রাজা চাঁদ রায় ও কেদার রায়
‘ভিনত্তি নিত্যং কবিরাজ কুম্ভং
বিভর্ত্তি বেগং পবনাতিরেকং
করোতি বাসং গিরিরাজ শৃঙ্গে
তথাপি সিংহঃ পশুরেব নান্যঃ॥’
নিয়ত হস্তীর মুণ্ড করে বিদারণ।
বায়ু অপেক্ষা বেশি বেগ করয়ে ধারণ॥
পর্বতের উচ্চ শৃঙ্গে করে অবস্থান।
তথাপি সে সিংহ পশু ভিন্ন নহে আন॥
ভেবে দেখ এ শৃঙ্খল কার পায় সাজে।
তরবারি লইলাম লাগাইব কাজে॥
যার ছিন্ন মস্তক ভূপতিত হয়েও গদগদ ভাষায় বলেছিল ‘ছিন্নমস্তে নমস্তে’, সেই বাঙ্গালীর পরম ভক্ত, শক্তিসাধক মহাবীর, বার ভূঁইয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া কেদার রায়ের পুণ্য নাম স্মরণ ও অক্ষয় কীর্ত্তিরাশি কীর্ত্তন করবার প্রারম্ভে তাঁকে একান্ত ভক্তি সহকারে প্রণাম করছি। ধন্য বঙ্গদেশ যে এমন সন্তান, এমন ভৌমিক তার কোলে খেলে বেড়িয়েছিলেন। তাঁর মতো বীরই সগর্বে বলতে পারে আমেরের (অম্বর) রাজা মানসিংহকে, ‘সিংহ পশুর রাজা হলেও পশু ছাড়া আর কিছুই নয়; ভাঙ্গুক, সে বড় বড় হাতির মাথা, হোক তার পবনের চেয়েও বেশি গতি, বাস করুক না সে বড় বড় পাহাড়ের সকলের উপরকার চূড়ায়।’
রাজা মানসিংহের অহঙ্কার পূর্ণ, আত্মশ্লাঘা পূর্ণ:
‘ত্রিপুর মগ বাঙ্গালী, কাক কুলি চাকালি
সকল পুরুষমেতৎ ভাগি যাও পালায়ী
হয়-গজ-নর-নৌকা কম্পিতা বঙ্গভূমি,
বিষম সমর সিংহহা মানসিংহশ্চায়াতি।’
উক্তির উত্তর ‘তথাপি পশু ভিন্ন সে আর কিছুই নয়’ এক মহাবীর, কায়স্থ-কুল-ভূষণ কেদার রায়েরই দেওয়া সম্ভবপর। কে আর এমন মুখে উত্তর দিতে পারে বল?
মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বের প্রায় দেড়শ বছর আগে কর্ণাট হতে নিমু বলে একজন উন্নতিপ্রয়াসী ঘূতকৌশিক গোত্রীয়, দেব উপাধিধারী কায়স্থ বাংলা দেশে আগমন করেন। তখন সেনবংশীয় রাজারা বাংলার রাজা। অনেক পরিশ্রম ও বহু আশা করে তিনি এসেছিলেন বাংলা দেশে চাকরি করবেন বলে। চাকরি তাঁর জুটে গেল। নিমু দেব মশাই সেনরাজাদের দপ্তরে মুহুরিগিরি চাকরি পেলেন।
কিন্তু মুহুরিগিরি করে জীবন কাটাবার লোক তো তিনি ছিলেন না। আশার- উচ্চাকাঙ্ক্ষার তাঁর ছিল না অবধি। সাধু যাঁর ইচ্ছা ঈশ্বর তাঁর সহায়। ভগবান নিজেও ইচ্ছাময়। কারও আকুল আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রাখেন না তিনি।
সুযোগ এসে ধরা দিল নিমু দেব মশাইয়ের সামনে অপূর্ব রূপ নিয়ে। একটা রাষ্ট্রে বিপ্লব উপস্থিত হলো। হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজ্যচ্যুত হলেন। পাঠানেরা এলেন জোয়ারের জলের মতো। সারা বাংলা প্লাবিত করে ফেললেন। বুদ্ধিমান, একান্ত উন্নতিলিপ্সু নিমু দেব মশাই দেখলেন এই তো তাঁর পূর্ণ সুযোগ, আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ করবার মাহেন্দ্রক্ষণ সমুপস্থিত হয়েছে। তিনি মুহূর্ত বিলম্ব না করে পাঠানের পক্ষ নিলেন। পাঠানেরা তাঁর কৃতিত্বে খুশী হয়ে তাঁকে বকসিস দিলেন বিক্রমপুর পরগণা। ভিখারী নিমু, কেরানী নিমু- হলেন রাজা। বিক্রমপুরের ফুলবাড়ীয়ায় বাস করতে লাগলেন। রাজা হয়ে হলো তার উপাধি ‘রায়’। নির্বিঘ্নে দীর্ঘদিন চলল রাজত্ব।
এক দুই করতে করতে এল পঞ্চদশ শতাব্দী শেষ হয়ে। তখন পাঠানদের রাজ্যের অবসান হয়েছে, পাঠানেরা তাদের তল্পীতল্পা গুটিয়ে ঢুকে পড়ছেন। হিন্দুদের মধ্যে; বাদশা হয়েছেন মোগলেরা। মোগলদের মাথায় লম্বা লম্বা তাজ, হাতে বাঁকানো তরোয়াল, ঘোড়ায় চড়ে তারা করছেন দেশকে শাসন। পাঠানদের ধরে মারে, হিন্দুদের মেরে বন্দী করে রাখে তাদের কোতোয়ালিতে।
এমন সময় এই নিমু রায়ের দুজন বংশধর একজনের নাম চাঁদ অন্য জনের নাম কেদার, রামায়ণের রাম লক্ষ্মণের মতো বীরত্বে, রূপে, নানা গুণে দেশ উজ্জ্বল করে পদ্মফুল দুটির মতো ফুটে উঠলেন। মোগলদের অত্যাচার, উপদ্রব্যের কথা শুনে বললেন, ‘আচ্ছা, রসো, এতো অহঙ্কার! বটে!’
এ হচ্ছে তিন, চার শ’বছর আগেকার কথা, তখনকার বাঙ্গালী এখনকার মতো ছিল না। বাঙ্গালী শিল্পীরা দেখতে দেখতে গড়ে উঠাতেন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গড়, লোহা গালিয়ে গড়তেন মস্ত মস্ত কামান, তাঁদের গোলন্দাজদের গোলার আগুন উড়ে বিপক্ষেরা বলত, হ্যাঁ এঁরা বীর বটে।
আগেই বলেছি, রাজা চাঁদ রায় আর রাজা কেদার রায় দুভাই। দুটো দেহ কিন্তু আত্মা যেন অভেদ- আত্মা যেন এক, ভাই বলতে অজ্ঞান দুজনেরই একবুদ্ধি, এক কাজ। যেন হরি আর হর— রাম আর লক্ষ্মণ।
তাঁরা বাছা বাছা লোক আনালেন, লস্কর আনালেন, সিপাই এল, শান্ত্রী এল, রাস্তায় ঘাটে গজ গজ করতে লাগল। মস্তবড় ছিল মাঠ, কোদাল দিয়ে কেটে হলো খাল। প্রকাণ্ড দুর্গ গড়ে উঠল সে খালের পাড়ে। পৎ পৎ করে উড়তে লাগল নিশান, নানা দেশ থেকে এল নানা মিস্ত্রি, রাজাদের হুকুমে স্তূপাকার সব লোহা গালিয়ে গড়ল হাজার হাজার কামান, বন্দুক, তরোয়াল, বর্শা, আর যত সব যুদ্ধের আয়োজন উপকরণ, অস্ত্রশস্ত্র।
রাজ্য রক্ষার জন্য যেমন দুর্গ ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হলো তেমনই প্রজার মঙ্গলের জন্য রাজারা দুভাই প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। অনেক বড় বড় পুকুর কাটালেন, ভালো ভালো পথ তৈরি করালেন, পথের পাশে পাশে দিলেন উত্তম উত্তম গাছ লাগিয়ে, বিচার-আচার এমনই সুন্দর আর নিরপেক্ষভাবে করতে লাগলেন যে সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগল। চোর, ডাকাত আর উপদ্রব করে না, রাতে দোর খুলে শুয়ে থাকলেও কেউ ঘরে ঢুকে চুরি করতে সাহস পায় না- পাকা পাহারার বন্দোবস্ত, কড়া আইন। রাজধানী হলো ‘শ্রীপুরে’। শ্রীপুর হচ্ছে, বিক্রমপুরে বর্তমান তারপাশা ষ্টেশনের কাছে পদ্মা নদীর তীরে।
রাজারা সব বন্দোবস্তই ভালো করে উঠালেন, কিন্তু, মস্তবড় দুটো ফ্যাসাদ ছিল, সে ফ্যাসাদ দুটো কেউই দূর করতে পারেননি। দেশের লোক ছিল শায়েস্তা, দেশের লোকের চরিত্রও ভালো ছিল সত্য কিন্তু বিদেশ পর্তুগাল থেকে একদল লোক এসে ভারী জ্বালাতন করতে শুরু করেছিল, আর আরাকানের একদল লোক, নাম তাদের মগ, তারা এসে বেজায় গোল বাধিয়ে দিয়েছিল; এই মগদের রাজা ছিল আরাকানের রাজা মেংরাজগী সেলিম সা। পর্তুগাল থেকে পর্তুগিজেরা এসে বাংলায় বাণিজ্য করত, তারা গোয়া, কোচিন, মলাক্কা, সিংহল প্রভৃতি স্থানে বাস করত, আর ব্যবসায় বাণিজ্য করে দেশে চলে যেত, অবশ্য সবাই যে খারাপ লোক ছিল তা নয় কিন্তু তাদের মধ্যে কতকগুলো লোক এত বেশি খারাপ ছিল যে, তারা তাদের নিজেদের সমাজে পর্যন্ত স্থান পেত না। তারা আরাকানের লোকদের সঙ্গে ভাব করে, আরকানেই করলে প্রধান আড্ডা, এদিকে আরাকানের রাজারও ছিল মহা মুস্কিল, মোগলেরা তাঁকে করত ভারী জ্বালাতন, কি করেন তিনি? অগত্যা জলদস্যু পর্তুগিজদেরই নিজ রাজ্যে স্থান দিয়ে খানিকটা প্রতিকার হবে ভেবে নিশ্চিন্ত রইলেন। তারা শুধু সেখানে বন্ধ না থেকে সমুদ্রের তীরে, চাটগাঁয়ের বন্দরের আশ্রয় নিলে। এদের মতো নিষ্ঠুর, দয়ামায়াহীন ডাকাতের কথা বড় শোনা যায় না। নৌকোয় চড়ে, জাহাজে চড়ে, নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে, রাত-দিন চুরি-ডাকাতি করত, গ্রামে গ্রামে আগুন লাগিয় দিয়ে, পুড়িয়ে যে সর্বনাশ করে, অসহায় গ্রামবাসীদের সব কিছু লুটপাট করে যাচ্ছেতাই করত। বঙ্গোপসাগরে, মেঘনায়, গঙ্গায় যারা নৌকো নিয়ে যাতায়াত করত, ব্যবসা-বাণিজ্য করত, তারা বিপদের আশঙ্কায় সর্বদা অস্থির হয়ে উঠেছিল। স্বয়ং মোগল সম্রাটও কিছু করতে পারেননি। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য, ভূষণার রাজা মুকুন্দরাম রায়, খিজিরপুরের নবাব ঈশা খাঁও এদের দমন করতে পারেননি, কৌশলে দমন করেছিলেন এই চাঁদ রায় আর কেদার রায় পর্তুগিজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তাদের বার বার পরাস্ত করেও যখন তাদের দমন করা সম্ভব হলো না, তখন তাঁরা বুদ্ধি খাটিয়ে পর্তুগিজদের সঙ্গে করলেন সদ্ভাব। তারা তাদের বশ হলো। কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তোলে তেমনি করে তাঁরা পর্তুগিজদের দিয়ে মগদের করলেন দমন, পর্তুগিজেরাও ক্রমে শায়েস্তা হয়ে এল। ততটা বাড়াবাড়ি আর রইল না, শেষে এমন হলো যে তারা চুরি-ডাকাতি ছেড়ে রাজাদের সম্পূর্ণ বশ হয়ে পড়ল। এতে তাঁদের রাজ্যে বেশ একটা শান্তির ছায়া দেখা দিল।
তার পর কি হলো শোনো। একদিন রাজা কেদার রায় তার দাদা চাঁদ রায়কে বললেন- “দাদা! সব তো হলো- কিন্তু আমরা কি এমনই অধীন হয়ে চিরটা কাল দুঃখ ভোগই করব? শুয়ে, খেয়ে, বসে পাচ্ছি না এতটুকুনও শান্তি, যারা পরের অধীন, তাদের আবার সুখ কোথায়? আপনি তো জানেন:
‘সর্ব আত্মবশং সুখম্,
সর্বং পরবশং দুঃখম্’
চাঁদ রায়, ভাইয়ের কথা শুনে, বললেন, তাহলে তোমার যা ভালো লাগে কর।
দুভাইয়ের মন্ত্রণা হলো। বাইরে এসে তারা হুকুম দিলেন, সব রাজাকে নিমন্ত্রণ করে আনতে! রাজাদের আদেশে ছুটে চলল দূতেরা, কেউ চলল ঘোড়ায়, কেউ চলল ছিপে চেপে, কেউ ছুটল হেঁটে।
রাজধানী শ্রীপুরের চার দিকে ছিল মাঠ, শস্যের ক্ষেত, সেই বিরাট, বিপুল, মাঠে, শস্যের ক্ষেত্রগুলো সমান করে, খাটানো হলো তাঁবু, তাঁবুর উপরে পৎ পৎ করে উড়তে লাগল সব নানা রঙ্গের নিশান। প্রকাণ্ড সভামণ্ডপ গড়ে উঠল।
বড় বড় সোনারূপোর কাজ করা সিংহাসন পাতা হলো। বাংলার সব রাজারা এসে সভা আলো করে বসলেন।
কথা উঠল, সকলে একবাক্যে নিজেদের ত্রুটি- সংঘবদ্ধ না হওয়ার কথা স্বীকার করলেন। সকলেই বললেন, ‘আসুন আমরা এক হই, বুঝিনি এত দিন, তাই ভাই ভাই ঠাই ঠাই হয়েছিলেম।’ সকলে মিলে স্বাধীনতার জন্য চেষ্টিত হলেন। দেশের অবস্থা আশাজনক হয়ে উঠল। রাজা চাঁদ, রাজা কেদারের মুখে নিশ্চিন্ততার হাসি দেখা দিল।
সব হলো- হতে চলল কিন্তু একটা জিনিস এতক্ষণ বলা হয়নি সেইটেই ছিল এ রাজাদের মস্তবড় মনোকষ্টের কারণ, তাদের ছিল না ছেলেপেলে, তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান।
ভাবতে ভাবতে রাজা চাঁদ রায় একদিন রাতে ঘুমোলেন। ঘুমোতে ঘুমোতে স্বপ্ন দেখলেন, কোনো এক দেবতা তাকে বলছেন! রাজা, তুমি যদি কোটীশ্বরের মন্দিরের পূজারী দেবল ব্রাহ্মণকে তোমার গুরু কর, তবেই দেখতে পাবে সন্তানের মুখ। শ্রীমন্ত খাঁ ছিলেন তাঁদের গুরু। তাকে ছেড়ে নূতন গুরু করতে হবে কিন্তু ঠাকুর যে অভিশাপ করবেন।
দাদার কথা, রাজা কেদার রায় ফেলতে পারলেন না, রাজা কেদার রায় গিয়ে দেবল ঠাকুরকে নিয়ে এলেন কেদার রায়ের মন্দির থেকে, শ্রীমন্ত ঠাকুরের বড্ড রাগ হলো।
স্বপ্ন সত্যি হলো। রাজা চাঁদ রায়ের এক মেয়ে হলো। মেয়ের নাম হলো স্বর্ণময়ী। মেয়ে বড় হলো। চন্দ্রদ্বীপের যুবরাজের সঙ্গে হলো তার বিয়ে।
কিন্তু স্বর্ণময়ী হলেন বিধবা। তিন দিনের জ্বরে যুবরাজ মারা গেলেন, মেয়েকে এনে রাজা আর রাণী রাখলেন নিজেদের কাছে। যুবতী মেয়ে অত রূপ, বিধবা হয়ে কি করে থাকবে সেখানে, মেয়ে তো এসে রইল বাপের বাড়ী, এদিকে কি হলো শোনো:
আগেই বলেছি। হিন্দু রাজারা সব এক হয়েছেন, হিন্দু ছাড়া মোসলমান ভূম্যধিকারীও যাঁরা একটু ক্ষমতা রাখতেন তাঁরা হিন্দুদের সঙ্গে মিশলেন, একে একে বাংলার অসীম প্রতাপশালী বার ভূঁইয়ার অভূত্থান হলো। ভারী বুদ্ধিমান, আর কৌশলী তাঁরা, প্রথমে বুদ্ধি করে দিল্লীর বাদশার কর বন্ধ না করে শক্তি সঞ্চয় করতে লাগলেন। বাদশা কর পেলেই খুশি। দিল্লী অনেক দূর। বাংলায় কি হতো না হতো তত খবর নেবার দরকারও বোধ করতেন না। প্রতিনিধি রেখে দিয়েছিলেন, তিনিই বাংলার রাজাদের তত্ত্বাবধান করতেন। বাংলার রাজারাও যে যখন পারতেন ছলে, বলে, কৌশলে জায়গা, জমি, রাজ্য দখল করে ভোগ করতেন, দিল্লীতে একটা কর দিলেই সব মিটে যেত। যিনি দিল্লীর প্রতিনিধি থাকতেন তিনি রাজ্যের ভেতরের ব্যাপারে হাত দিতে পারতেন না, দিতেনও না। এইভাবে যশোর থেকে উঠলেন, প্রতাপাদিত্য, তা আগে বলেছি। সুবর্ণগ্রাম থেকে উঠলেন ঈশা খাঁ, আর শ্রীপুর থেকে উঠলেন আমাদের এই চাঁদ রায় আর কেদার রায়। সকলেরই মনে একভাব— স্বাধীন হবেন, মোগলের অত্যাচার, অধীনতা আর সইবেন না, বার ভূঁইয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া ঈশা খাঁ, মোসলমান হয়েও মিশতে চাচ্ছিলেন রাজা চাঁদ রায়, কেদার রায়ের সাথে, দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন— যুক্তি পরামর্শ করা চাই ত।
সংবাদ দিয়ে, খুব ঘটা করে, রাজার হালে ভূঁইয়া ঈশা খাঁ চললেন শ্রীপুরে। কি করা যায় ঠিক করবেন, সঙ্গে তেমন লোকজন নিলেন না, গেল কেবল রাজার ঠাট বজায় রাখতে, যে সব লোকের দরকার তারাই।
ঈশা খাঁ শ্রীপুরে উপস্থিত হলে রাজারা যত দূর সম্ভব তাঁর অভ্যর্থনা করলেন। তিনি জনে নির্জনে আগুন সাক্ষী করে মিত্রতা করলেন, আমোদ উৎসবও খুব হলো।
দৈবের নির্বন্ধ। খণ্ডন করবে কে? ঈশা খাঁর খেয়াল হলো তিনি গোপনে, ছদ্মবেশে শ্রীপুর নগর পাঁতি পাঁতি করে দেখবেন।
চাঁদ রায়, কেদার রায়ের বাড়ী— শ্রীপুর শহর— কি বিরাট, কি চমৎকার! মহলের পর মহল, আঙ্গিনার পর আঙ্গিনা রাস্তা, ঘাট, গাড়ি, ঘোড়া, দেখতে দেখতে ঈশা খাঁ চলেছেন।
দেখলেন ছাদের উপর এক সুন্দরী মেয়ে বসে আছেন, পরনে তাঁর ধবধবে ধুতি। চুলগুলো তাঁর মেঘের মতো, কাঁধে, পিঠে, বুকে, মুখে এলিয়ে পড়েছে, কি সুন্দর তার মুখ পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ছেনে বুঝি বিধাতা গড়েছেন তাঁকে, ঈশা খাঁ কেমন যেন হয়ে গেলেন। শুনলেন তিনি আর কেউ নন, চাঁদ রায়ের ষোড়শী, বিধবা মেয়ে স্বর্ণময়ী বা সোনামণি। ঈশা খাঁ সব ছেড়েছুড়ে পাগলের মতো তাঁর বাড়ী এলেন, বাড়ী ছেড়ে তাঁর ত্রিবেণী দুর্গে আস্তানা গাড়লেন, কারও সাথে নেই কথা— রাত-দিন ভাবছেন।
একদিন হঠাৎ ডাকলেন- ‘কোন হ্যায়?’ এনায়েৎ খাঁর প্রহরী এসে, কুর্নিস করে বলল, “হুজুর!” ঈশা খাঁ তাঁর হাতে একখানা চিঠি দিয়ে বললেন, ‘এই চিঠি নিয়ে এক্ষুণি ছুটে যাও শ্রীপুরে, যে কদমে যাবে, সেই কদমে আসবে কিন্তু। রাজার উত্তর নিয়ে আসা চাই, বুঝলে, খুব হুঁসিয়ার।’
এনায়েৎ খাঁ মস্ত ঘোড়সোয়ার। ছুটে চলে গেল শ্রীপুরে। ভেতরে খবর গেল— ঈশা খাঁর দূত এসেছে। দেখা করতে রাজা চাঁদ রায় এলেন না— এলেন রাজার ভাই, রাজা কেদার রায়।
রাজা কেদার রায় ঈশা খাঁর কৌটো খুলে, আতরে মাখা চিঠি পড়লেন। পড়ে, থরথর করে কাপতে লাগলেন। বললেন, ‘দূত! তুমি অবধ্য, কি আর বলব তোমায়? তোমার মুনিবকে বলো, এ আস্পর্ধা সইব না। চিঠির উত্তর সে পাবে তরোয়ালের মুখে।’ এই বলে চিঠিখানাকে ডেলা পাকিয়ে ফেলে দিলেন।
রাজা কেদার রায় ক্রোধে আগুন হয়ে সব কথা গিয়ে দাদাকে বললেন, ঈশা খাঁ সোনামণিকে বিয়ে করতে চায়, আমাদের বিধবা মেয়ে আমরা হিন্দু, সে মোসলমান, জেনেশুনেও তার এত আস্পর্ধা। দুভায়ে, হাজার সৈন্য নিয়ে চললেন, স্থলপথে চলল গোলন্দাজ, অশ্বারোহী, পদাতিক; জলপথে চলল, জাহাজে জাহাজে যত সব জল যোদ্ধারা, বাছা বাছা সব লোক, অহঙ্কার চূর্ণ করতে হবে লোভী ঈশা খাঁর।
দেওয়ান রঘুনন্দনের উপর রইল রাজ্যের ভার রাজবাড়ীর ভার, রাণীদের ভার, রাজকন্যা স্বর্ণময়ীর ভার। রাজারা কোটীশ্বরকে প্রণাম করে রথে চড়ে ছুটে চললেন। ব্রহ্মপুত্র, বলেশ্বরী ও লক্ষ্যা নদী যেখানে মিশেছে, সেইখানে ছিল ঈশা খাঁর ত্রিবেণী দুর্গ, সে দুর্গ ছিল সুদৃঢ়। তারই কিছু পশ্চিমে আবার লক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমস্থলে ছিল কলাগাছিয়া দুর্গরাজারা দুভাইয়ে সে দুর্গ ধূলিস্যাৎ করলেন, ত্রিবেণী দুর্গ দখল করতে হবে। রাজা কেদার রায়ের সঙ্গে চলল নৌসেনা। রাজা চাঁদ রায় ঈশা খাঁর রাজধানী খিজিরপুর আক্রমণ করে, তাঁর সমস্ত ধন-ভাণ্ডার লুঠ করলেন, ঈশা খাঁ গেলেন তার সবচেয়ে দৃঢ় দুর্গ ত্রিবেণীতে, রাজা কেদার রায় যে সেখানেও গেলেন তা তো আগেই বলেছি। রাজা কেদার রায় ছিলেন জলযুদ্ধে অদ্বিতীয়। তাঁর জলযুদ্ধের সৈন্যেরাও অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল। নিজেরাই ছিপ চালাত, বন্দুক মারত, অব্যর্থ তীর ছুড়ত। বাঙ্গালীর সে নৌসেনা আর নেই সে অসীম বীরত্বে ভরা প্রাণ, কৌশলী যোদ্ধা রাজা কেদার রায়ও নেই। রাজা কেদার রায়ের সেই দেড়শ ছিপ, আর হাজার সৈন্য ত্রিবেণী দুর্গ ছেয়ে ফেললে।
এদিকে এক কাণ্ড হলো। রাজাদের গুরু, শ্রীমন্ত খাঁর কথা আগে বলেছি। তিনি তাদের ব্যবহারে ভারী রুষ্ট হয়েছিলেন, প্রতিহিংসার জন্য করছিলেন প্রতীক্ষা। এইবার তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত পূর্ণ সুযোগ উপস্থিত হলো। তিনি এসে যোগ দিলেন ঈশা খাঁর সাথে।
এসে দেখলেন ঈশা খাঁ মনে মনে একান্তভাবে চাচ্ছেন সোনামণিকে। কিন্তু কোনো উপায় করতে পারছেন না, বললেন, ‘খাঁ সাহেব, তুমি সেই সোনার বরণ কন্যা, সেই মেঘ বরণ চুল, হাসতে যার মুক্তা ঝরে, তাকে চাও? যদি এনে দিতে পারি, কি দেবে বলো ত?’
ঈশা খাঁ আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বললেন, যদি সত্যি পার, তুমি কেন, তোমার ছেলে, তার ছেলে যাতে পায়ের উপর পা রেখে খেতে পারে, তার ব্যবস্থা আমি করে দেব এখন। ঈশা খাঁ জিজ্ঞাসা করলেন ‘পারবে ঠাকুর?’ শ্রীমন্ত ঠাকুর বললেন, “নিশ্চয়’– ঈশা খাঁ উঠে, এক ঘড়া সোনার মোহর এনে দিলেন আগাম। বললেন, ‘আজ এই নিয়ে যাও ঠাকুর, কাজ শেষ করে এই সোনার গায়ে সোনামণিকে নিয়ে এস, যা আমার মনে আছে দোব, এই নাও আমার আংটি, এর জোরে এ রাজ্যে হবে তোমার অবাধ গতি।’ এক ঘড়া সোনার মোহর নিয়ে, আর ঈশা খাঁর আংটি নিয়ে শ্রীমন্ত ঠাকুর চললেন বাড়ীতে। গিয়ে, গোপনে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে, ঘড়া রেখে মাটি চাপা দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে, চুলগুলোকে উসকো খুসকো করে, পাগলের মতো হয়ে, শ্রীমন্ত ঠাকুর চললেন শ্রীপুরের পথ দিয়ে, রাস্তায় ভিড় হতে লাগল। কারও সাথে একটা কথাও না বলে শ্রীমন্ত ঠাকুর একেবারে হাজির হলেন রাজবাড়ীর দোরে। ঠাকুর ভেতরে ঢুকে রাণীর মহলে গিয়ে, স্বামীর মঙ্গলের জন্য পূজারতা রাণীকে বললেন, রাণীমা! রাণীমা! সর্বনাশ হয়েছে, রাণী চমকে উঠে বললেন- ‘সে কি ঠাকুর?’
শ্রীমন্ত ঠাকুর কান্নার ভাণ করে বললেন, ‘রাজারা বন্দী হয়েছেন, সৈন্য সব বিশৃঙ্খল, শত্রুসৈন্য তাদের তাড়া করেছে, শ্রীপুরের দিকেই তারা আসছে— আসছে কি, এল বলে।’
রাণী বললেন, ‘আসুক।’
শ্রীমন্ত বললেন, ‘সে কি মা? তারা কি আর কিছু রাখবে? তারা যে আসছে, সোনামণিকে নিতে! আপনি শ্রীপুর ছেড়ে চলে যান সোনামণিকে লুকাবার চেষ্টা করুন।’
রাণীর চোখ দুটো বাঘিনীর মতো জ্বলে উঠল, রাণী বললেন- ‘চাঁদ রাজার রাণী যাবে পালিয়ে? তাও কি কখনও হয়? যা তো একজন দেওয়ানজীকে ডেকে নিয়ে আয়।’
দেওয়ান রঘুনন্দন এলেন, বললেন, ‘না, না পালাবেন কেন মা? প্রাণ দিয়ে রঘুনন্দন আপনাদের বাঁচাবে।’
রাণী আশ্বস্তা হলেন, কিন্তু শ্রীমন্তের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। শ্রীমন্ত বললেন, ‘দেওয়ানজী, এ বুদ্ধি ভালো হচ্ছে না, কি সে কি হয় কে জানে, সাবধানের মা’র নেই, সোনামণিকেই তো তারা নিতে আসছে। তা ওকে চন্দ্রদ্বীপে পাঠিয়ে দিন না। দেওয়ানের কথা রাণী এইবার শুনলেন না। তিনি সোনামণির জন্য ব্যাকুল হয়ে শ্রীমন্ত ঠাকুরের পরামর্শে তার সঙ্গে সোনামণিকে তার শ্বশুরবাড়ী চন্দ্রদ্বীপে পাঠিয়ে দিলেন। শ্রীমন্তের মনোবাসনা এইরূপে পূর্ণ হলো।
দেওয়ান রঘুনন্দন, চর পাঠিয়ে জানলেন সবই মিথ্যা। খিজিরপুরে যে চর গিয়েছিল সে গিয়ে রাজা চাঁদ রায়ের কাছে সোনামণিকে তার শ্বশুরবাড়ী পাঠাবার খবর, শ্রীমন্তের যুদ্ধে পরাজয় ও রাজাদের বন্দী হওয়ার খবর সব বলল। রাজা তো শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি শ্রীপুরে গিয়ে দেখলেন শ্রীমন্ত সোনামণিকে নিয়ে সত্যিই পালিয়েছে। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। সোনামণিকে নিয়ে শ্রীমন্ত ঠাকুর ঈশা খাঁর রাজধানীতে, ঈশা খাঁর অন্দরমহলে ঢুকে পড়ল।
সোনামণির ভালো জ্ঞান ছিল না— যখন জ্ঞান হলো তখন তিনি চেয়ে দেখলেন, এক সুন্দর সাজানো ঘরে শুয়ে আছেন। ক্রমে সব প্রকাশ হলো।
স্বর্ণময়ী সোনামণি বা সোনা বিবি নাম নিয়ে ঈশা খাঁর রাণী হলেন। রাজা চাঁদ রায় অভিমানী রাজা ছিলেন এই দারুণ অপমানে একেবারে মুসড়ে গেলেন।
বেশিদিন সইতে হলো না তার এ অপমান; একদিন ভোরবেলায় তিনি তার আরাধ্য দেবতা কোটীশ্বরের নাম জপতে জপতে চোখ বুজলেন।
রইলেন, একা রাজা কেদার রায়।
এক হাতে চোখের জল মুছে আর এক হাতে রাজকার্য চালিয়ে তিনি প্রতিশোধের চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করলেন।
দাদা তো গেলেনই— প্রজারা রয়েছে, তাদের যাতে ভালো হয় সেই সব করতে যত দূর সাধ্য রাজা কেদার রায় উঠে পড়ে লাগলেন। তাঁর রাজ্যে যাতায়াতের ভালো রাস্তা ছিল না। যাতায়াত কষ্টের মতো কষ্ট আর নেই— তিনি বহু অর্থব্যয়ে সেই কষ্ট দূর করে দিলেন। জলের কষ্টে প্রজারা কষ্ট পাচ্ছিল, পুকুর কাটিয়ে, দীঘি কাটিয়ে, খাল কাটিয়ে, নালা কাটিয়ে প্রজাদের সেসব কষ্ট নিবারণ করলেন, ছেলেরা পড়াশোনা করতে পারত না – ভালো পাঠশালা, মক্তব, কিছু ছিল না বললেই হয়, লেখাপড়া না শিখলে, প্রজাদের জ্ঞান না হলে নানা অসুবিধা হয়, তিনি ভালো ভালো পাঠশালা, মক্তব, টোল করে দিলেন। পুজো অর্চনার জন্য, ধর্মভাব বৃদ্ধির জন্য গড়ালেন মন্দির, মঠ ও মসজিদ। লোকে ধন্য ধন্য করতে লাগল। বলতে শুরু করল, ‘এত দিনে রাজার মতো রাজা হয়েছেন।’
তিনি সুন্দর সুন্দর সেনানিবাস, বিচারালয়, কারাগার, কোষাগার প্রভৃতি স্থাপন করে কুলদেবতা কোটীশ্বরের মন্দির গড়ে, কাঁচকীর দরজা গড়ে, দক্ষিণ বিক্রমপুরে কেদার-বাড়ী তৈরি করে, উত্তর বিক্রমপুরে রাজবাড়ীর মঠ নির্মাণ করায়ে, ঢোল সমুদ্র ও কেশার মার দীঘি কাটায়ে দেশে এক নবযুগের সৃষ্টি করলেন।
মোগলগণ পর্তুগিজদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলে, কেদার রায় দেখলেন, পর্তুগিজেরা জাহাজ পরিচালনায় সকলের চেয়ে পটু, জল-যুদ্ধে ভারী ওস্তাদ, তাদের পক্ষে নিলে মোগল সম্রাটকে ও আরাকানের রাজাকে শায়েস্তা করা যাবে। এই ভেবে তিনি পর্তুগিজদের পক্ষ নিলেন ও মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে সন্দ্বীপ কেড়ে নিলেন, কেড়ে নিয়ে সেখানে পর্তুগিজদের বসিয়ে দিলেন, আর তাদের সেনাপতি কার্ভোলিয়াসকে করলেন সন্দ্বীপের শাসনকর্তা, এইভাবে পর্তুগিজেরা হলো তাঁর পক্ষ। আরাকানের রাজা, রাজা কেদার রায়ের প্রতি বিরক্ত হয়ে ১৫০ রণতরী নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন, কিন্তু জলযুদ্ধে তার সঙ্গে পারে কে? তিনি ১০০ রণতরী নিয়ে কামানের ধূয়ায় মেঘনার বুক আঁধার করে ফেললেন। সে যুদ্ধের কথা অনেকে অনেকভাবে বলেছেন। তেমন যুদ্ধ বাঙ্গালী আর করেনি, বোধ হয় করবেও না।
সকালবেলা হলো সে যুদ্ধের শুরু। সারাদিন চলল সে যুদ্ধ- সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সন্ধ্যা-সূর্যের লোহিত কিরণে নীল আকাশের পশ্চিম প্রান্ত হয়ে উঠল রঙ্গীন, নিচে সৈন্যগণের লোহিত দেহ-শোণিতে নীল সমুদ্রের পূর্বপ্রান্ত হয়ে উঠল লালে লাল।
রাজা কেদার রায় ভীষণ হতে ভীষণতর বেগে আরাকানের রাজার রণতরী আক্রমণ করলেন, ১৪০ খানা রণতরী রাজা কেদার রায়ের বাহুবলে তাঁর অধীন হলো, সমস্ত সৈন্য বন্দী করে রাজা কেদার রায় তাদেরকে নিয়ে এলেন রাজধানী শ্রীপুরে, আরাকান রাজ পরাজিত হলেন। পরাজয়ের সংবাদ শুনে, আরাকান রাজ ক্রোধে দিশেহারা হয়ে উঠলেন। বহু অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে হাজার রণতরী পাঠালেন, কিন্তু রাজা কেদার রায় ভয় পাওয়ার লোক ছিলেন না। কামানের আগুনে সব পুড়িয়ে, ডুবিয়ে দিলেন। আরাকান রাজ ভাবতে লাগলেন কি করা যায়।
এদিকে রাজা কেদার রায়ের মহাবীর পর্তুগিজ সেনাপতি কার্ভোলিয়াস রণতরীর সংস্কার ও পুর্নগঠনের জন্য এবং উত্তম নৌবহর গঠন করতে শ্রীপুরে এলেন।
শ্রীপুর, বাকলা ও সাগরদ্বীপে রণতরীর আবশ্যকানুরূপ সংস্কারাদি হতে থাকল, সেনাপতি কার্ভোলিয়াস এই সমস্ত নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন। সন্দ্বীপ ছেড়ে এলেন। এই অনুপস্থিতির সুযোগে আরাকানপতি সন্দ্বীপ অধিকার করলেন।
মোগল সেনাপতি ছিলেন রাজা মানসিংহ, তিনি এই সময়ই রাজা কেদার রায়কে আক্রমণ করা যুক্তিযুক্ত বোধ করে কোষা নামক ১০০ রণতরী রাজা কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিলেন, যুদ্ধে ক্লান্ত রাজা কেদার রায়কে এই সময়ে আক্রমণ করলেই হয়তো রাজা পরাস্ত হবেন এই ছিল তার ধারণা, তিনি বিক্রমপুরের প্রসিদ্ধ জলযোদ্ধা মন্দ রায়কে তাঁর প্রেরিত নৌ-বাহিনীর সেনাপতি করলেন।
কিন্তু এই এত বড় সেনাপতি মন্দা রায় বা মধু রায়ও দীর্ঘকাল যুদ্ধ করে অবশেষে রাজা কেদার রায়ের নিকট পরাজিত ও নিহত হলেন। পর্তুগিজ বীর কার্ভোলিয়াস, এই যুদ্ধে রাজা কেদার রায়ের নৌ-বাহিনী পরিচালনা করেছিলেন। সেনাপতি কার্ভোলিয়াস অতঃপর মোগলগণের সকল জায়গা অধিকার করে, সুদূর হুগলী দুর্গ অবধি জয় করে ফেললেন।
দেখে শুনে আরাকান-পতি রাজা কেদার রায়ের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে, তাকে প্রচুর সৈন্য ও অর্থদ্বারা সাহায্য করতে লাগলেন।
রাজা কেদার রায়ও এতে সমধিক উৎসাহিত হয়ে সোনারগাঁ, বিক্রমপুর প্রভৃতি অঞ্চল হতে বহু সৈন্য সংগ্রহ করে প্রস্তুত হতে লাগলেন। মোগলের চিরশত্রু পাঠানবীর আহাম্মদ খাঁ রাজা কেদার রায়ের সঙ্গে মিশলেন। মোগল শাসনকর্তা ছিলেন, সুলতান কুলী খাঁ, তিনি এই সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে সাহসী না হয়ে কোনোক্রমে আত্মরক্ষা করতে থাকলেন, কিন্তু রাজা কেদার রায় তাঁর রাজধানী আক্রমণ করে বসলেন। সুলতান কি করেন? – অগত্যা এই ঘোর বিপদের সংবাদ রাজা মানসিংহকে জানালেন। রাজা মানসিংহ অত্যন্ত চতুর ছিলেন। তিনি সম্মিলিত ত্রিশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধোদ্যত কুলীকে সাহায্য করবার জন্য পাঠালেন সেনানায়ক আৎকার, দলপৎ রায় ও রঘুসাদকে।
ঘটনাক্রমে আরাকান রাজের সঙ্গে হঠাৎ আবার রাজা কেদার রায়ের হলো মনোমালিন্য, ফলে একাকী যুদ্ধ করে আরাকান রাজ মানসিংহের নিকট পরাজিত হলেন।
রাজা কেদার রায় পরাক্রান্ত মোগল সেনাপতি মন্দা রায়কে যুদ্ধে নিহত করলেন, এতে মোগল প্রতিনিধি রাজা মানসিংহের ভারী রাগ হলো; তিনি মাত্রা হারিয়ে ফেললেন যখন শুনলেন যে মোগল সেনাপতি কিলমকও রাজা কেদার রায় কর্তৃক বন্দী হয়ে তাঁর রাজধানীতে আছে।
তিনি বাংলায় এসে রাজা কেদার রায়কে চিরাচরিত প্রথামত তাঁর শৃঙ্খল ও তরবারি পাঠালেন।
রাজা কেদার রায় অবজ্ঞা ভরে শৃঙ্খটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে তরবারি নিয়ে মানসিংহকে সম্মুখ যুদ্ধে আহ্বান করলেন।
তারপর তিনি স্বয়ং যুদ্ধে চললেন, চতুর্দিকে রণভেরী বেজে উঠল। তাঁর বৃহৎ বৃহৎ ৫০০ কোষা নামক রণতরী নিয়ে তিনি অগ্রসর হলেন, যুদ্ধে রাজা মানসিংহ পরাজিত হলেন। রাজা কেদার রায়ের জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রতিধ্বনি হয়ে উঠল।
কিন্তু দুঃসময় যখন আসে তখন এমনই করে আসে যে কেউ তার গতি রোধ করতে পারে না।
একদিন, রাজা কেদার রায় একান্তভাবে করছিলেন তাঁর আরাধ্যা। দেবীর ধ্যান— দেবীর মন্দিরে, দেবীর সামনে চোখ বুজে। এমন সময় রাজা মানসিংহ একজন গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে ধ্যানস্থ মহাবীর রাজা কেদার রায়ের মস্তক ছেদন করে ফেললেন।
এই সুযোগের সংবাদ দিয়েছিল, সেই গৃহশত্রু, বিশ্বাসঘাতক শ্রীমন্ত খাঁ। ভক্তবীর রাজার মস্তক ভূপতিত হতে হতেও ‘ছিন্নমস্তে নমস্তে, ছিন্নমস্তে নমস্তে’ বলতে বলতে ইষ্ট নাম জপ করছিল।
এইরূপে বাংলার এই স্বাধীন হিন্দুরাজা কেদার রায়ের দেহাবসান ঘটে।
রাজার মৃত্যুতে তার সৈন্যগণ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। মন্ত্রী রঘুনন্দন চৌধুরী ও সেনাপতি রঘুনন্দন রায় অনেক যুদ্ধ করলেন, সেনাপতি কালিদাস ঢালী, রামরাজা সর্দার, পর্তুগিজ ফ্রান্সিস, শেখ কালু প্রভৃতিও অনেক যুদ্ধ করলেন। কিন্তু বাঙ্গালীর ভাগ্য ছিল না ভালো। অধপতন অনিবার্য হয়ে উঠল। ফ্রান্সিস, সাহেব ও শেখ কালুকে অর্থের প্রলোভনে বশ করে এবং রঘুনন্দনকে যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে নামে মাত্র মোগলের আনুগত্য স্বীকার করতে অনুরোধ করে বাধ্য করলেন। কিছুদিন রাণীই রাজ্য চালালেন।
তারপর মোগল প্রতিনিধি এসে, ব্যবস্থা করে মন্ত্রী রঘুনন্দনকে দিলেন বিক্রমপুর পরগণা, সেনাপতি রঘুনন্দনকে দিলেন ইদিলপুর, শেখ কালুকে দিলেন কার্তিকপুর, কালিদাস ঢালী পেলেন দেওভোগ আর রামরাজা সর্দার পেলেন মূলপাড়া তালুক।
হিন্দুর শেষ মহিমা স্তম্ভ রাজা কেদার রায় নেই – রয়েছে তাঁর অগণিত কীর্তি। সেসব কীর্তির কথা আগেই বলেছি।