রাজার হেঁচকি

রাজার হেঁচকি

এই যে বলাইবাবু, নমস্কার! তা খবরটবর সব ভালো তো?”

”হ্যাঁ, তা খবর তেমন খারাপও কিছু নয়। বাজারে নতুন ফুলকপি উঠেছে, রাঙা মুলো পাওয়া যাচ্ছে, সরেস নলেনগুড়ও এসে গিয়েছে। টাটকা কই মাছের আমদানিও ভালো। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক ঠিক চিনলাম না।”

”আপনি কি নবকিশোর রায়কে চেনেন?”

”নবকিশোর! না মশাই, নবকিশোর নামে কাউকে তো মনে পড়ছে না।”

”তা হলে বটকৃষ্ণ বাঁড়ুজ্যে?”

”উঁহু, বটকৃষ্ণ নামটা শোনা—শোনা হলেও চেনা—চেনা লাগছে না তো।”

”মহানন্দ তলাপাত্র নামের কাউকে কি চেনা ঠেকছে?”

”না মশাই, মহানন্দ নামটা শুনেছি বলেই মনে পড়ছে না।”

”মুশকিল কি জানেন বলাইবাবু, আপনি না চিনলেও এঁরা সব আছেন কিন্তু! এই আপনার মতোই সকালে বাজার করছেন, দশটায় অফিসে যাচ্ছেন, সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে রুটি আর কুমড়োর ছেঁচকি খাচ্ছেন, লুঙ্গি পরে রকে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।”

”অ, তা হবে, কিন্তু এদের কাউকেই আমি চিনি না মশাই।”

”আজ্ঞে, তাই তো বলতে চাইছি বলাইবাবু, দুনিয়ার ক’টা লোককেই বা আপনি চেনেন? চেনা তো বড় সহজ কাজও নয়। লোকও যে হাজারে—বিজারে, লাখো—লাখো, কোটি কোটি। কোন মহাপুরুষ যেন বলেছেন, লোক না পোক। তা এত অচেনা লোকের মধ্যে এক—আধজনকে মাঝে—মাঝে চেনা করে নিতে ইচ্ছে যায় না আপনার? এই ধরুন, নবকিশোরকে আপনি চেনেন না, কিন্তু নবকিশোরের ছেলে কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে ফস করে যদি আপনার মেয়ে টেঁপির বিয়ে হয়ে যায়, তা হলে নবকিশোর কি আর আপনার অচেনা থাকবে?”

”টেঁপির বিয়ের কথা উঠছে কেন মশাই? টেঁপির তো মোটে এগারো বছর বয়স!”

”আহা, কথার কথা বলছি আর কী! কৃষ্ণকিশোরেরও মোটেই বিয়ের বয়স হয়নি, সবে সতেরোয় পড়েছে। তাই বলছিলুম অচেনা লোক বলে কি দূরে ঠেলে রাখা ভালো? কার সঙ্গে কখন কোন সূত্রে চেনা—পরিচয় হয়ে যায় তার তো কোনো ঠিক নেই। এই যে আমি, গতকাল পর্যন্তও কি আমার সঙ্গে আপনার চেনা ছিল? আজ কেমন হুট করে চেনা হয়ে গেল বলুন তো!”

”না মশাই, চেনা এখনও হয়নি, আপনাকে আমি মোটেই চিনি না।”

”ওই তো আপনার দোষ বলাইবাবু! চিনবেন না বলে গোঁ ধরে থাকলে কি আর চেনা যায়? আমি হলুমগে গোবিন্দলাল।”

”অ। তা ভালো। পরিচয় পেয়ে বড় খুশি হলুম। আমি তা হলে আসি?”

”বিলক্ষণ। আসবেন বইকি। তা চলুন, আমিও ওইদিকেই যাব কিনা! যেতে—যেতে দু’টো সুখ—দুঃখের কথাও বলা যাবে। তবে আমার আবার দুঃখের পাল্লাটাই ভারী কিনা!”

”দেখুন গোবিন্দবাবু, দুঃখটুঃখ আমাদের সবারই আছে। এখন ওসব হাপরহাটি শোনার আমার সময় নেই। অফিসের দেরি হয়ে যাবে।”

”তা তো বটেই। তবে কিনা আজ একটু দেরি হলেও তেমন ক্ষতি নেই। রোববারের অফিস তো!”

”আজ রোববার বুঝি? একেবারেই খেয়াল ছিল না। অফিস না থাকলেও আমার অনেক কাজ আছে গোবিন্দবাবু।”

”সে আর বলতে! রোববার তো আপনার গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার কাচার দিন এ কেন না জানে? এ ছাড়া করালীবাবুর সঙ্গে জমিতে বেড়া দেওয়া নিয়ে বকেয়া ঝগড়াটাও মুলতুবি রয়েছে। রোববারে কিস্তির কাজিয়াটাও সারতে হবে। তারপর ধরুন বেলা এগারোটায় লক্ষ্মীকান্তবাবুর সঙ্গে একপাট্টি দাবা খেলা আছে। রোববারে যে আপনার দম ফেলার সময় থাকে না এও সবাই জানে কিনা!”

”আপনি তো খুব ঘড়েল লোক মশাই! আমার সম্পর্কে এত খবর পেলেন কোথায়? আপনি পুলিশের চরটর নন তো?”

”ঘাবড়াবেন না বলাইবাবু। আমি আসলে একজন দুঃখী লোক। একটা খারাপ খবর দিতেই আপনার কাছে আসা।”

‘খারাপ খবর? কীরকম খারাপ খবর মশাই? কাটোয়ায় আমার নব্বই বছরের বুড়ি পিসি থাকেন, তা পিসি হঠাৎ মারাটারা যাননি তো? আমার রাঙামামার ক্যানসার হয়েছিল বলে একটা উড়ো খবর পেয়েছিলাম, তাঁর কিছু হলটল নাকি? হ্যাঁ মশাই, টাটা কোম্পানির শেয়ারের দর কি হঠাৎ পড়ে গিয়েছে? আমার চিরশত্রু কালোবরণ কি লটারি পেয়েছে? নাকি ট্যারাকেষ্ট জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে? সে বলেছিল বটে, জেল থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখে নেবে। হ্যাঁ মশাই, বিষ্টুবাবু কি তাঁর দু’হাজার টাকা ধার আদায় করতে আসছেন? আমার নামে হুলিয়া জারি হয়নি তো? নাকি কেউ আমাকে মারার জন্য গুন্ডাদের সুপারি দিয়েছে?”

”না, মশাই না। খবরটা খারাপ হলেও আপনার ভয় নেই। কথাটা হল আমার চাকরিটা গিয়েছে।”

”যাক বাবা, বাঁচা গেল! খারাপ খবরের কথা শুনলে আজকাল বড় বুক ধড়ফড় করে। তা আপনার চাকরি গেলে আমার কী যায়—আসে বলুন! আমি মশাই বড্ড ছাপোষা লোক, সাহায্যটাহায্য চেয়ে লজ্জা দেবেন না!”

”আরে না, আপনাকে লজ্জা দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। দুঃখের কথা কইলে বুকটা একটু ঠান্ডা হয়, এই যা।”

”তা অবশ্য ঠিক। তা আপনি কোথায় চাকরি করতেন গোবিন্দবাবু?”

”রামনগর রাজবাড়ির কথা জানেন কি?”

”রামনগর রাজবাড়ি! না মশাই, ঠিক মনে পড়ছে না।”

”আপনার জানা না থাকলেও রামনগরের রাজবাড়ি খুবই বিখ্যাত।”

‘তা হতেই পারে। কত কিছুই তো আমাদের জানা নেই।”

”অতি সত্যি কথা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই রাজবাড়িতে আমার একটি চাকরি হয়েছিল।”

”রাজবাড়ির চাকরি! কিন্তু শুনতে পাই, আজকাল আর রাজাগজাদের দিন নেই। রাজবাড়িগুলো সব মিউজিয়াম বা সরকারি দপ্তর হয়ে গিয়েছে।”

”তা গিয়েছে বটে। তবে দেশের সব চোর—ডাকাত যেমন জেলে যায় না, পুকুর বা নদীর সব মাছই যেমন ধরা পড়ে না, দেশলাইয়ের সবক’টা কাঠিই যেমন জ্বালানো যায় না, তেমনই রাজবাড়িগুলোরও কয়েকটা এখনও টিকে আছে। রামনগরে শুধু রাজবাড়িই নেই, জরির পোশাকপরা মুকুট মাথায় বুড়ো রাজা আছেন, তাঁর তিন রানি, মন্ত্রী, সেনাপতি, সেপাই—সান্ত্রী সব আছেন। সকালে রোজ দরবার বসে, সেখানে অপরাধীদের বিচারও হয়। সভাগায়ক, সভাকবি পর্যন্ত আছেন।

”বলেন কী মশাই? এ তো আষাঢ়ে গল্প! তা সেখানে যাওয়া যায়?”

”খুব যাওয়া যায়। রাস্তাটা একটু প্যাঁচালো, এই যা!”

”তা আপনি সেখানে কী চাকরি করতেন গোবিন্দবাবু?”

”চাকরিটা বেশ গুরুতরই ছিল মশাই। সকালে শয্যাত্যাগের পর থেকে রাতে শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত রাজামশাই ক’বার কাশলেন, ক’বার হাঁচি দিলেন, ক’বার হাই বা ঢেকুর তুললেন এবং ক’টা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তার হিসেব রাখা। কাশি হলে ক্রশচিহ্ন, হাঁচি হলে ঢ্যাড়া, ঢেকুর তুললে গোল্লা, হাই তুললে দাঁড়ি, আর দীর্ঘশ্বাস ফেললে ভাগচিহ্ন। রাত্রিবেলা বুড়ো রাজবৈদ্য সেগুলো যোগ দিয়ে হয়তো দেখলেন, রাজামশাই বাইশবার কেশেছেন, এগারোটা হাঁচি দিয়েছেন, একশো বত্রিশটা ঢেকুর আর তেরোটা হাই তুলেছেন, সেই বুঝে তিনি রাজার জন্য নানা ওষুধের ব্যবস্থা করতেন।”

”এ তো ভারি মজার চাকরি মশাই!”

”না মশাই, মোটেই মজার চাকরি নয়। রাজার হাঁচি—কাশির হিসেব রাখতে গিয়ে আমার নিজের নাওয়া—খাওয়া শিকেয় উঠল। সারাক্ষণ রাজামশাইকে নজরে—নজরে রাখতে হত। একটা হাঁচি—কাশির এদিক—ওদিক হলে বেতন কাটা যেত।”

”তা রাজবাড়িতে বেতনটা কীরকম ছিল গোবিন্দবাবু?”

”তা সেটা খুব মন্দ ছিল না। মাসে পাঁচ মোহর।”

”মোহর? মানে সোনার মোহর?”

”আজ্ঞে, সেখানে এখনও মোহরেরই চল ছিল কিনা! রাজামশাই তো সোনা—রুপো ছাড়া আর কোনো ধাতু ছুঁতেন না। তাঁর তলোয়ারের হাতলটাও রুপো—বাঁধানো। গাড়ু, পিকদানি, থালা—গেলাস, সবই রুপোর!”

”ওঃ, এ তো ভাবা যায় না মশাই! মাসে পাঁচ মোহর মানে তো পঞ্চাশ—ষাট হাজার টাকা! রীতিমতো শাঁসালো চাকরি মশাই? তা সেটা খোয়ালেন কী করে?”

”সেটাই তো দুঃখের কথা মশাই! একদিন রাতে রাজামশাই খেতে বসেছেন। কাশ্মীরি পোলাওয়ের সঙ্গে মাছের নবরত্ন কালিয়া, মোগলাই দমপুক্ত, মাংস, মুড়িঘণ্ট, মুর্গমসল্লম, চিংড়ির মালাইকারি, আলুবখরার চাটনি, নলেনগুড়ের পায়েস, রাবড়ি, রাঘবশাহি আর সরভাজা।”

”এ যে এলাহি ব্যবস্থা মশাই! বলি রাজাগজাদের কি ব্লাডসুগার, কোলেস্টেরল, হার্ট ডিজিজের ভয় নেই, নিদেন গ্যাস, অম্বল অথবা ডিসপেপসিয়া তো হতেই হবে।”

”আপনার—আমার মতো চুনোপুঁটি তো নন, সাড়ে ছ’ফুট লম্বা ইয়া বুকের ছাতি, পেল্লায় ভুঁড়ি, থামের মতো পা, মুগুরের মতো হাত।”

”বুঝেছি, বুঝেছি। তারপর কী হল বলুন?”

”হ্যাঁ, সেই দুঃখের কথাটাই বলি। মাংস চিবোতে গিয়ে রাজামশাই একটা লঙ্কা চিবিয়ে ফেলেছিলেন। সে এমন ঝাল লঙ্কা যে, রাজামশাই একেবারে নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা। ঝালের চোটে হেঁচকি উঠে গেল। আর সে কী হেঁচকি মশাই। হেঁচকির চোটে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। রাজবৈদ্য ছুটে এলেন, মন্ত্রী এলেন, সেনাপতি এলেন, বিদূষক এলেন। ঘটি—ঘটি জল খাওয়ানো হল, নানা মুষ্টিযোগ প্রয়োগ করা হল, বিদূষক নানা রসিকতা করলেন, কিছুতেই কিছু হয় না। রাজামশাই হিচিক—হিচিক করে কেবল হেঁচকি তুলে যাচ্ছেন। তখন আমি বললাম, ‘মন্ত্রীমশাই আমি একটু চেষ্টা করে দেখব?’ মন্ত্রী বললেন, ‘অবশ্য—অবশ্য। রাজাকে আরোগ্য করলে পারিশ্রমিক পাবে।’ আমি দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গিয়ে কী করলাম জানেন? রাজার গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে দিলাম!”

”বলেন কী মশাই! এঃ হেঃ, এটা খুব ভুল করলেন। রাজার গালে চড় মারলে কি কারও চাকরি থাকে?”

”থাকে। আমারটা অন্তত ছিল। কারণ, সামান্য একজন নফরের হাতে আচমকা চড় খেয়ে রাজা এমন চমকে গেলেন যে, তাঁর হেঁচকি সেরে গেল। গম্ভীর হয়ে শুধু বললেন, ‘এই ছোকরা কে?’ মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, এ আপনার হাঁচি—কাশির হিসেবরক্ষক।’ রাজা থমথমে মুখে একটা ‘হু’ দিয়ে শোওয়ার ঘরে চলে গেলেন। হেঁচকি সেরে যাওয়ায় আমি একথালা রুপোর টাকা বকশিশ পেলাম। কোম্পানির আমলের অ্যান্টিক জিনিস।”

”তা হলে চাকরি গেল কীসে?”

”পরদিন আমাকে বরখাস্ত করে যে চিঠিটা দেওয়া হল, তাতে লেখা ছিল, ‘রাজা ক’টা হেঁচকি তুলেছিলেন তার হিসেব রাখোনি বলে তোমাকে বরখাস্ত করা হচ্ছে।”

”এ তো বড় অন্যায় মশাই! হেঁচকির হিসেব রাখবার তো কথা ছিল না আপনার?”

”সেই দুঃখের কথাই তো বলতে এত দূর আসা মশাই! তা বলাইবাবু, আঠারোশো পঞ্চান্ন সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই রুপোর টাকাগুলোর কীরকম দাম হবে বলতে পারেন? ভাবছি, কয়েকটা বেচে দেব। যদুস্বর্ণকার পাঁচশো করে দিতে চাইছে। খুব ঠকা হবে কি? এই যে দেখুন না!”

”আহা, হাটেবাজারে এমন জিনিস বেচবার দরকার কি আপনার? এই দরেই আমি না হয় সবক’টা কিনে নিচ্ছি।”

”নেবেন? তা নিন। চেনা মানুষের কাছে দু’—পাঁচশো টাকা ঠকেও সুখ।”

”তা তো বটেই, তা তো বটেই!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *