রাজার হয়েছে বাড়াবাড়ি
ধুন্দুভি রাজ্যের রাজামশাইয়ের হয়েছে এক বিতিকিচ্ছিরি সমস্যা।
মুশকিল হল, রাজামশাই নিজে বুঝতেই পারছেন না যে এটা একটা সমস্যা। ফলে সমস্যা বিতিকিচ্ছিরি থেকে মহা বিতিকিচ্ছিরি হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন এভাবে চললে মহা বিতিকিচ্ছিরি সমস্যা হয়তো সুপার মহা বিতিকিচ্ছিরি সমস্যা হয়ে যাবে। তখন হবে বিরাট কেলেঙ্কারি।
মন্ত্রীমশাই, সেনাপতি, রাজপণ্ডিত, রাজকোষের প্রধান হিসেবরক্ষক, রাজবদ্যি সবাই চিন্তিত। এমনকী রানিরও রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। দু:স্বপ্ন দেখেন। ঘুম ভেঙে যায়। সেই দু:স্বপ্নে রানি দেখেন, রাজামশাই তার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আছেন আর…। ঘুম ভেঙে রানিমা রাজপালঙ্কের ওপর ধড়ফড় করে উঠে বসেন। রাজামশাইয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েন। রাজামশাইয়ের ঠোঁটের কোণে কি মিটিমিটি হাসির অভাস? নাকি অট্টহাসির ভঙ্গি? নাকি ফিচফিচে হাসির ভাব? যে হাসিই হোক, হাসি তো বটেই! সর্বনাশ! ঘুমের মধ্যেও একই কাণ্ড!
আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। একটা কিছু করতে হবে। রাজামশাই যখন নিজের সমস্যা বুঝতে পারছেন না, তখন বাকিদের ভাবনাচিন্তা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঠিক হল মিটিং হবে। গোপন মিটিং। সবাই মিলে পরামর্শ করলে একটা পথ কি বেরোবে না? নিশ্চয় বেরোবে।
কিন্তু এতসব বড় বড় মানুষ মিলে গোপন মিটিং হবে কী করে? সে তো খুবই কঠিন ব্যাপার। মিটিং-এর খবর জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। মন্ত্রীমশাই, সেনাপতি, কোটাল, রাজপণ্ডিত, হিসেবরক্ষক, রাজবদ্যি তো আর যে-সে মানুষ নন। তারা রাজ্যের বড় বড় মাথা। রাজদরবার ছাড়া তারা অন্য কোথাও একসঙ্গে বসলে খবর ছড়িয়ে পড়বে। সেই খবর একসময়ে রাজামশাইয়ের কানেও চলে যাবে। তাঁকে নিয়ে গোপনে মিটিং হয়েছে জানলে রাজমশাই কি আর খুশি হবেন? মোটেও হবেন না।
আরও মুশকিল হয়েছে, খোদ মহারানি নিজে গোপন মিটিং-এ থাকতে চেয়েছেন। সে তো মস্ত ফ্যাচাং-এর ব্যাপার। মহারানিকে যদি রাজপ্রাসাদ থেকে বেরোতে হয় তাহলে প্রয়োজন বিস্তর আয়োজন। রানিমা তো আগড়ুম বাগড়ুম কেউ নন যে বেরোনোর দরকার হল আর ফট করে কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। তার জন্য এলাহি ব্যবস্থা লাগে। সে ঘণ্টা তিনেকের পথই হোক আর দশ মিনিটের পথই হোক আর রাজপ্রাসাদের পাশের গলিই হোক।
সবার আগে ফুল মালা, রঙিন কাপড়, জরি দিয়ে রাজপালকি সাজাতে হবে। সঙ্গে গাদাখানেক সখী, দাসী, পরিচালিকা, সহায়িকা, সঙ্গীসাথী লাগবে।
রাজপ্রাসাদ থেকে বেরোলেই রানির সঙ্গে থাকে প্রসাধন সেবিকা। সে ক্ষণে ক্ষণে রানির চুল আঁচড়ে দেবে, মুখের পাউডার ঠিক করে দেবে, কপালে চন্দন লাগিয়ে দেবে।
একজন পরনিন্দা-পরচর্চার সঙ্গীও চাই। পরনিন্দা, পরচর্চার ইংরেজি ডাকনাম হল পিএনপিসি। মহারানির যদি হঠাৎ পিএনপিসি করার ইচ্ছে হয় তখন কী হবে? তাই এই ব্যাপারে এক্সপার্ট একজনকে সবসময় সঙ্গে নিতে হয়। সে পালকিতে গুছিয়ে বসে পরনিন্দা করবে। এ বাড়ির ছেলেটা কেমন, ও-বাড়ির মেয়েটা কেমন—এইসব।
এ ছাড়া মহারানির সফরে চাই ঝগড়ার সাথী। হঠাৎ যদি রানির মনে হয়, পথে যেতে যেতে বোর লাগছে। কারও সঙ্গে কোমর বেঁধে খানিকটা ঝগড়া করলে বেশ হত। তখন সেই ঝগড়া-সাথীকে পালকিতে ডেকে নেওয়া হবে। ঝগড়ার ব্যাপারে রানির ছোটবেলার বন্ধু কুন্তলা দারুণ পোক্ত। সে যে-কোনও বিষয় ঝগড়া শুরু করতে জানে। হয়তো রানি বললেন, ‘পালকি বড্ড ঢিমে তালে চলছে রে কুন্তলা।’
কুন্তলা অমনি বলবে, ‘কী বলছিস! পালকি ঢিমে তালে চলছে? পাগল হলি? পালকি তো খুবই জোরে চলছে। মনে হচ্ছে ঘোড়ার গাড়িতে বসে আছি।’
রানি বললেন, ‘ঘোড়ার গাড়ি কত জোরে দৌড়োয় তোর জানা আছে? জীবনে ঘোড়ার গাড়িতে চড়েছিস?’
কুন্তলা মুখ পাকিয়ে বলবে, ‘কেন জানব না? ঘোড়ার গাড়ি কি কেবল তুই চড়িস। রাজপ্রাসাদের ঘোড়াগুলো ঘোড়া নাকি? সব রং করা গাধা।’
রানি অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি কি সেকথা বলেছি?’
কুন্তলা নাকের পাটা ফুলিয়ে বলবে, ‘আলবাত বলেছিস। একশোবার বলেছিস।’
রানি বলবেন, ‘ঝগড়া করছিস কেন?’
কুন্তলা চোখ ঘুরিয়ে বলবে, ‘ঝগড়া করার মতো কথা বলেছিস, তাই ঝগড়া করছি। ঝগড়া করবার মতো কথা বললে আমি কি তোর গলা জড়িয়ে ধরে আহারে উহুরে করব?’
রানি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলবেন, ‘তোর গলা জড়ানোয় আমার বয়ে গেছে।’
ব্যস, ঝগড়া লেগে গেল। এই কারণেই রানির ঝগড়া-সঙ্গী লাগে। গতবছর কুন্তলার অসুখ হয়েছিল। সে একমাস বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি। ঝগড়া করতে না পেরে সেই ক’টা দিন রানি যে কী মনোকষ্টে ভুগেছেন, বলবার নয়। তিনি নিজে রোজ কুন্তলার বাড়ি গিয়ে তার সেবাযত্নের তদারকি করতেন। রাজামাশাইকে বলে চিকিৎসার যাবতীয় খরচ রাজকোষ থেকে ধার্য করা হয়েছিল। এটা ছিল রাজকোষের ঝগড়া খাতে খরচ।
এ ছাড়াও পথে রানির সঙ্গে থাকে নাকি সুরের গায়িকা, কড়ি খেলবার বান্ধবী। খানিকটা পথ রানি হয়তো গান শুনতে শুনতে যাবেন। খানিকটা পথ খেলবেন কড়ি। তখন এদের পালকিতে তুলে নেওয়া হয়।
এ তো গেল শুধু রানির সঙ্গী। আরও লোক লাগে।
পালকি কাঁধে নেবে চার বেহারা। মজুত থাকবে আরও চার। দু-পাশে কম করে আটজন করে পাইক-বরকন্দাজ হাতে বল্লম, লাঠি, কোমরে তরবারি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটবে। এদের বলে ছুটনদার। মহারানির নিরাপত্তারক্ষী।
পালকির সামনে গোলাপ জল আর ফুল ছিটোতে ছিটোতে যাবে মালি কন্যা মালিনী। রানি তো আর যে-সে পথ দিয়ে যেতে পারবেন না। তার পথে ফুলের পাপড়ি আর গোলাপজল ফেলতে হবে। নগরের সবাই যাতে বুঝতে পারে, এই পথে রানিমা গেছেন।
সবার সামনে মোটা গোঁফওয়ালা মুসকো একজন চলবে, পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে। রাজপ্রাসাদ থেকে বেরোনোর আগেই সে গন্তব্য জেনে নেয়। এই লোক পথ চেনায় বলে তাকে বলা হয় ‘পথরু’।
সবমিলিয়ে একটা হুড়ুমদুড়ুম কাণ্ড। কোনও আয়োজন যে বাদ যাবে, সে উপায় নেই। রাজপরিবারের নিয়ম। সেই নিয়ম ফাঁকি দেওয়া যাবে না। এত কাণ্ড করে রানিমা কীভাবে গোপন মিটিং-এ যাবেন?
মন্ত্রী চিন্তিত মুখে বললেন, ‘রানিমা মিটিং-এ গেলে তো জানাজানি হয়ে যাবে। পথে সবার নজরে পড়বে।’
সেনাপতি মাথা চুলকে বললেন, ‘তা তো ঠিকই, কিন্তু তা বলে উনি যখন যেতে চেয়েছেন আমরা তো বাধা দিতে পারি না। তা ছাড়া আলোচনায় ওনার থাকাটা খুবই জরুরি। অন্দরমহলে রাজামশাইকে উনি সবসময় দেখেন। রাজামশাইয়ের সমস্যা তো সেখানেও হচ্ছে।’
কোটাল দাড়ি চুলকে চিন্তিত মুখে বললেন, ‘কথাটা ঠিক। রানিমাকে বাদ দিলে চলবে না। কিন্তু মিটিং হবে কোথায়?’
মন্ত্রীমশাই পাগড়ি ঠিক করতে করতে বললেন, ‘আমার বাড়িতে। আর কোনও উপায় নেই। রানিমাকে তো আর যে-কোনও জায়গায় বসানো যায় না। তার জন্য সিংহাসন লাগে। সবার বাড়িতে তো সিংহাসন নেই। চামরের পাখা লাগবে। হাত-মুখ ধোওয়ার জন্য রুপোর জলপাত্র লাগবে। এসব কোথায় পাব?’
রাজপণ্ডিত মাথার টিকি নাড়িয়ে বলল, ‘তা তো বটে। তা তো বটেই।’
রাজবদ্যির হল শ্লেলষ্মার অসুখ। নিজের তৈরি পাঁচন খেয়েও সে অসুখ তিনি ঠিক করতে পারেননি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘মিটিং কখন হবে?’
রাজকোষের হিসেবরক্ষক হিসেবের খাতা সামলাতে সামলাতে বললেন, ‘দ্বিপ্রহরেই হওয়া উচিত। ওই সময়টা রাজামশাই দিবানিদ্রায় ব্যস্ত থাকেন।’
সেনাপতি ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘বাপরে, হিসেবরক্ষক দেখছি, রাজামশাইয়ের ঘুমের হিসেবও রাখছে।’
হিসেবরক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, ‘কেউ যদি না রাখে আমাকেই তো রাখতে হবে।’
সেনাপতি তেড়েফুড়ে বললেন, ‘কেউ রাখে না কে বলল? যার নিদ্রার খবর রাখবার কথা সে রাখবে নিদ্রার খবর। তোমার রাজকোষের টাকাপয়সার হিসেব রাখবার কথা, তুমি রাখবে টাকাপয়সার হিসেব। অন্য হিসেব রাখতে গিয়ে তো আসল হিসেবে ভুল করবে।’
আসলে হিসেবরক্ষকের ওপর সেনাপতির রাগ হয়েছে। মাস কয়েক আগে তিনি হাজার খানেক নতুন তরবারি আর শ’ খানেক বল্লম তৈরির জন্য রাজামশাইয়ের কাছে আবেদন করেছিলেন। তরবারিতে ধার কমেছে। বল্লমে জং পড়েছে। তাই নতুন অস্ত্র চাই।
রাজামশাই আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রাজকোষে। অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। প্রধান হিসেবরক্ষক করেছেন আপত্তি। তিনি রাজামশাইকে জানিয়েছেন, যুদ্ধবিগ্রহ কিছু নেই, অস্ত্রের পিছনে খামোকা অর্থব্যয় অর্থহীন। সেনাপতি এতে গিয়েছিলেন বিরাট চটে।
‘হিসেবরক্ষক ব্যাটা স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা জানে। ও যুদ্ধের কী জানে? শত্রুরা আক্রমণ করলে ও বাঁচাবে? কী দিয়ে লড়বে? হিসেবের খাতা?’
সেই রাগ থেকেই হিসেবরক্ষকের সঙ্গে সেনাপতির ঠান্ডা লড়াই। সুযোগ পেলেই কেউ কাউকে খোঁচা দিতে ছাড়ে না। আজও দিয়েছে।
হিসেবরক্ষক চটেমটে বললেন, ‘আমি কী হিসেব রাখব তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা কীসের হে সেনাপতি? তোমার হল মোটা মাথা।’
মন্ত্রীমশাই হাত তুলে ধমক দিলেন।
‘অ্যাই চুপ করো তোমরা। রাজ্যের মহাসংকট। এখন আর নতুন করে নিজেরা গোলযোগ পাকিও না। তাহলে কালই দ্বিপ্রহরে আমার বাড়িতে গোপন মিটিং-এর আয়োজন করছি।’
কোটাল চিন্তিত ভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন, ‘হ্যাঁ, কালই করতে হবে। দেরি হয়ে গেলে বিপদ।’
মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘এভাবে রাজ্য চলতে পারে না। যা বলছি তাতেই রাজামশাই…।’
সেনাপতি কোমরে ঝোলানো তরবারির বাট চেপে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘রাজামশাই যদি সমস্যা থেকে বেরোতে না পারেন তাহলে সব যাবে।’
রাজপণ্ডিত বললেন, ‘আমরা ধনে প্রাণে যাব। হয় পথের ফকির হয়ে যাব। নয় শত্রুর হাতে বন্দি হয়ে বাকি জীবনটা কারাগারে নিক্ষেপিত হব।’
মন্ত্রীমশাই থমথমে গলায় বললেন, ‘রানিমাকে খবর দিই। তিনি যেন দ্বিপ্রহরে আমার বাসভবনে পৌঁছে যান। যতটা গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব ততটাই যেন করেন। যাত্রাপথে বাদ্যবাদ্যি যেন না বাজে।’
রাজবদ্যি গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘কী করে কী হবে কিছুই তো বুঝতে পারছি না। চেষ্টা তো কম করলাম না।’
মন্ত্রীমশাই বিরক্ত গলায় বললেন, ‘দুর, তুমি যে কেন রাজবদ্যি হলে তাই তো বুঝতে পারছি না। যাক, কাল মিটিং-এ সব কথা হবে।’
পরদিন গোপন মিটিং বসল। তবে মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে নয়। মহারানির ঝগড়া-সাথী কুন্তলার বাড়িতে। প্ল্যানটা মহারানির। শেষ মুহূর্তে মন্ত্রীমশাইকে খবর দিয়ে তিনি ‘ভেনু’ বদলেছেন।
অনুষ্ঠান, মিটিং, নেমন্তন্ন যেখানে হয় তাকে ইংরেজিতে বলে ‘ভেনু’। অন্য কোথাও যেতে গেলে ঢাক-ঢোল পেটাতে হবে। জানাজানি হবে। রাজা জেনে গেলেও বিপদ। কিন্তু কুন্তলা-সখীর বাড়িতে গেলে এই সমস্যা নেই। সেখানে চুপচাপ চলে যাওয়া যাবে!
এমন নয়, সে বাড়িতে এই প্রথম যাচ্ছেন, আগেও গিয়েছেন। কুন্তলার যখন অসুখ করেছিল, তখন কয়েকবার একা একা চলে যেতেন। তাই এবার রাজামশাই জানলেও ক্ষতি নেই। তিনিও ভাববেন, রানি সখীর কাছে গল্পগুজব করতে গেছে।
কুন্তলা খুব ভালো মেয়ে। সে কখনো তার বন্ধুর কাছ থেকে বাড়তি সুযোগ সুবিধে চায় না। বরং কিছু দিতে গেলে রাগ করে। তার অসুখের সময় রাজকোষ থেকে তাকে অর্থ সাহায্য করা হয়েছিল সেকথা রানি তাকে জানাননি। কুন্তলা রানিমাকে ‘মহারানি’ হিসেবে দেখে না, ‘সখী’ হিসেবে দেখে। সত্যি কথা বলতে কী, ঝগড়া-সখী হলে কী হবে, দুজনের গলায় গলায় ভাব।
গোপন মিটিং-এর জায়গা শুনে মন্ত্রীমশাইয়ের তো মাথায় হাত। কুন্তলাকে মহারানি খুব ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু কুন্তলা গরিব ঘরের মেয়ে। তার স্বামী অতি সামান্য কাজ করে। আট বছরের বালক পুত্র আর বরকে নিয়ে কুন্তলা যে বাড়িতে থাকে সেটি অতি সাধারণ। বাড়ি রাজপ্রাসাদের খুব কাছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে এতগুলো বড় মানুষের আপ্যায়ন কী করে সে করবে! কিন্তু একথা মহারানিকে বলবার সাহস তার আছে? তিনি সবই জানেন, এমন তো নয়, এই প্রথম তিনি তার ঝগড়া-সখীর বাড়িতে যাচ্ছেন। যাক, রানিমার যথা আজ্ঞা।
কুন্তলা ঘরের দরজা বন্ধ করে ছেলেকে বলল, ‘তুই এখানে টুল পেতে পাহারা দিবি। আমি রসুই ঘরে চললাম। এদের জন্য তো জলখাবার বানাতে হবে।’
ছেলে বলল, ‘এরা কারা মা?’
কুন্তলা হেসে ছেলের মাথার চুল ঘেটে বলল, ‘বড় বড় মানুষ সব। রাজামশায়ের চেনা লোক।’
ছেলের চোখ চকচক করে উঠল। বলল, ‘আমিও তাহলে বড় মানুষ মা। আমিও তো রাজামশাইকে চিনি। তুমি তো আমাকে মাঝে মাঝে রাজাবাড়িতে নিয়ে যাও। আমিও তো রাজামশাইকে কতবার দেখেছি। গোমড়া মুখো। বাঘের মতো হাঁড়ি মুখ। থম মেরে বসে আছেন। বাপরে, কী রাগী। মনে হচ্ছে নাক-মুখ দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে গরম নিশ্বাস ফেলছে। একটুও হাসি নেই। বাপরে!’
কুন্তলা বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি এখন এখানে বসে পাহারা দাও। যদি কোনও দরকারে ডাকাডাকি করে, তুমি যাবে। আমাকে খবর দেবে।’
কুন্তলার বালক পুত্র টুলের ওপর বসে পড়ল। ভিতরে চলতে লাগল মিটিং। গোপন মিটিং।
এই ফাঁকে রাজামশাইয়ের বিতিকিচ্ছিরি সমস্যার কথাটা চট করে বলে নেওয়া যায়।
রাজামশাইয়ের হয়েছে হাসি অসুখ। সবসময় হাসছেন। হাসির একটু কিছু পেলেই হল। সঙ্গে সঙ্গে হাসি। কখনও মুচকি, কখনও হালকা, কখনও হো-হো, কখনো অট্ট। রাজামশাই যেন গম্ভীর থাকতে ভুলেই গেছেন। রাজদরবারে হাসছেন, সভাসমিতিতে হাসছেন, ঘরে হাসছেন, জেগে হাসছেন, ঘুমিয়েও হাসছেন। রাতে রানিমা স্বপ্ন দেখছেন। রাজামশাই তার দিকে তাকিয়ে ‘হা-হা’ হাসি দিচ্ছেন। ঘুম ভেঙে তিনি ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করছেন, মুখে হাসি লেগে আছে কি? মন্ত্রীমশাই পড়েছেন বিপদে। কঠিন কোনও আলোচনা চলছে, রাজামশাই হয়তো ফিক করে হেসে ফেললেন।
‘কী হল রাজামশাই!’
‘মন্ত্রী, তোমার পাগড়িটা এমন ভাবে বসেছে যে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি মাথায় কলসি নিয়ে নদীতে জল আনতে চলেছ। হি-হি।’
হিসেবরক্ষকমশাই হয়তো এসে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘রাজামশাই, রাজকোষাগারের অবস্থা মোটে ভালো নয়।’
রাজামশাই ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কেন এই হাল?’
হিসেবরক্ষক বলেন, ‘খাজনা ভালো পাওয়া যায়নি। এই ভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে আমাদের অবস্থা একসময় খুব খারাপ হয়ে যাবে রাজামশাই।’
রাজামশাই একটু চুপ করে থেকে ‘হো হো’ আওয়াজে হেসে উঠলেন।
‘একবার ঘটনাটা ভেবে দেখো হিসেবরক্ষক। খাজনা আদায়ের অভাবে আমরা সব গরিব হয়ে গিয়েছি। রাজামশাই, মন্ত্রীমশাই, কোটালমশাই গান গেয়ে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। পরনে রাজপোশাক, হাতে ভিক্ষাপাত্র। হো হো হো…।’
এরপর আর কথা বাড়ানো যায়? সব থেকে খারাপ হল সেনাপতির বেলায়। সেদিন তিনি রাজামশাইকে রাজময়দানে নিয়ে গিয়েছিলেন সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখাতে। আসলে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, তার আন্ডারে সৈন্যরা কত ফিট।
ও বাবা! সেখানেও হাসির কেলেঙ্কারি। রাজামশাই গম্ভীর মুখেই রাজসৈন্যদের লম্ভঝম্প দেখছিলেন। হঠাৎ এক পদাতিক উটের ল্যাং খেয়ে পড়ল ছিটকে। কোনওরকমে উঠল ল্যাগবেগিয়ে। রাজামশাই হেসে কুটোপাটি।
দেখলে কোটাল? কাণ্ডটা একবার দেখলে? উটের ল্যাং খেয়ে নিজে কেমন উট হয়ে গেছে। হি-হি। তোমার এই সৈন্য যদি ব্যাঙের ল্যাং খেত? হি-হি। এদের নিয়ে তুমি যুদ্ধ করবে? হি-হি।’
রাজবৈদ্য এক সকালে রাজামশাইকে টনিক খাওয়াতে এলেন। অনেক খেটেখুটে নিজে হাতে টনিক বানিয়েছেন। টনিকের নাম ‘রাজকীয় চনমনাস্য টনিক:’। রাজামশাই মুচকি হেসে বললেন, ‘টনিক আগে তুমি খাও বদ্যি। আগে দেখি এই টনিকে তুমি কেমন চনমনে হও।’
রাজামশাইয়ের কথা তো অমান্য করা যায় না। রাজবদ্যি বাধ্য হয়ে খানিকটা ‘রাজকীয় চনমনাস্য টনিক:’ সেবন করলেন। তারপরেই কেমন ঝিমিয়ে পড়লেন। তাই দেখে রাজামশাই হাসি থামাতে পারেন না।
‘চনমনে টনিক খেয়ে এমন গুটিয়ে গেলে কেন? হা-হা।’
রাজপণ্ডিতের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। সেদিন রাজদরবারে সবার সামনে রাজামশাই তাকে একশো ঊনত্রিশের নামতা মুখস্থ ধরে ফিচফিচ করে হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘দেখি পণ্ডিত, তুমি কেমন নামতা পারো।’ রাজপণ্ডিত তো ঘেমেনেয়ে একসা।
এরপরেও সবাই চিন্তিত হবে না? এ কেমন রাজামশাই! তিনি হবেন গোমড়া, রাগী, থমথমে। ক্ষণে ক্ষণে হুংকার দেবেন। একটু এদিক ওদিক হলেই চাইবেন গর্দান। যে রাজার রাগ যত বেশি, তত তার রাজত্ব চলবে ভালো। বাইরের শত্রুরা ভয় পাবে। আর এখন যেমন হাসিখুশির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সে তো ভয়ংকর। ঘরের শত্রুরা জানলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। বাইরের শত্রুরাজ্যের কানে হাসির খবর পৌঁছোলে তারা কি আর দেরি করবে? মোটেও না। ‘রে রে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কী হবে তখন? রাজ্য রক্ষা করা যাবে?
গোপন মিটিং না করে উপায় আছে?
দরজার ভিতরে মিটিং চলছে। সবাই চাপা গলায় কথা বলছে। সেনাপতি চেপে ধরছেন রাজবদ্যিকে। তাকেই নাকি ওষুধ বের করতে হবে। এমন কোনও তেতো ওষুধ চাই যা একবার খেয়ে রাজামশাই গোটাদিন মুখ ভেটকে থাকবেন। রাজবদ্যি বললেন, ‘পাগল! আমার গর্দান যাবে।’
এদিকে যখন মিটিং চলছে, ওদিকে রাজপ্রাসাদে তখন রাজমশাইয়ের ঘুম গেল ভেঙে। তিনি পালঙ্কে আধশোয়া অবস্থায় একটা বই টেনে নিলেন। ঘণ্টাখানেক বই পড়ে তবে পালঙ্ক থেকে উঠবেন। একটু আগে পরিচালিকা এসে খবর দিয়েছে, রানি গেছে তার প্রিয় ঝগড়া সখীর বাড়ি। সুতরাং নিশ্চিন্তে বই পড়া যাবে।
রাজামশাইয়ের স্টকে অনেকরকম হাসির বই থাকে। সুকুমার রায়, ওঙ্কার গুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, তারাপদ রায়, হিমানীশ গোস্বামী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। তিনি এখন খুললেন উল্লাস মল্লিক নামে একজনের লেখা একটা বই। বইয়ের নাম ‘পেট ফাটা ১৮’।
ক’দিন আগে রাজামশাই খবর পেয়েছেন উল্লাস মল্লিক নামের এই ছোকরা নাকি হাসির গল্প বেশ লিখছে। সেই কারণেই বইটা আনানো। আজকাল তো আর ভালো হাসির গল্প পাওয়া যায় না। যেটুকু যা পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই ছেবলামি।
রাজামশাই মনে মনে ঠিক করেছেন, উল্লাস লোকটার লেখা যদি ভালো লাগে তাহলে তাকে একদিন নেমন্তন্ন করবেন। মোহর পাঠিয়ে রাজপ্রাসাদে ডাকবেন। ভুরিভোজ দেবেন। কোপ্তা কালিয়া মাছ মাংস পায়েস রাবড়ি দই। লেখক কবজি ডুবিয়ে খাবে। আচ্ছা, উল্লাস ছোকরা খেতে পারে তো? পেটরোগা নয় তো? খবর নিতে হবে।
এমন সময় রক্ষী এসে খবর দিল রাজামশাইয়ের বক্তিগত গুপ্তচর দেখা করতে চায়। জরুরি প্রয়োজন…।
রাজামশাই একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে কুন্তলার বাড়ির সামনে এসেছেন। গুপ্তচর খবর দিয়েছে, এখানে গোপন মিটিং চলছে। সেই মিটিং এ যারা আছে তাদের নাম শুনে তো রাজামশাইয়ের চক্ষু চড়ক গাছ। এমনকী রানিও।
কীসের মিটিং? তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত? রাজামশাই বাড়ির সদর দরজা ফাঁক করে ভিতরে ঢুকলেন। কুন্তলাকে ডাকবেন? না, থাক। মিটিং নিজের কানে শুনতে হবে। কম্বলে আর একটু ভালো করে নিজেকে ঢেকে রাজামশাই কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। কাদের যেন গলা শোনা যাচ্ছে না? ওই তো, ওই ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। নিশ্চয় সবাই ওইখানে। রাজামশাই উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় উঠলেন। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন দক্ষিণ দিকের ঘরে। বন্ধ দরজার ভিতর থেকে মানুষের গলার আওয়াজ আসছে।
কিন্তু এ গোপন শলাপরামর্শ কোথায়? এ তো হাসির আওয়াজ! ওই তো রানি খিলখিল করে হাসছে। ‘হো-হো’ হাসিটা কার? মন্ত্রীর না! তাই তো মন্ত্রীরই তো? খিকখিক করে কে হাসে? রাজপণ্ডিতের গলা মনে হচ্ছে। সে-ও আবার হাসে নাকি। আরে ফিচফিচ করে হাসছে কে? কোটাল? নাকি রাজবদ্যি? হিসেবরক্ষক নয় তো? এরা সবাই এত হাসতে পারে? কই জানা ছিল না তো। রাজদরবারে সবাই এমন মুখ করে বসে থাকে যে মনে হয়, মুখের ভিতর খানিকটা করে নিমপাতা দিয়ে বসে আছে। হাসলে গর্দান যাবে। আশ্চর্য! কিন্তু গোপন মিটিং করতে এসে সবাই হাসছে কেন?
রাজামশাই এগিয়ে দরজা খুললেন। খুলেই চমকে উঠলেন।
এত বড় বড় সব মানুষ সবাই গোল হয়ে বসে আছে মেঝেতে! মাদুরের ওপর। এমনকী রানি পর্যন্ত! মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুন্তলার আট বছরের বালক পুত্র। কী যেন করছে! ধেড়ে ধেড়ে মানুষগুলো তাকে দেখে হাসছে। আর যাই হোক, এখানে যে কোনও গোপন ষড়যন্ত্র হচ্ছে না সেটা নিশ্চিত। রাজামশাই দরজার ফাঁকে আরও একটু মুখ বাড়ালেন। হাসির চোটে কেউ তাকে খেয়াল করল না।
বালক কী করছে?
বালক রাজামশাইকে নকল করছে। সে সবাইকে দেখাচ্ছে রাজামশাই কেমন গোমড়া মুখে সিংহাসনে বসে থাকেন। কেমন হুম হুম করে এ-পাশ ও-পাশ তাকান। কেমন ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলেন। মুখটা কেমন রাগি রাগি করে রাখেন। আর কথায় কথায় হম্বিতম্বি করেন।
রাজামশাই আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। তিনি ঘরে ঢুকে বালককে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এখন আর আমি ওরকম নেই রে দুষ্টু ছেলে। আমি এখন বদলে গিয়েছি। বুঝেছি গোমড়া মুখে মজা নেই। আনন্দ নেই। এখন কীরকম হয়েছি জানিস? এইরকম—। দেখি তো আমায় কেমন নকল করতে পারিস।’
রাজামশাই হাত তুলে ‘হো-হো’ করে হেসে উঠলেন। কুন্তলার পুত্রও নিজের ছোট ছোট দুটো হাত তুলে হেসে উঠল ‘হো-হো’ করে।
সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল।