রাজার হুকুম – অমর মিত্র

রাজার হুকুম – অমর মিত্র

ঘণ্টারাম ঘণ্টাশোলের রাজা

বড়োরানি

ছোটোরানি

গোলাপি ধুতি ঘুম ভাঙানিয়ার দল

হলুদ ধুতি ,,

নীল ধুতি ,,

যদু

মধু

মন্ত্রী

কোটাল

নিধিরাম সর্দার

লালুরাম

ঢোলবাদক

১ম নগরবাসী

২য় নগরবাসী

পুরোহিত

প্রথম দৃশ্য

[ রাজার নাম ঘণ্টারাম রায়। রাজ্যের নাম ঘণ্টাশোল। মঞ্চের গভীরে ঘণ্টাশোলের রাজ-সিংহাসন। সিংহাসনের পিছনে চালচিত্র, ঠাকুরের পিছনে যেমন থাকে। এই চালচিত্রে বাঘ, সিংহ, ময়ূর, হরিণ, জীবজন্তু আঁকা। সিংহাসন এখন শূন্য। সবে ভোর হচ্ছে। সিংহাসন পাহারা দেওয়া দুই প্রহরীর হাতে দুটি পাখা। খালি সিংহাসনকে হাওয়া করতে করতে সিংহাসনের গায়েই দুই দিকে ঢলে আছে দুজন। কাকের ডাক, পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। প্রহরীদ্বয়ের নাক ডাকার আওয়াজ তার ভিতরে মিশে যাচ্ছে।

মঞ্চের সামনের দিকটা নগরের রাজপথ ভেবে নেওয়া যেতে পারে। সামনের দিকে খোল-করতাল বাজিয়ে ঘুমভাঙানিয়ার দল প্রবেশ করে। একজন গান গায়, দুইজন বাজায়। ঘুমভাঙানিয়া তিনজনের তিনরঙের ধুতি। গোলাপি, নীল, হলুদ। যার গোলাপি ধুতি তার নীল পাগড়ি, যার নীল ধুতি তার হলুদ পাগড়ি। যার হলুদ ধুতি, তার গোলাপি পাগড়ি। গোলাপি ধুতি পরা লোকটি মূল গায়ক। অন্যরা তার সঙ্গে গলা মেলাবে ]

গোলাপি ধুতি। গান

ভোর অ হইল, বায়স অ ডাকিল

ঘণ্টারাজার ঘুম কি ভাঙিল?

ঘুম ঘুম চোখে রাজা, না চাহে খাজা গজা,

এক ধামা মুড়ি রাজা চাহিল।

(গান থামিয়ে) এমনই রাজা, যে মুড়ি ছাড়া কিছু চান না।

হলুদ ধুতি। সত্যি কথা মুড়ি ছাড়া তিনি কিছু খান না।

গোলাপি ধুতি। ধরো হে গান ধরো, আজ এখনও কারো ঘুম ভ াঙল না, আমাদের কাজ ঘুম ভাঙানো।

নীল ধুতি। হ্যাঁ। হ্যাঁ, ঘুম ভাঙানিয়া গান করো। (করতাল বাজায়)

গোলাপি ধুতি। গান

কে দিবে রাজায় মুড়ি

তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি

ছোটোরানি, বড়োরানি,

এক আনি, দুই আনি

বলে আমি আনি, আমি আনি

আনিতে আনিতে তাই

ঠোকাঠুকি লাগিল,

ভোর অ হইল, বায়স অ ডাকিল,

রাজা মশায় জাগিয়া কি উঠিল?

হলুদ ধুতি। কারো ঘুম ভাঙেনি আজ।

নীল ধুতি। ঠিকই বলেছ, ওই দেখো সিংহাসনের প্রহরী দুটো কেমন ঘুমোচ্ছে।

[ তিনজন ডিঙি মেরে দেখতে থাকে, যেন পথ থেকেই দেখছে ]

গোলাপি ধুতি। ঘুমিয়েই আছে, দেখো মনে হচ্ছে স্বপন দেখছে।

নীল ধুতি। কী স্বপন?

গোলাপি ধুতি। সেটা ভেবে বলতে হবে।

হলুদ ধুতি। এত বেলা পর্যন্ত প্রহরীও ঘুমোয়, ঘণ্টাশোলের হল কী?

গোলাপি ধুতি। ভাবতে হবে।

নীল ধুতি। ভাবতে হবে না, আমি জানি। সবাই ঘুমোচ্ছে। কেননা কাল রাত্তিরে তো ঝড়-বিষ্টি হল খুব, ঠান্ডা ঠান্ডা ছিল রাতটা, তাই আর কি?

গোলাপি ধুতি। তাই কি?

নীল ধুতি। তাই-ই তো।

গোলাপি ধুতি। কী জানি, ভেবে দেখি।

নীল ধুতি। ভাবতে হবে না, আমার কথাই সত্যি।

হলুদ ধুতি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাইতো, শেষরাতে এমন ঝড়-বাদলা হল যে আমার ঘুমও ভাঙছিল না একটুও, তোমরা করতাল বাজিয়ে গান করে হাঁকাহাঁকি করলে, তাই তো জাগতে পারলাম।

নীল ধুতি। তাই তো, আমার ঘুম-ও তো ওই করে ভেঙেছে, তোমরা খোল বাজালে, আর কাকগুলো এমন হল্লা লাগাল, কাকা কাকা করে ডাকতে লাগল ভাইপোরা, ঘুম ভেঙে গেল, নাহলে কে জাগায়?

নীল ধুতি। তোমার ঘুম, ও গোলাপ চন্দর, ভাঙল কী করে?

গোলাপি ধুতি। ভেবে বলতে হবে।

নীল ধুতি। কেন, মনে নেই?

গোলাপি ধুতি। মনে হয় পড়ে গিয়ে ভাঙল।

হলুদ ধুতি। সে কী গো, ঘুম আবার পড়ে ভাঙে নাকি, একি মাটির কলসি, হাঁড়ি?

গোলাপি ধুতি। ভাঙে ভাঙে, পালঙ্ক থেকে পড়লে ভাঙে।

নীল ধুতি। ওই হো হো, তাই বলো (হাসতে থাকে)

হলুদ ধুতি। ভাগ্যিস তুমি পড়েছিলে, না হলে কে গাইত? নাও, নাও, গান আরম্ভ করো, রাজ্যের কেউ জেগে ওঠেনি মনে হয়। (গোলাপি ধুতি গান ধরে। সকলে গলা মেলায়)

গান

উঠোগো নগর অ বাসী,

কাকা জেঠা, মামা, মাসি

উঠোগো নগরবাসী।

জয় রাজা, রানি বলে,

তালি মারো খোল করতালে, (খোল করতাল জোরে বেজে ওঠে)

উঠোগো নগরবাসী,

রাজা, প্রজা, পিসে, পিসি…

উঠোগো….।

[ ঘুম ভাঙানিয়ার দল ধীরে প্রস্থান করতে থাকে। তারা চলে যেতে যেতেই সিংহাসনের দুই ধারের দুই প্রহরী জেগে ওঠে। একজন যদু, অন্যজন মধু ]

যদু। রাত ফুরোল না, এর ভিতরে ঘুম ভাঙানির দল কান ভাঙানি দিল।

মধু। (চোখ মুছতে মুছতে) মনে তো হয় রাত ফুরিয়েছে।

যদু। ঘুমই ফুরোল না, রাত ফুরোল!

মধু। আলো ফুটল কী করে?

যদু। ও তো চাঁদের আলো, চন্দর কিরণ।

মধু। তুই বড়ো ফালতু বকিস, দিনের বেলায় চাঁদের আলো থাকে?

যদু। হতেই পারে না, আমি আবার ঘুমিয়ে নিই।

মধু। অ্যাই অ্যাই ঘুমোবিনে, আমি একা পাহারা দেব না সিংহাসন।

যদু। আমি দেখতে পাচ্ছি ফটফটে জোছনা, জোছনা না হলে রাত্তিরে এত আলো হয়?

মধু। হয়, দিনের বেলায় জোছনা দরকার হয় না।

যদু। দেখ এখন কী সুন্দর চাঁদের আলোয় দশদিক ম-ম করছে।

মধু। তোর মুন্ডু, সূর্য উঠে গেছে।

যদু। তার প্রমাণ কী?

মধু। প্রমাণ! বাইরে তাকা, ওই দেখ।

যদু। কী দেখব, চাঁদের আলোয় সব পস্কার।

মধু। ওরে মুখ্যু, ওই দেখ, রাখাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। (আঙুল তুলে দূরে দেখায় মধু)

যদু। বই কই?

মধু। বই মানে?

যদু। ও কথা তো বইয়ে লেখা ছিল, ছোটোকালে পড়েচি, রাখাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে, শিশুগণ- আর মনে নেই।

মধু। আমারও মনে নেই, তুই দেখ ওই যে রাখাল যাচ্ছে।

যদু। দেখতে আমার বয়েই গেছে।

[ তখন ডাক ওঠে নেপথ্যে-রাজা মশায়ের ঘুম ভাঙিল। চারণ গায়ক তিনজন আবার প্রবেশ করে মঞ্চে ]

হলুদ ধুতি। গান

সকাল অ হইল, ফুল অ ফুটিল

রাজা মশাই ঘুম থেকে উঠিল।

রোদ অ উঠিল, স্বপন অ ভাঙিল

সোনার খাট থেকে রাজা নামিল…

[ গান গাইতে গাইতে করতাল খোল বাজাতে বাজাতে ঘুম ভাঙানিয়ার দল চলে গেল

মধু। ওই দেখ ঘুমভাঙানিয়ারা কী বলে গেল।

যদু। তা বটে, ওদের ঘুম যখন ভেঙেছে, কিন্তু আমার যে একেবারে বিশ্বাস হচ্ছে না মধুদা।

মধু। তাহলে ঘুমো।

যদু। ঘুমও যে পাচ্ছে না, এমন জোছনা রাত্তির।

মধু। চাঁদটা বরং দেখে আয়।

যদু। সিংহাসনে হাওয়া করবে কে তখন?

