রাজা-মেমসাহেব সংবাদ

রাজা-মেমসাহেব সংবাদ

রাজার থেকে মেমসাহেবের বয়স বেশি। তা প্রায় ছমাস বয়সের ফারাক দুজনের মধ্যে।

মেমসাহেব যখন প্রথম অধীনের বাড়িতে এসেছিল, তখন তার বয়স নিরুপণ করা যায়নি। কারণ সে ছিল একেবারেই অজ্ঞাতকুলশীলা। আগমন, কোনও এক নর্দমার মুখ দিয়ে, অথবা কোন ফাঁকে বাড়ির বাইরে যাবার দরজা খোলা পেয়ে। তার আগমনের পথ বা কৌশল অদ্যপি অজ্ঞাত। অপিচ, তার আগমন সে গোপন রাখতে পারেনি। বাড়িতে বাজার আসার পরে, ঝি যখন বাইরের কলতলায় মাছ। কুটতে যায়, তখনই তার আগমন টের পাওয়া যায়। সে কিছুটা ভয়ে ও সংকোচে নিচু স্বরে ডাকতে ডাকতে, দূর থেকে মাছ কোটা দেখতে থাকে। ঝি চোখ তুলে দেখতে পায়, পাঁচিলের এক পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে, দু আঙুলে জীবটি, তার আগমন ও ক্ষুধা, যুগপৎ জানাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ ঝিয়ের মুখ বিকৃত ও ঝংকার, ইদেখো, এ বিল্লি কাহাঁসে আবেতি।

মাছ কোটা ও অবাঙালি দাসী, অনেকের কাছে ব্যাপারটা বৈসাদৃশ্য মনে হতে পারে। যাঁদের তা মনে হয়, তাঁরা অতীব প্রাচীন যুগের বাঙালি। কেন না, মছলিখোর বাঙালি হয়ে, অধীন তার গৃহেই লক্ষ করেছে, অবাঙালি স্ত্রীলোকটি ইস্তক কইমাছ পর্যন্ত ছাই মাখিয়ে কী রকম কট কট ঘসর ঘসর শব্দে কেটে থাকে, এবং তারপরে চাকুম-চুকুম করে খেয়েও থাকে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলতে পারি, বাঙালির মাছ অনেক অবাঙালির পাতে ছড়িয়ে গিয়েছে। যাই হোক, তার ঝংকার শোনা মাত্রই, বাড়ির গৃহিণী উৎকণ্ঠিত বিতৃষ্ণায় নির্দেশ দিলেন, ঝাঁটা মেরে বিদায় কর।

ঝিয়ের ঝাঁটা হাতে ওঠবার প্রয়োজন হয়নি। দু আঙুলে জীবটির বয়স তখন মাস দুয়েক হলেও, গৃহিণীদের বচন ও ভঙ্গি তার সম্ভবত জানা হয়ে গিয়েছিল। ঝিয়েদের মুখভঙ্গি কথাবার্তার ধরনধারণও ইতিমধ্যেই তার বিলক্ষণ প্রত্যক্ষগত ছিল। অতএব ঝি বঁটি ছেড়ে ওঠা মাত্রই, সে যে কোথায় পালিয়ে গেল, খোঁজ পাওয়া গেল না। তখন খোঁজ পাওয়া গেল না বটে, কিন্তু একটু পরেই বাড়ির নানান কোনা খুঁজি থেকে তার কাতর ডাক শোনা যেতে লাগল। আর তাতেই কাল হল। কারণ গৃহিণীর মা ষষ্ঠীর দানসকল, সেই ডাকে আকৃষ্ট হয়ে, সারা বাড়ি খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। করতে করতে, বাড়ির পিছনে, স্যানিটারি ট্যাঙ্ক-এর উপরে, যেখানে অনেক বাজে মালপত্র গাদাগাদি করে রাখা ছিল, তারই কোনও এক ফাঁক থেকে ছেলেমেয়েরা তাকে বের করে নিয়ে এল। গৃহিণী তাঁর সন্তানদের নির্দেশ দিলেন, এখুনি ওটাকে বাড়ির বাইরে বিদেয় করে দাও।

কিন্তু তাঁর সন্তানেরা, দর্শনমাত্রেই সেই দু-আঙুলে জীবটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। তার মিউ মিউ ধ্বনিতে তাদের হৃদয় কাতর হয়ে উঠল। তার সাদা গায়ে, দু-একটি কালো ছাপ, ছেলেমেয়েদের মুগ্ধ করল। বলতে কী, অধীনের মনটাও একটু বিচলিত হল। কিন্তু গৃহিণীর নির্দেশ অমান্য করার সাহস কারুরই নেই। অতএব বাড়ির বাইরে যাবার দরজা দিয়ে তাকে বের করে দেওয়া হল। তবে কিছু কিছু কথা পূর্বপুরুষেরাই তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়ে গিয়েছেন। যেমন, ছাঁচো কোটো মারো লাতি, লজ্জা নাইকো বেড়াল জাতির। সেই দু-আঙুলে জীবটি কিছুতেই বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গেল না। অনেক শাসন-পীড়ন সত্ত্বেও, দেখা গেল, ক্রমেই তার চেহারায় একটু চেকনাইয়ের ঝলক। এবং একেবারে বিছানায় তার অধিষ্ঠান। বাড়ির ছোটমেয়ে তার কপালে সিঁদুরের টিপ পরাতেও ভুলল না। অর্থাৎ কিছুদিনের মধ্যেই তার বরণ হয়ে গেল, গৃহিণীর প্রতিবাদ সত্ত্বেও তার চেহারা চালচলন ইত্যাদি দেখে, অধীন তার নামকরণ করলে, মেমসাহেব।

মেমসাহেব মোটামুটি তার নিজের রাজ্যে বেশ বহাল তবিয়তেই কাটাচ্ছিল। মাখা ভাত, সকলের ভাগের দুধ, মাছ এবং কাঁটাটাটা মিলিয়ে আহার-বিহার মন্দ বলা যায় না। গায়ে-গতরে বৃদ্ধি এবং রূপে ক্রমাগতই যৌবন সমাগমের লক্ষণ দেখা দিতে লাগল। যে কারণে, আশপাশের মাস্তানেরা ক্রমেই হানা দিতে শুরু করল। প্রায়ই মেমসাহেবের চিৎকার-চেঁচামেচিতে, বাড়ির সকলেই ছুটোছুটি আরম্ভ করলে।

এ সময়েই রাজার আবির্ভাব। রাজা তখন মাত্র একুশ দিনের। অধীন নিজেই তাকে সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে। রাজা অজ্ঞাতকুলশীল নয়। তার বাবা-মা, উভয়েই জর্মন দেশের। রাজা তার চেহারাতে সেই ঐতিহ্য বহন করছে। কিন্তু মেমসাহেবের কাছে সে আপদ সদৃশ। বিষনজরে সে রাজাকে দেখতে লাগল। দেখলেই, মুখব্যাদান করে ফ্যাঁস ফাঁস শব্দ করতে লাগল। রাজার অবিশ্যি সে সব খেয়ালই নেই। সে মেমসাহেবকে নিজের খেলুড়ি ভেবে কাছে যায়। মেমসাহেব তৎক্ষণাৎ নখ বিস্তার করে মারমুখী হয়ে ওঠে।

ব্যাপারটা বিপজ্জনক। রাজা তখনও শিশু। সে মেমসাহেবের ব্যাপারটা বোঝে না। অথচ মেমসাহেব তাকে যে-কোনও মুহূর্তেই, থাবার এক ঘায়ে কানা করে দিতে পারে। নাকের ডগা ছিঁড়ে ফেলতে পারে। তখন বাড়ির সকলেরই কাজ হল, রাজাকে মেমসাহেবের হাত থেকে রক্ষা করা। রাজাকে রক্ষা করার ব্যাপারটা মেমসাহেবের মোটেই মনঃপূত নয়। সে একটা স্বাধীন ফয়সালার পক্ষপাতী। অথচ সবাই রাজাকে কোলে তুলে নেয়, আদর করে। মেমসাহেবের দুচোখ ক্ষোভে ও দুঃখে, রাগে ও বিতৃষ্ণায় জ্বলে যায়।

তবু দুজনকে কাছাকাছি হওয়া রোধ করা যায় না। তবে, মেমসাহেব একটা জিনিস লক্ষ করে একটু চিন্তিত ও ভাবিত হয়ে পড়ল। সে দেখল, রাজা কয়েক মাসের মধ্যেই, তার থেকে চারগুণ বড় ও বলশালী হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, রাজার মধ্যে ক্রমেই নিজের জাতের কিছু কিছু লক্ষণ দেখতে পেল। সে দেখল, রাজা ইট চিবিয়ে, কাঠ চিবিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। পাথরের মতো শক্ত বল ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাড়িতে একটা কাকপক্ষী তো দূরের কথা, একটা মানুষ ঢুকতে এলে পর্যন্ত যখন গম্ভীর গলায় প্রতিবাদ জানায়, মনে হয়, গোটা বাড়িটা কাঁপছে। আরও সে লক্ষ করল, এদেশে রাজাজাতীয় যাদের সে দেখেছে, রাজার চালচলন মোটেই তাদের মতো নয়। একটা বিশেষ রাজকীয়তা তার মধ্যে আছে। যে বনের স্বাধীন বোনপোদের কথা মনে করিয়ে দেয়। অর্থাৎ সে যাদের মাসি, তাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। বক্তার ধারণা, মেমসাহেব তার বোনপোদের কথা সম্যক জানে।

মেমসাহেব আরও লক্ষ করল, তাকে যে সব মাস্তানেরা বাড়িয়ে পাঁচিল টপকে বিরক্ত করতে আসে, বা সরাসরি প্রেম নিবেদন করতে আসে, রাজা তাদের যমতুল্য। কেউ আর বাড়ির ত্রিসীমানায় আসে না। এলেই রাজা তাকে এমন তেড়ে যায়, মেমসাহেব নির্ভয় আনন্দে বিশেষ প্রতিবোধ করে।

তবু মেমসাহেবের পক্ষে রাজাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে ওঠা সম্ভব হয় না। কারণ রাজা তার সঙ্গে যেভাবে খেলা করতে চায়, তা মেমসাহেবের পক্ষে সামলে ওঠা সম্ভব হয় না। তার ক্ষীণ দেহের তুলনায়, রাজা পর্বত প্রমাণ। সে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে খেলতে যায়, মেমসাহেব বলের মতো ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে। ভাবে রাজা তাকে মারতে আসছে। তৎক্ষণাৎ সে আক্রমণের জন্যে নখদন্ত বিস্তার করে। তাতে রাজা মর্মাহত বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। ভাবে, গেলুম খেলতে, আর ও কিনা মারতে আসে! সে ঘেউ করে ওঠে এবং একটা গোটা মেমসাহেবকে গিলে ফেলা যায়, তত বড় হাঁ করে। মেমসাহেব ভয় পেয়ে একটা কোণ নেয়। আর নেওয়াটা একদিক থেকে মারাত্মক। আত্মরক্ষার শেষ আশ্রয় বেছে নেওয়া বলা চলে।

রাজার মধ্যে ক্ষোভ থাকে, কিন্তু সে হিংস্র হয়ে ওঠে না। যদিও সে কথা মেমসাহেব মোটেই বোঝে না। সে মরিয়া হয়ে ওঠে। তার কারণ আর কিছুই নয়। মেমসাহেব ক্ষীণাঙ্গী আর দুর্বল বলেই তার ভয় বেশি। ভয় থেকেই ঘৃণা এবং হিংস্রতা দেখা দেয়। রাজা আবার ততখানি বোঝে না। জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা মেমসাহেবের থেকে কম। আর সেটা সবদিক থেকেই। ফলে, মেমসাহেবের আক্রমণের পদ্ধতি বা হিংস্রতার মাত্রা মেপে উঠতে পারে না। অনেকটা বন্ধুত্বের দাবি নিয়েই সে আরও ধমকে উঠে এগিয়ে যায়। মেমসাহেবের লক্ষ্য একমাত্র রাজার চোখ এবং নরম নাকের ডগা। কায়দা করতে পারলেই যে কোনও একটাকে সে জখম করতে পারে।

তখন বাড়ির ছেলেমেয়েরাই ছুটে আসে দু জনকে দু দিকে সরিয়ে দেয়। মেমসাহেব আর কোনও কথা নয়। পেয়ারা গাছ বেয়ে একেবারে পাঁচিলে, এবং সেখান থেকে রাজার দিকে বিরক্ত বিস্মিত চোখে দেখতে থাকে।

রাজার শরীর যদিও তখনই পাঁচ ফুট, তবু এই একটা ব্যাপারে মেমসাহেবের কাছে তার চরম পরাজয়। থাবা দিয়ে সে গাছের গায়ে বিদ্ধ করতে পারে না, অতএব উঠতে পারে না। অগত্যা সে দশ ফুট পাঁচিলের গায়ে পা বাড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে, সম্ভবত যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, এই বাঁদরি, নেমে আয় বলছি।

মেমসাহেব ভ্রূক্ষেপও করে না। সে কেবল দেখে নেয়, উচ্চতার মাপ কতখানি। এ বিষয়েও সে নিঃসন্দেহ, প্রকাণ্ড দস্যুটা কিছুতেই পাঁচিলে উঠতে পারবে না। তাই নিশ্চিন্তে জিভ দিয়ে চেটে গা চুলকোতে থাকে। যে ব্যাপারটা রাজাকে আরও খেপিয়ে তোলে।

অবিশ্যি এই ধরনের ঘটনা দুজনের ভুল-বোঝাবুঝি থেকেই ঘটে। প্রথমে দুর্বল মেমসাহেবের ধারণা, গুণ্ডাটা তাকে মারতে আসছে। রাজা ভাবে, খেলার মধ্যেও পুঁটকে রাক্ষুসীটা খামচাতে চায়।

সুবিধা একটাই, এই ভুল-বোঝাবুঝি দীর্ঘসময় স্থায়ী হয় না। কারণ, পরে যখন দুজনের দেখা হয়, তখন বোধহয় আর সে কথা তাদের মনে থাকে না। দেখা যায়, মেমসাহেব রাজার গায়ে গা ঘষতে ঘষতে একেবারে তার পেটের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আর রাজা সরে সরে গিয়ে, মেমসাহেবের গা চাটছে। সরে না গিয়ে রাজার উপায় নেই, পেটের তলায় তার জিভ যায় না। শুধু তাই নয়, দুজনে এমন ভাবে মুখে মুখ ঠেকিয়ে পরস্পরকে শোঁকে, বোঝা যায় না, ওটাই ওদের চুম্বনের পদ্ধতি কিনা। তবে একটা কথা স্মরণ রাখতেই হবে, এ প্রেম সম্পূর্ণই কামগন্ধহীন। তাদের জাত গোত্র আলাদা। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কোনও সম্ভাবনাই নেই। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাষা, রাজার পক্ষে মেমসাহেবকে নিয়ে সেরকম চিন্তা করাই দুরূহ। তথাচ, যখন তাদের পরস্পরকে চুম্বন লেহন ইত্যাদি দ্বারা আদর সোহাগ করতে দেখা যায়, তখন মানতেই হবে, দুজনে গভীর প্রেমে আবদ্ধ। কিন্তু কামগন্ধহীন।

রাজার অবিশ্যি একটু শোঁকবার বাতিক আছে। বাতিক না বলে, বৈশিষ্ট্য বলাই ভাল। মেমসাহেব যখন বাইরের থেকে এসে রাজার গায়ে গা অবিশ্যি নাগাল পায় না, পায়ে গা ঘষে, এবং আদরে গরগর শব্দ করে পেটের তলায় চলে যায়, তখন রাজা তাকে অনেকবারই এঁকে নেয়। শুঁকেই বারে বারে নাকঝাড়া দিয়ে নেয়। মনে হয়, মেমসাহেব কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কাদের সঙ্গে মিশেছিল, গন্ধের দ্বারা রাজা সবই খবর পায়। এবং এই খবর থেকেই সম্ভবত বাড়ির কোনও অংশে কোনও হুলো মাস্তান এলেই, রাজা মুহূর্তে গন্ধের দ্বারা তা জানতে পারে। তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে, ক্রুদ্ধস্বরে ডাকতে থাকে।

দীর্ঘসময় অদর্শনের পরে, যখন দুজনের দেখা হয়, তখন যে আদরের ঘটা লাগে, তা দেখবার মতো। দুপুরের খাওয়ার পরে, প্রায়ই দেখা যায়, রাজা ঠ্যাং ছড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। আর তার বুক ঘেঁষে, মেমসাহেবও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। গোলমালের সম্ভাবনাও তখনই। ঘুম ভেঙে রাজা যখন দেখল, মেমসাহেব তার কোলের কাছে, তখন তার হয়তো একটু খেলবার ইচ্ছা হল। সে পা দিয়ে মেমসাহেবকে খোঁচা দিতে লাগল। তারপরেই একটু সরে গিয়ে, ঝাঁপ দেবার জন্যে ওত পাতল। দর্শন মাত্রেই মেমসাহেব সন্দেহে এবং ভয়ে, তৎক্ষণাৎ ভয়ংকরী হয়ে উঠল। খুদে ধারালো দাঁত বের করে, রয়েল বেঙ্গল টাইগ্রেসের মতো ফাঁস করে উঠল। আবার সেই ভুল-বোঝাবুঝির ঝগড়া, এবং মেমসাহেবের পলায়ন।

তবে গৃহস্থদের সঙ্গে অধীনও নিশ্চিন্ত ছিল, তাদের গৃহে দুই বিরুদ্ধ জীবের মধ্যে একটা মোটামুটি প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু সেটা কতখানি, তার মাত্রা বিষয়ে কারুরই কোনও ধারণা ছিল না।

অনেক সময়েই লক্ষ করা গিয়েছে, মেমসাহেব হয়তো কাছের কোনও বাড়ির টালির চালে বা কোনও সানসেট-এ শুয়ে আছে বা বসে আছে। রাজার চোখে পড়লে, তৎক্ষণাৎ সে ঘেউ ঘেউ আরম্ভ করে। সে ঘেউ ঘেউ-এর সুর কিন্তু মোটেই অপরিচিতকে দেখে ডেকে ওঠার মতো নয়। একটু অন্যরকম, যেন বলা হয়, এই হতভাগী, ওখানে কী করছিস। শিগগির বাড়ি আয়।

জানা নেই, রাজার ভাষা মেমসাহেবের বোধগম্য কিনা। সে মিউ মিউ করে ঠিক বাড়ি চলে আসে, এবং রাজা তখন তাকে একবার শুঁকে নেয়। সব বিষয়েই রাজার একটা খবরদারি ভাব আছে।

যাই হোক, অধীনের গৃহে প্রায়ই একটা বিষয় বড়রা আলোচনা করতেন, মেমসাহেব সত্যি মেয়ে কি না। কারণ তার মা হবার বয়স হয়ে গিয়েছিল। এর থেকে অনুমিত হয়, স্বাভাবিক বিষয়কে সকলে চায়। কিন্তু মেমসাহেব বাড়ির ছোটমেয়ের হাতে টিপ ছাপ ইত্যাদি নানান সাজে সেজে বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছিল। মাঝে মধ্যে কানে মুখে দু-একটি রক্তাক্ত চিহ্ন দেখে বোঝা যেত, বাইরে খুব ঝড় গিয়েছে। মাস্তানদের আদর কিংবা মারামারির চিহ্ন সে সব, বোঝা যেত না। মেমসাহেবদের সোয়ামিদের ভালবাসার আচার-আচরণ অনেক সময়েই একটু মারাত্মক ধরনের হয়। তাদের প্রেমের উচ্চগ্রামের সম্বোধনাদি শুনেই, অনেকে তা ধারণা করতে পারেন।

অবশেষে, মেমসাহেবের প্রায় দেড় বছর বা দু বছর বয়সকালে, তার মধ্যে কয়েকটি লক্ষণ দেখা গেল। তার পেট বড় হল, শরীর কিছু স্ফীতকায়, তৎসহ ঈষৎ ক্লান্তি। কেতাবি কথায়, এবার ঘোষণা করা গেল, মেমসাহেব এক্সপেকটিং। সে গর্ভবতী।

এই সময় থেকেই, রাজার আচরণের পরিবর্তনও লক্ষ করা গেল। সে কী বুঝল, জানা নেই। তবে মেমসাহেবের সঙ্গে ঝাঁপাইজোড়া খেলা বন্ধ করে দিল। বরং অধিকাংশ সময়েই গা চেটে দিত। মেমসাহেব ঘুমিয়ে থাকলে, জাগিয়ে দিত না। নাক দিয়ে ঢুসো মারা বা থাবা দিয়ে খোঁচানো, একেবারেই না। গোটা গা-টা শুঁকে নিত কেবল।

মেমসাহেব এমনিতেই একটু ক্ষীণাঙ্গী। গর্ভধারণে আরও কাহিল হয়ে পড়ায়, সে বেরোনো বন্ধই করে দিল। তারপরে একদিন সকালে দেখা গেল, সিঁড়ির তলায় সে একটি বাচ্চা প্রসব করেছে। এবং রাজা সিঁড়ির তলা আগলে বসে আছে।

বাড়ির ছেলেমেয়েরা সকলেই খুব খুশি, মেমসাহেবের ছেলে হয়েছে। গৃহিণী আশা করলেন, একাধিক বাচ্চা হবে, কারণ সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা গেল, মেমসাহেব একটি প্রসব করেই ক্ষান্ত দিলে। এতে গৃহস্থেরা সকলেই মেমসাহেবের বিবেচনায় তুষ্ট হল। বাড়ির ছোটমেয়ে মানু জানালে, সে এতেই খুশি।

বাচ্চাটির তখনও চোখ ফোটেনি। মানু যখন তার মায়ের নির্দেশে কিছু ছেঁড়া কাপড়চোপড় সিঁড়ির তলায় দিতে গেল, তখনই হঠাৎ দেখা গেল, রাজার গলায় গরগর গর্জন। তার চাপা গর্জন শুনে মানু একটু অবাক হল, ভয়ও পেল। অথচ রাজা তাকে অত্যন্ত ভালবাসে। তার এরকম পরিবর্তনে সে ছেঁড়া কাপড় মেমসাহেবকে ছুঁড়ে দিয়ে সরে এল। এবং যে-ই সিঁড়ির তলায় কাছে যায়, রাজা তাকেই চাপা গর্জন শুনিয়ে দেয়।

ব্যাপারটা বুঝতে অবিশ্যি বিলম্ব হল না। রাজার বান্ধবী সদ্যপ্রসূতা, বাচ্চাটি নিয়ে সে কষ্টে আছে। সে চায় না, কেউ সেখানে যাক, বিরক্ত করুক বা বাচ্চাটি নিয়ে চলে যাক। রাজার চোখে বেশ একটু সন্দেহের ভাব, যে কারণে গর্জন এবং অনড় নিশ্চল। সে প্রায় প্রহরীর মতোই কখনও বসে রইল, কখনও কাছে পায়চারি করতে লাগল। কখনও নাক বাড়িয়ে শুকল। আর মেমসাহেব বেরিয়ে এলেই, তাকে চেটে দিতে লাগল। মেমসাহেবও সেই আদর অনেকক্ষণ ভোগ করল।

কয়েকদিন এ ভাবেই চলল। কিন্তু হঠাৎ কী হল বলা যায় না, বাচ্চাটির চোখ ফোঁটার আগেই, সে হঠাৎ মারা গেল। মেমসাহেব বারে বারে ডেকে তার মৃত বাচ্চাটিকেই চাটতে লাগল, কিন্তু তাতে জীবন ফেরানো গেল না। তার উপস্থিতিতে মৃত বাচ্চাটিকে সরাবার উপায় ছিল না। তাই যখন সে একবার একটু অন্যদিকে গেল, তখন সেটি সরিয়ে নিয়ে আসা হল। কিন্তু এ ঘটনা রাজার চোখে পড়তেই সে ছুটে এল। বারে বারে মৃত বাচ্চাটিকে খুঁকে দেখে, তার কী মনে হল। সে চুপ করে সেটির দিকে তাকিয়ে রইল। বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে কোনও বাধা দিল না।

মেমসাহেব ফিরে বাচ্চা না দেখতে পেয়ে খানিকটা খুঁজল। কিন্তু তার ক্ষীণ ক্লান্ত শরীরে ক্ষমতা একেবারেই ছিল না। সে তার আঁতুড়েই শুয়ে রইল। রাজা তার মুখোমুখি শুয়ে বসে কাটাতে লাগল। বেশ বোঝা গেল, রাজা অত্যন্ত বিপন্ন। মেমসাহেবের জন্যে তার সুখ আনন্দ, কিছু নেই। কেবল মেমসাহেব বেরিয়ে এলেই তাকে চেটে চেটে আদর-যত্ন করে।

কয়েকদিন এভাবে কাটবার পর, দেখা গেল, মেমসাহেব অনড় নিশ্চল। দেখা গেল, সে-ও মারা গিয়েছে। সন্তানের শোকে কিংবা স্বাস্থ্যহানিতে, তা ঠিক বোঝা গেল না।

রাজার এমন করুণ অবস্থা আর দেখা যায়নি। সে তার পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি শরীরটাকে লম্বা করে ছড়িয়ে, সামনের পায়ের উপর মুখ রেখে, মেমসাহেবের শরীরটার দিকে তাকিয়েছিল। হয়তো তার চোখে জল পড়ে না, কিন্তু সে চোখের অবস্থা কান্নার থেকেও মর্মন্তুদ। তার গলায় একটা করে শব্দ হয়, আর তার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস। সে কী বুঝেছিল, কে জানে।

মেমসাহেবকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন একবার সে এঁকেছিল। মৃত মেমসাহেবের ঠোঁটের সঙ্গে মুখ ঘষে, আবার সে সিঁড়ির তলার কাছে, তেমনি লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। কারুর ডাকে সে সাড়া দিল না। কেবল মেমসাহেব যেখানে শুয়েছিল, সেখানে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

.

এ কথা ঠিক, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। কিন্তু অনেক নখদন্তই গোপন থাকে, তবু যখন তারা বলে, মানুষ হয়ে কেন কুকুর-বেড়ালের মতো ঝগড়া কর তখন তাদের সঙ্গে এই অধীন সর্বদা একমত হতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *