রয় করিবেন।”
দোকানদার এই কথা শুনিয়া মুক্তা কয়েকটি উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, “এ অতি উৎকৃষ্ট মুক্তা, এরূপ মুক্তা সচরাচর বাজারে পাওয়া যায় না। আপনি যখন ইহা ক্রয় করিয়াছেন, তখন আপনাকে অধিক মূল্য প্রদান করিতে হইয়াছে; কিন্তু আজকাল মুক্তার বাজার অত্যন্ত নরম যাইতেছে। তথাপি যদি আপনি প্রকৃতই ইহা বিক্রয় করেন, তাহা হইলে আমি এই মূল্য প্রদান করিতে পারি।” এই বলিয়া সেই মুক্তা কয়েকটির একটি দাম বলিয়া দিলেন। সেক্রেটারী বাবু দেখিলেন, তিনি যে দর প্রাপ্ত হইয়াছেন তাহা জহরত-বিক্রয়কারীর কথিত মূল্য অপেক্ষা অধিক ন্যূন নহে, প্রায় সমান।
দোকানদারের কথা শুনিয়া দেবীলাল কহিলেন, “আরও দুই একজন দোকানদারকে দেখাই। দেখি, উহারাই বা কি প্রকার দরে ক্রয় করিতে চাহে। আপনার প্রদত্ত দর অপেক্ষা অধিক দর অপর দোকানদার যদি প্রদান না করে, তাহা হইলে আপনার নিকটই উহা বিক্রয় করিব।” এই বলিয়া বাবুকে সঙ্গে লইয়া নিকটবর্ত্তী আর একখানি দোকানে গমন করিলেন। সেই দোকানদার এই মুক্তা কয়েকটি দেখিয়া পূৰ্ব্ব দোকানদার অপেক্ষা আরও কিছু কম মূল্য বলিয়া দিলেন। এবারও পূর্ব্বরূপ বলিয়া দেবীলাল, বাবুকে লইয়া সেই দোকানের বাহিরে আসিলেন। সেই সময় সেক্রেটারী বাবুকে কহিলেন, “আমরা যেরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, আমাদিগের সে অনুমান ঠিক নহে। এখন বুঝিতে পারিতেছি যে, মুক্তা কয়েকটি প্রকৃতই উত্তম দ্রব্য, এবং বিক্রেতাও যে নিতান্ত অধিক দর বলিয়াছে, তাহা নহে! আরও দুই এক দোকানে যদি উহা দেখাইতে চাহেন, তাহাও দেখাইতে পারেন।
দেবীলালের এই কথা শ্রবণ করিয়া সেক্রেটারী বাবু কহিলেন, “ইহার প্রকৃত দর এক প্রকার বুঝিতে পারিয়াছি, আর কোন দোকানে দেখাইবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু বিক্রেতা যখন ইহার মূল্যের জন্য আগমন করিবে, সেই সময় তুমিও তাহার সহিত আসিও। তাহাকে বলিয়া কহিয়া ইহার মূল্য আরও কিছু কম করিয়া লইতে হইবে।” দালালদ্বয় বাবুর কথায় সম্মত হইয়া আর কোন দোকানে গমন করিল না। বাবুর সহিত বাজার পরিত্যাগ করিয়া মেছুয়াবাজারের বাসা-অভিমুখে প্রস্থান করিল।
গমনকালীন কথায় কথায় সেক্রেটারী বাবু দালালদ্বয়কে কহিলেন, “তোমাদিগের দালালীতে আমি বিশেষরূপ সন্তুষ্ট হইয়াছি। কোনরূপ দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার নিমিত্ত যখন আমি কলিকাতায় আসিব, সেই সময় তোমাদিগের সন্ধান করিব, এবং তোমাদিগের সহায়তা গ্রহণ করিয়া দ্রব্যাদি ক্রয় করিব। তোমাদিগের দালালী দেখিয়া বোধ হইতেছে যে, তোমরা উভয়েই অতিশয় পুরাতন দালাল।”
ভগবান দাস। হাঁ মহাশয়! অনেক দিবস হইতে এই কার্য্য করিতেছি।
সেক্রেটারী বাবু। অনেক টাকা কর্জ দিতে পারে, এরূপ কোন বড়লোকের সহিত তোমাদিগের জানাশুনা আছে কি?
ভগবান। কেন মহাশয়! কোন ব্যক্তি টাকা কর্জ্জ করিতে চাহেন কি?
বাবু। একজন বড়লোকের কিছু টাকার প্রয়োজন আছে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি।
ভগবান। দালালীই যখন আমাদিগের ব্যবসা, তখন আমরা সকল কর্ম্মেরই দালালী করিয়া থাকি। টাকা ধার দেওয়া ত আমাদিগের প্রধান কর্ম্ম। কি দ্রব্য বন্ধক রাখিয়া কত টাকা ধার দেওয়াইতে হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিবেন, আমি অনায়াসেই টাকার সংগ্রহ করিয়া দিব।
বাবু। সময় মত আমি এ বিষয়ে তোমার সহিত পরামর্শ করিব।
এইরূপ কথাবার্তা শেষ হইতে না হইতেই সকলেই মেছুয়াবাজারের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। কিয়ৎক্ষণ পরেই সেই জহরত-বিক্রেতাও আগমন করিল। সে পূর্ব্বে যে মূল্য স্থির করিয়া জহরত রাখিয়া গিয়াছিল, দালালদ্বয় বাবুর সাক্ষাতে অনেক করিয়া বলায়, তাহা অপেক্ষা মূল্য কিছু কম করিয়া দিল। বাবুও তাহার সমস্ত টাকা মিটাইয়া দিলে সকলে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। প্রকৃত দরে মুক্তা ক্রয় করা হইয়াছে বিবেচনা করিয়া, বাবু সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন। ওদিকে দালালগণ বাবুকে উত্তমরূপে ঠকাইয়া হাস্যমুখে আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিল।
পাঠকগণকে বোধ হয় বলিয়া দিতে হইবে না, জহরত বিক্রয়কারী ও দুইজন দালাল চক্রান্ত করিয়া সেক্রেটারী বাবুকে বিশেষরূপে প্রতারিত করিল। যে যে দোকানে মুক্তা জাচাইয়া দেখিবার নিমিত্ত সেক্রেটারী বাবুকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল, সেই সকল দোকান পূৰ্ব্ব হইতেই ঠিক করিয়া রাখা হইয়াছিল। সুতরাং এরূপ চক্রান্তে পড়িয়া একজন সহর হইতে বহুদূরদেশবাসী ব্যক্তি যে প্রতারিত হইবেন, তাহার আর ভুল কি?
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নূতন রাজ পরিচয়
মুক্তা ক্রয়ের গোলযোগ মিটিয়া যাইবার দুইদিবস পরে ভগবান দাস একাকী আসিয়া পুনরায় সেক্রেটারী বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ভগবান দাসকে দেখিয়াই সেক্রেটারী বাবু সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন, এবং তাহাকে সেইস্থানে বসিতে আসন দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন মহাশয়! শারীরিক ভাল আছেন ত?”
ভগবান। আমার শরীরটা নিতান্ত ভাল নাই; এই নিমিত্তই মহাশয়ের নিকট আসিতে দুইদিবস বিলম্ব হইয়াছে। কিন্তু আমি আপনার নিকট আসিতে পারি নাই বলিয়া যে আপনার কোন কার্য্য করি নাই, তাহা নহে। আমি একজন বিশিষ্ট ধনী মহাজন স্থির করিয়াছি। কোন্ ব্যক্তি, কি বন্ধকে কত টাকা কর্জ্জ লইবেন, তাহার সবিশেষ বিবরণ অবগত হইতে পারিলেই এখন সমস্ত স্থির করিয়া ফেলিতে পারি।
বাবু। আমিও মনে মনে তাহাই ভাবিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম যে, আপনার আসিতে যখন বিলম্ব হইতেছে তখন নিশ্চয়ই আপনি একটা কিছু স্থির করিয়াই আসিবেন। সে যাহা হউক, কোন্ ব্যক্তি টাকা ধার করিবেন, এবং কিরূপে ধার করিতে চাহেন, তাহা আপনি এখনই জানিতে চাহেন কি?
ভগবান। সেই নিমিত্তই আমি আজ আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। কারণ, ওদিকে আমি যে প্রকার স্থির করিয়া আসিয়াছি, তাহাতে বোধ হয় যে, আপনার কার্য্য শীঘ্রই শেষ করিয়া দিব।
বাবু। কাৰ্য্য যত শীঘ্র শেষ করিতে পারেন, ততই ভাল। কারণ, কেবলমাত্র সেই কার্য্যের নিমিত্তই আমাকে খরচপত্র করিয়া কলিকাতায় অবস্থান করিতে হইতেছে। যে অর্থ কৰ্ম্ম লইবার কথা হইতেছে, তাহা আমি নিজে গ্রহণ করিব না, আমার মনিব উহা গ্রহণ করিবেন।
ভগবান। আপনার মনিব কে?
বাবু। আমার মনিব একজন নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি নহেন জানিবেন। তিনি… নামক স্থানের স্বাধীন রাজা। তাঁহার নাম…..।
ভগবান। আপনি যে স্থানের কথা উল্লেখ করিলেন, আমি পূর্ব্বে সেইস্থানের নাম শুনিয়াছি। সেইস্থানের রাজা প্রকৃতই স্বাধীন। তিনি তাঁহার রাজত্বে আপনার প্রণীত আইন চালান। নিজের ইচ্ছামত দোষী ব্যক্তিকে ফাঁসী দেন, ইহাতে ইংরাজ পর্য্যন্ত কথাটি কহেন না। তিনি টাকা কর্জ্জ করিবেন! এরূপ লোকের টাকা কর্জ্জ করিতে আর কোনরূপ কষ্টই হইবে না। যিনি অবগত হইতে পারিবেন, তিনিই উঁহাকে টাকা ধার দিবেন। তাঁহা কত টাকা লইবার প্রয়োজন?
বাবু। কম সুদে পাইলে, আপাততঃ তিন লক্ষ টাকা হইলেই চলিতে পারিবে।
ভগবান। কম সুদ আপনি কত পৰ্য্যন্ত সুদ দিতে সক্ষম আছেন?
বাবু। শত করা বাৎসরিক ছয় টাকার অধিক দিতে পারিব না। ইহা অপেক্ষা যত কম হয়, ততই ভাল। ভগবান। যদি আমি পাঁচ টাকায় করিয়া দিতে পারি?
বাবু। তাহা হইলে ত উত্তমই হয়।
ভগবান। কি বন্ধক দিয়া তিনি এই টাকা গ্রহণ করিতে চাহেন?
বাবু। আবশ্যক হইলে তাঁহার রাজত্ব পর্য্যন্ত বন্ধক দিতে তিনি প্রস্তুত আছেন।
এই কয়েকটি কথাবার্তার পর ভগবান দাস সেই দিবস চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন যে, কথাবার্তা স্থির করিয়া পরদিবস তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।
ভগবান দাস চলিয়া যাওয়ার পর সেক্রেটারী বাবু মনে মনে বলিতে লাগিলেন যে, এ ব্যক্তি নামেও ভগবান, কাজেও ভগবান। টাকা ধার করিবার কথা ইতিপূৰ্ব্বে কত লোককে বলিয়াছি; কিন্তু কেহই তাহার কোনরূপ সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। পরন্তু ইহার নিকট প্রস্তাব করিতে না করিতেই এ সমস্ত ঠিক করিয়া ফেলিল! আবার সেই টাকা পাওয়া যাইতেছে তাহাও অল্প সুদে। এখন আমার নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, ভগবান দাস কর্তৃক আমার সমস্ত টাকা সংগৃহীত হইবে।
ভগবান দাস যেরূপ বলিয়া গিয়াছিলেন, পরদিবস ঠিক সেই সময় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং বাবুকে কহিলেন, “আমি সমস্তই প্রায় ঠিক করিয়া আসিয়াছি। এখন আপনি দেখিয়া শুনিয়া সমস্ত ঠিক করিয়া লউন। এই আমার নিবেদন।”
বাবু। তোমার কথায় আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। কোন ব্যক্তি টাকা দিতে প্রস্তুত আছেন, তাঁহার নাম জানিতে পারি কি?
ভগবান। যিনি ঋণ গ্রহণ করিবেন, তিনি যেরূপ উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি, যাঁহার নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করা যাইবে, তিনিও সেই প্রকার উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি। ইনিও একজন রাজা। সম্প্রতি কোন কাৰ্য্য-বশতঃ ৰুলিকাতায় আগমন করিয়াছেন, এবং আরও কিছুদিবস এইস্থানে অবস্থিতি করিবেন। আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া তাঁহার দরবারে লইয়া যাইতেছি, তাহা হইলেই আপনি বুঝিতে পারিবেন, আমার কথা প্রকৃত কি না। আমি দালালী ব্যবসা দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করি সত্য; কিন্তু যিনি যেরূপ পদস্থ উহাকে সেইরূপে সেইস্থানেই লইয়া গিয়া থাকি।
বাবু। আমাকে কোন সময়ে সেই রাজ-দরবারে গমন করিতে হইবে?
ভগবান। আপনি এখনই চলুন, আমি এখনই আপনাকে লইয়া গিয়া মন্ত্রী মহাশয়ের সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া দি। আপনি রাজ-কর্মচারী; সুতরাং রাজন্যগণের কার্যপ্রণালী আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন। এতদ্দেশীয় রাজামাত্রই প্রায় নামে। রাজকার্য্যাদি যাহা কিছু সমস্তই মন্ত্রী বা সেই প্রকার উচ্চপদস্থ কর্মচারীর হস্তে।
বাবু। রাজগণের কার্য্য আমি উত্তমরূপেই অবগত আছি, তাহা আর তোমাকে বলিয়া দিতে হইবে না। এখন কোন সময়ে তুমি আমাকে মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট লইয়া যাইবে, তাহাই বল?
ভগবান। আপনি প্রস্তুত হইয়া আসুন, এখনই আমি আপনাকে সঙ্গে লইয়া মন্ত্রী মহাশয়ের সহিত আলাপ পরিচয় করাইয়া দিব।
ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিয়া সেক্রেটারী বাবুও আর কালবিলম্ব করিলেন না। নিয়মিত সজ্জায় সুসজ্জিত হইয়া তখনই তাহার সহিত আপন বাসা পরিত্যাগ করিলেন। এখানে বাবুর নিজের গাড়ী ঘোড়া প্রভৃতি কিছুই ছিল না; সুতরাং ভাড়াটিয়া গাড়ীতেই বাবুকে রাজবাড়ী গমন করিতে হইল বলিয়া, মনে মনে যেন একটু লজ্জিত হইলেন। ভগবান দাসের নির্দেশ-মত এ গলি ও গলি দিয়া গাড়ী ক্রমে গমন করিতে করিতে অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই একখানি বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। সেইস্থানে উপস্থিত হইবামাত্র ভগবান দাস কহিলেন, “রাজা মহাশয় এই বাড়ীতেই অবস্থিতি করেন।”
ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিয়া সেইস্থানে সেক্রেটারী বাবু গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া, ভগবান দাসের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। কোচমান খালি গাড়ী ঘুরাইয়া লইয়া পথের একপার্শ্বে রাখিয়া দিল।
যে বাড়ীর ভিতর সেক্রেটারী বাবু ভগবান দাসের সহিত প্রবেশ করিলেন, সেই বাড়ীর অবস্থা পাঠকবর্গের এইস্থানে একটু জানা আবশ্যক। যে দ্বার দিয়া তাঁহারা বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলেন, সেই দ্বারে দুইজন প্রহরী সিপাহীর সাজে সজ্জিত হইয়া সেঙ্গিয়ান বন্দুক লইয়া পাহারায় নিযুক্ত আছে। তাহাদিগের পোষাক এবং চাকচিক্যময় সেঙ্গিয়ান বন্দুকের অবস্থা দেখিয়া বাবুর মনে মনে একটু ভয় হইল। তিনি একটু ইতস্ততঃ করিয়া ভগবান দাসের সঙ্গে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। সিপাহীদ্বয় বাবুকে একবার আপদ-মস্তক দর্শন করিল মাত্র, কিন্তু কিছু বলিল না। তাহাদিগের ভাব-ভঙ্গীতে বোধ হইল, যেন ইহারা সহজে বাবুকে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দিত না; কেবল ভগবান দাসের সহিত যাইতেছেন বলিয়া কোন কথা কহিল না।
দ্বার অতিক্রম করিলেই বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, তাহার মধ্যে মনোহর পুষ্পোদ্যান। এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পুষ্পোদ্যানের ভিতর দিয়া কিছুদূর গমন করিলে, একটিদ্বিতল বাটীতে উপনীত হওয়া যায়। সেই বাটী দেখিলে বোধ হয় যে, অতি অল্প দিবস হইল, উহা উত্তমরূপে মেরামত হইয়া মনোহর রঙ্গে রঞ্জিত হইয়াছে। ভগবান দাসের সহিত সেক্রেটারী বাবু সেই পুষ্পোদ্যানের মধ্য দিয়া সেই দ্বিতল বাড়ী অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। পথিমধ্যে কেবলমাত্র দুইজন উড়িয়া মালির সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহারা উঁহাদিগের দিকে লক্ষ্যই করিল না। বোধ হইল, ইহারা আপন কাৰ্য্যেই ব্যস্ত।
সেই সুবিস্তৃত প্রাঙ্গণের মধ্যস্থিত পুষ্পোদ্যান অতিক্রম করিয়া ক্রমে ক্রমে তাঁহারা সেই দ্বিতল গৃহের সন্নিকটে গিয়া উপনীত হইলেন। সেইস্থানে কেবলমাত্র একজন চাপরাশীর সহিত উহাদিগের সাক্ষাৎ হইল। ভগবান দাস সেই চাপরাশীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মন্ত্রী মহাশয় আসিয়াছেন কি? উত্তরে চাপরাশী কহিল, “না, — মন্ত্রী মহাশয় এখনও আগমন করেন নাই। তাঁহার আগমন করিবার সময় হইয়াছে, এখনই তিনি আগমন করিবেন। দাওয়ানজী মহাশয় প্রভৃতি অন্যান্য কৰ্ম্মচারীগণ প্রায় সকলেই রাজ-দরবারে উপস্থিত আছেন। আপনারাও সেইস্থানে গমন করুন।”
চাপরাশীর এই কথা শুনিয়া সম্মুখবর্তী সোপান দিয়া ভগবান দাস উপরে আরোহণ করিলেন। সেক্রেটারী বাবুও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ উপরে গমন করিলেন। উপরে আরোহণ করিয়াই সম্মুখবর্তী একটি প্রশস্ত গৃহের ভিতর উভয়েই প্রবেশ করিলেন।
এই গৃহটি যেমন দীর্ঘ, তেমনি প্রশস্ত, এবং একখানি উৎকৃষ্ট কার্পেট দ্বারা উহার মেজে আবৃত। সেই কার্পেটের বা গৃহের মধ্যস্থলের কিয়দংশ স্থানে অতি উৎকৃষ্ট কিংখাপের চাদর পাতা, তাহার উপর সেইরূপ কিংখাপের কয়েকটি তাকিয়া বা সুন্দর উপাধান। দেখিলে বোধ হয়, রাজা বাহাদুর যখন এই দরবারে আগমন করেন, তখন সেই সুসজ্জিত সুপরিষ্কৃত স্থানেই উপবেশন করেন। এই গৃহের চতুষ্পার্শ্বস্থ মধ্যবর্তী দেওয়াল নয়ন-মনোরম-বর্ণে সুরঞ্জিত ও শিল্পীদ্বারা নানাবর্ণে অতি উৎকৃষ্টরূপে চিত্রিত। মধ্যে মধ্যে এক একখানি উৎকৃষ্ট অয়েল পেটিং বড় বড় প্রতিকৃতি সেই দেওয়ালের আরও শোভা বৃদ্ধি করিতেছে।
এই গৃহের মধ্যে তিন চারিজন বেশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া উপবিষ্ট আছেন। তাঁহাদিগকে দেখিলে বোধ হয় যে, একান্ত মনোযোগিতার সহিত তাঁহারা আপন আপন কার্য্যে নিযুক্ত আছেন।
ভগবান দাস সেক্রেটারী বাবুর সহিত সেই গৃহের ভিতর প্রবিষ্ট হইবামাত্র উপবেশনকারী ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি কহিলেন, “কেও, ভগবান দাস! কখন আগমন করিলে, সমস্ত মঙ্গল ত? এই বাবুটি কে?”
উত্তরে ভগবান দাস কহিলেন, “আমরা এখনই আগমন করিতেছি। আর যে স্বাধীন রাজার কর্মচারীর কথা আমি তোমাদিগকে বলিয়াছিলাম, ইনি সেই
কৰ্ম্মচারী। রাজা মহাশয়ের সহিত সমস্ত বিষয় স্থির করিবার নিমিত্ত আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া এইস্থানে আনিয়াছি।
ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিবামাত্র পুনরায় তিনি বাবুর প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আসুন মহাশয়! এইদিকে আসুন। আপনার সহিত পরিচয় হওয়ার অদ্য যে কি পরিমাণে সুখী হইলাম, তাহা বলিতে পারি না।” এই বলিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিয়া সেক্রেটারী বাবুর হস্ত ধরিয়া আপনার বসিবার স্থানে লইয়া গেলেন ও আপনার সন্নিকটে বসাইলেন।
এই সময়ে ভগবান দাস বলিয়া দিলেন, “দাওয়ানজী মহাশয় আপনাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিবেন। কারণ, আপনি যে কার্য্যের নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, সেই কার্য্য সম্পন্ন হইবার মূলই ইনি। তাহার পর মন্ত্রী মহাশয়, এবং সর্ব্বশেষে রাজা মহাশয়।” এই বলিয়া ভগবান দাসও সেইস্থানে উপবেশন করিলেন। সেক্রেটারী বাবু দাওয়ানজী মহাশয়ের নিকট উপবেশন করিলে দাওয়ানজী মহাশয় তাঁহাকে কহিলেন, “আমরা আপনার সবিশেষ পরিচয় এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হই নাই। কেবল এইমাত্র জানিতে পারিয়াছি যে, আপনি… রাজ্যের একজন প্রধান কৰ্ম্মচারী। যদি আত্মপরিচয় প্রদানে আপনার কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তাহা হইলে আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলে সবিশেষ সুখী হইব।”
বাবু। আমার বাসস্থান ঢাকা জেলার অন্তর্গত….. গ্রামে। কিন্তু বহুদিবস হইতে রাজ সরকারে কর্ম্ম করি তাই এই নিমিত্ত এখন সেইস্থানেই একরূপ বাসস্থান হইয়াছে।
দাওয়ান। রাজ-সরকারে আপনি কি কার্য্যে নিযুক্ত আছেন?
বাবু। আমি রাজার এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী। রাজ্যের প্রায় সমস্ত কার্য্যের উপর আমায় লক্ষ্য রাখিতে হয়। দাওয়ান। আপনার উপর আর কয়জন কৰ্ম্মচারী আছেন?
বাবু। একজন। সেক্রেটারী আমার ঊর্দ্ধতন
দাওয়ান। যাহা হউক, মহাশয় একজন বড়লোক। মহাশয়ের সহিত অদ্য বিশেষরূপে পরিচয় হওয়ায় যে কি পৰ্য্যন্ত আনন্দিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। যে কার্য্যের নিমিত্ত মহাশয়ের এইস্থানে শুভাগমন হইয়াছে, তাহা অনায়াসেই হইয়া যাইবে। মন্ত্রী মহাশয় আগমন করিলে তাঁহার সহিত আপনার পরিচয় আমি করাইয়া দিব, এবং যাহাতে আপনার কার্য্য শীঘ্র শীঘ্র সম্পন্ন হয়, তাহারও বন্দোবস্ত করিয়া দিব।
বাবু। আপনার অনুগ্রহ। এখন আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি,—আপনার যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই করিবেন।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী ও দাওয়ানজী মহাশয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় একজন চাপরাশী আসিয়া সংবাদ প্রদান করিল যে, মন্ত্রী মহাশয় আসিতেছেন। এই সংবাদ পাইবামাত্র সকলেই উঠিয়া দাঁড়াইলেন, দেখিতে দেখিতে মন্ত্রী মহাশয় গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া আপন স্থানে উপবেশন করিলেন। মন্ত্রী মহাশয়ের অভ্যর্থনার নিমিত্ত যখন সকলেই গাত্রোত্থান করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন, তখন এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুও দাঁড়াইলেন, এবং সকলে যখন উপবেশন করিলেন, তখন তিনিও সেই সময় উপবেশন করিলেন। উপবেশনকালীন মন্ত্ৰী মহাশয় দাওয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাবুটি কে? ইহাকে ত আমি চিনিতে পারিলাম না।”
দাওয়ান। ইঁহাকে আপনি পূর্ব্বে কখনও দেখেন নাই, এই নিমিত্ত চিনিতে পারিতেছেন না। যে স্বাধীন রাজ্যের রাজ কর্মচারীর কথা পূর্ব্বে আপনাকে বলা হইয়াছিল, ইনিই সেই রাজ-কৰ্ম্মচারী। ইনি একজন সামান্য কর্ম্মচারী নহেন, ইনি মহারাজের এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী। এক কথায়, রাজকার্য্যের সমস্ত ভারই ইঁহার উপর। অত বড় স্বাধীন রাজ্যের সমস্ত কৰ্ম্মই ইঁহাকে নির্ব্বাহ করিতে হয়। এদিকে ঢাকা জেলার সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে ইঁহার জন্ম।
বাবুর পরিচয় পাইয়া দুই চারিটি মিষ্টকথায় তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিয়া তাঁহাকে সেইস্থানে বসিতে কহিলেন, এবং রাজাকে বলিয়া তাঁহার কার্য্য যত শীঘ্র পারেন, সম্পন্ন করিয়া দিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন।
সেই সময়ে আরও তিন চারি জন লোক সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। দাওয়ানজী মহাশয় ও মন্ত্রী মহাশয় উভয়েই তাঁহাদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া সেইস্থানে বসাইলেন। ইঁহাদিগের কথার ভাবে বোধ হইল যে, ইঁহারা সেক্রেটারী বাবুর ন্যায় অপরিচিত নহে, সকলেই পূৰ্ব্ব হইতে পরস্পরের পরিচিত। তাঁহারা সেইস্থানে উপবেশন করিলে একজন কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “রাজা মহাশয় বলিয়া দিয়াছেন যে, ইঁহারা আগমন করিবামাত্র যেন তাঁহার নিকট সংবাদ প্রেরণ করা হয়।”
কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া রাজা মহাশয়কে সংবাদ দিবার নিমিত্ত মন্ত্রী মহাশয় স্বয়ং গমন করিলেন। সেই সময়ে সেই নবাগত ব্যক্তিগণের মধ্যস্থিত এক ব্যক্তি দাওয়ানজী মহাশয়কে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “কল্য আপনি আমাদিগের যেরূপ উপকার করিয়াছিলেন, অদ্যও যদি সেইরূপ করেন তাহা হইলে কল্য যেরূপ লভ্যাংশের অর্দ্ধেক আপনার হইয়াছিল, অদ্যও তাহাই হইবে।”
এই কথার উত্তরে দাওয়ানজী মহাশয় বলিলেন, “এ অতি সামান্য কথা। রাজা মহাশয়কে আমি চিরকাল দেখিয়া আসিতেছি; সুতরাং উঁহার ভাব গতিক আমি যতদূর অবগত আছি, ততদূর আর কেহই অবগত নহেন। মনে করিলে ইহার প্রত্যেক হাত আমি জিতিয়া লইতে পারি; কিন্তু মনিবের সঙ্গে বসিয়া ক্রীড়া করা উচিত নহে বলিয়াই, আমি চুপ করিয়া থাকি। আপনি আমার সঙ্কেত অনুযায়ী কার্য্য করিবেন; দেখিবেন আপনি কত অর্থ উপার্জ্জন করিয়া লইয়া যাইতে পারেন।”
দাওয়ানজী মহাশয়ের সহিত নবাগত ব্যক্তির এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময় মন্ত্রী মহাশয় সেইস্থানে প্রত্যাগমন করিয়া আপন স্থানে উপবেশন করিলেন। তাঁহার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে দাওয়ানজী মহাশয় প্রভৃতির কথা বন্ধ হইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ সকলেই স্থিরভাবে সেইস্থানে উপবেশন করিয়া রহিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
হার-জিত
মন্ত্রী মহাশয় দরবারে আগমন করিয়া উপবেশন করিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই রাজা মহাশয় আগমন করিয়া দরবারে প্রবেশ করিলেন। রাজা মহাশয়ের অবস্থা আর কি বর্ণন করিব? রাজা ত রাজাই, চেহারা রাজার মত, পোষাক পরিচ্ছদ রাজার মত, আদব কায়দা, চাল চলন রাজার মত। তিনি রাজ-কায়দায় রাজধরণে আগমন করিয়া তাঁহার বসিবার স্থানে উপবেন করিলেন। একজন অনুচর তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চৎ একটি ক্যাসবাক্স হস্তে সেই দরবার গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং রাজা মহাশয়ের সম্মুখে সেই বাক্সটি স্থাপিত করিয়া দূরে গিয়া দণ্ডায়মান রহিল। রাজা মহাশয় যে সময় দরবার গৃহে প্রবেশ করেন, সেই সময় সেই গৃহস্থিত ব্যক্তিমাত্রই দণ্ডায়মান হইয়া আপন আপন পদমর্য্যাদা অনুযায়ী রাজা মহাশয়কে অভিবাদন করিলেন। বলা বাহুল্য যে, আমাদিগের এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ও অপরাপর কর্মচারীবর্গের ন্যায় রাজা মহাশয়কে অভিবাদন করিতে বিস্মৃত হইলেন না। রাজা মহাশয় উপবেশন করিলে সকলে রাজ-দরবারে রীতি-অনুযায়ী উপবেশন করিলেন। উপবেশন করিবার সময় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের দিকে রাজা মহাশয়ের নয়ন আকৃষ্ট হইল। তিনি মন্ত্রী মহাশয়ের দিকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই বাবুটি কে? ইঁহাকে ইতিপূর্ব্বে আর কখন দেখিয়াছি বলিয়া ত আমার বোধ হয় না।”
উত্তরে মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “ইতিপূর্ব্বে ইহাকে আপনি আর কখনও দেখেন নাই।” এই বলিয়া রাজা মহাশয়ের নিকট তিনি এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের পরিচয় প্রদান করিলেন, এবং পরিশেষে কহিলেন, “ইহারই টাকা ঋণ করিবার কথা আপনাকে পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম।”
মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় কহিলেন, “ইহাকে একটু অপেক্ষা করিতে বলুন, টাকা দেওয়া যাইবে।” এই বলিয়া সেই নবাগত লোকদিগের প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আপনারা কতক্ষণ আসিয়াছেন? আজ আমার আসিতে একটু বিলম্ব হইয়াছে, তজ্জন্য আমাকে মাপ করিবেন। যাই হোক এখন আসুন কার্য্য আরম্ভ করা যাউক, বিলম্বে আর প্রয়োজন কি?”
রাজা মহাশয়ের মুখ হইতে এই কথা বহির্গত হইবামাত্র একজন অনুচর একজোড়া তাস আনিয়া রাজা মহাশয়ের সম্মুখে রাখিয়া দিল। আগন্তুক কয়েক ব্যক্তিও তাঁহার নিকটে গমন করিয়া উপবেশন করিল। খেলা আরম্ভ হইল। কথায় কথায় হাজার দু হাজার টাকার হার-জিত হইতে লাগিল। দরবারস্থ সমস্ত লোক অতীব মনোযোগের সহিত ক্রীড়া দেখিতে লাগিলেন। দাওয়ানজী মহাশয় আগন্তুকদিগের নিকট বসিয়া ইঙ্গিতে দুই এক কথা তাহাদিগকে বলিয়া দিতে লাগিলেন। তাহারাও সেই অনুযায়ী কার্য্য করিয়া কেবল জিতিতে লাগিল, এবং রাজা মহাশয় ক্রমে হারিতে লাগিলেন।
এই সময় রাজা মহাশয় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীর দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “কেমন মহাশয়! আপনার এইরূপ একটু আধটু ক্রীড়া করা অভ্যাস আছে কি?”
উত্তরে সেক্রেটারী মহাশয় কহিলেন, “না মহাশয়! ইতিপূর্ব্বে এরূপ ক্রীড়ায় হস্তক্ষেপ করা দূরে থাকুক, অপর কাহাকেও এরূপ ক্রীড়া করিতে দেখি নাই।”
প্রত্যুত্তরে রাজা মহাশয় কহিলেন, ‘এ অতি সামান্য খেলা। যে কোন ব্যক্তি একটু মনোযোগের সহিত দেখিলেই তখনই শিখিতে পারেন। তাহার দৃষ্টান্ত দেখুন, ইহাঁরা এ ক্রীড়া আদৌ জানিতেন না। আমার নিকট শিক্ষা করিলেন; আশ্চর্য্য দেখুন, এখন আমাকেই ইঁহাদিগের নিকট পরাস্ত হইতেই হইতেছে!”
এই বলিয়া ক্রীড়ায় পুনরায় মনঃসংযোগ করিলেন। দুই একবার জিতিতেও লাগিলেন, কিন্তু প্রায়ই হারিতে লাগিলেন। সেই সময় মন্ত্রী মহাশয়ের দিকে একবার লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “পাট ক্রয় করিতে পারদর্শী লোকের কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে পারিয়াছেন কি?”
মন্ত্রী। বিশেষরূপ চেষ্টা দেখিতেছি; কিন্তু সেরূপ উপযুক্ত লোক এখনও স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। লোকের অভাব কি? দুই এক দিবসের মধ্যে সমস্ত ঠিক করিয়া লইব।
পুনরায় ক্রীড়া চলিতে লাগিল। পুনরায় রাজা মহাশয় পরাভূত হইতে লাগিলেন। এইরূপে প্রায় দুই ঘণ্টা কাল ক্রীড়া হইবার পর হার-জিতের হিসাব হইল। সেই সময় জানিতে পারা গেল যে, রাজা মহাশয় পঁচিশ হাজার টাকা জিতিয়াছেন। কিন্তু এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা হারিয়া গিয়াছেন; সুতরাং হিসাবে রাজা মহাশয় লক্ষ টাকার জন্য দায়ী হইলেন।
এইরূপে অনেকগুলি টাকা একবারে হারিয়া যাওয়ায় তিনি একটু দুঃখিত হইলেন সত্য; কিন্তু ক্যাসবাক্স খুলিয়া একতাড়া নোট বাহির করিয়া উহাদিগের হস্তে প্রদান করিলেন। করেন্সি আফিস হইতে নূতন নোটের তাড়া বাহির হইবার সময় যেরূপভাবে লাল সূতার দ্বারা উহা বাঁধা থাকে, এ নোটগুলিও সেইরূপভাবে বাঁধা। এই তাড়ার উপরিস্থিত একখানি নোটের উপর সকলের দৃষ্টি পড়িল; উহা একখানি হাজার টাকার নোট। সুতরাং সকলেই তখন অনুমান করিল যে, এ নোটের তাড়ায় একশত নোট আছে, এবং প্রত্যেক নোট এক হাজার টাকার। যাহার হস্তে রাজা মহাশয় সেই নোটের তাড়া অর্পণ করিলেন, তিনি উহা না গণিয়া আপনার পকেটেই রাখিয়া দিলেন!
ইহার পরই সে দিবসের নিমিত্ত ক্রীড়া শেষ হইয়া গেল। পরদিবস এই সময়ে পুনরায় ক্রীড়া আরম্ভ করিবেন, এইরূপ স্থির করিয়া রাজা মহাশয় গাত্রোত্থান করিবার উদ্দ্যোগ করিলেন। সেই দিবস অনেকগুলি টাকা তিনি হারিলেন বলিয়া, তাঁহার মনে একটু অশান্তির উদয় হইয়াছে, ইহাই সকলের অনুমান হইল।
[পৌষ, ১৩১১]
রাজা সাহেব দ্বিতীয় অংশ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
জালে পড়া
রাজা মহাশয়ের গমন করিবার সময় মন্ত্রী মহাশয় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীর দিকে লক্ষ্য করিয়া রাজা মহাশয়কে কহিলেন, “ইহার প্রতি কি আদেশ হয়?”
রাজা। কি সম্বন্ধে আদেশ?
মন্ত্রী। ইনি ইঁহার মনিবের নিমিত্ত যে টাকা কর্জ্জ করিতে চাহিতেছেন, সেই সম্বন্ধে কি আদেশ হয়?
রাজা। কেন, সে আদেশ ত আমি পূৰ্ব্বেই দিয়াছি। আমি বলিয়া দিয়াছি, টাকা দেওয়া যাইবে।
মন্ত্রী। তাহা হইলে কোন তারিখে ইঁহাকে আসিতে কহিব?
রাজা। কল্যই আসিতে বলিয়া দিন। যেরূপ ভাবে লেখাপড়া হইবে, তাহা সমস্ত ঠিক করা হইয়াছে ত?
মন্ত্রী। না, এখনও তাহার কিছুই হয় নাই।
রাজা। আজ যদি সুবিধা হয়, সে সমস্ত কার্য শেষ করিয়া রাখুন। আর পাট ক্রয় করিবার লোকের বন্দোবস্ত করিতেছেন না কেন? এক মাসের মধ্যে সমস্ত পাটের ডিলিভারি দিতে হইবে, তাহা আপনি ভুলিয়া গিয়াছেন কি? ঢাকা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি যে সকল প্রদেশে পাট জন্মিয়া থাকে, সেই প্রদেশীয় কোন লোক হইলে ভাল হয়। কারণ, সেইস্থানের লোক সকল যেরূপভাবে পার্ট চিনিতে পারে, অপর কোন স্থানের লোক সেরূপভাবে পাট চিনিতে পারে না।
মন্ত্রী। দুই এক দিবসের মধ্যে আমি পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত লোক স্থির করিয়া দিতেছি। পাটের ডিলিভারি দেওয়ার নিমিত্ত আপনি ব্যস্ত হইবেন না। দশ পনর দিবসের মধ্যে সমস্ত পাট যাহাতে ক্রয় করা যায়, তাহার নিমিত্ত আমি সবিশেষরূপে চেষ্টা করিব। অন্যান্য মহাজনদিগের ন্যায় টাকার অভাব ত আর আমাদিগের নাই; সুতরাং কার্য্য শেষ করিতে কয়দিবস লাগিবে?
মন্ত্রী মহাশয়ের সহিত এই কয়েকটি কথা হইবার পরই রাজা দরবার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া অন্দরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। ক্যাসবাক্সবাহীও ক্যাসবাক্স লইয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রস্থান করিল।
যে পর্য্যন্ত রাজা মহাশয় দরবারে উপস্থিত ছিলেন, সেই সময় এক মন্ত্রী মহাশয় ব্যতীত অপর কাহারও মুখ দিয়া কোন কথা নির্গত হয় নাই; সকলেই মুখ বন্ধ করিয়া আপন আপন কর্ম্মে নিযুক্ত ছিলেন। রাজা মহাশয় অন্তঃপুরে গমন করিবার পর সকলের মুখ দিয়া কথা নির্গত হইল। সেই সময়ে দাওয়ানজী মহাশয় মন্ত্রী মহাশয়কে কহিলেন, “পার্ট ক্রয় করিতে দক্ষ লোকের নিমিত্ত রাজা মহাশয় যখন এত ব্যস্ত হইযা পড়িয়াছেন, তখন একটি লোক স্থির করিয়াই কেন দিউন না।”
মন্ত্রী। লোকের আবশ্যক বলিযাই যে একটি অকৰ্ম্মণ্য লোক নিযুক্ত করিতে হইবে, এমন নহে। পনের কুড়ি দিবস একটু পরিশ্রম করিলে সম্বৎসরের নিমিত্ত তাহাকে আর চিন্তা করিতে হইবে না। এরূপ কার্য্যের নিমিত্ত আমি একজন সামান্য লোক নিযুক্ত করিতে পারি না।
দাওয়ান। তবে এরূপ উৎকৃষ্ট অথচ কঠিন কার্য্যের নিমিত্ত অপর লোক নিযুক্ত করিবার প্রয়োজনই বা কি? আপনার অধীনে ত অনেকগুলি কৰ্ম্মচারী কর্ম্ম করিতেছেন; দশ পনর দিবসের নিমিত্ত তাহাদিগের মধ্য হইতে একজনকে পাঠাইয়া দিলে হয় না?
মন্ত্রী। আমিও মনে মনে তাহাই স্থির করিয়া রাখিয়া ছিলাম। কিন্তু রাজা মহাশয় যখন ঢাকা কি সিরাজগঞ্জ নিবাসী কোন লোককে নিযুক্ত করিতে চাহিতেছেন, তখন আমি আমার অধীনের কর্ম্মচারীগণের মধ্যে কাহাকেও পাঠাইতে পারি না। কারণ, সেই প্রদেশীয় কোন লোকই রাজ সরকারে কর্ম্ম করেন না।
দাওয়ান। এরূপ অবস্থায় যাহা আপনি ভাল বিবেচনা করেন, তাহাই করুন। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুর বাড়ী আমার বোধ হয় ঢাকা জেলায়। তাঁহাকে বলিলে তিনি নিশ্চয়ই একজন উপযুক্ত লোক স্থির করিয়া দিতে পারেন সন্দেহ নাই।
মন্ত্রী। আপনি উত্তম কথা বলিয়াছেন। সেক্রেটারী মহাশয়ের বাড়ী ঢাকা জেলায়, ইহা আমি অবগত হইয়াছি; কিন্তু কার্য্যের সময় সে কথা আমার মনে হয় নাই। আপনার এই প্রস্তাবের নিমিত্ত আমি আপনাকে ধন্যবাদ না দিয়া থাকিতে পারি না। ( এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীর প্রতি) আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক যদি একজন উপযুক্ত ও বিশ্বাসী লোক স্থির করিয়া দেন, তাহা হইলে সবিশেষ উপকৃত হই। কারণ, আপনি নিজেই শুনিলেন, রাজা মহাশয় একজন লোকের নিমিত্ত কিরূপ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী। লোকের অভাব নাই। আমি কলা নিশ্চয়ই একজন লোক ঠিক করিব, এবং যে সময় এইস্থানে আগমন করিব, সেই সময় আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনয়ন করিব।
মন্ত্রী। দেখিবেন, যেন ভুলিবেন না। আর আপনার টাকা সম্বন্ধে যেরূপভাবে লেখা পড়া করিয়া লইতে চাহেন, সেইরূপভাবে একটি খড়া আপনি প্রস্তুত করিয়া আনিবেন। উহা আমি একবার দেখিয়া রাজা মহাশয়ের মঞ্জুর লিখাইয়া লইব। তাহার পর উহা নিয়মিতরূপ ষ্ট্যাম্প কাগজে লিখিয়া দিলেই আপনি টাকা প্রাপ্ত হইবেন। লেখা পড়া করিবার কি রেজিষ্টারী হইবার পূর্ব্বেই যদি আপনার টাকার সবিশেষ প্রয়োজন হয়, তাহা হইলেও কতক অংশ পূর্ব্বেই আপনি লইতে পারিবেন।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীর সহিত এইরূপ দুই চারিটি কথা হইবার পরই মন্ত্রী মহাশয় সেই দরবার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আপনার বাসা-অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।
যাঁহারা রাজা মহাশয়ের সহিত তাস খেলা করিয়া এক দিবসেই লক্ষ টাকার সংস্থান করিয়া লইলেন তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া দাওয়ানজী মহাশয় কহিলেন, “এইরূপ ক্রীড়ায় রাজা মহাশয়ের মনের গতি কতদিবস স্থির থাকিবে, তাহা বলিতে পারি না। এই সময়ে কিছু সংস্থান করিয়া লউন। রাজা মহাশয়ের অগাধ টাকা; সুতরাং ইহাতে তাঁহার অধিক কিছু ক্ষতি হইবে না, অথচ আমরা পাঁচজন এই সুযোগে কিছু উপার্জ্জন করিয়া লইতে পারিব।”
দাওয়ানজী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া উঁহাদিগের মধ্য হইতে একজন কহিলেন, “আপনার সম্মুখে আপনার মনিবের নিন্দা করা উচিত নহে। আমরা বিস্তর বিস্তর মূর্খ দেখিয়াছি, কিন্তু আপনার রাজা সাহেব সদৃশ মূর্খ ব্যক্তি এ পর্য্যন্ত আমাদিগের নয়নগোচর হয় নাই। বড়মানুষ হইলেই কি এরূপ মূর্খ হইতে হয়?”
দাওয়ান। আমার মনিব যে সকল কার্য্য করেন, তাহাতে তাঁহাকে মূর্খ বলা যাইতে পারে না; চলিত কথায়, উহাকে বড়মাসি কহে। চিরকালটা পল্লীগ্রামে রাজত্ব করিয়া ইঁহাকে জীবন অতিবাহিত করিতে হয়। সেই সকল স্থানে যে সে লোক ইঁহার নিকট গমন করিতে পারে না; সুতরাং এরূপভাবে অর্থ নষ্ট করিবার সুযোগও হয় না। কলিকাতায় যে কয়দিবস অবস্থিতি করেন, সেই কয়দিবস নানারূপে খরচের হাত সকলকে দেখাইয়া যান। আপনারা যেমন একদিন জুটিয়া গিয়াছেন, সেইরূপ যদি আর কাহাকেও পাই, তাহা হইলে আমার মনিবের সঙ্গে তাঁহাকেও জুটাইয়া দিই। আপনাদিগের উপলক্ষে যেমন কিছু কিছু প্রাপ্ত হইতেছি, সেইরূপ তাঁহাদিগের উপলক্ষ করিয়া আরও কিছু সংস্থান করিয়া লইতে পারি।
ক্রীড়াকারী একজন। তাস খেলার কৌশল যেমন আমাদিগকে শিখাইয়া দিয়া, পরিশেষে রাজা মহাশয়ের সহিত মিলাইয়া দিয়াছেন, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়কেও কেন সেইরূপে শিখাইয়া দিয়া তাঁহাকেও এই রাজা মহাশয়ের সহিত মিলাইয়া দেন না? তাহা হইলে আপনারও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে, এবং এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ও মধ্য হইতে কিছু উপার্জ্জন করিয়া লইয়া যাইতে পারিবেন। রাজা মহাশয় এইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়া গেলে ত আর এরূপ সুযোগ সহজে পাওয়া যাইবে না।
দাওয়ানজী। সেক্রেটারী মহাশয় যদি সেরূপ ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমিও চেষ্টা দেখিতে পারি।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় এ সম্বন্ধে কোন কথা কহিলেন না। ইহার পর গল্পের স্রোত ফিরিয়া গেল। অন্যান্য অনেক কথার পর সে দিবসের কার্য শেষ হইল। আগন্তুক ব্যক্তিগণ আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। দাওয়ানজী মহাশয়ও দরবার গৃহ পরিত্যাগ করিবার মানসে গাত্রোত্থান করিলেন। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় অতঃপর গাত্রোত্থান করিয়া ভগবান দাসের সহিত আপন বাসায় গমন করিলেন। যাইবার সময় দাওয়ানজী মহাশয়ের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন। “যে সময়ে আজ আগমন করিয়াছিলাম, পরদিবস পুনরায় সেই সময় মুসবিদার খসড়া সহিত আগমন করিব” —এই কথা বলিয়া গেলেন। গমন করিবার কালে পথে ভগবান দাস কহিল, “কেমন মহাশয়! কিরূপ মহাজনের যোগাড় করিয়া দিয়াছি?”
সেক্রেটারী। মহাজন ভালই বলিয়া বোধ হইতেছে; তবে কাৰ্য্য শেষ না হইলে কোন কথা বলা যায় না।
ভগবান। যখন রাজা মহাশয়ের আদেশ হইয়া গিয়াছে, তখন কাৰ্য্যও শেষ হইয়া গিয়াছে জানিবেন।
সেক্রেটারী। যে পর্যন্ত সমস্ত বিষয় শেষ না হইয়া যায়, সেই পর্য্যন্ত যদি রাজা মহাশয় পুনরায় নূতন আদেশ প্রদান না করে, তা’ হলেই ভাল।
ভগবান। আপনি ইঁহার সহিত পূর্ব্বে কখনও ব্যবহার করেন নাই বলিয়া, এই প্রকার কহিলেন। যদি পূৰ্ব্ব হইতে ইঁহার সহিত আপনার জানা শুনা থাকিত, তাহা হইলে এরূপ কথা কখনই আপনার মনে উদিত হইত না। ইঁহার মুখ হইতে একবার যে কথা বাহির হইবে, লক্ষ লক্ষ মুদ্রার ক্ষতি হইলেও, সে আদেশ কখনই তিনি প্রত্যাহার করিবেন না। তাহার দৃষ্টান্ত আজ আপনি স্বচক্ষেই দর্শন করিলেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে লক্ষ টাকা নষ্ট করিয়া যিনি একবারের নিমিত্ত একটু দুঃখ প্রকাশ করিলেন না, তাঁহার মন কত উচ্চতর। বিশেষতঃ ইঁহার কত টাকা আছে, তাহা আমরা এ পর্য্যন্ত কেহই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
সেক্রেটারী। তবে কি তোমার বিশ্বাস হয় যে, রাজা মহাশয়ের নিকট হইতে আমি আমার প্রস্তাবিত অর্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইব?
ভগবান। তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। টাকা আপনার হস্তগত হইয়াছে, ইহাই আপনি স্থির করিয়া রাখুন।
সেক্রেটারী। ইনি কি এতই ধনী?
ভগবান। তাহা আর আপনি আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করিতেছেন? ইঁহার কার্য্য দেখিয়া আর আপনি অনুমান করিতে পারিতেছেন না?
ভগবান দাসের সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতে না হইতেই এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় তাঁহার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
পাট ক্রয়ের বন্দোবস্ত
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে তাঁহার বাসায় পৌঁছাইয়া দিয়া, ভগবান দাস আপন বাসাভিমুখে প্রস্থান করিল। যাইবার সময় বলিয়া গেল, “পুনরায় কল্য আসিয়া আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব।”
ভগবান দাস গমন করিবার পর সেক্রেটারী মহাশয় মনে মনে অনেক প্রকার চিন্তা করিলেন। রাজার কায়দাকরণ, কথাবার্তা, তাঁহার মনে সৰ্ব্বদা জাগিতে লাগিল। দুই ঘণ্টার মধ্যে লক্ষ টাকা নষ্ট করিয়া একেবারের নিমিত্তও তিনি দুঃখ প্রকাশ করিলেন না, এই বিষয় কেবল তাঁহার মনে পড়িতে লাগিল। ভাবিতে লাগিলেন যে, যে ব্যক্তি এইরূপে জলের মত অর্থ অপব্যয় করিতে পারে, তাঁহার বৈভবই বা কত টাকার? মনে মনে এই প্রকার চিন্তা করিতে করিতেই তিনি সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিলেন। পাট ক্রয় করিবার একজন উপযুক্ত লোকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত মন্ত্রী মহাশয় যে তাঁহাকে বলিয়া দিয়াছিলেন, তাহা এক প্রকার ভুলিয়াই গেলেন।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের স্বদেশীয় একজন উকীল তাঁহার বাসার সন্নিকটেই বাস করিতেন। পরদিবস অতি প্রত্যূষে তিনি সেই উকীল মহাশয়ের বাসায় গমন করিয়া রাজত্ব বন্ধক রাখিয়া অর্থ গ্রহণ করিতে হইলে যে প্রকার লেখা-পড়া করিবার প্রয়োজন, সেই প্রকারের একটি খড়া মুসবিদা প্রস্তুত করাইয়া লইলেন। বলা বাহুল্য, সুযোগ বুঝিতে পারিয়া সেক্রেটারী মহাশয় উক্ত লেখাপড়ার স্বত্ব যতদূর সম্ভব আপনার মনিবের অনুকূলে লিখাইয়া লইলেন। নিয়মিত সময়ে পুনরায় ভগবান দাস আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজবাড়ীতে গমন করিবার অভিপ্রায়ে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় পূর্ব্ব হইতেই প্রস্তুত হইয়া বসিয়াছিলেন। মেছুয়া বাজারের যে বাসায় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় বাস করিতেন, সেই বাসায় আরও অনেকগুলি লোক অবস্থিতি করিত, একতা পাঠকগণ পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত আছেন। রাজবাড়ীতে রাজা মহাশয় সম্বন্ধে যে সকল বিষয় সেক্রেটারী বাবু স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছিলেন, রাজবাড়ী হইতে বাসায় আসিয়া তিনি সকলের সম্মুখে সেই সকল গল্প করেন। তাঁহার গল্প শ্রবণ করিয়া তাঁহার জনৈক বন্ধু তাঁহার সহিত পরদিবস গমন করিয়া রাজ-দরবার দেখিয়া আসিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সুতরাং আজ তিনিও সেক্রেটারী মহাশয়ের সহিত রাজ-দরবারে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া বসিয়া আছেন। এইরূপে ইঁহারা কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিবার পরই ভগবান দাস আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল, এবং তাঁহাদিগকে লইয়া পুনরায় সেই রাজবাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহারা সকলে পূর্ব্বের ন্যায় দরবার গৃহে গিয়া উপবেশন করিলেন। যে সময় তাঁহারা দরবার গৃহে প্রবেশ করিলেন, সেই সময় সেইস্থানে দুই একজন নিম্ন কৰ্ম্মচারী ব্যতীত অপর আর কেহই ছিলেন না। কিন্তু তাঁহাদের গমন করিবার পর ক্রমে দাওয়ানজী মহাশয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মন্ত্রী মহাশয় আগমন করিলেন। ক্রমে পূর্ব্বোক্ত আগন্তুক ব্যক্তি কয়েকজনও আগমন করিল, এবং পরিশেষে পূর্ব্ব দিবসের ন্যায় রাজা মহাশয়ও দরবার গৃহে প্রবেশ করিলেন।
দাওয়ানজী মহাশয় আগমন করিয়াই এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি খসড়া মুসবিদা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছেন কি?” এই কথায় তিনি আপনার নিকট হইতে সেই খড়া লেখা-পড়াখানি বাহির করিয়া দাওয়ানজী মহাশয়ের হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি নিতান্ত উদাস ভাবে এ কবার উহা আদ্যোপান্ত দেখিয়া লইলেন, কহিলেন, “ঠিক হইয়াছে, মন্ত্রী মহাশয় আগমন করিলে আপনার কার্য শেষ করিয়া দেওয়া যাইবে।” এই বলিয়া কাগজখানি আপনার নিকটেই রাখিয়া দিলেন। পরিশেষে মন্ত্রী মহাশয় আগমন করিলে, তিনি তাঁহার হস্তে উহা প্ৰদান করিলেন। মন্ত্রী মহাশয়ও দাওয়ানজী মহাশয়ের মত একবার পড়িয়া লইলেন ও কহিলেন, “ইহার ভিতর সামান্য সামান্য কয়েকটি দোষ থাকিলেও লেখা মন্দ হয় নাই। রাজা মহাশয় দরবারে আসিবামাত্রই তাঁহার মঞ্জুরি লিখাইয়া লইয়া আপনাকে প্রদান করিব। পরিশেষে উপযুক্ত ষ্টাম্পযুক্ত কাগজে আপনি উহা লিখাইয়া আনিবেন। এই বলিয়া মন্ত্রী মহাশয় সেই কাগজখানি আপনার নিকটেই রাখিয়া দিলেন। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাকে যে লোকের নিমিত্ত বলিয়া দিয়াছিলাম, তাহার কিছু করিতে পারিয়াছেন কি?”
সেক্রেটারী। লোকের ভাবনা নাই। কিন্তু কিরূপ ভাবে পাট খরিদ করিতে হইবে, কত পাট ক্রয় করিতে হইবে, যে ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হইবে, সেই বা কিরূপ প্রাপ্ত হইবে? প্রভৃতি বিষয় উত্তমরূপে জানিতে পারিলেই আমি লোক আনিয়া দিতে পারিব।
মন্ত্রী। আমাদিগের রাজা মহাশয় কখনও পাটের ব্যবসা করেন নাই। কিন্তু ইঁহার একজন বন্ধু সাহেব ইঁহার জমীদারীর ভিতর একটি চটের কল খুলিয়াছেন। যে প্রদেশে চটের কল খোলা হইয়াছে, সেই প্ৰদেশীয় কোন লোক এই কাৰ্য্য বুঝে না। সুতরাং পার্ট আমদানী করিয়া দিবার কনট্র্যাক্ট কেহই লয়েন না। এই অবস্থা জানিতে পারিয়া রাজা মহাশয় বিরক্ত হন, এবং তাঁহার রাজত্বের ব্যবসাদারদিগকে শিক্ষা দিবার নিমিত্ত নিজেই পথ-প্রদর্শক হইয়া, সমস্ত পাট নিজেই সরবরাহ করিয়া দিবেন বলিয়া, নিজেই কনট্র্যাক্ট গ্রহণ করিয়াছেন।
সেক্রেটারী। আমি গত কল্য যেরূপ বুঝিতে পারিয়াছি, তাহাতে আমার অনুমান হয় যে, সেই পার্টের ডিলিভারি দিতে অতি অল্প সময়ই বাকি আছে। কি পরিমাণ পাট ক্রয় করার প্রয়োজন হইবে?
মন্ত্রী। নিতান্ত অধিক পাট ক্রয় করিতে হইবে না। আমার বোধ হয়, কেবলমাত্র লক্ষ মণ পাটের কন্ট্র্যাক্ট আছে, এই লক্ষ মণ পাট ক্রয় করিলেই হইতে পারিবে। আপনি যাহা বিবেচনা করিয়াছেন, তাহা ঠিক। পাটের ডিলিভারি দিবস আর অধিক দিবস বাকি নাই; কিন্তু এক আধ আনা দাম অধিক দিয়া নগদ টাকায় ক্রয় করিলে এই সামান্য পাট ক্রয় করিতে আর কয়দিবস লাগিবে?
সেক্রেটারী। যে ব্যক্তি পাট ক্রয় করিবে, তাহাকে কি পরিমাণে বেতনাদি দিতে মনস্থ করিয়াছেন?
মন্ত্রী। যে কয়দিবসই হউক, এক মাসের বেতন অন্যূন একশত টাকা তিনি পাইবেন। গমনাগমন করিতে, কিম্বা ক্রয়ের স্থানে আসা প্রভৃতি করিয়া অবস্থান করিতে যে ব্যয় হইবে, সে সমস্ত ব্যয়ই সরকার হইতে প্রাপ্ত হইবেন। ইহা ব্যতীত যত টাকার পার্ট ক্রয় করিবেন, তাহার প্রত্যেক টাকায় এক পয়সা করিয়া কমিসন পাইবেন।
সেক্রেটারী। যে ব্যক্তি পাট ক্রয় করিতে গমন করিবে, তাহাকে পাট ক্রয় করিবার টাকা কিরূপভাবে দেওয়া হইবে?
মন্ত্রী। এইখান হইতে গমন করিবার সময় প্রথমতঃ তিনি এক লক্ষ টাকা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন। সেই টাকায় পাট ক্রয় সমাপ্ত হইলে, তিনি যখন যে টাকা চাহিবেন, তাঁহার নিকট সেই পরিমিত টাকা পাঠাইয়া দেওয়া হইবে।
সেক্রেটারী। যে লোককে প্রথমে নিযুক্ত করিয়া পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত পাঠাইয়া দেওয়া হইবে, তাহাকে বিশ্বাস করিয়া, একবারে এত টাকা তাহার হস্তে সমর্পণ করা যাইবে কি প্রকারে?
মন্ত্রী। এই নিমিত্তই ভাল লোকের অনুসন্ধান করা হইতেছে। বিশ্বাসী লোক না হইলে তাঁহার হস্তে এত টাকা কিরূপে সমর্পণ করা যাইতে পারে? কিন্তু যে লোক নিযুক্ত করা হইবে, আমাদিগের সরকারের নিয়মানুযায়ী তাঁহাকে প্রথমতঃ জামিন দেওয়ার প্রয়োজন হইবে।
সেক্রেটারী। কিরূপ ভাবে জামিন লওয়া হইবে? এত টাকার জামিন হইতে সহজে কোন লোক স্বীকৃত হইবেন না।
মন্ত্রী। জামিন অতি সামান্য। কেবল সরকারের নিয়ম প্রতিপালন করা মাত্র। অতি সামান্য পরিমিত নগদ টাকা রাজসরকারে জমা দিলেই চলিতে পারিবে।
সেক্রেটারী। আপনাদিগের রাজসরকারের নিয়মানুযায়ী জামিনস্বরূপ কত টাকা জমা দিবার প্রয়োজন হইবে।
মন্ত্রী। সে অতিশয় সামান্য টাকা। কেবলমাত্র পাঁচ হাজার টাকা জমা দিলেই হইতে পারিবে।
মন্ত্রী মহাশয়ের সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় রাজা মহাশয় আসিয়া উপস্থিত। সঙ্গে সঙ্গে পূৰ্ব্ব দিবসের ন্যায় ক্যাসবাক্স ও উপস্থিত হইল।
রাজা মহাশয় দরবার গৃহে আপন স্থানে উপবেশন করিবার পরই মন্ত্রী মহাশয়, সেক্রেটারী মহাশয়ের আনীত খড়া মুসাবিদাটি রাজা মহাশয়ের হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি উহা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া পাঠ করিয়া দেখিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময়ে সেই কয়েকজন আগন্তুকের দিকে তাঁহার নয়ন আকৃষ্ট হইল। তিনি তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আপনারা কতক্ষণ আগমন করিয়াছেন? আসিবামাত্র আমাকে সংবাদ প্রদান করেন নাই কেন? আমার সন্নিকটে আসুন, কার্য্য আরম্ভ করিয়া দেওয়া যাউক।”
রাজা মহাশয়ের মুখ হইতে এই কয়েকটি কথা নির্গত হইবামাত্র তাঁহারা যেমন রাজার সন্নিকটবর্তী হইলেন, অমনি রাজা মহাশয় সেই খড়া কয়েকখানি আপনার ক্যাসবাক্সের নিম্নে রাখিয়া দিয়া তাঁহাদের সহিত ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হইলেন। পূর্ব্ব দিবসের ন্যায় ক্রীড়া আরম্ভ হইল। দেখিতে দেখিতে হাজার হাজার টাকার হার-জিত হইতে লাগিল। সেই দরবার গৃহস্থিত সমস্ত লোক একমনে সেই ক্রীড়া দেখিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় ও তাঁহার বন্ধু একদৃষ্টে সেই খেলার দিকে লক্ষ্য করিয়া রহিলেন। আজ রাজা মহাশয়ের শরীর একটু অসুস্থ থাকা- প্রযুক্ত অধিকক্ষণ খেলা হইল না, এক ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত শেষ হইয়া গেল। সেই সময় হিসাব করিয়া দেখিয়া জানিতে পারা গেল যে, আজ রাজা মহাশয় পঞ্চাশ হাজার টাকা জিতিয়াছেন। কিন্তু পঞ্চান্ন হাজার টাকা হারিয়াছেন, সুতরাং পাঁচ হাজার মাত্র ঋণী হইলেন। সেই সময় রাজা মহাশয় আপনার ক্যাবাক্স খুলিয়া পূর্ব্ব দিবসের ন্যায় হাজার টাকার নোটের একটি বাণ্ডিল বাহির করিলেন এবং কি ভাবিয়া কহিলেন, “সামান্য টাকার নিমিত্ত আর বাণ্ডিল খুলিব না। আজ আপনাদিগের টাকা বাকি থাকিল। –না, বাকিই বা থাকিবে কেন?” এই বলিয়া মন্ত্রী মহাশয়কে কহিলেন, “আপনাদিগের তহবিল হইতে এই খুচরা পাঁচ হাজার টাকা ইহাদিগকে প্রদান করুন।” রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া মন্ত্রী মহাশয় তাহাতেই সম্মত হইলেন ও কহিলেন, “আমি ইহাদিগকে পাঁচ হাজার টাকা এখনই প্রদান করিতেছি।” এই বলিয়া খাতাঞ্চী মহাশয়কে ডাকিয়া আনিবার নিমিত্ত একজন লোক প্রেরণ করিলেন।
সেই সময় রাজা মহাশয় সেই খড়া মুসাবিদাটি বাহির করিয়া একবার এপিট ওপিট করিয়া দেখিলেন। পরিশেষে মন্ত্রী মহাশয়কে কহিলেন, “আজ আমার শরীর একটু অসুস্থ বোধ হইতেছে; সুতরাং ইহা আর এখন আমি দেখিতে পারিব না। ইহা অদ্য আপনার নিকট রাখিয়া দিন। লেখা ঠিক হইয়াছে কি না, সময় মত তাহা আপনি একবার দেখিবেন, এবং কল্য আমাকে প্রদান করিবেন।” এই বলিয়া সেই কাগজখানি মন্ত্রী মহাশয়ের হস্তে অর্পণ করিলেন, তিনি উহা আপনার বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলেন। পরিশেষে মন্ত্রী মহাশয় কতকগুলি কাগজ আপনার বাক্স হইতে বাহির করিয়া রাজা মহাশয়ের হস্তে প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন, “এই কয়খানি অতীব প্রয়োজনীয় কাগজ। ইহাতে অদ্যই আপনার স্বাক্ষর না হইলে রাজত্বের কতকগুলি কার্য্যের সবিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা।”
মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় সেই কাগজগুলি এক একখানি করিয়া দেখিতে লাগিলেন, এবং স্বাক্ষর করিয়া মন্ত্রী মহাশয়ের হস্তে অর্পণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সমস্ত কাগজগুলিতে স্বাক্ষর হইবার পর, তিনি উহা দাওয়ানজী মহাশয়ের হস্তে অর্পণ করিলেন। দাওয়ানজী মহাশয় উহা আপনার বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিলেন।
এইরূপে রাজকার্য সম্পন্ন করিয়া সে দিবসের নিমিত্ত সভা ভঙ্গ করিয়া রাজা মহাশয় গাত্রোত্থান করিলেন, এবং অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবার উদ্দ্যোগ করিলেন। সেই সময় রাজা মহাশয় মন্ত্রী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পাট ক্রয় করিবার লোকের বন্দোবস্ত শেষ হইয়া গিয়াছে কি?” উত্তরে মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “এখনও সম্পূর্ণরূপে স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। অদ্য প্রাতঃকালে আমি হাটখোলায় গমন করিয়া কয়েকজন পাটের মহাজনের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাদিগকে আমার মনের কথা বলিয়াছিলাম।” তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই এ কার্য্যের ভার গ্রহণ করিতে সম্মত হইয়াছেন, তদ্ব্যতীত এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ও একজন পারদর্শী লোক স্থির করিয়া দিবেন বলিতেছেন। কারণ, ইহার নিজের নিবাস ঢাকা জেলা। সুতরাং সেই প্রদেশীয় একজন ভাল লোক অনায়াসেই ইনি স্থির করিয়া দিতে পারিবেন।
মন্ত্রী মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “অতি অল্প দিবসের নিমিত্ত যদি আপনি একজন উপযুক্ত লোক দিতে পারেন, তাহা হইলে ভাল হয়। কিরূপ বন্দোবস্তে লোক নিযুক্ত করা হইবে, তাহার সমস্ত অবস্থা আপনি মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট হইতে জানিতে পারিবেন।” এই বলিয়া রাজা মহাশয় অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
রাজা মহাশয় গমন করিলে পর মন্ত্রী মহাশয় পুনরায় আপনার স্থানে উপবেশন করিলেন। সেই সময় যে লোক খাতাঞ্চী মহাশয়কে ডাকিতে গিয়াছিল, সে প্রত্যাগমন করিয়া কহিল, “খাতাঞ্চী মহাশয়ের শরীর অসুস্থ হইয়াছে, এই নিমিত্ত তিনি আসিতে পারিবেন না। কিসের নিমিত্ত তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠান হইয়াছে, তাহা তিনি জানিতে চাহিয়াছেন। যদি না আসিয়া সেই কার্য্য তাঁহার দ্বারা হইতে পারে, এই নিমিত্ত তাঁহার উপর যে আদেশ হইয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত পুনরায় আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন।”
এই কথা শ্রবণ করিয়া সেই আগন্তুকদিগকে পাঁচ হাজার টাকা দিবার নিমিত্ত একখানি রোকা লিখিয়া তাঁহাদিগের হইতে প্রদান করিয়া কহিলেন, “আপনারা খাতাঞ্চী মহাশয়ের নিকট হইতে পাঁচ হাজার টাকা লইয়া যাউন।” তাঁহারা মন্ত্রী মহাশয়কে অভিবাদন পূর্ব্বক সেই রোকা লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
উঁহারা সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলে মন্ত্রী মহাশয় সেক্রেটারী মহাশয়কে কহিলেন, “আপনার প্রস্তুত মুসাবিদা আমি এক প্রকার দেখিয়াছি, উহা প্রায় ঠিকই আছে। তথাপি রাজা মহাশয় যখন বলিতেছেন তখন পুনরায় আর একবার দেখিয়া রাখিব, এবং কল্য যখন তিনি দরবারে আগমন করিবেন, সেই সময় তাঁহাকে দিয়া মঞ্জুরি লিখিয়া লইব। তাহার পর ষ্ট্যাম্প কাগজে উহা উঠাইতে, না হয়, আরএকদিবস বিলম্ব হইবে। কিম্বা ইংরাজ আইনের নিয়মানুযায়ী আপনার রাজা মহাশয়কে একবার এখানে আসিতে হইবে। তাঁহাকে সেই দলিল সহি করিতে হইবে এবং রেজেষ্টারী আফিসে গিয়া তাঁহাকেই উহা রেজেষ্টারী করিয়া দিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় তাঁহাকে সংবাদ প্রদান করুন। দেখুন কতদিবস পরে তিনি এইস্থানে আগমন করিয়া আবশ্যকীয় কার্য্য সমাপনাস্তর সমস্ত টাকা লইয়া গমন করিতে পারিবেন।”
সেক্রেটারী। খড়াখানি রাজা মহাশয়ের মঞ্জুরি লেখা হইলেই আমি তাঁহাকে সংবাদ প্রদান করিব। কিন্তু আমার অনুমান হয় যে, এক মাসের কম তিনি কোন প্রকারেই আগমন করিতে সমর্থ হইবেন না।
মন্ত্রী। টাকা প্রদান করিতে রাজা মহাশয় মুখে আদেশ প্রদান করিয়াছেন। তথাপি কল্য লিখিত আদেশ করাইয়া লইব এখন আমাদিগের দ্বারা এই কাৰ্য্য যত শীঘ্র সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা, তাহাও করিব। আপনার রাজা মহাশয় যত শীঘ্র আগমন করিবেন, কার্যাও তত শীঘ্র শেষ হইয়া যাইবে। এক মাস সময়ের মধ্যে না আগমন করিতে পারেন, তাহাতেও সবিশেষ ক্ষতি হইবে না। কারণ, আমার মনিব এখনও দুই তিন মাস কলিকাতায় অবস্থান করিবেন, একথা তিনি আমাকে দুই তিনবার বলিয়াছেন।
সেক্রেটারী। আমি কলাই রাজা মহাশয়কে পত্র লিখিব, এবং যত শীঘ্র পারেন, এইস্থানে আগমন করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিব।
মন্ত্রী। আপনার কার্য্যের সমস্তই ত এক প্রকার শেষ হইয়া গেল। এখন আপনি আমার কার্য্যের কিছু করিতে পারিবেন কি? যদি আপনার দ্বারা এ কাৰ্য্য সম্পন্ন না হয়, তাহা হইলে তাহাও আমাকে বলিবেন। আমি হাটখোলায় কোন একজন পাটের মহাজনের সহিত বন্দোবস্ত করিব। একটি সামান্য কর্ম্মের নিমিত্ত প্রত্যহ রাজা মহাশয়ের নিকট অপদস্থ হওয়া ভাল নহে।
মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া দাওয়ানজী মহাশয় কহিলেন, “হাটখোলায় কোন মহাজনের সহিত আপনার বন্দোবস্ত করিতে হইবে না। বিশেষতঃ রাজা মহাশয়ের কথার ভাবে বোধ হইল যে, তিনিও সেইরূপ বন্দোবস্তে সম্মত নহেন। সেক্রেটারী মহাশয় যখন বলিতেছেন, তখন তিনিই একজন উপযুক্ত লোককে আনিয়া দিবেন। না পারেন, আমিও মনে মনে একরূপ স্থির করিয়াছি যে, সেরাজগঞ্জে বহুদিবস হইতে অবস্থান করিতেছেন, এরূপ আমার একজন লোক আছে। আবশ্যক হয়, তাঁহাকে টেলিগ্রাফ করিব। সংবাদ পাইবামাত্র তিনি এইস্থানে আগমন করিয়া সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া পাঁচ হাজার টাকা জমা দিবেন, এবং আপাততঃ এক লক্ষ টাকা লইয়া গিয়া আপনার কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবেন। দশ পনর দিন কার্য্য করিলে যাহাতে পাঁচ ছয় সহস্র টাকা পাইবার সম্ভাবনা এরূপ কাৰ্য্য কি সহজে হস্তান্তর করা কর্তব্য?”
এইরূপ কথাবার্তার পর সকলেই আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। সেক্রেটারী বাবু ও তাঁহার বন্ধুকে পূর্ব্ব দিবসের ন্যায় ভগবান দাস তাঁহাদিগের বাসায় রাখিয়া গেল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
নূতন কৰ্ম্মে নিয়োগ
পথে গমন করিতে করিতে ভগবান দাস এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুকে কহিলেন, “মহাশয় আপনারা বড়লোক, সুতরাং আপনাদিগের কার্য্য-কলাপ আমাদিগের মত ক্ষুদ্র ব্যক্তি কিরূপে বুঝিতে পারিবে? তথাপি আমার মনে যে একটি ভাবের উদয় হইয়াছে, তাহা আপনার নিকট প্রকাশ না করিলে কোন মতেই থাকিতে পারিলাম না। অতএব এরূপ অনধিকার প্রবেশে যদ্যপি আমার কোনরূপ অপরাধ হয়, অনুগ্রহ পূর্ব্বক ক্ষমা করিবেন।”
“মন্ত্রী মহাশয়ের ও আপনার কথানুযায়ী যেন আমার বোধ হইল, আপনার রাজা মহাশয় এক মাসের কম কোনরূপ এখানে আগমন করিতে পারিবেন না; সুতরাং এক মাসের মধ্যে আপনার কার্য্যও শেষ হইবে না। আর বিনাকার্য আপনাকে মাসাবধি কলিকাতায় বসিয়া থাকিতে হইবে। আমি আরও বুঝিতে পারিয়াছি যে, পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত রাজা মহাশয় ঢাকা জেলা নিবাসী একজন ভাল লোক চাহেন। আরও শুনিয়াছি, আপনার বাসস্থান ঢাকা জেলায়। এরূপ অবস্থায় কলিকাতায় বসিয়া না থাকিয়া আপনি কেন এই সময় বাড়ী গমন করুন না? সেইস্থানে আপনার লোকজন নিশ্চয়ই অনেক আছেন, তাঁহাদিগের দ্বারা এই কার্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন করিয়া লইতে পারিবেন। এরূপ উপায়ে অনায়াসেই আপনি পাঁচ ছয় হাজার টাকা লাভ করিতে পারিবেন। অথচ সময় মত এইস্থানে আগমন করিয়া আপনার মনিবের কার্য্যও উদ্ধার করিতে পারিবেন। মহাশয়! আমি নিতান্ত সামান্য লোক। আমার সামান্য বুদ্ধিতে যাহা আসিল—তাহাই আমি কহিলাম। ভাল মন্দ বিবেচনা করিবার ভার আপনার উপর।”
ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় কহিলেন, “তোমাকে সামান্য বুদ্ধির লোক কে কহে? যে কথা আমাদের মনে উদিত হয় নাই, তাহা তোমার মনে উদয় হইয়াছে দেখিয়া, আমি তোমার উপর অতিশয় প্রীত হইলাম। তুমি যাহা কহিলে, তাহা আমি প্রথমে বিশেষরূপে বিবেচনা করিয়া দেখিব, এবং পরিশেষে অপর লোকের অনুসন্ধান করিব।”
এইরূপ কথাবার্তা হইতে না হইতে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় আপন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। “পুনরায় সময়-মত কল্য আগমন করিব” এই বলিয়া ভগবান দাস প্রস্থান করিল।
ভগবান দাস সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুর বন্ধু কহিলেন, “আমি যতদূর দেখিলাম, তাহাতে আমার বোধ হয় যে, রাজা মহাশয়ের নিকট হইতে আপনার মনিব নিশ্চয়ই টাকা প্রাপ্ত হইবেন। আমার আরও বোধ হয়, দালাল ভগবান দাস যা কহিল, তাহা নিতান্ত অযৌক্তিক কথা নহে। পাঁচ ছয় হাজার টাকা কেন, আমার বিবেচনায় একটু চালাকির সহিত কার্য্য করিলে আট দশ হাজার টাকা অনায়াসেই উপার্জ্জন হইতে পারিবে।”
সেক্রেটারী। আপনি যাহা কহিলেন তাহা সত্য, একথা আমি ইতিপূর্ব্বে অনেকবার ভাবিয়াছি। সকল কাৰ্য্য আমি অনায়াসেই সম্পন্ন করিতে পারিব এবং বিনাক্লেশে ও পরের অর্থে কিছু উপার্জ্জনও হইবে; কিন্তু আমি আপাততঃ পাঁচ হাজার টাকা কোথায় পাইব?
মন্ত্রী। পাঁচ হাজার টাকার নিমিত্ত আপনি এত চিন্তিত হইতেছেন কেন? এই কলিকাতা সহরে আপনার বন্ধুবান্ধব কম নাই; দুই এক দিবসের নিমিত্ত তাঁহাদিগের নিকট হইতে ধার করিলে, অনায়াসেই পাঁচ সহস্র মুদ্রার সংগ্রহ হইবে। এই টাকা আপনার জামিন স্বরূপ প্রদান করিলে, আপনার হস্তেই পাট ক্রয়ের ভার ন্যস্ত হইবে; আপনাকে রাজা মহাশয় লক্ষ টাকা প্রদান করিবেন। সেই সময় এই টাকা হইতে আপনার হাওলাতি দেনা পরিশোধ করিয়া পঁচানব্বই হাজার টাকা লইয়া আপনি সেইস্থানে গমন করিবেন এবং যেরূপ সুবিধা বুঝেন, সেইরূপ ভাবে কার্য্য করিবেন।
সেক্রেটারী। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা সত্য। কিন্তু বন্ধুবান্ধবদিগের নিকট হইতে এইরূপ ভাবে টাকা কর্জ্জ লওয়া কৰ্ত্তব্য কি না, তাহা আমি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এদিকে একজনের নিকট কর্ম্ম করিতেছি। সেই কৰ্ম্মে আমি নিযুক্ত থাকিতে থাকিতে এইরূপ ভাবে অপরের কার্য্যে আমার হস্তার্পণ করাও উচিত, কি না?
বন্ধু! একজনের কর্ম্মে যখন নিযুক্ত থাকা যায়, তখন সেই কার্য্যের ক্ষতি করিয়া অপরের কর্ম্মে হস্তক্ষেপ করা কোনমতে যুক্তি-সঙ্গত নহে; ইহা আমি স্বীকার করি। কিন্তু বর্তমান কার্য্য ভিন্ন প্রকারের। দুইটি কারণে ইহাতে অনায়াসেই হস্তক্ষেপ করা যাইতে পারে। প্রথমতঃ, এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে আপনার মনিবের কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই। বরং রাজা মহাশয় আপনার কাৰ্য্যে সন্তুষ্ট হইলে আপনার মনিবের প্রস্তাবিত অর্থ প্রদান করিতে কোনমতে কুণ্ঠিত হইতে পারিবেন না। সুতরাং ইহাতে আপনার মনিবের অনিষ্ট না হইয়া বরং ইষ্টই সাধিত হইবে। দ্বিতীয়তঃ, যখন আপনাকে একমাস কাল বিনাকর্ম্মে বসিয়া থাকিতে হইতেছে, তখন কলিকাতায় না থাকিয়া তাহার কতক সময় আপন বাড়ীতে বসিয়া থাকিলে, আপনার মনিবের কি ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা?
সেক্রেটারী। আপনার কথা যুক্তি-শূন্য নহে স্বীকার করি; কিন্তু বন্ধুবান্ধবের নিকট হইতে পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করিতে পারিব কি?
বন্ধু। টাকার সংগ্রহ হইবে কি না, তাহা চেষ্টা না দেখিয়া বলা সহজ নহে।
এইরূপে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী ও তাঁহার বন্ধুর সহিত পরস্পরের অনেক কথা হইবার পর, পরিশেষে ইহা স্থির হইল যে, যাহাতে পাঁচ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়, তাহার চেষ্টা করাই কর্তব্য। এইস্থানে বোধ হয়, পাঠকগণকে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক যে, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুর বন্ধ বি-এ ক্লাশের একটি ছাত্র।
সেই দিবস সন্ধ্যার পরই এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় আপনার বন্ধুবান্ধবদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। কি নিমিত্ত তাঁহার টাকার নিতান্ত প্রয়োজন হইয়াছে, তাঁহা কিন্তু কাহারও নিকট না বলিয়া, দুই এক দিবসের নিমিত্ত কিছু টাকার প্রয়োজন হইয়াছে, এই বলিয়া যাঁহার যাঁহার নিকট হইতে যাহা প্রাপ্ত হইতে পারিবেন, তাহার একটিআনুমানিক হিসাব স্থির করিয়া লইলেন। এইরূপে বন্ধুবর্গের নিকট হইতে যাহা প্রাপ্ত হইতে পারেন, এবং নিজের নিকট যাহা কিছু আছে তাহা মিলাইয়া দেখিলেন; সৰ্ব্বসমেত প্রায় সাড়ে চারি হাজার টাকা হইতে পারে। এখনও পাঁচশত টাকার অনটন রহিল।
পরদিবস ভগবান দাস নিয়মিত সময়ে পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হইল। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু পূর্ব্ব হইতেই কাপড় ছাড়িয়া ঠিক হইয়া বসিয়াছেন। ভগবান দাস আসিবামাত্র কালবিলম্ব না করিয়া তাহার সহিত গমন করিলেন।
পথে গমন করিতে করিতে ভগবান দাস সেক্রেটারী বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাজবাড়ীতে গমন করিবামাত্রই মন্ত্রী মহাশয় প্রভৃতি সকলেই পাট, ক্রয় করিবার লোকের কথা জিজ্ঞাসা করিবেন। আপনি লোকের ঠিক করিয়াছেন?”
সেক্রেটারী। লোক ত ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই। কোন লোককে বিশ্বাস করিয়া একবারে এত টাকা তাহার হস্তে প্রদান করিতে রাজা মহাশয়কে বলিব? টাকার লোভ সম্বরণ করা সকলের পক্ষে নিতান্ত সহজ কথা নহে। সে ব্যক্তি যদি সেই লোভ সম্বরণ করিতে না পারিয়া, রাজা মহাশয় প্রদত্ত টাকা লইয়া পলায়ন করে, তাহা হইলে সেই টাকার নিমিত্ত রাজা মহাশয়ের নিকট কে দায়ী হইবে? তুমি কাল যেরূপ ভাবে বলিতেছিলে, সেইরূপ ভাবে আমি নিজে গমন করিতে পারি, যাইব; নতুবা অপর কোন লোককে আমি এই কার্য্যে পাঠাইতে ইচ্ছা করি না।
ভগবান। ইহাই উত্তম পরামর্শ। আপনি নিজেই এই কার্য্যে গমন করুন। দশ পনর দিনের মধ্যে কার্য্য শেষ করিয়া পুনরায় আপনি কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিতে সমর্থ হইবেন।
সেক্রেটারী। আমি নিজেই এই কার্য্যে গমন করিতে প্রস্তুত আছি, একথা আমি নিজে মন্ত্রী মহাশয়, কি রাজা মহাশয়ের নিকট কিরূপে প্রস্তাব করিব?
ভগবান। তাহার নিমিত্ত আপনি ভাবিতেছেন কেন, সে কার্য্যের ভার আমি লইতে প্রস্তুত আছি।
এইরূপ কথা বলিতে বলিতে উভয়েই ক্রমে রাজবাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন এবং রাজ দরবারের ভিতর প্রবেশ করিলেন। দরবার গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, মন্ত্রী মহাশয় আজ অগ্রেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। সেক্রেটারী মহাশয় দরবার গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র মন্ত্রী মহাশয় নিজে গাত্রোত্থান করিয়া সসম্ভ্রমে তাঁহাকে সেইস্থানে বসাইলেন, এবং আপনার বাক্স হইতে সেই খড়া মুসবিদাখানি বাহির করিয়া কহিলেন, “আমি সবিশেষ মনোযোগের সহিত ইহা পাঠ করিয়াছি। ইহা অতি উত্তমরূপেই লিখিত হইয়াছে, কেবল একটিমাত্র স্থান ভিন্ন ইহাতে আমার আর কোন কথা বলিবার নাই। ইহাতে লিখিত আছে যে, শতকরা বাৎসরিক চারি টাকা সুদে আপনারা টাকা কর্জ্জ করিতেছেন, এত কম সুদে টাকা ধার দেওয়ার পদ্ধতি এ সরকারে নাই। অভাব পক্ষে শতকরা বাৎসরিক পাঁচ টাকা সুদের কমে এ পর্যন্ত কাহাকেও কখন টাকা প্রদত্ত হয় নাই। উহা অপেক্ষা অধিক না হউক, আপনি যদি উহাতেও সম্মত হইতে না পারেন, তাহা হইলে রাজা মহাশয় যে টাকা প্রদান করিবেন, তাহা আমার বোধ হয় না; বিশেষ সরকারে যে দস্তুর নাই, তাহা সম্পাদন করিবার নিমিত্ত আমরাও কোন কথা রাজা সাহেবকে বলিতে সাহসী হইব না, আর বলিলেও তিনি যে তাহা শুনিবেন, তাহাও বোধ হয় না। এরূপ অবস্থায় আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করেন, তাহা আমাকে বলুন, রাজা মহাশয় আসিলে আপনার কার্য শেষ করিয়া দিবার বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখি।”
সেক্রেটারী। আমার মনিবের টাকার প্রয়োজন, তাঁহাকে টাকা গ্রহণ করিতেই হইবে। যদি পাঁচ টাকার কম সুদে আপনাদিগের সরকারে ধার দেওয়ার পদ্ধতি না থাকে, তাহা হইলে কাজেই আমাকে উহাতেই স্বীকৃত হইতে হইবে। আপনি রাজা মহাশয়কে বলিয়া আমার কার্য শেষ করিয়া দিউন, আমি বাৎসরিক শতকরা পাঁচ টাকা হিসাবেই সুদ দিতে স্বীকৃত হইলাম।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া মন্ত্রী মহাশয় খড়া মুসবিদার যে স্থানে চারি টাকা সুদের কথা লেখা ছিল, সেই স্থানটি কাটিয়া পাঁচ টাকা করিয়া দিলেন। সেই কাগজখানি আপনার নিকট রাখিয়া দিয়া পরিশেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি আমার কার্য্যের কিছু স্থির করিতে পারিয়াছেন কি?”
সেক্রেটারী। এখন পর্যন্ত সবিশেষ কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। বিশ্বাস করিয়া যাহার হস্তে একবারে লক্ষ টাকা প্রদান করিবেন, এরূপ বিশ্বাসী লোক সহজে প্রাপ্ত হওয়া নিতান্ত সহজ নহে। আজ কালকার অবস্থা যেরূপ, তাহা আপনি উত্তমরূপে অবগত আছেন। দশ টাকা দিয়া কোন লোককে বিশ্বাস করিতে সহজে সাহস হয় না। তাহার উপর একেবারে লক্ষ টাকা আপনারা তাহার হস্তে একবারে প্রদান করিবেন ও তাহার জামিনের স্বরূপ আপনারা কেবল মাত্র পাঁচ সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিবেন। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি, আমি কাহাকে বিশ্বাস করিয়া এই কার্য্যে প্ৰবৃত্ত করিতে সাহসী হই। ঈশ্বর না করুন, সে যদি ঐ টাকা লইয়া কোন রূপে আত্মসাৎ করিয়া বসে, তাহা হইলে ভাবুন দেখি, আমার পরিণাম কি হইবে, আমার উপর আপনাদিগের কিরূপ বিশ্বাস বর্তমান থাকিবে ও পরিণামে আমার মনিবের কার্য্যেই বা কতদূর কৃতকার্য হইতে সমর্থ হইব? সে সময়ে আপনারা আমার কথায় আর কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিবেন না। যে কার্য্যে এতদূর বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা আছে, সেই কার্য্যের নিমিত্ত লোক প্ৰদান করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
এই সময়ে ভগবান দাস কহিল, “ধর্ম্মাবতার! আমার একটি কথা বলিবার আছে। সেক্রেটারী বাবু যাহা কহিলেন, তাহা সত্য; বিশ্বাস করিয়া যাহার হস্তে প্রথমেই লক্ষ টাকা প্রদান করিবেন, এরূপ লোক সহজে প্রাপ্ত হওয়া একেবারেই অসম্ভব। সেক্রেটারী বাবুর মনিবের কলিকাতায় আসিয়া দলিলাদি রেজেষ্টারী করিয়া দিতে প্রায় মাসাবধি লাগিবে। এই সময়ের মধ্যে যদি আপনারা তাঁহার সমস্ত কার্য্য ঠিক করিয়া রাখেন, তাহা হইলে আপনাদিগের উপকারের নিমিত্ত সেক্রেটারী মহাশয় নিজেই যাহাতে আপনাদিগের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে প্রস্তুত হন, তাহা না হয় একবার চেষ্টা করিয়া দেখি। তিনি যদি অনুগ্রহ করিয়া এই কার্য্য নিজ হস্তে গ্রহণ করিতে সম্মত হন, তাহা হইলে এক লক্ষ কেন দুই লক্ষ টাকাও রাজা সাহেব ইহার হস্তে অনায়াসেই প্রদান করিতে পারেন। ইহার হস্তে আর প্রদান করিতে যেমন কাহাকেও কোনরূপে সঙ্কুচিত হইতে হইবে না, ইহার দ্বারা কার্য্যও সেইরূপ সুচারুরূপে অনায়াসেই নিৰ্ব্বাহ হইবে। আমার বিবেচনায় অপর লোকের চেষ্টা না দেখিয়া যাহাতে ইনিই ঐ কার্য্যে প্রবৃত্ত হন, তাহারই চেষ্টা দেখা আমাদিগের একান্ত কৰ্ত্তব্য।
ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিয়া, মন্ত্রী মহাশয় অতীব সন্তুষ্ট হইলেন, এবং সেক্রেটারী মহাশয়ের দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আপনি নিজেই যদি এই কার্য্যের ভার গ্রহণ করেন, তাহা হইলে আমাদিগের যে কি উপকার করা হয়, তাহা আর কি বলিব। আপনার কার্য্যের নিমিত্ত আপনাকে কিছুমাত্র দেখিতে হইবে না, সে ভার আমি নিজেই গ্রহণ করিলাম। আপনার মনিব যে দিবস কলিকাতায় আসিয়া দলিল রেজেষ্টারী করিয়া দিবেন, সেই দিবসই টাকা প্রাপ্ত হইবেন। আর ইহাতেও যদি তাঁহার কার্য্যের অসুবিধা হয়, অর্থাৎ দলিল রেজেষ্টারী হইবার পূর্ব্বে যদি টাকার একান্ত প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আমি তাহা প্রদান করিবারও বন্দোবস্ত করিতে পারিব।”
সেক্রেটারী। যখন আপনি বলিতেছেন, তখন আমি আপনাদিগের পাট ক্রয় করিবার কার্য্য স্বহস্তে গ্রহণ করিতে সম্মত আছি। আশা করি, এই কার্য্য সুচারুরূপে আমি সম্পন্ন করিতে পারিব; কিন্তু একটি বিষয়ের নিমিত্ত আমার কিছু অসুবিধা হইতেছে। এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে হইলে সর্ব্বপ্রথম পাঁচ হাজার টাকা আপনাদিগের সরকারে জমা দিবার নিয়ম আছে। কলিকাতায় আমি একে এক প্রকার অপরিচিত, তদ্ব্যতীত অত টাকা আমার সঙ্গে নাই। এরূপ অবস্থায় আমি কিরূপে সেই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ হইব?
মন্ত্রী। আপনিও রাজসরকারের একজন প্রধান কর্ম্মচারী, সুতরাং যে সরকারে যেরূপ নিয়ম আছে, তাহার অন্যথাচরণ করা যে কতদূর অসম্ভব, তাহা আপনাকে বলা নিষ্প্রয়োজন। আপনি অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে যদি প্রবৃত্ত হন, তাহা হইলে যে উপায়েই হউক, রাজসরকারের নিয়মানুযায়ী আপনাকে পাঁচ হাজার টাকার বন্দোবস্ত করিতেই হইবে। তবে দুই এক শত টাকার যদি কোন প্রকারে অনটন হয়, তাহা হইলে সে উপায় আমি করিতে পারিব।
সেক্রেটারী। দুই এক শত টাকার বন্দোবস্ত করিলে হইবে না, অভাব পক্ষে আপনাকে পাঁচশত টাকার বন্দোবস্ত করিতে হইবে।
মন্ত্রী। যতদূর সংগ্রহ করিতে পারেন, তাহা লইয়া কল্য আগমন করিবেন। সেই সময় সে বিষয়ের বন্দোবস্ত করা যাইবে। যদি শতাবধি-টাকা কমই পড়ে, তখন যেরূপ হয়, একরূপ বন্দোবস্ত করা যাইবে; আমিই না হয় আপনাকে ঐ টাকা হাওলাত স্বরূপ প্রদান করিব। পরিশেষে সুযোগমতে আপনি আমাকে উহা পাঠাইয়া দিবেন।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী ও মন্ত্রী মহাশয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এরূপ সময়ে সংবাদ আসিল যে, রাজা মহাশয় দরবার গৃহে আগমন করিতেছেন। এই সংবাদ পাইবামাত্র সকলেই শশব্যস্তে গাত্রোত্থান করিলেন। রাজা মহাশয়ও দরবার গৃহে প্রবেশ করিয়া আপনার স্থানে উপবেশন করিলেন ও কহিলেন, “আজ আমার শরীরটা তত ভাল নহে। খেলা করিবার মানসে যদি তাঁহারা আগমন করেন, তাহা হইলে কল্য তাঁহাদিগকে আসিতে কহিবেন। অদ্য আমি অধিকক্ষণ দরবার গৃহে উপবেশন করিব না, এখনই অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিব। অতএব অদ্য একান্ত প্রয়োজনীয় কোন কাগজ পত্রে যদি আমার স্বাক্ষর করিবার নিতান্ত প্রয়োজন থাকে, তাহা হইলে তাহা এখনই আনায়ন করুন।”
রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “বিশেষ আবশ্যকীয় কোন কাগজ পত্র নাই, যাহা আছে, তাহা কল্য দেখিলেও অনায়াসেই চলিতে পারে, তবে কেবলমাত্র সেক্রেটারী মহাশয়ের খসড়াখানি একবার আপনার দেখার আবশ্যক।” এই বলিয়া সেই খড়া মুসবিদাখানি রাজা মহাশয়ের হস্তে প্রদান করিয়া কহিলেন, “আমি সবিশেষ মনোযোগের সহিত ইহা দেখিয়াছি। লেখার মধ্যে কোন দোষ আছে বলিয়া আমার বোধ হয় না। কেবল সুদের হার কিছু কম করিয়া লেখা ছিল, তাহা আমি ঠিক করিয়া দিয়াছি।”
মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় আর কোন কথা কহিলেন না। কেবল সেই খড়ার উপর লিখিয়া দিলেন, “উপযুক্ত ষ্ট্যাম্প কাগজে লেখা পড়া ও রেজেষ্টারী হইলে, টাকা প্রদান করা হউক।”
মন্ত্রী। তাহা হইলে ষ্ট্যাম্প কাগজে লেখা পড়া হইলে স্বাধীন রাজা মহাশয় আমাদের ঐ দলিল রেজেষ্টারি করিয়া দিলেই আমরা টাকা প্রদান করিতে পারি।
রাজা। নিশ্চয়ই, কিন্তু রেজেষ্টরি হইবার পূর্ব্বে যেন টাকা দেওয়া না হয়। রেজিষ্টারির সময়ে রেজিষ্টরি আফিসে টাকা প্রদান করিবেন।
মন্ত্রী। তাহাই হইবে। আর একটি কথা, পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত আপনি যে একটি লোক স্থির করিতে বলিয়াছিলেন, অদ্য তাহা স্থির হইয়াছে। যেরূপ উপযুক্ত লোক এই ভার গ্রহণ করিয়াছেন, এইরূপ লোক যে অনায়াসেই পাওয়া যাইবে, তাহা ইতিপূর্ব্বে কখনও ভাবি নাই। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় নিজেই গমন করিয়া পাট ক্রয় করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন।
রাজা। সেক্রেটারী মহাশয় নিজেই গমন করিবেন, ইহা অপেক্ষা সৌভাগ্যের বিষয় আমাদিগের আর কি হইতে পারে? আমি যেরূপ নূতন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে মনস্থ করিয়াছি, ঈশ্বর অনুকম্পায় সেইরূপ উপযুক্ত লোকও প্রাপ্ত হইয়াছি। কোন নূতন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে হইলে সর্ব্বপ্রথম প্রায়ই লোকসান দিতে হয়, কিন্তু যেরূপ উপযুক্ত লোক এই কাৰ্য্য নিজ হস্তে গ্রহণ করিতেছেন, তাহাতে লোকসান হওয়া দূরে থাকুক, দেখিবেন, এ কার্য্যে বিশেষরূপ লাভ হইবে। এখন সেক্রেটারী মহাশয়ের সহিত কথাবার্তা স্থির করিয়া রাজসরকারের নিয়মানুযায়ী টাকা জমা লইয়া ইঁহার গমনের সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিবেন। যখন ইনি গমন করিবেন, সেই সময়ে আপাততঃ এক লক্ষ টাকা ইঁহার হস্তে প্রদান করিবেন। পরিশেষে পাট ক্রয় করিবার স্থান হইতে যখন যে টাকার নিমিত্ত লিখিবেন, তখনই তাহা প্রেরণ করিবেন। যাহাতে কল্যই সেক্রেটারী মহাশয় গমন করিতে পারেন, তাহার বন্দোবস্ত করিবেন। আপনাদিগের তহবিলে যদি তাত টাকা মজুত না থাকে, তাহা হইলে আমি উহা প্রদান করিব। বোধ হয়, আমার বাক্সে এখনও দুই লক্ষ টাকা মজুত আছে।
এই বলিয়া রাজা মহাশয় গাত্রোত্থান করিলেন, এবং অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। রাজা মহাশয় গমন করিবার পর, সেই খড়া মুসবিদার উপর রাজা মহাশয় যে আদেশ লিখিয়া দিয়েছিলেন, তাহা মন্ত্রী মহাশয় সেক্রেটারী বাবুকে দেখাইলেন। রাজা মহাশয়ের স্বহস্ত-লিখিত আদেশ দেখিয়া সেক্রেটারী মহাশয় অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং মনে মনে ভাবিলেন, টাকা পাইবার পক্ষে আর কোনরূপ সন্দেহ নাই। এখন মনিব মহাশয় আসিয়া এইস্থানে উপস্থিত হইতে পারিলেই অল্প দিবসের মধ্যে সমস্ত কাৰ্য্য শেষ হইয়া যায়। এই ভাবিয়া সেক্রেটারী মহাশয় সেই কাগজখানি আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন ও কহিলেন, “উপযুক্ত ষ্ট্যাম্প কাগজে আমি উহা লিখাইয়া আনিব।” সেক্রেটারী মহাশয়ের প্রস্তাবে মন্ত্রী মহাশয়ও সম্মত হইলেন ও পরিশেষে কহিলেন, “আপনি জামিনের টাকা প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়া কল্যই লইয়া আসিবেন। কারণ, কল্যই পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত আপনাকে গমন করিতে হইবে।” মন্ত্রী মহাশয়ের প্রস্তাবে সেক্রেটারী মহাশয় সম্মত হইলেন। পরদিবস আসিয়া পুনরায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, এইরূপ বলিয়া সেই দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। বলা বাহুল্য, ভগবান দাসও তাঁহার সহিত তাঁহার বাসা পর্যন্ত গমন করিল। যাইবার সময় আবার কহিল, “আপনি পাট খরিদ করিতে সম্মত হইয়া বিশেষ বুদ্ধিমানের কার্য্য করিয়াছেন, না হইবে কেন, আপনারা যে কার্য্য করিয়া থাকেন, এরূপ বুদ্ধিমান না হইলে কি ঐ কাৰ্য্য কেহ সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারেন। আপনি দেখিবেন, যে কার্য্যের নিমিত্ত আপনি আগমন করিয়াছেন, সেই কার্য্য সম্পন্ন হইতে হইতেই আপনি অনায়াসেই দশ টাকা সংস্থান করিয়া লইতে পারিবেন। অবশ্য আপনার অর্থের কিছু কম নাই, তাহা আমি জানি, কিন্তু বিনা চেষ্টায় অথচ সততায় যদি কোন অর্থ আপনা হইতে আগমন করে, তাহা ইচ্ছা করিয়া কে পরিত্যাগ করিয়া থাকে। কিন্তু মহাশয় গরিবের একটি নিবেদন যে, তাহাকে যেন ভুলিবেন না।”
সেক্রেটারী। তা কি কখন হয়, ভগবান দাস, তোমাকে আমি কি কখন ভুলিতে পারি? যদি এই কার্য্যে আমার দশ টাকা উপার্জ্জন হয়, তাহা হইলে জানিও, তোমারই পরামর্শে ও উদ্যোগে। অবশ্য তোমার পারিতোষিকের কথা আমাকে কিছু বলিতে হইবে না। তোমাকে আমি সন্তুষ্ট করিতে বিশেষরূপ চেষ্টা করিব।
এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের স্বদেশীয় যে উকীল বাবু খড়া মুসবিদাখানি প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট গমন করিয়া রাজা মহাশয়ের আদেশ-সংযুক্ত সেই কাগজখানি পুনরায় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু তাঁহার হস্তে অর্পণ করিলেন, এবং উপযুক্ত ষ্ট্যাম্প কাগজে উহা উত্তমরূপে লিখিয়া প্রস্তুত করিয়া রাখিতে কহিলেন। উকীল বাবু সেক্রেটারী বাবুর প্রস্তাবে সম্মত হইলেন ও কহিলেন, “আমি সমস্তই ঠিক করিয়া রাখিয়া দিব, আপনি চারি পাঁচ দিবস পরে আসিয়া লইয়া যাইবেন।”
সেক্রেটারী। আপনি সমস্ত ঠিক করিয়া রাখিবেন। চারি পাঁচ দিবস পরে আমি বোধ হয় আসিয়া উহা লইয়া যাইতে পারিব না। আমার পক্ষ হইতে অপর কেহ আপনার নিকট আগমন করিলে আপনি উহা তাহার হস্তে প্রদান করিবেন। আমার বন্ধুবান্ধব ও লোকজন সকলেই আপনার নিকট পরিচিত। আপনার পরিচিত যে কেহ আসিলে আপনি উহার হস্তে উহা অনায়াসেই প্রদান করিতে পারিবেন।
উকীল। আপনি নিজে আসিতে পারিবেন না কেন?
সেক্রেটারী। কোন বিশেষ কার্য্যের নিমিত্ত আমাকে বোধ হয় কল্যই বাহিরে গমন করিতে হইবে।
উকীল। কোথায় যাইবেন।
সেক্রেটারী। আর কোন স্থানে নহে, আমাদিগের দেশেই গমন করিব।
উকীল। এমন হঠাৎ এরূপ কি কার্য্য পড়িয়া গেল যে, কল্যই আপনাকে দেশে গমন করিতে হইবে?
সেক্রেটারী। সমস্তই আপনি জানিতে পারিবেন, আপনাকে সমস্তই পরে বলিব।
উকিল বাবুর সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত হওয়ার পর এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় তাঁহার যে সকল বন্ধুবান্ধবের নিকট পূর্ব্বদিবস টাকার বন্দোবস্ত করিয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের নিকট গমন করিলেন, এবং যাঁহার নিকট হইতে যতদূর সম্ভব, তাঁহার নিকট হইতে সেইরূপ টাকা সংগ্রহ করিয়া রাত্রি প্রায় দশটার সময় আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন। বলা বাহুল্য, ঐ সকল টাকা যাহাদিগের নিকট হইতে সংগ্রহ করিলেন, তাহাদিগের প্রত্যেককেই শতকরা এক টাকা হইতে দুই টাকার হিসাবে সুদ দিতে সম্মত হইলেন। কেবল একটি কি দুইটি বন্ধু বিনা সুদে টাকা প্রদান করিয়াছিলেন। বাসায় আসিয়া আপনার নিকট যাহা কিছু ছিল, তাহাও বাহির করিয়া দেখিলেন যে, সাড়ে চারি হাজার টাকার সংস্থান হইয়াছে। এখনও পাঁচশত টাকার অনাটন আছে; কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়া সেই পাঁচশত টাকা কোন প্রকারে সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারিলেন না।
পরদিবস ঠিক নিয়মিত সময়ে পুনরায় দালাল ভগবান দাস আসিয়া উপস্থিত হইল। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় তাঁহার সংগৃহীত সাড়ে চারি হাজার টাকা সঙ্গে লইয়া তাঁহার সহিত রাজা মহাশয়ের বাসাভিমুখে গমন করিলেন। দরবার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, সে দিবসও মন্ত্রী মহাশয় পূৰ্ব্ব হইতেই আসিয়া বসিয়া আছেন। সেক্রেটারী মহাশয় গৃহের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্র মন্ত্রী মহাশয় সাদর সম্ভাষণ করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন, শেষে কহিলেন, “ কেমন মহাশয়! অদ্যই গমন করিতে পারিবেন কি?”
সেক্রেটারী। অদ্যই গমন করিতে আমার আর কোন প্রকার প্রতিবন্ধক দেখিতেছি না; কেবলমাত্র রাজসরকারে যে টাকা জমা দিতে হইবে, এ পর্যন্ত তাহার সমস্ত সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারি নাই।
মন্ত্রী। কত টাকার সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছেন?
সেক্রেটারী। সাড়ে চারি হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি; বক্ৰী পাঁচ শত টাকা সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারি নাই।
মন্ত্রী। যখন এত টাকা সংগ্রহ হইল, তখন সামান্য পাঁচ শত টাকা সংগ্রহ করিতে পারিলেন না? সামান্য টাকার নিমিত্ত কাৰ্য্য নষ্ট হওয়া কোনরূপ যুক্তিসঙ্গত নহে, নাগাইত সন্ধ্যা বক্রী পাঁচ শত টাকার যোগাড় করিয়া উঠিতে পারিবেন না কি?
সেক্রেটারী। আপাততঃ আর কিছুই সংগ্রহ হইবার উপায় নাই, যদি কোনরূপ সম্ভাবনা থাকিত, তাহা হইলে এই সামান্য বিষয়ের নিমিত্ত আমাকে বলিতে হইত না।
[মাঘ, ১৩১১]