মধু। আমি তো আছি।

যদু। তুমি তো তোমার দিকটা করবে, আমার দিকটা?

মধু। যা না, দেখে আয় না চাঁদটা, একটুখানি সময় তো।

[ তখন ধামা হতে লালুরাম ভৃত্য প্রবেশ করে প্রায় ছুটতে ছুটতে ]

লালু। যদুদা, মধুদা, রাজামশায়ের ঘুম ভেঙে গেছে, তোমরা প্রস্তুত হও।

যদু। আমরা সবসময় প্রস্তুত, কিন্তু আজ বড়ো তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল, এখনও যে চাঁদ রয়েছে।

লালু। (ভ্রূ কুঁচকে) কী রয়েছে বললে?

যদু। চাঁদ। সকাল কি হল?

লালু। সকাল মানে, বিকেল হতে গেল, সুয্যি আকাশে হামলে পড়েছে, কুসুম কুসুম রোদ কখন যে গনগনে হয়ে উঠল।

যদু। সত্যি?

লালু। তিন সত্যি, রাজা মশায়ের কিরে, আমি যাই।

মধু। যাচ্ছিস কোথায়?

লালু। (হাতের ধামা দেখিয়ে) বুঝতে পারছ না?

মধু। মুড়িশালে?

লালু। ঠিক ধরেছ (কোমরে গোঁজা চাবি তুলে বাজায়) , এই হল মুড়িশালের চাবি, আজকে কোটালমশায়ের ঘুম ভাঙেনি এখনও, তাই চাবি আমার হাতে।

যদু। বা বা! এত চাবি!

মধু। কত তালা?

লালু। যত চাবি তত তালা, তারপর দোর খোলা।

যদু। রাজামশায় আমাদের কত ভালো।

মধু। মুড়ি খায় শুধু, তবু কত ভুঁড়ি!

যদু। খাজা, গজা খায় না রাজা।

মধু। খাজা, গজা খাই আমরা প্রজা।

লালু। রাজা খায় মুড়ি, মুড়ি আর মুড়ি, রানি খায় তাই চানাচুর কুড়মুড়ি। আমি যাই, হুকুম হয়েছে মুড়ি চাই এখনই, তোমরা দাঁড়িয়ে পড়ো, আজ দেরি হয়েচে কিনা, রাজা এখনই সভা শুরু করে দেবেন।

মধু। না খেয়ে?

লালু। এখেনেই খাবেন, আমি যাই, এত চাবি নিয়ে আমার শুধু ভয় করছে।

যদু। কীসের ভয়?

লালু। যদি চাবি হারায়, হারিয়ে গেলে কী হবে?

মধু। কী আর হবে তালা খোলা যাবে না।

লালু। তালা না খোলা গেলে কী হবে?

যদু। কী আর হবে মুড়ি আর পাবে না।

লালু। ওরে বাবা! চাবি আমার কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখব এরপরে, এখন ধুতির খুঁটে বেঁধে রেখেছি কষে।

যদু। চাবি যদি হারাবার হয় ওতেই হারাবে।

লালু। তার মানে?

যদু। মানে বলতে হলে একটা গল্প বলতে হয়, একবার চাবি হারিয়ে আমি সমস্ত দিন পথে পথে ঘুরেছি, ঘরে ঢুকতে পারিনি।

লালু। তাই! কী করে ঢুকলে?

যদু। আবার কী করে, চাবি দিয়ে তালা খুলে।

লালু। চাবি পেয়ে গেলে, কোথায় পেলে?

যদু। ওই তো চাবির মজা, তোমার জামায় যদি দুটো পকেট থাকে তবে এক পকেটে চাবি রেখে অন্য পকেটে খুঁজবে। যত খুঁজবে, খুঁজেই পাবে না, অথচ তুমি জানো না পাশের পকেটে চাবি আরামে ঘুমোচ্ছে, তুমি ভাবছ দু-পকেটই খুঁজছ, আসলে কিন্তু এক পকেটই বারবার দেখছ।

লালু। আমার তো পকেট নেই, খালি গা, জামাই নেই।

যদু। ওতে তো আরও ভয়, পকেট ছিল বলে চাবি পাওয়া গেছিল, না থাকলে কোন পকেটে থাকত?

[ কথাটা শুনে লালু হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে ]

মধু। দেখ যদু ভয় দেখাসনে, না গো লালু চাবি হারাবে না, যদি হারায় তবে তা খুঁজে দেবার লোকও পাবে।

লালু। কোথায় পাব?

মধু। আমি চিনি, আমার পিসের ছেলে হারানো জিনিস খুঁজে দেয়, মাটিতে ছুঁচ পড়লেও বের করে দেবে।

লালু। বাঁচালে মধুদা, বড়ো দায়িত্ব পেয়েচি, মুড়িশালের চাবি থাকে রাজার কাছে, তিনি কোটালকে দেন, আবার নিয়ে নেন। মুড়িশাল নিয়ে রাজার বড়ো ছুঁচিবাই, যাকে তাকে ঢুকতে দেন না। আজ আমাকে চাবি দিয়েছেন। যাই গো, রাজার খাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করা যাবে না।

[ লালু এগোয়, পিছন থেকে ডাক দিল মধু ]

মধু। দাঁড়াও গো লালু।

লালু। (ঘুরে) ইস, পেছন থেকে ডাকলে?

মধু। কোন তালার কোন চাবি জানা আছে?

লালু। না তো!

মধু। তাহলে যে, সমস্ত দিন লেগে যাবে তালা খুলতে।

লালু। তালে দৌড়ে যাই, আর দাঁড়াবনা, ওফ, কত উচুঁতে উঠে গেছে সুয্যি, রাজা আর কখন খাবেন?

[ লালু আবার এগোয়, পিছন থেকে ডাকে যদু ]

যদু। ওহে, একটু দাঁড়াও।

লালু। (ঘুরে) ইস, আবার পেছন থেকে ডাকলে, অযাততারা।

যদু। দাঁড়িয়ে যাও, বলি মুড়ি আনার সময় আকাশে তাকিয়ে খোঁজ নিয়ো তো, সুয্যি না চাঁদ?

লালু। দিনের বেলায় কি চাঁদ থাকবে? যদি থাকত তবে কি এমন হত যদুদা?

যদু। তুমি খোঁজটা নিয়ো ভালো করে, এইরকম করে দেখো (চোখের উপর হাতের তালু মেলে দিল যদু)

লালু। এই তিরিশটা চাবি দিয়ে তিরিশটা তালা খুলতে হবে, যাইগো, আর ডেকো না পেছন থেকে।

[ লালু এগোয়। তখন মধু ডাকে ]

মধু। আর একটা কথা, শোনো লালু।

লালু। আবার! তোমরা তো আচ্ছা আরম্ভ করলে।

মধু। বলছি কী রাজার মুড়ি আনার সময় আমাদের জন্যও একটু এনো।

যদু। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে খিদে পাচ্ছে, যদি সত্যিই সুয্যি উঠে থাকে তবে তো খিদে পেয়েই যাবে, আমরা কি মুড়ি পাব?

লালু। তোমরা তো আচ্ছা লোক! বলচি রাজার হুকুম হয়েছে মুড়ি নিয়ে যেতে, শুদুমুদু দেরি করিয়ে দিচ্ছ।

মধু। তুমি দাঁড়াচ্ছ কেন?

লালু। পেছন থেকে ডাকছ কেন?

যদু। যা যা বললাম একটু মনে রেখো লালুভাই, তুমি যাও, আর আমরা ডাকব না।

লালু। সত্যি ডাকবে না তো?

যদু। সত্যি, সত্যি, সত্যি, যাও যাও, চাবিটা এরপর হারিয়ে গেলে আমরাও মুড়ি পাব না।

লালু। বড্ড অলক্ষুনে কথা বল। (দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে)

যদু মধু। লালু… লালু…

[ লালু বেরিয়ে গেল। দুই প্রহরী খালি সিংহাসনের দুই পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়া করতে থাকে খালি সিংহাসনকে। ধীরে আলো নিভে যায়। নেপথ্যে হুংকার শোনা যায়- কোথায় মুড়ি, মুড়ি কই, হতভাগা লালুরাম গেল কোথায়, ছোটোরানি, বড়োরানি… ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ রাজা বসে আছেন। ক্ষুব্ধ, ক্ষুধার্ত, রাগী রাজা, তাঁকে পেছন থেকে হাওয়া করছে যদু-মধু। দুই রানি দুই পাশে, তাঁদের মুখ দুটি করুণ। রাজার সামনে বড়ো প্লেটে নানারকম খাবার, খাজা, গজা, জিলিপি, সন্দেশ ]

রাজা। মুড়ি কই, মুড়ি?

ছোটোরানি। এই আসছে। (ডিঙি মেরে বাইরে দেখে)

রাজা। সত্যি আসছে?

ছোটোরানি। আসবে মহারাজ, গরম জিলিপি দুটো খেয়ে জল খান।

রাজা। মুড়ি দাও, মুড়ি। লালু, অ্যাই লালু রায়।

বড়োরানি। খাজা আছে মহারাজ, বাদশাহি খাজা, খেয়ে জল খান।

রাজা। খবদ্দার, অন্য খাবার খাওয়ার কথা বলবে না, মুড়ি কই, মুড়ি?

ছোটোরানি। আসবে, একটু শরবত খেয়ে নিন রাজামশায়।

রাজা। ফেলে দাও, জানো না সকালে উঠিয়া আমি মুড়ি মুড়ি বলি।

বড়োরানি। জানি মহারাজ, আপনি শান্ত হন, মুড়ি আসছে।

রাজা। এখনও এল না কেন, এই তো মুড়িশাল দশ পা দূরে, মাত্তর তিরিশটা তালা খুলতে হবে, এক ধামা মুড়ি আনতে হবে। ছোটোরানি আমার ভয় করছে।

ছোটোরানি। কীসের ভয় মহারাজ?

রাজা। বড়োরানি, আমি একটা স্বপন দেখেছি।

বড়োরানি। কী স্বপন মহারাজ?

রাজা। ছোটোরানি সে খুব ভয়ানক স্বপন।

ছোটোরানি। না, না, ভয়ানক হবে কেন, স্বপন তো সুন্দর হয়।

রাজা। বড়োরানি আমার স্বপনে দত্যি এসেছিল।

বড়োরানি। দত্যি! ওরে বাবা, সত্যি?

রাজা। হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি, স্বপনে এক দত্যি। আমি দেখি কী সেই দত্যির এ্যাত্তো বড়ো হাঁ- (হাঁ করে)

ছোটোরানি। ওই টুকুন?

রাজা। না, না, খুব বড়ো, ধরো তার চোখ দুটো গোল, লাল, লাল, দাঁতগুলো মুলো মুলো, হাত দুটো হাতা হাতা, সে আমার মুড়িশালে ঢুকে …।

বড়োরানি। মুড়িশালে ঢুকে…

ছোটোরানি। কী করে ঢুকল?

রাজা। সেইটা তো কথা, কোটাল, কোটাল!

বড়োরানি। কোটাল থাক, আগে বলুন কী করে ঢুকল?

রাজা। আমিও তো তাই বলি, কী করে ঢুকল? দেখি কী সব মুড়ি সে নিজে খেয়ে নিচ্ছে, মুড়িপাহাড়ে নাচছে আর গাইছে।

বড়োরানি। গান?

রাজা। গান তো গান-কোথায় হয় মুড়ির ধান/ধান শুনতে শুনছি কান।

ছোটোরানি। এইটা গান?

রাজা। দত্যির গান-আরও শুনবে? মুড়ি মুড়ি মুড়ি,

বাড়বে আমার ভুঁড়ি

মুড়ি এক কুড়ি।

থুড়ি পাঁচ কুড়ি।

বড়োরানি। এর মানে?

রাজা। আমার চোখের সামনে দত্যি সব মুড়ি খেয়ে নিল।

ছোটোরানি। তিরিশটা তালা, তবু মুড়ি খেল?

রাজা। স্বপনে এসেছিল যে।

ছোটোরানি। স্বপনে এসেছিল তো কী, যখন স্বপন দেখছিলেন তখন কি মুড়িশালের তালা খোলা ছিল?

রাজা। মোটেই না।

ছোটোরানি। তবে এল কী করে, আর রাজবাড়িতে এত প্রহরী, দাসদাসী, তবু স্বপনে দত্যি এল?

রাজা। সত্যি এল।

বড়োরানি। স্বপন যে সত্যি হবে তার মানে নেই। লালু এখনই আপনার মুড়িশাল থেকে মুড়ি নিয়ে আসবে রাজামশায়।

ছোটোরানি। হ্যাঁ, বরং, একটু শরবত খান, কখন সকাল হয়েছে, কিছুই পেটে পড়েনি, আহা, আপনি যে রোগা হয়ে যাবেন রাজামশাই।

রাজা। মুড়িটা আসুক, মুড়ি না এলে আমি কিছুই খাব না, (ডাকে) লালু- লালুরাম-

ছোটোরানি। (ডিঙি মেরে দেখল) ওই আসছে।

বড়োরানি। (ডিঙি মেরে দেখল) হ্যাঁ আসছে, মুড়ি আনছে ধামা ভরে।

ছোটোরানি। মুড়ি জিলিপি খান তাহলে মহারাজ।

বড়োরানি। খাজা দিয়ে মুড়ি খান।

ছোটোরানি। গজা দিয়ে মুড়ি খান।

বড়োরানি। মুড়ি আর বোঁদে।

ছোটোরানি। এই রোদে! মুড়ি বোঁদে! বেলা কত হল বলো।

[ তখন কুঁজো হয়ে ভয়ে এতটুকুন লালু ঢুকল ধামা আর চাবি নিয়ে ]

রাজা। মুড়ি এল!

ছোটোরানি। দিয়ে ফেলো।

বড়োরানি। মুড়ি মুড়ি করছেন মহারাজ, এত দেরি কেন হল?

রাজা। মুড়ি ঢালো।

লালু। (কেঁদে) রানিমা, রাজামশাই, মুড়ি নেই।

রাজা। নেই!

লালু। না, নেই।

রাজা। সত্যি!

ছোটোরানি। তাহলে সেই দত্যি!

বড়োরানি। মুড়ি ছিল ঘর ভরতি!

লালু। মুড়ি নেই সত্যি, সত্যি।

[ শুনে রাজা বেদম রেগে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার কোমরে ছোটো তলোয়ার ঝুলছিল। স্যাঁৎ করে তলোয়ার বের করে আবার ঢুকিয়ে দিয়ে গর্জন করে উঠল ]

রাজা। কোথায় মুড়ি?

লালু। জানি না মহারাজ।

রাজা। ঘর ছিল তালাবন্ধ, কী করে ঢোকে দত্যি?

লালু। জানি না মহারাজ, আমি গেলাম ধামা আর চাবি হাতে, তখন আমাকে পিছন থেকে ডাকল।

রাজা। কে ডাকল?

লালু। একবার নয় তিনবার ডাকল।

রাজা। তিনবার! অযাতরা, কে ডাকল?

লালু। আমি যত বলি ডেকো না, তবু ডাকে।

রাজা। কারা ডাকে, কেন ডাকে?

[ যদু আর মধু ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে পাখার আড়ালে মুখ লুকোয় ]

লালু। আকাশে সুয্যি না চাঁদ তার খোঁজ আনতে বলে।

রাজা। কখন বলল?

লালু। এই তো যখন যাই।

রাজা। কী দেখেছ.? সুয্যি না চাঁদ?

লালু। দেখব কী মহারাজ, দেখছি মুড়ি নেই, মুড়িশাল হা হা করছে, তিরিশটা দরজা, তিনটে জানালা সব খোলা।

রাজা। কে খুলল?

লালু। জানি না।

রাজা। চাবি তোমার কাছে, অথচ দরজা খুলল আর কেউ?

ছোটোরানি। মহারাজ, আপনি বসুন, আমি জিজ্ঞেস করি।

রাজা। বসব কেন, রাজ্যটা আমার; আমার রাজ্যে আমার মুড়ি উধাও হয়ে যাবে! কোটাল, কোটাল, মনতিরি, মনতিরি, কে কোথায় আছ, সেনাপতি সৈন্য সাজাও, আজ হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা-

বড়োরানি। এইরে, মাথা গরম হয়ে গেছে রাজামশায়ের, ওরে জোরে বাতাস করো, শান্ত হন মহারাজ, শান্তি, শান্তি, শান্তি, বাতাস, বাতাস, বাতাস, বরফ, বরফ।

[ রাজা ধপ করে আসনে বসে পড়ল, চিৎকার করে হাঁপাচ্ছে ]

ছোটোরানি। বসুন মহারাজ বসুন, মুড়ির খোঁজ নিচ্ছি আমরা।

[ ছোটোরানি লালুকে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে খোঁজ নেয় ]

ছোটোরানি। দত্যির কথা তালে সত্যি?

লালু। দত্যির কী কথা?

ছোটোরানি। পরে শুনো, এখন কী হবে?

লালু। ধামা আর চাবি নিন রানিমা, আমি পালিয়ে যাই।

ছোটোরানি। পালাবে কেন?

লালু। আমার গর্দান যাবে, শূলে উঠতে হবে। (কেঁদে ফেলে)

[ তখন শান্ত রাজা আবার অশান্ত হয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে গর্জন করতে লাগল ]

রাজা। কোটাল, মনতিরি, প্রহরী, জলদি আও।

[ এবার কোটাল এল সত্যি। বড়ো গোঁফ, চোগা চাপকান। দেখলেই বোঝা যায় অকম্মার ঢেঁকি ]

কোটাল। মহারাজ এসে গেছি।

রাজা। কখন থেকে ডাকছি।

কোটাল। ঘুম ভাঙল দেরি করে, ঝড়-বৃষ্টির পর ঠান্ডা হল রাত্তিরটা।

রাজা। ওই সময়ে দত্যি এল, মুড়িশালে মুড়ি নেই, কোটাল তুমি থাকতে দত্যি এসে মুড়ি খেয়ে গেল সত্যি।

কোটাল। কে বলল মুড়ি খেয়ে গেল?

[ লালু প্রায় ছুটে এসে মাটিতে বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে। ধামা আর চাবি রাখল পাশে। জোড় হাত করে কোটালের দিকে চেয়ে থাকল ]

কোটাল। (চোখ পাকিয়ে) মুড়ি কই?

লালু। (কাঁপতে কাঁপতে) নেই।

কোটাল। নেই কেন?

কোটাল। যদু-মধু তোরা কী করছিলি?

যদু। সিংহাসনে হাওয়া।

কোটাল। নিয়ে যা একে, বন্দি করে কারাগারে ঢুকিয়ে দে।

লালু। (কেঁদে) হুজুর গো, মোর দোষ নাই, এরা মোর পিছু ডেকেছিল, তাই এই সব্বোনাশ হল।

মধু। (স্বগত) এইরে!

রাজা। সত্যি?

যদু। একদম না মহারাজ, আমরা ছিলাম সিংহাসনের পিছনে।

রাজা। ওকে পিছু ডেকেছিলি?

মধু। সিংহাসনের পিছনে ছিলাম মহারাজ, ওর পেছনে ছিলাম না যখন, ডাকব কী করে পেছন থেকে?

রাজা। মিথ্যেবাদী, নিয়ে যা ওকে কারাগারে।

যদু। ছি লালু, এমন কথা বললে কেন?

কোটাল। এখন বন্দি হোক, পরে দশ ঘা দেওয়া হবে।

[ লালুকে নিয়ে চলে যায় যদু, মধু

কোটাল। মহারাজ এবার তো হল।

রাজা। কী হল?

কোটাল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলাম, ধরা পড়ল চোর।

রাজা। কে চোর?

কোটাল। কেন ওই লালু।

রাজা। কী চোর?

কোটাল। মুড়ি চোর।

রাজা। লালু কি দত্যি?

কোটাল। দত্যি মানে?

রাজা। (গর্জন করে ওঠে) ধরে আনো মুড়িদত্যি, লালু কি ঘর ভরতি অত মুড়ি একটুখানি সময়ে সব খেয়ে নিতে পারে?

কোটাল। দত্যির কথা কে বলল মহারাজ?

রাজা। আমি বললাম, কোটাল ধরে আনো মুড়িদত্যি, নাহলে সব্বাইকে শূলে দেব, সব্বাই-এর গর্দান নেব।

কোটাল। কী সব্বোনাশ!

ছোটোরানি। লালুকে তালে ছেড়ে দিন মহারাজ।

রাজা। নেহি, আগে মুড়ি আসুক।

বড়োরানি। ওর কী দোষ?

রাজা। সবকো ফাটকমে ভর দেগা, মনতিরি, মনতিরি।

[ মন্ত্রী ঢুকে পড়ল। শীর্ণকায় মন্ত্রী সবসময় প্যাঁচ কষে ]

মন্ত্রী। এলাম মহারাজ।

রাজা। এতবড়ো কাণ্ড হয়ে গেল, ছিলে কোথায় তুমি?

মন্ত্রী। আজ্ঞে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল মহারাজ। কী হয়েছে?

রাজা। সব্বোনাশ হয়েছে।

মন্ত্রী। কী নাশ?

রাজা। মুড়ি নাশ, মুড়িশালের সব মুড়ি বিনাশ হয়ে গেছে মনতিরি।

মন্ত্রী। কোটাল।

কোটাল। বলুন মান্যবর।

মন্ত্রী। চোর ধরো।

কোটাল। একজন ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার।

রাজা। (গর্জন করে) চোর না, দত্যি ধরো কোটাল, মুড়িদত্যি নাহলে মনতিরি, কোটাল সবায়ের গর্দান যাবে। মনতিরি আমি ক্ষুধার্ত, সকাল থেকে খাই নাই।

মন্ত্রী। রানিমা এ কী হল?

ছোটোরানি। আপনারা দত্যি ধরুন, আমরা রাজামশায়কে দেখছি।

কোটাল। যাই তাহলে।

মন্ত্রী। আমিও যাই, দত্যি চাই, দত্যি চাই, দত্যিপনা হয়ে গেছে মুড়িশালে, দত্যি ধরে আনো কোটাল।

[ কোটাল, মন্ত্রীর প্রস্থান

ছোটোরানি। রাজামশাই, তাহলে জিলিপিটা খেয়ে নেন।

বড়োরানি। খাজাটা, গজাটা।

[ রাজা পায়চারি করছে, এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছে ]

ছোটোরানি। মুড়ি এলে খাবেন, এরপরে পিত্তি পড়ে যাবে মহারাজ।

বড়োরানি। আহা মুখ শুকিয়ে গেছে আপনার।

ছোটোরানি। ছাতু খাবেন মহারাজ, ছাতু?

বড়োরানি। চিঁড়ে খাবেন মহারাজ চিঁড়ে, ভেজে দেব?

রাজা। না, মুড়ি চাই।

ছোটোরানি। একটু শরবত খান, অনশনে আছেন। (গেলাস ধরল)

বড়োরানি। খাজাটা দাঁতে কাটুন। (খাজা বাড়িয়ে ধরল)

রাজা। নেহি খায়েঙ্গা।

ছোটোরানি। খায়েঙ্গা।

রাজা। নেহি।

বড়োরানি। আলবত খায়েঙ্গা, খাইয়ে মহারাজজি।

রাজা। নেহি খায়েঙ্গা, খাব না, খাব না, খাব না, মুড়ি আনো।

ছোটোরানি। আসবে মুড়ি, গজাটা খেয়ে নিন (রাজার মুখে গজা ধরে। রাজা ছিটকে সরে যায়)

রাজা। খাজা গজা বিষবৎ, মুড়ি আনো।

বড়োরানি। না, না, সরভাজাটা খেয়ে নিন।

রাজা। নেহি।

বড়োরানি। জরুর।

রাজা। নেহি, নেহি খায়েঙ্গা-

ছোটোরানি। জরুর, আলবাত খায়েঙ্গা! না খেলে নেহি ছাড়েঙ্গা-

[ মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেল ]

তৃতীয় দৃশ্য

[ রাজপথ। হেলেদুলে কেউ কেউ চলে যাচ্ছে। তাদের পরনে রঙিন ধুতি, গায়ে রঙিন জামা, তারা কেউ বেলুন নিয়ে যাচ্ছে। কেউ বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। কেউ চটপটি ব্যাং বাজনা কট কট করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে টিকিধারী পুরোহিত। সেই সময় এক ঢোলবাদক ঢুকল ঢোলে চাঁটি মারতে মারতে ]

ঢোলবাদক। দাঁড়াও, দাঁড়াও নগরবাসী।

[ দুজন দাঁড়াল ]

১ম নগরবাসী। খবর আছে?

ঢোলবাদক। জবর খবর, জবর খবর, খবর নিতে তৈরি হও। (ঢোল বাজায়)

২য় নগরবাসী। কী হল, মশার পিঠে চেপে হাতি চলল?

১ম নগরবাসী। নাকি জলে ভাসল পাথর-টাথর, আকাশ নেমে এল নীচে?

ঢোলবাদক। মুড়ি চুরি, মুড়ি চুরি, (ঢোলে চাঁটি মারে) শুনো গো নগরবাসী, রাজার মুড়িশালের সব মুড়ি চুরি হয়ে গেছে, তিরিশটা তালা খুলে, তিরিশটা দরজা খুলে…

১ম নগরবাসী। ওফ এই খবর!

ঢোলবাদক। এটা কি খবর না?

২য় নগরবাসী। খবর না গোবর, তিরিশটা দরজা খুলে হল কী?

ঢোলবাদক। (ঢোলে চা৺টি মারে) মুড়ি চুরি।

১ম নগরবাসী। ধ্যাৎ এ হয় নাকি, গোবরই সত্যি।

ঢোলবাদক। না, না, দত্যি, দত্যি, দত্যি। দত্যি এসে মুড়ি খেয়ে গেছে, রাজা উপোসে আছেন।

১ম নগরবাসী। কীসে আছেন?

ঢোলবাদক। উপোসে।

২য় নগরবাসী। ওরম আমরা কত থাকি, এই যে ভোরবেলায় পান্তা ভাত আর লেবুপাতা ডলে খেয়েছি, তারপর কি আর খেয়েছি?

ঢোলবাদক। রাজা কাল রাতের পর খাননি কিছু, রাজার মুড়ি চুরি। (ঢোলবাজায়)

১ম নগরবাসী। খেয়েচে কি না খেয়েচে কে জানে! রাজার কত কী খাবার, খাজা, গজা, রাবড়ি, দরবেশ, আমাদের সেই পান্তা ভাত আর লঙ্কা।

ঢোলবাদক। পান্তা ভাতে লঙ্কা- হা হা হা।

২য় নগরবাসী। হা হা করার কিছু নেই, যদি হাসো আমরা চলে যাব, খবর শুনব না।

ঢোলবাদক। (ঢোলে চাঁটি মারে) শুনো ভাই শুনো, পান্তা ভাতে লঙ্কা- হি হি হি, জোর খবর।

[ ঢোলবাদকের সম্বিত ফেরে ]

ঢোলবাদক। (জিভ কাটে লম্বা করে) এই যাহ! কী খবর নিয়ে এসে কী খবর বললাম? রাজার মুড়ি চুরি হল। চোর ধরতে পারলে (ঢোল বাজায়) চোর ধরলে দশধামা মুড়ি আর দশটা টাকা, দশটা গামছা।

১ম নগরবাসী। পুরস্কার?

ঢোলবাদক। হ্যাঁ, তার সঙ্গে আছে তিন গন্ডা জিলিপি এমনি এমনি, দেবেন ছোটোরানি। (ঢোলে চাঁটিঁ) আরও আছে, আজকে চত্তির মাসের লোটন ষষ্ঠীর দিন, এই উপলক্ষে দুই গন্ডা গজাও দিচ্ছেন বড়োরানি।

২য় নগরবাসী। মাত্তর?

ঢোলবাদক। তালে আরও আছে, পাঁচ গন্ডা কুচো নিমকি, দেবেন কোটাল মশায়।

১ম নগরবাসী। এ তো সামান্য খাবার।

ঢোলবাদক। আজ চত্তির মাসের অমাবস্যা, সেই উপলক্ষে মন্ত্রী দিচ্ছেন কাঁচকলা আর বেগুন।

২য় নগরবাসী। এই বললে ষষ্ঠী, এই বললে অমাবস্যা।

ঢোলবাদক। ষষ্ঠীও আজ, অমাবস্যাও আজ। শুনো গো নগরবাসী, রাজা মুড়িচোর না ধরতে পারলে, দেবেন ফাঁসি- শুনোগো নগরের লোকজন, মুড়িচোর ধরতে পারলে মুড়ি পাবে মণ মণ, সঙ্গে জিলিপি, সঙ্গে গজা, সঙ্গে নিমকি, সঙ্গে কাঁচকলা আর বেগুন তার সঙ্গে আরও আছে। (ঢোল বাজায়)

১ম নগরবাসী। থাকবেই তো, এতে হয়, মুড়িচোর ধরব বলে কথা, চিনতেই কত কষ্ট হবে।

ঢোলবাদক। আরও আছে, আছে আছে, সেনাপতি দেবেন কাঁচা আমড়া আর নুন, আরও আছে।

২য় নগরবাসী। সত্যি!

[ ঢোলবাদক ঢোল বাজাতে বাজাতে নাচতে থাকে ]

ঢোলবাদক। আরও আছে বলি, মুড়িচোর ধরবে যে, আরও আরও পাবে সে, কী পাবে?

১ম, ২য় বাসী। (একসঙ্গে) কী পাবে?

ঢোলবাদক। দশধামা মুড়ি, দশটা গামছা, দশটা টাকা, তিন গন্ডা জিলিপি, দুই গন্ডা গজা।

১ম নগরবাসী। গজাটা চার গন্ডা হলে হত।

ঢোলবাদক। ওহ, বড্ড ভুল করে দাও, কোন পর্যন্ত বলেচি?

২য় নগরবাসী। বোধ হয় জিলিপি।

১ম নগরবাসী। না, না, প্রথম থেকে বলো আবার, নাহলে বাদ যাবে কোনো খাবার।

ঢোলবাদক। (দ্রুত বলে) মুড়ি, গামছা, জিলিপি, গজা, নিমকি, আর কী কী পাবে, কাঁচকলা, বেগুন, আর কী যেন,

২য় নগরবাসী। পাকা আমড়া, কাঁচা নুন।

ঢোলবাদক। উহুঁ কাঁচা আমড়া আর পাকা নুন।

১ম নগরবাসী। ঠিক আছে, আর কী বলো।

ঢোলবাদক। (আহ্লাদে লাফ দেয়) কাঁচা তেঁতুল, পাকা তেঁতুল, মুড়িচোর ধরতে পারলে কাঁচা তেঁতুল, পাকা তেঁতুল দুই ঝুড়ি, সঙ্গে নুন ঝাল-

[ ঢোলবাদক ঢোল বাজাতে বাজাতে ‘কাঁচা তেঁতুল, পাকা তেঁতুল’ বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। আর পেছনে দুই নগরবাসীও হাঁটে ‘কাঁচা তেঁতুল পাকা তেঁতুল’ বলতে বলতে। ঢোলবাদক ও নগরবাসীরা যেদিকে প্রস্থান করে তার অপর দিক থেকে কোটাল এবং মন্ত্রী প্রবেশ করে হনহন করতে করতে ]

মন্ত্রী। ওই তো ঢোল সহরত হচ্ছে, সবাই জেনে যাচ্ছে।

কোটাল। কিন্তু চাদ্দিকে যে প্রহরী পাঠালাম, কেউ ফিরছে না।

মন্ত্রী। বসে বসে সবায়ের হাতে পায়ে জং ধরে গেছে কোটাল।

কোটাল। কী কাণ্ড বলুন দেখি মন্ত্রীমশায়, রাজা দাঁতে কিছুই কাটছেন না, এদিকে মুড়িচোর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মন্ত্রী। রাজা যা রেগে আছেন, পেলেই শূলে চড়াবেন।

কোটাল। কেন ওই লালুটাকে চোর মেনে নিলে রাজার কী অসুবিধে হত?

মন্ত্রী। সব ঝামেলা চুকেই যেত।

কোটাল। চাবি আর ধামা নিয়ে মুড়ি আনতে গেল ও, খবর দিল ও, তাহলে ওই যে চোর নয়, তার প্রমাণ কী?

মন্ত্রী। ওই যে দুই রানি, রানি নয় যেন শনশনি, ওঁরা বলচেন লালু কেন চোর হবে, রাজাও বলচেন তাই।

কোটাল। (দাঁত কিড়মিড় করে) লালু চোর হলে এতক্ষণে শূলে চাপানো হয়ে যেত।

মন্ত্রী। সব ঝামেলা মিটে যেত।

কোটাল। তাহলে আমি কী করি?

মন্ত্রী। গর্দান থাকবে না, তিরিশটা দরজা খুলে মুড়ি নিয়ে গেল, ছি, ছি, ছি!

কোটাল। সব দিকে লোক পাঠিয়েছি-

মন্ত্রী। ছ্যা, ছ্যা, ছ্যা!

কোটাল। প্রহরী গেছে বাছা বাছা।

মন্ত্রী। ঠিক, ঠিক, ঠিক।

কোটাল। উত্তর, দক্ষিণ, পুব, পশ্চিম, সবদিক, সবদিক।

মন্ত্রী। (নাকে উত্তরীয় চাপে) গন্ধ, গন্ধ, গন্ধ!

কোটাল। কাকে যে করি সন্দ?

[ তখন একটা ডিগডিগে লোক প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকে, মাটিতে সে কী যে খুঁজছে। তার পিছনে পুরোহিতমশায়, মাথায় তাঁর লম্বা টিকি ]

মন্ত্রী। কে রে রে রে, তুই কেরে?

কোটাল। মাটিতে খুঁজিস কী রে, কী খুঁজিস কী রে?

পুরোহিত। টিকির ফুল খোঁজে নিধিরাম সর্দারে।

মন্ত্রী। পন্নাম পুরুতমশায়, এ কে?

পুরোহিত। নিধিরাম।

মন্ত্রী। কী করে?

পুরোহিত। ফুল খোঁজে।

মন্ত্রী। মাটিতে ফুল ফোটে?

কোটাল। ফোটে ফোটে, ভুঁই চাঁপা ফোটে।

মন্ত্রী। তুমি চুপ করো, কোটাল চোর খুঁজে আনো।

কোটাল। আপনি বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন মন্ত্রীমশায়, চোর তো আপনারও ধরার কথা।

পুরোহিত। ওফ, কী বলেন, সরেন সরেন, নিধিরাম ফুল খোঁজে, আমার টিকির ফুল। (টিকি দেখায়)

কোটাল। টিকির ফুল মানে?

পুরোহিত। মানে টিকির ফুল, এই টিকিতে যে ফুল ছিল?

কোটাল। টিকিতে ফুল ফোটে, ও মন্ত্রীমশায়, টিকিতে কি ফুল ফোটে?

পুরোহিত। আচ্ছা বুদ্ধু তো, মন্ত্রীমশায় ইনি কে?

মন্ত্রী। কোটাল, কোটাল।

পুরোহিত। কোটালে কী বলে?

মন্ত্রী। কোটালের এখন মাথার ঠিক নাই, রাজার মুড়ি চুরি হয়েছে জানেন তো?

পুরোহিত। ঢোল সহরত শুনলাম, খুঁজে পেলে নাকি কাঁচা আমড়া, কাঁচা তেঁতুলও দেবে?

[ হামাগুড়ি দিয়ে ফুল-খোঁজা নিধিরাম মাথা তোলে ]

নিধিরাম। তেঁতুল, পাকা না কাঁচা?

পুরোহিত। কাঁচা, পাকা দুই-ই, তুই খোঁজ বাবা, ও আমার মন্তরপড়া ফুল, হারানো মানে সব্বোনাশ।

নিধিরাম। এই তো পেয়েছি। (হাতের মুঠো থেকে সাদা ফুল বের করে)

পুরোহিত। (আপ্লুত) সত্যি পেয়ে গেলি?

নিধিরাম। না পেলে খুঁজছিলাম কেন?

পুরোহিত। সত্যি সেই ফুল তো?

নিধিরাম। তাহলে খুঁজতে বললে কেন?

পুরোহিত। (ফুলটি নিয়ে টিকিতে বাঁধতে বাঁধতে বলে) নিধি, বেঁধে দিবি?

কোটাল। (এগিয়ে এসে) বাঁধা-টাঁধা পরে হবে পুরুতমশায়, এই যে নিধিরাম তুমি কি সেই নিধি?

[ নিধিরাম ফুল বেঁধে দিতে থাকে পুরোহিতের টিকিতে ]

নিধি। কোন নিধি?

কোটাল। হারানো ছুঁচও যে খুঁজে পায়, সেই নিধিরাম?

নিধি। আমি তিনিই বটে।

মন্ত্রী। তবে তো হয়ে গেল।

পুরোহিত। কী হয়ে গেল?

মন্ত্রী। নিধিরাম, চোর খুঁজে আনো।

কোটাল। আপনি বলছেন কেন মন্ত্রীমশায়, আমি বলব, ওহে নিধিরাম এদিকে এসো।

মন্ত্রী। না, না, নিধিরাম এদিকে আয়।

পুরোহিত। তাহলে আমি যাই।

কোটাল। নিধিরাম আমার কাছে এসো।

মন্ত্রী। না আমার কাছে।

[ মন্ত্রী ও কোটাল দুইজনে নিধিরামের দুই হাত ধরে টানাটানি করে। সেই ফাঁকে পুরোহিত চলে যেতে থাকে ]

নিধিরাম। চলে গেল, চলে গেল।

মন্ত্রী। কে গেল?

নিধি। উনি, পুরুতমশায়, টাকা দিল না, খাটনির টাকা দিল না পুরুতমশায়।

[ পুরোহিত দৌড়ে বেরিয়ে যায়

কোটাল। পুষিয়ে দেব, তুই চোর ধরে আন।

নিধি। না না, টাকা দিল না।

মন্ত্রী। পরে পাবি, আমরা দিয়ে দেব, শোন নিধিরাম, রাজার মুড়ি চুরি হয়েছে, চোর খুঁজতে হবে।

কোটাল। না না, শোন নিধিরাম, মুড়িশালের সব মুড়ি চুরি হয়েছে, চোরকে খুঁজে আন।

মন্ত্রী। না না, আমার কথা শোন।

কোটাল। ওফ, এটা আমার কাজ, চোর ধরে কোটাল।

মন্ত্রী। ও!, ব্যাপারটা চোরের না, দত্যির! দত্যি বড়ো। কাজেই মন্ত্রী! মন্ত্রী বড়ো কোটাল ছোটো।

কোটাল। কে বলেছে, কে বলেছে?

মন্ত্রী। রাজা বলেছে।

কোটাল। না, কোটাল বড়ো মন্ত্রী ছোটো, এও বলেছে রাজায়।

নিধিরাম। আমায় ছাড়ুন মন্ত্রীমশায়, কোটাল মশায়।

কোটাল। ছাড়ব, তবে কাজটা করে দিতে হবে।

মন্ত্রী। আমার কাজটাও, ধরতে হবে মুড়িদত্যি।

[ নিধিরাম এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় ]

নিধিরাম। কী দেবেন?

কোটাল। সব দেব।

মন্ত্রী। অনেক দেব।

নিধিরাম। কী চাই?

মন্ত্রী। দত্যি চাই।

নিধিরাম। তাহলে যাই।

কোটাল। চোর যেন পাই।

নিধিরাম। কাঁচা তেঁতুল, পাকা তেঁতুল যেন খাই।

মন্ত্রী। পাবি, দত্যি চাই, আগে দত্যি চাই।

নিধি। (দৌড়ে গেল) যাই আমি দত্যি আনতে যাই।

[ নিধিরাম চলে যায়

কোটাল। তাহলে তো হয়ে গেল।

মন্ত্রী। হয়ে গেল মানে?

কোটাল। চোর পাওয়া গেল।

মন্ত্রী। পাওয়া গেল মানে?

কোটাল। যে ছুঁচ হারালে, টিকির ফুল হারালে খুঁজে পায়, সে কি চোর খুঁজে পাবে না?

মন্ত্রী। চোর কি হারিয়েছে?

কোটাল। না হারালে খুঁজছি কেন?

মন্ত্রী। তোমার যা বুদ্ধি, তোমার এবার কোটালগিরি ছাড়া উচিত।

কোটাল। আপনি বড়ো প্যাঁচালো, আপনি কি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরেন?

মন্ত্রী। তোমার বুদ্ধি পাকেনি, দত্যি আর চোর এক হল যে নিধিরাম ধরে আনবেই?

কোটাল। এই টুকুন ছুঁচ খুঁজে পায় যে সেকি একটা ইয়া বড়ো চোর খুঁজে পাবে না?

মন্ত্রী। তুমি যে ছুঁচ আর গায়ে গত্তি আনা দত্যি এক করে দিলে! এই বুদ্ধি?

কোটাল। আপনার চেয়ে আমার বুদ্ধি বেশি।

মন্ত্রী। মোটেই না।

কোটাল। মোটেই হ্যাঁ।

মন্ত্রী। তুমি নিরেট, কাজ না করে করে তোমার সব গেছে।

কোটাল। খবদ্দার।

মন্ত্রী। খবদ্দার! মুড়িশালে চুরি হল কেন, তোমার দেখার কথা না?

কোটাল। আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।

মন্ত্রী। যেখেনে ইচ্ছে যাও।

কোটাল। কোথাও যাচ্ছি না, রেগে যাচ্ছি।

মন্ত্রী। আমি রাজসভায় যাচ্ছি, যাও দত্যি খুঁজতে যাও।

কোটাল। মন্ত্রীমশাই, আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি।

মন্ত্রী। যাও যাও, (হনহন করে হাঁটতে থাকে মন্ত্রী) যাই রাজসভায়।

কোটাল। আমিও যাব।

মন্ত্রী। না যাবে না, দত্যি খুঁজতে যাও।

[ মন্ত্রী কোটালের কলহের ভিতর মঞ্চ অন্ধকার হয় ]

চতুর্থ দৃশ্য

[ রাজসভা। রাজা বসে আছেন সিংহাসনে। রাজাকে দুই দিক থেকে যদু-মধু হাওয়া করছে। রাজার সামনে, কোনাকুনি দুই রানি দুটি টুলে বসে আছে। একপাশে কোটাল, একপাশে মন্ত্রী, কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে। রাজার সামনে মস্ত থালায় খাবার। ছোটোরানির হাতে শরবতের গ্লাস, বড়োরানির হাতেও শরবতের গ্লাস। রাজা রেগে টং হয়ে আছে ]

রাজা। না না না, এ সহ্য করা যাবে না, কোটাল বরখাস্ত হবে আজ।

মন্ত্রী। তা তো হবেই, তিরিশটা তালা বলে কথা।

রাজা। তুমিও বরখাস্ত হবে মনতিরি।

কোটাল। তা তো নিশ্চয়, দুজনেই দায়ী।

রাজা। (উঠে দাঁড়ায়) সব্বাইকে শূলে দেব।

ছোটোরানি। বসুন মহারাজ বসুন, বাদামের শরবত একটু মুখে দিন।

রাজা। দেব না, মুড়ি কই?

বড়োরানি। মুড়ির চাল আনতে পাঠানো হয়েছে মহারাজ।

রাজা। মুড়িচোর সে দত্যি কই?

ছোটোরানি। তাকেও আনা হচ্ছে মহারাজ।

রাজা। সব মিথ্যে, মিথ্যে।

কোটাল। না মহারাজ, সত্যি, সত্যি।

রাজা। সত্যি না কাঁচকলা, কোটাল তোমার ফাঁসি হবে।

মন্ত্রী। হতেই পারে।

কোটাল। মন্ত্রীমশাই আমি কিন্তু সহ্য করছি না।

মন্ত্রী। তুমি তো কিছুই করো না, সহ্য করবে কী করে?

কোটাল। মহারাজ, মন্ত্রীমশাই আমাকে আপমান করছেন।

রাজা। উনি তো কিছুই করেন না, অপমান করবেন কীভাবে?

ছোটোরানি। মহারাজ, বেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে, এবার কিছু মুখে দিন।

বড়োরানি। লেবুর শরবতটা খেয়ে অনশন ভাঙুন মহারাজ।

রাজা। এত সৈন্যসামন্ত, এত কোটাল, মনতিরি, তবু আমার মুড়ি চুরি হয়ে যাবে, চোর ধরা যাবে না!

ছোটোরানি। হবে মহারাজ, হবে।

রাজা। কী হবে? (পদাঘাত করে মাটিতে)

ছোটোরানি। চোর ধরা হবে।

রাজা। আর কখন হবে? ও কোটাল, কখন হবে? ও কোটাল, তুমি এখেনে কী করছ? চোর ধরে আনো।

মন্ত্রী। ঠিকই তো কোটাল এখেনে কেন?

রাজা। তুমিও কেন, তুমি বলো কী করে চোর ধরা হবে, তোমাকে রেখেছি কেন মনতিরি?

মন্ত্রী। আজ্ঞে আমি মন্ত্রণা দিই।

রাজা। এই যে চুরি হল, কী মন্ত্রণা দিলে?

মন্ত্রী। চোর ধরতেই হবে।

রাজা। সে তো আমিও জানি, আর কী মন্ত্রণা দেবে?

মন্ত্রী। আর মন্ত্রণা … (ভেবে নিয়ে) রাজামশায় কিছু অন্তত খেয়ে নিন, না খেলে পেটে পিত্তি পড়ে আর এক চিত্তির।

রাজা। তুমি খুব চালাক মনতিরি। কোটাল, কোটাল, মনতিরি আমাকে খেতে বলছে, মনতিরিকে শূলে চাপাও।

কোটাল। এখনই মহারাজ, নিয়ে যাব? (মন্ত্রীর দিকে এগিয়ে যায়)

রাজা। দাঁড়াও, তুমি আগে শূলে চাপবে মনতিরি, এই অকম্মার ঢেঁকি কোটালকে কী করা হবে?

মন্ত্রী। শূলেই চাপানো হোক।

রাজা। ওকে শূলে চাপালে তোমাকে চাপাবে কে? কোটাল গিয়ে দেখে এসো মুড়ি চোরকে ধরা গেল কি না।

কোটাল। যাই মহারাজ।

[ প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে যায়

মন্ত্রী। বেঁচে গেল।

রাজা। বেঁচে গেল মানে?

মন্ত্রী। থাকলে তো শূলে চাপত।

রাজা। (ধমকে) তুমি কেন দাঁড়িয়ে, যাও দেখে এসো কী হল, আমি আর কতক্ষণ উপোসে থাকব?

মন্ত্রী। যাই মহারাজ। বেঁচে গেলাম।

[ মন্ত্রীর প্রস্থান

ছোটোরানি। মহারাজ, এবার কিছু খেয়ে নিন।

রাজা। কী করে নেব, আমি রেগে আছি।

বড়োরানি। এখেনে তো আর কেউ নেই, খেয়ে নিন।

রাজা। (গর্জন করে) চোর না ধরা পর্যন্ত উপোস, প্রতিজ্ঞা করেছি না।

ছোটোরানি। কেউ জানবে না মহারাজ, খেয়ে নিন, কখন চোর ধরে আনবে, আচ্ছা যদি চোর না ধরা পড়ে?

রাজা। সব্বাইকে শূলে চাপাব।

ছোটোরানি। সে তো হল, কিন্তু খাবেন না?

রাজা। না খাব না।

ছোটোরানি। চোরের উপর রাগ করে?

রাজা। রাগ হবে না! মুড়ি ছাড়া আমি আর কিছু খাই? স্বপনের ভিতরে দত্যি এসে মুড়ি খেয়ে যাবে!

বড়োরানি। আপনি বড্ড স্বপন দেখেন মহারাজ, স্বপন না দেখলে এমন ঘটনা কিছুতেই হত না।

রাজা। ঘুমের ভিতরে স্বপন এলে কী করব?

বড়োরানি। কাত হয়ে শোবেন, মহারাজ চোরের উপর রাগ করে উপোস দেবেন না, খাজা, গজা খেয়ে নিন, সন্দেশ, দরবেশ খেয়ে নিন।

ছোটোরানি। যা ইচ্ছে খেয়ে নিন, কেউ জানবে না।

রাজা। খাব?

ছোটোরানি। খেয়ে নিন না, কে জানছে?

রাজা। বলছ?

বড়োরানি। তাড়াতাড়ি করুন মহারাজ, খেয়ে হম্বিতম্বি করুন, না খেলে গলার জোর কমে যাবে, কোটাল, মন্ত্রী ভয় পাবে না।

রাজা। বলছ সত্যি?

বড়োরানি। হ্যাঁ মহারাজ, সকালে আপনার গলায় কত জোর ছিল, এখন কেমন মিইয়ে গেছে, খিদে কি পায়নি মহারাজ?

রাজা। খুব পেয়েছে, পেটে যেন গজ চলেছে রানি।

ছোটোরানি। হাতি মানে তো গজ, তাহলে গজা খেয়েই নিন, কোটাল, মন্ত্রী তো নেই, কে জানছে?

রাজা। তোমরা?

ছোটোরানি। আমরা! ঠিক আছে আমরা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকব, দেখবই না, খাচ্ছেন কি খাচ্ছেন না তা জানবই না।

রাজা। না, তোমরা চোখ বুজে থাকবে।

বড়োরানি। তাহলে খেয়ে নেবেন?

রাজা। তা বলব কেন?

ছোটোরানি। আচ্ছা বলতে হবে না, খেয়ে নিন মহারাজ, আহা মুখখানি শুকিয়ে গেছে, এমন হতচ্ছাড়া চোর, এক ধামা মুড়িও রাখেনি।

রাজা। (পদাঘাত করে) ঠিক বলেছ, শয়তান চোর এক ধামা মুড়ি রেখে দিলে কি এমন উপোসে থাকতে হত!

ছোটোরানি। ধরা পড়লে কান ধরে উঠ-বস করাবেন মহারাজ।

রাজা। করাব।

ছোটোরানি। নাকে খত দেওয়াবেন।

রাজা। দেওয়াব।

বড়োরানি। কানমলা দেবেন, কানমলা, পিঠে একশো কিল, আর এক গেলাস নিমপাতার ঝোল।

রাজা। নিমপাতার ঝোল! কী তেতো না, না! ওটা খাব না।

বড়োরানি। বালাই ষাট, আপনি কেন খাবেন, ওই চোর খাবে, নিমপাতার ঝোল, একশো লঙ্কার আচার।

রাজা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই খাবে, দুষ্টু চোর!

ছোটোরানি। তাহলে এবার খেয়ে নিন।

রাজা। খাব, কী করে খাই- (যদু -মধুকে) তোরা এখানে কী করছিস?

যদু-মধু। বাতাস!

বড়োরানি। যা, চোর খুঁজগে যা!

যদু। রাজামশাই খাবার সময় বাতাস করব না!

ছোটোরানি। কে বললে রাজামশাই খাচ্ছেন! উনি রাগ করেছেন না?

বড়োরানি। চল, আমাদের বাতাস করবি। ওধারে চল…

[ দুই রানি খাবারের থালা এগিয়ে দিয়ে শরবতের গেলাস দুটি টেবিলের দুই পাশে রেখে চোখে চোখে ইশারা করে, রাজামশায়কে খেতে ইঙ্গিত করে বেরিয়ে যায় ]

রাজা। (খাবারের দিকে তাকিয়ে।) কতবড়ো গজা, গজা না বাদামভাজা, সেই যে পড়েছিলাম, কী পড়েছিলাম- রোদে রাঙা বাদামভাজা, খাচ্ছে তবু গিলছে না… (এগিয়ে যায়) বাহরে বেশ তো। সবগুলো আমার পেটে ঢুকতে চাইছে (তাকিয়ে হাসে), পেটের ভিতর চলছে হাতি, হাতি তোর গোদা পায়ে নাথি… পেটের ভিতর আগুন জ্বলছে… দুষ্ট চোর, পাজি চোর, হাতির কান ভাজা খা, ঘোড়ার লেজ খা, ছাগলের শিং খা তুই, পিঁপড়ের ঝোল খা, নিমপাতা খা, লঙ্কা খা, নুন খা, উচ্ছে খা, করলা খা, কচু খা, কচু খেয়ে তোর গলা ধরুক, ওল খেয়ে তোর গাল ধরুক… (খাবারের থালায় হাত দেয়) সব খাবার আমার, এই খাজা আমার, গজা আমার, সন্দেশ, রসগোল্লা, নিমকি, লাড্ডু সব আমার, খেয়ে নিলেই হল, এই যে শরবত (গেলাস তুলে ধরে), এই যে বাদামের শরবত, আমার, এই যে নেবুর শরবত, এও আমার, খেয়ে নিতেই পারি, বাদামের শরবত, নেবুর শরবত কী যে ভালো! রানিরা কত দেয় আমাকে, ইচ্ছে হলেই খেতে পারি, কিন্তু খাব না (খাবারের এটা ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। জিভ দিয়ে জল ঝরে যায় এমন অবস্থা।)। খাব না, খাব না, জিভ দিয়ে জল পড়লেও খাব না, আগে চোর ধরো, তারপর খেতে বলো, আমি ঘণ্টাশোলের রাজা, রাজা বলে কথা, আমি কি চুরি করে খেয়ে নেব? নেব না, নেব না, তোদের আমি এখন খাব না, ওরে খাজা, ওরে গজা, ওরে সরভাজা, আমি ঘণ্টাশোলের রাজা… (হাতে একটি মিষ্টি তুলে) এই যে গজা, গজানন, তুই কি গজ-এর সঙ্গে আ, তারমানে হাতির সঙ্গে আ, তুই কি হাতি, হি হি গজা যদি হাতি হয় আমি তবে কী? (গজাটা মুখের সামনে এনেও না খেয়ে থালায় রেখে দেয়) পেটে খিদে থাকলে মাথার গোলমাল হয়ে যায়, গজা হয়ে যায় গজানন, গজানন মানে গজের মুখ, মানে হাতির মুখ, আবার গজা মানে গজানো, যেমন আমার দাড়ি, দাড়ি গজায়, মাঠে ঘাস গজায়…. আমি এসব কী বলছি, খিদেয় আমার মাথা খারাপ, রানি, রানি, রানি, ছোটোরানি, বড়োরানি, চারানি, আটানি, চোর কই চোর, চোর না হলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে, এই যে গজা, এই যে সরভাজা, এসব নিয়ে কী করবে রাজা? গজা মানে যদি দাড়ি গজানো হয়, তবে কি আমি দাড়ি খাব, ছোটোরানি, বড়োরানি, কোটাল, মন্ত্রী সব গেলে কোথায়, চোর ধরতে গিয়ে আমায় একা রেখে গেলে, এখন যদি আসে দত্যি, সত্যি, সত্যি (পায়চারি করতে থাকে। বিহ্বল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। খাবারগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, আবার পিছিয়েও আসতে থাকে।) আমার ভয় করছে, আমি খাজা গজা সরভাজা খাব, নাকি সরভাজারা আমাকে খেয়ে নেবে, রানিরা গেল কোথায়? কোটাল, কোটাল, মন্ত্রী, মন্ত্রী, রানি, রানি…।

[ দুই রানি দ্রুত পায়ে ঢোকে ]

বড়োরানি। খাওয়া হয়ে গেল, খেয়েচেন তো মহারাজ?

ছোটোরানি। সরভাজা না সন্দেশ, শরবত খেয়েচেন মহারাজ?

রাজা। চোওপ, আর খাওয়া খাওয়া করবে না। যদি ইচ্ছে হয় তোমরা খেয়ে নাও, আমার চোর ছাড়া খাওয়া হবে না। চোর চাই, চোর চাই।

ছোটোরানি। একা হয়েও খেলেন না মহারাজ?

বড়োরানি। একী হল রাজামশাই! (কেঁদে ফেলে)

ছোটোরানি। মাথার গোলমাল হয়ে গেল গো, মুড়ির শোকে না খেয়ে খেয়ে মরে যাবে ঘণ্টাশোলের মহারাজ।

বড়োরানি। সন্ধে হয়ে এল।

ছোটোরানি। চোর ধরা গেল না।

বড়োরানি। রাজা কিছুই খেল না, দুটো বাতাসাও না।

ছোটোরানি। না খেয়ে খেয়ে রাজা রোগা হয়ে যাবে।

বড়োরানি। না খেয়ে খেয়ে রাজা পাগল হয়ে যাবে।

ছোটোরানি। এখন কী হবে?

বড়োরানি। কোটাল, মন্ত্রী আসুক। (গালে হাত দেয় দুই রানিই)

রাজা। (বিড়বিড় করতে করতে পায়চারি করে) মুড়ির বদলে গজা, মানে নাকের বদলে নরুন, বললেই খেয়ে নেব, খেয়ে নিলেই হল, আমি খাব না, খাব না, খাব না, এরপর যদি খেতে বলে রানিরা, ওদের শূলে চাপাব, কারাগারে বন্দি করে রেখে দেব। কোটাল, কোটাল, মন্ত্রী, মন্ত্রী, কাকে যেন কাজে লাগিয়েছিল চোর খুঁজতে, কী হল তার?

ছোটোরানি। কিছু বলছেন মহারাজ?

রাজা। সেই যে নিধিরামের কথা বলল, নিধিরাম সর্দার, যে হারানো ছুঁচও খুঁজে পায়, চোর খুঁজে পাবে, বড়ো আহ্লাদ করে বলছিল যে মন্ত্রী, কোটাল!

[ তখন আগে কোটাল, পেছনে নিধিরাম, তার পেছনে মন্ত্রী, তার পেছনে যদু ও মধু, প্রবেশ করে রাজসভায় ]

রাজা। পাওয়া গেছে, কোটাল পাওয়া গেছে?

কোটাল। চেনা গেছে, চেনা গেছে, শুধু চেনা গেছে।

রাজা। চেনা গেছে?

কোটাল। মহারাজ এই যে নিধিরাম সর্দার, চিনেছে এই লোক।

রাজা। চোর কই, চোর কই?

নিধিরাম। পন্নাম হই মহারাজ, চিনেছি তবে চোর দেখতে পাইনি।

রাজা। (হতাশ হয়ে) কী করে দেখবে, যে চোখে ছুঁচ দেখতে পায়, সে চোর দেখবে কী করে, ছোটো জিনিস দেখে দেখে বড়ো জিনিস দেখে চেনাই ভুলে গেছে, পারবে কী করে? নিকালো।

কোটাল। মহারাজ শান্ত হন।

রাজা। চোর না হলে শূল, মনতিরি, চোর দাও, চোর।

মন্ত্রী। মহারাজ একটু শান্ত হন।

রাজা। আর কত শান্ত হব, ভোর রাতে চুরি হল মুড়ি, স্বপনে এল দত্যি, সমস্ত দিন গেল, সন্ধে হয়ে গেল, এখনও চোর পেলে না, লজ্জা করে না কথা বলতে।

মন্ত্রী। কথা বলতেই হবে মহারাজ, চোর চেনা গেছে।

রাজা। ধরা গেছে?

মন্ত্রী। না মহারাজ।

রাজা। চেনা গেছে, ধরা যায়নি, তার মানে? মশকরা হচ্ছে আমার সঙ্গে?

নিধিরাম। (নিচু হয়ে) না মহারাজ, আমি তো ছোটো জিনিস খুঁজে পাই, ছুঁচ হারালেও খুঁজে পাই, আমি সমস্ত দিন নগরে মাথা নামিয়ে ঘুরেছি। (নিচু হয়ে হামাগুড়ির ভঙ্গি করে ঘুরতে থাকে)

রাজা। এটা কী হচ্ছে, চোর কি ছুঁচ যে ওইভাবে ধরা যাবে?

নিধিরাম। জানা গেছে, কিন্তু তার আগে একটা কথা, মহারাজ চাবি ছিল কার কাছে, কাল রাতে?

রাজা। কেন আমার কাছে।

কোটাল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাতে তো চাবি মহারাজই নিলেন।

নিধিরাম। (জোড় হাত করে) অপরাধ নেবেন না মহারাজ, কাল রাতে আপনি মুড়িশালে মুড়ি খেতে গিয়েছিলেন?

রাজা। গিয়েছি তো, আমার মুড়িশাল, আমি যাব না?

নিধিরাম। যাবেন, যাবেন, তিরিশটা তালা খুলবেন, জানালা খুলবেন, মুড়িও খাবেন।

রাজা। তাই বলে মুড়ি চুরি হবে? এরাজ্যে সবাই দরজা খুলে ঘুমোয়, কারো ঘরে কখনো চুরি হয়?

নিধিরাম। হয় না, চোর সব পালিয়েছে। কোটাল মন্ত্রীর শাসন বড়ো কড়া- রাজাকেও সবাই ভয় করে, ঘণ্টাশোলের মহারাজা, রাজাধিরাজ ঘণ্টারাম রায়, তার রাজ্যে সমস্ত চোর নাম শুনলেই পালায়।

[ রাজা খুব খুশি। বড়ো বড়ো পায়ে বুক চিতিয়ে হাঁটেন ]

রাজা। ঠিক বলেচ নিধিরাম, তবে কেন মুড়ি চুরি হল?

নিধিরাম। মুড়িশালের জানালা দরজা বন্ধ করেছিলেন মহারাজ?

রাজা। বন্ধ করার কী আছে, এই রাজ্যে চোর আছে?

নিধিরাম। (হাসে) খোলা রেখে চলে এলেন?

রাজা। এলাম তো, কী হয়েচে তাতে?

নিধিরাম। তখন এল দত্যি।

রাজা। সত্যি, সত্যি, সত্যি।

দুই রানি। (একসঙ্গে) সত্যি, সত্যি, সত্যি।

নিধিরাম। কিন্তু সেই দত্যি নয় একরত্তি।

রাজা। সত্যি, সত্যি, সত্যি।

ছোটোরানি। কোথায় গেল দত্যি?

নিধিরাম। শুনুন রানিমা, রাজামশাই, মুড়িশাল ছিল তো মুড়ি ভরতি?

বড়োরানি। একদম সত্যি, সত্যি, ধরে আনো সেই দত্যি।

নিধিরাম। বলছি সব, শুনুন সবাই, আমাদের মহারাজা, রাজামশাই, কাল সন্ধেয় গেলেন মুড়িশালে, খুললেন তিরিশ তালাই। তারপর তো এলেন চলে, মুড়ি খেয়ে, আনন্দে নেচে নেচে। খেয়ালই নেই তিরিশ দরজা তিন জানালা খোলা থেকে গেচে। এমন সময়, মাঝরাত্তিরে এল সেই দত্যি, ঢুকল জানালা দিয়ে। মুড়িশালের মুড়ি যত, দিল এক ফুঁয়ে উড়িয়ে।

রাজা। জানালা দিয়ে ঢুকতে পারে দত্যি? তাহলে তার কতটুকু শক্তি?

নিধিরাম। খুব শক্তি, বললাম না সব মুড়ি একফুঁয়ে উড়িয়ে দিল, বলুন দেখি সে কে?

রাজা। কে?

নিধিরাম। রানিমারা বলুন দেখি ভয়ানক সে কে?

বড়ো ও ছোটো। (একসঙ্গে) কী জানি কে, কিছুই বুঝছিনে।

নিধিরাম। আমি তো শুধু মাটিই দেখতে পারি, মাটির ভিতরে চুল পড়লেও খুঁজে দিতে পারি। কোটালমশাই, মন্ত্রীমশাই তাই যখন বলল চোর খুঁজে দিতে, আমি নিধিরাম, আসলে এক বোকারাম, খুঁজতে লাগলাম মাটিতে। দেখি কত পিঁপড়ে, পোকামাকড়, হারানো সিকি, কানের মাকড়ি, নাকছাবি…

রাজা। (হেসে ফেলে) সত্যিই তুমি বুদ্ধুরাম নিধিরাম, ওইভাবে কেউ চোর খোঁজে! ওহে কোটাল, ওহে মনতিরি, এমন বুদ্ধি নিয়ে তোমার খবদ্দারি!

নিধিরাম। শুনুন রাজামশাই, তারপর কী হল-

দেখি ঘাসে ছড়িয়ে আছে, কী ওগুলো?

সাদা, যেন জুঁইফুল, ঘাসে ঘাসে ছড়িয়ে

ওই দেখে বুঝে গেছি কে গেছে হারিয়ে।

রাজা। কে? কে?

নিধিরাম। মুড়ি মুড়ি, কালরাত্তিরে আপনি এলেন চলে, জানালা-দরজা খুলে, তারপর তো এল হাওয়া, হল ঝড়।

রাজা। হ্যাঁ হ্যাঁ ঝড় ঝড়, আকাশ ডাকল কড়কড়।

নিধিরাম। খুব ঝড়, সেই ঝড় ঢুকল জানালা দিয়ে, বেরিয়ে গেল বড়ো দরজা দিয়ে, উড়িয়ে নিয়ে গেল সব মুড়ি, এই হল আপনার মুড়িচুরি।

রাজা। (চমকে গেছে ভীষণ) অ্যাঁ, কী বলো?

নিধিরাম। আসল এই হল।

রাজা। ও মনতিরি সত্যি?

মন্ত্রী। হ্যাঁ সত্যি।

রাজা। কোটাল?

কোটাল। হাওয়া, ঝড়, সেই হল আসল অপরাধী মহারাজ।

রাজা। আমার তো বিশ্বাস হয় না, মুড়ি সব উড়ে গেছে।

কোটাল। নগরের ঘাসে ঘাসে সব মুড়ি ছড়িয়ে আছে, চলুন মহারাজ দেখে নেবেন।

রাজা। তাহলে লালু মুক্ত।

মন্ত্রী। খবর পাঠাচ্ছি, লালু নির্দোষ প্রভুভক্ত।

রাজা। কিন্তু কোটাল, চোর ধরা গেল না, সমস্ত দিন আমার খাওয়া হল না।

কোটাল। হাওয়া যদি হয় চোর, কী করে তাকে হবে ধরা?

ছোটোরানি। মহারাজ, মহারাজ এবার খেয়ে নিন।

বড়োরানি। খাজা আছে, গজা আছে, আছে সরভাজা।

খেয়ে এবার উদ্ধার করুন ঘণ্টাশোলের রাজা।

রাজা। হ্যাঁ খাব, খাব তো বটেই, খিদেও পেয়েছে খুব, খেতে তো হবেই (পায়চারি করে বড়ো বড়ো পায়ে) শোনো কোটাল, শোনো মনতিরি, ঢোল-শোহরত করে দাও, রাজার হুকুম জানিয়ে দাও।

রাজা। কী হুকুম?

রাজা। রাজার হুকুম, আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে এই রাজ্য ঘণ্টাশোলে ঝড়বিষ্টির প্রবেশ নিষেধ, হুকুম না মানলে জরিমানা, ফাঁসি, শূলে-চাপা-সব হবে।

কোটাল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তো, ঠিক তো।

নিধিরাম। হাওয়া আসলে চোর তো, দত্যি তো।

রাজা। তাহলে হুকুম জারি করো-(দুটি হাত তুলে দুটি পা ফাঁক করে গজরাতে থাকে) হুকুম জারি হউক।

[ রাজার সঙ্গে সবাই হাত তুলে বলে, হুকুম জারি হউক। বেজে ওঠে ঢোল। ঢোলে চাঁটি মারতে মারতে মঞ্চে ঢুকে পড়ে ঢোলবাদক ]

ঢোলবাদক। হুকুম জারি, ঝড়, বিষ্টি হাওয়ার ঢোকা বন্ধ। বন্ধ, বন্ধ, বন্ধ! স-অ-ব বন্ধ, রাজা হুকুম দিয়াছেন।

[ ঢোলবাদক ঢোল বাজাতে বাজাতে, ঘোষণা করতে করতে উধাও। তখন প্রবেশ করছে সকালের ঘুম ভাঙানিয়ারা, প্রথম দৃশ্যে যারা ছিল ]

গোলাপি ধুতি। এখন আমরা ঘুম পাড়ানিয়া, রাজার হুকুম শুনেছি, ঝড়বিষ্টি বন্ধ, ওই যে ঢোল বাজিয়ে বলে যাচ্ছে ঢুলি এখন সন্ধেবেলা, রাজা ঘুমোবেন-

গান

সাঁঝ অ হইল, তারারা ফুটিল,

ঘণ্টারাম ঘুমাইতে যায় রে।

নিজের হুকুম শুনে রাজা, ভয়েতে হইল কাঁটা,

স্বপনের ভিতরে রাজা, কান্দে রে।

রাত হইল, আন্ধারও ছড়াইল

আন্ধারে রাজার বড়ো ভয় রে।

আসে গো সত্যি সত্যি

দাঁত উঁচু ইয়া দত্যি,

দত্যি তো সব মুড়ি খায় রে

ঘুমের ভিতরে রাজা কান্দে রে।

শুনুন সবাই, ঝড়বাদলা ঢুকবে না, কিন্তু রাজারও ঘুম হবে না, তার স্বপনে দত্যি আসা ঠেকাবে কে? কোটালে না নিধিরামে? নমস্কার, নমস্কার,

রাত অ হইল, ঘুমাইতে যাইল,

স্বপনে রাজা মুড়ি খায় রে…

আহা রাজা মুড়ি শুধু শুধু খায় রে ….

[ গানের ভিতরে পরদা নামে ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *